হান কাং এর হিউম্যান অ্যাক্টস- বাংলা তরজমা - ৩

সেই বিকালে বাড়িটা ছিল নিস্তব্ধ। এই এত বিপর্যয়ের মধ্যেও তোমার মা ডেনবাজারে তোমাদের পারিবারিক চামড়ার দোকানটি খুলে বসেছিলেন, আর কদিন আগে চামড়া বোঝাই একটা ভারী বাক্স তুলতে গিয়ে পিঠে চোট লাগা তোমার বাবা শুয়েছিলেন ভিতরের ঘরে। তুমি সদর দরজাটা ঠেলা দিয়ে খুললে, যার একটা দিক ভেজানোই ছিল, পাথরে ধাতব ঘষটানির শব্দ হল ক্যাঁচ করে। উঠোনে দাঁড়িয়ে তুমি শুনতে পাচ্ছিলে তোমার মেজদা তার ঘরে ইংরিজি শব্দকোষ মুখস্থ করছে।

“ডং হো?” বড় ঘর থেকে তোমার বাবার স্পষ্ট গলার আওয়াজ শোনা গেল। “ডং হো, ফিরলি?” তুমি কোনো উত্তর দিলে না। “ডং হো, তুই যদি হোস তাহলে এঘরে এসে আমার পিঠটা একটু মালিশ করে দিয়ে যা তো বাবা।“

কথাগুলো শুনতে পেয়েছ এমন কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে তুমি ফুলের বেদীটার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাম্পের হ্যান্ডেলে ঠেলা মারলে। পরিস্কার, ঠান্ডা জল নিকেলের ওয়াশ বেসিনটায় এসে পড়ছিল। তুমি প্রথমে তোমার হাতদুটো জলের নীচে ধরলে, তারপরে অঞ্জলি করে জল তুলে মুখে ছেটালে। মুখটা উঁচু করে ধরার পরে জলের ধারা তোমার চোয়াল বেয়ে তোমার গলার বরাবর নামছিল।

“ডং হো, বাইরে তুইই আছিস তো? এদিকে আয়”। ভেজা হাতটা চোখের ওপর চেপে রেখে তুমি পাথরের বারান্দাটায় সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলে। কিছুক্ষণ পরে তুমি জুতোগুলো পা থেকে খুললে, ওপরে কাঠের বারান্দাটায় উঠলে এবং বড় ঘরের দরজা খুললে। ঘরের ঠিক মাঝখানে তোমার বাবা ঝুঁকে শুয়েছিলেন আর পুরো ঘরটা ধুপের গন্ধে ভরে ছিল।

“পিঠের পেশীতে একটা টান লেগেছে, আমি উঠতে পারছি না। নীচের দিক থেকে একটু মালিশ করে দে বাবা”

তুমি মোজাগুলো খুলে ডান পা টা তোমার বাবার কোমরের কাছে তুলে দিলে, তোমার পুরো ওজনের চাপটা যেন না পড়ে সেটা খেয়াল রেখে।

“কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলি তুই? তোর মা বারবার ফোন করে জানতে চাইছিল তুই ফিরেছিস কি না। যা চলছে আশেপাশে, তাতে এখন পাড়ার মধ্যে ঘোরাঘুরি করাটাও নিরাপদ না। কাল রাতে স্টেশনের ওদিকে গোলাগুলি চলেছে – কয়েকজন মারাও গেছে – ভাবা যায় না। খালি হাতে কেউ এভাবে বন্দুকের সামনে দাঁড়ায় গিয়ে?”

তুমি অভ্যস্ত ভঙ্গীতে পা বদলালে এবং সাবধানে তোমার বাবার শিরদাঁড়া আর কোমরের সংযোগস্থলে হালকা চাপ দিলে। “আহ! হ্যাঁ – ঠিক ওখানে – ঠিক একদম…”

