বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্কর : রাঙামাটির পথের পাঁচালী
- 07 September, 2021
- লেখক: নীতা মণ্ডল
(১)
উনিশশো চুয়াল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাস। হাওড়া ষ্টেশন থেকে দিল্লী এক্সপ্রেস ছাড়বে। চারিদিকে ব্যস্তত্রস্ত ভাব। বিচিত্র শব্দে মুখরিত রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম। যাত্রীদলের সামনে স্তূপাকার করে রাখা রাজ্যের বোঝা। বাক্স, বিছানা, খাবারের পুঁটুলি, জলের কুঁজো সহ হরেক দ্রব্য। কুলির সঙ্গে কেউ দর কষাকষি করছে, কেউ ঝগড়া। কামরার ভেতর আপন আপন সুবিধার দাবী নিয়ে চলছে বচসা। এ সবই যেন রেলযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে ক্ষণস্থায়ী। নিমেষের মধ্যেই পরিবেশটা পালটে গেল। রেলকামরা সহ প্ল্যাটফর্ম ভাসতে লাগল আবেগ মিশ্রিত উপদেশের বন্যায়। যেন যাত্রীরা কোনও বিপদসঙ্কুল পথে পা বাড়িয়েছে! ট্রেন দুর্ঘটনা, বিদেশ বিভূঁইয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া, অচেনা লোককে বিশ্বাস করে তার দেওয়া খাবার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার উদাহরণ দিয়ে রেলভ্রমণকালীন মজার সবটুকু মাটি করে দেবার আয়োজন করেছে যাত্রীদের স্নেহপ্রবণ আত্মীয়কুল।
সেদিকে কান পেতেছিলেন একজন। তিনিও এই ট্রেনের যাত্রী। সংসারে তাঁর জন্যে উদ্বিগ্ন হবার মানুষের অভাব নেই। তারা কেউ কেউ সঙ্গে এসেছে। বাক্সপ্যাঁটরা তুলে দিয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায়। কামরার মধ্যে ভিড় করে অন্যের অসুবিধা না বাড়িয়ে নেমে এসে দাড়িয়েছে প্ল্যাটফর্মের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায়। দরকারি ওষুধ, তেল-মাজন, মোজা-মাফলার, খাতা-পেন কোথায় কী আছে সেকথা আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। যাত্রী অবশ্য অন্যমনস্ক। তাঁর চোখ চারিদিকে ঘুরছে। প্ল্যাটফর্ম অথবা রেলকামরার প্রতিটি ছবি, প্রতিটি শব্দ তিনি শুষে নিচ্ছেন। জমিয়ে রাখছেন স্মৃতিতে। সুযোগ পেলেই অক্ষরে অক্ষরে বন্দি করবেন খাতায়। বিদায়লগ্ন এগিয়ে আসতেই সঙ্গীরা তাঁর পায়ের ধুলো নিল। তাদের বুকে জড়িয়ে ধরতেই হঠাৎ মনে এল রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন
‘সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
‘দিব না দিব না যেতে’। নাহি শুনে কেউ...’
মুখে বললেন, ‘তোমরা এবার এস।’ তারপর উঠে পড়লেন ট্রেনে।
কামরার ভেতর জানলার ধারে একজন অনেকক্ষণ আগে এসে বসেছেন। চুপচাপ তাকিয়ে আছেন জানলার বাইরে। চারিপাশের কোলাহল, কলরব, কলহ কোনও কিছুই তাঁর কানে প্রবেশ করে নি। জানলার বাইরে কুলিদের ব্যস্ততা, যাত্রীদের দৌড়াদৌড়ি, প্ল্যাটফর্মের স্টল, টিনের শেড ইত্যাদি জাগতিক দৃশ্যকে নস্যাৎ করে দিয়ে তাঁর একজোড়া চোখ যেন কোন সুদূরে হারিয়ে গিয়েছে। উল্টোদিকের খালি আসনে যাত্রীর আগমন হতেই তাঁর মগ্নতা ভেঙে গেল। খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়েই বলেলেন, ‘তারাশঙ্কর! এস এস।’
তারাশঙ্করের মুখমণ্ডলে পড়ল খুশির আলো। তিনি বললেন, ‘বাঃ বিভূতি, একেবারে যে তোমার সামনেই আমার জায়গা। এ যাত্রা শুভ না হয়ে যায়!’
