জেন্ডার জাস্টিস : ছাত্রীদের স্বর

জাস্টিস ফর আর্জিকর - এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের প্রায় পাঁচ বছর পর আবারো এত বড় আন্দোলনের সাক্ষী রইল মহানগরী। কেবল তাই নয়, এই আন্দোলন ব্যাপ্তিতে ছাপিয়ে গেল আগের প্রায় সব নজির, হয়ে উঠল অনন্য। শুধু কলকাতা নয়, ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে, চলমান আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখা গেছে। আর জি কর হাসপাতালে পিজি ২য় বর্ষের ডাক্তারি পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে  গোটা দেশ তোলপাড়। মহিলা ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষেরা পাড়ায়-পাড়ায় রাস্তার দখল নিচ্ছে। অধিকার দখলের এই লড়াইতে সামিল হয়েছেন আট থেকে আশি সকলে। তবে এই আন্দোলন কি কেবল বিচারের দাবিতে সীমাবদ্ধ? উত্তরে আসছি৷ তার আগে কিছুটা নিজের অভিজ্ঞতা বলি।
 
আমি উত্তর চব্বিশ পরগণার মেয়ে। পড়াশোনা করেছি কলকাতার স্কুলে। কলকাতা বলতে আমার কাছে তখনও শুধুই আমার স্কুল। আমার তখন ক্লাস ইলেভেন, সেইসময় আমাদের পাড়ারই একটি ছেলে আমার কাছে প্রেম প্রস্তাব নিয়ে আসে। সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ছেলেটি যারপরনাই ক্ষুব্ধ। টিউশন পড়ে আমি বাড়ি ফিরতাম রাত ৯টার দিকে। বন্ধুরা বাড়ির কাছাকাছি ছেড়ে দিত সাইকেলে। বাকি রাস্তাটুকু একাই আসতাম। আমার বাড়িটা যে গলিতে, সেই গলিতে আলো প্রায় ছিল না বললেই চলে। ফিরতি পথে প্রায়শই দেখতাম ওই অন্ধকারের মধ্যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকত। সে হঠাৎই একদিন আমায় দেওয়ালে ধাক্কা দিয়ে চেপে ধরে জানতে চায়, আমি কেন তাকে 'রিজেক্ট' করলাম! দেওয়ালে আমার পিঠ ঘষে যায়। থতমত খেয়ে প্রথমটায় কী করব বুঝতে পারি না! কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরতে কোনোরকমে হাত ছাড়িয়ে রীতিমতো পালিয়ে আসি। তারপর থেকে সেই ছেলেটি নিয়মিত আমায় উত্যক্ত করেছে। মুখে অ্যাসিড মারার মতো ভয়ঙ্কর থ্রেট করেছে। আমি ভয়ে, লজ্জায় বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি। রাতে ঘুমোতে পারিনি। পড়ায় মন দিতে পারিনি। দিনের পর দিন ভয় পেতে পেতে মানসিক সমস্যায় ডুবে গেছি, জানতেও পারিনি।
 
এমন টুকরো টুকরো খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়েই অধিকাংশ মেয়ের বড় হওয়া। কথা বললেই জানা যায়, অপরিচিত পুরুষের তুলনায় অনেক পরিচিত পুরুষই ছোটবেলায় চার দেওয়ালের ভেতর মেয়েদের মলেস্ট করে। তারপর ট্রেনে-বাসে, রাস্তায়, স্কুলে, কলেজ, অফিসে। এই লেখা যারা পড়বে, তারা অনেকেই হয়তো ট্রিগার্ড হবে! হয়তো আমারই মতো ভয়-লজ্জায় এদের অনেকেই আজ অবধি কাউকে এসব কথা বলে উঠতে পারেনি! 
 
