জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল - গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী - পর্ব ২৮

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল

(গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী)

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদঃ অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – আঠাশ

রাতে যখন বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকত না, তখন মা আমাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে বাবার চিঠি পড়ে শোনাতেন। বেশির ভাগ চিঠিই ছিল প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে নজর ঘোরানোর উদ্দেশ্যে বিশেষ মুন্সিয়ানায় লেখা। তবে তারই মধ্যে তিনি বিশদে লিখতেন নিম্ন মাগদালেনায় বয়স্ক লোকেদের মধ্যে কেমনভাবে হোমিওপ্যাথির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ‘এখানে এমন কিছু জিনিষ আছে যা জাদুকরী বলে মনে হবে,’ বাবা লিখেছিলেন। কখনও কখনও এমন ভাবে লিখতেন যে আমাদের মনে হত খুব শীঘ্রই তিনি একটা বড় কিছু ঘোষণা করতে চলেছেন, কিন্তু বাস্তবে যেটা হত তা হল আরেক মাসের নিস্তব্ধতা। সেমানা সান্তার সময় আমার দুই ভাই চিকেন পক্সে আক্রান্ত হল বাবাকে খবর দেওয়া গেল না, কেননা খুঁজে বের করার অতিবড় বিশেষজ্ঞও তখন তাঁর গতিবিধির সন্ধান করতে পারত না।

    এই সময়ে বুঝতে পেরেছিলাম বাস্তব জীবনে আমার দাদু-দিদিমার বহু উচ্চারিত একটি কথার অর্থ – দারিদ্র্য। যখন তাঁদের সঙ্গে থাকতাম তখন আমার কাছে এই শব্দের অর্থ ছিল কলা কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই বাড়ির যে অবস্থার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাই। এটা নিয়ে সবসময় তাঁরা অভিযোগ করতেন। তখন আর আগের মতো খাবার টেবিলে দু’বার বা তিনবার পাত পড়ত না, পড়ত শুধু একবার। টেবিলের পবিত্র নিয়ম রক্ষা করার জন্য যখন বাড়িতে বিশেষ কিছুই থাকত না তখন বাজারের ভিতরের দোকান থেকে বেশ ভালো ও খুবই সস্তা খাবার কিনে আনা হত। এতে আরেকটা ভালো ব্যাপার হত – আমরা ছোটরা ওই খাবার খেতে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু এই ব্যবস্থাটা বন্ধ হয়ে গেল যখন মিনা জানতে পারলেন যে খাবার আর আগের মতো ভালো নেই বলে ঘন ঘন আসে এমন একজন অতিথি আর না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

    বিপরীতে বাররানকিয়ায় আমার বাবা-মার দারিদ্র্য ছিল ক্লান্তিকর। তবে সৌভাগ্যক্রমে এই দারিদ্র্যের ফলে মায়ের সঙ্গে আমার একটি ব্যতিক্রমী সম্পর্ক তৈরি হল। তাঁর চরিত্রের জন্য স্বাভাবিক অনুগত ভালোবাসার চাইতে অনেক বেশি অভূতপূর্ব শ্রদ্ধা অনুভব করতাম। তিনি ছিলেন সেই শান্ত সিংহী যিনি প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হলেই ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। আর একটা কারণ হল ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, যা নিবেদনের চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধং দেহী। এই দুটি গুনের জন্য এমন একটি আত্মবিশ্বাস তিনি অর্জন করেছিলেন যা কখনও ব্যর্থ হয়নি। অতি কষ্টের সময়েও দৈবশক্তির জন্যই তিনি হাসতে পারতেন। যেমন একবার তিনি একটি ষাঁড়ের হাঁটু কিনলেন আর তাই সেদ্ধ করে দিনের পর দিন আমাদের দিলেন। ক্রমশ তা পাতলা হতে হতে যখন আর কিছুই বের হল না তখন শেষ করলেন। এক রাতে প্রচন্ড ঝড়ের পর যখন সারা রাত বিদ্যুৎ ছিল না তিনি সারা মাসের জন্য রাখা শুয়োরের চর্বি খরচ করে সলতে পাকিয়ে আলো জ্বালিয়েছিলেন আর বাচ্চাদের অন্ধকার নিয়ে বিরাট ভয় দেখালেন যাতে তারা বিছানা থেকে না নামে।

