এক বিপন্ন জাহাজের নাবিক ও গার্সিয়া মার্কেসের সাংবাদিক প্রতিবেদন

১৯৫৫ সালে গার্সিয়া মার্কেস সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতার বিখ্যাত কাগজ এল এসপেক্টেটাডোরে। সেই সময়ে কলম্বিয়া তথা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয় জাহাজডুবির দশদিন পর লুই আলেজান্দ্রো ভেলাসকো নামে এক নাবিকের বেঁচে ফেরার চমকপ্রদ ঘটনা। ক্যালডাস নামে কলম্বিয়ান নেভির এক ডেস্ট্রয়ার জাহাজ প্রায় আট মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা প্রদেশের মোবিল বন্দরে মেরামতির জন্য আটকে ছিল। অত:পর মেরামতির কাজ সমাপ্ত করে জাহাজটি রওনা দেয় কলম্বিয়ার কার্তাজেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে। ২৮ ফেব্রুয়ারি উথাল পাতাল সমুদ্রের ঢেউতে ডেকের ওপরে থাকা আট নাবিক ভেসে যান। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে তাঁরা পড়ে যাবার পর শুরু হয় তল্লাসি। পানামা ক্যানেল কর্তৃপক্ষ বিমান থেকে তল্লাশি করেও কাউকে খুঁজে পায় নি। চারদিন পরও কাউকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে অনুসন্ধান থামিয়ে দিয়ে সকলকেই সরকারীভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়। নাবিকদের আত্মীয় পরিজন আর বন্ধু বান্ধবরাও সেটাই মেনে নেন। 

দুর্ঘটনার দশদিন পরে কুড়ি বছরের তরুণ ভেলাসকো অর্ধমৃত অবস্থায় কলম্বিয়ার এক জনবিরল দ্বীপে এসে পৌঁছন ডেক থেকে নাবিকদের সঙ্গেই পড়ে যাওয়া এক লাইফ বোটে ভাসতে ভাসতে। 

এই দশদিন কীভাবে বিনা খাদ্যে বিনা পানীয় জলে হাঙরের মুখে পড়েও কীভাবে তিনি বেঁচে রইলেন সেই অত্যাশ্চর্য কাহিনী জানতে সকলেই উন্মুখ হয়ে ওঠেন। 

ভেলাসকো খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন কথা বলেন তরুণ সাংবাদিক গার্সিয়া মার্কেস। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সেই ঘটনাটির পুন:নির্মাণ ভেলাসকোর জবানিতে কয়েক কিস্তিতে বেরোয় এল স্পেকটেটাডোর কাগজে। এই প্রতিবেদন কাগজটির সার্কুলেশন দ্বিগুণ করে দেয়। গোটা কলম্বিয়ার মানুষ এই প্রতিবেদনটি পড়তে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। 

সংবাদপত্রে প্রকাশের সময় কোনও কিস্তিতেই লেখক হিসেবে গার্সিয়া মার্কেসের নাম ছিল না। ১৯৭০ সালে প্রতিবেদনগুলি বই হিসেবে সংকলিত হয় ও সেই সময়েই প্রথম প্রতিবেদক হিসেবে গার্সিয়া মার্কেসের নামটি জনসমক্ষে আসে। ততদিনে গার্সিয়া মার্কেসের অন্যান্য আখ্যানের পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে সুবিখ্যাত 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড'ও। সাড়া জাগানো লেখকের এই সাড়া জাগানো প্রতিবেদনটিও নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি করে। 

