
হান কাং এর হিউম্যান অ্যাক্টস- বাংলা তরজমা
- 07 July, 2025
- লেখক: রৌহিন
১
ছেলেটি। ১৯৮০
‘বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে’ তুমি নিজের মনেই বিড়বিড় করছ।
ঝমঝমিয়ে নামেই যদি, কী করব আমরা?
তুমি চোখটা অল্প করে খুলেছ – যাতে একটা সরু আলোর রেখাই ঢুকতে পারে বড়জোর – তারপর সামনের জিংকোগাছগুলির ফাঁক দিয়ে প্রাদেশিক কার্য্যালয়টির দিকে নজর দিয়েছ। যেন ওই ডালপালাগুলির ফাঁকে হাওয়া যেন রূপ নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠবে এক্ষুণি। যেন বৃষ্টির ফোঁটাগুলি ঝুলে আছে বাতাসে – মণিমুক্তোর মত চকচক করছে – ওপর থেকে খসে পড়ার আগে এক মুহুর্ত দম নিয়ে নিচ্ছে।
চোখটা এবারে তুমি পুরোটা খুলেছ – গাছের অবয়বগুলি আবছা, অস্পষ্ট হয়ে এল যেন। নাহ, এবারে তোমার একটা চশমা লাগবে শিগগিরই।
ঝরণার দিক থেকে একটা কোলাহল আর হাততালির শব্দ ভেসে এসে ভাবনাটাকে কিছুক্ষণের জন্য ওলোটপালোট করে দিল। তোমার দৃষ্টিশক্তির যতটা বারোটা বাজার ছিল, বেজেই গেছে মনে হয় – চশমা না নিয়ে এবারে আর পার পাবে বলে মনে হয় না।
‘নিজের ভালো যদি সত্যিই বোঝো তো আমার কথা শোনো। ঘরে ফিরে এসো। এখনই।‘
মাথা নেড়ে এসব স্মৃতির ভার ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছ তুমি – তোমার ভাইএর স্বরে যে রাগের স্পর্শ, সেটাকেও। ঝরণার ওদিক থেকে মাইক্রোফোনে তরুণী বক্তা মেয়েটির স্পষ্ট গলার তীক্ষ্ণ স্বর ভেসে আসছে। মিউনিসিপালের জিমনাসিয়ামে যাবার সিঁড়িগুলি উঠে গেছে যেখানে, সেই পথে এই ঝরণাটা এখান থেকে চোখে পড়ে না। এই স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান এমনকি দূর থেকে এক ঝলক দেখতে হলেও তোমাকে বিল্ডিংটার ডানদিক দিয়ে ঘুরে অন্যদকে যেতে হবে। কিন্তু তুমি সে চেষ্টা না করে এখানেই বসে বসে চুপচাপ শুনে যাচ্ছ সেই বক্তৃতা।
“হে আমার প্রিয় ভাইবোনেরা, আমাদের প্রিয়জনেদের আজ রেড ক্রস হাসপাতাল থেকে এখানে নিয়ে আসা হচ্ছে”
এরপর সেই মেয়েটির নেতৃত্বে সেই চত্বরে সমবেত জনতা একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে উঠল। সহস্র কন্ঠের যোগদানে অল্প সময়ের মধ্যেই তার কন্ঠস্বরটি হারিয়ে গেল – সেই সমবেত স্বর যেন মাটি থেকে উঠতে উঠতে ক্রমশঃ আকাস ছুঁয়ে ফেলছিল। সেই সুরেলা ধ্বনি একটা পেন্ডুলামের মতো কখনো উঁচুতে চড়ছিল, আবার পরক্ষণেই নেমে আসছিল খাদে। তোমার নিজের মৃদু গুনগুন স্বর প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না।