    প্রথম দিকে বাবা-মা আরাকাতাকা থেকে আগত বন্ধুদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তাঁরা এসেছিলেন প্রধানত কলা কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর গন্ডগোল শুরু হওয়ায়। এই যাওয়া-আসায় সর্বক্ষণ যে বিষয় নিয়ে কথা হত তা হল দুর্ভাগ্য কিভাবে সেই শহরকে গ্রাস করেছে। কিন্তু বাররানকিয়াতে যখন দারিদ্র্য আমাদের গ্রাস করল তখন আর অন্য কারু বাড়ি গিয়ে অভিযোগ করতাম না। আমার মা একটি মাত্র বাক্যে তা প্রকাশ করতেনঃ ‘দারিদ্র্য চোখে লেখা থাকে।’

    পাঁচ বছর বয়স অবধি আমার কাছে মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক পরিণতি যা অন্যদের জীবনে ঘটে। স্বর্গসুখ আর নরক যন্ত্রণা দুটোই ছিল ফাদার আস্তেতের ধর্মশিক্ষার ক্লাসের জন্য মুখস্ত করার বিষয়। এ সবের সঙ্গে যেন আমার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু যেদিন আমি একটি শবদেহের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম যে মরা মানুষটার মাথা থেকে উকুন বেরিয়ে বালিশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন যেটা আমাকে নাড়া দিল তা মৃত্যুভয় নয়, বরং মৃত্যুর পর সব আত্মীয়দের চোখের সামনে আমার মাথা থেকেও উকুন বেরিয়ে পড়বে তার জন্য বিব্রত বোধ। যাই হোক, বাররানকিয়ায় প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় বুঝতেও পারিনি যে আমার মাথায় উকুনে ভরে গেছে আর তা বাড়ির সবার মাথায় ছড়িয়ে পড়েছে। তখন মায়ের চরিত্রের আরেকটা দিক দেখতে পেলাম। ছেলেমেয়েদের একজন একজন করে ধরে আরশোলা মারার ওষুধ দিয়ে সমস্ত উকুন ছাড়ালেন আর এই নিধনযজ্ঞের নামকরণ করলেন এক সম্ভ্রান্ত বংশের নামে – পুলিশ। কিন্তু মুশকিল হল আবার সবার উকুন হল, কেননা আমি স্কুল থেকে নিয়ে এসেছিলাম। তখন মা একেবারে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিলেন ও আমার মাথা ন্যাড়া করে দিলেন। পরের সোমবার একটা কাপড়ের টুপি পরে স্কুলে হাজির হওয়াটাই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। তবে বন্ধুদের রঙ্গ-ব্যঙ্গ থেকে সসম্মানেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলাম এবং সে বছর সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলাম। পরে আর কোনোদিন কাসালিনাস স্যারের সঙ্গে দেখা হয়নি, তবে তাঁর প্রতি আমি চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ।

