ঋত্বিকের যুক্তি তক্কো গপ্পো : কয়েকটি নীড় হারা পাখি ও এক দিশেহারা বুদ্ধিজীবী

ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো যে সময়ের কথা বলছে সেটা ১৯৭০-৭১।  ছবিটি ঋত্বিক তৈরি করা শুরু করেন ১৯৭৪ এ। ১৯৭৪ থেকে ৭৬ - ঋত্বিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে অবধি চলেছে এই ছবির কাজ। ছবিতে যেমন সবার সব স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়, তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন ছবি মুক্তি অসমাপ্ত রেখে চির বিদায় নিলেন পরিচালক। ঋত্বিকের মৃত্যুর পরের বছর ১৯৭৭ এ শেষপর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করল এই ছবি। সত্তর দশকের শুরুর যে দিনগুলোর কথা এই সিনেমা বলছে সেখানে অনেকগুলো মুক্তির সম্ভাবনা-ছবি নানা দিকে আঁকার চেষ্টা চলছিল। একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ। অন্যদিকে এই বাংলায় নকশালপন্থী যুবকেরা প্রাণ বাজি রেখে চেষ্টা করছিলেন সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করে তুলতে। পাকিস্তানকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে জাতীয়তাবাদী শিবির তাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আখ্যা দিচ্ছিল এশিয়ার মুক্তিযুদ্ধ বলে।

যে সময়টায় এই সিনেমা তৈরি হচ্ছে সেই ৭৪ -৭৫ পর্বে সমস্ত স্বপ্ন সম্ভাবনা শুধু ধূলিস্যাৎ ই হয়ে যায় নি, এক বিপরীত নৈরাজ্য দেখা দিতে শুরু করেছে। নকশালপন্থীরা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছেন একদিকে নিজেদের ভেতরের নানা ভুল আর অন্যদিকে নিদারুণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। এশিয়ার মুক্তিসূর্য হিসেবে যার কথা বলা হচ্ছিল সেই ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থা জারি করার মধ্যে দিয়ে দেশ ব্যাপী জন্ম দিয়েছেন প্রবল প্রতিবাদ আর অসন্তোষের। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে বাংলাদেশ জন্ম নিল অত্যাচারী পাকিস্তানের বুক চিরে, সেখানেও এই সংগ্রামের মূল কাণ্ডারী শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলেন এক সেনা অভ্যুত্থানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আড়াল হল বেশ কিছুকালের জন্য। সত্তরের শুরুর দিনগুলোয় নানা পক্ষ যে স্বপ্ন সম্ভাবনা দেখেছিল এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ পর্ব সেই সমস্ত সম্ভাবনারই নির্মম করুণ অপমৃত্যু দেখেছে। সেই দেখার ছাপ পড়েছে বছর পাঁচেক আগের সময়কালটির পুনঃনির্মাণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখানে একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সুখস্বপ্নের  ছবিকে তুলে ধরে না। ছবিতে আসে খান সেনার অতর্কিত আক্রমণে এক টোলের পণ্ডিত সহ গোটা গ্রামের নিদারুণ করুণ মৃত্যুর কথা। সীমান্তের সেই গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা টোলের পণ্ডিতের কন্যা কিশোরী বঙ্গবালাই এই উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র। নকশালপন্থী আন্দোলনের আশা ভরসা জাগানো মিছিল সংগ্রাম নয়, সিনেমায় এসেছে পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া যুবকদের দৃশ্য। ভারত পাক যুদ্ধের সেই আলোড়নতোলা মুহূর্তের দিনকালকে যে ছবি ধরেছে সেখানেও জনৈক কংগ্রেসী নেতার বক্তৃতায় কোনও আকর্ষক বয়ান নেই, দেশের জন্য আত্মত্যাগ করার কথাগুলি কোনও শ্রোতাকেই বিন্দুমাত্র উৎসাহিত করে না, একটি কুকুরের হিংস্র চিৎকারের সঙ্গেও এই বক্তৃতাকে একবার যেন ব্যাঙ্গাত্মকভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয়। ছবির শুরুতে ও শেষে এক নেশাগ্রস্থ স্থবির বৃদ্ধর চোখে দেখা ভূতের নাচের দৃশ্য রেখেছেন পরিচালক। সিনেমা নির্মাণের সময়ের বাংলায় তিনি চারদিকে যে ভূতের নাচ দেখছিলেন, এ তারই প্রতিচ্ছবি।