একই গন্তব্যে, একই কাজে চলেছেন দুজনে। কানপুরে প্রবাসী-বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলনে যোগ দিতে। পরস্পরের পূর্ব পরিচয় সৌজন্যমূলক। রমেশ সেনের আড্ডায় পরিচয় হয়েছিল ক-বছর আগে। পরে দুএকবার দেখাসাক্ষাৎ হলেও বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় তেমনটা গড়ে ওঠে নি। তবে পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একে অপরের নতুন লেখার জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন। সেই সূত্র ধরেই বাক্যালাপ শুরু হল। কখন ট্রেন ছেড়ে দিল দুজনের কেউই টের পেলেন না।
(২)
ট্রেন বর্ধমান ছাড়িয়ে রুক্ষ অঞ্চলের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর বিভূতিভূষণ মগ্ন হয়ে গেলেন বাইরের দৃশ্যে। জানলা দিয়ে অপলক চেয়ে আছেন। তারাশঙ্কর একটি বই খুলে বসলেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সংক্রান্ত বই।
আশ্চর্যের কথা। আকাশ, মাঠ, নদী, পুকুর, লাইনের ধারে ঝোপজঙ্গল, গ্রাম, শহর, গোরু, ছাগল, পল্লী শিশুর দল কিমবা টেলিগ্রাফের তারে বসা ছোট্ট পাখির দোল খাওয়ার দৃশ্য রেখাপাত করছে না বিভূতিভূষণের মনে। তিনি অতীতে ডুব দিয়েছেন। মনে পড়ছে কয়েক বছর আগের কথা। একজন নতুন লেখকের নাম খুব শোনা যাচ্ছে তখন। একেবারে অন্যধারার গল্প লিখছে সে। কারও মতে সে খাঁটি নতুন জিনিসের আমদানি করেছে। কেউ বলছে তার লেখাগুলি বড্ড স্থূল। একবার দুতিন দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাবার আগে সেই নতুন লেখকের একখানি বই যোগাড় করে ফেললেন তিনি। বইটির নাম ‘রাইকমল’। ভাবলেন, ছুটির অবসরে পড়ে ফেলবেন। গ্রামের নির্জন ঘরে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে বইটি পড়তে শুরু করে আর থামতে পারলেন না। একটানা পড়ে যখন শেষ করলেন তখন গভীর রাত। বইটি তাঁকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। হৃদয় হয়েছে আনন্দে পরিপূর্ণ। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন বাঁশবাগানের জমাট অন্ধকারের মধ্যে মিটমিট করে জোনাকি জ্বলছে। অপূর্ব আলো! তাঁর মনে হল, ‘ওই কথাটাই সত্যি। বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন সুরের সংযোজন ঘটেছে। এ লেখক এক অপার্থিব, অচেনা দুনিয়ার কথা শোনাতে আবির্ভূত হয়েছেন।’
পরদিন সকালে বইখানি নিয়ে গিয়ে গ্রামের লাইব্রেরীতে দিয়ে বিভূতিভূষণ বেশ কয়েকজনকে বলেছিলেন, ‘বইটি পড়ে দেখ, নতুন জিনিসের সন্ধান পাবে।’
জানলা দিয়ে আসা হাওয়ার দাপটে তারাশঙ্করের হাতে ধরা বইটির পাতার পর পাতা উলটে যাচ্ছে। তিনি আনমনে ভাবছেন বছর খানেক আগের কথা। ১৯৪৩ সাল। বাংলার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে। বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ নিজের সন্তানকে বেঁচে দিয়েছে। মেয়েরা বেচেছে তাদের মান সম্ভ্রম। দুর্ভিক্ষই ছিল গতবার তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। শারদীয়া যুগান্তরে বেরিয়েছিল ‘ময়দানব’ আর আনন্দবাজারে বেরিয়েছিল ‘মন্বন্তর’। পুজোর পরপরই একদিন ধর্মতলায় একটি সাহিত্য বাসর বসেছিল। পূজাসাহিত্যের সমালোচনার আসর। বহু বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও সমালোচক উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সকলেই একবাক্যে তারাশঙ্করের লেখাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। এ অভিজ্ঞতা তারাশঙ্করের জীবনে অভিনব। লেখার জন্যে এমন নির্ভেজাল প্রশংসা আগে পান নি! তাই ভারি আনন্দ হল।
