গণতন্ত্রের লাক্সারিতে গড়ে ওঠেনি আমাদের দল, মানুষের ন্যূনতম গণতন্ত্রের জন্য লড়াইটাই আমাদের অভ্যাস
- 08 June, 2021
- লেখক: দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
(গুরুচণ্ডা৯ ওয়েবজিন এ নীলাঞ্জন হাজরা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের যে সাক্ষাৎকার নেন তিন কিস্তিতে, সেটিই এখানে একত্রিত করা হয়েছে।)
প্রথম পর্ব
‘বিজেপিকে রোখার প্রস্তুতিতে আরও কিছুটা সময় দিল বাংলার ভোটের ফলাফল’
নীলাঞ্জন হাজরা— আজ ১২ মে, ২০২১। কথা বলছি সিপিআই(এমএল)-লিবারেশন নামের রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সঙ্গে। সবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে—অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস(এআইটিসি) পেয়েছে ২১৩ টি আসান, ভারতীয় জনতা পার্টি(বিজেপি) ৭৭ এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট(আইএসএফ) ১ টি। এখন পর্যন্ত বুথ-ওয়াড়ি পরিসংখ্যান আসেনি, কাজেই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তবু, মোটামুটি সার্বিক ধারণার ভিত্তিতে আপনি আমায় বলুন, আপনার কাছে এই ফলাফল কী ইঙ্গিতবাহী?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য— সবথেকে স্পষ্ট যে ইঙ্গিত তা হল, একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে জোর করে ক্ষমতা দখল করে নেবে। এই আশঙ্কা ছিল বলেই আমরা সবথেকে বেশি জোর দিয়েছিলাম যে, বিজেপি-কে হারাও, বাংলা বাঁচাও। তৃণমূল কংগ্রেস ভোট পেয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ, আর বিজেপি ৩৮ শতাংশ। কাজেই ধরে নিতে পারি প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ এই নির্বাচনে বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটা আমার কাছে মনে হয় একনম্বর ইঙ্গিত এবং সবথেকে ভালো ইঙ্গিত।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, আমরা যদি ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে ফিরে যাই তাহলে দেখব, বিজেপির জেতা আসনসংখ্যা ছিল ৩, ভোটের শতাংশ আমার ঠিক মনে নেই সম্ভবত ১০-১২ শতাংশ (১০.১৬), সেই নিরিখে বিজেপি হয়েছে তিন থেকে ৭৭ (৩৮.১৩ %)। এটা শুধু লাফিয়ে বাড়া নয়, বিধানসভায় এই মুহূর্তে বিরোধী বলতে শুধু বিজেপি। সেখান লেফট এবং কংগ্রেস পুরোপুরি আউট। বিরোধীপক্ষের এই যে ছবিটা এটা অবশ্যই একটা বড়ো বিপদের ইঙ্গিত। ফলে, এই নির্বাচনে যে আশঙ্কা ছিল সেইটা ঠেকানো গেছে। বিজেপি কিন্তু মনে করছে আমরা ওয়েটিং লিস্টে আছি। এবারে এটাকে কনফার্মেশন করে দিতে হবে। যেটা ওরা বলছে।
কাজেই, আমি বলছি খানিকটা সময় আমরা পেলাম। আমরা এটাকে ‘বেঙ্গল ব্রিদার’ বলতে পারি, নিশ্বাস নেওয়ার কিছুটা সময় পেলাম।
নী. হা.— এবার আমার প্রশ্ন হল, ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও তৃণমূল কংগ্রেস ৪৭.৯৪ শতাংশ ভোট পেল, যা আগে কখনও পায়নি, এটা তো চাট্টিখানি কথা নয়। এটা কীভাবে সম্ভব হল? তার কোনো বিশ্লেষণ আপনারা করেছেন? এর একাধিক কারণ থাকতে পারে, সে বিষয়ে আপনারা কী ভাবছেন?
দী. ভ.— সার্বিক ভাবে যদি দেখি, এর মধ্যে দুটো দিক আছে। একটা হচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্কে প্রচুর বিক্ষোভের কথা আমরা শুনি, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস তার নিজস্ব ভোটের একটা বড়ো অংশকে ধরে রাখতে পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যাঁরা লেখালিখি করেন, বিশেষ করে ইকনমিস্টরা, তাঁরা বলছেন, এই সরকারের যে বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার স্কিমগুলি চলে সেগুলোর ডেলিভারিতে অবশ্যই কিছু লিকেজ আছে, কিছু হয়তো দুর্নীতি আছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ আছে, কিন্তু ওভার-অল তার যে ডেলিভারি, সেখান থেকে (তৃণমূল কংগ্রেসের) ভোটের একটা ভিত্তি তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বেশ একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যার মানুষ, যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক নন, যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি এবং সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নেই যথেষ্ট বিরোধী, তাঁরা বিজেপি-র বৃহত্তর বিপদটাকে বুঝে, বিজেপির বিরুদ্ধে সবথেকে শক্তিশালী ও ভায়াবল বিকল্প হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ৪৮ শতাংশ ভোটের মধ্যে আমি বলব দুটো ভাগ আছে, একটা সেদলের নিজের ভোট, আর-একটা ভাগ বিভিন্ন কোণ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে জড়ো হয়েছে বিজেপিকে আটকাতে। তার শতাংশের হিসেব এই মুহূর্তে আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু যদি ধরি তার নিজস্ব ভোট ৪০ শতাংশ (গত বিধানসভা নির্বাচনে ছিল ৪৪.৯১ শতাংশ), আট শতাংশ ভোট কিন্তু এই দলকে মানুষ দিয়েছেন বিজেপি-কে আটকাতে।
নী. হা.— এইবারে আমি বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে এই ফলাফলে যে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে, সেগুলি আপনার নজরে এনে, সেগুলির বিষয়ে আপনার মতামত চাইব। প্রথমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এ পর্যন্ত যা বলেছেন, আমার নজরে যা এসেছে—খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ জনপরিসরে করেননি এই ফলাফলের। সার্বিক ভাবে মানুষকে ধন্যবাদ দিয়েছেন বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য। কিন্তু দুটো কথা বলেছেন, যার মধ্যে একটি আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে—তিনি মহিলাদের সমর্থনের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। আর বলেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ভোটের কথা।
এখন এই যে বিপুল সংখ্যক মহিলা ভোটার, এই বিষয়ে আমার প্রশ্ন হল—আপনার কী মনে হয়েছে যে, তৃণমূলের নিজের যে কমিটেড ভোটাররা আছেন, যাঁদের মধ্যে বহু মহিলাও স্বাভাবিক ভাবেই আছেন, তাঁরা ছাড়াও, এতকাল তৃণমূলের প্রধান বিরোধী সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বাম দলগুলি, এবং কংগ্রেস, সেই দলগুলির দীর্ঘকালীন সমর্থক মহিলারাও এবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন?
দী. ভ.— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে দিয়েছেন এটা হয়তো নির্দিষ্ট ভাবে বলা যাবে না। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে দিয়েছেন। মহিলাদের ভোটের বিষয়ে আমি বলব, এটা নিশ্চয়ই একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এখানে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যেটা করতে চেয়েছিল সেটা হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ। ওদের অঙ্কটা খুব সোজা ছিল—মুসলমানরা একদিকে ভোট দিলে আমরা হিন্দুদের বলব, ওরা একদিকে ভোট দিচ্ছে, তোমরাও একদিকে ভোট দাও, ওরা ‘মুসলিম তুষ্টিকরণের মাধ্যমে মুসলিম ভোটব্যাংক তৈরি করা হচ্ছে’ এই কথাটা বারবার বলে আসলে নিজেরা একটা হিন্দু ভোটব্যাংক তৈরি করতে চেয়েছিল। মানে, যেখানে হিন্দু ভোট দেবে হিন্দু হিসেবে। এই ছকটা ভাঙার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘জেন্ডার’। ক্লাস, শ্রেণি—কৃষক-শ্রমিক—যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জেন্ডার। এবং আমার মনে হয়েছে, পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন ভাবে এটা উঠে এসেছে। সেখানে আপনি মহিলা ভোটারদের আলাদা আলাদা ডিমগ্র্যাফিক এজ-গ্রুপ ভাবতে পারেন, শিক্ষা ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁদের আলাদা আলাদা প্রোফাইল করতে পারেন, আমাদের কাছে যে খবর আসছে সব মিলিয়ে মহিলাদের তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি-কে সমর্থনের মধ্যে ১৪-১৫ শতাংশ পার্থক্য হয়েছে।
নী. হা.— যেটা বিশাল ব্যাপার…
দী. ভ.— বিশাল… এটা বিশাল। এই যে ওয়েলফেয়ার স্কিমগুলোর কথা বলছিলাম, অবশ্যই মহিলাদের মধ্যে তার একটা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। ধরুন স্বাস্থ্যসাথী বলে যে স্কিমটা আছে, সেটাতে মহিলাদের ভূমিকা যা রাখা হয়েছে…
নী. হা.— কন্যাশ্রী থেকে সেটা শুরু হয়েছে…
দী. ভ.— অবশ্যই। অবশ্যই। তো সেক্ষেত্রে মহিলাদের ক্ষমতায়ন বলতে যা বলা হয়, তার অন্তত একটা বোধ যদি তৈরি হয়ে থাকে, সেটা আছে। এ ছাড়া, বিজেপির যে রাজনৈতিক ভাষা— যেমন ধরুন যোগী আদিত্যনাথ এসে বললেন উত্তরপ্রদেশের মতো এখানে ‘অ্যান্টিরোমিও স্কোয়াড’ করব, ‘লাভ-জিহাদ’ বন্ধ করে দেব। এখন ‘লাভ-জিহাদ’ বিরোধী আইন মানে কী? কিছু মুসলমান যুবককে জেলে পুরে দেওয়া। এই ‘লাভ-জিহাদ’-বিরোধী আইন আনার হুমকি, এটা আসলে কী? হিন্দু-মুসলমান মৈত্রী ও নারীস্বাধীনতা উভয়ের ওপর একাধারে হামলা। এমন কোনো আইন হলে নিজের ধর্মপালনের অধিকার এবং নিজের জীবনসাথী নিজে বেছে নেওয়ার অধিকার, দুটোই আক্রান্ত হবে। এটা কিন্তু শুধু মুসলমান যুবকদের ভাবায়নি। এটা কিন্তু হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে যে নতুন প্রজন্মের মেয়েরা, যারা স্বাধীনতা চায়, তাদেরও ভাবিয়েছে।
নী. হা.— আমিও নয়-নয় করে অনেকগুলি বিধানসভা-লোকসভা নির্বাচন দেখলাম। কিন্তু এবারের নির্বাচনি প্রচারে বিজেপির নেতা-কর্মীরা, বাইরে থেকে আসা নেতারাই শুধু নয়, একেবারে দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করা বিজেপি নেতারা যে উগ্র মনুবাদী-পুরুষতান্ত্রিক হুঙ্কার পেড়েছিলেন, যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তা আমি এর আগে কোনোদিন মনে করতে পারি না। এখন, আমার মনে হয় যে, বাংলার একটা দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক পরম্পরা থেকেই, নারীরা, মেয়েরা, হয়তো ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী এসব তাত্ত্বিক ভাবে না ভেবেই, এই ভাষাটাকেই, এই আক্রমণাত্মক অবস্থানটাকেই নিতে পারেননি, সহ্য করতে পারেননি। আপনার কী মনে হয়?