শুরু ও শেষের এই দৃশ্যের মতো এমন প্রতীকী ব্যাপার সিনেমাতে আরো অনেক আছে। বঙ্গবালার মুখের পাশে দুর্গার মুখোশ ধরে রাখা, ছৌ নাচ – সবেতেই রয়েছে ইয়ুং এর মাদার কমপ্লেক্স, একথা নিজেই ঋত্বিক জানিয়েছেন। এই ছবির চরিত্রগুলোর নামও ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতীকী, পুরাণ প্রসঙ্গে সংযুক্ত, যেমন - নীলকন্ঠ, বঙ্গবালা, নচিকেতা, জগন্নাথ, পঞ্চানন।

ছবির প্রধান চরিত্র নীলকন্ঠের দাম্পত্য সমস্যা ও ঘর আলাদা হয়ে যাওয়া দিয়ে সিনেমার শুরু। সিনেমার শেষে নায়ক নীলকন্ঠ চেষ্টা করে সম্পর্ককে জোড়া লাগিয়ে ঘরে ফিরতে, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় না। নীলকন্ঠের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ক্রমশ একটা সময়ের সম্ভাবনার ব্যর্থতায় ব্যাপ্ত হয়ে যায়।

ছবির নায়ক নীলকন্ঠ বাগচী একদিকে যেমন নির্মাতা ঋত্বিকের অল্টার ইগো, তেমনি সেকালের একজন অবক্ষয়িত বুদ্ধিজীবীর প্রতিনিধিও বটে। চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের মুক্তির আলোয় যাঁরা তাঁদের প্রতিবাদী শিল্প সাহিত্যকে উজ্জ্বল করে তোলার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন, সত্তরের দিনকালে তাঁরা অনেকেই শিকার হলেন অবক্ষয়ের। দু ধরনের অবক্ষয়িত বুদ্ধিজীবীকে এই সিনেমায় নিয়ে আসেন ঋত্বিক। একদল নেশায় আবদ্ধ ও সমাজের সমকালীন জটিলতা থেকে পলায়নপর। সিনেমার নায়ক নীলকন্ঠ বাগচী এঁদের প্রতিনিধি। তিনি নিজেই নিজেকে বলেন এক ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল, ভাঙা বুদ্ধিজীবী। বাক্য সাজাবার ক্ষমতা তাঁর আছে ঠিকই, কিন্তু সেই বাক্যকে সজীব প্রেরণায় সজ্জিত করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার দৃঢ়তা তিনি হারিয়েছেন। নিজেকে বারবার তিনি বলেন কনফিউজড, আটারলি কনফিউজড। অন্যদিকে এই সিনেমাতে ঋত্বিক নিয়ে আসেন আর এক ধরনের অবক্ষয়িত বুদ্ধিজীবীকে। এঁদের প্রতিনিধি নীলকন্ঠ বাগচীর একদা বন্ধু সত্যজিৎ বসু। এই চরিত্রটি যে সমরেশ বসুর আদলে তৈরি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সিনেমায় বলেও দেওয়া হয় এই লেখক একসময় কমিটেড সাহিত্য লিখতেন, এখন সুড়ঙ্গ, পোকামাকড় নামে উপন্যাস লিখছেন আর বাজারে সেগুলোর বিরাট কাটতি। সুড়ঙ্গ ও পোকামাকড় নাম দুটি যে সমরেশের ‘বিবর’ আর ‘প্রজাপতি’কে ইঙ্গিৎ করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে সত্যজিৎ বসু বিকিয়ে গেলেও তাঁর বিবেক যে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয় নি, সেটাও দেখানো হয় একটি বাউল গান শুনে তাঁর স্মৃতিকাতরতা ও মানসিক উচাটনের দৃশ্যে। তিনি যা করছেন, যেভাবে ধনী হচ্ছেন, তা যে তাঁকেও ভেতরে ভেতরে কোথাও যন্ত্রণা দেয়, তেমন ইঙ্গিৎ এখানে স্পষ্ট। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির যে আত্মসমালোচনা নীলকন্ঠ করেন, তা হয়ত ঋত্বিকেরও আত্মধীক্কার – “হয় আমরা চোর, নয় বিভ্রান্ত – আর নয়তো কাপুরুষ হয়ে পালিয়ে যাবার মিছিল। খাঁটি কোন বেটা না।”