    বাড়ির কাছের এক ছাপাখানায় ছুটিতে কাজ জুটিয়ে দিলেন আমার বাবার এক বন্ধু, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি। মাইনে ছিল শূণ্যের থেকে একটু বেশি। তবে আমার প্রধান উৎসাহ ছিল কাজ শেখায়। কিন্তু ছাপার যন্ত্রটাকে আমি এক মিনিটের জন্যও দেখতে পারিনি, কারণ আমার কাজ ছিল সম্পূর্ণ অন্য জায়গায় – লিথোগ্রাফের প্লেট সাজিয়ে রাখা। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল যে মা আমার মাইনে থেকে ‘লা প্রেন্সা’-র রবিবাসরীয় কাগজটা কিনতে দিয়েছিলেন। সেখানে কমিক স্ট্রিপ প্রকাশিত হত – টারজান, বাক রজার্স, যার নাম ছিল ‘রোহেলিয়ো এল কনকিস্তাদোর’ (বিজয়ী রোহেলিয়ো) আর মাট ও জেফ কমিক, যার নাম ছিল ‘বেনিতিন ও এনেয়াস’। রবিবারের ছুটিতে আমি স্মৃতি থেকে এই সব কমিকের ছবি আঁকতাম আর সপ্তাহের পর্বগুলোকে নিজের মতো করে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতাম। এমনকি প্রতিবেশী বয়স্কদের মধ্যেও কমিকের এমন আগ্রহ তৈরি করেছিলাম যে তাদেরকে ওই ছবি ও গল্প দুই সেন্তাভোতেও বিক্রি করতে পেরেছিলাম।

    কাজটা ছিল ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে। যত পরিশ্রম করেই কাজ করি না কেন উর্ধতনেরা সব সময়ই অভিযোগ করতেন যে আমার কাজের উৎসাহ নেই। আমার পরিবারের প্রতি সহমর্মীতায় আমাকে রুটিন বাঁধা কাজের থেকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হল আর রাস্তায় রাস্তায় একটি কাশির সিরাপের বিজ্ঞাপণের কাগজ বিলি করতে দেওয়া হল। এই সিরাপের বিজ্ঞাপন করতেন সিনেমার সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। আমার কাজটা বেশ সুবিধাজনক মনে হল, কেননা মসৃণ কাগজের উপর রঙিন ঝকঝকে ছবি খুবই সুন্দর লাগত। কিন্তু কাজে নেমে বুঝতে পারলাম এই বিলি করা যত সহজ মনে করেছিলাম তা আদৌ নয়। বিনা পয়সায় দেওয়া হত বলে লোকেরা ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখত আর অধিকাংশই বিরক্ত হয়ে এমন ছিটকে সরে যেত যে মনে হত যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। প্রথম কয়েকদিন ছাপাখানায় ফিরে আসতাম বিলি করার পর যা বেঁচে থাকত সেইগুলো নিয়ে যাতে বোঝা যায় কতগুলো দিতে পেরেছি। কিন্তু একদিন আরাকাতাকার স্কুলের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাদের মা চমকে উঠলেন আমাকে এরকম ভিখিরির মতো কাজ করতে দেখে। তারপর ন্যাকড়ার চটি পরে রাস্তায় বেরিয়েছি বলে রীতিমতো চিৎকার করে আমায় বকলেন। আমার মা-ই ওই জুতো কিনে দিয়েছিলেন যাতে বুট জুতোটা পরে নষ্ট না করে ফেলি।

  • লুইসা মার্কেসকে বোলো,’ বন্ধুর মা আমায় বললেন, ‘তার বাবা-মা তাঁদের আদরের নাতিকে এইভাবে রাস্তায় সিরাপের বিজ্ঞাপন বিলি করে বেড়াচ্ছে দেখলে কি বলবেন সেটা যেন একবার ভাবে।’

মায়ের খারাপ লাগবে বলে তাঁকে সেকথা বলিনি। কিন্তু বহু রাতে বালিশে মাথা রেখে রাগে-দুঃখে অনেক কেঁদেছি। এই নাটকের শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর কাগজ বিলি করব না; তার বদলে বাজারের নর্দমায় সেগুলো ফেলে দিতাম। অবশ্য ভাবতেও পারিনি যে সেই জল স্থির হওয়ার জন্য আর কাগজগুলো চকচকে ও মসৃন বলে সেগুলো সব এক হয়ে জলের উপর রঙিন চাদরের মতো ভেসে থাকবে আর সেতুর উপর থেকে সেই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখা যাবে।