এরপর কথা উঠল বিভূতিভূষণকে নিয়ে। কথাগুলো মনে পড়ছে। হুবহু মনে পড়ছে সেই ঘরের দৃশ্য। সেবার বিভূতিভূষণের গল্পের বিষয়বস্তু অপরূপ মধুর। উত্তমপুরুষের বয়ানে লেখা। বক্তার কোনও কারণে মন ভালো নেই। রোজ দেখা চারিপাশের দৃশ্যে অথবা নিত্যদিনের কাজে সেদিন সে কোনও আকর্ষণ বোধ করল না। মনে হল, সবকিছু কেমন সারহীন, রসহীন, অর্থহীন। ধীরে ধীরে তার মনের বিষাদ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বপ্রকৃতিতে। আকাশ বিষণ্ণ, বাতাস উদাস, আলো ম্লান, সঙ্গীত মাধুর্যহীন এবং খাদ্য স্বাদহীন বোধ হল। সারাদিন ধরে দুঃখে পীড়িত হয়ে, ঘুরতে ঘুরতে সে পৌঁছল কার্জন পার্কের কাছে। সেখানে সাহেবদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে এসেছে তাদের ঝি চাকরেরা। শিশুগুলি আপন আনন্দেই মাতোয়ারা। তাদেরই একজন অর্থহীন বকবক করছে আর টুপি নিয়ে পরিচারকের মাথায় পরিয়ে দিয়ে খুশিতে হাততালি দিচ্ছে। টুপিটা মাথা থেকে খসে পড়লেও সে একই রকম খুশি হচ্ছে। আবার তুলে সেটা পরিয়ে দিচ্ছে। নিজের কীর্তিতে নিজেই হাসছে খিলখিল করে। কোনও এক জাদুমন্ত্রে বক্তার বিষাদ দূর হয়ে গেল। শিশুটির আনন্দ সংক্রামিত হল তার মধ্যে। বিশ্বপ্রকৃতি আবার আনন্দময় হল। গল্পটি এটুকুই। ‘একটি দিনে’র অনুভবের বিবরণ শুধু।
তারাশঙ্করের অস্বস্তি হচ্ছে। গল্পটার নাম মনে পড়ছে না। জিজ্ঞেস করবেন ভেবে বিভূতিভূষণের দিকে তাকিয়ে মত পালটালেন। স্মৃতিপটে আবার সেই সাহিত্যবাসরের ছবি ফুটে উঠল।
‘এটা কী লিখেছেন বিভূতিবাবু? এসব যে কেন লেখেন তিনি?’ একরাশি বিরক্তি মিশিয়ে কেউ একজন প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিল। চুপ করে থাকলেও কারও কারও মুখের রেখায় ফুটে উঠেছিল বক্রতা। প্রশ্নটির ব্যাপারে সবাই সহমত। তারাশঙ্করই নীরবতা ভেঙে বলেছিলেন, ‘গল্পটি কিন্তু আমার ভালো লেগেছে।’
যেন মৌচাকে ঢিল পড়েছিল। ঘরখানা গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। কলকাতার সুশিক্ষিত সাহিত্য সমালোচকগণ বিভূতিভূষণের গল্প পড়ে যত না বিস্মিত হয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলেন গল্পটি তারাশঙ্করের ভালো লেগেছে জেনে। তাই তাঁরা তারাশঙ্করকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন।
- একটা মানুষের মন বিষণ্ণ। মানছি, সে হতেই পারে। তবে বিষণ্ণতার একটা কারণ তো থাকবে। গল্পে তার বিশ্লেষণ কোথায়?
- একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মন খারাপ কেবল ছেলেদের কলরব আর আনন্দে কেটে যাবে? তা হয়?
- দেশে চারিদিকে কেবল দুঃখ, দুর্দশা, মড়ক, দুর্ভিক্ষ। সাহিত্যিক কি এখনও এই সব নিয়েই লিখে যাবে?
তারাশঙ্কর চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি এঁদের প্রশংসায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। সে ঘোর তখনও কাটে নি। তিনি ভাবলেন, সত্যিই তো গল্পটি কেন এত ভালো লাগল? সঠিক যুক্তিযুক্ত কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন না কিন্তু গল্পটির প্রতি ভালোলাগাও অস্বীকার করতে পারলেন না।
ট্রেন নদী পার হচ্ছে। ব্রিজের উপর ট্রেনের চাকার তীব্র শব্দে সজাগ হয়ে উঠলেন বিভূতিভূষণ। নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘এক কাপ চা খাওয়া দরকার। গলা যে শুকিয়ে গেল!’
বিভূতিভূষণের গলার স্বরে তারাশঙ্করেরও চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। চায়ের কথায় তিনি তেষ্টা অনুভব করলেন। চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভূতিভূষণকে দেখছিলেন তিনি। লেখক বিভূতিভূষণের মুখমণ্ডলে গ্রাম্য সরল বালক অপুর কচি মুখখানি যেন মাখামাখি হয়ে আছে।
কী বিচিত্র মানুষের মন! পরক্ষণেই তারাশঙ্করের মনে সন্দেহ ঘনিয়ে উঠল, ‘এই যে বিভূতির এমন অনাড়ম্বর জীবন, এই যে বাস্তব সম্পর্কে এমন উদাসীনতা, এ কি খাঁটি? কোনও কৃত্রিমতা নেই?’