ছবিতে যে সব গৌণ চরিত্রেরা আছে সকলকেই বলা হয় নীড় হারা পাখি। উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে চাকরীর সন্ধানে যেমন ঘুরে বেড়ায় এক ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ নবীন যুবক, তেমনি গ্রামের ইস্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃদ্ধ সংস্কৃত শিক্ষক কাজ খুঁজতে চলে আসেন কোলকাতা মহানগরীতে। কিন্তু কোথাও তাঁদের কোনও কাজ নেই। প্রযুক্তি বা ধ্রুপদী ভাষার জ্ঞান - সবই যেমন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, তেমনি দিন গিয়েছে ছৌ নাচের এককালের নামী শিল্পীরও। কেউ আর তার থেকে মুখোশ নিতে আসে না। তিন কুড়ি বয়সে পৌঁছে সেই শিল্পী একাকী দিনযাপন করেন আর আক্ষেপ করে বলেন এখন তাঁর শরীর থাকা বা যাওয়া একই ব্যাপার।

এই সিনেমা যেহেতু এক ভাঙা সময়ের রক্তাক্ত হওয়ার যন্ত্রণার কথা বলে তাই এর আঙ্গিককেও হতে হয়েছে সেরকম। কোলকাতা শহরই হোক বা দূর জঙ্গলমহলই হোক – এখানে কেউ কোথাও থিতু হতে পারে না। সবাই যেন নীড় হারা পাখি। গোটা সিনেমা জুড়ে দেখি এই নীড় হারা মানুষদের পথ চলা। সিনেমাটি শুরু হয় নীলকন্ঠ বাগচীর স্ত্রী দুর্গার গভীর যন্ত্রণা নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামীকে ছেড়ে চলে যাবার দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে। সিনেমার শেষে খাবার নিয়ে শালবনে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন দুর্গা, কিন্তু দেখা হবার আগেই নকশাল নিধনে আসা পুলিশের গুলিতে ভূলুন্ঠিত হয়ে যান নীলকন্ঠ। তাঁর আর ঘরে ফেরা হয় না। এর আগে জোতদারের গুলিতে অতর্কিতে প্রাণ হারান বৃদ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিত। এক নাটকীয় মুহূর্তে নীলকন্ঠের কন্ঠে বেজে ওঠা দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া রবীন্দ্রগানটি সিনেমার মূল বক্তব্য হিসেবে ধ্বনিত হতে থাকে –

       কেন চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে ।

       এরা  চাহে না তোমারে চাহে না যে,  আপন মায়েরে নাহি জানে।

       এরা  তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না— মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভাণে।।

       তুমি তো দিতেছ, মা, যা আছে তোমারি— স্বর্ণশস্য তব, জাহ্নবীবারি,

                        জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী।

       এরা কী দেবে তোরে ! কিছু না, কিছু না। মিথ্যা কবে শুধু হীনপরানে।।

       মনের বেদনা রাখো, মা, মনে ।  নয়নবারি নিবারো নয়নে।।

       মুখ লুকাও, মা, ধুলিশয়নে— ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে।

