আমি তোমার জীবনতরী বাই : রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তা

'যাঁরা আমার কাব্য মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন ...মৃত্যুর  নিবিড় উপলব্ধি আমার কাব্যের এমন একটি  বিশেষ ধারা নানা বাণীতে, যার  প্রকাশ।" 'কড়ি ও কোমল' এ 'কবির  মন্তব্য' অংশে স্বয়ং  রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুভাবনা  বিষয়ে একথা বলেছেন। তাঁর মতে  'কড়ি ও কোমল' এর  যুগেই তাঁর  মনে প্রথম  মৃত্যুর উপলব্ধি জাগে। এ সময়েই  কবির জীবনে কাদম্বরী  দেবীর মৃত্যুর আকস্মিক আঘাত এসে পড়ে। এর আগে  তাঁর শিশুকালে মা  সারদা দেবীর মৃত্যু তাঁকে সেভাবে বিচলিত করেনি "প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু  মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে  তাহার কোন প্রমাণ ছিল না; সেদিন প্রভাতের আলোকে  মৃত্যুর যে-রূপ  দেখিলাম তাহা সুখ সুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ  স্পষ্ট  করিয়া চোখে পড়িল না। "কিন্তু চব্বিশ বছর বয়সে মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর যে পরিচয় হল তা স্থায়ীভাবে কবির মনে মুদ্রিত হয়ে গেল। এরপর কবির দীর্ঘজীবনে  নানা অধ্যায়ে নানা প্রিয়বিয়োগের মধ্যে দিয়ে যে মৃত্যুচেতনা জেগেছে নানাভাবে কবির লেখায়  তার প্রকাশ ঘটেছে। কোথাও বা  মৃত্যু সম্পর্কে খণ্ড উপলব্ধি তাঁকে ব্যাকুল করেছে,কখনও জীবন মৃত্যুর অখণ্ড উপলব্ধির প্রত্যয়িত বাণী গভীর বিশ্বাসের রূপ নিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে।
                     কবির মৃত্যু জিজ্ঞাসা তাঁর গভীর জীবন জীবনপ্রীতিরই  পরিচায়ক। জীবনকে গভীরভাবে  ভালবেসেছিলেন বলেই মৃত্যুর স্বরূপ উদ্ঘাটনে বরাবরই  আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি দিয়ে আপন মনন ও দার্শনিক জীবন জিজ্ঞাসা দিয়ে, ঔপনিষদিক জীবনবোধ দিয়ে নানাভাবে নিজের ও অন্যের কাছে কাছে মৃত্যুর স্বরূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন কবি।
                     রবীন্দ্রনাথ একটিমাত্র উপলব্ধি বা  বিশ্বাসকে সম্বল করেই পথ চলেন নি। তাই ব্যক্তিগত জীবনের শোকের অভিজ্ঞতা থেকে সবসময় একই  অনুভূতির প্রকাশ ঘটেনি তাঁর। চব্বিশ বছর বয়সে  কাদম্বরী দেবীর  মৃত্যুতে যিনি জীবনে কেন্দ্রচ্যুত তিনিই তাঁর একচল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী বিয়োগে অচঞ্চল, তা শোকের পার্থক্য নয়, মৃত্যুর উপলব্ধির পার্থক্যই এর কারণ।জীবনের দুই অধ্যায়ে মৃত্যুর রূপ কবির কাছে এক হয়ে নেই।
                     রবীন্দ্রনাথ  যখন খণ্ড বা বিচ্ছিন্ন দৃষ্টিতে মৃত্যুকে  দেখেছেন  তখন মৃত্যু জীবনের অনিবার্য  নিষ্ঠুর শূন্যময় পরিণাম হিসেবে তাঁর কাছে দেখা দিয়েছে। মৃত্যুতে জীবনের চরম অবসান ঘটে বলে মনে হয়েছে। জগৎ ও জীবন তাঁর কাছে অন্ধকার ও বিষাদময় হয়ে উঠেছে। এজন্য কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুশোকে তিনি বিহ্বল হয়েছেন। 'চিত্রা'র 'মৃত্যুর পরে'  কবিতাটির প্রতিটি স্তবকে  হাহাকার যেন দমকে দমকে নিঃসারিত হয়ে উঠেছে।  তিনি যেন কিছুতেই  মেনে নিতে পারছেন না  জীবনের  এই ভয়ঙ্কর পরিণতিকে। তাই রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন----


