লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ : অমীমাংসিত বিষয় ও আগামী দিনের কর্তব্যগুলি

লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ : অমীমাংসিত বিষয় ও আগামী দিনের কর্তব্যগুলি

২০২৪ সালের ফলাফলের আশাব্যঞ্জক দিকগুলি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। বিজেপির একক গরিষ্ঠতা না পাওয়া আমাদের খানিক আশ্বস্তও করেছে। সংসদে যেমন তেমন আইন পাশ করিয়ে নেওয়া হয়ত এখন অত সহজ হবে না৷ সংবিধান বদল ও হিন্দুরাষ্ট্রের আশঙ্কাও একই কারণে কমেছে, যদিও অন্তর্হিত হয়নি। এসব ভাল দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে যথেষ্ট। সেই খাঁড়াগুলি নিয়ে মনে হয় আলোচনা করা প্রয়োজন যেগুলি এখনও মাথার উপর ঝুলছে।

এক, বিজেপি এখনও একক ভাবে সবচেয়ে বেশি আসন প্রাপক দল। আগের চেয়ে ৬৩ টি আসন কমলেও ২৪০ টি আসন সে একাই পেয়েছে, এবং এর ধারেকাছেও কোনও কোনো দল নেই। ৪৭ টি আসন বাড়িয়ে কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯ টি আসন। একক পার্টি হিসেবে ফার্স্ট ও সেকেন্ড হলেন যাঁরা, তাদের মধ্যে এখনও তুলনা চলে না। একে তাই ফ্যাসিবাদের পরাজয় বলা চলে না। বিজেপির মতো ফিনিক্সীয় একটি দলকে নিয়ে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। হারের পরে তাদের বারবার পুনরুত্থান ঘটে। সামান্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাদের কি খুব সময় লাগবে? পরের লোকসভায় তারা সম্পূর্ণ পরাজিত হবে না শক্তি বাড়িয়ে ফিরবে? – এইসব প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে।

এর উত্তর কী মিলতে পারে তা নির্ভর করছে বিরোধী জোটের উপর। আর এখানেই দ্বিতীয় খাঁড়া। আমরা অনেকেই এখন বিজেপিকে সরকার গড়তে তেলেগু দেশম ও জেডিইউ-এর মতো (অনির্ভরযোগ্য পাল্টিবাজ বলে পরিচিত) শক্তির সাহায্য নিতে বাধ্য হল বলে হাসাহাসি করছি। কিন্তু বিরোধী ইন্ডিয়া জোটে তো শরিক সংখ্যা অনেক বেশি। নাইডু ও নীতীশের মতোই, তাদেরও অনেকের নৈতিক চরিত্রের উপর ভরসা করা যায় না। ছাব্বিশ দলের ছাব্বিশ রকম স্বার্থের সংঘাতে এই জোট কতদিন টিকবে? বিজেপি বিরোধী নাগরিক এই জোটের উপর চরম ভরসা করছেন এটা ঠিক। কিন্তু এর বৃহত্তম শরিক কংগ্রেস বিভিন্ন প্রাদেশিক দলকে তৈলমর্দন করে কতদিন এই জোটকে টেকাতে পারবে – সেই প্রশ্নও রয়েছে।

তিন, আরএসএস বা সংঘপরিবারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কটি এখন জটিল। বিজেপির অন্যতম নেতা যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে সংঘের সম্পর্ক ভাল নয় বলে শোনা যায়। আবার প্রমাণ না পেলেও শোনা গেছে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সংঘ সরকার গড়তে বারণ করেছিল। তা সত্ত্বেও, সম্ভবত নানা দুর্নীতি চাপতে মোদী-অমিত শাহ সরকার গড়ার পথটিই বেছেছেন। অন্তর্ঘাত যাই থাকুক, আরএসএস এখনও বিজেপির চালিকাশক্তি। এই সরকার আরএসএস-এর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তাকে কী ভেট দেবে? নজর থাকবে সেদিকে।

চতুর্থত, এখনও ২৪-২৫ টি রাজ্যে/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বিজেপি এবং তাদের সহযোগীদের দখলে। ভারতের মানচিত্র তাহলে এখনও বহুলাংশে গৈরিক। কর্নাটক, দিল্লি, ওড়িশা আর ঝাড়খন্ড হতাশ করেছে। মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাট তথৈবচ। সিটের হিসেবে ১৫৬ টি সিটে বিজেপি ৫০% এর বেশি ভোট পাচ্ছে। সেইসব জায়গায় জনমত তার মানে প্রবল ভাবে গেরুয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকে আছে। মেরুকৃত ভোট হচ্ছে।