আজ সকালে তুমি যখন জানতে চেয়েছিলে কতগুলি মৃতদেহ আজ রেড ক্রস হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে, জিন সুই ঠিক যতটুকু না বললেই নয়, সেটুকুই বলেছিল উত্তরেঃ তিরিশজন। জাতীয় সঙ্গীতের সুরের ওঠা-নামা, বিরতির মধ্যেই একে একে তিরিশটা কফিন ট্রাক থেকে নামানো হবে। আজ সকালে তুমি আর জিন-সু মিলে যে আঠাশটা কফিন পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছিলে, তার পাশেই ওগুলোও রাখা হবে – জিম থেকে ঝরণাটা অবধি টানা লম্বা একটা সারিতে। গতকাল সন্ধের আগে অবধি তিরাশিটার মধ্যে ছাব্বিশটা কফিন তখনো যৌথ স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে আনা হয়নি – কাল সন্ধ্যার পরে আরও দুটো বেড়ে সংখ্যাটা আঠাশে দাঁড়িয়েছিল – কারণ আরও দুটি পরিবারের লোক এসে আরও দুটি দেহকে চিহ্নিত করার পর দ্রুত কাজ চালানোর মত আচারবিধি সেরে সেদুটিকেও কফিনে পুরে ফেলা হয়েছিল। লেজারে তাদের নাম আর কফিন নাম্বারগুলি নোট করে বন্ধনীর মধ্যে তুমি “যৌথ স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান” কথাগুলিও জুড়ে দিয়েছিলে। জিন-সু বলেছিল, কোন কফিনগুলির স্মৃতিচারণ হয়ে গেছে তা পরিস্কার হিসাব রাখতে – যাতে একই কফিন দুবার না বার করতে হয়। এইবারেরটা অন্তত তুমি ওখানে গিয়ে পুরোটা দেখতে চেয়েছিলে, কিন্তু জিন-সু তোমাকে জিমেই থাকতে বলে দিয়েছে।
“অনুষ্ঠান চলাকালীন কেউ চলে আসতে পারে হয়তো – তাঁদের আত্মীয়ের খোঁজে – এখানে লক্ষ্য রাখার জন্য তাই কারুর থাকা দরকার।“
তোমার সাথে আর যারা কাজ করে, সকলেই তারা তোমার থেকে বয়সে বড় এবং তারা সকলেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গেছে। তাদের বুকের বাঁ দিকে পিন দিয়ে কালো ফিতে আটকানো। শোকগ্রস্ত মানুষগুলি যারা এই কদিন কফিনের সামনে নজরদারিতে বসেছিল, তাদের পিছন পিছন ধীর, জড়োসড়োভাবে যেন ময়লা কাপড় আর বালি ঠাসা কাকতাড়ুয়ার মতন সারি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ইউন-সুক পিছনে দাঁড়িয়েছিল – তুমি যখন ওকে কথাটা বললে, ও ওর উঁচু দাঁতটা বের করে হেসে বলল, “ঠিক আছে, যাও ওদের সাথে”। বেকায়দায় পড়ে যখনই ও হাসে, ওর ওই উঁচু দাঁতটা বেরিয়ে পড়ে ওকে কেমন দুষ্টু মেয়ের মত দেখায়।
“ঠিক আছে, আমি শুধু শুরুটুকু দেখেই এক্ষুণি চলে আসছি”
এবারে নিজের মত করে তুমি জিমে যাওয়ার সিঁড়িটার ওপর একটা কালো পিচবোর্ডকে ভাঁজ করে বানানো মলাটের লেজারটাকে হাঁটুর ওপর রেখে বসলে। তোমার ট্র্যাকস্যুটের নীচ দিয়ে কংক্রিটের ধাপগুলির ঠান্ডা তোমার পায়ে উঠে আসছে। গায়ের জ্যাকেটটার সবগুলো বোতাম আটকে নিয়ে হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে জড়োসড়ো হয়ে বসেছ তুমি।
জবা এবং তিন সহস্র রি জুড়ে অপূর্ব নদী ও পাহাড় ---
জাতীয় সঙ্গিতের সাথে গাইতে গাইতে এখানেই থেমে গেছ তুমি। “অপূর্ব নদী ও পাহাড়” গাইতে গাইতে চিনা ভাষা শেখার সময়ে “অপূর্ব”র দ্বিতীয় অক্ষর নিয়ে সেসব ঘটনা তোমার মনে পড়ে গেছে। তোমার এখন সেসব আর মনে আছে কি না, ভাবছ – এত রকমের অক্ষর ওতে! মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে – নদী আর পাহাড়, যেখানে ফুলেরা সব অপূর্ব, নাকি নদী ও পাহাড়গুলি ফুলের মতই অপূর্ব? মনে মনে তুমি ঐ নদী ও পাহাড়ে হোলিহকের ছবি ভাবছ – তোমাদের বাড়ির বাগানে যেমন