কেন এই আনাগোনা,
কেন মিছে  দেখাশোনা
দু দিনের তরে,
কেন বুকভরা আশা,
কেন এত ভালোবাসা
অন্তরে অন্তরে,
আয়ু যার এতটুক
এত দুঃখ এত সুখ
কেন তার মাঝে
অকস্মাৎ এ সংসারে
কে বাঁধিয়া দিল তারে
শত লক্ষ কাজে ---


তিনি কেবলি  উন্মাদের মত খুঁজে বেড়িয়েছেন  যে চলে গিয়েছে তাকে। না খুঁজে পেয়ে দিশেহারা কবি বলেছেন:


বৃথা তারে প্রশ্ন করি,
বৃথা তার পায়ে ধরি
বৃথা মরি কেঁদে  
খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে
কোন অঞ্চলের তলে
নিয়েছে সে বেঁধে।
ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে   
ফিরে  নিতে চাহি মিছে
সে কি আমাদের ?
পলেক বিচ্ছেদে হায়
তখনি তো বুঝা যায়
সে যে অনন্তের।

লক্ষ্য করার  বিষয় এখানেও অনন্তের পটভূমিতে মৃত্যুকে স্থাপন  করতে চাইছেন কবি, কিন্তু পারছেন না। উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগ তাঁকে আবার অজস্র অশ্রুজলে  ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে 'জীবনস্মৃতি'তে  মৃত্যুশোক অধ্যায়ে উল্লিখিত শোকের  অভিঘাতের কথা মনে আসে, "সেই সময়ে আবার  কিছুকালের জন্য আমার একটা সৃষ্টিছাড়া রকমের মনের ভাব ও বাহিরের আচরণ দেখা দিয়াছিল। ....আহারের ব্যবস্থাও অনেক অংশে খাপছাড়া ছিল কিছুকাল ধরিয়া, আমার শয়ন ছিল বৃষ্টিবাদল শীতেও তেতালার বাহিরের বারান্দায় ...বাড়ির ছাদে একলা গভীর অন্ধকারে মৃত্যুরাজ্যের কোন একটা চূড়ার উপরকার, একটা ধ্বজপতাকা, তাহার কালো পাথরের তোরণদ্বারের উপরে আঁকপাড়া  কোন একটা অক্ষর  কিম্বা  একটা চিহ্ন দেখিবার জন্য আমি যেন সমস্ত রাত্রিটার উপর অন্ধের মত দুই হাত বুলাইয়া ফিরিতাম।"
                    আশ্চর্যের  বিষয়  জীবনের প্রথম শোক যখন তাঁকে গ্রস্ত  করেছিল তখনই সেই মৃত্যুর মাঝেই কোথায় যেন  তিনি অস্পষ্ট স্বরে  শুনতে পেয়েছিলেন অনন্তের বাণী:  "এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে  একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, তাহাতে আমি নিজেই আশ্চর্য হইতাম জীবন যে একেবারে অবিচলিত নিশ্চিত নহে এই দুঃখের সংবাদেই মনের ভার লঘু হইয়া গেল। ...সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবন হরণপূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে সে ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না। একেশ্বর  জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না, এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম। "বহুকাল পরে,বছরের কবির পঞ্চাশ বছর বয়সে এই পঁচিশ বছরের শোক তাঁর কাছে ফিরে  এসেছে শান্তিরূপে। শ্রাবণের মেঘের মত কালো শোক আশ্বিনের সোনার প্রতিমা হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর নয়নে। 'লিপিকা'র 'প্রথম শোক' তাঁকে বলেছে "যা ছিল শোক,আজ তাই হয়েছে শান্তি"।কিন্তু শোককে শান্ত মনে অখণ্ডের পটভূমিকায় গ্রহণ করতে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে জীবনের দীর্ঘ পথ।সইতে হয়েছে বহু মৃত্যুর কঠিন থেকে কঠিনতর আঘাত।
                      জীবনের একটা সময় তাঁর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে শোকের ঝড়।  ১৯০১ সালে তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রদ্বয় বলেন্দ্রনাথ ও নীতিন্দ্রনাথের মৃত্যু, ১৯০২ সালে পত্নী মৃণালিনী দেবীর প্রয়াণ, ১৯০৩ এ কন্যা রেণুকা,  ১৯০৪ এ আশ্রমবন্ধু সতীশচন্দ্র রায়ের মৃত্যু, ১৯০৫ এ পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের লোকান্তর কবির জীবনে  বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করে।
                      বারবার  মৃত্যুর আঘাতে কবির অন্তর্জীবন  বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কবি ক্রমে ক্রমে অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন। বহির্জীবনে  শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয়ের আর্থিক সংকট, কার্জনী শাসনে বঙ্গভঙ্গের  রাজনৈতিক উত্তাপ তাঁকে ক্রমাগত পোড়াতে থাকে। বহির্জীবনে এই ঘাত সংঘাত তাঁকে আরো অন্তর্মুখী করে তোলে।নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার সাধনা কবিকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে 'খেয়া'থেকে 'গীতাঞ্জলি'  পর্বের কাব্যে  একান্ত আপন কথা বলতে শুরু করেন কবি। একথা অপরকে বোঝাবার জন্য নয়, এ কেবল অন্তরে অনুভব করা। কবির এ সময়কার মনের অবস্থা 'খেয়া'কাব্যের 'শেষ খেয়া' কবিতার মধ্যে সার্থকভাবে  ফুটে উঠেছে ।কবিতাটি কবির অরূপ জগতে প্রবেশের সংকেত নির্দেশ করেছে। তবে মনের এই মানসিক প্রস্তুতি 'নৈবেদ্য'র (১৯০১) যুগেই এসে গিয়েছিল।
                       'নৈবেদ্য' কবির চল্লিশ বছর বয়সের রচনা। আয়ুর মধ্যসীমায় পা দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কবির জীবন ও কাব্যে এসেছে এক লক্ষণীয় পরিবর্তন। কবির জীবনবোধ বদলেছে। রূপ নয় অরূপের প্রতি কবির তীব্র আকর্ষণ দেখা দিয়েছে এই সময় থেকেই এবং তা উত্তরোত্তর বেড়ে গেছে। এই সময়কার কবিতার মর্মকথাই হল 'সীমার মাঝে অসীমের সুর' ধ্বনিত করে তোলা --বিশ্বদেবতার সঙ্গে  জীবনদেবতার ব্যক্তিক সম্বন্ধ স্থাপন করা।
'নৈবেদ্য'র কবিতায় মৃত্যু বিষয়ক যে ধারণার প্রকাশ হয়েছে তা ভারতীয় দর্শনেরই অনুরূপ, তাই তিনি বলেন---