দী. ভ.— একদম ঠিক। বাংলার সংস্কৃতির কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। বাংলার যে মনীষীরা… ধরুন রামমোহন রায়, বা ধরুন বিদ্যাসাগর… ওই সময়ে, অতকাল আগে, তাঁরা সতীদাহ প্রথা রুখে দিতে চাইছেন, বিধবা-বিবাহ চালু করতে চাইছেন। কী কঠিন সময় তখন, এখনকার থেকে অনেক কঠিন। মানে ধরুন, হিন্দুকোড বিল আনতে গিয়ে (ভীমরাও) আম্বেদকরকে যে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ১৯৫০-এর দশকে, তার থেকে বহুগুণ বাধা তখন ছিল, সেইটাকে অতিক্রম করে, তার বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তো। রামমোহন, বিদ্যাসাগররা সেইসময় যা অ্যাচিভ করতে পেরেছিলেন, সেটা তো বাংলার সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গিয়েছে। ফলে, ওই ‘জয় শ্রীরাম’ বলে রণহুঙ্কার—আপনি ওইসব মিছিলে মহিলাদের বেশি দেখবেন না। এই রণহুঙ্কার মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়। কাজেই আমার মনে হয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে যে-মহিলারা লাভবান হয়েছেন, শুধু তাঁরাই নন, বিজেপিকে ভোট দেওয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে যে ক্যাম্পেনটা হয়েছে, আমি দেখেছি আজকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রীরা তার একেবারে সামনের সারিতে থেকেছে।
নী. হা.— এবার, বলুন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, মানে মূলত মুসলমানরা যেভাবে ভোট দিয়েছেন তাতে আপনার কী মনে হয়েছে?
দী. ভ.— মুসলিম জনগণের ব্যাপক অংশ দেখাই যাচ্ছে তৃণমূলকেই বেছে নিয়েছেন। এমনকি পরম্পরাগত ভাবে যে মুসলমানরা কংগ্রেসের পক্ষে ছিলেন, মালদা, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুরের কিছু অঞ্চলে, তাঁদের একটা বিরাট অংশ শিফট করে গিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। অন্যদিকে (আইএসফ নেতা) আব্বাস সিদ্দিকি-কে ঘিরে মুসলমান ভোট ভাগাভাগির যে আশঙ্কা দেখা গিয়েছিল অন্তত ২৪ পরগনা, হুগলি, হাওড়ার মতো জেলাগুলোতে সেটাও দেখা গেল ঘটেনি। একটা-দুটো আসনে ছাড়া কিছুই দাঁড়ায়নি। বিজেপি এই মুসলমান ভোটটাকে, VOTE শব্দটার অক্ষরগুলো রদবদল করে নিয়ে বলছে এটা VETO, মাইনরিটি ভেটো। রাকেশ সিনহা একটা টুইট করেছেন দেখলাম। এই নিয়ে একটা অপপ্রচার চলছে। মুসলমানদের হয়তো দেখা যাবে ৭৫ শতাংশ তৃণমূল কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছেন—অনেকেই বেছে নিয়েছেন, ওঁরাও নিয়েছেন। এবং আমি মনে করি এটা মুসলমানদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারবোধের যে চেতনাতার পরিচয়। কাজেই, আমার মনে হয়, ঠিকই এইবারের নির্বাচনে মহিলা এবং মুসলিম ফ্যাক্টর যদি বলা যায়, দুটোই খুব ডমিন্যান্ট ভূমিকা নিয়েছে।
নী. হা.— বেশ। আমি টেলিভিশনে প্রশান্ত কিশোরের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে তিনি এই ফলাফলের কারণের প্রশাসনিক, স্ট্র্যাটেজিক এবং কিছুটা রাজনৈতিক বিশ্লেষণও করেছেন। বিশদে।
দী. ভ.— নির্বাচনের আগে না পরে…
নী. হা.— পরে। প্রথম যেটা আমার চোখে পড়ল তা এই—সোশাল মিডিয়ায় যে ক্যাম্পেনটা চলেছে যার মূল কথা ছিল ‘ফ্যাসিবাদ রুখতে বিজেপি-কে আটকাও’, উনি সেই কথাই তুললেন না। ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণই করলেন না। উনি বললেন, মিডিয়া যেটা লক্ষ্যই করেনি সেটা হল, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে খানিকটা ধাক্কা খাওয়ার পরে আমরা (উনি ‘আমরা’ ‘আমরা’ করেই বলছিলেন) সোশাল ওয়েলফেয়ার স্কিমগুলোর সুযোগ-সুবিধে যাতে মানুষের কাছে পৌঁছোয়, তার ডেলিভারির দিকটায় খুব নজর দিয়েছিলাম। তৃণমূল কংগ্রেস সরাসরি ভোটের মেশিনে তার ফসল তুলেছে।
এই সামাজিক প্রকল্পর কথা আপনিও বলেছেন। প্রশান্ত কিশোর খুব জোর দিয়ে এটাই বলেছেন। এবারে, আমি যদি গোটা প্রেমাইসটাকে এইভাবে গঠন করি যে, একদিকে বহু সামাজিক প্রকল্পে যতটাই ডেলিভারি হয়ে থাকুক না কেন তাতে খুশি হয়ে, এবং অন্যদিকে বিজেপি-র রাজনীতি-সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস ও বাম জোট, আমি সরাসরি সিপিআই(এম)-ই বলব, তাদের ওপর ভরসা না করে সাধারণ মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর ভরসা রাখলেন। তাহলে এই ভোটের ফলাফলকে আমি সামগ্রিক ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি আস্থার ভোট কেন বলব না? মানে, আপনি কী বলবেন?
দী. ভ.— এটা, একটা বড়ো কম্পোন্যান্ট অবশ্যই। কিন্তু যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের হার ৪৮ শতাংশে চলে গিয়েছে, অতএব এখানে তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি একটা আস্থা অবশ্যই আছে। বড়ো অংশই, হয়তো ৪০ শতাংশ তাই হবে। এর সঙ্গে ওই যে আট শতাংশের কথা বললাম…
নী. হা.— কিন্তু সেই আট শতাংশও যে সিপিআই(এম) বা কংগ্রেসকে না বেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে বাছলেন, সেটাও তো একটা আস্থা। যে আমি জানি, এরাই পারবে, এরাই করবে। যদি এইভাবে দেখা যায়?
দী. ভ.— আমি বলব, সেটা ভারসাম্যের আস্থা। কারণ, অন্য কাকে দিতেন? কংগ্রেস বা সিপিআই(এম)-এর সাংগঠনিক জায়গাটা ভোট করার দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল। এবং রাজনৈতিক জায়গা থেকেও তাঁরা ওই জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছেন।
নী. হা.— আমি এইটাতেই আসতে চাইছি… বলুন আপনি…
দী. ভ.— বিজেপির বিরুদ্ধে আমরা আছি, সেই জায়গাটা কংগ্রেস, সিপিআই(এম) পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে। ধরুন, নির্বাচন চলাকালীন একটা প্রশ্ন উঠেছিল ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে কী হবে? তখন তাঁরা এই অবস্থান নিতেই পারতেন যে, বিজেপি-কে আটকাতে নির্বাচনের পরে যদি কিছু ব্যবস্থা নিতে হয় আমরা নেব।
নী. হা.— কিন্তু সূর্যকান্ত মিশ্র খুব অ্যাগ্রেসিভলি বললেন…
দী. ভ.— হ্যাঁ, বললেন, ‘আমরা কোনোমতেই তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করব না’। তার মানে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এল কী এল না তাতে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
নী. হা.— আপনি আমার পরের প্রশ্নটার উত্তর অনেকটাই দিয়ে ফেলেছেন। তবু জিজ্ঞেস করি, সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামজোট যে মানুষের আস্থা সম্পূর্ণ হারালেন, এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়? এই আলোচনাটা বড়ো করে হওয়া দরকার, কারণ এর বিপুল প্রভাব আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, সমাজ সবকিছুর ওপরে পড়বে বলে আমার মনে হয়।
দী. ভ.— এটা কয়েকটা ধাপে বলতে হবে। এই নির্বাচনের আগে সিপিআই(এম) আমাদের (সিপিআই-এমএল-লিবারেশন-এর) সম্বন্ধে লিখলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে যদি আমাদের মুখ খুলতে হয়, তাহলে তার প্রথম কথাই হতে হবে ‘অ্যান্টিইনকাম্বেন্সি’। আপনি যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পূর্ণ বিরোধিতা না করেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আপনার কথা বলারই কোনো জায়গা নেই। তার মানে, ওঁদের মনে ছিল এবারে বিধানসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বিবেচ্য মূল প্রশ্নটা হল—১০ বছর ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেসকে কে সরাচ্ছে?
নী. হা.— এখানে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন আছে, তাই একটু আটকাচ্ছি—এই মনে হওয়াটা কেন হল? যদি সিপিআই(এম)-এর রাজ্য নেতৃত্বের কথা ধরা যায়, সেটা ২০১১ (বা তারও আগে) থেকে কার্যত অপরিবর্তিত। সেই একই মুখ। এঁরা কিন্তু প্রত্যেকে সিপিআই(এম)-কে ক্ষমতায় আসতে দেখেছেন, পূর্ণক্ষমতায় দেখেছেন, ক্ষমতা হারাতে দেখেছেন। সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম… প্রথমসারির রাজ্যনেতৃত্বের প্রত্যেকে ৩৪ বছরের বামশাসন পরিচালনায়, সরকারের সঙ্গে যুক্ত থেকে হোক বা সাংগঠনিক ভাবে হোক, সক্রিয় ভাবে থেকেছেন। এমন অভিজ্ঞ মানুষদের এই অদ্ভুত মনে হওয়াটার কারণ কী? কী মনে হয় আপনার?