কিন্তু, কীসের ভয়? কীসের লজ্জা? বাইরের কোনও পুরুষ তোমাকে খারাপভাবে ছুঁয়ে দিলে তুমি নষ্ট হ'য়ে যাবে – কারা শেখায় ছোটবেলায়? "এডুকেশন বিগিনস্ অ্যাট হোম।" বড় হয়ে বুঝেছি, শুধু শহরের ভালো স্কুলে সন্তানকে পড়ালেই হয় না, তাকে ছোট থেকে লিঙ্গ এবং যৌনতা বিষয়ক প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতে দেওয়া প্রয়োজন। অথচ, এই শিক্ষা কি আদৌ বাড়ির বড়দের আছে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই শিক্ষা সাধারণ জনগণের থাকার কথা?
 
মহিলা এবং প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষেরা আরজিকর-এর ঘটনার বিচার চেয়ে যে আন্দোলন করছে, সেই আন্দোলন প্রতিদিন নতুনভাবে ইতিহাস লিখছে। কলকাতা সহ অন্যান্য জেলায় তাদের সমস্যার কথা উঠে আসছে। সাথে আসছে বিবিধ দাবিদাওয়া। সোচ্চারে জানানো হচ্ছে সেসব। স্পষ্টত বলা যায়, এই লড়াই কেবল একজন ধর্ষিতার বিচার চেয়ে নয়, এই লড়াই দেশ তথা বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের ধর্ষণ-সংস্কৃতি বিরুদ্ধে।
 
যুগ পালটেছে। আমাদের বুঝতে হবে, আজকাল ১১-১২ বছর বা তারও আগে থেকে বাচ্চাদের সাথে ইন্টারনেট দুনিয়ার পরিচয় হয়ে যায়। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মারফত তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট যায়। দেখা যায় সেইসমস্ত কনটেন্ট আত্মস্থ করার জন্য, ওইটুকু বয়সে বাচ্চাদের মস্তিষ্ক পূর্ণ বিকশিত হয় না। এহেন গ্যাজেটে ঠিক-ভুল বিচার করারও কেউ থাকে না। ফলে ছোট থেকেই ছেলেরা গোগ্রাসে সেক্সিষ্ট কনটেন্ট গিলছে। অপরদিকে প্রাথমিক বা বুনিয়াদি স্তরের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে যৌনতা ও লিঙ্গ সম্পর্কে কোনও আলোচনা নেই। বাড়ির মা-বাবাদেরও এই বিষয় খোলামেলা আলোচনা করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। সরকার থেকে তাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। পুরুষকে ছোট থেকে জানতে হবে, 'হোয়াট ইজ কনসেন্ট?' সম্মতি কী এবং কেন? ইয়ার্কির ছলে বান্ধবীর চুলের ক্লিপ খুলে নেওয়া বা তার ব্যাগ ধরে টানাটানি করা, সবকিছুর জন্য সম্মতি প্রয়োজন। সম্মতি যে ম্যানুপুলেট করে নেওয়া যায় না, সেই শিক্ষাও বুনিয়াদি স্তরে বাচ্চাকে দেওয়া দরকার।
 
অতিরিক্ত যৌনক্ষুধা তৈরি করে, এমন ভিডিও অর্থাৎ পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে ধ্যানধারণা কৈশোর বয়সে তৈরি করতে হলে এইসকল বিষয় সচেতনতামূলক অভিযান চালানো প্রয়োজন। পর্ন এবং বাস্তবের যৌন-প্রক্রিয়ার মধ্যে যে আকাশপাতাল পার্থক্য, তা বৈজ্ঞানিক আলোচনার মাধ্যমে কিশোর অবস্থার পুরুষদের বোঝাতে হবে। পৌরুষের দর্প চুর্ণ করার জন্য উপযুক্ত লিঙ্গশিক্ষা চালু করা দরকার। রিজেকশনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলতে হবে সন্তানকে। মেল ইগো, হাইপার ম্যাসকুলিনিটি – সমস্ত কিছুই আসে একজন পুরুষের বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। ছেলেরা তুলনামূলক নরম স্বভাবের হলে, কথায় কথায় কেঁদে ফেললে, বাবা-মায়েরা অনেকসময় তাদের মেয়েদের সাথে তুলনা করে। ছোট থেকে মেয়েদের দুর্বলের প্রতীক করে তোলাই আসলে পুরুষের ভেতর অজান্তেই নিজের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে অহংকার ও দম্ভ সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার প্রবণতাকে বদলাতে হলে গোড়া থেকে অনেক প্রাচীনপন্থাকে বর্জন করতে হবে, আনলার্ন করতে হবে।
 