আমার মা নিশ্চয়ই তাঁর প্রিয় মৃত আত্মাদের কাছ থেকে স্বপ্নে কিছু জানতে পেরেছিলেন, কেননা দু’মাস শেষ হওয়ার আগেই কাজ থেকে আমায় বের করে আনলেন। তবে কেন করলেন সে ব্যাপারে কিছুই বললেন না। ‘লা প্রেন্সা’-র রবিবাসরীয় কেনার জন্য কাজ ছাড়তে চাইনি আমি। ওই কাগজটা আমাদের পরিবারের কাছে ছিল স্বর্গের আশীর্বাদের মতো। কিন্তু আমার মা তা বন্ধ করেননি, ঝোলে একটা আলু কম পড়লেও না। অন্য আরেকটি আশীর্বাদ ছিল সব থেকে কষ্টের মাসগুলোয় হুয়ানিতো মামার পাঠানো টাকা। তিনি সান্তা মার্তাতেই থাকতেন ও স্বল্প মাইনের অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করতেন। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে তিনি আমাদের একটা চিঠি পাঠাতেন যার মধ্যে এক পেসোর দুটো নোট থাকত। আমাদের পারিবারিক বন্ধু আউরোরা লঞ্চের ক্যাপ্টেন সকাল সাতটার সময় আমার হাতে সেই চিঠি দিতেন আর বেশ কয়েকদিনের মতো বাজার করে তবে আমি বাড়ি ফিরতাম।

এক বুধবার আমি যেতে পারিনি বলে মা লুইস এনরিকেকে বাজারে পাঠালেন আর সে চিনাদের দোকানে ওই দু’ পেসো দ্বিগুন করার যন্ত্র দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। প্রথম দুটো টোকেন দিয়ে হেরে যাওয়ার পরেও সে থামতে পারেনি, উপরন্তু সেই দুটো ফেরত পাওয়ার আশায় শেষ পেসোটা পর্যন্ত খেলায় লাগিয়ে দিল। ‘আমি এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম,’ বড় হয়ে আমায় বলেছিল এনরিকে, ‘যে ঠিক করেছিলাম আর কখনও বাড়ি ফিরব না।’ সে ভালোভাবেই জানত যে ওই দুটো পেসো দিয়েই এক সপ্তাহের ভাত-ডাল জুটবে। ভাগ্যক্রমে শেষ টোকেনটা দিতেই মেশিনটায় কিছু গোলমাল হয়। তার ভেতরটা ভূমিকম্পের মতো কাঁপতে থাকে আর নষ্ট হয়ে যাওয়া দু’পেসোর বিনিময়ে যতগুলো টোকেন দিয়েছিল তার সবকটা উগড়ে দেয়। ‘তখন আমার মাথায় দৈত্য ভর করেছিল,’ আমাকে বলল লুইস এনরিকে, ‘আবার সাহস করে একটা টোকেন দিলাম মেশিনে।’ আর সে জিতে গেল। আবার ঝুঁকি নিয়ে একটা টোকেন দিল। আবার জিতে গেল। তারপর একটা দিল, আরেকটা এবং জিতে নিল। ‘তখন টাকা নষ্ট হওয়ার থেকেও বেশি ভয় হচ্ছিল আর গা গুলাচ্ছিল,’ সে বলেছিল আমায়, ‘তবুও খেলা ছাড়তে পারিনি।’ সে মূল দু’পেসোর দ্বিগুন পরিমাণ জিতেছিল, কিন্তু তা পেয়েছিল খুচরো পাঁচ সেন্তাবোয়। তবুও সে দোকান থেকে খুচরোর বদলে টাকার নোট নেয়নি পাছে চিনারা তার সঙ্গে কিছু জুয়োচুরি করে এই ভয়ে। খুচরোয় তার পকেটটা এমন ভরে গিয়েছিল যে হুয়ানিতো মামার দেওয়া দু’ পেসো পাঁচ সেন্তাবোয় মাকে দেওয়ার আগে যে চার পেসো জিতেছিল তা উঠোনের এক কোনায় পুঁতে রেখেছিল। এরকম ভাবে উপরি পাওনা তার কত সেন্তাবো যে ওখানে পোঁতা ছিল! একটু একটু করে সে ওই টাকা খরচ করত এবং বহু বছর পর্যন্ত এই রহস্য সে কাউকে জানায়নি। তারপর একদিন লোভে পড়ে ওই চিনা দোকানেই শেষ পাঁচ সেন্তাবো নষ্ট করে ফেলে।

