ভারতের অর্থনীতি : স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে
- 07 September, 2023
- লেখক: অমিত দাশগুপ্ত
২০১৯ সালে, ২০১৮-১৯ সালের অর্থ বর্ষের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন ৫ বছরের মধ্যে দেশের জাতীয় উৎপাদন ৫ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন =১ লক্ষ কোটি) ডলারে পৌঁছে দেবে তার সরকার। অবশ্য কোনো এক টিভি চ্যানেলে বিতর্কের সময়ে তাঁর দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্র ১ ট্রিলিয়নে কটা শূন্য থাকে তা বলতে পারেননি। পরে ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে মোদিজি পুনরায় বলেন যে, দেশের জিডিপি ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষেই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে তিনি মনে করেন। করোনায় যে সময় নষ্ট হয়েছে তাকে পুষিয়ে দিতে অর্থনীতিকে একটু দ্রুতলয়ে চলতে হবে মাত্র, যা তাঁর সরকার চালাতে সক্ষম। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের জিডিপি ৩.৭৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে বর্তমান চলতি অর্থবর্ষে জিডিপির বৃদ্ধি ডলারের অঙ্কে ৩৪ শতাংশের বেশি হতে হত। প্রধানমন্ত্রী দেরিতে হলেও বুঝেছেন যে সেটা সম্ভব নয়, তবে তিনি সরাসরি নিজের ভুল স্বীকার করেননি, করেন না, কারণ রাজা কখনো ভুল করতে পারে না। বলতে শুরু করেছেন যে, ভারত এখন বিশ্বের ৫ নম্বর অর্থনীতি এবং শিগগিরি আমরা ৩ নম্বর অর্থনীতি হয়ে যাব, দেশের জিডিপি ২০২৬-২৭ সালে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। মোদিজি অনৃত ভাষণে পটু। তাছাড়া তাঁর তাঁবে সমস্ত মিডিয়া হাউসগুলি রয়েছে। ফলে তিনি যেটা বলবেন সেটাকে প্রচারের মাধ্যমে সত্যিতে রূপান্তর করা হবেই হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের জিডিপি পরিসংখ্যান অনুযায়ী যদি ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতিতে পরিণত করতে হত তাহলে ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রয়োজন ছিল বার্ষিক ১২ শতাংশ। যেখানে ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত ওই বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক মাত্র ৬.৮ শতাংশ। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ৫ বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার ঘোষণা একটি জুমলা ছিল বলাই যায়। মোদিজির রাজত্বে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে খুব বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে ওই রাজত্বের ৯ বছরে ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৬.৯ শতাংশ। তুলনায় মনমোহন সিং সরকারের ১০ বছরে ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ৯.৯ শতাংশ। যদি ওই হার বজায় রাখা যেত তাহলে সত্যি সত্যিই ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ৫.২৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেত। অন্যদিকে যদি ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার মোদিজির রাজত্বের হারে চলতে থাকে তাহলে ওই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ক ২০২৬-২৭ অর্থবর্ষেও ছোঁয়া যাবে না। সেখানে পৌঁছতে আরো এক বছর লেগে যাবে। যদি ডলার মূল্যে বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৭.৬ শতাংশ থাকে তাহলেই দেশের জিডিপি ২০২৬-২৭ সালে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারবে। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে, বর্তমান সরকার জিডিপিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে যথাসময়ে নিয়ে যেতে সার্বিক ব্যর্থ হয়েছে, অন্তত পক্ষে ৩ বছর পিছিয়ে দিয়েছে দেশের অর্থনীতির পরিমাণকে। দেশের অর্থনীতির পরিমাণ বা বহর নিয়ে মোদি সরকারের গর্বিত নয়, লজ্জিত হওয়ার কথা।
তবে কেবল পরিমাণ নয়, বহু অর্থনৈতিক বিষয়েই বর্তমান সরকারের অক্ষমতা পরিস্কার। প্রকৃতপক্ষে জিডিপির পরিমাণ বা বৃদ্ধি দেশের জনকল্যাণ বিষয়ে কিছুই বলে না, কীভাবে সেই জিডিপি বা তার বৃদ্ধি বন্টিত হচ্ছে তা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপিকে পরিমাপ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় (C), বিনিয়োগ ব্যয় I), সরকারি ব্যয়( (G), নিট রফতানি ((X-M) অর্থাৎ রফতানি (X) – আমদানি (M)
