সোনার তরীর রূপকথারা

রবীন্দ্রনাথ প্রায় একশটির মত কবিতায় গল্প বলেছেন। এই একশটি কবিতাগল্পের মধ্যে রূপকথা আশ্রিত কবিতাগল্প পাই মাত্র চারটি। সেগুলি হল 'বিম্ববতী,' 'রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে', 'নিদ্রিতা', 'সুপ্তোত্থিতা'। এই চারটি কবিতাগল্পই রয়েছে 'সোনার তরী' (১৮৯৪) কাব্যে।


                   এই কবিতাগুলিতে গল্প বলতে চেয়েছেন কবি। আসলে 'সোনার তরী' পর্বেই  'হিতবাদী' পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প লেখার শুরু। তাই কবিতা লিখতে গিয়েও মাঝে মাঝে কবিতায় ধরা দিয়েছে গল্প। রূপকথাধর্মী গল্প দিয়েই কবি কবিতায় গল্প  লেখার কাজটি শুরু করেন। শিরোনামে কবি খুব সচেতনভাবে  ' বিম্ববতী' এবং  'রাজার ছেলে  ও রাজার মেয়ে'কে   রূপকথা বলে চিহ্নিত করেছেন।
                   রূপকথা নামে চিহ্নিত হলেও গড়নের দিক থেকে নব-রূপকথা বলাই যায়। ড. সুকুমার সেন এই কবিতাকে কবির 'কল্পিত রূপকথা, আত্মকথার প্রলেপমন্ডিত' মনে করেছেন। কবিতার  ছাঁচে গড়া গদ্যাশ্রয়ী  রূপকথা। কাহিনীর বিনির্মাণ ঘটেছে এখানে। এ কবিতার ভাষা সহজ-সরল, জটিলতা বর্জিত। কবিতায় তৎসম সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহার নেই, নেই কোন বাক্য জটিলতা। প্রতিটি বাক্যই সরল। ক্রিয়াপদগুলিও সাধু নয় চলিত, যা আমাদের মুখের ভাষার বেশ কাছাকাছি।শিশুদের যেমন করে আমরা সহজ সরল ভাষায়  রূপকথার গল্প বলি, কবি প্রায়  সেরকম সরলভাবে, একেবারে মুখের ভাষায় এক 'রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে'-র  গল্প বলেছেন।কবিতায় কাহিনী বর্ণনা করেছেন কবি। রচনার ভাষা সংলাপধর্মী নয়। কবিতায় চারটি স্তবক ১,২,৩,৪ সংখ্যায় চিহ্নিত। প্রতিটি স্তবকের আবার নিজস্ব শিরোনাম আছে। প্রথম স্তবক 'প্রভাতে', দ্বিতীয় স্তবক 'মধ্যাহ্নে' তৃতীয় স্তবক 'সায়াহ্নে'  আর চতুর্থ  'নিশীথে'  শিরোনামে চিহ্নিত। এ যেন মানবজীবনের  শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের  অধ্যায় বিভাগ। শৈশব, কৈশোর, যৌবনে  মানব মানবীর প্রেম কখনো কখনো মিলনে, বিরহে বা  কখনো স্বপ্নমিলনে যে পরিণতি পায়, কবি যেন সেই চিরন্তন প্রেমের রূপকথাই যেন আমাদের শোনাতে চেয়েছেন।
                 লক্ষ করার বিষয়, কবিতায় বর্ণিত দুটি চরিত্র রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে যেন অতীতচারিতা থেকে নেমে এসে সমকালের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কবিতার শুরুতে কবি চরিত্র দুটিকে অতীত কালে স্থাপন করে ইতিহাসগত দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছেন। যেন তিনি অনেক কাল আগের এক রূপকথার গল্প বলবেন। তাই শুরুতে ক্রিয়ার কাল অতীত ---


                       ''রাজার ছেলে যেত পাঠশালায়
                                 রাজার মেয়ে যেত তথা
                        দুজনে দেখা হত পথের মাঝে
                                কে জানে কবেকার কথা।"