ফুটত, গরমকালে এত উঁচুতে, যে তোমার আর হাত যেত না। শক্ত আর লম্বা কান্ডের ওপর ফুলগুলি ফুটত যেন ছেঁড়া সাদা কাপড়ের টুকরো সব। ছবিটা যাতে আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে মনের ভিতর, সেইজন্য তুমি চোখটা বন্ধ করেছ। একবার এক পলকের জন্য চোখতা একটু মেলতেই দেখতে পেলে জিংকোগাছগুই হাওয়ায় দুলছে। একফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি এখনো।
জাতীয় সঙ্গীত শেষ, কিন্তু কফিনগুলো নিয়ে কিছু দেরি হচ্ছে মনে হল। হতে পারে এতগুলো কফিন বলেই দেরি হচ্ছে। মানুষজনের কথাবার্তা, সাড়াশব্দের মাঝ থেকে মাঝেমধ্যে মৃদু কান্নার আওয়াজ আসছে। মাইক হাতে মেয়েটি প্রস্তাব করল, যতক্ষণ কফিনগুলি রেডি না হছে, সবাই মিলে আরিরাং গানটি গাওয়া হবে।
যে তুমি আমায় ছেড়ে যাও এখানে
পায়ে ব্যথা করবে তোমার, মেরেকেটে দশ রি পথ যাবারও আগে…
গান থেমে গেলে মেয়েটি বলল, “এখন মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশে আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করব”। কয়েক হাজার লোকের উপস্থিতির গুঞ্জন মুহুর্তে থেমে গেল – যেন কেউ একটা মিউট বোতাম টিপে দিয়েছে – সেই নৈঃশব্দ্য যেন তার প্রকট উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। এই এক মিনিটের নীরবতা দেখতে তুমি উঠে দাঁড়ালে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেলে – যেটার একখানা পাল্লা খুলেই রাখা ছিল। প্যান্টের পকেট থেকে তোমার সার্জিকাল মাস্কটা বের করে তুমি পরে নিলে মুখের ওপর।
এই মোমবাতিগুলো কোনো কাজের না।
জিমের হলটায় ঢুকে চাপা দুর্গন্ধে দমবন্ধ করা বাতাসটা একটু সামলে নিলে তুমি আগে। এখন মাঝদুপুর – কিন্তু আধা-অন্ধকার হলঘরটা যেন গোধুলির আলোছায়ার মত হয়ে আছে। যেসব কফিনগুলির স্মৃতিচারণা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, সেগুলি দরজার পাশে সারিবদ্ধভাবে একসাথে রাখা আছে। অন্যদিকে বড় জানালাটার নীচে যে বত্রিশটি দেহ এখনো কোনো আত্মীয় পরিজন এসে সনাক্ত করে কফিনে পোরেননি, সেগুলি সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা আছে। তাদের প্রত্যেকের মাথার কাছে খালি পানিয়ের বোতলে লাগানো মোমবাতিগুলি মৃদু দপদপ করছে।
সেই প্রশস্ত হলঘরের আরও ভিতরদিকে তুমি হেঁটে যাচ্ছ, যেখানে সাতটি মৃতদেহ আলাদাভাবে রাখা আছে একপাশে। অন্য দেহগুলির গলা পর্যন্ত চাদর টানা – যেন তারা ঘুমাচ্ছে মাত্র – কিন্তু এই দেহগুলি আপাদমস্তক ঢাকা। একমাত্র যখন কেউ কোনো বাচ্চা মেয়ে বা কোনো শিশুর খোঁজে আসছেন, তখনই একটুখানির জন্য এদের মুখের আবরণগুলি সরানো হচ্ছে। অন্যথায় এ দৃশ্য সর্বসাধারণের চোখের পক্ষে খুবই নিষ্ঠুর।