ভিতরের ঘর ছেড়ে তুমি এবার রান্নাঘরের আশে তোমার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলে। কাগজপাতা মেঝেতে গুটিশুটি মেরে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়ে পড়লে তুমি। এত হঠাৎ করে তোমার ঘুম এসে গেল, যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি আবার চমকে জেগে উঠলে, কোনো একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে, যার একবর্ণও তুমি আর মনে করতে পারছিলে না। আর এমনিতেও  তোমার সামনে ছিল লম্বা জাগরণের পালা – যেটা যে কোনো স্বপ্নের থেকে অনেক বেশী ভয়াবহ। সদর দরজার লাগোয়া যে ছোট ঘরটায় জিওং ডে ওর দিদির সঙ্গে থাকে, সেখান থেকে স্বভাবতঃই কোনো শব্দ  আসছিল না। সন্ধে হয়ে যাবার পরেও কোনো আলো জ্বলছিল না। পাথরের বারান্দাটার ওপাশে গাঢ় খয়েরি রঙের জারটার মধ্যে চাবিটা পড়েছিল একইভাবে।

ঘরের মধ্যে শুয়ে জিওং ডে র মুখটা তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তুমি দেখতে পাচ্ছিলে সেই হালকা নীল ট্র্যাকশ্যুটের নীচের অংশটা ছটফট করছে, আর তোমার দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছিল, যেন তোমার পেটের স্নায়ুতন্ত্রের ভিতর একটা আগুনের গোলা ঢুকে বসে আছে। দমবন্ধ কষ্টটাকে কাটানোর জন্য অন্য যে কোনো স্বাভাবিক দিনে, বা ধরা যাক আজই, জিওং ডে র মুখটা তুমি মনে করার চেষ্টা করছিলে, যেন সে দরজাটা ঠেলে উঠোনের মধ্যে ঢুকছে, যেন কিছুই হয়নি। মিডল স্কুলে পড়া আর পাঁচটা বাচ্চার মত বাড় হয়নি জিওং ডে’র। অনেক অভাবের মধ্যেও ওর দিদি জিওং মী ওর জন্য কোথাও না কোথাও থেকে দুধ জোগাড় করে আনত, ওর আরেকটু বাড়বৃদ্ধি হবে এই আশায়। জিওং ডে কে দেখে অবাকই হতে হয় যে ও জিওং মীর ভাই। ওর চ্যাপ্টা নাক আর কুতকুতে চোখ নিয়েও সেই নাকটাকে কুঁচকে ও এখনো লোককে হাসাতে পারে, আর ওর নিজের হাসিতে জ্বলে হাজার ওয়াটের আলো। স্কুল ট্যালেন্ট শো তে চোখমুখ কুঁচকে, গাল ফুলিয়ে ওর ডিস্কো নাচের বহর দেখে ভয়ঙ্কর রাগী রাগী শিক্ষকেরাও হেসে কুটিপাটি হয়েছিলেন সব। চিরদিনই পড়াশোনার চেয়ে টাকাপয়সা রোজগারের দিকেই ওর উৎসাহ বেশী। কিন্তু তারপরেও ওর দিদি জোর করেই ওকে লিবারাল আর্টস কলেজের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসানোর জন্য তৈরী করছিল। ওর সেই পেপার ওর দিদিকে লুকিয়ে গোল করে পাকিয়ে হাত ফেরত হত – শীতকালের সন্ধেবেলার তীব্র বাতাসে ওর গালগুলো ফেটে লাল হয়ে যেত। ওর হাতের পিছনে ছিল একটা বিশ্রী আঁচিল। ও যখন উঠোনে আমাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলত, স্ম্যাশ ছাড়া আর কিছুই মারতে চাইত না – এমন একটা ভাব করত যেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের হয়ে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছে।

জিওং ডে – যে অম্লানবদনে ওর বইএর ব্যাগে স্কুলের = ব্ল্যাক বোর্ড মোছার ডাস্টারটা ঢুকিয়ে ফেলত।

“ওটা কেন নিচ্ছিস?”

“আমার দিদিকে দেব বলে”।

“ও ওটা দিয়ে কী করবে?”

“ও সবসময়ে এটার কথা বলে। মিডল স্কুলে এটার কথাই ওর সবচেয়ে বেশী মনে আছে।“

“একটা ব্ল্যাকবোর্ড মোছার ডাস্টার? ওদের আর খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না মনে হয়।“