"ওরে মূঢ়, জীবনসংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জন্ম-মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার পূর্বে? মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার  মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মতো।জীবন আমার
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে এমন ভালো বাসিব নিশ্চয়।
স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।"

কবিতার শেষ দুটি পংক্তি আমাদের আশ্বস্ত করে  বলেছে জীবন ও মৃত্যু বিশ্বদেবতার দুই অমৃতভাণ্ড, জীবনের রস পান করতে করতে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করতে হয়।জীবন-মৃত্যু  পরস্পর বিরোধী ঘটনা নয়, একই সত্যের  এপিঠ ও পিঠ। মৃত্যু মানেই সমাপ্তি নয়। মৃত্যুতে  দৈহিক বিনাশ হলেও আত্মিক বিনাশ ঘটে না। শৈশব থেকে  উপনিষদের রসে সিঞ্চিত কবিমন ঔপনিষদিক মৃত্যুচিন্তায় আস্থাশীল হয়ে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে মৃত্যু  দৃশ্যত থাকলেও কার্যত নেই। কবি ক্রমশ নিজের মানসিক শক্তির বলে মৃত্যুর দুঃখ বেদনাকে  ধীরে ধীরে অতিক্রম করে উত্তীর্ণ  হয়েছেন এক পরিপূর্ণ  সত্যবোধের মধ্যে। সে সত্যবোধ তাঁর জীবনের মধ্যে একটা স্থায়ী সামঞ্জস্যের  রূপ আবিষ্কারের শক্তি  দিয়েছে।একটা অধ্যাত্মবোধের মধ্যে সমস্ত খণ্ড অনুভূতির বেদনাকে মিলিয়ে দিয়ে কবিকে সেই  উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে গিয়েছে যেখান থেকে তিনি বলতে পেরেছেন।


