কবিতার পাঠ : রবীন্দ্রনাথের বাঁশি

পুনশ্চের কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ ছন্দকে পয়ারের বাঁধাধরা নিয়ম থেকে মুক্তি দিয়ে বিস্তৃতি দিতে চেয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন অনন্য এক গদ্যছন্দের। দ্বিতীয়ত, গদ্যছন্দে লেখা কাব্যে তিনি বাংলার চলিত ভাষাকে জায়গা দিয়েছেন খোলামেলা মনে। ফলে রচনাভঙ্গিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

'পুনশ্চ' রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের কাব্য। এই কাব্য রচনাকালে সদ্য সত্তর পেরিয়েছেন কবি। তাঁর শেষ জীবনের কাব্যে অন্তত দুটি বিশেষত্ব  চোখে পড়বেই। এক, রচনাভঙ্গি আর অন্যটি বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব।

                   এই পর্যায়ে  তিনি ছন্দকে পয়ারের বাঁধাধরা নিয়ম থেকে মুক্তি দিয়ে বিস্তৃতি  দিতে চেয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন অনন্য এক গদ্যছন্দের। দ্বিতীয়ত, গদ্যছন্দে লেখা কাব্যে তিনি বাংলার চলিত ভাষাকে জায়গা দিয়েছেন খোলামেলা মনে। ফলে রচনাভঙ্গিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। 'পুনশ্চ,' 'শেষসপ্তক', 'পত্রপুট', ও 'শ্যামলী' প্রধানত এই চারটি কাব্যে কবি ধারাবাহিকভাবে গদ্যছন্দের  পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

                  গদ্যকবিতা কাব্যের বিষয়বস্তুর ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেয়। চলিত ভাষারীতি সেই বিষয়বস্তুকে একেবারে গদ্যের মত করে কবিতায় উপস্থাপিত করেছে। ফলে তথাকথিত কাব্যিক বিষয়বস্তু ছাড়াও একেবারে সাধারণ এমনকি অতি তুচ্ছ বিষয়গুলিও খুব সহজেই এই নতুন আঙ্গিকের লেখা হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

'ছেলেটা', 'বাঁশি', 'সাধারণ মেয়ে' তারই সার্থক উদাহরণ।

                  'পুনশ্চ' কাব্যের 'বাঁশি' (২৫ আষাঢ় ১৩৩৯) কবিতায় এক তুচ্ছ কেরানির জীবনের গল্প বলেছেন কবি। এই গল্প বলা হয়েছে বিশুদ্ধ চলিত ভাষায়। বাক্যের ক্রিয়াপদগুলো সবই চলিত। তৎসম ও সমাসবদ্ধ শব্দ, উপমা, অনুপ্রাস সম্পূর্ণ বর্জন করে প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত আটপৌরে শব্দগুলোকে নিতান্ত ঘরোয়া ভঙ্গিতে বসিয়েছেন তাঁর লেখায়। যেমন---

                      "বেতন পঁচিশ টাকা

                      সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি

                      খেতে পাই  দত্তদের  বাড়ি।

                      ছেলেকে পড়িয়ে।

                      শেয়ালদা ইস্টিশন যাই,

                      সন্ধেটা কাটিয়ে আসি,

                      আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।"

গোটা কবিতাতেই নেওয়া হয়েছে এই চলিতরীতি। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আটপৌরে ভাষায় বাস্তবের নিখুঁত বর্ণনা ফুটে উঠেছে কবিতার প্রথম ৫৭টি চরণ জুড়ে। বাস্তবতার ছবি এখানে খুব স্পষ্ট।

                      "জমে ওঠে, পচে ওঠে

                      আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি

                      মাছের কানকো,

                      মরা বেড়ালের ছানা,

                      ছাই পাঁশ আরো কত কী যে।"

রবীন্দ্র কবিতায় এমন বর্ণনা ব্যতিক্রমী এক দৃষ্টান্ত।

               'কিনু গোয়ালার গলি', 'শিয়ালদা প্ল্যাটফর্ম', এবং কেরানির রোজনামচার বর্ণনা জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে দৃঢ় রেখায় এঁকেছে। কবিতায় ব্যবহৃত দু-একটি উপমাও বেশ গদ্যধর্মী ও  অভিনব।

হরিপদ তাঁর ছাতাটির বেহাল দশা বোঝাতে বলেছেন--

                 "ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা দেওয়া

                  মাইনের মতো,

                  বহু ছিদ্র তার।"

