না-শরীরী কাহন - নিকোলাই গোগোলের ‘ডেড সোলস' এর নাট্যরূপ - ৮

                                      দ্বিতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য

 

  [ গান-বাজনা ও বলনাচ চলছে। বিচারালয় সমূহের প্রেসিডেন্টের অফিস। একটা লম্বা টেবিল। প্রেসিডেন্ট চিচিকভের কয়েকটি ক্রয়দলিল খুঁটিয়ে দেখছেন ]

  প্রেসিডেন্ট : ওহে মি.চিচিকভ। প্যাভেল ইভানোভিচ। আপনি সম্পত্তি লাভ করেছেন। তাই তো?

 চিচিকভ : হ্যাঁ স্যার।

 প্রেসিডেন্ট : বিশাল সম্পত্তি! ভালো, খুব ভালো।

    ( মানিলভ প্রবেশ করে। পরনে জমকালো লোমের কোট। চিচিকভকে দেখে সে  বিস্ময়ানন্দে চেঁচিয়ে ওঠে)

 মানিলভ : আঃ।

     ( সে চিচিকভকে আলিঙ্গনে অস্থির করে তোলে। উভয়ে উভয়কে এমনভাবে চুমু খায় যে সারাদিনে তার সামনের দাঁতের ব্যথা যায় না। মানিলভ এতটাই খুশি যে তার চোখ প্রায় বুজে আসে। মুখজুড়ে জেগে থাকে শুধু নাক আর ঠোঁটজোড়া)

 প্রেসিডেন্ট : আমাদের প্রিয় অতিথি মি.চিচিকভ বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, বুঝলেন?( প্রেসিডেন্ট দলিলগুলি দেখাতে চায় কিন্তু তার আগেই মানিলভ ফিকে নীল ফিতেয় বাঁধা একটা কাগজের গোল পুঁটলি চিচিকভের হাতে তুলে দেয়)

 চিচিকভ : এটা কী?

 মানিলভ : আপনার ভূমিদাসের দল।

 চিচিকভ : আঃ!

 প্রেসিডেন্ট : আরও সম্পত্তি! ( চিচিকভের কাছে এসে ওকে কাছে টেনে নিতে চায়)

 চিচিকভ : ( পুঁটলিটি খুলে দলিলটি দেখে) বাঃ, সুন্দর হয়েছে। যেন একটি শিল্পকর্ম এটি, নিছক ক্রয়দলিল নয় ( প্রেসিডেন্টকে) এর আর কপি করার দরকার নেই স্যার… বাঃ, চারদিকের এই বর্ডারটা কে করেছে? ফুল এঁকে?

 মানিলভ : ওটি জানতে চাইবেন না দয়া করে।

 চিচিকভ : আপনি এঁকেছেন? 

 মানিলভ : না, আমার স্ত্রী লিজানকা।

 চিচিকভ : এর পিছনে এত খেটেছেন ভেবেই আমার লজ্জা লাগছে খুব।

 মানিলভ : খাটনি? প্যাভেল ইভানোভিচ চিচিকভের বিষয়ে এই শব্দের কোনও অস্তিত্বই নেই।

    ( সবাকেভিচ ও ফাদার কিরিল প্রবেশ করে। সবাকেভিচ কথা না বলে এক গোছা কাগজ চিচিকভের দিকে ঠেলে দেয়।) 

 চিচিকভ : ( আবার দলিলের দিকে তাকিয়ে, খুশিমনে) মশাই, কেমন আছেন?

 সবাকেভিচ : এই চলে যাচ্ছে একরকম, তাঁর কৃপায়।

 প্রেসিডেন্ট : চলে যাচ্ছে মানে? আপনার পোক্ত শরীরের একটা নাম আছে। ( চিচিকিভের প্রতি) ঠিক ওঁর শক্তিশালী বাবার মতো, বুঝলেন?

 সবাকেভিচ : তা বটে! বাবা খালি হাতেই বিশাল ভালুককে পেড়ে ফেলতে পারত।

 চিচিকভ : মনে হয় আপনিও পারবেন… যদি মনে করেন।

 সবাকেভিচ : না, না। আমি পারব না। বাবার গায়ের জোর আমি কোথায় পাব?...আগেকার দিনের মানুষ কিনা!

