হান কাং এর হিউম্যান অ্যাক্টস- বাংলা তরজমা - ৬

কিন্তু দুঃসময়ের তখনো বাকি ছিল।

এই ক্রমশঃ বাড়তে থাকা ভয়টা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি আমার দিদির কথা ভাবলাম। মাথার উপরে জ্বলন্ত সূর্যটাকে ক্রমশঃ আরও দক্ষিণের দিকে সরে যেতে দেখতে দেখতে আমি আমার দিদির কথাই শুধু ভাবছিলাম, আলোর রশ্মিগুলো যেন আমার ওই ভাঙাচোরা চোখের পাতা ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যেতে চাইছিল। আর তখনই সেই তীব্র যন্ত্রণাটা টের পেলাম। ও আর বেঁচে নেই; ও আমারও আগে মরে গেছে। আমার তো জিভ নেই, গলার স্বরও নেই, তাই আমার চিৎকারটা যেন আরেকটু রক্ত আর দেহরস হয়ে আমার শরীর থেকে বেরিয়ে এল। আমার এই আত্মা আমিটার কোনো চোখ নেই; এই রক্তটা আসছে কোথা থেকে? কোন স্নায়ুতে জমেছিল এই ব্যথা? আমি আমার অপরিবর্তিত মুখটার দিকে আবার দেখলাম। আমার হাতগুলো যথারীতি নোংরা, যেমন সবসময়েই থাকে। নখের উপর রক্ত আর রস জমে গাঢ় একটা মরচের মতন পড়েছে, লাল পিঁপড়েগুলো নিঃশব্দে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার আর নিজেকে পনেরো বছরের বলে মনে হচ্ছিল না; পঁইয়ত্রিশ, পঁয়তাল্লিশ, এসব সংখ্যাগুলোও এক এক করে মনে এল, কিন্তু সেসবও যথেষ্ট লাগল না। নাহ, পঁয়ষট্টি বা পঁচাত্তর, এই আমিটাকে মাপার জন্য এসব কোনো সংখ্যাই আর যথেষ্ট মনে হচ্ছে না।

আমি আর বর্ষসেরা বাঁটকুল জিওং ডে নই। পার্ক জিওং ডে, যার ভালোবাসা কিংবা ভয় সম্বন্ধে যাবতীয় ধানধারণার একমাত্র প্রতিমূর্তি তার দিদি, সে আর আমি নই। আমার ভিতরে একটা অদ্ভুত রাগ, হিংসার সঞ্চার হচ্ছিল – আমি মরে গেছি বলে নয়, বরং যা আমি জানিনা, যে সব প্রশ্ন আমাকে কুরে খাচ্ছিল, সেগুলোর জন্য। কে মারল আমাকে, আমার দিদিকে, কেন মারল? যত আমি এই ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম, তত আমার মধ্যে এই নতুন ক্ষমতাটা জোরদার হচ্ছিল। বাধাহীন রক্তপ্রবাহ – যা একটা মুখহীন, অবয়বহীন, গাঢ় অন্ধকার মণ্ড থেকে উপচে উপচে আসছিল।

তাহলে আমার দিদির আত্মাটাও নিশ্চই আমার মতই কোথাও একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে; কিন্তু কোথায়? এখন তো আমাদের আর শরীর বলে কিছুও নেই, আমাদের দেখা হবার জন্য বোধ হয় আর শরীরিভাবে কাছাকাছি থাকতেই হবে এমন কোনো কথাও নেই। কিন্তু শরীর না থাকলে আমরা নিজেদেরকে চিনতে পারব কেমন করে? দিদির ছায়াশরীরটাকেও কি আমি ঠিকই চিনতে পারব?