"তোমার  অসীমে প্রাণমন লয়ে
যতদূরে আমি যাই
কোথাও দুঃখ কোথাও  মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই।

মৃত্যু যে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ যে হয় দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে স্বতন্ত্র হয়ে
আপনার পানে চাই ।

হে পূর্ণ , তব চরণের কাছে
যাহা কিছু সব আছে আছে আছে --
নাই নাই নাই ভয়; যে শুধু আমারি
নিশিদিন কাঁদি তাই।

অন্তরগ্লানি সংসারভার  
পলক ফেলিতে কোথা একাকার
তোমার স্বরূপ জীবনের মাঝে
রাখিবারে  যদি পাই।"

ঈশ্বরের পায়ে আত্মসমর্পণের  এই মানসিক প্রস্তুতি 'নৈবেদ্য'র  যুগে এসে  গিয়েছিল বলেই  পত্নীবিয়োগে তিনি ভেঙে পড়েন নি। ১৯০১  সালে ৭ই অগ্রহায়ণ  রবীন্দ্রনাথের একচল্লিশ বছর  বয়সে চলে যান  মৃণালিনী। শোকস্তব্ধ  রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সংহত করেন করেন  নিজেরই মধ্যে । মৃত্যুকে  জীবনের  একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নিয়ে সেই শোককে  অনায়াসে অনন্তের পটভূমিকায় রেখে তাকে দার্শনিকতা মন্ডিত করে  তুলেছেন।পত্নীর স্মৃতিতে লেখা  'স্মরণ' কবিতায়  তাই তিনি কল্পনা  করেছেন তাঁর পত্নী যেন তাঁর মধ্যে  দিয়ে  আজও প্রকৃতির  রূপ মুগ্ধ চোখে দেখে চলেছেন। তিনি আজও কবির মধ্যে বেঁচে আছেন। এই বিশেষ অনুভূতি তাঁকে শোক বর্জনে  সাহায্য করেছে। তিনি নিজেকে এই পৃথিবীতে  প্রয়াত পত্নীর  'প্রতিনিধি' মনে করেছেন ।


"মৃত্যুমাঝে  আপনাকে করিয়া হরণ
আমার জীবনে তুমি ধরেছ জীবন
আমার নয়নে তুমি পেতেছ আলোক
এই কথা মনে জানি , নাই কোন শোক।"
                       ('স্মরণ'  ১৭ সংখ্যক কবিতা)

পত্নীবিয়োগের দুঃসহ বেদনাকে বুকে নিয়ে  যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত মধ্যম কন্যা  রেণুকার শুশ্রূষার জন্য কবি তাকে  নিয়ে যান আলমোড়া। সেখানে  তার রোগশয্যার পাশে বসে  'শিশু'র  কবিতাগুলি লেখা হয়। কবি বলেন, "আলমোড়াতে যখন তাকে (মেজ মেয়ে রেণুকা) চেঞ্জে নিয়ে যাই , তখন তার অসুখ খুব বেশি। তাকে খুশি রাখবার জন্যে রোজ  রোজ কবিতা লিখে বিছানার পাশে বসে শোনাতুম, যাতে কিছুক্ষণও  অন্তত  রোগের যন্ত্রণা ভুলে থাকে। এমনি করেই আমার 'শিশু' বইখানা লেখা হয়েছে। ও কবিতাগুলো রাণীর অসুখের সময় লিখেছিলুম।"
             ১৯০৩ সালে কবিকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে গেলেন রানী। রানীর চলে যাওয়ার দিন রামেন্দ্রসুন্দর এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে সে খবর না  জেনেই। দীর্ঘ আলাপের পর  রামেন্দ্রসুন্দর  রানীর কথা জানতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, "আজ সকালে সে মারা গিয়াছে।"

             পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ চলে গেলেন ১৯০৫ সালে। ১৯০৭ সাল পুজোর ছুটিতে কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ  মুঙ্গেরে বন্ধুর বাড়ি গেলেন ছুটি কাটাতে। সেখানে কলেরায় আক্রান্ত হলেন।কবি টেলিগ্রাম পেয়েই  সেখানে পৌঁছলেন, কিন্তু শমীন্দ্রকে রক্ষা করা গেল না। মাত্র তেরো বছর বয়সে চলে গেলেন প্রাণপ্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বুক পেতে নিলেন সেই শোক। সহ্য করলেন।
"শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, পড়ে নি,  সমস্তের মধ্যেই সবই রয়ে গেছে। আমিও তার মধ্যে। সমস্তের জন্য আমার কাজও বাকি রইল।" শমীর  মৃত্যুতে  কবির মনে  নিদারুণ আঘাত লাগলেও তার কোন প্রকাশ দেখা গেল না। দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথ মারা গেলে মেয়ে মীরাকে তিনি একটি চিঠিতে লেখেন ---"যে রাত্রে শমী গিয়েছিল  সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে না টানে।"
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রবীন্দ্রনাথ 'গীতাঞ্জলি'তে বিশ্বদেবতাকে আশ্বস্ত করে বললেন----


"আরো আঘাত সইবে আমারো
আরো কঠিন সুরে জীবন তারে  ঝংকারো ।।
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে,বাজেনি তা চরম তানে
নিঠুর মূর্ছনায় যে গানে মূর্তি সঞ্চারো।
লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ  কোর না
জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো।।"

কবির প্রিয় কন্যা মীরার দাম্পত্য ছিল অ-সুখের। মীরা ও নগেন্দ্রনাথের বিবাহ সুখের হয়নি। সেই ব্যথা প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে কবিকে ভেতরে ভেতরে। তিনি নিজে এই বিবাহ স্থির করায় সারাজীবন মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা পেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন মেয়ের অপঘাতে মৃত্যুও।
রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন ,"বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফণা ধরে উঠেছিল ----আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনই ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।"
               কবির প্রথমা কন্যা মাধুরীলতা, তাঁর আদরের বেলিও কবির কাছে বেশিদিন থাকলেন না। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে কবিকে ছেড়ে চলে যান ১৯১৮ সালের ১৬ই মে।
এভাবেই আরো আরো আঘাত সহ্য করলেন কবি।
বরণ করে নিলেন বিশ্বদেবতার শোকের দুঃখের বীণাটিকে আপন অন্তরে। সেই বীণায় তুললেন তিনি নব জীবনের তান। সেই সুর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের অন্তরে ছড়িয়ে পড়লো। আমরা সে পরমানন্দের বাণীতে পেলাম শোক, যন্ত্রণা, অবসাদ থেকে উত্তরণের শক্তি। দুঃখ তাঁর অন্তরে চুপি চুপি আপনার চিরস্থায়ী আসনটি পাতলো, থাকলো পরমেশ্বরের চরণচিহ্ন রূপে একান্তে।
কবি জীবনবিমুখ হলেন না। কর্মবিমুখ হলেন না। জগতের আনন্দময় কর্মযজ্ঞে সঁপে দিলেন নিজেকে।
                জন্মমৃত্যুর রহস্যের কথা বোঝাতে গিয়ে শেষ বয়সে একদিন তিনি রানী চন্দকে কথায় কথায় বলেন "জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও ততটাই সত্য। মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোন মূল্যই থাকে না। যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোন মানে নেই। তাই শোকটাকে অত বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়। অনেক সময় আমরা চেষ্টা করে আর খুব ঘটা করে শোককে জাগিয়ে রাখি, তা না হলে যেন যাকে হারিয়েছি তার কর্তব্যের ত্রুটি হলবলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু আমার মতে সেইটাই অপরাধ, কারণ এটা মিথ্যে। জীবনের 'হ্যাঁ 'এর দিক হল বেঁচে থাকার আনন্দ আর 'না' এর দিক হল মৃত্যু। তাই মৃত্যুর চেয়ে জীবনের দাবি নিশ্চয়ই বেশি।" এ কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই তাঁর 'মৃত্যুঞ্জয়' কবিতায়।


"দূর হতে ভেবেছিনু মনে
দুর্জয় নির্দয় তুমি, কাঁপে পৃথ্বী তোমার শাসনে।
   ....       .....       ....
তোমার  আঘাত সাথে নেমে এলে তুমি
যেথা মোর আপনার ভূমি
ছোট হয়ে গেছ আজ।
আমার টুটিল সব লাজ
যত বড়ো হও,
তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।
আমি মৃত্যু চেয়ে এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে।"