“না না, আসলে এর পিছনে একটা গল্প আছে। এপ্রিল ফুলের দিন ওর ক্লাসের বাচ্চারা সবাই দুষ্টুমি করে পুরো ব্ল্যাকবোর্ড ভরে হিজিবিজি লিখে রেখেছিল – যাতে টিচার এসে সব মুছে পড়া শুরু করতে করতেই অনেকটা সময় চলে যায়। কিন্তু টিচার এসে ওটা দেখেই চেঁচালেন, ‘এই সপ্তাহের ক্লাস মনিটর কে?’ – আর সেই সপ্তাহে ছিল দিদির পালা। আর কি - সবাই যখন ক্লাস করছিল, ও তখন বাইরে দাঁড়িয়ে এই কাপড়টা একটা লাঠি দিয়ে ঝাড়ছিল, যাতে সব চকের গুঁড়ো চলে যায়। মজার গল্প কিন্তু, তাই না? মিডল স্কুলের দুই বছরের মধ্যে ওই ঘটনাটাই ওর সবচেয়ে স্পষ্ট মনে আছে।“

কাগজমোড়া ঠান্ডা মেঝেতে দুই হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে নিজেকে টেনে তুললে তুমি। তারপর দরজার কাছে গিয়ে সেটা টেনে খুলে চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে নিলে। সরু উঠোনটা পেরিয়ে বাইরের লাগোয়া ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে। চকচকে জারটার মধ্যে পুরো হাতটা ঢুকিয়ে দিয়ে তুমি ভিতরে হাতড়াচ্ছিলে। চাবিটা সেই মাটির পাত্রের একদম নীচের দিকে ছিল, হাতড়ে হাতড়ে হাতুড়ি আর ছেনির নীচে থেকে সেটা তুমি বার করে নিলে। লাগোয়া ঘরের দরজাটা খুলে গেল। চটি খুলে ঘরের ভিতর ঢুকলে তুমি।

যা কাণ্ড ঘটে গেছে, ঘরের মধ্যে তার কোনো চিহ্ন নেই। ডেস্কের ওপর ঠিক রোববার যেমন ছিল, নোটবুকটা একইরকমভাবে খোলা পড়ে আছে। সেদিন জিওং ডে প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম করছিল আর তুমি ওকে সান্ত্বনা দিতে জিওং মী কোথায় কোথায় গিয়ে থাকতে পারে তার তালিকা করছিলে। সন্ধেবেলার ক্লাস, কারখানা, মঝে মাঝে যে গীর্জায় ও যায় সেখানে; ওদের কাকা একবার ইলগক-ডং এ চলে গেছিল, সেখানে। পরেরদিন সকালে তোমরা দুজনে এই সব জায়গায় ফোন করেছিলে, কিন্তু কোথাওই জিওং মী র খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ক্রমশঃ অন্ধকার হয়ে আসা সেই ঘরের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে তুমি তোমার শুকনো চোখদুটো কচলাচ্ছিলে। যতক্ষণ না ওখানে চামড়াটা জ্বালা করতে শুরু করল, তুমি কচলেই যাচ্ছিলে। তুমি জিওং ডে র ডেস্কটায় বসতে চেষ্টা করলে একটু, তারপর সেই ঠান্ডা মেঝেতে মুখটা গুঁজে তুমি পড়ে রইলে। তোমার হাত দুটো ভাঁজ করে পাঁজরের খোঁদলের মধ্যে যেখানটা ধুকপুক করছে সেখানে নিয়ে রাখলে। যদি এখন জিওং মী দরজাটা ঠেলে ঢুকে আসত, তুমি হয়তো একছুটে ওর কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে ওকে বলতে যে চলো আমরা প্রভিন্সিয়াল অফিসের সামনে জমা করে রাখা লাশগুলোর মধ্যে থেকে জিওং ডে’র শরীরটা খুঁজে নিয়ে আসি। না তোমার বন্ধু? তুমি কি মানুষ নও? এই বলেই জিওং মী তোমায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিত। আর তখন তুমি ওর কাছে ক্ষমাভিক্ষা করতে।