আমার লাশটা ক্রমশ আরও পচে যাচ্ছে। একগাদা মাছি ক্ষতস্থানগুলোয় ভীড় করে আছে। ডাঁশগুলো আমার চোখ আর ঠোঁটের ওপর ওদের মোটা মোটা কালো পা গুলো ঘষ্টাতে ঘষটাতে হাঁটছে। অবশেষে যখন দিনের আলো কমে আসতে শুরু করল, ওক গাছগুলোর মাথার ওপরে কমলা হয়ে আসা আলোর রশ্মিগুলো কাটাকুটি খেলতে শুরু করল, তখন দিদি কোথায় থাকতে পারে সে ভাবনা ছেড়ে আমি ওদের দিকে মনোযোগ দিলাম। যে লোকটা আমাকে খুন করল, আর যে আমার দিদিকে মারল। তারা এখন কোথায়? ওরা যদি বেঁচেও থাকে, ওদেরও তো নিশ্চই আত্মা আছে, তাহলে আমি যদি আমার সমস্ত চেতনা নিয়ে ওদের কথা ভাবতে পারি, তাহলে নিশ্চই ওদের আত্মাগুলোর স্পর্শ পাব। আমি আমার এই শরীরের খাঁচাটা থেকে বেরোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম, সাপ যেভাবে খোলস ছাড়ে, সেভাবে। ওই পচাগলা শরীরটা একটা অদ্ভুত অমোঘ টানে আমাকে আটকে রেখেছে, মাকড়শার জালের মতই পাতলা কিন্তু শক্তপোক্ত, বাড়ছে, কমছে, ছিঁড়ছে না। আমি চাই এই বন্ধনটা ছিঁড়ে উড়ে যেতে – যেখানে ওরা আছে, ওদের কাছে জানতে চাইব – কেন মারল ওরা আমাকে? কেন মারল দিদিকে? কী করল তার লাশটাকে?

রাতের নৈঃশব্দ চিরে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ধাতব দরজাটা একবার খুলল, আবার বন্ধ হল। ইঞ্জিনের গুড়গুড় আওয়াজটা এগিয়ে এল কাছে। ট্রাকের হেডলাইট জোড়ার আলো অন্ধকার চিরে এগিয়ে এল। সেই আলো যখন আমাদের লাশগুলোর উপর এসে পড়ল, তখন সেখানে গাছের পাতার ছায়াগুলো আমাদের প্রত্যেকের মুখের সেই কালো উল্কিগুলো নেচে বেড়াতে লাগল।

এবারে ওরা মাত্র দুজন মিলে এই শেষ ব্যাচের লাশগুলো আমাদের দিকে নিয়ে আসা শুরু করল একে একে। এ যাত্রায় মোট পাঁচটা লাশ, তাদের মধ্যে চারজনের খুলির ওপর মস্ত গর্ত, যেন কোনো ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে সেগুলো ভাঙা হয়েছে, শরীরের ওপরের অংশগুলো টুকরো টুকরো নকশার মত হয়ে আছে, আর আরেকজন একটা নীল হাসপাতালের গাউন পরে আছে। আমাদের পাশে একটা ছোট ঢিপি করে এই লাশগুলোকে রাখল ওরা, সেই একইরকম আড়াআড়ি করে। হাসপাতালের পোশাক পরা লাশটা সবার ওপরে রেখে দ্রুত তার উপর কিছু খড়ের গাদা চাপিয়ে ওরা ওখান থেকে চলে গেল। ওদের ভাবলেশহীন চোখ আর কোঁচকানো ভুরুগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎই আমি উপলব্ধি করলাম, কাল থেকে আজ অবধি পড়ে থেকে আমাদের লাশগুলো নিশ্চই ভয়ানক দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে।