কিন্তু আস্তে আস্তে প্রথম স্তবকের শেষ চারটি চরণে ক্রিয়ার কাল অতীত থেকে বর্তমানে গড়িয়ে এসেছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্তবকে আর একবারও অতীত কাল ফিরে আসেনি। কাহিনীকে অতীত থেকে তুলে এনে বর্তমান কালে স্থাপন করবার ফলে প্রাচীন রূপকথার প্রাচীনতম কাহিনীও  আমাদের পরিচিত বাস্তবের নর -নারীর প্রেমকাহিনী হয়ে উঠেছে।

               'পুনরুক্তি'(reoccurrence) ও 'বৈপরীত্য' (contrast) এ কবিতায় ভাবগত সংহতি ও ভাষিক সংলগ্নতা গড়ে তুলেছে।কবি এ কবিতায় 'রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে'কে নিয়ে  নব রূপকথার নির্মাণ করেছেন। কবিতার শিরোনাম তাই 'রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে'। কবিতায় এই বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার, গল্পে যা রূপকথার পরিবেশ বজায় রেখেছে।

                কবিতার কাহিনীও অতীত থেকে বর্তমানে এসেছে  পুনরুক্তির হাত ধরে। কবিতার প্রথম স্তবকের প্রথম দুই পংক্তি---- "রাজার  ছেলে যেত পাঠশালায় /রাজার মেয়ে যেত তথা" ,পরবর্তী ছয় পংক্তির পর আবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এর পুনরাবর্তনের মধ্যে দিয়ে অতীত কালের কথা তথা তাদের শৈশবের প্রেমের প্রসঙ্গটির যেন ইতি টেনেছেন কবি। এরপর গল্প বলতে গিয়ে বাক্যের ক্রিয়ায় বর্তমান কালের ব্যবহার করেছেন কবি।

                "পথের দুইপাশে ফুটেছে ফুল / পাখিরা গান গাহে গাছে।" ক্রিয়ার কাল এখানে বর্তমান কাল। ফলে গল্প সেকাল থেকে স্বচ্ছন্দে একালের হয়ে উঠেছে।একালে এসে সেকালের চরিত্রদুটি গল্পে আবার  পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে  পুনরুক্তির মাধ্যমে---"রাজার ছেলে আগে এগিয়ে যায় / রাজার ছেলে যায় পাছে।"

                 পংক্তি দুটি প্রায় পুনরুক্ত হলেও এদের ক্রিয়ায় রয়েছে বৈপরীত্য। সমগ্র কবিতা জুড়েই এই পুনরুক্তি এবং ক্রিয়াগত বৈপরীত্বের এক অপূর্ব নকশা বুনেছেন কবি যা প্রেমের মিলন ও বিরহের বিষয়টিকে দ্যোতিত করেছে বারে বারে। উপরের পংক্তি দুটিতে রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে একসাথে চলেনি। রাজার মেয়ে ও রাজার ছেলে  এগিয়ে গেছে, রাজার ছেলে পিছিয়ে পড়েছে। এগোনো ও পিছোনো ক্রিয়াগত এই  বৈপরীত্য দুজনের মধ্যে আসন্ন বিচ্ছেদ তথা  বিরহের  ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলেছে। ক্রিয়াপদের অবস্থানও ভাবের এই বৈপরীত্য সূচিত করে। এখানে 'এগিয়ে চলে'তে বাক্যিক ক্রম স্বাভাবিক, কিন্তু 'যায় পাছে'তে ক্রম  বিপ্রতীপ। এগোনো আর পিছোনোর বৈপরীত্য ধরা পড়েছে  বাক্যিক ক্রমের বিপ্রতীপকতার  মাধ্যমেও।