জিওং মী কেও ওর ভাইএর মতই বয়সের তুলনায় ছোট দেখায়। তার মধ্যে ওর ছোট করে ছাঁটা ববকাট চুল পিছন থেকে দেখলে যে কেউ ওকে মিডল স্কুল বা এমনকি প্রাইমারি স্কুলের সিনিয়রও ভাবতেই পারে, অথচ এ বছর ও কিন্তু উনিশে পা দিয়েছে। সামনে থেকে দেখলেও, বিশেষ করে যখন খুব হালকা প্রসাধন করে, ওকে বড়জোর হাইস্কুলের ফার্স্ট ইয়ার বলে মনে হয়। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে পা ওর ফুলে যায়, তবুও হেঁটে হেঁটে কাজে যাওয়া আসার সময় ও হাই হীল জুতো পরবেই। কাউকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওয়া তো অনেক দূরের কথা, ওর নরম গলার কথা শুনলে ও আদৌ কখনো রাগতে পারে বলেই ভাবা যায় না। অথচ জিওং ডে বলে কিছু কিছু ব্যাপারে ওর মতামত খুব স্পষ্ট, আর বিতর্কে নিজের অবস্থান ধরে রাখার মত যথেষ্ট ক্ষমতা ও রাখে। লোকে জানেনা, কিন্তু আসলে আমার বাবার থেকেও বেশী গোঁয়ার

এই যে গত দু বছর ধরে ওরা তোমাদের লাগোয়া ঘরটায় ও আর জিওং ডে থাকছে, এর মধ্যে একবারও জিওং মীর সাথে তোমার ঠিক সেভাবে কোনো কথা হয়নি। ও একটা কাপড়ের কারখানায় কাজ করে আর সেখানে প্রায়ই ওকে রাতের শিফটে কাজ করতে হয়। জিওং ডে’রও প্রায়ই বাড়ি ফিরতে রাত হত – ওর ওই কাগজ পাকানোর চক্করে – ওর দিদির কাছে অবশ্য ভান করত যেন লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করছিল বলে – সেজন্য প্রথম বছর শীতে ওদের ঘরের কয়লার আগুনটা প্রায়ই নিভে যেত। যেসব সন্ধেয় ও ওর ভাইএর আগে ঘরে ফিরে আসত, তুমি দরজায় একটা মৃদু টোকা শুনতে পেতে। কানের পাশে ছোট চুলের গোছা, মুখে রাজ্যের ক্লান্তি, আগুনটা একটু --- মনে হত যেন ঠোঁটদুটো খুলে কথাটা উচ্চারণ করতেও ওর পরিশ্রম হচ্ছে। আর তখন প্রতিবারই তুমি এক লাফে উঠে দৌড়ে গিয়ে একটা চিমটে দিয়ে ফায়ারপ্লেস থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে জিওং মীর হাতে ধরা একটা লম্বা হাতলের প্যানে সেটা দিয়ে দিতাম। ধন্যবাদ, বলতো ও, নইলে কী যে করতাম জানিনা

গত বছর এক শীতের সন্ধেবেলা প্রথম তোমাদের মধ্যে ওই হাতে গোনা বাক্যালাপের বাইরে কিছু কথাবার্তা হয়েছিল। জিওং ডে যথারীতি স্কুল থেকে ফিরেই ওর ব্যাগটা এক কোনায় ফেলে দিয়েই ওর পেপার রাউন্ডের জন্য বেরিয়ে গেল। ও তখনো ফেরেনি, সেই সময়ে তুমি দরজায় একটা টোকার আওয়াজ পেলে, যেটা নিঃসন্দেহে জিওং মী রই। এত মৃদু সেই টোকা, যেন ও ভয় পাচ্ছে, ওর হাতের টোকায় কাঠটা ভেঙে না যায়, অথবা যেন ওর আঙুলগুলো ন্যাকড়া দিয়ে মোড়ানো। তুমি সোজা দরজা খুলে বাইরে রান্নাঘরটায় চলে এসেছিলে।

“আমি ভাবছিলাম কি – মানে, তোমার কাছে ফার্স্ট ইয়ারের কোনো বই আর নেই মনে হয়, তাই না?”

“ফার্স্ট ইয়ার?” তুমি বোকার মত সেই কথাটারই প্রতিধ্বনি করলে, আর ও বলল যে আসলে ডিসেম্বর থেকে শুরু হতে চলা রাতের স্কুলে ও ভর্তী হবে ভাবছে।