(৩)
সামনের বায়ুস্তরকে আন্দোলিত করে ট্রেন ছুটে চলেছে উত্তরে। বন্ধ জানলার সামান্য ফাঁক দিয়ে বাতাস বয়ে আনছে শীতের শিরশিরানি। চা পান করতে করতে দুজনের গল্প জমে উঠেছিল। নৈশাহারের সময় হতে তাতে ছেদ পড়ল। তারাশঙ্কর খাদ্যরসিক নন উপরন্তু মশলা দেওয়া খাবার তাঁর জন্যে নিষিদ্ধ। সামান্য পেট ভরানোর মতো খেলেন তিনি। উলটোদিকে বিভূতিভূষণ তৃপ্তি করে অনেককিছু খাচ্ছেন।
খাওয়া শেষ হতেই তারাশঙ্কর আপন আসন থেকে উঠে গুছিয়ে নিলেন উচ্ছিষ্টের পাত্র। হাত ধুতে যাবেন এমন সময় বিভূতিভূষণ তাঁর এঁটো হাত দুখানি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দে না ভাই হাতদুটো ধুয়ে। বড্ড খেয়েছি। উঠতে কষ্ট হচ্ছে।’
তারাশঙ্কর ঘুরে তাকালেন। লেখক বিভূতিভূষণের মুখ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। তাঁর দিকে যে চেয়ে আছে, সে অবিকল গ্রাম্য সরল বালক অপু। পাত্রটির উপর বিভূতিভূষণের হাত রেখে তারাশঙ্কর যত্ন করে ধুয়ে দিলেন। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল তারাশঙ্করের। বিভূতিভূষণের আসল রূপটি যেন অকস্মাৎ তাঁর সামনে প্রকট হল। মুখমণ্ডল জুড়ে অনাবিল সারল্য আর পবিত্রতা। চোখদুটি অতলস্পর্শ গভীর। কিছুক্ষণ আগে মনে ঘনিয়ে আসা সন্দেহ কোথায় ভেসে গেল। তারাশঙ্করের মনে হল, ‘যে সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা মানুষের বা সংসারের বিচার করে থাকি সেই দৃষ্টিতে বোধ হয় বিভূতির স্বরূপ দেখা যায় না। বিভূতি সাধক। সাহিত্যের সাধনার সঙ্গে সঙ্গে সে মনুষ্যত্বের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে। পেয়েছে অমৃতের সন্ধান। তাই তার চিত্ত অমন অহরহ আনন্দে আপ্লুত। এতে কোনও ভান নেই।’
হাত ধুয়ে ফিরে এসে তারাশঙ্কর রাতের শোবার তোড়জোড় করতে লাগলেন। দিল্লী এক্সপ্রেস হু হু করে মানভূম পার হয়ে ছুটে চলেছে। হঠাৎ কামরা ভরে গেল কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে। বিভূতিভূষণ জানলা খুলে দিয়েছেন। তারাশঙ্কর আঁতকে উঠে বললেন, ‘করছ কি?’
বিভূতিভূষণ বললেন, ‘আয় বস। জ্যোৎস্না হয়েছে, দেখ।’
তারাশঙ্কর বললেন, ‘সেজেগুজে কনে পছন্দ করে মানুষ অধিকাংশ সময়েই ঠকে যায় বিভূতি। হঠাৎ দেখা পাওয়া যায় যার- তাকে এমন করে দেখা যে বিড়ম্বনা, এইভাবে জ্যোৎস্না দেখে কি সঠিক লগ্নের দর্শনলাভ হয়?’
