হান কাং এর হিউম্যান অ্যাক্টস- বাংলা তরজমা - ৫
- 07 November, 2025
- লেখক: রৌহিন
২
ছেলেটির বন্ধু। ১৯৮০
আমাদের দেহগুলো একটা ক্রসের আকারে একটা আরেকটার ওপর চাপিয়ে রাখা হয়েছে।
আমার পেটের উপর আড়াআড়ি করে একজন অচেনা লোকের দেহটা নব্বই ডিগ্রী কোনে রাখা, আর তার উপরে আছে আরেকটা ছেলে, আমার গথেকে বয়সে একটু বড়ই হবে। ছেলেটা বেশ লম্বা, ওর হাঁটুর পিছনদিকটা আমার পায়ের পাতার কাছে ঝুলছে আর ওর লম্বা লম্বা চুলগুলো আমার মুখের উপর বুলাচ্ছে। এসবই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, কারণ আমি তখনো আমার শরীরটার সাথেই আটকে ছিলাম।
ওরা এবার আমাদের দিকে এগিয়ে এল দ্রুতপায়ে। মাথায় হেলমেট, চকরাবকরা ইউনিফর্মের হাতায় রেড ক্রসের আর্ম ব্যান্ড। দুজন দুজন করে ওরা আমাদের দেহগুলোকে ধরে ধরে একটা মিলিটারি ট্রাকের ভিতরে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। যেন চালের বস্তা তুলছে ট্রাকে। আমি উড়ে গিয়ে আমার ঘাড় আর গালের ওপর পড়লাম, আর এই ওড়াউড়ির মধ্যে আমার শরীরটার সাথে লেপ্টে থাকার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করছিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হল, টড়াকটার ভিতরে আমিই একা মনে হল। মানে শরীরগুলো তো আছে অবশ্যই, কিন্তু আমার মত আর কাউকেই দেখতে পেলাম না। হয়তো ট্রাকের ভিতর দিকে কোথাও চাপাচাপি করে আছে, কিন্তু আমি তাদের দেখতে পাচ্ছিলাম না, টেরও পাচ্ছিলাম না তাদের অস্তিত্ব। লোকে কথায় কথায় বলে, “জীবনের ওপারে আবার দেখা হবে”, সেসব কথা এখন অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
আমারটা সহ গাদা গাদা লাশ ট্রাকটার মধ্যে জমা হয়ে ছিল। আমার এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল যে হৃদপিণ্ডটাই শেষমেশ বন্ধ হয়ে গেছিল, কিন্তু তাও আমার শরীরটা দিয়ে তখনও রক্ত পড়েই চলেছিল, আমার মুখের চামড়াটা পুরো একটা লেখার কাগজের মত সাদা হয়ে গেছিল। ওই রক্তাক্ত মুখের মধ্যে নিজের বন্ধ চোখদুটো দেখতে অদ্ভুত লাগছিল।
সন্ধে ঘনিয়ে আসছিল, জেলা শহরের ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে ট্রাকটা এখন চারিদিকে অন্ধকার মাঠের মধ্যে একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে ছুটছিল। একটা ছোট্ট পাহাড়ের উপর উঠতে শুরু করল গাড়িটা, দুধারে বিশাল বিশাল ওক গাছের ঘন জঙ্গল। তারপর একটু দূরে একটা লোহার গেট দেখা দিল। গেটের সামনে এসে ট্রাকটা দাঁড়াল, সান্ত্রী দুজন স্যালুট ঠুকল। দরজাটা খোলা আর বন্ধ করার সময়ে দুবার ধাতব ক্যাঁচক্যাঁচানির আওয়াজ হল। এবারে ট্রাকটা পাহাড়ি রাস্তায় আরও একটু উপরে উঠল, তারপর একটা মোড় ঘুরেই একদিকে একটা কংক্রিটের বাড়ি, আরেক দিকে ওক গাছের জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটায় এসে থামল।