টাকার সঙ্গে লুইস এনরিকের সম্পর্কটা ছিল একেবারেই ব্যক্তিগত। একবার মায়ের ব্যাগ থেকে বাজারের টাকা চুরি করলে মা ধরে ফেলেন। তখন তার যুক্তি ছিল খুবই উদ্ভট কিন্তু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট – বাবা-মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা নিলে তা চুরি করা হয় না কারণ ওই টাকা সবার জন্য, কিন্তু তাঁরা আমাদের দিতে চান না কেননা ছেলেমেয়েরা টাকা নিয়ে যা করে তা ওঁরা করতে পারেন না বলে আমাদের হিংসে করেন। আমি তার যুক্তির সমর্থনে দাঁড়ালাম, এতটাই যে আমিও বললাম খুব প্রয়োজন পড়ায় আমিও মায়ের লুকানো জায়গা থেকে টাকা নিয়েছি। এতে মায়ের মাথা এত গরম হয়ে গেল যে চিৎকার করে আমাকে বললেন, ‘বোকার মতো কথা বোলো না। না তুমি না তোমার ভাই তোমরা কেউই আমার কাছ থেকে টাকা চুরি করতে পারো না। কেননা আমি সেরকম জায়গাতেই টাকা রাখি যাতে তোমাদের দরকার পড়লে সেটা নিতে পারো।’ রাগের বশে তাঁকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছিলাম যে সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য চুরি করলে সময়ে সময়ে ভগবানও পাপ দেন না।

লুইস এনরিকের দুষ্টুমির স্বকীয়তা আমাদের দুজনের সমস্যা সমাধানেই কাজে লাগত। তবে সে কোনোদিন তার কুকর্মে আমায় সঙ্গী করেনি। বরং সে এমনভাবে কাজ করত যাতে আমার উপর বিন্দুমাত্র সন্দেহ না হয় আর এর ফলে তার প্রতি যে স্নেহ আমার ছিল তা সারা জীবনেও নষ্ট হয়নি। অন্যদিকে সে কোনোদিন জানতে পারেনি সাহসের জন্য আমি কতখানি তাকে হিংসে করতাম বা বাবা যখন তাকে মারতেন কী কষ্টটাই না পেতাম। তার আচরণ থেকে আমার আচরণ ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, কিন্তু মাঝে মাঝে রীতিমতো কষ্ট করে হিংসে চেপে রাখতাম। তবে কৃমির ওষুধ বা ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ানোর জন্য আমায় যখন মামার বাড়ি কাতাকায় ঘুমোতে পাঠানো হত আমি খুবই বিরক্ত হতাম। এতটাই যে ভালো করে ওষুধ খেয়ে নেওয়ার জন্য বিশ সেন্তাবো আমায় দেওয়া হলেও মন ভালো হত না।

মায়ের হতাশা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল তখন তিনি একটা চিঠি দিয়ে আমাকে এক ভদ্রলোকের কাছে পাঠালেন যিনি সম্পদে ও বদান্যতায় শহরের শীর্ষে ছিলেন। তাঁর দরদী মন ও তাঁর আর্থিক সাফল্য উভয়ই সর্বজনবিদিত ছিল। মা সেই চিঠিতে সরাসরি আর্থিক সাহায্যের কথা লিখেছিলেন, তবে তাঁর নিজের জন্য নয়, কেননা সবকিছুই তিনি সহ্য করতে পারেন, চেয়েছিলেন শুধু ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে।  মাকে যারা ভালোভাবে চিনত একমাত্র তারাই বুঝতে পারবে এটা তাঁর পক্ষে কী চরম লজ্জাজনক। কিন্তু পরিস্থিতির দাবী এমনটাই ছিল। আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে এই ব্যাপারটা শুধু আমাদের দুজনের মধ্যেই গোপন থাকবে, তাই ছিল এতদিন, এই লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত।