অন্যমনস্ক বিভূতিভূষণ মৃদুস্বরে বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। তা যায় না। কিন্তু কি জানিস, মানুষ ইষ্ট দেবতার ধ্যান করে, নিত্যই করে, করতে করতে গোটা জীবনটায় কটা মুহূর্তের জন্য দেবতাকে পায়! হঠাৎ আসে। তাই, বাইরে যখন আয়োজন রয়েছে- তখন বসলাম আসনে। জানলা বন্ধ করে থাকব- কিন্তু সে লগ্ন যদি আজই আসে! তবে? তুইও আয় না।’
তারাশঙ্কর বসলেন না আবার ঘুমনোর কথাও ভাবলেন না। চিনতে চাইলেন বিভূতিভূষণের অন্তরখানি। ভাবলেন, সেই লগ্ন যদি আজ সত্যি আসে তাহলে তাকে তিনি বিভূতির মধ্যে দিয়েই দেখবেন। আপন আসনে শুয়ে একদৃষ্টে তারাশঙ্কর চেয়ে রইলেন বিভূতিভূষণের দিকে।
অনেকক্ষণ পর বিভূতিভূষণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তারাশঙ্করের মনে হল, ‘সেই অমৃতের স্বাদ বিভূতি অন্তত আজ রাতে পেল না।’
(৪)
উনিশশো পঞ্চাশ সাল। বর্ষার শেষদিকের কথা। বিভূতিভূষণ এসেছেন কলকাতায়। সজনীকান্তের সঙ্গে দেখা করে যাবেন তারাশঙ্করের নতুন বাড়ি দেখতে। বছর খানেক আগেই তারাশঙ্কর টালাপার্কে বাড়ি করে উঠে এসেছেন। এই পাড়াতেই থাকেন সজনীকান্ত, শৈলজানন্দসহ বেশ কিছু স্বনামধন্য সাহিত্যিক।
বছর ছয়েক আগে সেইবার কানপুরের সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে উদ্যোক্তাদের ব্যবস্থা মতো দিন তিনেক তারাশঙ্করের সঙ্গে একই ঘরে ছিলেন বিভূতিভূষণ। গঙ্গার ধারে ছিমছাম একটি বাংলোয় চমৎকার কেটেছিল দিনগুলি। নৈশাহারের পর বাংলোর পেছনদিকের বারান্দায় দুজনে কিছুক্ষণ বসতেন। অদূরে বয়ে যেত শীতের গঙ্গা। সেই তিনদিনেই বিভূতিভূষণ তারাশঙ্করের মধ্যে একজন সহজ সরল অমায়িক সুরসিক মানুষকে আবিষ্কার করেছিলেন। এরপর দুজনের সম্পর্ক অন্তরঙ্গ হয়েছে। গড়ে উঠেছে নিবিড় বন্ধুত্ব। যা কেবল লাখে একজনের সঙ্গে হয়।
বয়সে বছর চারেকের ছোট এই বন্ধুটির জন্যে পরবর্তীদিনে বিভূতিভূষণের স্নেহ আর গর্বের অন্ত ছিল না। সেই গর্ব প্রকাশ করে তিনি লোকের কাছে বিরক্তিভাজন পর্যন্ত হয়েছিলেন। তারাশঙ্কর যেবার মোটরগাড়ি কিনেছিলেন বিভূতিভূষণ রাস্তায় পরিচিত মানুষের দেখা পেলেই আহ্লাদ করে বলতেন, ‘শুনেছ, তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে।’
শুধু যে রাস্তায় সাক্ষাৎ হলে বলেছেন এমন না, লোকের বাড়ি বয়ে গিয়েও বলে এসেছেন। একজন একবার বিরক্ত হয়ে বলেই দিয়েছিলেন, ‘তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে তো আপনার আনন্দের কী আছে?’
বিভূতিভূষণ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘একজন মানুষ শুধু লিখে একটা আস্ত মোটরগাড়ি কিনে ফেলেছে, এতে আনন্দ পাব না!’ পরক্ষণেই তাঁর সহজাত সারল্যে মিষ্টি হেসে নিচু গলায় বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, ‘আমাকে একদিন ওর গাড়িতে চাপাবেও বলেছে!’
তারাশঙ্করের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লেন বিভূতিভূষণ। অস্ফুট স্বরে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘বাঃ’।
অতিথিকে আপ্যায়ন করতে তারাশঙ্কর নেমে এসেছিলেন উঠোনে। দেখলেন বিভূতিভূষণ জগৎ সংসার ভুলে, মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছেন গেটের উপর। গেটের উপরিভাগ লাল ফুলে ভরা মর্নিংগ্লোরীর লতায় ঢেকে আছে। বিভূতিভূষণের চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তাঁর সেই রূপ দেখে তারাশঙ্করের মনে হল, ‘সেই যে কানপুর যেতে যেতে যার সন্ধানে শীতের রাতে জানলা খুলে বসেছিল, তাই যেন সে আজ দেখতে পেয়েছে এই ফুলে ভরা মর্নিংগ্লোরীর লতার মাঝে। এ বিভূতির পক্ষেই সম্ভব। সেই পারে কলকাতার ধনীগৃহে পার্টিতে উপস্থিত থেকে, সেখানকার রাজনৈতিক বা বৈষয়িক আলোচনার মাঝেও ‘কুশল পাহাড়ী’র বনে মানসভ্রমণ করতে। বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমলে ড্রয়িংরুম থেকে অনায়াসে সে চলে যেতে পারে জোনাকি জ্বলা অন্ধকার অরণ্যভূমিতে। শুনতে পায় শালগাছে ফুল ফোটার শব্দ, বর্ষাকালের ময়ূরের ডাক অথবা ঝরনার কুলকুল ধ্বনি।’