ওরা ট্রাক থেকে নেমে পিছন দিকে এসে ডালাটা খুলে ফেলল। আবারও দুজন দুজন করে, একজন পা দুটো আরেকজন হাতদুটো ধরে আমাদের তুলে তুলে ওই ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে এনে জড়ো করছিল। আমার শরীরটা যেন ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি প্রায় মরিয়া হয়ে ওটাকে আঁকড়ে থাকলাম। নীচু বাড়িটার দিকে একবার তাকালাম আমি, জানালায় আলো জ্বলছে। এটা কোন জায়গা, ওই বাড়ির ভিতরেই বা কি আছে, আমার লাশটাকে কোথায় আনল ওরা, এসবই জানতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল।
খালি জায়গাটার ওপর গজিয়ে অঠা ঝোপঝাড়গুলো ঠেলে সরিয়ে জায়গা করছিল ওরা। নেতাগোছের একজনের পরিচালনায় ওরা লাশগুলোকে সারে সারে ক্রসের আকারে সাজিয়ে ফেলল। আমারটা নীচ থেকে দুই নম্বরে ছিল, আমার উপরের লাশগুলোর চাপে প্রায় সেঁটে গিয়ে আটকে ছিল। কিন্তু এত চাপেও আমার ক্ষতগুলো থেকে আর কোনো রক্ত বেরিয়ে এলো না – তার মানে নিশ্চই এতক্ষণে সব রক্ত শেষ হয়ে গেছে। উলটো হয়ে ঝুলে থাকা আমার মুখটার উপর কাঠের ছায়া পড়ে কেমন ভুতের মতই দেখাচ্ছিল, চোখ বন্ধ, মুখটা আধখোলা। সবচেয়ে উপরের লাশটার উপরে ওরা এক বস্তা খড় ফেলে দিতে এই লাশের স্তম্ভটাকে একটা অদ্ভুত কোনো রূপকথার জানোয়ার বলে মনে হচ্ছিল – চারিদিকে তার ডজন ডজন পা বেরিয়ে আছে।
ওরা চলে যাবার পর আমাদের চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। পশ্চিম আকাশের শেষ আলোর আভাসটুকুও আস্তে আস্তে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি এই ডাঁই করা স্তম্ভের একেবারে মাথায় গিয়ে উঠলাম, সবার উপরে যে লোকটার মুখের উপর মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দেওয়া এক টুকরো চাঁদের আলো এসে পড়েছিল। ঝোপঝাড় আর গাছের ডালপালাগুলো ওই আলোটার সাথে কাটাকুটি খেলছিল, মৃত মুখগুলির ওপরে তাদের ছায়া পড়ে বেশ অদ্ভুত ধরণের উল্কির মত লাগছিল।
প্রায় তখন মাঝরাত, আমি সেই স্পর্শটা অনুভব করলাম; একটা অশরীরি, প্রায় নিঃশ্বাসের মত হালকা কিছু, মুখহীন একটা ছায়ার মত, এমনকি তার কোনো ভাষাও নেই। এটা কী বা কে, এর সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করা যাবে, না বুঝতে পেরে আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কোনো আত্মার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা তো আগে আমাকে কেউ শেখায়নি।
কিন্তু আমার এই সঙ্গীটিও সেরকমই ভেনলে আছে মনে হচ্ছে। আমাদের চিরপরিচিত ভাষার সাহায্য এখন নেই – তবুও আমরা একে অপরের অস্তিত্ব নিজেদের মনের মধ্যে বেশ টের পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও সরে গেল, সেই হাল ছেড়ে দেওয়া, সরে যাওয়া আমাকে আবার একা, নিঃসঙ্গ করে দিল।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশ কিছু ঘটনা ঘটে চলছিল। আবারও কিছু একটা আমার ছায়াটাকে স্পর্শ করে গেল; আরেকটা আত্মা। আরেকজন কে, তাই ভাবতে ভাবতেই আমরা একে অপরকে হারিয়ে ফেলব আবার, কারণ আমাদের কোনো মুখ নেই, হাত-পা নেই, জিভ নেই, চোখ নেই – আমাদের ছায়াগুলো পরস্পরকে স্পর্শ করছে, কিন্তু একে অপরের সাথে ঠিক মিলতে পারছে না। কাচের মসৃণ দেওয়ালে কখনো অশরীরি ছায়াগুলো ছুঁইয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেখানে যে বাধাই থাক, তা অতিক্রম করতে না পেরে আবার নীরবেই মিলিয়েও যাচ্ছে। যতবারই কোনো ছায়া আমাকে ছুঁইয়ে যাচ্ছিল, আমি একবার করে ওপরে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল যে মেঘে আধো ঢাকা ওই চাঁদটার বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছে অন্ততঃ। বাস্তবে একটা বিরাট নিশ্চল পাথরের চাঁই ছাড়া আর কিছুই আমাকে দেখছিল না।