বাড়িটার সঙ্গে কোথাও একটা গীর্জার মিল ছিল। সদর দরজায় কড়া নাড়তেই একটা ছোট্ট জানলা খুলে গেল এবং সেখানে যে মহিলাকে দেখা গেল তার শুধু বরফশীতল চোখটাই মনে আছে আমার। কোনও কথা না বলে সে চিঠিটা নিল ও ফিরে জানলাটা বন্ধ করে দিল। তখন সকাল এগারোটা বাজবে। দরজার গোড়ায় বসে রইলাম বিকেল তিনটে পর্যন্ত। তারপর ভাবলাম আরেকবার কড়া নাড়ব উত্তরের জন্য। সেই মহিলাই আবার আবির্ভূত হল, আমাকে চিনতে পেরে অবাক হল আর আমাকে এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলল। তারপর আবার এসে বলল পরের সপ্তাহে মঙ্গলবারে একই সময়ে আসতে। তাই করলাম। তখনও বলল যে এক সপ্তাহের আগে কিছুই হবে না। আরও তিনবার গিয়েছিলাম, প্রতিবার একই উত্তর পেতাম। তারপর প্রায় দেড় মাস বাদে আবার গিয়েছি, আগের মহিলার চেয়েও রুক্ষ এক মহিলা ভদ্রলোকের হয়ে আমাকে জানাল যে ওই বাড়িটা কোনও দানছত্র নয়।

উত্তপ্ত রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ভাবছিলাম মাকে কী জবাব দিলে আশাহত হবেন না। মায়ের কাছে যখন ফিরে গেলাম তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। যন্ত্রণা-দগ্ধ হৃদয়ে মাকে জানালাম যে সেই সদাশয় মানুষটি বেশ কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল ওই লোকটির আত্মার শান্তি কামনা মায়ের প্রার্থনা।

চার-পাঁচ বছর পরে যখন রেডিয়োতে আমরা শুনলাম আগের দিন ওই পরোপকারী লোকটির সত্যিকারের মৃত্যু হয়েছে তখন মায়ের কী প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম না কী করে তিনি সেই সংবাদ মন দিয়ে শুনলেন ও দরদভরা কন্ঠে বললেন,

  • ওঁর আত্মার চিরশান্তি হোক!’

