স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারীরা

১৯১৫ তে বাঘাযতীন শহীদ হবার পর বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবের ঝড় উঠেছিল। যদুনাথ মুখার্জীর নেতৃত্বে অস্ত্র জোগাড় করে বিদ্রোহ শুরু হলে সারা বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বাংলার যুব সমাজ গোপনে অস্ত্র যোগাড় করে সশস্ত্র বিপ্লবে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। হাওড়ার অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী, রামচন্দ্র মজুমদার, অতুল ঘোষ বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর পিসিমা ননীবালা দেবী ( ১৮৮৮-১৯৬৭) ষোল বছরে বিধবা হয়ে তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন। নিজে উৎসাহী হয়ে ভাইপোর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ননীবালা দেবী কখনো চন্দননগরে কখনো রিষড়াতে গৃহকর্তৃ সেজে ঘরভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন আর পুলিশের চোখে ধুলো দিতেন। কলকাতার শ্রমজীবী সমবায়এ হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়েছিল। বিপ্লবী অমরেন্দ্র পালিয়ে গেলেও, ধরা পরেছিল রামচন্দ্র মজুমদার। রামচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘মসার’ পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন জানার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা ননীবালা দেবী সধবা সেজেছিলেন। না রঙ্গমঞ্চে নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন ননীবালা। রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে শাখা সিঁদুর পরে জেলে গিয়ে জেনে এসেছিলেন পিস্তলের খবর। তাঁর মত বিধবাদের একাদশীর উপবাস ছিল জীবনসঙ্গী, চা খেলেও জাত যেত,  সিন্দুর তো দূরের কথা লালরঙ থেকে দূরে থাকত তারা। অন্যের স্ত্রী সাজার জন্য শাখা সিঁদুর পরা অত্যন্ত দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল, সমাজের চোখে ছিল বেশ্যাবৎ কর্ম। পুলিশ জানতে পারল আগেই ননীবালা দেবী তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর দাদা প্রবোধ চন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পেশোয়া চলে গেলেন। সেযুগে একজন বিধবার পরপুরুষের সঙ্গে দেশছাড়া মানে সমাজের কাছে ‘চোখেরবালি’ হওয়া। তবু সমাজকে থোড়াই কেয়ার করলেন দেশের জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তি ছিল তাঁর একমাত্র কাম্য। তিনি দেশছাড়ার পর পুলিশ তাঁর বাবা সূর্য কান্ত ব্যানার্জীকে ইলিসিয়াম রো তে নিয়ে গিয়ে সকাল দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেরা করত। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ পেশোয়া গেলো। তিনি ধরাপড়লেন যখন তখন তিনদিনের কলেরার রুগী। স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল তাঁকে হাজতে, তারপর কাশীর জেলে। জেরা করে কিছু জানতে না পেরে জিতেন ব্যানার্জী লংকা বেটে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢেলে দেবার মত অত্যাচার চালিয়েছিল। যন্ত্রনায় ছটফট করেছেন, চিৎকার করেছেন তবু কারও সন্ধান দেননি। পরে আলো বাতাসহীন শেলেও সংজ্ঞা হারিয়েছেন বারবার তবু বিপ্লবীদের কোনো সন্ধান দেননি। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা রাজবন্দী। জেলের সুপার ইন্টেন্ডেন্ট গোল্ডির কথামত দরখাস্ত লিখেছিলেন জেলারকে সারদামায়ের কাছে যেতে চেয়ে কিন্তু গোল্ডি নিজে হাতে ননীবালার সামনে সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন গোল্ডির গালে। এমনই আত্মসম্মান বোধ ছিল তাঁর। আর ছিল মমত্ববোধ, দু কড়িবালা নামে এক বিপ্লবী ঐজেলে থার্ড গ্রেডের শাস্তি পাচ্ছেন জেনে দাবি করেছিল বামুনের মেয়ের হাতের রান্না না হলে অনশন ভাঙ্গবেন না। বামুনের মেয়ে বলতে দুকড়ি বালা দেবীর কথাই বুঝিয়েছিলেন যে! দুকড়িবালা দেবীর শাস্তি লাঘব করতে তাঁকে নিজের রান্না করিয়ে ঊনিশদিন পর অনশন ভাঙ্গেন। এহেন মহিলা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সকলের কাছে অবাঞ্ছিত হলেন। বালি ছেড়ে কলকাতায়  আসতে বাধ্য হলেন। শেষ জীবনে রান্নার কাজ করে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটালেন।  শেষ জীবনে টিবি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯৬৭ এর মে মাসে শেষ ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন। এর পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

 এই বীরভূমের দুকড়ি বালা দেবী ( ১৮৮৭- ১৯৭০) যিনি জেলে গিয়ে ননীবালাদেবীর জন্য রান্না করেছিলেন তিনি ছিলেন বিপ্লবী নিবারন ঘটকের মাসিমা। নিবারন ঘটক মাঝে মাঝে বিপ্লবীদের মাসির বাড়িতে আনতেন আশ্রয়ের জন্য। বিপ্লবীদের ‘মাসিমা’ দুকড়ি বালা আশ্রয় দিতেন জ্যোতিষ ঘোষ, বিপিন গাঙ্গুলীর মত বিপ্লবীকে। সেবার গাড়োয়ানের ছদ্মবেশে বিপ্লবী হরিদাসদত্ত ৯ বাক্স কার্তুজ আর ৫০টি মসার পিস্তল চুরি করেছিলেন। চুরি করা সাতটি পিস্তল দুকড়িবালা দেবীর কাছেই রাখা ছিল। পুলিশ জানতে পেরে দুকড়িবালার বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল ১৯১৭ সালের ৮ই জানুয়ারি। হাতে নাতে ধরাও পরেছিলেন। শিশু সন্তানকে রেখে দু বছরের জন্য জেলে গিয়েছিলেন তৃ্তীয় শ্রেনীর কয়েদি হয়ে। অখাদ্য খাবার, চটের মত মোটা জামা কাপড় ছিল তাঁদের জন্য বরাদ্দ। যৌন নির্যাতন, মলদ্বারে রুল ভরে দেওয়া, চোখে পিন ফুটিয়ে দেওয়া, আঙ্গুলের নখ টেনে তুলে নেওয়ার মত অমানুষিক অত্যাচার করা হত তৃ্তীয় শ্রেণির কয়েদিদের। আর দিনে কুড়ি কিলো করে ডাল ভাঙ্গা ছিল তাঁদের জন্য বরাদ্দ। সেই অত্যাচের সহ্য করেও তিনি বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন ‘ভালো আছেন’ জানিয়ে।

কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের দুই মেয়ে কল্যাণী দাস (১৯০৭-১৯৮৩) ও বীণা দাস স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মা সরলা দাসের মত সাংগঠনীশক্তি ছিল কল্যাণীর। বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়া কালীন ‘ছাত্রীসংঘ’ গঠণ করেন। রাজনৈ্তিক দিক থেকে এই সংঘের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই সংঘের সম্পাদক ছিলেন কল্যাণী দাস। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্তর মত আন্দোলনকারীরা যোগ দেন। এখানে মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামী তৈ্রী করা হত। তাঁদের সাঁতার শিক্ষা, সাইকেল চড়া শিক্ষা, ফার্স্ট এইড এর শিক্ষা দেওয়া হত। এই ধরনের শিক্ষিত মেয়েদের লোকে ঢিল ছুঁড়ত। এই সংঘের মেয়েরা সেসব উপেক্ষা করেই এগিয়ে এসেছিল। যুগান্তর দলের কর্মী দীনেশ চন্দ্র মজুমদার লাঠিখেলা ও ছোরাখেলা শেখাতেন। পরবর্তীতে এইকাজের জন্য তাঁর ফাঁসিও হয়েছিল। তিনি আইনঅমান্য আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। কখনও বেথুন কলেজের সামনে, বড়বাজারের বিদেশী কাপড়ের দোকনের সামনে পিকেটিং করতেন। ততদিনে তিনি নারী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। পরে ১৯৩২ এ হাজরা পার্কে সভা করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিচারে তার আটমাসের জেল হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে নতুন করে উদ্যোগী হলেন। এদিকে মেদিনীপুর জেল থেকে পালিয়ে এলেন ডালহৌসি স্কোয়ার মামলার যাবজ্জীবন দীপান্তর সাজা প্রাপ্ত বিপ্লবী দীনেশ চন্দ্র মজুমদার। আন্দোলন জোরদার করতে কল্যাণী গোপনে যোগাযোগ করলেন তার সঙ্গে। যেহেতু সেই সময় আইন অমান্য আন্দোলন করে বহু বিপ্লবী জেলে বন্দি ছিলেন তাই বাইরের বিপ্লবীরা কিছুটা ছত্রহীন হয়ে পড়েছিল। সেই সময় কল্যাণী মহিলাদের সংগঠণকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিলেন। সম্পাদক না হলেও ‘মন্দিরা’ নামের পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বে ছিলেন,  এই পত্রিকাটি ছিল ছিল মহিলা রাজনৈ্তিক কর্মীদের মুখপত্র। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আবারও তিন মাসের জন্য বোম্বে জেলে যান। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় এসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুর্ভিক্ষপীরিত মানুষের সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শেষ জীবনে “জীবন অধ্যায়” নামে আত্মজীবনী লিখেছিলেন এবং সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

কমলা দাশগুপ্ত ( ১৯০৭-২০০০) জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান জেলে। ঢাকার বিদগাও গ্রামের কল্পনা বেথুন কলেজে পড়তে এসে কল্যানী দাসের ছাত্রীসংঘের সদস্য হন। প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে, যদিও ছোটবেলা থেকেই তিনি দেশপ্রেমী ছিলেন। ১৯২৮ এ কলিকাতা বিস্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা অবস্থায় গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছিলেন সবরমতি আশ্রমে থেকে দেশসেবা করবেন বলে। গান্ধীজিও লিখেছিলেন বাবামায়ের অনুমতি নিয়ে চলে আসতে। সেই সময় মায়ের অনুমতি না পাওয়ায় যাওয়া হয়নি। তাই পরে ছাত্রীসংঘে যোগ দিয়েছিলেন, লাঠিখেলা শিখলেন দীনেশ মজুমদারের কাছে। তিনি রসিকলাল দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদেবার জন্য যুগান্তর দলের সদস্য হয়েছিলেন। বাড়ি ছেড়ে হস্টেলে থাকতে শুরু করলেন। এই হস্টেলেই তিনি ট্রাঙ্ক ভর্তি করে বোমা লুকিয়ে রাখতেন, যে বোমা ব্রিটিশদের ওপর আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করা হত। হস্টেলের ভাঁড়ার ঘরেও বোমা রেখেছেন প্রয়োজনে। এই বোমা কখনও কমলা দাশগুপ্ত নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে দিতেন, কখনও হস্টেলে এসে নিয়ে যেত অন্য বিপ্লবীরা।  এর পর ডালহৌসি স্কোয়ার ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন কমলা দাশগুপ্ত। ১৯৩০ এর ২৫ এ অগস্ট দীনেশ মজুমদার, শৈলেন নিয়োগী,  অতুল সেন ও অনুজা চরণ সেন ডালহোউসি স্কোয়ারে গিয়ে কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চারলস টেগারকে মারতে চেয়েছিলেন। অভিযান ব্যর্থ হলেও ধরা পড়েন দীনেশ মজুমদার। এর পরই সন্দেহ হয় কমলা দাশগুপ্তকে কিন্তু প্রমাণের অভাবে ২০/২১ দিন পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বীণা দাস যে পিস্তল দিয়ে  গভর্নরকে গুলি করেছিলেন সেটি তাঁরই গোছানো টাকায় কেনা হয়েছিল। কিন্তু বীণা দাসের গভর্নরকে গুলি চালানোর চক্রান্তের সঙ্গে কমলা দাশগুপ্ত জড়িয়ে আছেন সন্দেহে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। প্রেসিডেন্সি ও হিজলি জেলে রাজবন্দি করে রেখা হয়েছিল তাঁকে। সেখান থেকে ছাড়া পান ১৯৩৮ এ। যুগান্তর দলের সঙ্গে তিনিও কংগ্রেসে যোগ দিলেন। মহিলাদের দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ করার জন্য “মন্দিরা” বলে একটি পত্রিকা চালাতে শুরু করলেন তাই নয় গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। পরাধীন ভারতে যদিও কাজটা খুব সহজ ছিল না। ১৯৪২ এ গান্ধীজির “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” মন্ত্রে যখন দেশ উত্তাল তখন সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে কমলা দাশগুপ্ত আবার তিন বছরের জন্য জেলে গিয়েছিলেন। ৪৬এর  নোয়াখালির দাঙ্গায় ধর্ষিত মহিলাদের বিবাহের ব্যবস্থা করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিয়েছিলেন। এবং ৮৬ জন ধর্ষিত মেয়েদের বিয়ে করতে সম্মত হয়ে চিঠি লিখেওছিলেন আমাদের দেশের যুবকরা। সেই সময় কমলা দাশগুপ্তা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্ষিত মেয়ে খুঁজেছিলেন, তিনি কয়েকজনকে পেয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগের ১৪ বছরের নীচে বয়স ছিল। আর কিছু মহিলাকে পেয়েছিলেন যারা বিবাহিত এবং তাদের স্বামীর সঙ্গে সংসার করছে। তাই শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। স্বয়ং গান্ধীজি এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি শেষজীবন পর্যন্ত দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। পরে তিনি তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে আত্মজীবনী লিখেছিলেন “রক্তের অক্ষরে”। তবে সব থেকে গুরুত্ব পূর্ণ যে কাজটি করে গেছেন তা হল “স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী” নামক বই লিখেছেন যা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নারীর অবদানের এক জ্বলন্ত দলিল।

 সশস্ত্র বিপ্লবের প্রথম দুই মহিলা সৈ্নিক শান্তি ঘোষ (১৯১৬- ১৯৮৯) ও সুনীতি চৌধুরী (১৯১৭-১৯৮৮)। শান্তি তাঁর বাবা কুমিল্লার ভিক্টরিয়া কলেজের অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ ঘোষের কাছে দেশাত্মবোধক গান শিখতেন, সরোজিনী নাইডুর সভায় গেয়ে নজর কেড়েছিলেন সবার। তখন শান্তিলতা কুমিল্লার ফৈজন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ঔ বিদ্যালয়ের আর এক ছাত্রী ছিলেন সুনীতি। ত্রিপুরা জেলার নবীনগরের উমাচরণ চৌধুরীর ঘরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। কুমিল্লার আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের লাঠিচার্জ দেখে তাঁদের কিশোরীমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। ওঁরা ঔ বয়সে স্বাধীনতা- সংগ্রামে অংশ নেবেন বলে লাঠি ও ছোড়া চালানো শিখেছিলেন, গ্রাম থেকে বারো মাইল দূরে ময়নামতি পাহাড়ে গিয়ে রিভলবার চালানো শিখেছিলেন বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য্র কাছে। মনে রাখতে হবে ১৯৩০ এ সাধারণত মেয়েরা লেখাপড়ার সঙ্গে বড়জোর গান বাজনা শিখত, পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা ছিল নিষিদ্ধ। তখন তো তাঁদের মত ১৫/১৬ বছরের অষ্টম শ্রেনীতে পড়া মেয়েদের জন্য পাত্র খোঁজা হত। সেই বয়সে সকলের চোখের আড়ালে তাঁরা দেশবন্দনা শুরু করলেন। ১৯৩১ এ কুমিল্লায় ছাত্র কনফারেন্স হলে তাঁরা ৫০/৬০ জন ছাত্রী নিয়ে ‘ছাত্রী সংঘ’ গড়ে তুলেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারকে জব্দ করতে ১৯৩১ এর ১৪ই ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে তাঁর বাংলোতে গিয়ে সামনে থেকে গুলি করে মেরেছিলেন। সুনীতির দুটোগুলি স্টিভেন্সের বুকে লেগেছিল। এটি ছিল সশস্ত্র সংগ্রামে মহিলাদের প্রথম পদক্ষেপ। বাড়ির পাহাড়াদারের কাছে ধরা পড়ে গেলে অশ্রাব্য গালাগালি আর এলোপাথা্রী মার জুটেছিল তাঁদের। ১৯৩২ এর ২৭ এ জানুয়ারি তাঁরা প্রস্তুত ছি্লেন ফাঁসির মঞ্চে যাবার জন্য, অষ্টম শ্রেনির ছাত্রীদের শাস্তি হয়েছিল যাবজ্জীবন জেল। এখানেও ওরা বিভাজন নীতি বলবৎ করেছিল, শান্তিকে দ্বিতীয় শ্রেনির আর সুনীতিকে তৃ্তীয় শ্রেনির কয়েদি করেছিল। সুনীতির দুই ভাইকে গ্রেফতার করে, বাবার পেনশন বন্ধকরে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। সুনীতিকে অপমানজনক অত্যাচারও সহ্য করতে হয়। সাতবছর পর গান্ধীজির আবেদনে অন্য কয়েদির সঙ্গে তাঁদের মুক্তি হয়েছিল। এরপরেও মনের জোড়ে সুনীতি পড়াশোনা করেন, ডাক্তার হয়ে গরিবের সেবা করেছেন। শান্তি সাহিত্যচর্চা করলেন, ‘অরণ্য-বহ্নি’ নামে জীবনকাহিনি লিখলেন। একদিন ইস্কুল ঘর থেকে বেরিয়ে কলম ফেলে এঁরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন দেশের জন্যই।

কল্যাণী দাসের ছোট বোন ছিলেন আরেক বিপ্লবী বীণা দাস (১৯১১- ১৯৮৬)। স্কুলে স্বদেশী প্রচার করার অপরাধে বাবার চাকরি বদলি হয়ে যায় কটক থেকে কৃ্ষ্ণনগরে। ১৯১১ তে সেখানেই জন্ম হয় তাঁর। ছোট থেকেই বাবা মা ও দিদির মত তিনিও পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করতেন। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশেষ নাম হয়ে উঠলেন। তখন বেথুন কলেজের ছাত্রী বীণা দাস, ১৯৩২ এর ৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার সেনেট হলে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বীণা গুলিকরেছিলেন তার মাথা লক্ষ করে। কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি, কর্নেল সুরাবর্দি বীণাকে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। স্ট্যানলি একটুর জন্য বেঁচে গেলেও ব্রিটিশ সরকারের কপালে ভাঁজ পড়েছিল বীণার সাহসী পদক্ষেপে। শত অত্যাচার সত্ত্বেও সংগঠণের কোনও খবর বার করতে পারেনি তাঁর মুখ থেকে। একদিনের বিচারে ৯ বছরের জেল হয়েছিল। নোয়াখালি দাঙ্গার পর সেখানে পীড়িত মানুষের সেবা করতে ক্যাম্প তৈ্রি করেছিলেন। পরে নিজের জীবনকাহিনি লিখেছিলেন ‘শৃ্ঙ্গ্খল- ঝংকার’এ। শেষ জীবনে তিনি বাংলার বাইরে হৃষিকেশে চলেগিয়েছিলেন। সেখানে শিক্ষকতা করে দিনপাত করতেন। কিন্তু তাঁর নিঃসঙ্গ শেষজীবন করুন মৃত্যুকে ডেকে এনেছিল।

 ব্রিটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম রেখেছিল তৎকালীন পাঁশত টাকা, তিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২)। চট্টগ্রামের প্রীতিলতা ছোটথেকেই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই চমৎকার প্রবন্ধ ও নাটক লিখতেন। আই এ পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ড থেকে ফার্স্ট হয়েছিলেন। বেথুন কলেজ থেকে ভালো রেজাল্ট করার জন্য পারিতোষিকও পেয়েছিলেন। ডিস্টিংশন সহ বি এ পাশ করেন। ছাত্রী অবস্থা থেকেই ঢাকা লীলা নাগের “দীপালি সংঘ” আর কলকাতার কল্যানী দাসের “ছাত্রী সংঘে”র সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ এ নন্দনকানন গার্ল্স স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ঐ বছরই মাস্টারদা সূর্যসেনের সঙ্গে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। অন্য এক বিপ্লবী কল্পনা দত্ত তাঁকে মাস্টারদার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে রিভলবর চালানো শিখিয়েছেন। দলের সক্রিয় সদস্য হয়ে কখনও পুরুষের পোশাকে দুর্গম পথ পেরিয়ে সূর্য সেনের সঙ্গে দেখা করেছেন, কখনও জেলে রামকৃ্ষ্ণ বিশ্বাসের বোন সেজে ঝুঁকি নিয়ে দেখা করতে গেছেন।  ১৯৩২ এর ২৪ এ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলীর ইউরোপিয়য়ান ক্লাব আক্রমণ করেছিল বোমা আর রিভলবার নিয়ে, যে ক্লাবের সামনে লেখা থাকত ‘কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। সেখানে প্রবেশ করেছিল আমার দুর্গা!! বেশ কয়েকজনকে মারতে পারলেও চারিদিক থেকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল তাঁদের, মুহূর্তের সিদ্ধান্তে পুরুষসঙ্গীদের বার করে দিয়ে সাইনাইড খেয়ে মাত্র একুশবছর বয়সে শহিদ হয়েছিলেন প্রীতিলতা। তারঁ দেহ সত্কার করতে পর্যন্ত দেয়নি ব্রিটিশ পুলিশ। ঠিক এর আগের রাতে মায়ের উদ্দেশ্যে য়াবেগভরে চিঠিতে লিখেছিলেন, আমি স্বদেশ জননীর চোখের জল মুছবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশির্বাদ করো নইলে আমার মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না। এই কাজের দায়িত্বে ছিলেন আর এক সাহসী কন্যা কল্পনা দত্ত ( ১৯১৩- ১৯৯৫) কিন্তু এক সপ্তাহ আগে পুরুষের পোশাক পরে রাতে লুকিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন বলে সে কাজে আর যাওয়া হয়নি। প্রমানের অভাবে ভ্যাগাব্যান্ড কেসে একমাস জেলে থাকার পর ছাড়া পেয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রীতিলতা ও কল্পনা একসঙ্গে থাকলে তাঁদের মিলিতশক্তি হয়ত অন্য ইতিহাস তৈ্রি করত। কল্পনা দত্ত, যিনি বোমা বাঁধতে শিখেছিলেন।, গরিলা দলে যোগ দিয়ে নারীশক্তির প্রতি বিপ্লবী অনন্ত সিং এর ভুলধারণা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। কল্পনা পুলিশের কাছে ক্রমে সন্দেহজনক হয়ে ওঠায় গৃহবন্দি হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় লুকিয়ে কাজ করতেন, কিন্তু অসুবিধা হওয়ায় বাড়ি ছেড়ে পুরুষ বিপ্লবীদের সঙ্গে বাইরে বাইরে থাকতে শুরু করেন। তখন ১৯৩০ সাল, সময়টা নারীদের এই সিদ্ধান্তের অনুকুল ছিল না। ১৯৩৩ এ ১৬ই ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা আর তারকেশ্বর দস্তিদারের পাশে দাঁড়িয়ে গহিরা গ্রামের ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে কোমড় বেঁধে লড়াই করেছিলেন কল্পনাও। মাস্টারদা আর ব্রজেন সেনকে ধরতে পেরে, ফাঁসির নামে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। পরে গহিরা গ্রামের পুর্ণ তালুকদার আর প্রসন্ন তালুকদারের বাড়ি থেকে ধরা পড়েছিলেন কল্পনা দত্ত। রাজশাহী আর হিজলীর জেলে ছ’ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন। জেল থেকে ফিরে বি এ পাশ করেন। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং  “অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ রাশিয়ান ল্যাংগুয়েজ” এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেন। “চট্টগ্রাম অভ্যুথ্থান” নামে একটি বইও লেখেন।

কোনও অস্ত্র না ধরেও যে কত বড় আত্মত্যাগ করা যায় তা বুঝেছিলেন ত্রিপুরার আশিকাঠির সুশীলা মিত্র( ১৮৯৩-১৯৪৮)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পলাতক বিপ্লবীদের নিয়মিত আশ্রয় দিতেন তিনি। তাঁর ছোট্ট কুঁড়ে ঘর যতই ছোট্ট হোক যুগান্তর দলের বিপ্লবী সত্যেন বসু, শচী বসুর জন্য জায়গার অভাব হত না। দিনের বেলায় যে বিপ্লবীরা শ্মশানে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন তাঁদের জন্য হতদরিদ্র মায়ের রান্নাঘর থেকে ঠিক পৌঁছে যেত খাবার। সুশীলা রাতে বাচ্চাদের সঙ্গেই বিপ্লবীদের শোবার ব্যবস্থা করতেন। শুধু তাই নয় দেশকে ভালোবেসে নোয়াখালির মহিলাদের উন্নতির জন্য ‘নোয়াখালি সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি’ গড়ে তুলেছিল। নিজেই সম্পাদিকার দায়িত্ব সামলেছেন। সেখানে মহিলাদের হাতের কাজ, ধাত্রীবিদ্যা শেখানো হত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে দেশের সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৩২ এর ২৬ শে জানুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার সময় বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন আড়াই মাস, তিন বছর ও পাঁচ বছরের তিনটি বাচ্চাকে।  তবু তিনি বন্ডে সইকরে মুক্তি পেতে আস্বীকার করে বলেছিলেন- “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব, চোখের জল ফেলব না”।

ভারতি পত্রিকার সম্পাদক সরলাদেবী (১৮৭২- ১৯৪৫)  মাত্র তেরো বছর বয়সে এন্ট্রান্স পাশকরে, সতেরো বছরে ইংরাজিতে অনার্স সহ বি এ পাশ করেছিলেন। ইংরাজি, বাংলা ও সংস্কৃত তিনটি বিষয়েই দক্ষতা ছিল তাঁর। তিনি দেশবাসীর মনে দেশাত্মবোধ জাগাতে চেয়েছিলেন অন্যভাবে। তিনি ভারতীতে লিখেছিলেন, “বিলিতি ঘুষি বনাম দেশী কিলো”। তাতে লিখেছিলেন - “ভারতীর পৃষ্ঠার আমন্ত্রণ করলুম, রেলে, স্টিমারে, পথে, ঘাটে, যেখানে সেখানে গোরা সৈ্নিক ও সিভিলিয়ানদের হাতে স্ত্রী, ভগ্নী, কন্যা বা নিজের অপমানে মুহ্যমান হয়ে আদালতে নালিশের আশ্রয় না নিয়ে –অপমানিত ক্ষুব্ধ মানী ব্যক্তি স্বহস্তে তখনি তখনি অপমানের প্রতিকার নিয়েছে- সেই সকল ইতিবৃত্তের ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠাতে। তাঁরা পাঠালেন ও তাঁদের ইতিবৃত্ত ‘ভারতী’তে বের হতে থাকল। পাঠক মণ্ডলীর মনে লুকানো আগুন ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে জ্বলে উঠল প্রবল বেগে”।  দেশবাসীর মনে দেশাত্ববোধ জাগানোর জন্য মারাঠিদের “শিবাজি উৎসবে”র অনুকরণে ১৯০৩ সালে “প্রতাপাদিত্য উৎসব” এর আয়োজন করেন। বাংলার তরুন প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা আনতে “বীরাষ্টমী ব্রত” র আয়োজন করলেন। শরীর চর্চায় উত্সাহ দেবার জন্য কুস্তিগীর ও পালোয়ানদের কাছে ব্যায়াম শিক্ষা ও চর্চার ব্যবস্থা করেন।  আবার স্বদেশি জিনিসের ব্যবহার প্রচলের জন্য “লক্ষ্মীর ভাণ্ডার” খুলেছিলেন। এটি ছিল মেয়েদের জন্য স্বদেশি জিনিসের দোকান। এই দোকানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বদেশি জিনিস সংগ্রহ করে আনা হত। এছাড়া যোগেশ চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে বড় বাজারে একটা লিমিটেড কম্পানি স্থাপন করেন। সেখানে স্বদেশি জিনিস বিক্রি করা হত, দোকানের নাম ছিল “স্বদেশি স্টোর্স”। মনে রাখতে হবে এই প্রচেষ্টা বঙ্গভঙ্গের বহু আগে। বাবা জানকীনাথ ঘোষাল ও মা স্বর্ণকুমারী দেবীর সন্তান ছিলেন সরলাদেবী। সেই সূত্রে ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক ছিল। “বন্দে মাতরম” গানটির প্রথম দু লাইনের সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসিয়েছিলেন। পরের সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে সরলাদেবী দিয়েছিলেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের কথা ভেবে ভারতের “স্ত্রী -মহামণ্ডল” স্হাপন করেন। এই “স্ত্রী-মহামণ্ডলের” শাখা লাহোর, অমৃতস্বর, দিল্লী, করাচী, হায়দ্রাবাদ, কানপুর, বাঁকিপু্র,‌ হাজারীবাগ, মেদিনীপুর, কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত হয়েছিল। এরপরে কলকাতায় “ভারত স্ত্রী শিক্ষা সদন” প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে কলকাতার মহিলাদের শিক্ষার আঙ্গিনায় আনতে পেরেছিলেন।

 

১৯২০ সালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এল এক পরিবর্তন, গান্ধীজির আইনমান্য ও অসহযোগ আন্দোলনে বহু ভারতীয় একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তার কারণ এই আন্দোলন ছিল অনেক সরল। এতে গোপনীয়তা ও চরম আত্মত্যাগের দরকার ছিলনা। তাই অনেকেই এগিয়ে এসেছিল গান্ধীজির ছত্রছায়ায়। তাঁর আন্দোলনের মূল কথা ছিল ব্রিটিশ সরকারকে পুরোপুরি আসহযোগিতা করা, এবং বিদেশি জিনিস বর্জন করে স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের মধ্যদিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলা। এই আন্দোলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে যে নারী সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি হলেন বাসন্তী দেবী (১৮৮০-১৯৭৪)। তিনি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তের স্ত্রী। সুভাষ চন্দ্র বসু ও বীণা দাস যাঁকে “মা” বলে ডাকতেন। বাসন্তী দেবী স্বামীর কাছে যেমন উচ্চশিক্ষা নিলেন তেমনি পেলেন রাজনীতির শিক্ষাও। শুধু দেশবন্ধুর আর সুভাষচন্দ্রের অনুপ্রেরণা দায়িনী হয়েই থাকেননি, আইন অমান্য আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯২১ এ আইন অমান্য আন্দোলনে মেয়েরা যখন খুব একটা এগিয়ে আসেনি, তখন বাসন্তীদেবী মেয়েদের নিয়ে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। মেয়েদের দিয়ে চরকার প্রচলন করেছিলেন। ১৯২১ এর ১৭ই নভেম্বের প্রিন্স অফ ওয়েলস বোম্বে আসার কথা ছিল। ঐদিনই সারা ভারতব্যাপী হরতাল ডাকা হয়েছিল। পরেরদিন ব্রিটিশ সরকার ‘স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী’কে নিসিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আর সভা সমিতি করলে তাঁদের রাজদ্রোহের অপরাধে সাজা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করার। এর পরেরদিনই ১৯ এ নভেম্বর বোম্বে গিয়ে গান্ধীজির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের এই অন্যায় আইন ভাঙ্গার পরিকল্পনা করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আর ৬ই ডিসেব্মর বৌবাজার ও কলেজ স্কোয়ারে হরতাল ঘোষণা করতে গিয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে জেলে গিয়েছিলেন। পরেরদিন খাদির কাপড় নিয়ে বড়বাজারে হরতাল ঘোষণা করতে গিয়েছিলেন বাসন্তী দেবী। সঙ্গে নিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জনের বোন ঊর্মিলা দেবী, ও নিজে হাতে তৈ্রি করা মহিলা সংগঠনের সদস্যদের। সেদিন পুলিশ বাসন্তী দেবীকে গ্রেফতার করেছিল। থানার সামনে বিক্ষভ শুরু হলে তাঁকে সেখান থেকে লালবাজার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।  সেখানেও জনতার বিক্ষভ হয়েছিল কারণ বাংলায় তখন চিত্তরঞ্জনের ও বাসন্তীদেবীর জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। হিন্দু মুসলমান সবাই মিলেছিল এই দেশবন্ধুর কাছে এসে। ভুলেছিল ভেদাভেদ। পুলিশ নিরুপায় হয়ে বন্ড লিখতে বললে তিনি তা আস্বীকার করেছিলেন। পরে তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠান হয়েছিল। কিন্তু গাঙ্গীজির পুত্র হীরালাল সহ কলকাতার যুব সমাজ দলে দলে জেলের সামনে গিয়ে বিক্ষভ দেখালে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন রাত এগারটা, বাসন্তী দেবীকে ছেড়ে দেওয়া হয় জেল থেকে একরকম প্রবল চাপে পড়েই। গভীর রাতে হেটে বাড়ি ফেরার পর চিত্তরঞ্জন জানিয়েছিলেন বাড়ি না এসে জেলে থাকলে ভালো হত, আন্দোলন জোরদার হত। আর ঠিক সেই কারণেই, যাতে আন্দোলন বেশি জোরদার না হতে পারে তাই গভীর রাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই মাঝরাতেই রাজনৈ্তিক টানাপোড়েনের শিকার হলেন বাসন্তীদেবী। তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বই তাকে সেদিন বাড়িতে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছিল আর বাংলার মেয়েদের আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।  

পাঞ্জাবের মেয়ে সুচেতা কৃপালনী (১৯০৮- ১৯৭৪) ছাব্বিশ বছর বয়সে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় থেকেই দেশের কাজে অত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৪ এ বিহারে ভূমিকম্পের সময় বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে মাসের পর মাস ত্রাণের কাজ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশায় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। নিখিল ভারত কংগ্রেসের মহিলা সাব কমিটির সম্পাদক ছিলেন। আবার কংগ্রেসের বৈদেশিক বিভাগেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৪০ এ গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগদিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিচারে তাঁর দেড় বছরের জেল হয়েছিল। জেল থেকে এসে আবার ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে খুঁজে পেতে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল, ততোদিনে তিন পুলিশের চোখে ধুলো দিতে শিখে গেছেন। প্রায় দু বছর পর তিনি ধরা পড়েছিলেন। ১৯৪৫ এ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন, “ কস্তুরবা গান্ধী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন” এর অরগানাইজিং সেক্রেটারি হন। কখনও নোয়াখালির দাঙ্গাপীড়িত নারী ও শিশুর পাশে  দাঁড়ান কখনও পাঞ্জাবের দাঙ্গার পর সেখানকার মানুষের পাশে ছুটে যান।

সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯- ১৯৪৯) বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আদি নিবাস হওয়া সত্ত্বেও হায়দ্রাবাদে জন্মগ্রহন করেন। ড অঘোর নাথ চট্টোপাধ্যায় মেয়েকে ইংল্যান্ড থেকে উচ্চিশিক্ষিত করান।  অসাধারণ বাগ্মী এই নেতৃ্র  প্রকৃ্ত নাম ছিল সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়। ড. এম জি নাইডুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি হয়ে যান সরোজিনী নাইডু। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গএর সময় সরাসরি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন দেশের সেবা করবেন বলে। সারা ভারতের প্রতিটি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সভা করে দেশবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গে সংগঠণকেও জোরালো করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কখনো বিহারে নীল চাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কখনও নারী মুক্তি ও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের জন্য প্রচারমূলক সভা করেছেন। ১৯১৭ তে মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবিতে ভারতীয় মহিলা সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন যার সভাপতি ছিলেন আনি বেসান্ত। ১৯২৮ এ আসহযোগ আন্দোলনের বার্তা নিয়ে আমেরিকা গিয়েছিলেন। আইনঅমান্য আন্দোলনে যোগদিয়ে সভা করতে গিয়ে সাত মাসের জন্য জেলে গিয়েছিলেন। পরে ছাড়া পেয়ে জাতিয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে গান্ধীজির সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। গান্ধীজির সঙ্গে ডান্ডি অভিযানে গিয়েছিলেন, লবন সাত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নিয়ে আবারও গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১০৪২ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে ২১ মাসের জন্য জেলে গিয়েছিলেন। পরে দেশ স্বাধীন হলে যুক্তপ্রদেশ বর্তমান উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপালের দায়িত্ব সামলান।

 অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে লতিকা ঘোষ (১৯০২-১৯৮৩), কবি মনোমোহন ঘোষ ও মালতী ঘোষের মেয়ে শুধু নন। শ্রী অরবিন্দু ঘোষের ভাইঝি ছিলেন। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন তাঁর বাবার মাতামহ। এমন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কলকাতার লরেটো স্কুলে্র ছাত্রী, শেষোবধি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বি লিট রিসার্চ ডিগ্রিধারী ছাত্রী লতিকা দেবী জাতীয়তা বাদী মানসিকতার জন্য বেথুন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি থেকে বঞ্ছিত হয়েছিলেন। এরপর শুরু করেন গোপনে রাজনৈতিক করমকাণ্ড। বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শে  চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে যোগ দিয়ে দুস্থ মেয়েদের জুনিয়র নার্সিং ও ধাত্রী কাজের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। ডাক্তাররা এসে ক্লাস নিতেন। আর লতিকা দেবী ইংরাজিতে রিপোর্ট লেখা শেখাতেন। কিন্তু গোপনে শেখাতেন দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার মন্ত্র, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯২৮ এর সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য ওয়েলংটন স্কোয়ারে কংগ্রেসের সভায় তাঁর নেতৃত্বে মহিলাদের উপস্থিতি ও শপথ গ্রহণ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুও বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁর কৃতি্ত্বে। পরে নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রকাশ্য সমাবেশে লতিকা দেবী মেয়েদের উপস্থিত করলেন অন্যরূপে। সুভাষ চন্দ্র বসুর পরামর্শে তাঁর নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবীকা বাহিনী নিয়ে মিলিটারি কায়দায় পুরুষের সঙ্গে মারচ করতে করতে প্রবেশ করেন। সারা কলকাতা সেবার বিস্মিত হয়েছিল নারীশক্তির বিচ্ছুরণ দেখে। শুধু তাই নয় তারা চা ও খাবারের টেবিল বা স্টল করেছিলেন। ছেলেরা ভাই ফোঁটা নিয়ে তারপর খাবারের টেবিলে যেতে পারতেন এমনই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মহিলাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে তা্ঁর অবদান অনস্বীকার্য।

আবাদি বানো বেগম-  (১৮৫০-১৯২৪) মহাত্মা গান্ধির আদর্শে অনুপ্রানীত হয়ে আবাদি বানো বেগম ওরফে বি আম্মা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। রামপুরের দুই বিপ্লবী মোহাম্মদ আলি জোহর ও শওকত আলী জোওহরের মা আবাদি বানো বেগম অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সব সময় খদ্দরের কাপড় পরে দিল্লি, আমেদাবাদ ও বাংলা জুড়ে সভা করে হিন্দু মুসলমানকে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলতেন। তাঁর আকর্ষনীয় ভাষণে আকৃ্ষ্ট হয়ে অভিজাত হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের মেয়েরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সভায় সকলকে নিজের সন্তান বলে ঘোষণা করে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের ‘আম্মা’।

গান্ধীজির নেতৃ্ত্বে আইন অমান্য আন্দোলন তখন সারা ভারতে আলোড়ন তুলেছিল। আমার আর এক দুর্গা মা। আইন অমান্য আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন হৃদয়ের টানে মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা (১৮৮০-১৯৪২), বালবিধবা গরিব চাষির মেয়ে। ১৯৪২ এর ২৯ এ সেপ্টেম্বের মেদিনীপুরের তমলুকে প্রায় আটহাজার বিপ্লবী যে শোভাযাত্রায় যোগ দেয়েছিল, তার সামনের সারিতে ছিলেন তি্যাত্তর বছরের এই বৃ্দ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা।পরিকল্পনা অনুযায়ী মেয়েদের  পিছনের সারিতে থাকার কথা, কিন্তু তিনি চলে এলেন সামনে। পুলিশের বিশাল বাহিনী তাদের বাধা দিয়েছিল। শুধু তাই নয় ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান অনিল কুমার ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পুলিশ এই শোভাযাত্রায় গুলি চালিয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা ধরে তখনও তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। এরপর তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছিল। পুলিশের গুলি মাতঙ্গিনীর হাতে লাগলেও জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা উঁচুকরে ধরে ছিলেন ততক্ষণ, যতক্ষণ না কপালে গুলি নিয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

 নেলী সেনগুপ্ত ওরফে নেলী গ্রে (১৮৮৬-১৯৭৩)এর নাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, ভারত সরকারের কাছ থেকে “পদ্মবিভূষণ” উপাধী পেয়েছিলেন। অথচ ইনি বাঙালি তো ননই ভারতীয়ও ছিলেননা। তিনি ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ শহরের বাসিন্দা উইলিয়াম গ্রে ও এডিথ হেন্রিয়েটা গ্রের সন্তান ছিলেন। ১৯০৪ এ কেম্ব্রিজে পড়ার সময় চট্টগ্রামের যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এবং ১৯০৯ এ তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। এর পরই নেলী গ্রে নেলী সেনগুপ্ত হয়ে চট্টগ্রামে আসেন এবং এই দেশকে আপন করে নিয়েছিলেন। স্বামীর মত তিনিও পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করার জন্য দেশের সেবায় অত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯২১ এ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে খদ্দরের কাপর বিক্রি করেছেন, নিজে বিদেশি হয়ে বিদেশি জিনিস কিনতে নিষেধ করেছেন। কারণ তিনি আমাদের দেশকে নিজের দেশ মনে করতেন। স্বামী যতীন্দ্রনাথ বারবার জেলে গিয়েছেন, আর অতিরক্ত শ্রম করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তখন তিনি রাজনৈ্তিক কাজের বেশিরভাগ দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলেনিয়েছেন। ১৯৩০ এ দিল্লী অমৃতস্বরে গিয়ে সভা করেছেন। যেহেতু সভা করা নিষিদ্ধ ছিল তাই দিল্লীর সভা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বিচারে তাঁর চার মাসের জেলও হয়েছিল। কিন্তু তিনি থেমে যাননি, জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩৩ এ কলকাতা অধিবেশনের নির্বাচিত সভানেত্রী একটি সভা করতে গিয়ে আবারও গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন এই বিদেশিনী। স্বাধীনতার সময় দেশভাগের চরম বিরোধীতাও করেছিলেন এবং দেশভাগের পর তিনি চট্টগ্রামেই থেকে গিয়েছিলেন।   

যশোরের দৌলতউন্নেষা (১৯১৮/২২-১৯৯৭) ১২ বছর বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন এই মেধাবী ছাত্রী। বঙ্গশ্রী, দেশ, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতেন। শুধু তাই নয়, তিনি ঢাকার ইডেন হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েদের শিক্ষার আলোতে আনা নিষেধ ছিল। কিন্তু দৌলতউন্নিসার বাবা মা এবং স্বামী তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১২ বছর গাইগান্ধা শ্মশুরবাড়ি চলে এসে বাড়িতে বসেই পড়াশোনা করেছিলেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্যে তাঁর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ছিল “পরশপাথর”(১৯৫৭)। এই দৌলতউন্নেসা ১৯৩২ এ আইন অমান্য আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে। ‘গাইবান্ধা মহিলা সমিতি’র সম্পাদক হয়েছিলেন কম বয়সেই। তাঁর জ্বালামুখী বক্তৃতার টানে সাত আটটা গ্রামের মেয়েরা, মুসলমান মেয়েরাও পর্দা সরিয়ে ছুটে আসত তাঁর সভায় যোগ দিতে। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে পুলিশ তাঁদের বসতবাড়ি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, পরিবারকে গাইবান্ধা থেকে বহিস্কার করে একপ্রকার রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছিল তাঁদের। তবু আন্দোলন থামেনি। আন্দোলন জোরদার করতে সভার পর সভা করেছিলেন। ফুলছড়ি গ্রামের একটি সভা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তাঁকে। শাস্তি ছিল এমনই যে রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি, বহরমপুর জেলে পাল্টে পাল্টে রাখা হয়েছিল। তবু মনের মধ্যে আগুন পুষে রেখেছিলেন, মুক্তি পাওয়ার পরও গোপনে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।

 ঢাকার বিক্রমপুরের ফুলবাহার বিবি (১৯১৬- ?) ছোটবেলায় বাবা মা হারিয়ে বড় হয়েছিলেন বড়ভাই তমিজুদ্দীনের কাছে। তমিজুদ্দীন জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং আইনমান্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ১৯২৯ এ গ্রেফতার হয়েছিলেন, কিছুদিন কারবাসও করেছিলেন। বড় ভায়ের কাছথেকেই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের দীক্ষানিয়েছিলেন। তার পরেই শুরু হয়েছিল তাঁর অভিযান। পাইকপাড়ার কিরণ রূদ্রের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে গ্রেফতার হলে ছ মাসের জেল হয়েছিল তাঁর। তাঁকেও ঢাকা ও বহরমপুর জেলে ঘোরানো হয়েছিল।  জেল থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসের গঠণমূলক কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

কৃষ্ণনগরের নির্মলনলিনী দেবী (  ১৯৩০ এ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের টাকায় জীবন ধারন করবে না বলে সরকারি কলেজের আধ্যাপক- স্বামীর বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে থাকত। সেই যুগে একজন মহিলার পক্ষে এই রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন ছিল। নদিয়া জেলার মহিলা সত্যাগ্রহী নির্মলনলিনী  ঘর ভাড়া করে মহিলাদের নিয়ে সংগঠন তৈ্রি করেছিল। ১৯৩১ এ আইন অমান্য আন্দোলন করার সময় পুলিশ গ্রেফতার করলে তাঁর সশ্রম কারাদন্ড হয়। বারবার পরিবর্তন করে কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, আলিপুর, হিজলীসেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়েছিল তাকে। শেষপর্যন্ত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

চামেলী গুপ্ত কলকাতার নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি বড়বাজারে শোভাযাত্রা, পিকেটিং করতেন পুরুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে। বড় বাজারের বিলিতি বস্ত্রের ব্যবসায়ীরা রীতিমত ভয় পেত এই উত্তর প্রদেশের কন্যাকে দেখে। তিনি গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকার থেকে বন্ড লিখতে বললেও তিনি রাজী হয়নি, তাই ছাড়াও পায়নি। জেলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন চামেলী। জেলের মধ্যে একটি পুত্র সন্তানও জন্মেছিল তাঁর। কিন্তু ধীরে ধীরে শরীর আরও খারাপ হলে যখন সরকার বিনা শর্তে যখন মুক্তি দিয়েছিল তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল, কয়েকদিন পরে চামেলী ও তার শিশুপুত্র দুজনেই মারা যায়। দেশের জন্য এই আত্মত্যাগের কথা না স্মৃতিতে, না খাতাতে কোথাও লেখা রইলনা!

 মেদিনীপুরের কুসুম বাগদী দশমাসের দুধের শিশুকে বাড়িতে রেখে জেলে এসেছিলেন আইন অমান্য করে। বাড়িতে ছেলে আর জেলে মা, দুজনেই কেঁদেছে দুই জায়গায়। তবু বন্ড লিখে ছেলেকে কাছে পেতে চাননি কুসুম। বন্ড লেখা আন্দোলনের জন্য ছিল অপমানজনক। তিনি কলুসিত করতে চাননি সে লড়াইকে।  জেলের দরজা থেকে দুধের শিশুকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। শিশুপুত্রকে ছেড়ে থাকার, মায়েরদুধ না খওয়াতে পারার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন কোনও শর্তের কাছে মাথা নোয়াবেনা বলেই।

সাহিত্যিক বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১০৩২) মুসলিম নারী মুক্তি আন্দোলন অনেকটা সাহায্য করেছিল মুসলিম মেয়েদের সমাজের কঠিণ পরদা ঠেলে বেরিয়ে আসতে। তিনি একাধিক বই লেখেন এবং সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নামে একটি মেয়েদের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিলেও মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার আলো দেখাতে সারা জীবন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, বলাবাহূল্য সফলও হয়েছেন। তাঁর “অবরোধবাসিনী” বইটিতে বাংলা ও বিহারের মেয়েদের করুন জীবনের কাহিনী তুলে ধরেছিলেন যা সমাজের জ্ঞান চক্ষু খুলে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেই দিক থেকে তিনি ছিলেন বিপ্লবী।

 সৌদামিনী পাহাড়ী, মেদিনীপুরের মেয়ে, আইন অমান্য আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ এর ১১ ডিসেম্বর এ বাগবাজারে সভা করতে যাবার সময় পুলিশ লাঠি চালায় তাঁদের ওপর। সৌদামিনীকে রাস্তা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাবার সময় পুলিশের সামনেই চীৎকার করতে করতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন- ‘প্রতিটি জিনিস কিনবার সময় দেশবাশী চিন্তা করে দেখবেন সেটি ভারতে তৈরি কিনা’।

 শুধু তাই নয়, তাঁর বিচারের সময় তিনি বিচারককে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন –

“আইন ভাঙ্গলে আপনারা যাকে খুশি গ্রেফতার করতে পারেন কিন্তু মহিলাদের প্রতি পুলিশ খারাপ কথা বলতে পারে কোন আইনে? জনতার ওপর লাঠি চালানো হয় কোন আইনে?”

তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর বিচারকের কাছে ছিলনা তাই দিতে পারেননি, তাই ছ মাস জেল দিয়েছিলেন।

ময়মনসিংহের  রাজিয়া খাতুন ও হালিমা খাতুন ছোটবেলা থেকে দেশের কাজ করতে উত্সাহী ছিলেন। ১৯৩০-৩২ নাগাদ  ময়মনসিংহের যুগান্তর দলে যোগ দিয়েছিলেন। পরে যুগান্তর দলের সঙ্গে তারাও জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪২ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। পর্দার পিছনে থাকা মুসলমান সমাজের মহিলাদের মাঝে এই স্বদেশ চেতনাময় মহিলারা ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 কুমুদিনী ডাকুয়া ছিল সুতাহাটার মেয়ে। বাঘাযতীন, কল্পনা দত্তের মতই কঠিণ শরীরচর্চা করে শরীর ও মনকে শক্ত করে তুলেছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদেবার পর যেকোনও বিপদজনক কাজের জন্য তিনি তৈ্রি থাকতেন। ‘সুতাহাটা থানা জাতীয় সরকার’ বাহিনীরও প্রধান ছিলেন। তিনি মহিলাদের শেখাতেন ‘হায়না’ পুলিশের সঙ্গে মোকাবিলা করার কৌশল। ১৯৪২ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর সুতাহাটা থানা ‘দখল’ করতে এলে পুলিশের নজরে পড়েছিল। পরে আত্মগোপন করেছিল পুলিশের নজর এড়াতে। নভেম্বর মাসে সুতাহাটা ক্ষুদীরামবাবুর মাকে দেখতে এলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। কিন্তু রাতে কিছুতেই পুলিশের সঙ্গে বাড়ির বাইরে যেতে রাজি হয়নি। এমন কি হাবিলদার জোর করলে তাকে ধারাল অস্ত্র দেখিয়ে থামিয়েছিলেন। বিচারে তাঁর এক বছর তিন মাসের জেল হলে জেলে অত্যাচারে এই সুঠামদেহী কন্যারও শরীর ভেঙ্গে গিয়েছিল।

১৯৪২ এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মেদিনীপুরের শশীবালা দাসী কেশপুর থানা দখল করার জন্য শোভাযাত্রা করতে ছুটে গিয়েছিলেন। আর সেখানেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনি। সেদিন দেশের জন্য শহিদ হয়েছিলেন কেশপুর থানার তোরিয়া গ্রামের এক অখ্যাত কন্যা, যাঁর নাম উপেক্ষিত থেকে গেছে ইতিহাসে আজও।

 বেলা মিত্র (১৯২০-১৯৫২) প্রথমে শ্বশুর বাড়ি থেকে, পরে কলকাতার বেহালার কাছে জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি ভাড়া নিয়ে গোপন রেডিও স্টেশন খুলেছিলেন। গোপনে বিদেশে সুভাষ চন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। তখন সুভাষ চন্দ্র ছিলেন বিদেশে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর গুপ্ত বিভাগের বিপ্লবীরা এখানে আশ্রয় নিতেন। ১৯৪৭ সালে বাংলায় ঝাঁসির রাণী বাহিনী গড়েছিলেন নেতাজীর ঝাঁসির রাণী বাহিণীর আদলে। ১৯৪৫ এ ১১ই সেপ্টেম্বর আজাদ হিন্দ ফৌজের কয়েকজনের ফাঁসির দিন ধার্য হলে বেলা মিত্রের তত্পরতায় বাইশ জনের মৃত্যুদন্ড রদ করা সম্ভব হয়েছিল। পরে দেশভাগ হয়ে স্বাধীনতা এলে ওপার থেকে যারা এপারে এলো তাদের একটা অংশ শিয়ালদা স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি তাদের জন্য রিফিউজি রিলিফ ক্যাম্পএ সেবা করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে অসুস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালে ৩১ শে জুলাই অকাল মৃত্যুবরণ করেন।

জ্যোৎস্না দাস বা মান্তু দাস ছিলেন ‘ওয়ার্ধা মহিলা আশ্রমে’র শিক্ষার্থী। ১৯৪১এ একটি মদের দোকানে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ন’ মাস ধরে বিভিন্ন জেলে রাখা হয়েছিল তাঁকে, প্রথমে ওয়ার্ধা জেল, তারপর নাগপুর জেল, পরে জব্বলপুর জেলে ঘোরান হয়েছিল। ছাড়া পেয়ে মেদিনীপুরে সুশীল কুমার ধারার ‘গরম দল’ এ যোগ দিয়েছিলেন। মহিলাদের নিয়ে ‘বাঘিনী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন। বিশেষ করে ধর্ষককে চরম শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেবার জন্য এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। নিজে হাতে সাজা দেন অনেককে। ১৯৪৪এ গান্ধীজির কথায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অবসান হলে তিনি আবার ওয়া্র্ধা ফিরে গিয়েছিলেন।

সত্যবতী, মেদিনীপুরের এই বিধবার আসহায়তার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষীরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁকে দেহপসারিনী করে তুলেছিল। এই অবাঞ্ছিত জীবনকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও ভারত মাতার শিকল পরা হাত দুটি তাঁকে ভাবিয়েছিল। শরীর আর মনে ছিল তাঁর বিস্তর ফারাক। তাঁর কাছে যৌনক্ষুধা মেটাতে আসা পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে গোপন খবর জেনে নিয়ে বিপ্লবীদের জানিয়ে দিতেন সত্যবতী। পুলিশের পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যেত বিপ্লবীরা। কিন্তু  এ কাজেও শান্তি পাননি। পরে আইনঅমান্য আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিলেন। নন্দীগ্রাম ও আসাদতলায় প্রথম লবণ আইন অমান্য করেছিলেন সত্যবতী। ১৯৩২ এ ১১ই ফেব্রুয়ারি তেরপেখিয়া বাজারে মদের দোকানের সামনে পিকেটিং করার সময় পুলিশের লাঠির ঘায়ে জ্ঞান হারালে তাঁকে ঐ জেলহেফাজতে পাঠান হয়েছিল। জেল থেকে তিন মাস পর এসে আবার প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯ শে আগস্ট নন্দীগ্রামে রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে গিয়ে আবারও গ্রেফতার হয়েছিলেন। ততদিনে পুলিশ জানতে পেরেছিল যে তিনি পুলিশের গোপন খবর বিপ্লবীদের জানিয়ে দেয়। পুলিশের লাঠির ঘায়ে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কিডনি আর অন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। হাসপাতালেও চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। দেশের দক্ষযজ্ঞে ‘সতী’ হয়ে প্রাণ গেল এই সত্যবতী দেবীর।  অথচ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁর নাম পর্যন্ত রইল না।

দিনাজপুরের যশোদা ছিলেন ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র সদস্য। জোতদারদের শোষন থেকে মুক্তি পেতে দরিদ্র দিনাজপুরের চাষিরাও ‘কৃষক সভা’ তৈরি করেছিল। ততদিনে তারা ভাবতে শিখেছিল-

“খেতের ফসল তিনভাগ হবে, দুই ভাগ গৃহমুষিকের

উনুনের চারপাশে বসে হাত গরম করেছি,

দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও

আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব।“

 একজোট হয়ে জোর গলায় বলতে শিখেছিল ‘জান দেব তবু ধান দেবনা’। ১৯৪৭ এর ২০ ফেব্রুয়ারি, চাষিদের খাঁ পুরের সভা শুরু হবার আগেই গ্রামে ঢুকে চাষিদের গ্রেফতার করতে চেয়েছিল পুলিশ। মহিলারা পুলিশের মুখোমুখি হয়েছিল। ততক্ষণে বিদ্রোহী চাষিরা পালাতে পেরেছেন। যশোদার স্বামী নীলকন্ঠও ছিলেন পলাতক। সেদিন যশোদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুলিশ। তাঁকে বিবস্ত্র করে, ধারাল অস্ত্র দিয়ে খোঁচানো হয়েছিল তার নগ্ন শরীর, তবু যশোদা মুখ খোলেননি। দুই সন্তানের মা যশোদার ক্ষতবিক্ষত শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল, যন্ত্রণায় চিত্কার করছিল তবু তাঁর উপর অত্যাচার বন্ধহয়নি। পলাতক বিপ্লবীচাষিদের খবর না পেয়ে আরো হিংস্র হয়েগিয়েছিল পুলিশ। শেষে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল যশোদাকে। সাঁওতাল চাষিরা ছুটে এসেছিল পাশের গ্রাম থেকে, পুলিশের সঙ্গে জোর লড়াই হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে কৌশল্যা কামারণি নামে তাদের একজন মহিলাও শহিদ হয়েছিলেন সেই লড়াইএ।

তেভাগার শহীদ রাসমণি (মৃত্যু ১৯৪৬ ৩১ শে জানুয়ারি) কিন্তু রাণী রাসমণি নন। তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্রের যেমন অবদান রয়েছে তেমনি এই রাসমণি দেবীরও অবদান রয়েছে। ময়মন সিংহ এর বাগমারীর এক টঙ্ক চাষীর ঘরে জন্ম তাঁর। বারো বছর বয়সে টংক চাষীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরেই বিধবা হলে ‘স্বামীখেয়েছে’ বলে ‘ডাইনী’ নাম হয়েছিল তাঁর। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল সংগ্রামের জীবন। বাঁচতে হয়েছে অন্যের সাহায্য ছাড়া। একাকী জীবনে নিজে হাতে ধান বুনে, ধানকেটে, চাল তৈ্রি করে, হাটে বেচে দিনপাত করতেন। গরম কালে কাঠ কুড়িয়ে, বিক্রি করে, শীত কালের খাবার জোগার করে রাখতেন। হাতে তাঁত বুনতেন, ধাত্রী মায়ের কাজ করতেন দক্ষহাতে। লাতাপাতার গুনাগুন জেনে অসুখ সারাতেন গ্রামবাসীর। নিজে হাতে তাঁতবুনে কাপড় দিতেন গরিব হাজংমেয়েদের। ধীরে ধীরে হাজঙ্গ, ডালু, গারোদের প্রিয় হয়ে উঠলেন রাসমণি। হতদরিদ্র ঠিকা চাষীরা তখন জমিদারদের অত্যাচারে নিপীড়িত। অর্থ আর পরিশ্রম দিয়ে ফলানো ফসল বেশির ভাগ তুলে দিতে হত জমিদার বা জোতদারকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসীবাদ বিরোধী লড়াই শুরু হলে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ তৈ্রি হয়েছিল শ্রমজীবী মেয়েদের নিয়ে। গ্রামবাসীদের জন্য নৈশবিদ্যালয় গড়ে নিজেও ছাত্রী হয়েছিলেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় লঙ্গরখানা খুলে তিনটি গ্রামের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছিলেন। হাজং চাষিদের নিয়ে একটি ‘স্কোয়াড’ তৈ্রি করা সাধারণ ব্যাপার ছিলনা। নিজেরা চা্ল আর টাকা জোগার তো করতেনই পাশাপাশি মজুতদারের গোপন গুদাম বাজেয়াপ্ত করতেন। হাজং চাষীরা বিরাট এক বাহিনী গঠন করেছিলেন। ১৯৪৬ এর ৩১ শে জানুয়ারি, ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাস্টিনের পরিচালনায় বহেরাতলি গ্রাম আক্রমন করেছিল ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল’ বাহিনী। গুলি, হত্যা, লুঠ, ধর্ষন চালিয়েছিল গ্রামের মধ্যে। পুরুষশূন্য গ্রামে মহিলারা ধর্ষিত হয়েছিল। সরস্বতীর অর্তনাদ কানে গিয়েছিল রাসমণির। তিনি আর পঁয়ত্রিশ জন চাষি তীর -ধনুক, কাটারি, বর্শা আর কুড়ুল হাতে ছুটে এসে বর্বর পুলিশের সঙ্গে সোমেশ্বরী নদীর ধারে লড়াই করেছিলেন। রাসমণি তখন রণমূর্তিতে ভয়ংকরী। কাটারি দিয়ে সরস্বতীর ধর্ষণকারীর মুণ্ডুটা ধড় থেকে কেটে নামিয়ে দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকার অধিকার, নারীর সম্মান রক্ষার অধিকারের লড়াইএ সোমেশ্বরী নদীর জল সেদিন লাল হয়েছিল। দশটা গুলির ধাক্কায় রাসমণির শরীর যে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে মহিলারাও কখনও অন্তরালে থেকে কখনও প্রকাশ্যে এসে লড়াই করেছেন। অষ্টাদশ- উনবিংশ শতাব্দীতে ভারত তথা বংলার সমাজে নারী ছিল পিঞ্জরাবদ্ধ। নিষেধের লোহার খাঁচার পড়ে থাকত তারা। বালিকা বধুরা পরগাছার মত সংসারে ঝুলত আর বিধবারা জঞ্জালের মত কোনায় কোনায় জমত। তখন সামাজিক অবস্থা এমন ছিল যে, ন’ বছরে বিয়ে হয়ে এগারো বছরে বিধবা হলেও তাদের জন্য থাকত তুলসীর মালা, মোড়ানো মাথা, একাদশীর উপবাস, সাদা থানের নির্দেশ। ক্রমে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের মত বিদ্বজনের অবদানে মেয়েদের শিক্ষার আঙ্গিনায় আনা হলেও তা সহজে মেনে নেয়নি সমাজ। মেয়েরা বাইরে যাবার অনুমতি সহজে পেতোনা। সেই সময় মেয়েরা সাইকেল চালালে, সাঁতার শিখলে তাদের উদ্দেশে ঢিল ছোঁড়া হত। কোনো কারনে বাইরে যাবার দরকার হলে যথাসম্ভব মুখঢেকে নিয়ে যাওয়া হত। বড়লোকের মেয়ে বৌদেরও পাল্কিতে করে নিয়ে যাওয়া হত। এমনকি গঙ্গাস্নান করানোর দরকার হলে পালকি সমেত জলে ডুবিয়ে আনা হত তবু বাইরে বেরতে দেওয়া হতনা। এমত অবস্থায় মেয়েদের বাইরে বেরিয়ে লাঠিখেলা, পিস্তল চালানো, রাত্রে ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেরানো, পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, জেলে যাওয়া ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ। তবু তৎকালীন সমজে কোনঠাসা হয়ে থাকা মেয়েরাও  নিজ নিজ জায়গায় থেকে দেশের সেবা করেছেন তা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতই দুরুহ কাজ। তাঁদের মধ্যে দু একজন রাজ পরিবারের হলেও বেশির ভাগই ছিল সাধারণ ঘরের অতি সাধারণ মেয়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে মুন্ডা বিদ্রোহ, আইন অমান্য আন্দোলন থেকে ঝাঁসির রানী বাহিনী হয়ে তেভাগা আন্দোলন, সবেতেই নারীর দৃষ্টান্ত মূলক অবদান রয়েছে। কেউ নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ প্রাণ দিয়েছেন, কেউ গোপনে সহযোগিতা করেছেন।

১৮৫৭ এর সিপাহী বিদ্রোহের সময় সংগ্রামীনারী হিসাবে আমরা সবার আগে ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈকেই স্মরণ করি। সেই সময় আরো কয়েকজন নারী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যেমন অওধের নবাব ওয়াজিদ আলির স্ত্রী বেগম হজরত মহল (১৮২০- ১৮৭৯) ওরফে মুহাম্মদি খানম। তার “হজরত বাহিনী” সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আবার এই ‘হযরত মহল’ বাহিনীর এক সিপাহী শহিদ মক্কা পাসির পত্নী উদাদেবী (?-১৮৫৭)। যিনি ‘কলিন ক্যাম্পবেল’ এর বাহিনীকে গাছের উপর থেকে একের পর এক গুলি করে ব্রিটিশদের হত্যা করে গাছেই শহিদ হয়েছিলেন। এরও পঁচাত্তর বছর আগে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গার মহারাণী ভেলুনাছিয়ার( ১৭৩০-১৭৯৬) ও তাঁর প্রধান সেনাপতি দেশের জন্য আত্মঘাতী কুইলির (?-১৭৮০) অবদানও ভোলার নয়। এই রাজপরিবার ও তাঁদের সঙ্গে যুক্ত থাকা মহিলা ছাড়াও অতিসাধারণ পরিবারের মেয়েরাও স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। যেমন নিয়েছিল তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তরগত ডগনাডিহির সাঁওতালদের ঘরের মেয়েরা। ১৭৯৩ এ বাংলা বিহার উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে নতুন জমিদারদের চড়া খাজনা, মহাজনদের মোটা সুদের চাপে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল ওরা, নিরাপদ জায়গার খোঁজে রাজমহলের কাছে পাহাড়ি জায়গায় চলে গিয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ও জমিদার- জোতদাররা মিলে সেখানেও তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে, নিরুপায় হয়ে ১৮৫৫ নাগাদ ওরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূরণ এই কারণে যে ওরা সেই বিদ্রোহের মধ্যদিয়েই কম্পানিকে দেশছাড়া করে স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিল আর নিজেদের সুবা রাজত্বের কথা ঘোষণা করেছিল। এই বিদ্রোহে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈ্রব, ডোমন মাঝি, বীরসিং মাঝির পাশে দাঁড়ানো মেয়েদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই ফুলো আর ঝানো। দুই বোন ফুলো আর ঝানো ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের সামনের সারিতে থাকা মেয়ে। তীর-ধনু্ক‌, টাংগি, বর্শা, কুড়ুল সবই চালাতে পারতেন ওঁরা। ফুলো, ঝানোর সঙ্গে সাঁওতাল মেয়েরা রাতে শত্রুশিবিরে ঢুকে কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছিল ২১ জন অত্যাচারীকে। এই ঘটনা তাদের তৎকালীন সংগঠণকে উজ্জীবিত করতে সাহায্য করেছিল। পরে এর প্রতিশোধ নিতে ব্রিটিশরা ফুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে হত্যা করেছিল। কেউ যাতে আর বিদ্রোহ করার সাহস না পায় তাই বাকিদের দেখানোর জন্য ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল ফুলোর বিভৎস লাশটা রেল লাইনের ধারে। আমাদের সাঁওতাল জাতির কাছে ফুলো, ঝানো চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে। কিন্তু বহির্জগৎএ লড়াইয়ের কথা এখনও জানেনা অনেকেই, সার্বিকভাবে জানানোর কোনও দায়িত্ব নেয়নি কেউ। সাঁওতাল বিদ্রোহ বা মুন্ডা বিদ্রোহে একে একে উঠে এসেছে আরও অনেক নারীর নাম। বাসবী কিরোর ‘উলগুলান কি ওউরতেঁ’ বই অনুযায়ী মুণ্ডা বিদ্রোহের মাকি, টিগি, নাগী, লেম্বু, সালি, চাম্পি- পুরুষের সঙ্গে সমানে তীর -কাঁড় চালিয়েছিলেন। আরও কত নাম হয়ত তলিয়ে গেছে অবহেলার স্রোতে!

যত নাম এখানে লিখতে পারলাম তার চেয়ে অনেক বেশি নাম না লেখার খাতায় রইল।

তথ্যসূত্র-

১) স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী - অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯ - র‍্যাডিকাল প্রকাশনা

২) মুক্তি সংগ্রামে বাংলার উপেক্ষিতা নারী - অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ১০ - র‍্যাডিকাল প্রকাশনা

৩) স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া।