আর জি কর-এর অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে আমরা দেখেছি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর মেয়েটির দিকে প্রশ্ন তুলতে। ইনিয়ে বিনিয়ে নির্যাতিতার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে। সরাসরি ভিক্টিম ব্লেমিং করতে। ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি হলে মহিলার পোশাক, জীবনযাপন, চরিত্র ইত্যাদিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, কমবেশি সমস্ত ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। যদি পোশাকের দৈর্ঘ্য সুরক্ষা সত্যিই সুনিশ্চিত করত, তাহলে তিন মাসের শিশুর ধর্ষণ হত কি? প্রশ্ন করুন৷ নিজেকেও।
 
আর জি কর-এর ধর্ষিতার ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার দায়ভার এখন সিবিআই-এর কাঁধে। আজ প্রায় একমাস অতিক্রান্ত, তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কোনও তথ্যই প্রতিবাদী-বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে নেই। উপরন্তু আমরা দেখলাম গত ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট দ্বিতীয় দিনের শুনানির তারিখ পিছিয়ে দিল। আর রাজ্য সরকার তো এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় কখনোই তার দায় এড়াতে পারে না! ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দুর্নীতি ও বেলাগাম দালাল চক্রের মারাত্মক চেহারাটা ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ছে। পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের এলাকায় এলাকায় তৃণমূলী গুন্ডারা ধমকাচ্ছে, চমকাচ্ছে। পুলিশ এসে আন্দোলনের নেতৃত্বদের গ্রেফতার করছে, তাদের উপর বিভিন্ন মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে চিঠিচাপাটি। বিক্ষোভকারীদের যখন-তখন থানায় তলব করছে। তৃণমূল জানে না, এতশত আগুনের ফুলকিকে হামলা দিয়ে, মামলা দিয়ে দমিয়ে দেওয়া যাবে না।
 
বলাবাহুল্য, তৃণমূল সরকার সবকিছু মিলিয়ে বেশ কিছুটা ব্যাকফুটে আছে। সাধারণ জনতা দু'কদম এগিয়ে গিয়ে বলছে 'জো না বোলে উস্ পে বোল, হাল্লা বোল! হাল্লা বোল!'  সরকারের আনা 'রাত্তিরের সাথী' প্রকল্পকে বাংলার মেয়েরা প্রত্যাখ্যান করেছে। নিরাপত্তার নাম করে মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার, রুটি-রুজি কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত তারা মানেনি। তীব্র নিন্দা করেছে।  
 
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ধর্ষণের শাস্তি হোক ফাঁসি। তৃণমূলের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তথাকথিত নম্বর টু নেতা প্রথমদিন থেকে বলেছেন, এনকাউন্টার চাই। সম্প্রতি বিধানসভায় 'অপরাজিতা বিল' পাশ করেছে। সেখানেও একই কথা, ধর্ষকদের ধরে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দাও। ডেথ পেনাল্টি, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট ইত্যাদি। নির্ভয়া কান্ডের পর চারজন দোষীর ফাঁসি হয়। ভার্মা কমিশনের সুপারিশ আজও লাগু হয়নি। সেখানে বলা হয়েছিল, ধর্ষণ কখনও স্রেফ ধর্ষকদের ফাঁসি দিলে কমবে না। ২০১২ সালে নির্ভয়া কান্ডের পর নইলে এতগুলো ধর্ষণের ঘটনা নিত্যদিন ঘটত না। ফাঁসি বা এনকাউন্টার করে ধর্ষণ সংস্কৃতি মুছে ফেলা যায় না। বরং ধর্ষিতা মহিলাকে বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যায়। তথ্যপ্রমাণ সরিয়ে ফেলা সমস্ত অপরাধীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রমাণ লোপাটের তাগিদে তারা শুধু ধর্ষণই করবে না, খুনও করবে। এভাবে মহিলাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলবে এধরনের আইন।
 