বাড়ির কাছেই মোস্কেরা পরিবারের সঙ্গে আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাঁরা অনেক পয়সা খরচ করে কমিক বই কিনতেন আর উঠোনে একটা শেডের নিচে তা স্তুপীকৃত করে রেখে দিতেন। আমরাই ছিলাম একমাত্র ভাগ্যবান যারা সেখানে প্রায় সারাদিন ধরে ডিক ট্র্যাসি ও বাক রজার্স পড়তে পারতাম। আরেকটি সৌভাগ্য আবিষ্কার করেছিলাম কাছের লাস কিন্তাস সিনেমা হলে। সেখানে এক নবিশ সিনেমার পোস্টার আঁকত। তাকে আমি সাহায্য করতাম শুধুমাত্র অক্ষর আঁকার আনন্দে আর সে সপ্তাহে দু’-তিন বার বন্দুকের লড়াই বা মুষ্টিযুদ্ধের ভালো ভালো সিনেমা বিনা পয়সায় দেখতে দিত। শুধুমাত্র একটাই মনোরঞ্জনের জিনিষ আমাদের ছিল না, তা হল রেডিও। যে কোনও সময় একটা বোতাম টিপলেই যে গান শোনা যায়, তা পারতাম না। আজ এটা কল্পনা করাই শক্ত গরীবের বাড়িতে তখন কত কী জিনিষের অভাব ছিল। লুইস এনরিকে আর আমি পাড়ার মোড়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকতাম যেখানে নিষ্কর্মা খড়িদ্দারের দল এসে গুলতানি মারত। আর সারাটা বিকেল সেখানে কাটাতাম সব রকমের জনপ্রিয় গান শুনে, কেননা বেশিরভাগ প্রোগ্রামে তাই শোনা যেত। এর ফলে আমাদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল মিগেলিতো বালদেসের সমস্ত গান, কাসিনো দে লা প্লাইয়ার অর্কেস্ট্রার সঙ্গতে। তাছাড়াও মনে ছিল সোনোরা মাতানসেরার সঙ্গতে দানিয়েল সান্তোসের গান ও তোইন্যিয়া লা নেগ্রার কন্ঠে আগুস্তিন লারার বোলেরো। দু’ বার বিল জমা দিতে না পারায় বাড়ির ইলেকট্রিক সংযোগ কেটে দিয়েছিল। সেই দুই দিন সারা রাত ধরে মাকে আর ভাইবোনেদের সেই গানগুলো আমরা শিখিয়েছিলাম। লিহিয়া আর গুস্তাবো কিছুই না বুঝে তোতাপাখির মতো সেগুলো শিখে নিয়েছিল আর তাদের সেই মজার, অর্থহীন গান আমাদের দারুণ মাতিয়ে রেখেছিল। কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। আমরা সবাই বাবা-মার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম গান মনে রাখার স্মৃতি ও দু’বার শুনেই একটা গান শিখে নেওয়ার দক্ষতা। সবচেয়ে উপরে ছিল লুইস এনরিকে। সে জন্মেই ছিল সঙ্গীতকার হয়ে এবং নিজে নিজেই গিটার বাজানো শিখেছিল। সে একা বাজাতো বিরহের গান। শীঘ্রই আমরা আবিষ্কার করেছিলাম যে প্রতিবেশী যে সব ঘরে রেডিও নেই তাদের বাচ্চারা আমাদের ভাইবোনেদের কাছ থেকে গান শিখে ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি শিখেছে আমার মায়ের কাছ থেকে, যিনি এই ছেলেমেয়েদের সভায় আরেকজন মেয়ে হয়ে গিয়েছিলেন।

আমার প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘লা ওরা দে তোদো উন পোকো’ (সব প্রহরের অংশ)। সঙ্গীতকার, গায়ক ও পরিচালক আনহেল মারিয়া কামাচো ই কানো এই অনুষ্ঠানে বেলা একটার সময় থেকে বিভিন্ন ধরণের অসাধারণ সব গানে শ্রোতাদের অভিভূত করে রাখতেন, বিশেষ করে পনের বছরের নিচের বাচ্চাদের জন্য সময়টায়। শুধু ‘লা বোস দে লা পাত্রিয়া’ (জাতির স্বর) অফিসে নিজের নাম লেখাতে হত আর অনুষ্ঠানের আধ ঘন্টা আগে পৌঁছতে হত। কামাচো ই কানো নিজে পিয়ানো বাজাতেন আর তাঁর একজন সহকারীর দায়িত্ব ছিল বাচ্চারা কেউ সামান্য ভুল করলেই অমার্জনীয় দন্ড দিতে গীর্জার ঘন্টার মতো একটা ঘন্টা বাজিয়ে গান থামিয়ে দেওয়া। সবচেয়ে ভালো যে গাইতে পারত তার জন্য ছিল অকল্পনীয় পুরষ্কার – পাঁচ পেসো। কিন্তু মা স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যে এরকম একটি বিখ্যাত অনুষ্ঠানে ভালো করে গান গাইতে পারাটাই সবচেয়ে বড় কথা।