এমনকি এই দেহগুলিতেও বীভৎসতার আলাদা আলাদা মাত্রা আছে। সবচেয়ে দূরেরটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। প্রথম যখন তুমি তাকে দেখেছিলে, সদ্য টিন এজ পার করা কিংবা কুড়ির ঘরে পা রাখা একটি ছোটখাটো চেহারার মেয়ে, মুখটা তখনো একটু একটু ঠাহর করা যাচ্ছে; এখন সেই শরীর ফুলে গিয়ে একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষের আকার হয়ে গেছে প্রায়। যখনই কেউ নিজের কোনো হারিয়ে যাওয়া বোন অথবা মেয়েকে খুঁজতে আসছে, তুমি তার মুখের কাপড়টা একবার করে সরাচ্ছ, আর শরীরটা আরও কতটা পচন ধরেছে দেখে চমকে যাচ্ছ প্রতিবারই। তার কপাল থেকে বাঁ চোখ, থুতনি থেকে চোয়াল, বুকের বাঁদিক থেকে বাহুমূল পর্যন্ত তীক্ষ্ণ ছুরির ক্ষতগুলোয় হাঁ হয়ে মাংস বেরিয়ে আছে। মাথার খুলির ডানদিকটা পুরোটাই গর্ত – সম্ভবত কোনো মুগুর জাতীয় কিছুর আঘাতে, মগজের ভিতরের মাংস ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। এই উন্মুক্ত ক্ষতগুলিই প্রথমে পচতে শুরু করেছিল, তারপরে ওর ছিন্নভিন্ন শরীরের আরও অজস্র ক্ষত ও কালশিটেগুলি। সুন্দর করে পেডিকিওর করা ওর পায়ের আঙুলগুলি শুরুতে অক্ষতই ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেগুলো ফুলে যেন আদার কন্দের মত হয়ে এখন ক্রমশ কালো হয়ে গেছে। জলবিন্দুর ছোপছোপ যে স্কার্টটা ওর পায়ের গোড়ালি অবধি ছিল, সেটা এখন ওর ফুলে যাওয়া হাঁটুগুলোকেও ঢেকে রাখতে পারছে না।
কয়েকটা নতুন মোমবাতি নেবার জন্য তুমি দরজার কাছের টেবিলটায় এলে, তারপর আবার সেই কোনার শরীরটার কাছে ফিরে গেলে। পুরনো মোমটার নিভু-নিভু আলোকবর্তিকা থেকে তুমি তোমার হাতের মোমটা জ্বালালে, তারপর আগেরটাকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে কাচের বোতলটা থেকে উপড়ে ফেলে নতুন মোমটা সন্তর্পনে বসিয়ে দিলে, আগুনের শিখা থেকে নিজের হাত বাঁচিয়ে।
তখনো গরম থাকা নিভন্ত মোমবাতির টুকরোটাকে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে তুমি ঝুঁকে তাকালে। সেই তীব্র দুর্গন্ধটাকে সইয়ে নিতে নিতেই নতুন শিখাটার ঠিক মাঝখানে চোখ রাখলে তুমি। স্বচ্ছ শিখাটা অবিরত তিরতির করে কেঁপে চলেছে – যেন এই ঘরের মধ্যে ভারী পর্দার মতন ঝুলে আছে যে মৃত্যুর ঘ্রাণ, তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে ওটা। কমলা রঙের শিখাটার ঠিক মাঝখানটা যেন কোনো জাদুকর – ওর উত্তাপ যেন চোখে দেখা যাচ্ছে। চোখগুলো সরু করে তুমি মন দিয়ে দেখছ শিখার সেই মাঝখানটা – যেখানে প্রকম্পিত শিখাটি মোমের পলতেটাকে জড়িয়ে ধরে নাচছে – সেই প্রকম্পিত শিখা দেখে তোমার একটা হৃদয়ের আকারের কথা মনে পড়ছে – নাকি, আপেলের বীজের মতন?
এবারে ওই গন্ধটা আর নিতে না পেরে তুমি সোজা হয়ে দাঁড়ালে। আধো-অন্ধকার সেই ঘরের ভিতর দিয়ে একবার চোখ বোলালে তুমি – সবকটা জ্বলন্ত মোমবাতির শিখাগুলির দিকে – তাদের কম্পমান আলোগুলি সব শান্ত হয়ে যাওয়া চোখের মণিগুলিকে আলোকিত করছিল।
হঠাৎই একটা প্রশ্ন জাগল তোমার মাথায়ঃ শরীর যখন মরে যায়, আত্মাটার কী হয়? কতক্ষণ অবধি সেটা তার পুরনো ঘরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে?