শিক্ষাক্ষেত্র থেকে কর্মক্ষেত্র, সর্বত্র মহিলাদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে। সমস্ত পেশায় সুরক্ষার অভাব। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কুপ্রস্তাব হামেশাই মহিলা কর্মীরা পেটের দায় হজম করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-অধ্যাপকদের অনেকেই ছাত্রীদের সঙ্গে অভব্যতা করেন৷ অভিযোগ করলেও সেই কেসের সুরাহা হয় না। অভিনয় জগতের মহিলাদের ক্ষেত্রেও তাই। যৌনপল্লীর ধর্ষণকে তো ধর্ষণের আওতায় আনাও হয় না। এমনকি ফুটপাতের গরীব মানুষ, মানসিক ভারসাম্যহীন, তারাও নিত্যদিন ধর্ষণের শিকার হয়৷ নিউ নর্মাল ইন্ডিয়ার অবস্থা ঠিক এমনটাই।
 
'হোয়াট ইজ টু বি ডান?'–  ধর্ষণ বা এনকাউন্টার নয়, দ্রুত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার চাই। নজরদারি নয়, আমরা মহিলাদের নির্ভয় স্বাধীনতার দাবি করছি। বিশাখা গাইডলাইন মেনে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নির্বাচিত সক্রিয় আইসিসি তৈরি করতে হবে। এছাড়াও, সমস্ত ক্যাম্পাসে 'জি এস ক্যাশ' লাগু করতে হবে। রাজ্যের প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার অডিট করা অত্যাবশ্যক। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষায় লিঙ্গসচেতনতাকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক। একমাত্র প্রকৃত সামাজিক শিক্ষাই পারে এই দুর্দিনকে বদলে দিতে।
 
ভারতে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩১,০০০ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। এই সংখ্যা আসল ঘটনার অর্ধেরও কম। কারণ পারিবারিক-সামাজিক চাপে পড়ে অনেকেই থানায় এসে অভিযোগ পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত করে না। পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন চলাকালীন উত্তরাখন্ড, ছত্তিসগড়, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, বিহার সহ অন্যান্য রাজ্যে মুহুর্মুহু ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির খবর আমাদের সামনে এসেছে। ধর্ষণ কোনও বিশেষ জায়গার সমস্যা না, ধর্ষণ সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যাকে দূর করার জন্য চাই সামাজিক শিক্ষা৷
 
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলার এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে আদ্যোপান্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী, নারীবিদ্বেষী বিজেপি এই সুযোগে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। নারী স্বাধীনতা ও বিচারের দাবির আন্দোলনকে বিজেপি চাইছে গদি দখলের নোংরা লড়াইতে পর্যবসিত করতে। সে গুড়ে বালি। বিজেপি শাসিত রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনায় বিজেপি'র ভূমিকা কী ছিল মনে আছে?
 