“প্রেসিডেন্ট পার্কের হত্যার পর চারপাশটা অনেক পালটে গেছে। শ্রমিক আন্দোলন ক্রমশঃ জোরদার হচ্ছে, এখন আর ওপরওয়ালারা আমাদের জোর করে ওভারটাইম করাতে পারে না। শুনছি আমাদের মাইনেও নাকি বাড়বে এবার। এটা একটা দারুণ সুযোগ আমার কাছে – আমি এটা হারাতে চাইনা। আমি আবার পড়াশোনা শুরু করব। তবে আমি তো অনেকদিন স্কুলে যাইনি, যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকেই আবার শুরু করা যাবে বলে মনে হয় না। তাই অন্য কিছু করার আগে ফার্স্ট ইয়ারে যেসব পড়াশুনা করেছিলাম সেগুলো আরেকবার ঝালিয়ে নিতে চাই প্রথমে – তারপর যখন জিওং ডে’র ছুটি শুরু হয়ে যাবে, ততদিনে আমিও সেকেন্ড ইয়ারের পড়া শুরু করতে পারব।“

তুমি ওকে একটু দাঁড়াতে বলে ওপরের লফটে উঠে গেলে। যখন হাতভর্তি পাঠ্য আর সহায়ক বইগুলো নিয়ে তুমি নেমে এলে, ওর চোখ গোল গোল হয়ে গেল।

“ও মা – কী ভালো ছেলে গো তুমি, এগুলো সব রেখে দিয়েছিলে! আমাদের জিওং ডে তো পরীক্ষা শেষ হতে না হতে সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়”। বইগুলো নিয়ে ও আবার বলল, “জিওং ডে কে এসব কথা কিছু বোলো না যেন। ও ভাবে যে ওর জন্যই আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি, আর সে জন্য ওর দুঃখের শেষ নেই। এখন তাই প্লীজ ওকে এসব কিছু বলার দরকার নেই, অন্ততঃ যতদিন আমি হাইস্কুলের এন্ট্রান্স পরীক্ষাটা পাশ না করছি।“

এই অভূতপূর্ব একটানা বকবকানি আর তার উজ্জ্বল চোখের ঝকঝকে দৃষ্টি দেখে তুমি হাঁ হয়ে গেলে। যেন কুঁড়ি ফুটে ফুল ফোটার মত উজ্জ্বলতা ছিল সেই চোখে।

“হয়তো জিওং ডে ইউনিভার্সিটি চলে যাবার পরে আমিও ওর পিছন পিছন চলে যেতে পারি, বলো? কে বলতে পারে, ভালো করে পড়াশোনা করলে আমিও পারব না?”

তখন অবশ্য তোমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল যে ও সত্যিই এই পড়াশোনার ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে পারবে কি না? কোনোদিন যদি জিওং ডে ঘরে এসে দেখে ও বইখাতা ছড়িয়ে বসে পড়াশোনা করছে, ওদের ওই ছোট্ট এক কামরার ঘরে কোথায় গিয়ে বা লুকাবে ও? ঐ রোগাপটকা চেহারার পিছনে? তাছাড়া জিওং ডে অনেক রাত অবধি জেগে হোমওয়ার্ক করে, কাজেই সে ঘুমিয়ে পড়লে ও পড়তে বসবে, সেটাও সম্ভব না।

অল্প কদিনের মধ্যেই অবশ্য সেই সন্দেহের জায়গায় আরও ঘনিষ্ঠ কল্পনারা জায়গা করে নিতে শুরু করেছিল। ঘুমন্ত জিওং ডে’র মাথার কয়েক ইঞ্চি দূরে সেই নরম আঙুলগুলো তোমার বইটার পাতাগুলো ওল্টাচ্ছে। সেই মৃদুভাবে নড়ে ওঠা ঠোঁট থেকে সেই কথাগুলো বেরিয়ে আসছে – মাকী ভালো ছেলে গো তুমি, এগুলো সব রেখে দিয়েছিলে!... আর সেই চোখদুটো। সেই ক্লান্ত হাসি। দরজায় সেই আলতো টোকা। তোমাদের লাগোয়া ঘরটায়, যেখানে কদিন আগেও তুমি রাত কাটিয়েছ, জিনিষপত্র নয়ছয় করেছ, সেখানে কী কী ঘটে চলছে সেসব ভেবে ভেবে দীর্ণবিদীর্ণ হচ্ছিলে তুমি। ভোরবেলা যখন ও দরজা খুলে উঠোনের কলে এসে হাতমুখ ধুতো, তুমি চোখে একরাশ ঘুম নিয়েও লেপটা সরিয়ে চুপিচুপি তোমার দরজার কাছে এসে কান পেতে সেই শব্দ শুনতে।