পঞ্চমত, ভোট শতাংশের হিসেবের কথা যখন উঠল, তখন পশ্চিমবঙ্গের কথা বলা যাক। পশ্চিমবঙ্গে এবার বিজেপি ৩৮.৭৩ % ভোট পেল। তা ২০১৯ সালের চেয়ে (৪০.৬%) কম। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে (৩৮.১%) সামান্য বেশিই। তাহলে বিজেপির রথ এ রাজ্যে থমকেছে বা মন্থর হয়েছে ভাবার বোধহয় কারণ ঘটেনি।

ষষ্ঠত, ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে ভোট হয়েছে, তা বিজেপির পশ্চিমবঙ্গে আসন কমারও কারণ, আবার ভোট বৃদ্ধিরও কারণ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানকে মূলত ভোটব্যাংক হিসেবে দেখার সংস্কৃতি তৃণমুলের মধ্যে আগেও ছিল। ভোটব্যাঙ্ক ভাবা আর দরদ সমার্থক নয়। ইমাম ভাতা সাধারণ মুসলমানের কাজে লাগে না, কিন্তু সাধারণ হিন্দুকে উত্তেজিত করার অস্ত্র হিসেবে বিজেপির কাজে লাগে৷ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হওয়া উচিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুগুলির ভিত্তিতে ভোট লড়া। সেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বেশ কিছু জায়গায়। ভিন রাজ্য থেকে এসে, পশ্চিমবঙ্গ বা বহরমপুরকে না চিনে, স্রেফ ধর্মের কারণে তৃণমূলের প্রার্থী হচ্ছেন ইউসুফ পাঠান। জিতছেনও। কিন্তু সেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে।

সপ্তমত, এই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের শাসক ও বিজেপি ছাড়া অন্য বিরোধী দলগুলির বিজেপি-বিরোধে ভূমিকার কথা বলা যাক। তৃণমূল একদা এনডিএ শরিক ছিল। কিন্তু এখন যেহেতু মোটামুটি ব্লক হিসেবেই মুসলমান ভোট তাদের পকেটস্থ হয়, তাই তাদের ওই জোটে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কেন্দ্রীয় ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তৃণমূল ও সর্বভারতীয় সিপিএম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সে জোট কার্যকর হয়নি। ২০২১ বিধানসভা ভোটে কং-সিপিএম জোটকে একেবারেই বিজেপি-বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। নিন্দুকে বলে ২০১৯ সালে সিপিএম লোকসভা ভোটে তলায় তলায় বিজেপির হয়ে খেটেছিল। তবে ২০২৪ এর ভোটে তাদের রণনীতি কিছুটা আলাদা। তারা নিজেদের জন্য লড়েছে ও হেরেছে ও এ কারণেই অনেক জায়গায় বিজেপির হার হয়েছে ও বিজেপির আসন কমেছে। এবারের ভোটে বিজেপি-বিরোধিতার আভাস নেতাদের বক্তৃতায় পাওয়া গেলেও, তৃণমূলকেই সি পি আই (এম) এখনও প্রধান বিপক্ষ হিসেবে নিশানা করে যাচ্ছে। তাদের আশ্চর্য ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব প্রচারে তারা ব্যস্ত থেকেছে, কিন্তু জনমতের চিঁড়ে তাতে ভেজেনি। নিশানার ভুলচুক পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যতেও বজায় থাকলে তা বিজেপির পক্ষে লাভজনক হবে।