দী. ভ.— দেখুন, এটা মানুষের থেকে একটা বিরাট বিচ্ছিন্নতা। একটা উইশফুল থিংকিং-এ আত্মমুগ্ধ হয়ে থাকা। এই আত্মমুগ্ধ তা তখনই আসে যখন আপনি বাস্তব পরিস্থিতি থেকে এবং জনগণের ব্যাপক ভাবনা থেকে ভীষণ ভাবে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা ওঁদের কথাবার্তা, ওঁদের স্লোগান, ওঁদের বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে, তেমনই ভোটের ফলাফলেও ধরা পড়েছে। যেটা বলছিলাম, ওঁরা ধরে নিলেন মানুষের সামনে বিবেচ্য প্রশ্ন হল, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে কে সরাচ্ছে।
দুই, এখন, নির্বাচনের পরে ওঁদের বিশ্লেষণ যদি দেখেন ওঁরা বলছেন, এটা বিজেপি-বিরোধী ভোট হয়েছে।
নী. হা.— ঠিকই। আমি পাঠকের জন্য একটু উদ্ধৃত করে দিই, ৩ মে, ২০২১, সিপিআই(এম)-এর মুখপত্র ‘গণশক্তি’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করেছে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে বিমান বসুর বিবৃতি—শিরোনাম: ‘বিজেপি’কে হারানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষায় লাভ তৃণমূলের’। এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘এই নির্বাচনে বিজেপি-র পরাজয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা… বলা যেতে পারে বিজেপি-কে পরাস্ত করার জন্য জনগণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৃণমূল লাভবান হয়েছে।’’
দী. ভ.— এই যে কথাটা, এই কথাটা স্বীকার করতে গেলে তো একটা আত্মসমালোচনা আগে করতে হয়। তা হল, জনগণের কাছে সব থেকে বড়ো প্রশ্ন ছিল—বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসবে না তো বাংলায়? জনগণের কাছে সবথেকে বড়ো প্রশ্ন—বিজেপি-কে কে আটকাবে? আর পার্টির নেতৃত্বের মনে হয়েছিল, মানুষের কাছে সবথেকে বড়ো প্রশ্ন হল, তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে কে সরাবে?
নী. হা.— হ্যাঁ। এবং এরপরেই একটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ ‘হাইফেন’ চলে আসছে—এরপরেই বিমান বসুর ওই বিবৃতি বলছে, ‘তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী সব শক্তির কাছেই দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে গেল।’ কাজেই ইঙ্গিত এই যে, ভবিষ্যতেও তাঁদের কাছে তৃণমূল এবং বিজেপি সমান শত্রু হিসেবেই থাকবে। তাঁরা এই নির্বাচনি ফলাফলের পরেও সেই অবস্থান থেকে সরছেন না।
দী. ভ.— সেটা দেখা যাক, আমরা পরে আরও দেখব ওঁরা কী ভাবছেন। কিন্তু ঘটনা এই যে, ওঁদের প্রথম ভুল ছিল, এই নির্বাচনে মানুষের প্রধান বিবেচ্য কী ছিল সেটা বুঝতে না পারা। সেটা যদি ওঁরা বুঝতে পারতেন, তাহলে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের প্রথম কর্তব্য ছিল, এটা মানুষের কাছে তুলে ধরা যে আমরাও বিজেপির বিরুদ্ধে একটা বড়ো শক্তি। আমরা যদি ক্ষমতায় চলে আসি, ভালো। যদি না আসতে পারি, তাহলেও বিজেপি-কে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেব না। যদি বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হয়, আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। এই কথাগুলো ওঁরা জোরের সঙ্গে বললেন না। এটা হল প্রথম ভুল।
নী. হা.— এবং আপনি মনে করেন এই না বলাটার পিছনে আছে সিপিআই(এম)-এর জনবিচ্ছিন্নতা?
দী. ভ.— জনবিচ্ছিন্নতা। এবং জনবিচ্ছিন্নতা ছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে—বিজেপি যে কীধরনের একটা পার্টি, তারা যে ভারতে কী করতে চলেছে সেবিষয়েও সিপিআই(এম)-এর একটা সম্যক ধারণা গড়ে ওঠেনি। যার ফলে ওঁরা এখানে বিজেপি-কে উল্লেখ করেছেন কার্যত তৃণমূলের বি-টিম হিসেবে। আজকে গোটা ভারত চিন্তিত, সারা দেশ দেখছিল পশ্চিমবঙ্গে কী হচ্ছে। সেইসময়ে সিপিআই(এম) বলছে বিজেপি(পশ্চিমবঙ্গে) তৃণমূলের বি-টিম, অর্থাৎ তাঁদের(সিপিআইএম নেতৃত্বের) পুরো পৃথিবীটা তৃণমূলকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে।
ওদের দুটি থিওরি—বিজেপি-কে হারাতে গেলে আগে তৃণমূলকে হারাতে হবে। এবং তৃণমূল ও বিজেপি একই বৃন্তে দুটি কুসুম, দুটো মিলে বিজেমূল—ওঁদের এই যে দুটো তত্ত্ব, এই আজগুবি তত্ত্ব (ওঁদের এই নির্বাচনী ফলাফলের পিছনে) বড়ো একটা ব্যাপার।
আরও আছে। গত দশ বছরে সিপিআই(এম)-এর কাছে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল, একটা বিরোধী দল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে নিজেকে রিইনভেন্ট করা। তার বদলে তাঁরা চিরস্থায়ী ভাবে ‘গভর্নমেন্ট-ইন-ওয়েটিং’ (মানে, এই তো আমরা সরকারে এলাম বলে) মানসিকতার মধ্যে থেকে গেলেন। এই মানসিকতাটা ওঁদের বাস্তব অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
নী. হা.— বেশ। এই গেল মোটামুটি নির্বাচনী ফলাফলের আপনার বিশ্লেষণ। এবার আর-একটা জরুরি প্রশ্নে আসি। সেজন্য কয়েকটা পরিসংখ্যান একটু দেখা দরকার। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক হিসেব —
২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন
মোট ভোটারসংখ্যা— ৫ কোটি ৯৯ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯৮৮
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট —২ কোটি ৮৭ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪২০ (৪৭.৯৪ %)
—জয়ী ২১৩
বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট — ২ কোটি ২৮ লক্ষ ৫০ হাজার ৭১০ (৩৮. ১৩ %) — জয়ী ৭৭
সিপিআই (এম)-এর প্রাপ্ত ভোট — ২৮ লক্ষ ৩৭ হাজার ২৭৬ (৪.৭৩ %) — প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে — ১৩৭
২০১৬ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন
সিপিআই (এম)-এর প্রাপ্ত ভোট—১ কোটি ৮ লক্ষ ২ হাজার ৫৮ (১৯.৭৫ %)—প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে—১৪৮—জয়ী ২৬
২০১১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন
সিপিআই (এম)-এর প্রাপ্ত ভোট — ১ কোটি ৪৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৬১ (৩০.০৮ %)—
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে — ২১৩ — জয়ী ৪০
এর মধ্যে আমার প্রশ্ন— পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬০-এর দশক থেকেই, নির্বাচনী রাজনীতিতে অন্তত, প্রধান বামশক্তি, বামদল হয়ে থাকা সিপিআই(এম)-কে ঘিরে। ২০১১ সাল, কার্যত বলা যায় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই, ভোটের মেশিনে এই দলের যে ক্রমাগত মানুষের আস্থা হারাতে থাকার প্রতিফলন, এবং শেষে এবারের ছ-কোটি ভোটারের মধ্যে ২৮ লক্ষে (শরিকদের ধরলে আরও সামান্য বাড়বে নিশ্চয়ই), আর আসনের নিরিখে শূন্যতে এসে ঠেকা—স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কোনো কমিউনিস্ট প্রতিনিধি থাকছেন না—এটা যদি সমাজের রাজনৈতিক মনোভাবের প্রতিফলন হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কমিউনিস্ট—আমি এখানে বাম-ঘেঁষা ইত্যাদি বলছি না—কমিউনিস্ট বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষ কি মুছে গেলেন? এমত পরিস্থিতিতে এখানে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী? ইংরেজিতে যাকে বলে—Whither Left?
দ্বিতীয় পর্ব - রাজ্যে গণতন্ত্রের সার্বিক পরিসর সঙ্কুচিত হলে তার ফসল ঘরে তুলবে বিজেপি
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য — ভোট তো অবশ্যই বিরাট ভাবে কমেছে। সেই কমার প্রেক্ষাপটটা কী তা আমরা খানিকটা আলোচনা করেছি। এটা বিচ্ছিন্নতার ফল। যেমন ধরুন, আজকে যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিচ্ছেন তাঁদের একটা বড়ো অংশ ১০ বছর আগেও তো সিপিআই(এম)-কেই ভোট দিতেন। সিপিআই(এম)-এর কাছে গরিব মানুষের ভোটটা ছিল—গ্রামে, শহরে, কৃষক, শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক, খেটে-খাওয়া মানুষ, তাঁরা গত ১০ বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিচ্ছেন। ভুল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং জনবিচ্ছিন্নতার ফলে আবার বামপন্থী ভোটারদেরই একটা অংশকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে বিজেপি-র দিকে। এইটা মারাত্মক।
কিন্তু অতীতে যেটা সিপিআই(এম)-এর ভোট ছিল, এবং এখনও বিজেপি-বিরোধী ভোট হিসেবে রয়েছে, আমি বলব তার অনেকটাই বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ভোট। এমনকি, এই যে মিসগাইডেড হয়ে যে একটা অংশ চলে গিয়েছে বিজেপির দিকে, এবং ফিরেও আসতে পারে, সেটাও তাই। শুধুমাত্র একটা নির্বাচন দিয়ে তো একটা পার্টির গণভিত্তি বা একটা রাজ্যের মানুষের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। সেক্ষেত্রে আমি বলব, এটা খানিকটা ডিসইন্টিগ্রেট করেছে। এটা একটা বড়ো সংহত শক্তি ছিল, সেই সংহতিটা মার খেয়েছে। এখান থেকে এবারে এটা বামপন্থীদের আবার তুলতে হবে।
নী. হা.— আচ্ছা। এখানে একটা প্রশ্ন করি—তৃণমূল কংগ্রেসের যে রাজনীতি, তাকে কি বাম-ঘেঁষা, যাকে লেফট-অফ-সেন্টার বলে তাই বলবেন আপনি? অনেকেই মনে করছেন শুধু সাংগঠনিক ভাবেই নয়, রাজনীতির দিক থেকেও সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গে যে বামপন্থী পরিসরটা অকুপাই করেছিল, ছেয়ে ছিল বহু কাল, সেটা এখন তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে নিয়েছে। আপনার কী মত?
