![](https://othervoice.in/uploads/1119.jpg)
২০২৪-এর ঐতিহাসিক গণরায় প্রসঙ্গে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
- 09 June, 2024
- লেখক: দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
ভারতীয় গণতন্ত্র ২০২৪-এর নির্বাচন থেকে পেল শক্তিশালী ও জরুরি এক উদ্দীপনা। এই নির্বাচনে মোদীর কোনো ভাষণবাজিই কাজ করেনি। জীবিকা, স্বাধীনতা, সংবিধান ও ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার কেন্দ্রীয় এজেন্ডায় জনতার আত্মঘোষণার সামনে বিজেপিকে দিশেহারা দেখিয়েছে। আজ পর্যন্ত যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে এবারের নির্বাচনই ছিল সর্বাপেক্ষা অসম এবং তা এমন এক নির্বাচন কমিশনের হাতে পরিচালিত হয়েছে, যা সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহির বাধ্যবাধকতাকে পদে পদে অবজ্ঞা করেছে। তারা এমন আচরণ করেছে যেন সেটি সরকারি প্রশাসনের বর্ধিত অঙ্গ মাত্র। বিরোধীপক্ষ অনেক দেরিতে একজোট হয়। পরিস্থিতির দাবি অনুসারে যে মাত্রার সংঘবদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও গতিময়তা দরকার ছিল তা বিরোধীজোট দেখাতে পারেনি। এ সত্ত্বেও জনগণ তাদের সক্রিয় হতে বাধ্য করেছে এবং স্বেচ্ছাচারী ফ্যাসিবাদী বুলডোজারের বিরুদ্ধে নিজেদের উদ্যমকে চালিত করার মাধ্যম হিসাবে এই জোটকে জনগণ কাজে লাগিয়েছে। ইন্ডিয়া জোটের মঞ্চের বাইরে এই নির্বাচন বাস্তব ক্ষেত্রে যথার্থই হয়ে উঠেছিল জনগণের এক আন্দোলন, যার পিছনে ছিল নাগরিক আন্দোলনের কর্মীবাহিনী এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সক্রিয় যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টিকারী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নাগরিক সম্প্রদায়ের সমর্থন।
১৯৭৭-এর পুনরাবৃত্তি ঘটা ২০২৪-এ বোধকরি সম্ভব ছিল না। তার একটা বড় কারণ হলো ১৯৭৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর, আর ২০২৪-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাস ও নিপীড়ন অব্যাহত থাকার পরিস্থিতিতে, যেখানে জরুরী অবস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ২০২৪ আবার ২০০৪-এর মতোও ছিল না। বিজেপি ২০০৪ সালে মোদী জমানার বিজেপির মতো শক্তিশালী ছিল না এবং বিরোধীপক্ষ - বিশেষভাবে কংগ্রেস, বাম এবং আঞ্চলিক ও সামাজিক ন্যায়-এর শিবিরভুক্ত দলগুলো তখন ততটা দুর্বল ছিল না, যতটা তারা পরবর্তীকালে দশকব্যাপী মোদী শাসনের সময়ে হয়ে পড়ে। এ সত্ত্বেও ২০২৪ সাল আধুনিক ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এক ঐতিহাসিক রায়ের জন্ম দেওয়ার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
রায়টা ফলদায়ক হয়েছে বিশেষভাবে এই কারণে যে সাংসদ সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনটে বৃহত্তম রাজ্য - উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবাংলার রায় উল্লেখযোগ্য চরিত্রেরই হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে এনডিএ-র শরিক হয় আরএলডি এবং বিজেপির নির্দেশে বিএসপিও যথেষ্ট সন্দেহজনক ভূমিকা পালন করে। তা সত্ত্বেও এসপি-কংগ্রেস জোট যে অনবদ্য ফল করে তা মোদী-শাহ-যোগী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের আত্মঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা হিসেবে দেখা দিয়েছে। খোদ অযোধ্যাতেই ইন্ডিয়া ব্লকের জয় হয়েছে। এই অসংরক্ষিত আসনে এক বরিষ্ঠ দলিত নেতার বিজয় জনগণের দ্বারা সংঘের এজেন্ডার প্রত্যাখ্যানের প্রতীক হিসেবে বিবেচনাযোগ্য। কৃষক আন্দোলনের উদ্যম, বিপুল বেকারত্ব এবং বিশেষভাবে অগ্নিবীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে যুব সম্প্রদায়ের ক্ষোভ এবং সংবিধান রক্ষায় দলিত-বহুজন সম্প্রদায় এবং স্বাধীনতা-প্রেমী নাগরিকদের দৃঢ়তা, এ সবই সম্মিলিতভাবে দেশের অনেকাংশেই এক গণ অভ্যুত্থানের রূপ পায়।
রূপের দিক থেকে নির্বাচনী ফলাফল স্বতন্ত্র ও বিচিত্র ধারার হলেও ঐ রায়কে নানান রাজ্য নির্বাচনের সমষ্টি হিসেবে গণ্য করলে ভুল হবে। উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশে লোকসভার সঙ্গেই রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয এবং এ কথাও ঠিক যেেই সব রাজ্যে বিজেপি রাজনৈতিক শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবর্তনের জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষার ওপর সওয়ার হতে পেরেছিল। তবে, নির্বাচনী ফলাফলে সার্বিকভাবে কিন্তু মোদী জমানার বিরুদ্ধে এক সর্বভারতীয় বার্তা স্পষ্টভাবেই ধরা পড়েছে। কেউ প্রমাণ চাইলে পশ্চিমবাংলার জোরালো ধরনের ফলের দিকে তাকাতে পারেন। ঐ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস যথেষ্ট প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার মুখে পড়েছিল, ইন্ডিয়া জোট বিভাজিত হয়ে গেছিল এবং অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন যে লোকসভা নির্বাচন রাজ্য সরকারের কার্যকলাপের ওপরই এক গণভোটে পর্যবসিত হবে। কিন্তু বাস্তবে ফল হয়েছে অন্যরকম এবং তা বিজেপির বিপক্ষে গেছে। অন্ধ্র ও উড়িষ্যার মতো কয়েকটা রাজ্য ছাড়া বিজেপি বস্তুত সারা ভারতেই ভোট ও আসন হারিয়েছে। অন্ধ্র ও উড়িষ্যায় ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারগুলো ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। অন্যদিকে তামিলনাড়ু, কেরল ও তেলঙ্গানার মতো দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বিজেপির ভোটের অংশ বাড়ছে এবং সেই বৃদ্ধি আসনেও পরিণত হতে শুরু করেছে। তবে ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও সংহত হওয়ার পথে যে রাজ্যটা প্রধান চরিত্রের হয়ে উঠেছিল, সেই উত্তরপ্রদেশেই বিজেপির সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাওয়ার ঘটনাটা ২০২৪-এর রায়ের কেন্দ্রীয় বিষয় রূপে সামনে এসেছে।
বিহারে ইন্ডিয়া জোটের ফল সম্ভাবনার তুলনায় খারাপ হলেও সবচেয়ে ভালো ফল আরও একবার কিন্তু এসেছে দক্ষিণ বিহারের সাহাবাদ ও মগধ অঞ্চল থেকে। এই অঞ্চলের আটটা আসনে শেষ দিনে ভোট হলেও ইন্ডিয়া জোট ছটা আসনে বিজয়ী হয়েছে এবং আরও দুটো আসনে জোরদার লড়াই করেছে। যে শক্তিগুলো গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য লড়াই করছে সেই শক্তিগুলোর ঐক্যে ও আত্মঘোষণায় রূপদান করতে মুখ্য অবলম্বনের ভূমিকা নিয়েছে সিপিআই (এমএল), এই আটটা আসনের তিনটেয় লড়াই করে সে দুটোতে বিজয়ী হয়েছে। এরই সাথে পার্টিকে ভোজপুরের আগিয়াঁও (এসসি সংরক্ষিত) আসনেও বিধানসভা উপনির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এক মিথ্যা মামলায় পার্টির বিধায়ক মনোজ মঞ্জিল অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে বিধায়ক থাকতে না পারায় ঐ উপনির্বাচন অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং পার্টি ঐ আসনেও ভালো ব্যবধানে বিজয়ী হয়। অন্য যে রাজ্যে সিপিআই(এমএল) ইন্ডিয়া জোটের সমর্থনের ভিত্তিতে প্রার্থী দেয় তা হলো ঝাড়খণ্ড। তবে, সেখানে পার্টির প্রার্থী বৃহৎ ব্যবধানে দ্বিতীয় হন। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি-বিরোধিতা ভিত্তিক জনগণের ভোট মাত্র পাঁচটা এসটি সংরক্ষিত আসনেই সীমাবদ্ধ কেন রইল তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পার্টি সারা দেশেই বিজেপির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রচার সংগঠিত করেছে, তবে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে ইন্ডিয়া জোটের সমঝোতায় পাওয়া আসনগুলোর ওপরই।
বিহার থেকে দুই এবং রাজস্থান থেকে এক, এই তিন সাংসদ হিন্দি বলয় থেকে বিজয়ী হওয়ায় সংসদে বামেদের প্রতিনিধিত্ব উৎসাহজনক মদত পেল। দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ু ও কেরলে যে ছয় সাংসদ আগে থেকেই ছিল এটা তার অতিরিক্ত।
এই নির্বাচনে দেখা গেল মোদী সরকারের প্রশ্নহীন প্রত্যাখ্যান ঘটেছে তবে এনডিএ-কে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করার লক্ষ্যের তুলনায় সামান্য কম মাত্রায় এসেছে গণরায়। এটা ছাড়াও সংসদ এবং তার বাইরে আরও দৃঢ়তাপূর্ণ এবং ঐক্যবদ্ধ বিরোধীপক্ষের উত্থানই হলো ২০২৪-এর নির্বাচনের সবচেয়ে বড় লাভ। টিডিপি ও জেডিইউ-র মতো দলের সমর্থনের ভিত্তিতে সরকার গড়ার মতো সাংসদ সংখ্যা এনডিএ পেতে পারে, তবে মোদী, শাহ এবং যোগীর মতো যে নেতাদের বিরুদ্ধে রায় গেছে তাদের নতুন সরকারের নেতৃত্বে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। বিগত সংসদের স্পিকার তাঁর পক্ষপাতমূলক আচরণ দিয়ে স্পিকার পদকে কলঙ্কিত করে তুলেছিলেন, যিনি নিজেদের সাংসদদের ঘৃণা ভাষণগুলি সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, আর গণতান্ত্রিক বিতর্ক এবং বিরোধী মতকে একতরফা রুদ্ধ করেছিলেন। নতুন সংসদে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং গণতন্ত্র ও সংসদীয় শিষ্টাচারকে ফিরিয়ে আনতে অ-বিজেপি স্পিকার থাকাই বাঞ্ছনীয় হবে। বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ভারত স্বস্তির এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে এবং ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটানোর লক্ষ্যে বৃহত্তর ঐক্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে লড়াই চালাতে হবে এবং তা করতে হবে প্রশাসনের লাগাম টেনে ধরা, আইনের সাংবিধানিক শাসনের পুনরুদ্ধার ঘটানো এবং ভারতের সামাজিক বুনট ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি রদ করার লক্ষ্যে।
(ইংরাজীতে প্রকাশিত এম এল আপডেট সম্পাদকীয়র বাংলা অনুবাদ)