এই বিশ্বাসে স্থিত হতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর গীতবিতান ভরে উঠেছিল জীবন আনন্দের গানে।তিনি মৃত্যুর কাছে জীবনের পরাজয় স্বীকার করতেন না। আর সেই অস্বীকারের প্রকাশ কেবল তাঁর কবিতায়,গানে,গল্পে নয় তাঁর জীবনচর্যার প্রতি দিনের আলাপচারিতায়। জীবনের শেষ মুহূর্তে যখন  তিনি তীব্র রোগাক্রান্ত এক মুহূর্তের জন্যও হার মানেন নি অসুখের কাছে, ক্লান্তির কাছে, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে করেছেন সুচিন্তিত মন্তব্য। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর কলম সচল থেকেছে। চরম অসুস্থতার মধ্যেও খবর নিয়েছেন তাঁর পোষ্যদের ঠিকমত খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা। দারোয়ানের বাড়ির অসুস্থ মানুষটি ভালো আছে কিনা এমন সব অতি সাধারণ বিষয়েও।
                 মৃত্যুর সঙ্গে কেবল পরোক্ষ নয় প্রত্যক্ষ পরিচয়ও ঘটেছিল তাঁর। ১৯৩৭ সালের  সেপ্টেম্বর মাসে কবি হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। সৌভাগ্যবশত  অল্পসময়ের  মধ্যেই তাঁর সংজ্ঞা ফিরে আসে। কিন্তু "এই অকস্মাৎ হত চৈতন্যলোক হইতে প্রত্যাবর্তনকে  কবি  নবজীবন লাভের সহিত তুলনা করিয়াছেন; মনে হইতেছে অধ্যাত্মলোকের নবতম রহস্য উদ্ঘাটিত হইতেছে।" মৃত্যুর প্রায় সাক্ষাৎ দর্শনের অভিজ্ঞতা সত্যের জ্যোতির স্পর্শে ও এক অশরীরী অনুভূতির রসে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই জন্য তাঁর প্রান্তিকের মৃত্যুভাবনা তাঁর আগের মৃত্যু বিষয়ক চিন্তা থেকে একেবারেই আলাদা।কবির দৃষ্টি এখানে স্পষ্টতই ঔপনিষদিক আত্মোপলব্ধির গভীরে নিমগ্ন। জীবন রঙ্গমঞ্চে এতদিন যে সাজে তিনি নিজের পরিচয় রচনা করেছেন, মৃত্যুদূতের স্পর্শে আজ তা তাঁর কাছে নিরর্থক মনে হয়েছে। বাইরের বর্ণ প্রসাধন মুছে গেছে, নিজের নিগূঢ় পূর্ণতা উপলব্ধির জন্য কবির আত্মা উন্মুখ হয়েছে।

"দেখিলাম অবসন্ন গোধূলি বেলায়
দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি..
অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আমি
একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড় হাতে--
হে নূতন সংবরণ করিয়াছে তব রশ্মিজাল,
এবার প্রকাশ করো তোমার আমার মাঝে এক।"

কবিতাটিতে কবি  "নিজেকে যেন দুটি পৃথক সত্তায় ভাগ করে পাশাপাশি রেখেছেন। দেহ আর চৈতন্য। ... চৈতন্যরূপে জ্যোতিস্বরূপের সাক্ষাৎ প্রাপ্তিই এখন কাম্য। মৃত্যু এখন সেই জ্যোতির্গমনের অপেক্ষায় রয়েছেন।"(উজ্জ্বল কুমার মজুমদার, 'রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টির উজ্জ্বল স্রোতে')।

এখানেও এক জ্যোতির্ময় সত্তার প্রকাশই আমরা দেখি। তিনি যেন সময় হলেই দুয়ার ভেঙে এসে আমাদের ঠিকই নিয়ে যাবেন। সেই আলোরই জয়গান গেয়েছেন কবি অর্ধচেতন অবস্থাতেও। যা আমাদের মৃত্যুর দুয়ারটুকু পার হয়ে যেতে সংশয় কাটিয়ে দেয়। মনে সাহস দেয়, আমরাও তাঁর সাথে বলতে পারি ...


"দুদিক দিয়ে ঘেরা ঘরে    তাইতে যদি এতই ধরে,
চিরদিনের আবাসখানা    সেই কি শূন্যময়
                 জয়  অজানার জয়।"