বইটির ভূমিকায় গার্সিয়া মার্কেস এই প্রতিবেদন লেখার একটি 'ইনসাইড স্টোরি'ও প্রকাশ করেন। সরকারী বয়ান এই  দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে একটি বিরাট সামুদ্রিক ঝড়ের কথা বলেছিল। গার্সিয়া মার্কেসের প্রতিবেদন থেকেই জানা যায় বড় কোনও ঝড় সে সময় হয় ই নি। নৌ বাহিনীর জাহাজে বে আইনীভাবে প্রচুর পণ্য তোলা হয়েছিল। সেগুলি মার্কিন দেশ থেকে উপহার হিসেবে কলম্বিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সেগুলি জাহাজের ভারকে একপাশে হেলিয়ে দেয় যা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কলম্বিয়ার তৎকালীন স্বৈরশাসকের আক্রমণ নেমে আসে এল স্পেকটেটাডোরের ওপর। অন্যদিকে জাহাজডুবির পর দশদিন খাদ্যজলহীন সমুদ্রে একা কাটিয়ে বেঁচে ফেরার পর ভেলাসকো কলম্বিয়ায় জাতীয় নায়কের মর্যাদা পান। তিনি যেখানেই যেতেন তাঁকে ঘিরে জনতার ভিড় জমে যেত। সাংবাদিক থেকে আমজনতা সবাই তাঁর মুখ থেকে সেই আশ্চর্য কাহিনী শুনতে চাইতো। ভেলাসকোর এই জনপ্রিয়তা দেখে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পণ্যের মডেল হিসেবে তাঁকে নির্বাচন করে। যেহেতু ভেলাসকোর ঘড়ি সেই সমুদ্রে বরাবর তাঁকে সঠিক সময় জানিয়েছিল, তাই বিখ্যাত এক ঘড়ি নির্মাতা সংস্থা তাঁকে তাদের ঘড়ির ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডার করে। একইভাবে ভেলাসকোর শক্তপোক্ত জুতোটি আগাগোড়া তার পায়ে সেঁটে ছিল, শত চেষ্টাতেও তা খোলা যাচ্ছিল না বলে এক জুতো কোম্পানির মুখও হয়ে ওঠেন তিনি। কলম্বিয়ান মুদ্রা পেসোর বন্যা বইতে থাকে এইসমস্ত বিজ্ঞাপণের সূত্রে। চাকরিতেও পদোন্নতি হয়।

গার্সিয়া মার্কেস তাঁর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের পনেরো বছর পর যখন একে বই হিসেবে প্রকাশ করেন, তখন এর সঙ্গে একটি ভূমিকা নতুনভাবে লেখেন তিনি। সেখানে সেই সময়কার পরিবেশকে তিনি ফিরে দেখেছেন। ভেলাসকোর সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। প্রতিবেদনটি ভেলাসকোর জবানীতেই প্রকাশিত হয়েছিল। গার্সিয়া মার্কেস জানিয়েছেন এই প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল চমকপ্রদ বাস্তবগুলিকে পাঠককুলের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশন করা, কারণ এই ঘটনাটি ছিল ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্য ফিকশন’ নামক প্রবাদটির সার্থক দৃষ্টান্ত।

প্রতিবেদনটি শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা প্রদেশের মোবিল বন্দরে মেরামতির জন্য আটকে থাকা ক্যালডাস জাহাজের নাবিকদের কথা দিয়ে। প্রায় আট মাস ধরে ডেস্ট্রয়ার নামের এই জাহাজটির যখন মেরামতি চলছিল, তখন ভেলাসকো ও তার সহ নাবিকেরা কীভাবে দিন কাটাত, সেই সব কথা বেশ বিস্তারিতভাবেই রয়েছে প্রতিবেদনের শুরুতে। ভেলাসকোর মেরী নামে সেই বান্ধবীর কথা এসেছে সবচেয়ে বেশি, যার সঙ্গে সে সিনেমায় যেত, আইসক্রিম খেত, যার কাছে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি সে দিয়েছিল। নির্জন সমুদ্রে যখনই ভেলাসকোর মৃত্যুমুখে পড়েছে, হতাশায় ডুবে গেছে এই মেরীর মুখ ও কথা তখনই তার মানসপটে বারবার ভেসে উঠেছে। বন্দর ছেড়ে যখন জাহাজ চলতে শুরু করেছে তখন ভেলাসকোর জবানীতে আমরা জেনেছি তার সহনাবিকদের কথা। জেনেছি নাবিকেরা সবাই মিলে কী বিপুল পরিমাণ পণ্যদ্রব্য তুলেছিল জাহাজে, যেগুলি মার্কিন দেশ থেকে কেনা হয়েছিল কলম্বিয়ায় ফিরে আত্মীয় বন্ধুদের উপহার দেবার জন্য। জাহাজের ডেকেই এইসব ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ও অন্যান্য দামি ও ভারি পণ্য সার দিয়ে দড়ি বেঁধে রাখা ছিল। আমরা জানতে পারি জাহাজ রওনা দেবার দু একদিনের মধ্যে অনেকে সমুদ্রব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও তা ভেলাসকোকে স্পর্শ করে নি। সে খুশিমনে অপেক্ষা করছিল দেশে ফেরার ক্ষণটির জন্য।