দী. ভ.— লেফট-অফ-সেন্টার হয়তো একদিক থেকে আপনি বলতে পারেন। দেখুন, ২০০৬-৭ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান যেভাবে হয়েছে, এবং যে আন্দোলন নির্ভর করে তাঁরা ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছেন, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পরে এই দলকে লেফট-অফ-সেন্টার বলা যায়। কিন্তু এরপরে যেটা হল পশ্চিমবঙ্গে, সেটা হল সিপিআই(এম)-এর প্রতি একটা প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে বামপন্থার বিরোধিতাও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে। নইলে বিজেপি আজকে যে ভোটটা পেল এটাও তাদের পাওয়ার কথা নয়। এই ৭৭টা আসন, ৩৮ শতাংশ ভোট এটাও বিজেপির পাওয়ার কথা নয়। প্রশান্ত কিশোর আজকে বলছেন নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের কথা, সেটা তো নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার। কিন্তু তা ধরে নিয়েও, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে এত ক্ষমতাবৃদ্ধি তার পিছনে কিন্তু সিপিআই(এম)-এর অনেক ভুল ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক পদক্ষেপ দায়ী। যেমন, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ক্ষমতার দাপট দেখা গেল, অনেকে নমিনেশনই ফাইল করতে পারলেন না, এর আগে যা দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেছে— কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচন এসব ক্ষেত্রেই সেই একই দাপট দেখা গেছে। এখন, গণতন্ত্র বলতে তো শুধু বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন বোঝায় না। গণতন্ত্রের যে বৃহত্তর পরিসর সেখানে ওই ক্ষমতার ধারাবাহিক দাপট কিন্তু বিজেপিকে একটা বড়ো জায়গা করে দিয়েছে।
নী. হা.— দেখুন, এটা আমার অভিজ্ঞতায় শাসকের দম্ভ। দম্ভও বলব না ঠিক, আসলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি খুব হিসেব করে এটা করে। আমরা আগেও বহুবার দেখেছি। সব দলই করে। সমাজের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে দলের বশবর্তী করে ফেলতে হয় সিপিআই(এম) তার একটা কপিবুকই রেখে গেছে বলা যায়। আমার প্রশ্নটা আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের যে সামগ্রিক নীতির অভিমুখ সেই সংক্রান্ত— আমার মনে হয়, বামপন্থার একটা অন্যতম নির্ণায়ক হল, মানুষের— বিশেষত পিছিয়ে পড়া মানুষের— উন্নয়নে, সাহায্যে সক্রিয় ভাবে অংশ নেওয়া যে রাষ্ট্রের, এবং সরকারের, অপরিহার্য দায়িত্ব তা স্বীকার করা। এখন যখন সার্বিক পরিবেশটাই হল রাষ্ট্র ও সরকারের এইসব দায়িত্ব সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলার পরিবেশ, সেইখানে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সরকারের সেই দায়িত্বটা দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার করেছেন। ডেলিভার কতটা করা গিয়েছে তা নিয়ে অবশ্যই বড়োসড়ো প্রশ্ন আছে, কিন্তু মৌলিক ভাবে এই নীতির অভিমুখের কারণেই কী তৃণমূল কংগ্রেসকে লেফট-অফ-সেন্টার দল বলা যেতে পারে? আপনি যে ক্ষমতার আস্ফালনের কথা বলছেন, সেটা সত্ত্বেও…
দী. ভ.— আমি যেটা বলছি, এই যে ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালানো, এটা কোনো বামপন্থী দল করলে তো সেটা বিচ্যুতি। সেটা তো আর বামপন্থা হল না। বিচ্যুতি দিয়ে তো বামপন্থা ডিফাইন করা যাবে না। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর যখন এটা হয়েছিল, তাঁদের বামপন্থা দুর্বল হয়েছিল। তার ফলেই তাঁরা একটা সময়ের পর আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। সেইজন্য, আমার মনে হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে যদি তার লেফট-অফ-সেন্টার বা সেন্ট্রিস্ট অবস্থানটা ধরে রাখতে হয় তাহলে বামপন্থীদের ওপর যে আক্রমণ চলেছে পশ্চিমবাংলায়, পার্টি অফিসগুলোর ওপরে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপরে, সেটা বন্ধ করতে হবে।
দেখুন, সারা দেশে একটা দক্ষিণপন্থী স্রোত বইছে। সার্বিক অর্থনীতি যদি দেখেন, কর্পোরেটগুলোর দাপট সেখানে ক্রমাগত বাড়ছে। এবং নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও আক্রমণাত্মক প্রতিনিধি। আমরা একটা বড়ো দক্ষিণপন্থার দিকে সরে যাওয়ার মধ্যে, রাইটওয়ার্ড শিফটের মধ্যে আছি। এবারে, ২০১১ সালে যখন সিপিআই(এম) ক্ষমতা থেকে চলে গেল, তাঁদের বহুকালের সমর্থক গরিব মানুষের ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে চলে গেল, এটা ঠিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো একটা বড়ো দক্ষিণপন্থী শক্তিও আছে, এবং সেটাও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যেই আছে। আমি সেই জন্যই তৃণমূল কংগ্রেসকে একটা মধ্যপন্থী, সেন্ট্রিস্ট শক্তি বলব।
এবার দেখতে হবে সেই মধ্যপন্থী শক্তির অ্যাঙ্গল-টা কী থাকছে। বারবার দেখতে হবে। সেটা লেফট-অফ-সেন্টার থাকছে না রাইট-অফ-সেন্টার হয়ে যাচ্ছে। বারবার দেখতে হবে। এটা যদি দক্ষিণ দিকে ঝোঁকে, তাহলে জেনে রাখবেন তার শেষ ঠিকানা কিন্তু বিজেপি। বামপন্থীদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে যদি পশ্চিমবঙ্গে একটা রাইটওয়ার্ড শিফট শুরু হয়, তাহলে তা কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসে থামবে না, সেটা অবধারিত ভাবে বিজেপিতে পৌঁছোবে। পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিসর যদি সংকুচিত হয় তাহলে সেটা বিজেপিকেই শক্তিশালী করবে। আমার ধারণা, কংগ্রেস, সিপিআই(এম)-এর বিচ্যুতি, জনবিচ্ছিন্নতা তো আছেই, কিন্তু বিজেপির এই ৩৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার একটা বড়ো দায়িত্ব শাসকদল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরেও বর্তায়।
আর, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সরকারি দায়িত্ব স্বীকারের প্রশ্নে আমি বলব, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। এমনকি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে কর্পোরেট নীতির বিরোধিতা সেটাও তাঁরা করেছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, কেন্দ্রীয় সরকার বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে, জনগণের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করে পিছু হটছে। সেখানে জনসাধারণের কিছু অংশের কাছে কিছু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াকে অবশ্যই একটা সেন্টার-লেফ্ট অর্থনীতির দিশা বলা যেতে পারে।
নী. হা.— এইবারে আসি আপনাদের দলের প্রসঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের এই যে পরিস্থিতি আপনি এতক্ষণ ব্যাখ্যা করলেন, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আপনারা কী ভাবছেন? আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, সিপিআই(এম) ও বামফ্রন্টের অন্য দলগুলোর সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কী হবে, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেই বা সম্পর্ক কী হবে, এইসব বিচার করেই তো আপনারা ভবিষ্যতে এ রাজ্যে একটা কর্মসূচি ঠিক করবেন, তার সার্বিক ভাবনাটা, ভিশনটা কী?
দী. ভ.— আমরা পশ্চিমবঙ্গেও বিগত ৫০ বছর ধরে কাজ করছি। এটা ঠিক যে, এ রাজ্যে আমাদের নির্বাচনী সাফল্য খুব কম। তার কারণ আছে। আমাদের পার্টি যখন পত্তন হয়, তখন আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গিয়েছিলাম। সেখানে পার্টি একটা বড়ো ধাক্কা খায়। সেখান থেকে পার্টিকে আবার পুনর্গঠন করতে হয়। এবং এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় আমরা দীর্ঘদিন নির্বাচন লড়িনি। এবার আমার নিজের বিশ্লেষণ হল, নকশালবাড়ি আন্দোলনের যে একটা বড়ো আবেগ, বড়ো একটা ইমপ্যাক্ট, সেটাকে কিন্তু নির্বাচনী গণতন্ত্রের আঙিনায় সংহত করে নিতে পেরেছিল সিপিআই(এম)। ১৯৭৭-এর নির্বাচন যদি দেখেন, বন্দিমুক্তি আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণআন্দোলনের যে ভোট সেই ভোটটা কিন্তু পেয়েছিল সিপিআই(এম)।
ক্ষমতায় আসার পরে গোড়ার দিকে তাঁরা অপারেশন বর্গার মাধ্যমে ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত নির্বাচন চালু করা ইত্যাদির মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থন নিজেদের পক্ষে করে ফেলতে সক্ষম হন। এরপরে আমরা যখন নির্বাচন লড়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখন খানিকটা দেরি হয়ে গেছে—যাকে বলে উই মিস্ড দ্য বাস। সেই পরিস্থিতিতে আমরা পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সাফল্য পাইনি। যেটুকু পাচ্ছিলাম সেখানেও আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করা হয়। আমার বারবার মনে পড়ে যায় ১৯৯৩ সালের বর্ধমান জেলার করন্দার কথা। এইখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় সিপিআই(এম)-এর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের সমর্থন করে অনেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, অনেকে ভোট দিয়েছিলেন। সেইটাকে আটকানোর জন্য, ছয়জন খেতমজুরকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয়। করন্দা গণহত্যা। ৩১ মে, ১৯৯৩। তো এ ধরনের নানাকারণ এ রাজ্যে আমাদের নির্বাচনী সাফল্যকে খুব ছোটো একটা জায়গায় আটকে রেখেছে।
এবার আমাদের মনে হয় যে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির একটা বড়ো পুনর্বিন্যাস দরকার।
নী. হা.— সেটা আপনারা কীভাবে ভাবছেন?
