না-শরীরী কাহন - নিকোলাই গোগোলের ‘ডেড সোলস' এর নাট্যরূপ - ৭
- 07 October, 2025
- লেখক: বিপ্লব বিশ্বাস
প্রথম অঙ্ক : সপ্তম দৃশ্য
[ করোবোচকার বাড়ি। ঝোড়ো রাত। ঘরে আলো জ্বলছে। আছে চায়ের স্যামোভার। দেয়ালে প্রভুর চিত্র ]
করোবোচকা : একটু চা দিই মশাই?
চিচিকভ : তা মন্দ হয় না, ম্যাডাম। অবশ্য যদি এভাবে হুট করে আসাতে আপনি বিরক্ত না হয়ে থাকেন।
করোবোচকা : মোটেই না, মোটেই না। বাইরে এমন ভয়ানক ঝোড়ো আবহাওয়া। প্রভু কী এক দুর্যোগের মাঝে না আপনাদের এনে ফেললেন! কী বাজ রে বাবা! আমি তো ছবিটির নিচে সারাক্ষণ একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখি। বরং চায়ের সঙ্গে একটা কিছু মুখে দিন। ফ্লাস্কে কিছু ফ্রুট ব্র্যান্ডি আছে।
চিচিকভ : সেটিও মন্দ বলেননি। ফ্রুট ব্র্যান্ডি! বাঃ, এতেই কাজ হবে। তা ম্যাডাম, আপনার পারিবারিক নামটি আর একবার বলবেন? আমি এখনও ঠিক…
করোবোচকা : করোবোচকা। একজন কলেজিয়েট সেক্রেটারির বিধবা।
চিচিকভ : বিধবা!
করোবোচকা : আপনি শুয়ে একটু বিশ্রাম নিন না। রাস্তায় সারাক্ষণ কী করেছেন? হা প্রভু! গোটা পিঠটা তো কাদায় ভর্তি! শুয়োর কাদায় গড়ালে যেমনটা হয় আরকি। আসুন, গরম জলে ওগুলো ঘষে তুলে দিই। জুতো খুলে শুয়ে পড়ুন। পায়ের গোড়ালিতে সুড়সুড়ি দেব? আমার স্বামীর আবার এটি না করলে ঘুমই আসত না। ফেটিনিয়া, কোথায় রে? এখানে আয় তো। মশায়ের পিঠের কাদা ঘষে তোল আর গোড়ালিতে এট্টু সুড়সুড়ি দিয়ে দে।
চিচিকভ : না, না। ধন্যবাদ ম্যাডাম। আমার ওসব লাগবে না।
করোবোচকা : কয়েকটি প্যানকেক চলবে? এত বেশি কিন্তু কিন্তু করবেন না তো, খান।
চিচিকভ : আপনার হাতের প্যানকেক? দুর্দান্ত! ফ্রুট ব্র্যান্ডিও তাই( চুমুক দিয়ে)।
করোবোচকা : আর আপনার নামটিই বা কী স্যার? কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আপনি কর-টর ঠিক করেন। আপনি নিশ্চয় ট্যাক্সের লোক নন?
চিচিকভ : না, না। আমি কর - নির্ধারক নই। আমি বেরিয়েছি ছোটোখাটো কিছু ব্যক্তিগত কাজে।
করোবোচকা : ওহো, আপনি তাহলে ব্যবসায়ী? কী কাণ্ড দেখুন তো! ওই লোকগুলোকে একদম সস্তায় মধুটা বেচে দিলাম। থাকলে আপনি নিশ্চয় পুরোটাই নিতেন, তাই না?
চিচিকভ : আরে না, না। আমি আপনার মধু কিনতে এখানে আসিনি।
করোবোচকা : তাহলে কেন এসেছেন? আমার কাছে কী চান? শণের দড়ি?
চিচিকভ : আরে, ওসব বাজে কিছু না। আমার একটি বিশেষ বস্তুতে আগ্রহ। দারুণ মজাদার পণ্য, ম্যাডাম। আমাকে শুধু বলুন, আপনার অধীনের কোনও ভূমিদাস মারা গেছে কি না।
করোবোচকা : গেছে তো। তা জনাআঠারো হবে। কী বলব মশাই, তারা সব এক একজন দারুণ কাজের লোক ছিল। এইতো গত সপ্তাহেই কামারটা আগুনে পুড়ল। খুবই চালাকচতুর ছিল মশাই।
চিচিকভ : হায়রে! আপনার আগুনও লেগেছিল?
করোবোচকা : বালাই ষাট। আমার আগুন লাগেনি। কামারটার লেগেছিল। সব্বাঙ্গে আগুন লাগিয়ে মরেছে। ওর ভিতর কোনও না কোনওভাবে আগুনের উসকানি ছিল। প্রচুর ভদকা গিলেছিল আর তার থেকেই নীল শিখা বেরুতে শুরু করে। তারপর ওর সারা দেহ একটু একটু করে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। শেষে ছাই। এখন আমার হাল দেখুন ; আমি আর ঘোড়াগাড়িটা নিয়ে বেরুতেই পারি না। আমার ঘোড়াদের পায়ে নাল দেবার আর কেউ নেই।
চিচিকভ : কী আর করবেন, সবই ঈশ্বরের হাতে। তাঁর হাতসাফাইয়ের মধ্যেই তো থাকাথাকি।… ম্যাডাম করোবোচকা, আপনার পারিবারিক নামটি জানতে পারি কি?
করোবোচকা : নাসতাশিয়া পেত্রোভনা।
চিচিকভ : নাসতাশিয়া পেত্রোভনা? আমার এক মাসি ছিল, তারও এই নাম। সুন্দর নামটি। নাসতাশিয়া পেত্রোভনা, ওগুলি আমি পেতে পারি না?
করোবোচকা :কাদের কথা বলছেন মশাই?
চিচিকভ : ওই যারা সব টেঁসে গেছে?
করোবোচকা : কিন্তু তাদের কীভাবে পাবেন?
চিচিকভ : খুব সোজা। ওদের বেচে দিন। আমি আপনাকে দাম দেব।
করোবোচকা : আমি শাদাসিধে মেয়েলোক মশাই। আপনার কথার টোপ তুলতে পারছি না। ওদের কি কবর খুঁড়ে তুলতে বলছেন?
চিচিকভ : উঁহু, তা হবে কেন? আমরা কাগজে সব নামগুলো লিখব, ওই যারা সব মরে গেছে, তাদের। ব্যস। ভাবুন তো, কী মজার ব্যাপার হবে? এদের জন্য কোনও ট্যাক্স দিতে হবে না। বদলে আমি আপনাকে পনেরো রুবল দেব। একেবারে নগদ। তাহলে কী ভাবছেন ম্যাডাম? ডিল অর নো ডিল?
করোবোচকা : সত্যি কথা বলতে কি মশাই, এর আগে এইসব মরা আত্মাদের কোনওভাবেই বিক্রির ব্যাবসা করিনি। জীবিতদের নিয়ে করেছি। এক সময় গঞ্জের চার্চের পুরোহিতকে দুই মহিলা বেচেছিলাম ; জনপ্রতি একশো রুবল করে। এবং তিনিও খুশিমনে তা কিনেছিলেন।
চিচিকভ : ঠিকাছে, তা তো জীবিত মানুষের ব্যাপার। আমি বলছি মৃত আত্মাদের কথা।
করোবোচকা : হ্যাঁ, সেটাই তো আমার মাথায় ঢুকছে না। মৃতদের নিয়ে…! আপনি কি আমার সঙ্গে ছলনা করছেন? এমন নয়তো যে ওদের দাম আরও বেশি?
চিচিকভ : তাহলে শুনুন, আপনি কী বলছেন, জানেন না। ওদের আর কতই বা দাম হতে পারে? ওরা কে? ধুলোমাটি ছাড়া?
করোবোচকা : তা অবশ্য ঠিক। এখন ওদের কী-ই বা প্রয়োজন! কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আমি তো এক আনপড় বিধবা… হয়তো এ সব করতে গিয়ে কোনওভাবে ঠকে যাব। ভালো হয় মশাই, আর কিছুদিন অপেক্ষা করি ; যদি আরও কেউ কিনতে আসে তবে দামের ব্যাপারটা একটু যাচাই করে দেখা যায়।
চিচিকভ : লজ্জা, কী লজ্জা! এ সব কী বলছেন? এদের আর কে কিনতে যাবে? আর কিনে করবেটাই বা কী?
করোবোচকা : না, মানে, এমন হতে পারে, খামারের কাজে, জরুরি ভিত্তিতে…
চিচিকভ : খামারের কাজে এই মরা মানুষ? এ সব কী বলছেন? যদি বলতেন রাতে আপনার সবজি বাগানে চড়ুই তাড়াবার জন্য খুলিগুলো টাঙিয়ে দেওয়া - তাও একরকম হত।
করোবোচকা : আরিব্বাস, এ সব কী বলছেন আপনি? ভয় করছে তো! ( শরীরে ক্রস আঁকে)
চিচিকভ : আচ্ছা, আচ্ছা, কোথায় আপনি এদের লাগাবেন বলুন তো? কবর, হাড়গোড়… সব আপনার থাকবে। আমি শুধু এক টুকরো কাগজ চাই। বলুন, কী ভাবছেন?...কিছু অন্তত বলুন? ( একটু থেমে) নাসতাশিয়া পেত্রোভনা।
করোবোচকা : তারচে বরং কিছু শণ কিনে নিন।
চিচিকভ : ( চেয়ারে বাড়ি মেরে) শয়তান আপনাকে গিলে খাক।
করোবোচকা : ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ ওকী! ওই নাম আপনি মুখে আনবেন না। ওকে একা থাকতে দিন। এইতো দু রাত আগে এক শয়তানের স্বপ্ন দেখলাম। কুৎসিত দেখতে ; শিংদুটো আমার ষাঁড়েরটির চাইতেও বড়ো।
চিচিকভ : তাহলে সে-ই আপনাকে খাক। জিশুর বদান্যতায় আমি ওকে সাহায্য করব। এক গরিব বিধবা, তিলে তিলে ক্ষয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনের ভাবনায় ভুগছে, আর আমি… আপনি, আপনার চাষার দল, আপনার দেশ- গাঁ… উচ্ছন্নে যাক সব। আপনার পুরো জোতদারিটাই অন্ধকার গহ্বরে ফেঁসে যাক। যত্তোসব…!
করোবোচকা : আপনি আমার ওপর এত রেগে যাচ্ছেন কেন বলুনতো? আপনার চোখমুখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে? আপনি এমন রাগি মানুষ জানলে আপনাকে একটি কথাও বলতাম না। আপনি যদি ইচ্ছে করেন তবে আপনাকেই বেচে দেব। পনেরো রুবলেই দেব। কিন্তু কখনও যদি শণ, শুয়োরের চর্বি বা গমের আটা লাগে আমাকে বলতে ভুলবেন না কিন্তু?
চিচিকভ : ( ভুরু কচলিয়ে) না, না, ম্যাডাম। আপনাকে কি ভুলতে পারি? যাকগে, এখন আপনাকে শহরে যাবার জন্য কষ্ট দেব না। সেখানে কি কোনও বিশ্বাসী বন্ধু- টন্ধু আছে যে আপনার হয়ে বিক্রি দলিলে সই-টই করে দিতে পারবে?
করোবোচকা : কেন? ফাদার কিরিল আছেন। আমাদের প্রধান যাজক। ওঁর ছেলে কোর্টে কাজ করে। কেরানি।
চিচিকভ : বাঃ, তাহলে তো ভালোই হল ( লিখতে থাকে)... দয়া করে এখানে একটি সই করে দিন( এই বলে টাকাটা দেয়)।
( পেত্রুশকার গলা শোনা যায় - গাড়ি রেডি স্যার)
করোবোচকা : পরের বার আমার শণ কিনতে হবে কিন্তু।
চিচিকভ : অবশ্যই ( তাৎপর্যপূর্ণ থামা)... আর শুয়োরের চর্বিও…।
করোবোচকা : বড়োদিন আসতে আসতে অনেকটাই জমে যাবে।
( উভয়ে রুশ ঢঙে তিনবার গালে চুমু খায়। চিচিকভ বিদায় নেয়)
চিচিকভ : ( মঞ্চের আড়ালে। জয়ী ঢঙে, রাস্তায়) পেত্রুশকা…
পেত্রুশকা : হাই…হ্যাট… উড়ে চল বাপ…
( করোবোচকা এখন একা, উত্তেজিত। এদিক থেকে ওদিকে হাঁটছে)
করোবোচকা : হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর… আমাকে এতটাই উত্তেজিত করে গেল ও। বুকটা জোর ঢিপঢিপ করছে যে! ঠিকভাবে কিছু ভাবতেই পারছি না! লোকটা কী যে করে দিয়ে গেল! আমি তো জানতামই না… পনেরো রুবল! নগদ! ওর আগেই আমাকে শহরে পৌঁছুতে হবে… আসলে কত যে দাম হয় এদের! দারুণ ভুল হয়ে গেল বোধ হয়! বিধবার ভুল। ফেটিনিয়া?... আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দে। জলদি। শহরে যেতে হবে। খুব সস্তায় বেচে দিয়েছি রে! খুব সস্তায়!