ওরা ট্রাকের ইঞ্জিন চালু করার পর আমি এই নতুন লাশগুলোর দিকে তাকালাম। আমি একা নই; আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে অন্য সব আত্মারাও আমার চারপাশে ভিড় করে এদের দেখছে। যে চারজনের মাথাগুলো ভাঙা তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, একজন মেয়ে। ওদের জামাকাপড় দিয়ে এখনো পাতলা জল আর রক্ত গড়াচ্ছে। ওদের মাথায় কেউ অনেকটা জল ছিটিয়েছে সম্ভবতঃ। কারণ ওদের বাকি শরীরের বেহাল অবস্থার তুলনায় মুখগুলো কিছুটা পরিস্কার দেখাচ্ছে। হাসপাতালের পোশাকে অল্পবয়সী ছেলেটা স্পষ্টতঃই এদের থেকে আলাদা, স্পেশ্যাল কেউ। সবার উপরে ওই খড়ের গাদাটা একটা কম্বলের মত গায়ের উপরে নিয়ে শায়িত ছেলেটি অন্য যে কারুর থেকে অনেক বেশি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। কেউ ওর শরীরটা ধুয়েছে। কেউ একজন ওর ক্ষতগুলো পরিষ্কার করে পুলটিশ লাগিয়েছে। ওর মাথায় জড়ানো সাদা ব্যান্ডেজটা এই অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। আমরা সবাই এখন স্রেফ লাশ, সেই হিসাবে আমাদের আর আলাদা করে পছন্দ অপছন্দের কিছুই থাকার কথা না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর শরীরটায় একটা মহান স্পর্শের সমস্ত চিহ্ন ফুটে উঠছিল – কেউ পরোয়া করেছে, মূল্য দিয়েছে, তার স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠছিল। অন্যদিকে আমার শরীরটা একগাদা লাশের নীচে কী বিশ্রী, লজ্জাকর অবস্থায় পড়েছিল।

সেই মুহুর্ত থেকে আমার শরীরটার উপর আমার একটা প্রবল ঘৃণা জন্মাল। এই মাংসের ডেলার মত ডাঁই করে ফেলে রাখা আমাদের সমস্ত লাশগুলোর উপর। সূর্যের আলোয় পচতে থাকা আমাদের নোংরা, পচাগলা মুখগুলোর উপর।

ইশ, যদি আমার চোখগুলো বন্ধ করতে পারতাম।

ইশ, যদি আমাদের এই লাশগুলো আর না দেখতে হত, অচে গলে সেগুলো এখন প্রায় একটাই মাংসের ঢিপিতে পরিণত হয়েছে প্রায়, যেন অনেক পা ওয়ালা কোনো রাক্ষসের পচতে থাকা কঙ্কাল একটা। ইশ, যদি একটু ঘুমাতে পারতাম, সত্যিকারের ঘুম, এই আধো ঘুম আধো জাগরণ নয়। আমার সেই অন্ধকার চেতনার অতলে যদি সোজা ঝাঁপ দিতে পারতাম।

যদি কোনো স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে পারতাম।

অথবা কোনো স্মৃতির অতলে।

গত গ্রীষ্মের সেই দৃশ্যে যদি ফিরে যেতে পারতাম, তোর ক্লাস শেষ হবে বলে করিডোরে আমি অধৈর্যভাবে ঘুরঘুর করছিলাম, একবার এই পায়ে আরেকবার ওই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম। যেই দেখলাম মাস্টারমশাই ক্লাস থেকে বেরোচ্ছেন আমি তাড়াতাড়ি আমার ইউনিফর্ম টানটান করে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর সব ছেলেমেয়েরা একে একে বেরিয়ে গেলে ক্লাসের মধ্যে ঢুকে দেখলাম তুই তখনো ব্ল্যাকবোর্ড মুছে চলেছিস।

“কী করছিস?”

“এই সপ্তাহে আমার পালা”

“সে তো গত সপ্তাহেও তোরই পালা ছিল না?”

“হ্যাঁ, মানে এই সপ্তাহে আরেকজনের পালা আসলে – কিন্তু ওর একটা ব্লাইন্ড ডেট আছে – তাই আমি ওর হয়ে করে দিচ্ছি আর কি”

“ও – নকল”

আমাদের চোখাচোখি হতেই দুজনেই ফ্যাক করে হেসে ফেললাম। তখনই খানিকটা চকের গুঁড়ো আমার নাকে ঢুকে গেল আর আমি হাঁচতে শুরু করলাম। আর তখনই তোর রেখে দেওয়া ব্ল্যাকবোর্ডের ডাস্টারটা আমি চুপিচুপি আমার ব্যাগে রেখে দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখনই তোর সাথে চোখাচোখি হয়ে যেতে দেখি তুই হাঁ করে তাকিয়ে আছিস – তখন আমি তোকে আমার দিদির গল্পটা একটুও না বাড়িয়ে, একটুও দুঃখ কিংবা লজ্জা না পেয়েই বলে ফেললাম।