                   দ্বিতীয় স্তবকের সূচনাতেও রয়েছে বৈপরীত্য। "উপরে বসে পড়ে রাজার মেয়ে / রাজার ছেলে নীচে বসে। "দুজনের অবস্থানগত বৈপরীত্য এখানে খুব স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত। এই বৈপরীত্য  রাজার মেয়ের অবস্থান রাজার ছেলের সামাজিক অবস্থানের অনেক উঁচুতে একথারই যেন ইঙ্গিত দেয়। আবার যখন কবি বলেন ---- "রাজার মেয়ে শোয় সোনার খাটে, / রুপোর খাটে শুয়ে রাজার ছেলে'। (চতুর্থ স্তবক) তখন দেখি  'সোনার খাট' ও 'রুপোর খাট 'এই স্থান সূচক পদ দুটি বাক্যে একে অপরের  বিপরীতে বসেছে। এরা ভাবগত দিক দিয়েও একে অপরের বিপরীত। 'সোনার খাট' রাজার মেয়ের ঐশ্বর্যের প্রতীক, 'রুপোর খাট' যেন রাজার ছেলের কম ঐশ্বর্যের ইঙ্গিত। এভাবেই ভাষার বিপরীতমুখীনতা যেন প্রেমিক প্রেমিকার সামাজিক অবস্থানের বৈপরীত্য চিহ্নিত করেছে এখানে।

                 সামাজিক অবস্থানের এই ভিন্নতা সত্ত্বেও  রূপকথার  নায়ক-নায়িকার  মধ্যে অসম প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দুজনের  দৃষ্টি বিনিময়ের  প্রক্রিয়াটি  পাঠক আপন অন্তরে প্রত্যক্ষ করতে পারে লেখকের বর্ণনাগুণে।


                     "রাজার ছেলে চায় উপর পানে
                     রাজার মেয়ে চায় নীচে।"

এ যেন অধরাকে ধরার বাসনা----একজন চায় উপরের দিকে, আর অন্যজন চেয়ে থাকে নীচে। এই ক্রিয়াগত  বৈপরীত্য  উভয়ের  বিপরীতের প্রতি আকর্ষণের প্রতীক। এ যেন সেই মিলনের ইচ্ছা যা কাঙ্খিত কিন্তু অলব্ধ। এরপর----

                    "রাজার ছেলে ঘরে ফিরিয়া আসে
                    রাজার মেয়ে যায় ঘরে।"

রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে পদ দুটি পুনরাবৃত্ত হয় বারবার, কিন্তু সবসময় তাদের ক্রিয়ায় থাকে ভিন্নতা, তাই এখানেও একজন ঘরে ফেরে ও একজন ঘরে যায়। 'ফেরা 'আর ' যাওয়া'  এই ক্রিয়াপদ দুটি বিপরীত পথের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে যা দুজনের বিরহের ইঙ্গিত বহন করে আনে। দুজনেই দুজনার নিজের নিজের ঘরে ফিরে যায়। এরপর আর তাদের  বাস্তবে দেখা হয়না যদিও এর মধ্যেই তাদের হৃদয় বিনিময় ঘটে যায়।


                   "খুলিয়া গলা হতে মোতির মালা
                   রাজার মেয়ে খেলা করে
                   পথে সে মালাখানি গেল ভুলে,
                   রাজার মেয়ে সেটি নিল তুলে ,
                   আপন মণিহার মনোভুলে  
                   দিল সে বালিকার করে।"


     
পরস্পরের মালা বদল হয়। মালাবদল এখানে হৃদয় বিনিময়ের প্রতীক। একজন মালা ফেলে, একজন সেটি তুলে নেয়। এখানেও দুটি ক্রিয়া বিপরীত। আবার একজন ভুল করে নিজের মালা অপরের হাতে দেয় এখানেও বিপ্রতীপের ছোঁয়া। এখানে বৈপরীত্য মিলের কথা বলে দুজনের মিলনের রাগিনী শোনায়। অন্যদিকে এরপরেই আবার স্তবকের প্রথম পংক্তি দুটি সামান্য পরিবর্তিত ভাবে পুনরাবৃত্ত হয়ে দুজনের বিরহের কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়। পুনরাবৃত্তি এখানে মিলের বদলে অমিল তথা বিরহের গল্প শোনায়।