অষ্টমত যেটা বলার, দেখাই যাচ্ছে কার্যত বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে আটকে রেখেছে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু সেই দল নিজে সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি সংক্রান্ত নানা মামলার ভারে ন্যুব্জ। রাজ্যসরকারী কর্মচারীরা তাদের উপর ক্ষুব্ধ ডিএ না পাওয়ায়। শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী তাদের উপর ক্ষুব্ধ চাকরির অভাবে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকের চাকরি দেদার বেচেছেন ও সেই টাকা তাঁর বান্ধবীর বাড়িতে থরে থরে পাওয়া গেছে, একথা বাঙালি ভোলেনি। স্থানীয় নির্বাচনগুলিতে, যেমন পঞ্চায়েত পুরসভা নির্বাচনে লাগামছাড়া সন্ত্রাস, ভোট দুর্নীতির মাধ্যমে সেগুলিকে প্রহসনে পরিণত করার কথাও কেউ ভুলে যেতে পারেন না। ২০১৮ তে পঞ্চায়েতে লাগাতার সন্ত্রাস ও ভোট লুঠের প্রেক্ষাপটেই ২০১৯ এ তৃণমূলের ভরাডুবি ও বিজেপির উত্থান হয়েছিল।

এমতাবস্থায় এইবারের লোকসভা নির্বাচনে সংবিধান বাঁচাতে হয়ত বিজেপি বিরোধী জনগণ তৃণমুলকে ভোট দিয়েছেন বা ভোট দিয়েছেন নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে বা ভোট দিয়েছেন তৃণমূল দলটা বিজেপির চেয়ে খানিক কম খারাপ (লেসার ইভিল) ভেবে। কিন্তু দুর্নীতি ও গুণ্ডারাজ একেবারে অসহ হলে তাঁরাই অন্য কোনো দল না পেয়ে বিজেপিকে বেছে নেবেন না তো?

 

শেষত, যেটা ভাবার সেটা হল পশ্চিমবঙ্গের ও ভারতে নাগরিক সমাজের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তব্য কী কী? এখানে যেগুলো খুবই দরকার তা হল -

১) বিজেপির যোগ্যতর বিকল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা ও সম্ভাবনা থাকলে তাতে মদত দেওয়া।

২) তৃণমূলের দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রী  কার্যকলাপের ওপর আন্দোলনের চাপ বজায় রাখা।

৩) আরএসএস বা সংঘপরিবারের হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি কেন ভারতের আত্মার পরিপন্থী, তা মানুষকে বোঝানো ও বুঝিয়ে যাওয়া। এই কাজটা রাজ্যেও করতে হবে, দেশজুড়েও করতে হবে।

আর সর্বভারতীয় স্তরে মূল নাগরিক কর্তব্য কী কী?

১) ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার মতো সর্বভারতীয় বিজেপি-বিরোধী সম্প্রীতিমূলক কর্মসূচী পাঁচটি বছর ধরে বজায় রাখা।

২) নির্বাচিত বিরোধী নেতাদের ও তাদের সমর্থনভিত্তিকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া যে ইন্ডিয়া জোটের প্রতি নেতাকেই বিজেপি-বিরোধিতার শর্তে নির্বাচন করা হয়েছিল। তাই বিজেপি-বিরোধী জোট ভাঙা তাঁদের পক্ষে অনৈতিক।

৩) গণতন্ত্রের সঙ্কট মানে বিভাজনের সঙ্কট। সেই বিভাজনের এক দিকে যেমন আছে ধর্মীয় বিভাজন, জাতপাতের বিভাজন, তেমনি অন্যদিকে আছে সম্পদের ক্রমাগত কেন্দ্রীকরণ, শ্রমিকের আপেক্ষিক মজুরী ও অধিকার হ্রাস, কৃষিক সঙ্কট ইত্যাদি। আছে পরিবেশের সঙ্কট, বিভিন্ন প্রান্তিক পরিচিতির ওপর ক্রমবর্ধমান হামলার সঙ্কট। গণ আন্দোলন ও শ্রেণি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এগুলোর মোকাবিলা ও শাসককে চ্যালেঞ্জ জানানো, নীতি বদলের কর্মসূচীকে জনপ্রিয় আন্দোলনের রূপ দেওয়া আগামী দিনে একটি অতি জরুরী কাজ হিসেবে আমাদের সামনে আছে।

অনেক কিছুই করার আছে। তার মূল কয়েকটির ইঙ্গিৎমাত্র এখানে রইলো। পরে আরো বিস্তারিতভাবে এই নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে রইলো। আরো নানাজনে নানাভাবে সেগুলো নিয়ে বলবেন। সেসব শোনার ও বোঝার চেষ্টা করা দরকার। বিজেপির গতিকে রুখে দেওয়ার আনন্দ-উৎসব অবশ্যই হোক। কিন্তু তারপর দ্রুত কর্তব্যকর্মে ফেরা দরকার।