তখনও পর্যন্ত শুধু বাবার পরিবারের পদবী – গার্সিয়া আর ব্যাপটিজমের সময়কার দুটো নাম – গাব্রিয়েল হোসে, এই ছিল আমার পরিচয়। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ঘটনার দিন মা আমাকে বললেন তাঁর পরিবারের ‘গার্সিয়া’ পদবী ব্যবহার করতে যাতে আমার পরিচয় নিয়ে কারুর কোনও ধন্দ না থাকে। এটা ছিল ঘরোয়া ব্যাপার। প্রথম কমিউনের মতো আমাকে ধবধবে সাদা পোশাক পরানো হল আর বেরোবার আগে দেওয়া হল এক চামচ পটাশিয়াম ব্রোমাইড। লা বোস দে লা পাত্রিয়ার অফিসে পৌঁছলাম দু’ ঘন্টা আগে। কাছের একটি পার্কে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনুষ্ঠানের পনের মিনিট আগেই ভেতরে ঢুকতে দেবে। ওষুধের ঘোর কেটে গেল ওখানেই। প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে আর মনে হচ্ছে যেন আমার ভিতরে বেড়ে উঠছে ভয়ের অসংখ্য মাকড়সা। শেষ পর্যন্ত যখন ভেতরে গেলাম আমার বুক ধরফর করতে লাগল। ইচ্ছে করছিল বাড়ি ফিরে গিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে না পারার ব্যাপারে যা হোক একটা গল্প বানিয়ে বলে দেব। কিন্তু সেটা না করার জন্য নিজেকে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করতে হচ্ছিল। কামাচো ই কানো পিয়ানোয় দ্রুত আমার পরীক্ষা নিলেন আমার স্বর বুঝে নিতে। নাম লেখানোর ক্রম অনুযায়ী যে সাতজনকে ডেকেছিল তাদের তিনজনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ভুল হওয়ায় ঘন্টা বাজল। তারপর আমাকে ডাকল শুধু গাব্রিয়েল মার্কেস বলে। আমি গাইলাম ‘এল সিসনে’ (রাজহাঁস)। একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ গান যার বিষয়বস্তু হল একটি রাজহাঁস যে বরফকণার থেকেও সাদা, তাকে ও তার প্রেমিকাকে মেরে ফেলেছে এক হৃদয়হীন শিকারী। প্রথম চরণ গাইবার পরেই বুঝতে পারলাম যে আমার জন্য স্কেলটা অনেক উঁচু হয়ে গেছে, বিশেষত কয়েকটি স্বরের ক্ষেত্রে। তাছাড়া মহড়ার সময় এই পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। তারপর মুহূর্তের জন্য আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম যখন সহকারী একটা সন্দেহের ভাব দেখালেন ও প্রস্তুত হলেন ঘন্টা বাজানো জন্য। আমি জানিনা কোথা থেকে শক্তি পেয়েছিলাম, কিন্তু ইশারায় তাঁকে বারণ করলাম ঘন্টা বাজাতে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। হৃদয়হীন ঘন্টাটা বেজে উঠল। পাঁচ পেসো, তৎসহ বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন উপহার সবকিছুই পেল এক সুন্দরী ব্লঁদ মেয়ে যে ‘মাদামে বাটারফ্লাই’-এর একটা গান বেশ খারাপই গাইল। পরাজয়ে বিদ্ধস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলাম আর মা এত হতাশ হলেন যে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া ছিল অসম্ভব। অনেক বছর পরে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি অত লজ্জিত হয়েছিলেন কেননা আত্মীয়-বন্ধুদের আগে থেকে বলে রেখেছিলেন আমার গান শুনতে, তাই তাদের এড়িয়ে যাওয়ার পথ ছিল না।

টীকা

১। সেমানা সান্তা –ইস্টারের পূর্ববর্তী সাত দিনকে বলা হয় পবিত্র সপ্তাহ।