      ( সবাকেভিচ মাথা নাড়তে নাড়তে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। অন্যান্যরা একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে)

 ফাদার কিরিল : আমি বিধবা মহিলা করোবোচকার হয়ে দলিলে সই করতে এসেছি। সে খুব রুগ্ন, এতটা পথের ধকল তার সইবে না ; আর এমন একটি দুর্দান্ত বিষয়ের আবেগ তার সইছে না ঠিক।

 প্রেসিডেন্ট : হুঁ, আর আমি বৃদ্ধ প্লায়ুশকিনের পক্ষে সই করব। ও যে বেঁচে আছে, জানতামই না।

 সবাকেভিচ : কুত্তা কোথাকার! শয়তান একটা! ভূমিদাসগুলোকে উপোসে রেখে মেরে ফেলল!

 প্রেসিডেন্ট : তাহলে আপনার সব তৈরি তো?

     ( প্রেসিডেন্ট, মানিলভ, সবাকেভিচ আর ফাদার কিরিলের ছেলে একে একে সই করে। সকলেই নিজ নিজ স্বাচ্ছন্দ্যমতো। ফাদার কিরিল ধর্মীয় ঢঙে সকলের ওপর হাতের ইশারায় ক্রশ আঁকেন। চিচিকভ এরপর দৌড়ে গিয়ে দলিলে প্রতিস্বাক্ষর দিয়ে দেয়)

 প্রেসিডেন্ট : যাক, তাহলে সব চুকল।

 চিচিকভ : হ্যাঁ, চুকে গেল।

 প্রেসিডেন্ট : এতদিনে দু লক্ষ রুবলের বিনিময়ে চাষাদের হাতবদল হল। বিষয়টি শহরময় শুধু চাউর হতে বাকি। দেখুন না কী হয়! শাশা, আমার স্ত্রীকে খবর দাও। এই তুমি ( কেরানিকে) গভর্নরকে গিয়ে বলো। বলো যে কাজ হয়ে গেছে। আমরা এখন সেলিব্রেট করব।

 মানিলভ : আঃ…

 প্রেসিডেন্ট : সম্পত্তির মালিক!

 চিচিকভ : হ্যাঁ, ঠিক তাই।

 ফাদার কিরিল : সম্পদের মালিক! ( ক্রশে হাত ঠেকিয়ে আশীর্বাদ দেন)

     [ গান শুরু হয়। গভর্নরের সাজানো ঘরে নাচের প্রস্তুতি চলতে থাকে যখন মঞ্চের এক পাশে চিচিকভও নাচের প্রস্তুতি নিতে থাকে - পেত্রুশকার ধরে থাকা একটি লম্বা আয়নার সামনে আর অন্যদিকে নাচের পোশাকে মহিলারা জড়ো হতে থাকে, বিশেষ করে মানিলভের স্ত্রী, আনা গ্রিগোরিয়েভনা আর সোফিয়া ইভানোভনা। তারা খোশগল্পেও মশগুল হয়]

।। মূল উপন্যাসের অংশবিশেষ।।

–-------------------------------------------

 [ পাক্কা একটি ঘন্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিচিকভ নিজেকে দেখতে থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মুখজুড়ে মেলতে থাকে নানান ভাব। কখনও তা গম্ভীর, কখনও শিষ্ট কিন্তু ভূতের হাসি মেশানো। তারপর হাসি ছাড়াই শিষ্ট। বেশ কয়েকবার সে আয়নার সামনে মাথা নোয়ায়, মুখে ফরাসি ভাষার মতো শুনতে অস্পষ্ট উচ্চারণ যদিও ফরাসি জানেই না সে। তারপর চোখ টিপে, ঠোঁট কুঁচকে জিভ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে নিজেকে মজার আনন্দ দিতে থাকে। সংক্ষেপে একা থাকলে অনেকেই এমনতরো বিদঘুটে সব আচরণ করে - ভাবে, দুনিয়ায় সেই তখন একমাত্র সুদর্শন মানুষ।

     শেষত চিবুক-ফাঁকে মুচকি হেসে ও বলল, দুষ্টু বুড়ো মুখটা!... বলেই সাজতে শুরু করল। সাজার সময়টায় নিজেকে পুরো সুখী আর সন্তুষ্ট ভাবতে লাগল; আর কখনও জোড়, কখনও বা গলাবন্ধনী টেনে দেখতে থাকে। নিচু হয়ে দক্ষ হাতে পোশাক ঠিকঠাক করে নেয় এবং যদিও জীবনে কখনোই নাচেনি তাও দুপায়ে টক্কর মেরে তৈরি হয়। এই টক্করের ছোট্ট আওয়াজে কেঁপে ওঠে ড্রয়ারের বুক আর ব্রাশটা টেবিলের ওপর থেকে পড়ে যায়।]

 চিচিকভ : বোকা বুড়ো কোথাকার!