কথা বলে তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণের ধ্যানমগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটালেন না। ভেতরে ডাকলেন না। বসতে বা চা খেতে বললেন না। মাটির উপর ছড়িয়ে পড়ে থাকা মর্নিংগ্লোরীর বীজ কুড়িয়ে নিলেন মুঠো ভর্তি করে। তারপর বিভূতিভূষণের হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিয়ে যা ভাই। ছড়িয়ে দিস। বর্ষার জল পেলেই কদিনেই গাছ বেরিয়ে পড়বে। মাসখানেকের মধ্যেই ফুল হবে।’
বিভূতিভূষণের যেন ঘুম ভাঙল। উঠে এলেন তারাশঙ্করের বসার ঘরে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে যাবার সময় খুশি খুশি মুখে বললেন, ‘ফুল হলে তোকে লিখব। বারাকপুরে, ঘাটশীলায় – দু জায়গায় ছড়িয়ে দোব। দেখলেই মনে পড়বে তোকে।’
(৫)
তিন মাসও পার হয় নি। শরতের শেষে হেমন্তের আগমন হয়েছে। বাতাসে লেগেছে হিমের স্পর্শ। বেশ কিছুদিন বিভূতিভূষণ বাস করছিলেন তাঁর সাধের গৌরীকুঞ্জে। ঘাটশীলায় সুবর্ণরেখা নদীর কাছে রাংচিতার বেড়ায় ঘেরা এই নির্জন বাড়িটি তাঁর বড় প্রিয়। প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব করা যায় এখানে। শরৎকালে বুনো লতা আর ঝোপঝাড়গুলি ফুলে ফুলে ভরে থাকে। তাদের মিলিত সৌরভে বাতাস হয়ে থাকে আমোদিত। সেই সময় শহরের গোলমালে প্রাণে হাঁফ ধরে। তিনি চলে আসেন এখানে। অকস্মাৎ এমন আনন্দময় পরিবেশের উপর নেমে এল মৃত্যুর থাবা। পয়লা নভেম্বর রাত্রির প্রথম প্রহরে বিভূতিভূষণ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন।
বেতারে খবর এল কলকাতায়। একখণ্ড শোকের মেঘ ছায়া বিস্তার করল টালাপার্কের মর্নিংগ্লোরী শোভিত বাড়ির কর্তার মনে। মাস কয়েক আগে তাঁর মাতৃসমা পিসিমা দেহ রেখেছেন। নানা কারণে তাঁর চিন্তাজগৎ বিক্ষিপ্ত। নাস্তিক্য ও আস্তিক্যবাদের টানাপোড়েনে মন ক্ষতবিক্ষত। বিভূতিভূষণের এমন অকস্মাৎ প্রয়াণ তাঁকে আরও অস্থির করে তুলল। বিভূতিভূষণের স্মৃতি আর আপন সূক্ষ্ম অনুভূতি মিলেমিশে অজস্র ছবি সৃষ্টি হল তাঁর মনে। মনে হল, ‘এ তো নিছক একটা মৃত্যু নয়। এ যে ঝলমলে বৈদ্যুতিক আলোর মাঝখান থেকে বাংলা সাহিত্যের ঘৃতপ্রদীপটির চিরতরে নির্বাপণ। সাহিত্যের নাটমণ্ডপে ‘পথের-পাঁচালী’র আসর ভঙ্গ হওয়া। ‘মেঘমল্লার’ রাগিণীর সমাপ্তি। ভাঁট ফুল- বনতুলসী- কাশফুল ভরা প্রান্তরে একতারা বাজিয়ে অরণ্যভূমির বিচিত্র সঙ্গীত গেয়ে টহল দিয়ে বেড়ানো উদাসী বাউলের কন্ঠ চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়া।’
বরাবর ভোরে ওঠা অভ্যাস তারাশঙ্করের। সেই দিন রাত থাকতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেই মনে পড়ল বিভূতিভূষণের কথা। ‘বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি চির অমর’ কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেও মন মানছে না। বিছানা ছেড়ে তারাশঙ্কর উঠে গেলেন ছাদে। চেয়ে থাকলেন তারা ভরা আকাশের দিকে। হেমন্তের হিমেল হাওয়া তাঁর মনের উপর শীতলতার স্পর্শ বুলিয়ে দিতে লাগল।