দী. ভ.— দেখুন, এতদিন ধরে যেটা ছিল, সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে একটা বামফ্রন্ট। সেখানে খুব বেশি বিতর্ক-টিতর্ক হত না। যেমন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়, ২০০৬ সালে, বামফ্রন্টের অনেক ছোটো শরিক দল সিঙ্গুরে সরকারি অবস্থানের বিরোধী ছিলেন। আমরা বারবার তাঁদের বলেছি, আপনারা অন্তত মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে আসুন। তাঁরা যদি মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে আসতেন, তাহলে ওই যে জনসমর্থন পুরোপুরি তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে চলে গেল, সেটা কিন্তু নাও যেতে পারত, বামফ্রন্টের মধ্যেই কিছু একটা শুধরোনোর ব্যবস্থা—কোর্স কারেকশন—হতে পারত। আপনি দেখবেন, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস যে ধাক্কাটা খেল, তারপরে তাঁরা কিন্তু কোর্স কারেকশন করেছেন।
নী. হা.— ঠিক এই কথাটাই বলেছেন প্রশান্ত কিশোর, কোর্স কারেকশন শব্দটাই ব্যবহার করেছেন…
দী. ভা.— সিপিআই(এম)-ও কিন্তু বারবার কোর্স কারেকশনের সুযোগ পেয়েছে, করেনি। আমার মনে আছে, সিঙ্গুরের আন্দোলন যখন চলছে তখন জ্যোতিবাবু (বসু) বলেছিলেন, ‘‘কৃষকসভা কী করছে, তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে?’’ উনি নীতিগত ভাবে সিঙ্গুরে কারখানা করার পক্ষে ছিলেন কি ছিলেন না তা আমি জানি না, কিন্তু উনি জানতেন কৃষকের জমি এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না। একজন প্রশাসক হিসেবে উনি এটা বুঝেছিলেন। এটা তো একটা বিরাট বড়ো সতর্কবার্তা ছিল। একটা কোর্স কারেকশন তো হতে পারতো। তৃণমূল কংগ্রেসকে এই ক্রেডিট আমি অবশ্যই দেব, তাঁদের চোখ-কান খোলা। সিপিআই(এম) সেটা করলেন না।
নী. হা.— বরং ভয়ংকর দম্ভে একেবারে উচ্চতম নেতৃত্ব বলে বসলেন ‘ওরা ৩৫, আমরা ২৩৫!’
দী. ভা.— এই কোর্স কারেকশন না করার ফলে (মানুষের সমর্থনের) সেই জায়গাটা আর রইলো না। এখন আর নেই। ২০১১ সালে হারাটা যদি সিপিআই(এম)-এর কাছে কোভিডের ফার্স্ট ওয়েভ হয়ে থাকে, এবারের ফলাফল তার থেকে বহুগুণ বড়ো ধাক্কা—সেকেন্ড ওয়েভ! ফলে আমাদের একটা বড়ো কাজ আছে—পশ্চিমবঙ্গে বামশিবিরের পুনর্বিন্যাস এবং বামপন্থার পুনরুত্থান। এখানে আমাদের কাজ করতে হবে।
নী. হা.— কীভাবে?
দী. ভ.— সেটা করতে হবে অনেক কিছু মিলিয়ে। বিধানসভায় আজ বামপন্থীরা নেই। বামপন্থীরা বাইরে আছেন। (আইনসভার) বাইরে বামপন্থীদের যে কাজ, সেগুলো করে যেতে হবে। সংকটে মানুষের পাশে থাকা, মানুষের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়া। এখানেও সিপিআই(এম) একটা ভুল করে এসেছে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে (জনমুখী) প্রকল্পগুলো, সেখানে ডেলিভারির ক্ষেত্রে চুরি হয়েছে। ধরুন, কথার কথা বলছি, সেগুলোতে ৬০ শতাংশ ডেলিভারি হচ্ছে। ৯০ শতাংশ ডেলিভারি হচ্ছে না কেন? এই আন্দোলনটা কারা করবেন? বামপন্থীরাই তো করবেন। কিন্তু সিপিআই(এম) এই স্কিমগুলোকেই কোনো গুরুত্ব দিতে নারাজ। এটা তো বড়ো ভুল। (তৃণমূল কংগ্রেসের বিষয়ে) আপনার যাই অ্যাসেসমেন্ট থাকুক না কেন, যতই রাগ থাকুক না কেন, কিন্তু আজকে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাসক। এখন বামপন্থীদের একটা বড়ো কাজ হল—To hold the government accountable। সরকার যাতে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় তা সুনিশ্চিত করা। কিন্তু একটা সরকারকে যদি আমরা সরকার হিসেবে মানতেই না পারি, তাহলে তো আমার মনে হয় সরকারকে খুব লঘু করে দেখা হয়। এবং জনগণকে বোকা ভাবা।
আমি তো বারবার বলি, ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ কথাটা বললেই ওই ‘হাওয়াই চটি’, ‘চালচোর’ এইসব বলতে থাকার মানে তো ওই যে ৪৮ শতাংশ ভোট তার কথা না ভাবা। ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ বলতে কেবল কয়েকজন নেতার কথা কেন ভাবছেন। ওই ৪৮ শতাংশ ভোট-দেওয়া মানুষের কথা ভাবুন। ৪৮ শতাংশ ভোট-দেওয়া মানুষের একটা কালেকশন, একটা সম্মিলিত অস্তিত্ব হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। তো সেই মানুষগুলির কথা ভাবুন। তাঁদের বিভিন্ন প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা, কোথায় তাঁদের মোহভঙ্গ হচ্ছে, হতাশ হচ্ছেন, সেই থেকে তাঁদের বিক্ষোভ, সেসব ভাবুন।
সেই ৪৮ শতাংশকে আমি একেবারে বাদই দিয়েদিলাম, এক অদ্ভুত রাজনীতিতে। তাহলে বাকি রইল ৫২ শতাংশ। যে বাহান্ন শতাংশের ৩৮ শতাংশ আবার বিজেপিকে সমর্থন করেন, এবং যাঁদের একটা বড়ো অংশ কমিটেড দক্ষিণপন্থী। তাঁদের কাছে গিয়ে আমি আরও পাঁচটা তৃণমূল-বিরোধী কথা বলে আমার সমর্থক করে তুলতে পারব না। কাজেই আমাদের যে অডিয়েন্স, আমাদের বড়ো কাজ হল তাঁদের পাশে থাকা, তাঁদের লড়াইগুলি লড়া। দ্বিতীয়ত…
নী. হা.— আবার আপনাকে একটু আটকাচ্ছি, কারণ ঠিক এইখানে একটা প্রশ্ন আসছে— যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি এর আগে যে একটা বৃহত্তর বামপন্থী মঞ্চ তৈরির ডাক দিয়েছিলেন, আপনার কি মনে হয় পশ্চিমবঙ্গে সেটার সুযোগ আছে? সেটা সম্ভব? সেটা দরকার?
দী. ভ.— অবশ্যই। অবশ্যই দরকার। মঞ্চ বলতে… এই নির্বাচনে দু-তিনটে প্রয়োগ আমার ভালো লেগেছে। একটা হচ্ছে, এই যে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান এসেছিল, বা ‘বিজেপি হটাও, বাংলা বাঁচাও’—এ সমস্তগুলো ধরে মানুষের একটা সমর্থন চোখে পড়েছে। এই যে একটা নাগরিক সক্রিয়তা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বামপন্থী, আবার তারও মধ্যে অনেকেই নতুন প্রজন্মের, এই সক্রিয়তাটাকে ধরে রাখা দরকার। এটাকে আমাদের আরও বেশি করে সংহত করা খুব দরকার।
দ্বিতীয়ত, আমরা একটা প্রোগ্রাম করেছিলাম ‘২১-এর ডাক, মানুষের দাবি’। এটা বেশ ভালো সমর্থন পেয়েছিল। এবার, পশ্চিমবঙ্গে মানুষের দাবি-দাওয়াগুলোকে নিয়ে আমরা ধারাবাহিক, সংহত একটা আন্দোলন করতে পারি…
নী. হা.— এই ‘আমরা’ বলতে আপনি কাদের বোঝাচ্ছেন?
দী. ভ.— আমরা বলতে সবাইকে বোঝাচ্ছি। আমাদের পার্টি (সিপিআইএমএল—লিবারেশন) একটা ছোটো পার্টি। আমরা অবশ্যই আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো। একই ভাবে আমার মনে হয় অনেক সমমনোভাবাপন্ন মানুষ আছেন… যেহেতু, ওই যে আমি বললাম একটা চার্নিং, একটা মন্থন চলছে, একটা বামপন্থী পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে আমরা যাবো, ফলত এই মুহূর্তে অনেকেই, অনেকেই পালটাচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত যাঁদের সঙ্গে কোনো কথা হত না, আগামীকাল তাঁদের সঙ্গে কথা হবে। অবশ্যই হবে।
তৃতীয়ত আমি বলব, পশ্চিমবঙ্গে যে বিজেপি-র বিপদটা বাড়ছে, সেইখানে তৃণমূল কংগ্রেস একভাবে তার বিরোধিতা করছে। অন্যভাবে তার বিরোধিতা করার দায়িত্বটা আমাদের। কথার কথা বলছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর ‘মুসলিম তুষ্টিকরণের’ অভিযোগ (বিজেপি) তোলার পর, উনি যে সত্যিই তা করেন না, সেটা দেখাতে গিয়ে উনি চণ্ডীপাঠ ইত্যাদি নানা কিছু করলেন। আমরা হলে এটা করতাম না। আমরা বলতাম, মানুষের যে রুজিরুটির প্রশ্ন, নানা সংকটের প্রশ্ন রাজনীতি তাই নিয়ে হোক। ধর্ম আলাদা থাকুক। শুধু প্রত্যেকে যাতে নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা পান অন্যের ওপর আক্রমণ না করে সেটা সুনিশ্চিত করা হোক।
তারপর দেখুন, এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস যে বিজেপি-বিরোধিতা করেছেন, তাতে একটা কথা ছিল যে, ওরা ‘বহিরাগত’, তার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের জয় হল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, আদিত্যনাথ যোগী—এই যাঁরা সব বারবার এসেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে একটা স্লোগানের মতো ‘বহিরাগত’ কথাটা ব্যবহার করা হল, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বিজেপি যে ৩৮ শতাংশের ভোট পেল, তাঁরা? আমরা যাঁরা বাংলার ইতিহাসটা ভালো করে জানি, এখান থেকেই তো হিন্দু মহাসভার২ শুরু। ফলে আমার মনে হয়, মতাদর্শগত ভাবে আরএসএস যে বিষ ছড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলায়, সেই বিষ, সেই বিদ্বেষে মোকাবিলা আমাদেরই করতে হবে।
তৃতীয় পর্ব - গণতন্ত্রের লাক্সারিতে গড়ে ওঠেনি আমাদের দল, মানুষের ন্যূনতম গণতন্ত্রের জন্য লড়াইটাই আমাদের অভ্যাস
নীলাঞ্জন হাজরা— এই পর্বে আমার প্রথম প্রশ্ন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় যে বিজেপি-কে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক শক্তিতে পশ্চিমবঙ্গে আটকে দিয়েছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের একটা বড়ো অংশের মধ্যে মুসলমান-বিদ্বেষের বিষটা রয়েই গিয়েছিল। মতাদর্শগত ভাবে, যেটা আপনি বলেছেন গত পর্বে, তা নির্মূল করার তেমন চেষ্টা হয়নি, বা করা যায়নি। নিজের চোখে দেখেছি, ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি কলকাতার অতি পশ সব এলাকায় মুসলমান বন্ধুরা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বাড়ি ভাড়া পাচ্ছে না। কমিউনিস্টদের তখন পশ্চিমবঙ্গে প্রবল প্রতাপ। এখন বিজেপি সংসদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সে দলের বিধায়কের সংখ্যা ৭৭। এমতপরিস্থিতিতে সেই নষ্ট-না-করতে-পারা বীজ থেকে মহিরুহ দেখা দেবে এ আশঙ্কা তো প্রবল। আটকাবেন কীভাবে? কী করে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন আপনি?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য— এ রাজ্যে একটা ইতিহাস আছে—দেশভাগের ইতিহাস, ভিটে-মাটি ছেড়ে উঠে আসার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস, আছে। এই স্মৃতিগুলো আছে। আরএসএস, বিজেপি বারবার সেই ঘা-টাকে খুঁচিয়ে দিতে চায়। এর বিরুদ্ধে, এই খুঁচিয়ে তোলার বিরুদ্ধে, এই মুহূর্তে আমাদের খুব বড়ো ভাবে প্রচার করা দরকার। প্রথম কথা হচ্ছে, ঠিক করতে হবে আমরা কী করতে চাই? অতীতে আমরা বিরাট ধাক্কা খেয়েছি— দেশ ভাগ হয়েছে, দাঙ্গা হয়েছে, প্রচুর মানুষ ভিটে-মাটি-ছাড়া হয়েছেন। আমরা কি সেইখানে ফিরে গিয়ে কোনো একটা স্কোর সেট্ল করতে, একটা হিসেবনিকেশ করে নিতে চাই? নাকি আমরা ওখান থেকে এগিয়ে যেতে চাই? আপনি সাধারণ ভাবে দেখবেন, অনেক মানুষের অনেক তিক্ত স্মৃতি আছে, কিন্তু আমরা এগিয়ে গিয়েছি। এটাই হচ্ছে জীবনের গতি। আমার মনে হয়, বিজেপি আমাদের আবার ঠেলে ওই জায়গাটায় নিয়ে যেতে চাইছে। আজকে যদি সেটা হয়— বলছে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করে এক কোটি লোককে বের করে দেব। এক কোটি লোককে বের করে কোথায় পাঠাবে? যদি পাঁচ লক্ষ লোককেও বাংলাদেশে পাঠাতে হয় তাহলে তো আগে বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে…
নী. হা.— এগুলো তো অ্যাবসার্ড…
দী. ভ.— তার মানে হচ্ছে, গোটা পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা স্থায়ী সামাজিক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা, যে সোশাল কনফ্লিক্ট-টা কিন্তু আমার মনে হয়, ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ চান না।
নী. হা.— আপনার মনে হয় চান না?