    ( মহিলারা চিচিকভকে নিয়ে খোশ কথা বলতে থাকে) 

 আনা গ্রিগোরিয়েভনা : অবাক লাগছে, অ্যাদ্দিন কেন ওকে খেয়াল করিনি!

 লিজানকা মানিলভ: দারুণ ভদ্র ব্যবহার লোকটার।

 সোফিয়া ইভানোভনা : আমরা তো কখনোই ভাবিনি যে লোকটা ক্রোড়পতি।

 আনা: অবশ্যই তা দিয়ে আমরা বাস্তবিকই প্রভাবিত নই।

 লিজানকা : আচ্ছা, ওর নাকটি দারুণ আকর্ষণীয় না?

 সোফিয়া : কথাটি শুনতে কী দারুণ! ক্রোড়পতি!

 আনা: ক্রো-ড়-প-তি! সত্যিই দারুণ শুনতে।

 সোফিয়া : এত গুণ! আমরা তো আগে খেয়ালই করিনি।

 আনা: মনে হয় কোটিপতির নানান গুণাবলি থাকে।

      ( চিচিকভ নাচঘরে পৌঁছায়)

 সকলে এক সঙ্গে : ওই যে আসছে!

     ( সকলেই চিচিকভের দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু উচ্চ- পদকর্তারাই আগে তাকে ধরে নেয় ; একজন গলায় জড়িয়ে অপরের গলায় সঁপে দেয়, নাচে যেমনটি হয়)

 গভর্নর : ওঃ, মি. চিচিকভ।

 পোস্টমাস্টার : আমাদের প্রিয় চিচিকভ মশাই।

 প্রেসিডেন্ট : আমাদের প্রিয় প্রিয় মি.চিচিকভ।

 পুলিশকর্তা: আমাদের সবচাইতে সম্মাননীয় মি. চিচিকভ।

 গভর্নরের স্ত্রী : আমি কি একটি চুম্বন পেতে পারি, মি. চিচিকভ?

       ( এবারে চিচিকভ মহিলাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে যায়। নাচের ভঙ্গিতে ছোটো ছোটো পা ডাইনে- বাঁয়ে ফেলে ঝুঁকে ঝুঁকে সে সকলকে খুশি করে)

 লিজানকা : আঃ, আপনি দারুণ, প্যাভেল ইভানোভিচ!

 সোফিয়া : খুবই চিত্তহারী!

 আনা : ওঃ, মি. চিচিকভ, মি. চিচিকভ!!

      ( চিচিকভের হাতের মুঠো ফুলমালায় ভরে যায়। গানবাজনা চলতে থাকে। জোড়ায় জোড়ায় নাচতে থাকে সব। চিচিকভ উদ্ভাসিত মুখে দেখতে থাকে)

 গভর্নরের স্ত্রী : তাহলে মি. চিচিকভ, আপনি শেষ পর্যন্ত সম্পত্তির মালিক হলেন?

 চিচিকভ : হ্যাঁ মহাশয়া, হলাম।

 গভর্নরের স্ত্রী : আর এটি একটি ভালো জিনিস, সত্যিই একটি দারুণ ব্যাপার হল।

 চিচিকভ : ইয়েস ম্যাম একসেলেন্সি। আমাকে এটা মানতেই হবে, আমি তো এর বেশি কিছু ভাবতেই পারছি না… দারুণ ভালো ব্যাপার… তা যাই বলুন না কেন, একজন মানুষ তখনই কলকে পায় যখন সে নিজের তৈরি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে… যৌবনকালের বড়ো বড়ো দিবাস্বপ্নের কোনও অর্থই হয় না।

   ( গভর্নর এ সব শুনছে না। সে তার উজ্জ্বল ষোড়শী মেয়ের সঙ্গে বলনাচ নাচছে। অন্যান্য মহিলাদের সুন্দর সাজগোজের মাঝে তার শাদা -সরল পোশাক দ্যুতি পাচ্ছে বেশি। চিচিকভ ওর সৌন্দর্য দেখে মোহিত দৃষ্টিতে তাকায়। ওর হাতের ফুল পড়ে যায়)

 গভর্নরের স্ত্রী : মি. চিচিকভ, আমার মেয়ের সঙ্গে তো আপনার পরিচয় হয়নি? এই সবে বোর্ডিং স্কুল থেকে এসেছে। দারুণ সতেজ!

 চিচিকভ : ঠিক তাই, মহীয়সী। যা বললেন তাই তো দেখছি!

     ( গভর্নরের স্ত্রী মেয়ের সঙ্গে যোগ দিতে এগোয়। চিচিকভ ঘাড় উঁচিয়ে সতেজ ফুলটিকে দেখতে থাকে। ওর নাচের ছন্দ বন্ধ হয়ে যায়। কোথায় হারিয়ে যায় যেন! মহিলারা সদর্পে চিচিকভের কাছে গিয়ে চোখা চোখা মন্তব্য সব ছুঁড়ে দেয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভালোটি ওর সামনে মেলে ধরতে ব্যগ্র হয় - কেউ পাশ থেকে চেহারা, কেউ উন্নত বুক, কেউবা সুন্দর চুলের গোছা, কেউবা আবার চমৎকার গাউনটি)

 সোফিয়া : ওহো মি. চিচিকভ… ওই সুন্দরীর নামটি জানতে পারি কি?

 আনা: এভাবে আপনাকে বিস্মৃতির সুন্দর উপত্যকায় গভীরভাবে ডুবিয়ে দিল কে?

     ( সোফিয়া ইভানোভনা তার নাচের কার্ড এগিয়ে দেয়। মাজুরকা নামের বিশেষ পোলিশ নাচ শুরু হয়। চিচিকভের কিন্তু এ সবে নজর নেই। সে এ সব ছাড়িয়ে গভর্নরের মেয়েকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়। তাকে দেখতে পায় ও পাশে বসার একটা জায়গাও আবিষ্কার করে। তারপর অভব্যঢঙে মহিলাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় সে এমনকি একজনকে ঠেলেও সরিয়ে দেয়। মহিলারা এক জায়গায় জড়ো হয় ও প্রতিহিংসার আগুনে ফুঁসতে থাকে)

 সোফিয়া : ওহোঃ।

 আনা : ঠিকাছে।

 সোফিয়া : লোকটা ক্রোড়পতি হতে পারে কিন্তু আদপে ওর কোনও গুণই নেই।

 আনা: আর ওই বেহায়া ছেনাল মেয়েটাকে দেখো, কেমন করে ওর পানে ছুটে আসছে!

   ( আসলে চিচিকভ যখন নতমস্তকে ওর সামনে দাঁড়ায় তখন গভর্নরের মেয়ে স্মিতঢঙে হাসে মাত্র ও সে এরমধ্যেই চিচিকভের সঙ্গে বাক্যালাপে চরম বিব্রত… প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়েছিল)

 চিচিকভ : ( গভর্নরের মেয়েকে) সম্ভবত আমি যে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছি সে বিষয়ে তুমি জানতে আগ্রহী। এ ছাড়া খেরশন প্রদেশে শেষ পর্যন্ত আমি যে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে চাই তার পরিকল্পনা বিষয়েও নিশ্চয়ই জানতে চাও? অথবা তোমার বয়স কম বলে তুমি হয়তো সেই দারুণ মজাদার গল্পটি শুনতে চাও যেখানে সিমবারস্ক প্রদেশে সফ্রোন বেসপেচনির বাড়িতে তার মেয়ে অ্যাডিলেডের সঙ্গে ওর তিন ননদ মারিয়া আলেকজান্দ্রা ও মাকলাটুরার সামনে আমার প্রতি যা ঘটেছিল অথবা পায়াজান প্রদেশে ফিওডোর পেরেক্রোয়িভের ওখানে… আর তারই শ্যালিকা ক্যাটারিনার সামনে… কী যে সব ঘটেছিল না…!

    ( গভর্নরের মেয়ে বিরক্ত, কোনওমতে ক্লান্তির হাই লুকোতে চাইছে তখন। মহিলারা চিচিকভকে দেখতে থাকে) 

 চাকর : উপস্থিত ভদ্রমহোদয়, মহোদয়াগণ… ডিনার প্রস্তুত।

      ( একটি পোলিশ গানের সুর বেজে ওঠে আর অতিথিরা খাবার টেবিলের দিকে এগোতে থাকে)

 পুনশ্চ :

–----------

     পাঠক, হাতে সময় আর ধৈর্য ধরে শোনার অবস্থায় থাকলে বলি কী কী প্লেট পরিবেশিত হল : শ্বেত স্টারজেন, সাধারণ স্টারজেন, স্যালমন। প্রেশ্‌ড ক্যাভিয়ার। হেরিংস, স্টেলাটেড স্টারজেন। নানাজাতের চিজ। স্মোকড্‌ টাং, শুকনো স্টারজেন, স্টারজেন পিঠে। মাশরুম পিঠে। ফ্রায়েড পেস্ট্রি। মাখনের রান্না ডাম্পলিং আর মধু মেশানো ফলের স্টু।