সেই বিচিত্র রাত যখন ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসছিল, কালো আকাশের মধ্যে থেকে একটা হালকা নীলাভ আলো ফুটে উঠতে শুরু করছিল, সেই সময়ে আমার তোর কথা মনে পড়ল, ডং হো। হ্যাঁ, সেদিন তো তুই আমার সাথেই ছিলি। হঠাৎ করে সেই ঠান্ডা শক্ত জিনিষটা আমার একদিক দিয়ে ঢুকে যাবার আগে পর্যন্ত তুই ছিলি। যতক্ষণ আমি একটা কাপড়ের পুতুলের মত রাস্তায় পড়ে না গেলাম। যতক্ষণ আমার হাত দুটো নিঃশব্দ সাবধানবানীর মত আকাশের দিকে উঠে না গেল, তখন চারিদিকে একটা প্রচণ্ড ছোটাছুটি, হট্টগোল, চত্বরটায় পায়ের দাপাদাপি, কান ফাটানো গুলির আওয়াজ। যতক্ষণ আমার নিজের গরম রক্ত আমার কাঁধ বেয়ে, ঘাড় বেয়ে নেমে আসাটা আমি টের না পেলাম, ততক্ষণ তুই আমার সাথেই ছিলি।
গঙ্গাফড়িংগুলো ফড়ফড় করছিল। পাখীগুলো কোনো অজানা আড়াল থেকে তাদের সকালের গান শুরু করে দিল। হাওয়ার ঝাপটে গাছগুলোর গায়ে জমে থাকা অন্ধকার একটু একটু করে ফিকে হছিল। দূরে দিগন্তে ফ্যাকাশে সূর্যটা তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসছিল, অথচ মাঝ আকাশে তার আগেই সে কী রাজকীয় সমাহার! ঝোপের পিছনে ডাঁই করে রাখা আমাদের লাশগুলো এবারে সূর্যের আলো পড়ে একটু নরম হল, তাদের মধ্যে একটু একটু ফাটল দেখা দিচ্ছিল। লাশের রক্ত জমে থাকা বা মাংস বেরিয়ে থাকা জায়গাগুলোয় এতক্ষণ যে ডাঁশ মাছিগুলো আঁট হয়ে বসেছিল, তারা একবার নিজেদের পাগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু উড়ল, তারপর আবার এসে জায়গামত বসে পড়ল। আমি আমার শরীরের পাশটা ছেড়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করলাম যে তোর বডিটাও এখানে কোথাও ডাঁই করা আছে কি না, কাল রাতে যেসব আত্মাগুলো আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে তুইও ছিলি কি না। কিন্তু উপায় নেই – আমি যেন আমার শরীরটার সঙ্গে লেপ্টে আটকে আছি – যেন ওটা কোনো চৌম্বক শক্তি পেয়েছে নতুন করে, আমাকে টেনে ধরে রেখেছে। আমার নিজের ভৌতিক ফ্যাকাসে মুখটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি।
সূর্য প্রায় মাথার উপর চলে আসা অবধি এইরকম চলার পর আমি বুঝতে পারলাম, তুই ওখানে নেই।
না, শুধু এই লাশের ডাঁইএর মদ্যে বলে নয়, তুই আসলে এখনো বেঁচেই আছিস। যদিও এখানে অন্য যারা ডাঁই হয়ে আছে তাদের কারুর পরিচয়ই আমি বুঝতে পারছিলাম না, তবু আমার সর্বশক্তি দিয়ে কোনো চেনা লোককে খঁজার চেষ্টা করলে অন্ততঃ সে আদৌ মারা গেছে কি না, সেটুকু আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সেই মুহুর্তে এটা আবিষ্কার করেও আমার তেমন কোনো স্বস্তি হল না। বরং আমার মনে একটা ভয় গেঁড়ে বসছিল ক্রমশঃ যে এই অদ্ভুত ঝোপের মধ্যে এইসব ক্ষয়িষ্ণু লাশ আর অপরিচিত আত্মাদের ভীড়ে আমি সম্পূর্ণ একা!