ফলে জিডিপি = C + I+ G + (X-M)। জিডিপির হিসেবের অন্তর্ভুক্ত ওই সমস্ত বিষয়গুলির পর্যালোচনা করলেও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে তা জানা যেতে পারে। ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের দুএকটি পণ্য ও পরিষেবার দিক থেকে আপাতত দেখা যাক।
২০২২-২৩ সালে দেশের মধ্যে টু-হুইলারের বিক্রির সংখ্যা ১৫৮.৬ লক্ষ, ২০২১-২২ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু তা ২০১৪-১৫ সালের ১৫৯.৮ লক্ষের তুলনায় কিছুটা কম, এবং ২০১৮-১৯ সালের ২১১.৮ লক্ষের তুলনায় অনেক কম। অনেক পরিবারের কাছেই টু-হুইলার মধ্যবিত্ত জগতে প্রবেশের একটি ধাপ, এবং অনেকের কাছেই বাড়ির পরে দ্বিতীয় দামি পণ্য। ফলে এই যে টু-হুইলারের বিক্রির পতন তা জানান দেয় যে নিম্ন আয় বর্গের বহু পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। কেবল তাই নয়, কম দামি টু-হুইলারের বিক্রি সামগ্রিক টু-হুইলার বিক্রির তুলনায় ারো দ্রুত কমেছে। ফলে বলা যায় যত আয়স্তরের নিচের ধাপে পৌছনো যাচ্ছে তত ক্রয় ক্ষমতা কমছে।
২০২২ সালে ভারতে ১৪.৪ কোটি স্মার্ট ফোন আমদানি করা হয়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ কম। সামগ্রিকে ২০২২ সালে ২০.১ কোটি মোবাইল ফোন এসেছে ভারতে যা ২০২১ সালের তুলনায় ১২ শতাংশ কম। কিন্তু আই ফোনের ও দামি স্মার্ট ফোনেরে বিক্রি বেড়েছে। এক্ষেত্রেও সেই বিত্তবানের রামরাজ্য।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে চিহ্নিত করতে দেশের অসামরিক পরিবহণ মন্ত্রক জানিয়েছে যে ৩০ এপ্রিল, ২০২৩এ রেকর্ড সংখ্যক, ৪৫৬০৮২ যাত্রী বিমানে ভ্রমণ করেছে। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ শতাংশ ভারতীয় ৪৫ শতাংশ বিমান যাত্রী। তাছাড়া ১৪০ কোটির দেশে ৪.৫ লক্ষ বিমানযাত্রী কিছুই না। ২০২২-২৩ সালে ১৩.৭ কোটি দেশের মধ্যে বিমান চড়েছেন। কিন্তু তা ২০১৮-১৯ এর ১৪.১ কোটি বা ২০১৯-২০ সালের ১৪.২ কোটিকে ছড়াতে পারেনি। ২০২২-২৩ সালে ট্রেনযাত্রীর সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালের যাত্রী সংখ্যার তুলনায় ২৪ শতাংশ কম, ২০১৯-২০ সালের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম। যদি লোক্যাল ট্রেনের যাত্রী বাদ দিয়ে ধরা হয় তাহলে ওই সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২৯ শতাংশ ও ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। ফলে ধরা যেতে পারে বহু ব্যক্তিই আর্থিক ভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়ায় দীর্ঘ যাত্রার ট্রেনে চড়ছে না। আবার কাজের ক্ষেত্রে গতি না আসায় লোকাল ট্রেনেও চড়ছে না। হিন্দুস্তান লিভারের কর্তার বক্তব্য অনুযায়ী ফাস্ট মুভিং ভোগ্যপণ্যের (সাবান, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু ইত্যাদি) বাজার ক্রমাগত কমছে, গ্রামীণ বাজার বেশি করে কমছে। অন্যদিকে ১০০ দিনের কাজের চাহিদা কোভিড অতিমারির সময়ের তুলনায় কমলেও, ২০১৯-২০ বা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় যথেষ্টই বেশি। ফলে কাজের বাজারের অবস্থাও খারাপ। সিএমআইই-র পরিসংখ্যানও তেমনটাই জানাচ্ছে, উপরন্তু শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণের অনুপাতও কমছে, বিশেষত মেয়েদের।
এবছরে ভারত ইউকে-কে জিডিপির পরিমাণে টপকে গেছে। আইএমএফ-এর পরিসংখ্যা অনুযায়ী ইউকের জিডিপি (৩.১৯ ট্রিলিয়ন ডলার) ২০২১ সালে ভারতের জিডিপির (৩.১৮ ট্রিলিয়ন ডলার) থেকে সামান্য বেশি ছিল। ওই সময়ে ইউকের জনসংখ্যা ছিল ৬.৭৩ কোটি, ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১৩৯ কোটি। ফলে ভারতীয় জনগণের গড় উৎপাদনশীলতা ব্রিটিশ জনগণের গড় উৎপাদনশীলতার ২০ ভাগের একবাগের থেকেও কম ছিল। ফলে জিডিপির পরিমাণে টপকে গেলেও ইউকের তুলনায় ভারত শক্তিশালী অর্থনীতি তা বলা বাতুলতা। একই ভাবে বলা যায় ভারতের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ব্রিটেনের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ৫ শতাংশের কম। যদি মোদি সরকার ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতি বলে গর্ব প্রকাশ করে তাহলে একই সাথে মাথাপিছু আয়ের কথাও বলতে হবে। এবং এও জানাতে হবে যে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের অবস্থান ১৯৩ টি দেশের মধ্যে ১৪৫ তম।
যে সমস্ত কথা এই ছোট্ট পরিসরে লেখা হল তা মোদিজি তথা বিজেপির মেকি গর্বের অসারতার আংশিক উন্মোচন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মহীনতা, দেশব্যাপী দাঙ্গার মত বিষয়গুলিকে এক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।