পুরো ঘরটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলে তুমি ভালোভাবে – দেখে নিলে আর কোনো মোম নিভু-নিভু হয়ে আছে কি না, পাল্টাতে হবে কি না, তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেলে।
কোনো জীবিত মানুষ যখন কোনো মৃত মানুষের মুখের দিকে তাকায়, এমন কী হতে পারে না যে সেই মৃত মানুষের আত্মাটিও তখন তার নিজের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে?
ঠিক দরজা দিয়ে বাইরে পা রাখার আগের মুহুর্তে তুমি মাথাটা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালে একবার। না, এখানে কোনো আত্মা টাত্মা নেই – আছে শুধু এই নীরব দেহগুলি, আর ওই তীব্র ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ।
শুরুতে এই ব্যায়ামাগারে নয়, প্রদেশ অফিসের অভিযোগ বিভাগের বারান্দায় দেহগুলি সারি দিয়ে রাখা হয়েছিল। দুজন মহিলা ছিলেন – তাঁরা তোমার থেকে বয়সে সামান্য কয়েক বছরের বড় – একজন একটা চওড়া কলারের স্কুল ইউনিফর্ম পরে ছিলেন, আরেকজন সাধারণ পোষাকে। বেশ কিছুক্ষণ তুমি তাকিয়েছিলে শূন্য চোখে – কেন এখানে এসেছ তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে, ওঁরা তখন একটা ভিজে কাপড় দিয়ে মৃতদেহগুলির মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন – তাদের শক্ত হয়ে থাকা হাতগুলি চেপেচুপে তাদের শায়িত শরীরের পাশে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
“বলো তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” স্কুলের পোষাক পরা মেয়েটি তার মুখাবরণীটি টেনে নামাতে নামাতে তোমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করেছিল। ওর গোল গোল চোখদুটিই ছিল সবচেয়ে সুন্দর, যদিও সেগুলি সামান্য ঠেলে বেরিয়ে আসার মত লাগছিল, আর চুলগুলি দুটি বিনুনি করে বাঁধা ছিল। ছোটছোট কয়েক কুচি চুল সেই বিনুনির বাঁধন থেলে বেরিয়ে ওর ঘর্মাক্ত কপালে আর রগের পাশে লেপ্টে ছিল।
“আমি আমার এক বন্ধুকে খুঁজছি” রক্তের গন্ধে অনভ্যস্ত তুমি নিজের নাকের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে বলেছিলে।
“তোমাদের এখানে দেখা করার কথা ছিল?”
“না। ও ওই এদের মধ্যে –”
“ওহ, আচ্ছা। বেশ, তুমি চাইলে এসে একবার দেখে নিতে পারো, এখানে আছে কি না।“
একে একে সেই বারান্দায় শোয়ানো কুড়িটা মানুষের দেহ আর মুখ পরীক্ষা করে দেখলে তুমি। ঠিকঠাক বুঝতে হলে খুব ভালোভাবে দেখে নিতেই হত তোমার – কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার চোখ টনটন করতে শুরু করল, দৃষ্টি ঠিক রাখার জন্য বারবার চোখ পিটপিট করছিলে তুমি।
“এখানে পাওয়া গেল না?” অন্য মেয়েটি এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল। ওর জামার হাতাগুলো কনুই অবধি গোটানো। তুমি হয়তো ভেবেছিলে এই মেয়েটিও ওই স্কুল ইউনিফর্ম পরা মেয়েটির বয়সিই হবে, কিন্তু এখন মাস্ক নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর বুঝলে এর বয়স একটু বেশী – সম্ভবতঃ কুড়ির আশেপাশে হবে। ওর চামড়াটা একটু পাতলামতন – আর খুব সুন্দর ঋজু ঘাড়। শুধু ওর চোখের দৃষ্টিটাই কঠিন এবং তীব্র। আর তার গলার স্বরেও কোনো দুর্বলতার লক্ষণ ছিল না।
“না”
“জেওন্নামের সমাধিক্ষেত্র বা রেড ক্রসের হাসপাতালটায় খোঁজ করেছিলে?”
“হ্যাঁ”
“তোমার বন্ধুর মা-বাবা কোথায়?”
“ওর মা নেই। বাবা দেজোন এ চাকরি করেন। ও আমাদেরই পাড়ায় ওর দিদির সাথে থাকে।“
“লং ডিস্ট্যান্স কলে এখনো কোনো যোগাযোগ করা যায়নি?”