সেই ইপ্সিত মুহূর্ত যখন কয়েক ঘন্টা মাত্র দূরে তখন হাওয়া আর ঢেউয়ের দাপটে জাহাজটি কাত হয়ে পড়ে একদিকে। ডেকে বে আইনীভাবে বিপুল সংখ্যক পণ্য মজুত করে রাখা তার একটা কারণ ছিল। কাত হয়ে থাকা ডেক থেকে পণ্যগুলি দড়ি ছিঁড়ে সমুদ্রে পড়তে থাকে একসময়। ডেকের ওপরে থাকা আটজন নাবিকও সেইসময় সমুদ্রে পড়ে যান। ডেকের ওপরে থাকা দুটি লাইফবোটও জলে পড়ে যায়। তার একটিতে কোনওক্রমে উঠে বসে ভেলাসকো। বাকি সাতজনের কেউই অনেক চেষ্টা করেও আর লাইফবোটে উঠতে পারে নি।

লাইফবোটে একাকী ভাসতে ভাসতে ভেলাসকো প্রথম কয়েক ঘন্টা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে উদ্ধারকারী জাহাজ বা এরোপ্লেনের জন্য। কয়েকটি প্লেন তার মাথার ওপর দিয়ে উড়েও যায়, কিন্তু তারা কেউই তাকে দেখতে পায় নি। এরপর বিমান আসা বন্ধ হয়ে যায়। দিকচিহ্নহীনভাবে লাইফবোটের ভেলায় ভাসতে থাকে ভেলাসকো।

এই প্রতিবেদনের বর্ণনা এতই চমকপ্রদ আর শিহরণ জাগানো যে তার অনেক অংশই উদ্ধৃতি সহকারে লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সমস্যা হল সমুদ্রে ভেসে থাকার অভিজ্ঞতাগুলির সবই এত চমকপ্রদ যে তা থেকে আলাদা করে চয়ন করা মুশকিল। হাঙরের দলের রোজ বিকেলের দিকে একটি নির্দিষ্ট সময় জুড়ে ভেলাসকোর ভেলাটিকে ঘিরে থাকা, একটি সিন্ধু সারসকে বাগে পেয়ে হত্যা করে তার কাঁচা মাংস খাবার ব্যর্থ চেষ্টা, সমুদ্রে ভেলাটি হঠাৎ উলটে সলিল সমাধির মুখোমুখি হওয়া ও কোনওক্রমে আবার ভেলায় উঠতে পারা – এসব চমকপ্রদ ঘটনা যেমন প্রতিবেদনের উল্লেকযোগ্য অংশ, তেমনি উল্লেখযোগ্য যখন কিছুই ঘটছে না আপাতভাবে, শুধুই দিশাহীনভাবে ভাসতে ভাসতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে ভেলাসকো – তখনকার শান্ত গভীর অনুভবগুলি।

এক কালো রাতের শেষে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখন ভেলাসকো হঠাৎই দেখতে পায় সবুজ ঘাসের দেশের ডাঙা। সেখানে শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিয়ে কোনওক্রমে পৌঁছয় সে। নারকেল গাছের সারি দেখে। একটি নারকোল ফাটিয়ে খেতে চায়, কিন্তু শক্ত আবরণটা কিছুতেই ভাঙতে পারে না। তারপর দেখতে পায় একটি ছোট মেয়েকে। তার কাছে চিৎকার করে সাহায্য চায়। মেয়েটির কাছ থেকে খবর পেয়ে এক তরুণ আসেন, তিনি খবর দেন গ্রামবাসীদের। জেলেদের ছশো লোকের ছোট গ্রামটির সকলের কৌতূহলী দৃষ্টির মুখোমুখি হয় ভেলাসকো। সেখানে প্রাথমিক শুশ্রুষা আর বিশ্রাম পেলেও কোনও ডাক্তার ছিলেন না। খচ্চরের পিঠে তাকে চাপিয়ে অনেক পথ পেরিয়ে গোটা গ্রামটা তাঁকে পৌঁছে দেয় এক বড় জনপদে। সেখানে ডাক্তার দেখেন তাঁকে। একটি বিমানের ব্যবস্থা হয়। বিমানে চেপে কার্তেজানায় এসে নৌসেনার হাসপাতালে ভর্তি হয় ভেলাসকো। সেই সেনা হাসপাতালেই ভেঙে পড়ে সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীর দল, যদিও তাদের প্রবেশ কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেনা কর্তৃপক্ষ। লুকিয়ে কেউ কেউ তার সাক্ষাৎকার নিতে সমর্থ হয় এরই মধ্যে। এক সাংবাদিক চিকিৎসকের ছদ্মবেশ ধরেও সাক্ষাৎকার নেবার চেষ্টা করেন মরীয়াভাবে। ভেলাসকোর গোটা দেশের কৌতূহলের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়ে ওঠার কথার মধ্যে দিয়েই প্রতিবেদনের সমাপ্তি।