সেই রাতে আমি লেপটা পেট অবধি টেনে নিয়ে শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর ভান করছিলাম। রোজকার মতই সেদিনও নাইট শিফট সেরে দিদি বেশ দেরীতেই ঘরে ঢুকল, ঢুকে টুকিটাকি কাজ করছিল, হাত ধোওয়ার জায়গার কাছে টেবিলটা ঠিক করল, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাতটায় জল ঢালল, আমি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্ধকারে চোখটা অল্প একটু খুলে ওকে একপাশ থেকে দেখছিলাম। ও হাত ধুলো, দাঁত মাজলো, তারপর পা টিপে টিপে জানলার কাছে গিয়ে দেখল মশার ধুপটা ঠিকমতন জ্বলছে কি না। সেখানেই জানলার পাশে আমার সাবধানে রেখে দেওয়া ডাস্টারটা দেখতে পেয়ে ও হেসে ফেলল। প্রথমে সেটা একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাসের মত শুরু হয়ে তারপর একটু পরেই বেশ জোরে জোরে হাসতে শুরু করল ও।

মাথাটা একবার নেড়ে ও চট করে একবার সেই ঝাড়নটা হাতে নিয়ে দেখে আবার তাড়াতাড়ি যথাস্থানে রেখে দিল। যথারীতি ওই ছোট্ট ঘরে আমার থেকে যতটা সম্ভব দূরে শূয়ে নিজের লেপটা টেনে নিল, তারপর একটু একটু করে আমি যেখানে শুয়েছিলাম, সেখানেই চলে এল গড়াতে গড়াতে। আমি চোখটা শক্ত করে বন্ধ করে ফেললাম। টের পেলাম ও আমার কপালে, গালে একটু হাত বুলিয়ে দিল, তারপরে আবার নিজের বিছানার কাছে ফিরে গেল, লেপটার খসখস আওয়াজে বুঝলাম, ও আবার ওটার নীচে ঢুকে গেল। ওর সেই হাসির শব্দটা এখন এই অন্ধকারে আমি আবার শুনতে পেলাম। প্রথমে একটা দীর্ঘশ্বাসের মত মৃদু, তারপর ক্রমশঃ জোরে জোরে।

এই গভীর অন্ধকার ঝোপের মধ্যে ওই স্মৃতিটাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছিলাম আমি। সেই রাতে, যখন আমার একটা দেহ ছিল, তখনকার প্রতিটা ছোটখাটো অনুভূতি আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম আমি। সেদিন রাতে জানলা দিয়ে আসা সেই ঠান্ডা, ভিজে ভিজে হাওয়া, আমার আয়ের পাতা ঘেঁষে সেই হাওয়ার মৃদু স্পর্শ। দিদি যেদিকে শুয়ে আছে সেদিক থেকে ভেসে আসছিল একটা লোশনের গন্ধ, যেটা ওর ব্যথা হওয়া কাঁধে আর পিঠে ও ব্যথার ওষুধের সাথে মিশিয়ে লাগিয়েছিল। বাইরে উঠোনে গঙ্গাফড়িংগুলোর প্রায় নিঃশব্দ ওড়াউড়ির মৃদু শব্দ। আমাদের বাড়ির সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা হোলিহকগুলো। আমাদের ঘরের উল্টোদিকের হাওয়া আটকানো দেওয়ালটার গায়ে বিচিত্র বর্ণের রায়ট লাগিয়ে দেওয়া কাঠগোলা আর জংলী গোলাপের দল। আমার মুখটা, যেটায় দিদি দুইবার হাত বুলিয়ে দিল। আমার চোখ বন্ধ করা মুখ, যেটা ও অত ভালোবাসে।