ক) ২০১৭ সালে, বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে ১৭ বছরের একজন নাবালিকাকে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন কুলদীপ সেঙ্গার। তখন তার পরিচয় ছিল, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার সদস্য। নির্যাতিতাকে পরবর্তীকালে ট্রাক চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয় এবং তার বাবাকে জেল হেফাজতে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারা হয়।
খ) ২০১৮ সাল। কাশ্মীরের কাঠুয়াতে মাত্র আট বছরের ছোট শিশুকে মন্দিরে আটকে রেখে সাতদিন ধরে গণধর্ষণ করা হয়। এরপর তাকে মাথায় পাথর দিয়ে মেরে, শ্বাসরোধ ক'রে হত্যা করা হয়। এইসময় ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী, ভারতীয় পতাকা হাতে ধর্ষকদের সপক্ষে বিজেপি মিছিল বের করে।
গ) ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে একজন ১৯ বছর বয়সী দলিত মেয়েকে চারজন উচ্চবর্ণের যুবক গণধর্ষণ ক'রে খুন করার চেষ্টা করে। মেরুদন্ডে আঘাত করে। ধর্ষিতা যাতে কোনও বয়ান না দিতে পারে, তাই তার জিভ কেটে নেওয়া হয়। দিল্লির এক হাসপাতালে ওই তরুণী মারা যায়। রাতারাতি উত্তরপ্রদেশের পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাটের তাগিদে, পরিবারের সম্মতি ছাড়া ওই নির্যাতিতার দেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়।
ঘ) ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময় অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিলকিস বানোকে ১১জন দুস্কৃতি মিলে গণধর্ষণ করে। পরিবারের সদস্যদের খুন করে। বিলকিসের তিন বছরের শিশুকন্যাকে পাথরে আছড়ে হত্যা করা হয়। এই পাশবিক ঘটনায় জড়িত সমস্ত দোষীকে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে জেল থেকে মুক্তি দেয় গুজরাটের বিজেপি সরকার। আরএসএস-এর অফিসে তাদের নিয়ে গিয়ে মালা পরিয়ে মিষ্টি খাওয়ানো হয়। গুজরাট সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সু্প্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিলকিস বানো। সরকারের সিদ্ধান্ত খারিজ করে ১১ অভিযুক্তকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।
ঙ) ২০২৩ সালে ভারতীয় কুস্তিগীররা দিল্লিতে রাজসড়কের দখল নেয়। ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের একাধিক কোচ এবং স্বয়ং প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগাটের মতো খেলোয়াড়েরা, যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। এই কুস্তিগীরদের অভিযোগের তীর মূলত রেসলিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার (ডাব্লিউ এফ আই) সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে, যিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন বিজেপির একজন সংসদ সদস্য।
চ) গতবছর মণিপুর যখন জ্বলছে, সেইসময় দু'জন কুকি মহিলাকে দিবালোকে সকলের সামনে বিবস্ত্র ক'রে গণধর্ষণ ক'রে রাস্তায় ঘোরানোর ঘটনা, বিশ্বের দরবারে সমগ্র দেশবাসীর মাথা হেট ক'রে দেয়। ক'দিন মাত্র আগের কথা। এই তালিকায় ঘটনা জুড়তে থাকলে লেখা ফুরোবে না। উপরিউক্ত একটি ঘটনারও বিচার বিজেপি সরকার করেনি। উপরন্তু প্রতিবাদ ক'রতে জনগণ রাস্তায় নামলে তাদের উপর হামলা ক'রে, বিভিন্ন মিথ্যে কেস চাপিয়ে আন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা ক'রেছে। কোনও ফ্যাসিস্ট দলকে এইসময় বাংলার মানুষ এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া যাবে না। আমরা দেখেছি, ২০১৪ সাল থেকে রাষ্ট্র ধর্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বদলে নির্লজ্জের মতো ধর্ষকের মুক্তির দাবি ক'রেছে। বিজেপি'র অধিকাংশ নেতাই মহিলাদের পোশাক, জীবন-যাপন ইত্যাদি নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ক'রেছেন। যার মধ্যে থেকে অনেকসময় তাদের ধর্ষকামী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
 
তিলোত্তমার বিচার  চেয়ে গণ আন্দোলন যখন তীব্র, রাজ্য সরকার ও রাজ্যের শাসক তৃণমূল যখন মূল নিশানা, তখনো বিজেপির সুযোগসন্ধানীদের ভুলে গেলে চলবে না।