বছর তিনেক আগে বিভূতিভূষণ তাঁকে জন্মদিনে আশীর্বাদ করেছিলেন ‘শতশরৎ পরমায়ু হোক।’ ‘শরৎকাল কি তাঁর প্রিয় ঋতু ছিল? মর্নিংগ্লোরীর বীজ থেকে কি গাছ হয়েছিল? ফুল ফুটেছিল তাঁর গৌরীকুঞ্জের বেড়ায়? ফুলের কথা জেনেই বা কী হবে? ফুল দেখে বিভূতির সেই আনন্দময় মুখখানি তো আর দেখতে পাওয়া যাবে না!’ এলোমেলো কিছু ভাবনা ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারাশঙ্কর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন।
অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। সারা বাড়ি ঘুমে অচেতন। তারাশঙ্কর পূজার ঘরে ঢুকে আসনে বসলেন। তাঁর ধ্যানমগ্ন চোখদুটি থেকে জলের ধারা নেমে এল। শোকের জগত থেকে তিনি ক্রমশ প্রবেশ করলেন প্রশান্তির জগতে। মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠল বিভূতিভূষণের বিদায় লগ্ন। মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে শিয়রে। নির্ভীক, প্রসন্ন, সরল চোখদুটি মেলে বিভূতিভূষণ চাইলেন। নিজের ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন। মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে, অচেনা পথের আনন্দ খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গেলেন। পথের উপর একটা একটা করে পায়ের ছাপ ফুটে উঠল। এক সময় পথের বাঁকে মিলিয়ে গেলেন।
ছবি কিন্তু শেষ হল না। আগামীর ছবি ভেসে উঠল তারাশঙ্করের মনের ক্যানভাসে। সেদিন থেকে সে কতকাল পরে ধরা যায় না। হয়ত অর্ধশতবর্ষ কিম্বা শতবর্ষ পরের ছবি। গ্রামের পথ ধরে হেঁটে বেড়ানো বাঙালি পথের ধারে ‘পথের পাঁচালী’র গীতিকারকে দেখতে পাচ্ছে। অরণ্যে ভ্রমণ করতে গিয়ে তারা খুঁজে পাচ্ছে ‘আরণ্যকে’র রূপকারকে। ‘ইছামতী’র বুকে নৌকায় ভেসে যেতে যেতে দেখছে ভগীরথের মতো শাঁখ বাজিয়ে সামনে চলেছে বিভূতিভূষণ আর সেই সব মানুষের বুক বেয়ে নামছে ইছামতীর স্রোত। জ্যোৎস্নালোকিত প্রান্তর, জোনাকি জ্বলা রাত্রি, সাঁই বাবলার গাছ যেখানেই আছে সেখানেই আগামীর বাঙালি বিভূতিভূষণের ছায়া দেখে মাথা নত করে।
প্রসন্ন মনে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে তারাশঙ্কর ঢুকলেন লেখার ঘরে। টেনে নিলেন ডেস্কখানি। কর্তব্য করতে হবে। পত্রিকায় পত্রিকায় লিখতে হবে বিভূতিভূষণের কথা।
(৬)
একুশ বছর পর। এর মাঝে সাহিত্য রচনা করে তারাশঙ্কর সাফল্য, অর্থ, স্বীকৃতি, পুরস্কার সবই অর্জন করেছেন। এসব দেখে বিভূতিভূষণ কতটা উচ্ছ্বসিত হতেন জানা নেই। তবে বাংলাসাহিত্যের পাঠক সমৃদ্ধ হয়েছে, মুগ্ধ হয়েছে। ধন্য হয়েছে রাঢ়বঙ্গের মানুষ। সেখানকার কথা তারাশঙ্কর গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন মহাকাব্যের আকারে।
চুয়াত্তরতম জন্মদিনটি আনন্দের সঙ্গে কাটানোর কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন তারাশঙ্কর। ইদানীং বড় বিষণ্ণ থাকতেন তিনি। যেন জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন ছুটি নিতে। বছর তিনেক আগে আয়নায় সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করেছিলেন নিজেকে। সেদিন লেখক তারাশঙ্কর নয়, ‘আরোগ্যনিকেতনে’র জীবনমশায়ের দৃষ্টি ছিল তাঁর চোখে। শরীরে মৃত্যুর হাতের স্পর্শছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। দূর থেকে শুনেছিলেন তার পদধ্বনি।
কদিন ভুগে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু হঠাৎ করেই রোগের প্রকোপ বেড়ে গেল। জীবন আর মৃত্যুর লড়াই শুরু হল। ডাক্তারের মতে, সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে হৃদযন্ত্রটি পঁচিশ বছরের যুবকের হৃৎপিণ্ডের মতন সবল। সেই বলেই টানা তিনদিন লড়ে গেলেন তারাশঙ্কর।
সেদিন বাংলার আঠাশে ভাদ্র। বিভূতিভূষণের জন্মদিন। আর সকলে বিভূতিভূষণকে তাঁর ইংরাজী জন্মতারিখে স্মরণ করলেও তারাশঙ্কর এই দিনটায় তাঁর ছবির সামনে মর্নিংগ্লোরী ফুল দিয়ে একান্তে শ্রদ্ধা জানান। এবারে তারাশঙ্কর চোখ খুললেন না। সকালবেলাতেই টালাপার্কে নেমে এল অকালসন্ধ্যা।
শোকের মেঘ ভাসতে ভাসতে পৌঁছল লাভপুরের আকাশে। বৃষ্টি হয়ে ঝরল সেখানকার মানুষের চোখ থেকে। এ মৃত্যু তাদের কাছে পরম আত্মীয়ের চিরবিদায়। তাঁর মতো করে এদের সুখদুঃখ কে বুঝবে! কে এইসব চাষা, ডোম, হাড়ি, বাউড়ি, কাহার, বায়েন, সাঁওতালদের মধ্যে খুঁজে পাবে ‘গণদেবতা’কে! তাদের ভেতর আবিষ্কার করবে খাঁটি ‘কবি’ সত্তা! এমন খবরে তাদের কেউ কেউ বুক চাপড়ে কাঁদল, কেউ শোকবিহ্বল হয়ে রইল।
‘ভালোবেসে মিটল না আশ, কুলোল না এই জীবনে!’ আক্ষেপ করতে করতে শোকার্ত কোনও কাব্যরসিক মানুষ হয়ত সেদিন সান্ত্বনা খুঁজতে চলে গিয়েছিল কোপাই বা ময়ূরাক্ষীর তীরে। কোনও সাহিত্যসভা আলো করে বাবুর পাশে বসার সৌভাগ্য তার হয় নি, কিন্তু নদীর নির্জন বাঁকে তাঁর সঙ্গে বসে ধূমপান করতে করতে দুটো ভাবের কথা, সুখ-দুঃখের কথার বিনিময় হয়েছে। সেদিন সে চোখ তুলে চেয়ে দেখেছিল, জন্মমৃত্যুর আলোছায়া চারিপাশে কোনও ছাপ ফেলে নি! দুনিয়ার লীলাখেলা যেমন চলে, তেমনই চলছে। শরতের মিঠে রোদ ঝলমল করছে। বাঁধের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া রেললাইনের ধারে কাশফুল দুলে দুলে উঠছে। নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ। নদীর ঘোলা জলে মেঘের ছায়া পড়ে ঢেউয়ের দোলায় ভেঙে আহ্লাদে নাচতে নাচতে দূরে সরে যাচ্ছে! নদীকূলের ওপাড়ে মাঠভরা কচি ধানগাছের উপর খেলছে বাতাসের ঢেউ। তারই মাঝে আল ভেঙে কে যেন হাঁটছে! ভঙ্গীটি বড় চেনা। মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে ঘোরা তাঁর নেশা। গাঁয়ের ধুলো কাদার প্রতিও তাঁর কত টান!
চোখের পলকে সেই পথিক কোথায় মিলিয়ে গেল! আকুল হয়ে খুঁজেও আর কিছু দেখা গেল না। কী আশ্চর্য! চোখ বুজে ভাবতেই ছবি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। মনে হল, ‘তিনি আছেন, তিনি থাকবেন এই মনের ভেতর। চোখ বুজলেই দেখতে পাওয়া যাবে।’
আবার চোখ বন্ধ করল সেই নামহীন কবি। দেখল মেঘের ভেলায় ভেসে চলেছেন বাবু। থোকা থোকা মেঘের ওপাড় থেকে একটি সরল, কচি মুখ টু-কি দিয়ে লুকিয়ে পড়ছে। খেলার মাতনে সে বাবুকে টেনে নিয়ে চলেছে এই ভুবন থেকে দূরে। বাবুও আনন্দে মেতে এগিয়ে যাচ্ছে। মুখোমুখি হতেই দুজনের মুখে আলোর ছটা। কচি মুখখানা দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবুর মুঠো খুলে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে রাঙ্গা কুসুম। তারপর দুজনেই স্থির। ফুলগুলির দিক থেকে কারও আর চোখ ফেরে না।
কৈফিয়তঃ তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের লেখা প্রবন্ধ থেকে তথ্য নিয়ে মুহূর্তগুলি কল্পনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, বিভূতিভূষণের জন্ম ও তারাশঙ্করের মৃত্যু বাংলা দিনপঞ্জী অনুসারে একই তারিখে।
তথ্যসুত্রঃ
১। বিভূতিভূষণ, প্রবন্ধ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; পূর্বাশা, অগ্রহায়ণ ১৩৫৭
২। অপরাজিত বিভূতিভূষণ, প্রবন্ধ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; যুগান্তর, কার্তিক ১৩৫৭
৩। বিভূতিভূষণ, প্রবন্ধ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; কথাসাহিত্য; অগ্রহায়ণ ১৩৫৭
৪। তারাশঙ্কর, বক্তব্য; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; শনিবারের চিঠি; শ্রাবণ ১৩৫৪
৫। আমার সাহিত্য জীবন (দ্বিতীয় খণ্ড); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
৬। ভূমিকা, তারাশঙ্কর রচনাবলী (খণ্ড-২৪); সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।