“না। আমি নিজেই বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি।“
“আর তোমার বন্ধুর দিদি? তার কী খবর?”
“ও সেই রবিবার থেকে আর বাড়ি ফেরেনি। আমি এখানে ওকে খুঁজতেও এসেছিলাম। আমাদের একজন প্রতিবেশী বললেন কাল যখন সৈন্যরা গুলি চালাচ্ছিল, ওঁরা আমার বন্ধুকে গুলি খেতে দেখেছেন।“
“হতেও তো পারে যে ও শুধু আহত হয়েছে, এখন কোনো হাসপাতালে ভর্তি আছে?” স্কুল ইউনিফর্ম পরা মেয়েটি এবার বলে উঠল এদিকে না তাকিয়েই।
তুমি মাথা নেড়ে না জানালে।
“না, তাহলে ও ঠিকই কোনোভাবে আমাদের কাউকে ফোন করে জানাত। ও নিশ্চই বুঝত যে আমরা ওর জন্য দুশ্চিন্তা করছি।“
“কাল আবার এসো, দরকার হলে পরশু বা তার পরেরদিনও” হালকা সবুজ শার্ট পরা মেয়েটি বলল, “মনে হচ্ছে এবার থেকে সব মৃতদেহগুলো এখানেই আনা হবে – বলছে মর্গে নাকি আর জায়গা নেই।“
স্কুল ইউনিফর্ম পরা মেয়েটি একটি যুবকের মুখ মুছিয়ে দিল – বেয়নেটের আঘাতে তার গলাটা ফালা হয়ে লাল আলজিভটা দেখা যাচ্ছে। যুবকটির তাকিয়ে থাকা চোখ দুটির ওপর দিয়ে নিজের হাতের তালুটা বুলিয়ে সেগুলিকে বন্ধ করে দিয়ে মেয়েটি পাশের একটা বালতিতে হাতের কাপড়টা ধুয়ে নিয়ে খুব জোরে নিংড়াল। কাপড়টা থেকে যে জলটা বেরিয়ে এল তা রক্তে ঘন হয়ে আছে, বালতির বাইরেও চিটকে পড়ল কয়েক ফোঁটা। সবুজ শার্ট পরা মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো।
“তোমার সময় থাকলে আমাদের একটু সাহায্য করতে পারো?” সে জানতে চাইল, “শুধু আজকের দিনটা। আমাদের লোকের অভাব খুব। কাজটা এমন কিছু কঠিন না – ওই যে বড় কাপড়টা দেখছ, ওটা কেটে কেটে এই শরীরগুলোকে ঢেকে দিতে হবে শুধু। তারপর যদি কেউ তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুকে খুঁজতে আসে, এই যেমন তুমি এলে, তখন ওটা নামিয়ে তাদের দেখাতে হবে। মুখগুলো তো খুব বীভৎস হয়ে আছে – তাই হয়তো শরীরটাও দেখাতে হবে – সেখানে কোনো চিহ্ন বা জামাকাপড় দেখে যদি যাকে খুঁজতে এসেছে তাকে চিনতে পারে।“
সেদিন থেকেই তুমি ওদের দলেরই একজন হলে। যেমন আন্দাজ করেছিলে, ইউন-সুক তার হাই স্কুলের শেষ ক্লাসে পড়ছে – আর সিওন জু, সবুজ শার্ট পরা মেয়েটি বাজারের রাস্তায় একটা দরজির দোকানে মেশিন চালায়। ওর মালিক যখন তার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেকে নিয়ে ওন্য শহরে গিয়ে থাকার মনস্থ করল তখন ওকে কার্যত রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিল। ইউন-সুক আর সিওন-জু, দুজনেই যখন ঘোষণা শুনল যে জিওন্নামে রক্তক্ষরণের ফলে মানুষ মারা যাচ্ছে, তারা সেখানে রক্ত দিতে গেছিল। সেখানেই তারা শোনে যে প্রদেশ অফিসটি এখন জনগণের পরিচালনায় চলছে এবং সেখানে লোকের অভাব, এবং তারা বিভ্রান্ত অবস্থায় আছে, তারা দুজনে এই মৃতদেহগুলির দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়।