       শূন্য-পানে চেয়ে প্রহর গণি গণি  দেখো কাটে কিনা দীর্ঘ রজনী।

       দুঃখ জানায়ে কী হবে, জননী,  নির্মম চেতনাহীন পাষাণে ।।

অনেক হতাশা ব্যর্থতাভরা চরিত্রদের মাঝে এই ছবিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে কেবল বঙ্গবালার কোমল কিশোরী মুখটি। সেও এক সর্বস্বান্ত নীড় হারা পাখি, কিন্তু ক্লান্ত হলেও হতাশ শ্রান্ত পথিক নয়। ছৌ নাচের মাতৃ মুখোশ দেখে সে যেমন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, তেমনি উজ্জীবিত করে তোলে বিপরীত কোটির দুই বৃদ্ধকে, যাঁদের একজন লোকায়ত শিল্পে আর অপরজন ধ্রুপদী সংস্কৃত শ্লোকে তাঁর মধ্যে ঘরের মা ও পুরাণের মাতৃকা শক্তিকে খুঁজে পান। ক্যামেরা যখন বঙ্গবালার মুখে ফোকাস করে, তখন ঋত্বিক চাইলে ব্যবহার করতেই পারতেন রবীন্দ্রনাথের আরো একটি গান। সেটিও হয়ে উঠতে পারত এই দৃশ্যের অমোঘ মর্মবাণী –

আজি        বাংলাদেশের হৃদয় হতে   কখন আপনি

তুমি এই    অপরূপ রূপে বাহির   হলে জননী!

ওগো        মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!

তোমার     দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥

ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে,   বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,

দুই নয়নে স্নেহের হাসি,   ললাটনেত্র আগুনবরণ।

ওগো        মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!

সিনেমার প্রথমদিকে ঋত্বিক যে রবীন্দ্রগানটি ব্যবহার করেন – আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি - তা নীলকন্ঠের সুখী সংসার জীবনের স্বপ্ন ও প্রেমের আবেশকে ধারণ করেছিল। তবে তার আগেই এসে গেছে স্ত্রী দুর্গার তাঁকে ছেড়ে চলে যাবার দৃশ্য। ফলে ফ্ল্যাশব্যাকে এই গান ও তার রোমান্টিক আবহ যখন আসছে, তখন দর্শক জেনে গেছে এই সুখস্বপ্ন টিঁকবে না, তা ভেঙে ছত্রাখান হয়ে যাবে। বস্তুতপক্ষে ঋত্বিকের এই গোটা সিনেমাটিই হল সুখস্বপ্নের ভাঙন দলিল।

বিশ শতক শুরু হয়েছিল এক বিরাট সঙ্কটের দিনকালের মধ্যেই অনন্ত সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধর ভয়াবহ দিনকালেই আত্মপ্রকাশ করেছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে নিজেকে ক্রমশ শক্তিশালী করল, কোটি কোটি মানুষকে প্রেরণা দিল। দুনিয়ার এক বিরাট অংশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। শতাব্দী শেষের আগেই ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ হল। ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশে দেশে কমিউনিস্ট শাসনের পতন হল। আশা দিয়ে শুরু করে হতাশাময় সমাপ্তির উদাহরণ যেমন বিশ শতক, তেমনি তার এক ক্ষুদ্র অধ্যায় সত্তর দশকও একই পরিণতি শিকার। সত্তরের শুরুর স্বপ্নের দিনকালের দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে এই সিনেমা শেষমেষ মধ্য সত্তরের সেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাকেই ধরেছে। চিত্রনাট্যের সময়কাল নয়, ঋত্বিকের যুক্তি তক্কো গপ্পোতে আসলে ধরা রয়েছে সিনেমা নির্মাণ পর্বের সেই সব দিনরাত্রির কথা-গল্প।