দী. ভ.— চান না। তাঁদের মধ্যে প্রেজুডিস থাকতে পারে। তাঁদের অনেকের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি অনেক বিদ্বেষ থাকতে পারে, অনেক ভুল ধারণা থাকতে পারে। হয়তো তিনি পাশের বাড়িতে মুসলমান চান না, হয়তো তিনি বাড়ি ভাড়া দেবেন না, কিন্তু তিনি চান না যে পশ্চিমবাংলার চারদিকে সারাক্ষণ একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়ে যাক। আমার মনে হয়, এই যে একটা নর্মাল শান্তির জায়গা আছে, বিজেপি সেটাকেও শেষ করে দেবে। বিজেপি মানে পার্মানেন্ট অশান্তি।
নী. হা.— আপনাকে একটু আটকাচ্ছি। আমাদের একটা জিনিস খুব স্পষ্ট করে খোলাখুলি বোঝা দরকার। এই যে ধরুন যিনি বিরোধী দলনেতা হলেন, তিনি নির্বাচনের সময় যে সাম্প্রদায়িক ভাষা ব্যবহার করেছেন, আমার কাছে অন্তত তা অকল্পনীয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিল। কিন্তু আমার কাছে তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন আছে— আমার বাড়ি বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে, যে অঞ্চলে মুসলমান মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। সেইখানে, আমি দেখি আমারই বন্ধুস্থানীয়, বা আমারই মতন সাধারণ, মধ্যবিত্ত, পরিশ্রমের রোজগারে দিন গুজরান করা মানুষ— তাঁরা সমাজবিরোধী নন, অপরাধজগতের মানুষ নন, একেবারে সাধারণ মানুষ—আমার মতোই, হিন্দুধর্মাবলম্বী, তাঁদের অনেককেই আমি বলতে দেখি—সব ঠিক আছে, কিন্তু মুসলমানরা বড্ড বাড় বেড়েছে, এদের একটু টাইট দেওয়া দরকার। আমি যখন পালটা প্রশ্ন করি—তুই ক-জন মুসলমান মানুষের সঙ্গে মিশেছিস, তোর চারপাশে তো একজন মুসলমানও নেই… তো দেখি একটা অদ্ভুত ভীতি। মানে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে চলে—সারাক্ষণ একটা ভয়, একটা শত্রুপক্ষ তৈরি করে রাখা সংখ্যাগুরু শ্বেতাঙ্গ মানুষের মনে, হলিউডের যেটা একটা কাজ—কখনও কৃষ্ণাঙ্গ, কখনও কমিউনিজম, এখন ‘জেহাদি মুসলমান’—তারই একটা যেন আদল কিন্তু এই পশ্চিমবঙ্গেও আমি দেখি। এটা আছে। আমার প্রশ্ন হল—এইটাকে কীভাবে উপড়ে ফেলা যাবে? তা না হলে তো…
দী. ভ.— সেটাই বলছিলাম, যে ঠিক করতে হবে আমরা কী চাই? মুসলমানদের টাইট দেওয়ার নামে সেইসব অশান্তির দিনে ফিরে গিয়ে চারপাশে একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি করে কি নিজেদেরই টাইট দিয়ে ফেলতে চান?
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাদের এখানে দেশভাগের ফলে দাঙ্গা হয়েছে, ঠিকই, কিন্তু সেটাই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র ইতিহাস নয়— যে স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার আরএসএস অংশই নেয়নি। আমার মনে হয়, এই যে বিজেপিকে রুখে দেওয়া গেল, তার কারণ মানুষের মনের মধ্যে কোথাও একটা সেই চেতনাটা আছে। যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই অধ্যায়টা, যেটাকে বিজেপি বারবার চেষ্টা করছে ডমিন্যান্ট হিসেবে তুলে ধরতে, সেটাই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নয়। আমার মনে হয়, একটা ইতিহাস বোধ তৈরি করাও দরকার। যাতে সামগ্রিক ইতিহাসের মধ্যে কোথায় কী হল তা আমরা দেখতে পাই, বুঝতে পারি। পশ্চিমবাংলার যে স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসের ঐতিহ্য সেটা খুব জরুরি ব্যাপার এখানে।
আবার বাংলাদেশকে যদি দেখি—বাংলাদেশ আমাদের কী শিক্ষা দেয়? যে, ধর্ম দিয়ে একটা দেশ গড়া যায় না। সেই যে চেষ্টা হয়েছিল (পাকিস্তান তৈরির মাধ্যমে) সেটা কিন্তু ভেঙে গেল। এবার দেখবেন, এখানে অনেকের মধ্যে সেই দেশভাগ নিয়ে একটা তিক্ত স্মৃতি আছে, কিন্তু শুধু তাই নেই, বাংলাদেশের যে স্মৃতি তা নিয়ে একটা আবেগও আছে। বিজেপি শুধু ওই তিক্ততাটাকেই খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে।
আমাদের লজিক্যালি ভাবতে হবে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টাটাকে যদি রুখতে হয়, কাউন্টার করতে হয়, তাহলে আমাদের হাতে কী কী হাতিয়ার রয়েছে। একটা হচ্ছে ক্লাস, শ্রেণি— আমি আগে কৃষক, আমি আগে শ্রমিক, তারপরে হিন্দু বা মুসলমান। এই ব্যাপারটা যদি আসে তাহলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ব্যাপারটা খানিকটা পিছন দিকে চলে যায়। এই কথাটা আমি বলছি অনেক অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে, শুধুমাত্র কোনো থিওরেটিকাল আশা থেকে বলছি না। এর দুটো উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। একটা হল, বিহারের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আমাদের অনেকেই প্রচুর ভোট পেয়েছেন— আমাদের যুবসংগঠনের যিনি সভাপতি তিনি প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন। তার কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, আমাদের যাঁরা সমর্থক তাঁদের ভোট আমরা পেয়েছি, আরজেডি আমাদের সমর্থন করেছিল, সে দলের ভোটও আমরা পেলাম। এর বাইরেও, যাঁরা বিজেপি এবং জনতা দল (ইউনাইটেড)-কে সাধারণ ভাবে ভোট দিয়ে থাকেন জাত-পাত ইত্যাদি নানা পরম্পরাগত কারণে তাঁরাও আমাদের ভোট দিচ্ছেন। তাঁদের এই ভোট দেওয়ার কারণ, তাঁদের কাছে এবারে কর্মসংস্থান, সম্মানজনক বেতন, কাজের নিরাপত্তা এই ব্যাপারগুলো একটা বড়ো প্রশ্ন ছিল। ফলে বিহারে যেখানে এত জাতপাতের ভাগাভাগি তাকে অগ্রাহ্য করে যুবকেরা আমাদের ভোট দিলেন।
একই উদাহরণ চোখে পড়ছে কৃষক আন্দোলনে। ওই মুজ়ফ্ফরনগর শামলি অঞ্চলের কৃষকদের, যাঁরা শুধু বিজেপি-কে ভোটই দেননি ওখানের দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাও কিন্তু শুনছেন যখন খাপ পঞ্চায়েতের বড়ো মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে মহিন্দর সিং টিকায়টের ঘনিষ্ট বন্ধু মহম্মদ জোলা বলছেন— তোমরা অনেক ভুল করেছ। তোমরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছ। পিন-ড্রপ-সাইলেন্স। চাবুকের মতো কথাগুলো গিয়ে কিন্তু ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে এই শ্রেণি-চেতনার মাধ্যমে যদি শ্রেণিঐক্য গড়ে ওঠে, তাহলে সাম্প্রদায়িক মনোভাবটা হয়তো শেষ হয়ে যায় না, কিন্তু অনেক নীচে চলে যায়। এটা সম্ভব এবং এটা করা খুব প্রয়োজন। ১৯৪০-এর দশকে যদি আমরা ফিরে যাই বাংলার ইতিহাসে, তখন দাঙ্গা যেমন হয়েছে তেভাগা (কৃষক) আন্দোলনও হয়েছে। যদি তেভাগা না হত, দাঙ্গা হয়তো আরও বীভৎস হত। আজও তেমন কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন (সাম্প্রদায়িকতাকে) কাউন্টার করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আগে যেটা বলেছি— জেন্ডার। জেন্ডার কিন্তু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আটকে দিতে পারে। এটা খুব বড়ো প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, আমাদের যে সংস্কৃতি এবং সাব-ন্যাশনালিজমই বলুন বা বাঙালি-আইডেন্টিটিই বলুন এটা একটা বড়ো জায়গা আছে। আমরা এটা এইভাবে ভেবেছি যে, বাংলার একটা প্রগতিশীল উদার ঐতিহ্য আছে। বাংলা মানেই সব ভালো, বাইরের মানেই খারাপ— এইভাবে বাংলা বনাম বহিরাগত নয়, কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যের মধ্যে যে প্রগতিশীল উদার উপাদান আছে তার কথা বলছি। এই উপাদানগুলো অবশ্যই বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজন রুখতে পারে।
চতুর্থত, এবারে বামপন্থীদের ভোট অনেক কমে গেছে, ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিনের যে কমিউনিস্ট আন্দোলন, চর্চা তার একটা অভিঘাত এখনও আছে। যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন যে, পশ্চিমবঙ্গে কিছুতেই বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না, তাঁদের পিছনে কী? তাঁদের পিছনে একটা বড়ো বামপন্থী চেতনা কাজ করেছে।
এই চারটেকে যদি সংহত করা যায় তাহলে অবশ্যই বিজেপির সাম্প্রদায়িকতাকে এখানে রুখে দেওয়া যাবে।
নী. হা.— আপনার কি মনে হয় এই যে সংহত করার কাজ, সেটা এখন পশ্চিমবঙ্গে যে মূলধারার বামপন্থা আছে তার মাধ্যমে সম্ভব হবে? নাকি, সম্পূর্ণ বিকল্প একটা বামপন্থী শক্তির উঠে আসা দরকার?