               এই বিরহের কথাকে পাঠকের মনে সুমুদ্রিত করার জন্য 'ফিরিয়া আসে'র বদলে 'ফিরিয়া এল' ক্রিয়াটি বসেছে।'আসে 'এই অসমাপিকা ক্রিয়ার বদলে 'এল' এই সমাপিকা ক্রিয়াটি এবং 'যায় 'এই অসমাপিকা ক্রিয়ার বদলে 'গেল' এই সমাপিকা ক্রিয়াটি পাঠকের মনে উভয়ের মিলনের সমাপ্তির কথাটিকে গেঁথে দেয়। এরপর  এক অপূর্ব চিত্রকল্পের আবির্ভাব, যার মধ্যে আছে  বিরহের দ্যোতনা।


                    "শ্রান্ত রবি ধীরে অস্ত যায়
                    নদীর তীরে এক শেষে
                    সাঙ্গ হয়ে গেল  দোঁহার পাঠ
                    যে যার গেল নিজ দেশে"

দুটি ঘটনার প্রত্যক্ষ কোন যোগ না থাকলেও আমরা বুঝতে পারি সায়াহ্নে শ্রান্ত রবি যেমন অস্ত যায় তেমনি রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নেয়। দুটি ঘটনায় যেন জড়িয়ে থাকে এক অব্যক্ত বেদনা। আমরা কবিতার ভাবে ও ভাষায় এক ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার দেখা পাই, যা 'সায়াহ্নে' স্তবকের এই শিরোনামকে সার্থক করে তোলে।
                 কবিতার চতুর্থ বা শেষ স্তবকে রয়েছে  নায়ক- নায়িকার স্বপ্নমিলনের কথা। নায়ক-নায়িকার মনোলোকের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি বলেছেন--


                      "করিছে আনাগোনা সুখ-দুখ,
                      কখনো দুরুদুরু করে বুক,
                      অধরে কভু কাঁপে হাসিটুক,
                      নয়ন কভু যায় ভাসি।"


এখানে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বৈপরীত্য প্রায় একই পংক্তিতে সহাবস্থান করছে। শেষ স্তবকটির শিরোনাম 'নিশীথে'। স্তবক জুড়ে রয়েছে বর্ষণ মুখরিত এক রাত্রির বর্ণনা। যে রাতে -----


                     "বাদর ঝরঝর গরজে মেঘ,
                     পবন করে মাতামাতি"


'র্' ধ্বনির  পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে কবি বর্ষণমুখর পরিবেশটি গড়ে তুলেছেন। এই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পরিবেশেও রাজার মেয়ে স্বপ্নে রাজপুত্রের মুখ দেখে। রাজার ছেলে স্বপ্নে রাজকন্যার হাসি দেখে মনে ভরিয়ে তোলে।


                    রাজার মেয়ে কার দেখিছে মুখ,
                    রাজার ছেলে কার হাসি।
                    শিথানে মাথা রাখি বিথান বেশ
                    স্বপনে কেটে যায় রাতি।


কবি বহিঃপ্রকৃতির ঝড় ঝঞ্ঝার উল্লেখ করে হয়তো তার রূপকে মিলনের পথে বাস্তব নানা বাধার ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। আবার তার বিপরীতে উভয়ের মনোলোকে উভয়ের প্রতি উল্লেখ ঘটিয়েছেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। ভাবগত এই বৈপরীত্যই প্রকাশ পেয়েছে ভাষিক বিপ্রতীপতার মধ্যে দিয়ে। এ কবিতায়  রাজপুত্র, রাজকন্যা ছাড়া রূপকথার রাজা, রানী, মন্ত্রী, শান্ত্রী, হাতিশাল ঘোড়াশালের কোন উল্লেখ নেই। রূপকথা গড়ে তুলেছে রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে এই বাক্যাংশ দুটির পুনরাবর্তন। তাদের মধ্যে যেন আমরা নিজেদের ছবিই দেখতে পাই। এ কবিতার  গল্পে  স্পর্শ  করি আমাদের প্রেমজীবনের রূপকথাকে। প্রেমে মিলন ও বিরহের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কটিকে ভাষার পুনরাবৃত্তি ও বিপ্রতীপতা এক আশ্চর্য আলো আঁধারি নকশায় বুনে আমাদের উপহার দেয়। যে নকশায় আমরা নিজেদের জীবনকে দেখতে পাই, মিল খুঁজে পেয়ে আপ্লুত হই।