আবার কেরানির ঘরে বাদলের কালোছায়ার অবস্থাটাও শোচনীয়---

                "বাদলের  কালোছায়া

                 স্যাঁৎসেঁতে  ঘরটাতে ঢুকে

                 কলে পড়া জন্তুর মতন

                 মূর্চ্ছায়  অসাড়।"

প্রথম উদাহরণে 'জরিমানা দেওয়া মাইনে' উপমান এবং 'শতছিদ্র ছাতা' উপমেয়,  দ্বিতীয় উদাহরণে কলে পড়া জন্তুর মত উপমাটি নিতান্ত কেজো গদ্যময় জগত থেকে সংগ্রহ করেছেন কবি। সমগ্র কবিতায় গল্পের বিষয়বস্তুকে  যথাযথভাবে  বোঝানোর জন্য অসমদৈর্ঘ্যের  পংক্তির ব্যবহার করেছেন কবি। কোন কোন পংক্তি একটিমাত্র শব্দ দিয়ে গঠন করেছেন, আবার দীর্ঘ পংক্তিও ব্যবহার করেছেন প্রয়োজন অনুসারে -

               "তীরে তমালের ঘন ছায়া

                            আঙিনাতে

               যে আছে অপেক্ষা করে, তার

        পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর ।।"

এই অসমদৈর্ঘ্যের পংক্তিবিন্যাস কবিতায় গল্পকথনে বিশেষ সাহায্য করেছে।

                     কবিতায়  নায়কের চরিত্রটি যেমন তেমনি তার স্বপ্নচারিণী নায়িকা,  কর্ণেট-বাজিয়ে কান্তবাবু, এমনকি অস্পষ্ট অবয়ব  পিসির চরিত্রটিও  কলমের কয়েকটি মাত্র আঁচড়ে, একটি অথবা দুটি বাক্যে  কখনো কয়েকটি  মাত্র পদ বা পদবন্ধে  অপূর্ব বাক সংযমের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি  যা তাঁকে সামাজিক গল্পগঠনে খুবই সাহায্য করেছে।

                     তবে 'বাঁশি' কবিতায় কেরানির জীবনের কাহিনী শুধুমাত্র হরিপদ কেরানির জীবনের  গল্প হয়ে থাকেনি। হরিপদ কেরানির জীবনের গল্পকে কবিতার শেষ ৩২ পংক্তি নিয়ে গেছে বস্তুভার  ভেদ  করে  অন্যলোকে। যেখানে কান্তবাবুর কর্নেটের সুরে ভেসে ওঠে '...অনাদিকালের বিরহ বেদনা।' এখানে কেরানির দিনযাপনের গল্প হয়েও কবিতাটি ব্যক্তি-আত্মার  যন্ত্রণার কাহিনীতে পরিণত হয়েছে।কেরানির জীবনে কিনু গোয়ালার গলির ঘরটি যতটা সত্যি তার ব্যক্তিসত্তার অনন্যতাও ততটাই সত্যি। একথাই বলেছে কবিতার শেষ ৩২পংক্তির কাব্যভাষা। রচনার এই অংশে বিরহবেদনা, রাজছত্র, গোধূলিলগ্নে  ইত্যাদি বেশ কিছু কাব্যিক শব্দ এবং শেষাংশে 'বহি চলে ধলেশ্বরী' পংক্তিতে 'বহি চলে', এই সাধু ক্রিয়াটি ব্যক্তির স্বপ্নকল্পনাকে সুদূরপ্রসারী করে তুলেছে। এই স্বপ্নকেই গাঢ়তা দিয়েছে 'তীরে তমালের ঘনছায়া 'বাক্যটি। এখানেও ধ্বনির হালকা অনুপ্রাস কোমল করেছে বাক্যকে। এরপর  কেরানির যন্ত্রণাময় চেতন লোকের ওপর পর্দা টেনে দিয়ে একটি স্বপ্নময় ছবি এঁকেছেন। সেখানে

                 "যে আছে অপেক্ষা করে তার

                 পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।"

তৃতীয় স্তবকের এই পংক্তিটিই কবিতার শেষতম পংক্তি। যা পুনরাবৃত্ত হয়ে মানবাত্মার স্বপ্নকল্পনার জয়ধ্বজা উড়িয়েছে। বাস্তবের পদ্মপাতায় একবিন্দু জলের মত টলমলে স্বপ্ন ক্ষণিকের জন্য হলেও সামান্য কেরানিকে আকবর বাদশার সমান করে তুলেছে। গল্প ও কবিতার সমানুপাতিক মিশ্রণে রচনাটি এখানেই সার্থক এক কবিতাগল্পে পরিণত হয়েছে।