দী. ভ.— দেখুন, একটা সময় ছিল যখন অনেকেই মনে করতেন দুটো (ধারা)—একটা বিকল্প বামপন্থা, আর-একটা প্রচলিত বেশ সফল বামপন্থা। এখন বামপন্থার যে প্রচলিত সবথেকে প্রভাবশালী মডেল ছিল সেটা এত দুর্বল হয়ে গেছে যে, নানা প্রশ্ন কিন্তু তার মধ্যেও উঠে গেছে। সেইজন্য আমার মনে হয় যে, আমাদের আরও দেখতে হবে। সেইজন্যই বলছি এটা পুনর্বিন্যাসের সময়। দেখতে হবে, সিপিআই(এম)-এর যাঁরা (নেতৃত্ব) তাঁরা কী করতে চাইবেন না বা চাইবেন। সবই এখন দেখার বিষয়। এখন কিন্তু চ্যালেঞ্জটা চলে এসেছে বামপন্থার কাছেই।
নী. হা.— এবার আপনাদের দলের বিষয়ে প্রশ্ন। ১৯৭৪ সালে আপনাদের দলের জন্ম, তারপর ধীরে ধীরে সংসদীয় রাজনীতিতে আসা, নির্বাচন লড়া—শেষে ২০২০ সালে এসে, ৪৬ বছর পরে, বিহারের বিধানসভায় ১২ টা আসন, ঝাড়খণ্ডের বিধানসভায় একটা আসন। দেশের সার্বিক সংসদীয় রাজনীতির যে ইতিহাস তার বিচারে আপনাদের দলের প্রায় ৫০ বছরের ক্রিয়াকর্মের আইনসভায় এই প্রতিফলন কি খানিকটা হতাশাব্যঞ্জক নয়?
দী. ভ.— না, আমি সেটা বলব না। আমাদের গ্রোথ হয়তো অনেক জায়গাতেই খুব ধীরে হয়েছে। আমরা একটা দুর্বল জায়গাতেই আছি। সেটা তো অবশ্যই আমাদের ভাবায়, ঠিক কথা। কিন্তু উলটো দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে ওটাই আমাদের স্ট্রেংথ। স্ট্রেংথ এই কারণেই, আমরা (নির্বাচনী) সাফল্যের স্বাদ এখনও পাইনি। কাজেই আমরা ওই নির্বাচনী সাফল্যের ওপরে খুব-একটা নির্ভর করি না। অর্থাৎ একটা আপাতদুর্বল শক্তি নিয়ে একটা কর্মসূচি তৈরি করে একটা আদর্শের জন্য কী করে লড়তে হয়, সেটা আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের দলের যদি সংস্কৃতি বলেন, তাহলে ভোটটা কেন এত কম হল, ওটা নিয়ে হইচই হবে না। কিন্তু কোনো একটা প্রশ্নে যেখানে পার্টির উচিত ছিল একটা উদ্যোগ নেওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কিন্তু তা করা হয়নি, তাই নিয়ে দলের মধ্যে একেবারে ধুন্ধুমার হয়ে যাবে। ধরুন আমাদের যে ছাত্রসংগঠন, আইসা (অলইন্ডিয়া স্টুডেন্ট্স অ্যাসোসিয়েশন) তাঁরা যে আন্দোলনগুলো করছেন, লড়ছেন, সেটা ভোটে রূপান্তরিত হবে না, কিন্তু সেগুলো আমাদের বিরাট ভাবে উৎসাহিত করে। ফলে, আমাদের কাছে নির্বাচনী সাফল্য কম, দমন, উৎপীড়ন, জেল, গণহত্যা এইগুলো ধারাবাহিক ভাবে আমাদের সহ্য করতে হয়েছে, ফলে আমাদের দলের একটা সহনশক্তি, একটা রেজিলিয়্যান্স তৈরি হয়েছে যেটা আমার মনে হয় আজকের দিনে খুব জরুরি। কারণ আজকে সাধারণ ভাবেই গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। সমস্ত বিরোধীদের ওপর আক্রমণ চলছে। আমাদের দলটা এমন পরিস্থিতিতে, এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে গণতন্ত্র খুব লাক্সারি। যে মানুষেরা এসেছেন, তাঁরা ভোটই দিতে পারতেন না। কাজেই আমরা খুব প্রিভিলেজের জায়গা থেকে আসছি না। ন্যূনতম গণতন্ত্র যেখানে নেই সেইখানে গণতন্ত্রের জন্য, সম্মানের জন্য লড়তে লড়তে আমরা আজকে এই জায়গাটায় এসেছি। ফলত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সম্মান-এর মূল্যটা আমরা খুব গভীর ভাবে বুঝতে পারি। সেইজন্যই বিজেপির বিপদটা বুঝতে আমাদের দলের কোনো অসুবিধা হয়নি।
নী. হা.— এবার আর-একটা মৌলিক প্রশ্ন। ভারতে Association for Democratic Reforms নামে একটি সংস্থা আছে। তারা ভারতীয় গণতন্ত্রের নানা সমস্যা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা, তথ্যসংগ্রহ, সমীক্ষা ইত্যাদি করে। বহু বছর ধরে তারা আমাদের সাবধান করছে, মানুষের ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত এ দেশে ক্রমাগত চলে যাচ্ছে অর্থবলের গ্রাসে। কীরকম? সম্প্রতি একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সিএমএস নামে একটা থিংকট্যাংক—Poll Expenditure, The 2019 Elections। এর মুখবন্ধ করেছেন প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি। ভারতে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জেতার জন্য যে অর্থ ব্যয় করে তাকে তিনি বলছেন ‘‘…horrors of money”। তার একটা হিসেব এরকম— ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সব দল মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীরা নিজেরা খরচ করেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। আর রাজনৈতিক দলগুলি সরাসরি খরচ করেছে ২০ হাজার কোটি টাকা। মানে, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলি একত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করতে খরচ করেছে, ৪৪ হাজার কোটি টাকা! কী করে প্রভাবিত করবে? ক্যাম্পেন করে, আর পাবলিসিটি করে (অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম মূলত ও সামাজিক মাধ্যমে কিছুটা)। এই দুই খাতে নির্বাচনী প্রচারের কয়েক মাসে খরচ হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার সিংহভাগ কোথা থেকে আসে চিহ্নিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এর একটি ক্ষুদ্র অংশ রাজনৈতিক দলগুলিকে জনপরিসরে বাধ্যতামূলক ভাবে জানাতে হয়। এডিআর-এর একটি পৃথক রিপোর্ট দেখলে দেখা যাবে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে অতি সামান্য, সিপিআই(এম) ঘোষিত ভাবে যে ৮.০১ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছিল তার ৫৫ শতাংশ দিয়েছিল নানা কর্পোরেট সংস্থা (বিজেপি পেয়েছিল ৯৬৯.৩১ কোটি টাকা, যার ৯৪ শতাংশ কর্পোরেট-অর্থ) এটা একটা ছোট্টো ঝলক, এর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব এই রিপোর্ট ও এডিআর-এর ধারাবাহিক নানা রিপোর্টে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনাদের দলের মতো একটি দল কীভাবে সংসদীয় রাজনীতিতে অগ্রসর হতে পারে?
