স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম নারীদের অবদান

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, লিখেছিলুম স্বাধীনতার লড়াই-এ দলিত ও আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণের কথা। স্বল্প পরিসরে সূত্রটুকু ধরিয়ে দেওয়ার কাজটুকুই করেছিলুম। আগ্রহী পাঠক আশা করি খুঁজে নেবেন আরও অনেককে বিস্মৃতির অতল থেকে। ইতোমধ্যে যেমন মেসেজ পেয়েছি, মেইল পেয়েছি, 'মেদিনীপুরের চূয়াড় নারীদের কথা কথা লিখবেন কখনও ? ' বা 'স্বাধীনতা সংগ্রামে পতিতা-বারাঙ্গনাদের ভূমিকা নিয়ে লিখবেন?' পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুগ্ধতার চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত এই সব সংলাপ। এতে সমৃদ্ধ হই, উৎসাহিত হই। এই সংখ্যার প্রতিশ্রুতি মতো স্মরণ করব মুসলিম সংগ্রামী কন্যাদের। কথাচ্ছলে হয়ত এসে পড়বেন তথাকথিত কোঠেওয়ালিরাও।

যেমন ধরুন, বেগম হজরত মহল৷ গল্পটা এক রানির প্রতিরোধের, সেদিক থেকে লক্ষ্মীবাইয়ের গল্পের ছায়া খুঁজে পাবেন অনেকে। যদিও হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রে হজরত মহল ইতিহাসে বন্দিত হলেন না লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো। কিন্তু গল্পের আগে আরও গল্প ছিল যে! 

১৮২০ সালে আওয়াধের ফৈজাবাদের গরীব পরিবারে যে মেয়ে জন্মেছিল, তার নাম ছিল মুহাম্মদী খানম। সে নাবালিকা অবস্থাতেই হারেমে বিক্রি হয়ে গেছিল। বাপ তার দাস, মা নিজেও গণিকা। খাজসিন (পরিচারিকা) হিসেবে হারেমে বিক্রিত হওয়ার পর, সেই বালিকা শীঘ্রই শেষ 'তাজদার-ই-আওয়াধ' ওয়াজিদ আলি শাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

পরিচারিকা হলেন 'পরী' পদে উন্নীত। 'পরী' বলতে বোঝাত সুন্দরী নারীদের একটি দল, যারা নাচে গানে, শিল্পদক্ষতায় নবাবের দিল খুশ রাখবে। 

'পরী' থেকে মুহাম্মদী হলেন 'মহেক পরী'। মানে আরেক ধাপ প্রোমোশন, কিন্তু সে তথাকথিত পতিতার প্রোমোশন। হয়ে উঠলেন নবাবের প্রিয় উপপত্নীদের একজন। নবাবই তাঁর নাম রাখেন ইফতারকার-উন-নিসা। এরপর বড়সড় শিকে ছিঁড়ল। উপপত্নী হলেন ওয়াজিদ আলি শাহের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁরই পুত্র পরে অওয়াধের যুবরাজ ঘোষিত হবেন, নাম যার বিরজিস কদর। পুত্রগর্ভা হয়ে নাম হল তাঁর বেগম হজরত মহল (রাজকীয় যে রানি)। কিন্তু তাঁকেও নবাব তার অন্যান্য উপপত্নীর মতো তালাক দিয়েছিলেন পরে।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৫৬ সালে লর্ড ডালহৌসির প্রবর্তিত স্বত্ত্ববিলোপ নীতির মাধ্যমে অওয়াধ দখল করল, কারণ আওয়াধ তুলা আর নীলের চাষে অগ্রণী। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে নির্বাসিত করা হল। ১৮৫৬ সালে পরিবারের একটি অংশের সাথে কলকাতায় (মেটিয়াব্রুজ) এসে ভিড়লেন তিনি। এক ক্ষয়িষ্ণু রাজার শেষ জীবনের দিনলিপি লেখা হতে লাগল কলকাতারই উপকণ্ঠে। কিন্তু আওয়াধে তখন কী ঘটছিল? বেগম হজরত মহল তখন আওয়াধ তথা তাঁর বারো বছরের ছেলের দায়িত্ব নিয়েছেন একা। বিরজিস কদরকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুকুট পরিয়ে দশ মাস শাসন চালাতে পেরেছিলেন হজরত মহল রাজমাতা ও রাজ-অভিভাবক হিসেবে। অংশ নিয়েছিলেন ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে। এমনকি রানি ভিক্টোরিয়া যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বণিকসংস্থা শাসিত অঞ্চলকে রাজাধিকারের আওতায় আনলেন, তখনও হজরত মহল এক পাল্টা ঘোষণা করেছিলেন। ব্রিটেনে রানির শর্ত মেনে চলতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ইংরেজদের রাজস্বদানে অনাগ্রহী জমিদার ও কৃষকরা সামরিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সব জাতি ও ধর্মের মানুষ এই তওয়ায়েফ রানির উপর আস্থা ন্যস্ত করেছিল। নানাসাহেব স্বয়ং ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। হাতির পিঠে সওয়ার বেগমের যুদ্ধের গল্প আজও ফেরে মানুষের মুখে মুখে। তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামীদের দলে আরও ছিলেন সরফাদ-দৌলা, মহারাজ বাল কৃষ্ণ, রাজা জয় লাল,  মাম্মু খান, বাইশওয়ারার রানা বেণী মাধো বকশ, মহোনার রাজা দ্রিগ বিজয় সিং, ফৈজাবাদের মৌলভী আহমদ উল্লাহ শাহ, রাজা মান সিং এবং রাজা জাইলাল সিং।

ব্রিটিশরা উন্নত যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে লখনৌ-এর যোদ্ধাদের পরাস্ত করে। বেগম হজরত মহল ইংরেজ রাজপরিবারের দেওয়া পেনশন প্রত্যাখ্যান করে লখনৌ থেকে পালিয়ে আবারও ফৈজাবাদ থেকে মুহুর্মুহু গেরিলা হামলার চেষ্টা করেন। সাহজাহানপুরে হামলা তার মধ্যে একটি। স্যার হেনরি লরেন্স (অওয়াধের প্রধান কমিশনার) চিনওয়াট/ চিনহাটের লড়াইয়ে তাঁর কাছে পরাজিত হন। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী তাঁরই ছিল। ১৮৫৭ সালেরই ৫ জুন মুঘল শাসনের অধীনে তার এগারো বছরের পুত্র বিরজিস কাদেরকে মুকুট পরান। শুরু হয় দশমাসের রানি-শাসন।

উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল ''মাই ইন্ডিয়ান মিউটিনি ডায়েরি''-তে লিখেছেন:

'এই বেগম মহান শক্তি এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। তিনি তাঁর ছেলের স্বার্থ গ্রহণের জন্য সমস্ত আওয়াধকে উত্তেজিত করে তোলেন। প্রধানরা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিয়েছে। বেগম আমাদের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছেন।'

 

ব্রিটিশরা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল, এমনকি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে তার স্বামীর কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু বেগম রাজি ছিলেন না। যখন বিদ্রোহের প্রধান-কেন্দ্র দিল্লি দখল করা হল, তখন আওয়াধের বেগমের পরাজয়ও ঘনিয়ে আসে। বেগম ছোট সাহেব পেশোয়া এবং অন্যান্যদের সঙ্গে নেপালে চলে যান। ব্রিটিশ শাসকরা তাঁকে লখনৌতে বিলাসবহুল জীবন দিতে রাজি ছিল। তিনি স্পষ্ট বলেন, স্বাধীন আওয়াধ রাজ্য ছাড়া আর কিছুই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৮৭৯ সালের ৭ এপ্রিল নেপালের কাঠমান্ডুতে তিনি মারা যান। কাঠমান্ডুর জামে মসজিদের কাছে আজও তাঁর সমাধিতে লেখা -

 

'লিখা হোগা হজরত মহল কি লাহাদ পার

নসিবো’ন কি জালি থি, ফালক কি সাতায়ি'

 

( হজরত মহলের কবরে লেখা থাকবে

নক্ষত্রের দ্বারা অভিসম্পাতিত ছিলেন,আকাশের দ্বারা নিপীড়িত)

 

ওয়াজিদ আলি শাহ যখন ১৮৫৬ সালে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন, তখনও বেগমের বীরত্বের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন শায়রি-তে-

 

'ঘরোঁ পর তবাহি পড়ি শহের মে, খুদে

মেরে বাজার, হজরত মহল

তু হি বাইস এ আইশো-আরাম হেয় গরীবোঁ কি

গমখওয়ার, হজরত মহল'

অর্থাৎ যুদ্ধপীড়িত শহরে গরীবের শেষ আশা হজরত মহল।

 

প্রসঙ্গত, রানি হজরত মহল নিজেও ছিলেন কবি। স্বাধীন ভারতে হজরত মহলের নামে প্রকাশ হয়েছে ডাকটিকিট একটি। লখনৌ-এর ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম বদলে হয়েছে বেগম হজরত পার্ক। ফিল্মস ডিভিশন ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে মহিউদ্দিন মির্জা তাঁকে নিয়ে অতি ক্ষুদ্র ডকুমেন্টারিও বানিয়েছেন।

 

এই বিস্মৃতপ্রায় 'গণিকা-রানি' যে নবাবের চেয়ে অনেক ভাল শাসক এবং নেতা ছিলেন, তা বস্তুনিষ্ঠভাবেই প্রমাণিত। কিন্তু আরও যে ইতিহাস অজানা রয়ে গেছে, তা হল, তিনি যুদ্ধের ময়দানে অন্য গণিকাদেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন, একত্রিত করেছিলেন। শোনা যায়, তেমন নারীর সংখ্যা নাকি ছিল প্রায় দুইশো পঁচিশ। তাঁরাও সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের প্রথম সেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে। আবার অনেক আফ্রিকান নারী আওয়াধ নবাবদের হারেম রক্ষার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরাও ১৮৫৭ সালে লখনউয়ের যুদ্ধে অংশ নিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশেও লেখা হয়েছিল শায়রি দু ছত্র-

 

'কোই আনকো হাবসিন কেহতা, কোই কেহতা নীচ আছুত।

আবলা কই আনহিন বাটলে, কই কহে আনহে মজবুত।'

(কেউ কেউ তাদের আফ্রিকান বলে, কেউ কেউ অস্পৃশ্য।

কেউ তাদের দুর্বল বলে, অন্যরা বলে, তারা শক্তিশালী।)

 

মূলধারার ইতিহাস হয়ত তাঁদের কাউকে ভুলেছে মুসলিম পরিচয়ের জন্য, বা নারী পরিচয়ের জন্য, কাউকে আবার গণিকা পরিচয়ের জন্য।

এরপর, আসুন পাঠক, শুনি কানপুরের গণিকা আজিজুন বাঈ-এর কথা। সেই কানপুর, যা নানাসাহেব বা তাঁতিয়া টোপির লড়াই মনে রেখেছে, কিন্তু ভুলেছে আজিজুনকে। কবি মাখমুর জালুন্ধর তাঁরই উদ্দেশে লিখেছেন -

 

'তেরে ইয়ালগর মে তামির থি তখরিব না থি

তেরে ইসার মে তরগিব থি তাদিব না থি'

 

(আপনার যুদ্ধের কান্না ছিল, ধ্বংস নয়/ 

আপনার আত্মত্যাগ এক অনুপ্রেরণা ছিল, কোনো উপদেশ নয়)

 

ভেবে দেখুন, রানি-যোদ্ধাদের মতো, বিদ্রোহে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত লাভ ছিল না। তিনি কেবল আদর্শগতভাবেই ইংরেজদের মেনে নিতে পারেননি। কানপুরের কথিত, তিনি পুরুষের পোশাক পরে, পুরুষ সৈন্যদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে, পিস্তলে-গোলাবারুদে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে যেতেন। ৪ঠা জুন ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দ। নানা সাহেব সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদানের আহ্বান জানালেন। সাড়া দিলেন আজিজুন। যেদিন কানপুরে প্রাথমিক বিজয় উদযাপনের পতাকা উত্তোলন হয়েছিল, সেদিন তিনি মিছিলে হেঁটেছিলেন।

 

লতা সিং তাঁর প্রবন্ধ ''মেকিং দ্য মার্জিন 'ভিজিবল' "-এ লিখেছেন, কানপুরের দ্বিতীয় অশ্বারোহী সিপাহীদের মধ্যে আজিজুন ছিলেন এক প্রিয় মুখ। সৈনিক শামসুদ্দিনের ছিলেন তাঁর প্রেমিক। তাঁর কোঠা ছিল সিপাহীদের মিলনস্থল। তিনি মহিলাদের, বিশেষত বারাঙ্গনাদের একটি দলও গঠন করেছিলেন, যারা সৈন্যদের শুশ্রূষা, অস্ত্রবিতরণের পাশাপাশি প্রয়োজনে যুদ্ধও করত। শোনা যায়, তিনি উমরাও জানের সমসাময়িক ছিলেন। ব্রিটিশদের গোপন তথ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সরবরাহ করতে গিয়ে ইংরেজদের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। জেনারেল হ্যাভলকের জিজ্ঞাসা করেন, ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্তিলাভ না শাহদত, কী চান তিনি? দ্বিতীয়টি বেছে নেন আজিজুন।

 

রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ''অন দ্য সিটি ওয়াল''-এও তো পাই ১৮৫৭ সাল ও তার নিকটবর্তী সময়ে গণিকাদের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের উল্লেখ। প্রকৃতপক্ষে, আরও অনেক গণিকার কোঠাই বিদ্রোহীদের আশ্রয়স্থল ছিল। ১৮৫৭ সালের পরে তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পূর্ণশক্তি নিয়ে এই কোঠাগুলিকে ধ্বংস করে। প্রাচীন সংস্কৃতি এবং চারুকলায় প্রজ্ঞা ছিল যাঁদের, সেই নগরনটীরা সাধারণ দেহোপজীবিনীতে পরিণত হন। তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়।

মুজাফফরনগর এলাকাতেও সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল হিন্দু-মুসলিম নারীদের। আশা দেবী, বখতাভারি, হাবিবা, ভগবতী দেবী ত্যাগী, ইন্দ্র কৌর, জামিলা খান, মন কৌর, রহিমী, রাজ কৌর, শোভা দেবী, উমদা- ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে তাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পঁয়তাল্লিশ বছরের আসগরি বেগমকে বাদ দিলে, এই সমস্ত মহিলারই বয়স ছিল বিশের কোঠায়। তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল কাউকে কাউকে। এই যে মধ্যবয়সিনী আসগরি বেগমের কথা বললাম, তিনিই বা কে? ১৮১১ সালে জন্মগ্রহণকারী আসগরি বেগম পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। ১৮৫৮ সালে আসগরিকে ব্রিটিশরা জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়।

আবার, হাবিবা ছিলেন মুজফফরনগরের এক মুসলিম গুজজর পরিবারের মেয়ে। সার বেঁধে বারো জন মহিলা যোদ্ধাকে মুজফফরনগরে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ১৮৫৮ সালে, হাবিবা তাঁদের অন্যতম। মৃত্যুকালে নাকি বয়স ছিল তাঁর পঁচিশ।

 

এই মেয়েরা পর্দানসিন অবলার স্টিরিওটাইপ ভেঙে দিয়েছিলেন। আর এই প্রেক্ষাপটেই উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের আমরোহা গাঁয়ে বেড়ে উঠেছিলেন আবাদি বানো নামের বালিকা (১৮৫২-১৯২৪), যিনি পরে রামপুরের আবদুল আলি খানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই ছেলে মৌলানা মোহাম্মদ আলি আর মৌলান শওকাত আলি, যাঁরা 'আলি ব্রাদার্স' নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই নারী কিন্তু শুধু 'আলি ভায়েদের মা' হয়েই থাকেননি। তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয় হোমরুল আন্দোলনের মাধ্যমে, যে আন্দোলনে তিনি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন ও আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছিলেন। যখন ব্রিটিশ সরকার ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রেগুলেশন বলে চন্দনওয়াড় গ্রামে আলি ব্রাদার্সকে আটক করে, মাকে বোঝায় ছেলেদের আত্মসমর্পণের জন্য রাজি করাতে, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘যদি আমার ছেলেরা সরকারের প্রস্তাবে রাজি হয়, তাহলে আমি তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করব। আমি আশা করি ঈশ্বর এই বৃদ্ধ মহিলার দুহাতে তা করার পর্যাপ্ত শক্তি দেবেন।' ১৯১৭ সালে আবাদি বানোর মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে দেখা হল। মহাত্মা গান্ধি ও গান্ধি-অনুগামীদের ‘আম্মিজান’ হয়ে উঠলেন তিনি। বি.আম্মা নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি গান্ধির অসহযোগ আন্দোলন হেতু এবং খিলাফত নেতাদের খিলাফত আন্দোলনের জন্য সার্বিক ভারত সফর বাস্তবায়িত করতে খোলা হাতে অর্থ ঢেলেছিলেন।

১৯১৭ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের যুগ্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল কলকাতায়। আম্মিজান সেই সভায় বক্তৃতা দিলেন। সে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। বোরখা তাড়াল থেকে তেজস্বী ভাষণ রাখছেন বৃদ্ধা এক পুরুষ-অধ্যুষিত উপত্যকায়। বলছেন হিন্দু-ম্যসলিম ঐক্যের কথা, বলছেন খিলাফত আর অসহযোগ আন্দোলনের কথা, ঘোষণা করছেন, 'দেশের কুকুর -বিড়ালও ব্রিটিশদের দাসত্বের অধীনে থাকা উচিত নয়।' ব্রিটিশ সরকারি রেকর্ড তাঁকে 'বিপজ্জনক ব্যক্তি' হিসেবে গণ্য করেছিল৷ বেশ কয়েকটি মহিলা সংগঠনেরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। তীব্র দেশপ্রেমিক এই বৃদ্ধা, অসুস্থতা ও পুলিশি অত্যাচারে ১৯২৪ সালের নভেম্বরে মারা গেলেন। গান্ধিজি বলেছিলেন, 'তিনি বৃদ্ধা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল যুবদের ন্যায় অদম্য প্রাণ শক্তি।'  তহবিল সংগ্রহ করতেন, মহিলাদের ব্রিটিশ পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের গুরুত্ব বোঝাতেন  মৌ আম্মা মাওলানা হাসরাত মোহানী, সরলা দেবী চৌধুরানী, বাসন্তী দেবী, সরোজিনী নাইডু,  বেগম হাসরাত মোহানিদের সঙ্গে। রাখহরি চ্যাটার্জির লেখা ''গান্ধি এবং দ্য আলি ব্রাদার্স: বায়োগ্রাফি অব ফ্রেন্ডশিপ'' বইতে দেখি, মাওলানা মোহাম্মদ জোহর আম্মিজান সম্পর্কে বলেছেন,

'যদিও তিনি কার্যত নিরক্ষর ছিলেন, আমার অভিজ্ঞতায় আমি তাঁর চেয়ে জ্ঞানী, ঐশ্বরিক এবং আধ্যাত্মিক কাউকে দেখিনি।'

 

বি.আম্মার পুত্রবধূও কম যেতেন না। আমজাদি বেগম ছিলেন মুহাম্মদ আলি জওহরের স্ত্রী। শাশুড়ির উৎসাহে আমজাদি বেগমও রাজনীতিতে যোগ দেন।  কথিত আছে, তিনি লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল সম্মেলনে আলি জওহরের পাশে ছিলেন। শাশুড়িকে অসহযোগ আন্দোলন এবং খিলাফত আন্দোলনে সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি জিন্নাহর পরামর্শে মুসলিম লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটিতে পঁচিশ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র মহিলা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে লখনৌতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে বেগম নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেন। মহাত্মা গান্ধি তাঁর উদ্দেশে ''আ ব্রেভ উওম্যান'' শিরোনামের একটি নিবন্ধ উৎসর্গ করেছিলেন।  

বিবি আমাতুস সালাম ছিলেন আরেক নিবেদিতপ্রাণ গান্ধিবাদী। তিনি ১৯০৭ সালে পাঞ্জাবের পাতিয়ালায় রাজপুতানা পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অভিজাত পরিবারে আরামে-আয়াসে না ভেসে আমাতুস সালাম খাদি আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর বড় ভাইরা অনেকেই ছিল তাঁর সহবিপ্লবী। মহাত্মা গান্ধির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সেবাগ্রামে আশ্রমিক হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন গান্ধি দম্পতির ঘনিষ্ঠ, কন্যাসমা। অসুস্থ শরীরে ১৯৩২ সালে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে তিনি কারাগারে যান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি গান্ধির ব্যক্তিগত সহকারী হলেন। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি, হরিজন ও নারীর কল্যাণও ছিল তাঁর লক্ষ্য। যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, তখন তিনি গান্ধির দূত হিসেবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, সিন্ধুপ্রদেশ এবং নোওয়াখালি পরিদর্শন করেন। দাঙ্গা বন্ধ করার ডাক দিয়ে তিনি কুড়ি দিন ধরে সত্যাগ্রহ অনশন করেছিলেন। আবার ১৯৬১ যখন খান আবদুল গাফফার খান যখন ভারত সফর করেন, তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। যখন ১৯৬২ সালে চীন, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বাধে, তখনও তিনি সৈন্যদের সেবা করতে দুর্গম অঞ্চলে পাড়ি দিতেন। ১৯৮৫ সালের ২৯ অক্টোবর অফুরান তাঁর প্রাণশক্তি শেষ হয় শেষমেশ।

 

অন্যদিকে হাজারা বেগম ছিলেন খানিক সোশালিস্ট আদর্শে দীক্ষিত। ১৯১০ সালে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে জন্ম তাঁর। বাবা পুলিস অফিসার, অথচ মেয়েকে শুনিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। প্রথম বিবাহের ব্যর্থতার পর, হাজারা উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। রাজনীতির বোধ পরিপক্ক হতে শুরু করে। ভারতে ফিরে আসেন ১৯৩৫ সালে, লখনৌয়ের কারামত হুসেন মহিলা কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি অল ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠনে বিখ্যাত কবি সাজ্জাদ জহিরকে সাহায্য করেন তিনি। এই ১৯৩৫ সালেই আরেক দেশপ্রেমী নেতা জয়নুল আবেদিন আহমেদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। একই বছরে তাঁরা দুজনই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। যেহেতু পুলিশ তাঁদের ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য চোখে চোখে রাখত,  তাই তাঁরা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আন্দোলনেই পূর্ণসময়ের জন্য যোগদান করলেন।

জাতীয় কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সময় হাজারা বেগম কমিউনিস্ট পার্টিরও সংস্পর্শে আসেন। ১৯৩৭ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের কোঠাপত্তনমে একটি গোপন রাজনৈতিক কর্মশালায় যোগ দেন তিনি। এই দম্পতি ১৯৪০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজেই নিয়োগ করেন নিজেদের। মেহনতি মানুষ এবং আপামর নারীর 'হাজারা আপা' হয়ে ওঠেন হাজারা বেগম। লেনিনের জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে, ১৯৬০ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে 'সুপ্রিম সোভিয়েত জুবিলি পুরস্কার'-এ সম্মানিত করে।  ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি মারা গেলেন তিনিও।

 

অরুণা আসাফ আলি বোম্বেতে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ইঙ্গিত দিতেই যে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন শুরু হয়, তা কে না জানে? অরুণা অবশ্য জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন না। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এক শিক্ষিত বনেদি বাড়ির উনিশ বছরের মেয়েকে জীবিত অবস্থাতেই মৃত ঘোষণা করা হয়। অরুণা গাঙ্গুলির অপরাধ ছিল, তাঁর থেকে তেইশ বছরের বড় এক মুসলিম আইনজীবী, আসফ আলিকে ভালোবেসে বিয়ে করা। ব্রিটিশ সরকার ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’র বিচার শুরু করলে, ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের হয়ে সওয়াল করেন এই আসফ আলি। বিয়ের পর থেকেই অরুণা ধীরে ধীরে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৩১ সালে প্রায় সব রাজনৈতিক নেতা মুক্তি পেলেও, ব্রিটিশরা অরুণাকে জামিন দিচ্ছিল জেলবন্দী সব নারী আন্দোলন শুরু করলে তিনি শেষে মুক্ত হন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে তিহার জেলে পাঠানো হয়। এখানেও তিনি বন্দিদের চিকিৎসার দাবিতে অনশন শুরু করেন। গণ-আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার আবার অরুণাকে মুক্তি দেয়। বিয়াল্লিশে ভারত ছাড়ো আন্দোলন পরবতী সময়ে অরুণা কখনো জেলে কখনো আত্মগোপনে ছিলেন। উর্দু 'ইনকিলাব' পত্রিকায় ১৯৪৪ সালে অরুণা লেখেন

‘স্বাধীনতার সংগ্রাম সহিংস হবে, নাকি অহিংস—এ নিয়ে বিতর্কের সময় এটা না। আমি চাই, ক্রান্তিকালের এই সন্ধিক্ষণে দেশের সব মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুক।’

 

ব্রিটিশ সরকার অরুণার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। তাঁকে ধরিয়ে দিলে ছিল পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার। অবশেষে ১৯৪৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার তাঁর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রদ করলে, অরুণা আত্মসমর্পণ করেন। পরে অরুণা আসফ আলি কংগ্রেসের প্রতি আস্থা হারিয়ে সমাজবাদী দলে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য নির্বাচিত হন। নেহেরু পুরস্কার থেকে পদ্মবিভূষণ, লেনিন শান্তি পুরস্কার থেকে ভারতরত্ন- নানা সম্মানে ভূষিত তিনি। ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নামে। অবশ্য এই ডাকটিকিট, এই ভারতরত্ন সম্মাননা প্রদানের(১৯৯৭) কিছু আগেই, ১৯৯৬ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যু হয় তাঁর। 

 

এছাড়াও তো ছিলেন কত শত! ছিলেন, রিজিয়া খাতুন, বাংলার প্রথম মুসলিম নারী, যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, শাস্তিস্বরূপ কালাপানি হয়েছিল যাঁর। ছিলেন মৌলনা সাফি দাউদির স্ত্রী জুবায়দা দাউদি। ছিলেন সাদাত বানু কিছলু, যিনি নিজে উর্দু ও পার্সি ভাষার সুবিখ্যাত কবি-প্রাবন্ধিকও বটে। স্বামী ডঃ সাইফুদ্দিন কিছলু গ্রেপ্তার হলে যিনি শান্ত কণ্ঠে জানান, তিনি তাঁর জীবনসঙ্গীর জন্য গর্বিত। ডঃ কিছলুর তