অযান্ত্রিক: যন্ত্র ও মানুষের সংলাপ এবং সম্পর্কের চড়াই - উতরাই

ঋত্বিক ঘটকের রহস্যঘন ছবি অযান্ত্রিকে বিমল একজন ট্যাক্সিচালক যে একটি ভাঙাচোরা গ্যারেজের মধ্যে বাস করে। সেটি একটি কেরেস্তানদের গোরস্থানে অবস্থিত, সারি দেওয়া কবরের ওপরে ক্রুশ যেখানে হাওয়ায় কাঁপে, প্রতি মুহূর্তে সেখানে যেন শোনা যায় মৃত্যুর পদধ্বনি। একটি ঘণ্টা দেখা যায়, জীর্ণ দেউলের তলছাদ থেকে ঝুলছে। মাঝে মধ্যে সেটি বেজে ওঠে, পুজা হয়। জায়গাটি ছোটোনাগপুর অঞ্চলের একটি অকিঞ্চিৎ জনপদ --- একটি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, মোটর মিস্ত্রি, চা-বিড়ির দোকান, কাছেই রেল স্টেশন। চতুর্দিক মনোরম, ছোট ছোট টিলা, নদী, এবড়ো খেবড়ো রাস্তা যা বর্ষার সময় স্বর্গের পথ হয়ে যায়। সন্নিহিত এলাকা আদিবাসী অধ্যুষিত, তাদের গান, ধামসা মাদলের আওয়াজ ভেসে আসে, উজ্জ্বল ওঁরাও রমণীরা দল বেঁধে হাটে যায়, উৎসবে নাচে।  

বিমলের একটা গাড়ি আছে, জগদ্দল, লঝঝড় একটা শেভ্রোলেট জালোপি, পনেরো বছর আগে যখন তার মায়ের মৃত্যু হয়, গাড়ি তার জীবনে প্রবেশ করে। সেই তবে থেকে বিমল আর জগদ্দল অভিন্নহৃদয় দুই প্রাণী। জগদ্দল জড় নয় সে এক প্রাণী, যে ঢক ঢক করে জল খায়, বিমল যখন হেঁড়ে গলায় ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ গেয়ে ওঠে হেডলাইট কঁকিয়ে উঠে প্রতিবাদ করে, মহিলা যাত্রী (কাজল গুপ্ত) যখন ‘এই গাড়িওয়ালা’ বলে বিমলের কাঁধে হাত দেয় তখন জোড়া হেডলাইট ঝটকা দেয়, যেন অন্য কোনও নারীর বিমলের প্রতি আসক্তি সে পছন্দ করে না। বিমল ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি পরে, ধুতির কোঁচা হাতে নিয়ে, চুলের টেরি করে,  লাজুক মুখে গাড়ির সাথে ফটো তুলতে চায়। তার গাড়ির অবস্থা, হাবভাব তাকে হাসির খোরাক করে, ফিচকে সর্দার তাকে আওয়াজ দেয়, গাড়ি আউরত হ্যায় ক্যায়া! বেঙ্গল ক্লাবের বাবুরা যখন তাকে যন্ত্র বলে, বিমল পাল্টা বলে কিন্তু জগদ্দল যে মানুষ সেটা তারা বোঝে না। এখানে একটা কথা বলা দরকার, সেই ১৯৫৮ সালে বিমলের এই কথা পাগলের প্রলাপ বলে মনে হলেও একবিংশ শতাব্দীতে যন্ত্রের মানুষের মতো আচরণ কিংবা অনুভুতিপ্রবণতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাজুও ইশিগুরোর ক্লারা এন্ড দ্য সান নামে একটি উপন্যাসে ক্লারা চোদ্দ বছর বয়সি এক কিশোরীর কৃত্তিম বন্ধু, Artificial Friend। কিশোরী যখন বড় হয় তখন তার অনেক বন্ধু হয়, কৃত্তিম বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়, সেটি junkএ পরিণত হয় ও জঞ্জালের স্তুপে স্থান পায়। প্রায় ষাট বছর আগে অনুরূপ চিন্তা করার কারণে ঋত্বিককে স্বপ্নদ্রষ্টা বা ভিশনারিও বলা যেতে পারে।

বাস্তবে গাড়িটা প্রায় একটা লোহার তাল; বাজারের সহৃদয় মেকানিক তাকে বোঝায় ওটার ওপর মায়া করে লাভ নেই, বেচে দিয়ে অন্য কিছু নিয়ে নেওয়া শ্রেয়। সেটার দরজা টান দিলে খুলে আসে, পাদানি ভাঙা, মাথার ওপরে ঢাকনা ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু বিমল অসীম মমতায় তার দেখভাল করে। জগদ্দলের সঙ্গে তার অবিরাম কথোপকথন চলে। ‘জল খেতে পারছিস না বলে ছটফট করছিস?’ জিজ্ঞাসা করে সে তাকে জল খাওয়ায়। মাথার ওপরের কভারটা ছিঁড়ে গেছে, সে আশ্বস্ত করে পুজোর পর ভালো রেক্সিনের ছাদ করে দেবে; বাচ্চারা যখন মজা করে গাড়ির দিকে কাদা ছোঁড়ে তখন বিমল শরীর দিয়ে তাকে গার্ড করে, সান্ত্বনা দেয়, ‘কুছ পরোয়া নেই জগদ্দল, তুই আর আমি আছি’। স্ট্যান্ডে অন্য গাড়ির পাশে বিশেষ করে, সর্দারজীর ঝাঁ চকচকে ট্যাক্সির পাশে, জগদ্দল  নিতান্তই বেমানন। কিন্তু বিমল অকুতোভয়, কারণ অন্য সব গাড়ির সর্দি লাগতে পারে, পেট খারাপ হতে পারে কিন্তু তার জগদ্দল বাঘের বাচ্চা। তাই ভরা বর্ষায় ঝর্ণার জলে যখন রাস্তা ভেসে গেছে, তখনো সে সওয়ারি নিয়ে নানা এলাকায় পাড়ি দেয়, খানাখন্দে গাড়ি আটকে গেলে যাত্রীকে ধমক দিয়ে গাড়ি ঠেলতে বাধ্য করায়। পক্ষিরাজের মতো গাড়ি ছুটিয়ে যাত্রীকে সময় মতো কলকাতার গাড়ি ধরিয়ে দেয়। এ হেন জগদ্দল সম্পর্কে কেউ কটু কথা বললে বিমল তার ওপর খড়্গহস্ত, তখন তার শরীরী ভাষা আগ্রাসী। এছাড়া সে কোমল প্রকৃতির। সুলতান তো বটেই, যে কোনও বাচ্চাকে সে স্নেহ করে এবং ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে মিস্ত্রি হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যে জগদ্দলের প্রতি কটাক্ষ করলেও সে তাকে সম্মান করে।

এক শহুরে ‘দম্পতি’ এক দিন তার সওয়ারি হয়। ছেলেটির চোখে কালো চশমা, বড়লোকি চাল, মেয়েটির সারা গায়ে ভর্তি গয়না। তার উচ্ছল আচরণ বিমলকে নাড়া দেয়। তাদেরকে সে একটি ডাকবাংলোয় নামায় এবং এখানেই এই কাহিনী শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয় না। প্রতারিত ওই নারীকে বিমল টিলার গায়ে বসে থাকতে দেখে। স্টেশনে টিকিট কেটে সে রানিং ট্রেনে তার হাতে টিকিট দেয়, মেয়েটি উত্তরে কিছু বলে যা বিমলের জীবনের আরও অনেক কিছুর মতো হাওয়ায় ভেসে যায়। রাস্তাই এই গাড়িচালকের নিয়তি, সে উপলব্ধি করে তার জীবনে কোনও আশ্রয় নেই। এই আশ্রয়হীনতা ঋত্বিকের সমস্ত ছবিতেই নানা ভাবে আছে এবং সেদিক থেকে অযান্ত্রিক, ছবিটির রহস্যময়তা সত্ত্বেও, পরিচালকের যাবতীয় চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, খুব স্বতন্ত্র কিছু নয়। যেমন সুবর্ণরেখা ছবিতে আমরা দেখি ঈশ্বর, সীতা, পরে বিনু নতুন বাড়ির খোঁজ করে। সংলাপ শুনি সবাই উদ্বাস্তু, কে নয়? নাগরিক ছবির রামু, যুক্তি তক্কো গপ্পো ছবির নীলকন্ঠ বাগচীও আশ্রয়হীন, এক গৃহ থেকে আরেকটিতে ঠোক্কর খায়।

স্টেশন থেকে ফিরে এসে বিমল আবিষ্কার করে মেয়েটির পুঁটলিটা গাড়িতেই পড়ে আছে। সে জগদ্দলকে নিয়ে ট্রেনের পিছনে ধাওয়া করতে চায়। গাড়ি স্টার্ট নেয় না, বারবার চেষ্টা করেও কোনও লাভ হয় না। বিমলের ওই নারীর প্রতি টানের কারণে জগদ্দল কি বিরক্ত, নাকি অভিমানি? নাকি জগদ্দল সত্যিই অচল? ছবিতে এই প্রথম বিমলকে তার ওপর রেগে উঠতে দেখা যায়। সে গাড়িতে লাথি মারে, হেডলাইট নুয়ে পড়ে। সেই যে জগদ্দল বিগড়ে যায় আর সে সেরে ওঠে না। বিমল নরমে গরমে অনেক চেষ্টা করে, ঘুষি মেরে সামনের কাঁচ ভেঙ্গে দেয়, বলে অনেক তোয়াজ করেছি তোকে আর না। বনেটে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়, দুর্মুল্যের বাজারে তুই আমাকে খাইয়েছিস, পরিয়েছিস, আর কত করবি! ভস্মে ঘি ঢালার মতো, গাড়ি সারানোর জন্য অনেক খরচ করে, কিন্তু সব বৃথা। অবশেষে মিস্ত্রি শহর থেকে লোহার কারবারিকে নিয়ে আসে, তার মজুররা জগদ্দলকে লোহালক্কড়ের এক অতিকায় পিন্ডে পরিণত  করে। অশ্রুসজল বিমলের চোখের সামনে দিয়ে ঠেলায় করে তারা সেই স্তুপ নিয়ে যায়। পেছন থেকে নেওয়া শটে একটা ক্রুশ দেখা যায়, একটি কবরের সামনে আদিবাসী রমণী বিলাপ করে। হঠাৎ রাস্তায় জগদ্দলের সেই পরিচিত আওয়াজ শোনা যায়, ছোট শিশু রাস্তায় পড়ে থাকা হর্ন তুলে নিয়ে মনের আনন্দে সেটা বাজাতে থাকে। তাকে দেখে বিমল হেসে ফেলে, বোঝা যায় ভবিষ্যত একেবারে অন্ধকার নয়। ঋত্বিক এখানেই মহৎ, তাঁর ছবিতে আমরা সব সময় জীবনের জয়গান শুনি, নানা বাধাবিপত্তি, দারিদ্র, বেকারত্ব, বিভ্রান্তি সত্ত্বেও সেখানে হতাশার কোনও স্থান নেই। নাগরিক ছবিতে শেষে ‘আন্তর্জাতিক’ গান রামুকে এগিয়ে যাবার দিশা  দেখায়; যুক্তি তক্কো গপ্পো ছবিতে ভোরের আলোয় মৃতপ্রায় প্রৌঢ় নীলকণ্ঠ পুত্র সত্যের মুখ দেখে এক নতুন পথের সন্ধান পায়; কিংবা তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে আমরা নদীর চরে বালককে বাঁশি বাজিয়ে ছুটে যেতে দেখি, যেখানে ধান গজিয়ে উঠছে, সমাজ নদীভিত্তিক থেকে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় রূপান্তরিত হচ্ছে।

ছবিতে ঝাড়খন্ডের ওঁরাও সম্প্রদায়কে পরিচালক যে সম্ভ্রম ও আন্তরিকতার সাথে চিত্রায়িত করেছেন তা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল। তিনি প্রচলিত শহুরে চোখে আদিবাসী সমাজকে দেখেননি, যেখানে তাঁদের জীবন, উৎসব নিছক বিনোদনের চোখে দেখা হয় এবং তাঁদের রমণীদের ভোগ লালসার শিকার হিসাবে করুণা করা হয়। সারা ছবি জুড়ে ওঁরাও জীবনের নানা দিক, বিশেষ করে তাঁদের দলবদ্ধ ছন্দময় নৃত্য, সংগীত, উৎসব, তাঁদের হাট, বেচাকেনা বারবার ঘুরে ফিরে আসে। বিমলের জগদ্দল সভ্য সমাজের কাছে বিদ্রুপের বস্তু, কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে সেটা চারিপাশের প্রকৃতিরই একটি অঙ্গ, তার সাথে মিলেমিশে গেছে। বিমলের সরল, আদিম আচরণ আদিবাসী জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে যেন তাঁদেরই একজন। অভাবনীয় কিছু শটের মধ্যে দিয়ে ছোটোনাগপুর অঞ্চলের মনোরম নিসর্গ ফুটে উঠেছে, বিশেষ করে চলমান গাড়ি আর সেটার মাথার ওপর ছাতার মতো ঘন কালো মেঘের আকাশ, কিংবা অরণ্যের গাছপালার ফাঁক দিয়ে সিলুয়েটে ওঁরাও রমণীদের অপূর্ব নৃত্য। এই ছবিতে শব্দের ব্যবহার, বিশেষ করে ভাঙাচোরা গাড়ির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নানা বিচিত্র আওয়াজ চলচ্চিত্রে স্বাভাবিক সাউন্ড ব্যবহারের একটা মাইলফলক হিসাবে গণ্য হতে পারে।

ঋত্বিক কোনও এক লেখায় বলেছেন সিনেমায় গল্প বলার দিন শেষ, এখন বক্তব্যের যুগ। ছবির কেন্দ্রে আছে যন্ত্র ও মানুষের দ্বন্দ, সম্পর্ক, ভাব-ভালোবাসা, নানা চড়াই উতরাই। এই সম্পর্কের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, যবে থেকে মানুষ পাথরের ব্যবহার শিখেছে। যন্ত্র নিয়ে মানুষের বিড়ম্বনার শেষ নেই। সেই উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজ তুলো শ্রমিকরা মেশিন ভেঙে ফেলেছিল, কারণ সেগুলি তাদের জীবিকা কেড়ে নিচ্ছিল। ইতিহাসে তারা লুডাইত নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। ওই শতাব্দীর বিশের দশকে রুশ কবি সের্গেই ইয়েসেনিন সদ্য আবিষ্কৃত ট্রেনকে ‘আয়রন গেস্ট’ নামে অভিহিত করেছিলেন এবং কীভাবে তা অশ্বের বিকল্প হয়ে উঠেছিল সেটা নিয়ে বিলাপ করেছিলেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অনেক টালবাহানার পরে জীবনের প্রান্তে এসে বলেছিলেন, যন্ত্র যদি মনুষ্য শ্রমের বিকল্প না হয় তবে সেটাকে মেনে নিতে তাঁর কোনও অসুবিধা নেই। আশির দশকে এই কলকাতায় আমরা দেখেছি ব্যাঙ্কে কম্পিউটারের প্রবেশ আটকাতে কীভাবে কর্মীরা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। ১৯৫৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি মনগড়া অভিযোগ খাড়া করে ঋত্বিককে দল থেকে বহিষ্কার করে। তবুও তিনি কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে এক চুলও বিচ্যুত হয়নি। রাশিয়ায় তখন শিল্পায়নের যুগ, যন্ত্র অভুতপূর্ব উন্নয়ন (যে ধরণের উন্নয়ন আজ প্রশ্নের মুখে) সূচিত করেছে। ভারতেও তখন নেহুরুর ‘টেম্পলস অফ মডার্ন ইন্ডিয়া’ মতাদর্শের কারণে বড় বাঁধ, কলকারখানা নির্মাণ হচ্ছে। তখন যন্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থার উল্লম্ফনের প্রধান উপকরণ। প্রবাদপ্রতিম পরিচালক তাই যন্ত্রকে সভ্যতার যাত্রায় এক সহযোগী হিসাবেই দেখেছেন, সেই বার্তাই তিনি সেলুলয়েডে অনবদ্য ভাবে প্রতিফলিত করেছেন। আজ এই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের যুগে এই বার্তা আরও প্রাসঙ্গিক।