দী. ভ.— আমাদের কাছে প্রশ্ন হল, আমাদের কাছে যা-যা পথ আছে, সেগুলিকে কাজে লাগাতে। এই ব্যবস্থা তো আমরা তৈরি করিনি। এটা আছে। এবং এর মধ্যেই আমাদের লড়াই করতে হবে। ছোটো করে হলেও এই পরিস্থিতিতেও কিছুটা সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে, আমার বিশ্বাস পরবর্তীকালে বৃহত্তর লড়াইয়ের পরিস্থিতেও সেটা সম্ভব। দেখুন, আমরা তো একসময় ভোট বয়কট করতাম। পরে দেখলাম সমাজের একটা বড়ো অংশের দরিদ্রতম অংশের তো আসলে ভোটই নেই, তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দেয়। তার সেই মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটা আদায় করতেই পরে আমাদের অনেক বেশি সংঘাতপূর্ণ লড়াইতে যেতে হয়েছে, যখন আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে শুরু করলাম। আমি এটা এভাবে দেখি— আম্বেডকর সংবিধান তৈরির সময় একটা কথা বলেছিলেন যে—Democracy in India is only a top-dressing on an Indian soil, which is essentially undemocratic. তার মানে, উনি বলছেন, সংবিধান আসলে একটা গ্যারান্টি নয়, একটা হাতিয়ার। এই হাতিয়ার ব্যবহার করে সংবিধানে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তার জন্য তো লড়তেই হবে, ওই অগণতান্ত্রিক জমিনটাকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে হলে। নির্বাচন অবশ্যই বেশি বেশি করে পয়সার খেলা হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে সংবাদমাধ্যমও আছে। কাজেই পরিস্থিতি সত্যিই আমাদের বিপক্ষে, কিন্তু লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই রাস্তা বের করা ছাড়া আর কী উপায় আছে আপনি বলুন! এবং আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই মডেলের বাইরেও কিন্তু নির্বাচন লড়া সম্ভব। আমরা যেটুকু জিতেছি নির্বাচনে, তাতে তো ওই বহরের খরচ করতে হয়নি। আমার মনে হয় নির্বাচন লড়ার ক্ষেত্রেও বৃহৎ পুঁজির সাহায্যের একটা বিকল্প মডেল তৈরি করা সম্ভব।
নী. হা.— আপনাদের দলের কর্মসূচির মধ্যে আমি একটা লাইন দেখলাম, যেটা আমার মনে হল আপনাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির নিরিখে খুব গুরুত্বপূর্ণ—অপারেটিভ অংশ যাকে বলে—Peoples’ democratic revolution with agrarian revolution as its axis। এটা একটু সোজা বাংলায় বুঝিয়ে বলবেন?
দী. ভ.— অবশ্যই। সহজ বাংলায়, ভারত এখনও কৃষিপ্রধান দেশ। আমদের সমাজের বেশির ভাগটাই এখনও কৃষিনির্ভর সমাজ। ফলে গ্রামের মানুষের সংখ্যা বিপুল। এই পরিস্থিতিতে যদি আমাদের একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে এই যে কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ, মানে শুধুমাত্র যে কৃষিকাজ বলছি তা নয়, কৃষিকাজ ঘিরে যে বৃহত্তর সমাজ রয়েছে, সেই গ্রামাঞ্চলে বড়ো পরিবর্তন আনতে হলে, ওই নীচের মাটিটায় গণতন্ত্র আনতে হবে। নইলে কিন্তু ওই টপ-ডেস্রিং ফেটে চৌচির হয়ে পড়ে যাবে। এই নীচের মাটিটায় গণতন্ত্র আনতে গেলে দরকার অ্যাগ্রারিয়ান রিভলিউশন, কৃষিভিত্তিক বিপ্লব। সেই মাটির সঙ্গে যুক্ত মানুষের ক্ষমতায়ণ, এটাই হল মূল কথা। যদি সিপিআই(এম)-এর কথা টেনে বলি, একটা সময় এসে তাঁরা বললেন ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। মানে, চলো কৃষিভিত্তির কাজ হয়ে গিয়েছে, এবার এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আজ তো সারা দেশে ভিত্তিটাই সংকটে। আমার মনে হয়, কৃষি যে ভিত্তি এ কথা বলে ছেড়ে দিলে হবে না। এই ভিত্তিটাকে শক্তিশালী করতে হবে। এটাই আমাদের দলের মূল কথা।
নী. হা.— বেশ। এবারে আর একটা জরুরি বিষয় তুলি। ১৯৪৭ সালের ভারত আর আজকের ভারতের মধ্যে একটা বড়ো তফাত হল এক বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান। তাঁদের মধ্যেও বিভাজন আছে, নিম্নমধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এইসব। কিন্তু এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষ, তাঁদের প্রধান একটাই দাবি আজ—চাকরি চাই। এই দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে, কিছু প্রসাধনিক পার্থক্য ছাড়া বিজেপি, কংগ্রেস এবং মূলধারার বামপন্থীদের যে ফর্মুলা, তাতে মৌলিক কোনো তফাত নেই। সহজ বাংলায়—দেশি, বিদেশি পুঁজিতে বৃহৎ শিল্প না গড়ে তুলতে পারলে এই ভয়াবহ বেকার-সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। বাকিটা গালগল্প, বাস্তবোচিত নয়। আপনাদের কর্মসূচি আমি যেটুকু পড়লাম তাতে ‘জব’ কথাটারই উল্লেখ নেই। ‘এমপ্লয়মেন্ট’ কথাটা একবার পেলাম ভারতীয় সমাজের চরিত্র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। আপনারা, আমি যা জানি, এই মডেলের বিরোধী। যদি তাই হয়, তাহলে আপনাদের মতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে কী করে?
দী. ভ.— হাতেকলমে অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিচ্ছে, একটা সময় বড়ো শিল্পে চাকরি হত, কিন্তু এখন সর্বত্র জব-লস্। বিরাট মাত্রায়। দেখবেন যাঁরা বড়ো শিল্পের পক্ষে বলছেন, তাঁরাও বলছেন বড়ো শিল্প হলে, অনেক অ্যানসিলারি হবে, পারিপার্শ্বিক ছোটো উদ্যোগ হবে, সেখানে অনেক চাকরির সুযোগ হবে। এখানে দেখুন, সিঙ্গুর নিয়ে একটা (বিতর্ক) হল, শিল্প ওখানে হবে নাকি হবে না। কিন্তু হিন্দমোটরের মতো বিশাল শিল্প যে ঠিক তার পাশেই বহুকাল ধরে ছিল, এবং উঠে গেল, কই সেটা নিয়ে তো কেউ কথা বললেন না। একদিকে একটা শিল্প হবে, তার জমি নিয়ে হইহই করব, বলব ঠিক ওইখানটায় ওই শিল্পটাই না হলে নয়, আর পাঁচটা শিল্প উঠে যাবে—তাহলে তো এই উত্তরটা আগে দিতে হবে, এই বড়ো বড়ো শিল্পগুলো কেন উঠে যাচ্ছে, কেন সরকারি উদ্যোগ তুলে দেওয়া হচ্ছে?
নী. হা.— কিন্তু আমি আমার মূল প্রশ্নটার উত্তর পেলাম না।
দী. ভ.— সে প্রশ্নের উত্তর হল, ওই কর্পোরেট শিল্পায়ন দিয়ে হবে না। এটা দিয়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে না। চাই অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই)। চিনের অভিজ্ঞতা দেখুন। সেদেশ যদি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষের চাকরির দাবি কিছুটা মিটিয়ে থাকতে পারে, সেটার একটা বড়ো কারণ এমএসএমই সেক্টরের প্রসার।
দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্রে আমরা যদি ইউরোপ বা মার্কিন মডেলে প্রযুক্তিকরণ, মেকানাইজেশন, করতে চাই, যেখানে বিপুল উৎপাদন হবে কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ মানুষের জীবিকা তার উপর নির্ভরশীল হবে, সেটা এ দেশে হবে না। কৃষিতে যদি কোঅপারেটিভ বা ছোটো খামার মডেলে (উন্নতি) না করা যায়। গোটা কৃষিক্ষেত্র যদি আদানি-আম্বানিদের হাতে চলে যায়, এবং কৃষিক্ষেত্র থেকে যদি কোটি কোটি মানুষ উদ্বৃত্ত হয়ে চলে আসতে থাকেন, এখনও আসছেন, তাহলে তাঁরা যাবেন কোথায়? কৃষি আমাদের ভিত্তি বলে কৃষিক্ষেত্র থেকে বহু মানুষকে উচ্ছেদ করে দিলাম, এ দিকে শিল্পে তাঁদের জীবিকার ব্যবস্থা হল না, তা হলে তাঁদের কী হবে? দেখুন, কৃষিনির্ভর অঞ্চল, মানে গ্রামাঞ্চল মানেই বঞ্চনা— সেখানে বিদ্যুৎ নেই, হাসপাতাল নেই, স্কুল নেই, ইন্টারনেট নেই— এই চেহারা যদি থেকেই যায়, তাহলে হবে না। গ্রামের একটা অন্য কল্পনা করতে হবে।
দেখুন, ব্যাপারটা একেবারে অন্য ভাবে ভাবতে হবে। শুরু করতে হবে প্রত্যেকের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করা দিয়ে। এটা ঠিক মতো করতে গেলে কত স্কুল, কত হাসপাতাল লাগবে হিসেব করুন। সেখানেও তো চাকরি হতে পারে। মানে এ ভাবেও ভাবা যায়। তা না ভেবে বড়ো বড়ো শিল্প হবে, সেখানে প্রচুর চাকরি হবে, এটা একটা ইলিউশন। এটা বাস্তবে হয় না।
নী. হা.— এক্কেবারে শেষে, আপনার বিষয়ে দু-কথা—আপনি এই রাজনীতিতে এলেন কীভাবে? আপনার দেশ কোথায়?
দী. ভ.— আমার জন্ম গুয়াহাটিতে, ১৯৬১ সালে। আমার বাবা—বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য—রেলে চাকরি করতেন। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে ওখানেই। পাঁচ বছর বয়সে চলে আসি আলিপুরদুয়ার। ১৯৬৭-তে আমি ক্লাস ওয়ানে। তখন নকশালবাড়ি আন্দোলন ঘটছে। আমাদের স্কুলের দেয়ালের গায়ে মানচিত্র, স্লোগান—সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন, শ্রীকাকুলাম… এই জিনিসগুলো তখন থেকেই আমার কাছে খুব জীবন্ত। তারপর বাবার সঙ্গে একটু একটু আলোচনা করতাম। বাবা বামপন্থী ছিলেন, তবে কোনো দলের নয়। কোনোদিন আমাকে বলেননি যে এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। অনেক পরে একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন, যদি আগে বুঝতাম তুমি এটাই করবে, তখন এসব বলতাম না। তো একটা ইমপ্রেশন ছিল, খুব গভীর। তারপর ১৯৭৪ সালে চলে আসি ক্লাস এইটে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে। জরুরি অবস্থার সময়। সেই বিশাল দেয়ালের ঘেরার মধ্যেও খবরাখবর পেতাম।
নী. হা.— উচ্চমাধ্যমিক পাস করা অবধি নরেন্দ্রপুরেই?
দী. ভ.— হ্যাঁ। নরেন্দ্রপুর থেকে বেরিয়েছি ১৯৭৯-তে। বেরিয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট (আইএসআই)। ১৯৭৯-১৯৮৪। সেইসময় থেকেই আমি প্রায় ফুলটাইম পার্টির সঙ্গে যুক্ত। যদিও পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ডিগ্রিও পেয়েছি। কিন্তু পার্টিটাই বেশি মনোযোগ দিয়ে করতাম।
নী.হা.— অনেক ধন্যবাদ।
দী.ভ.— ধন্যবাদ।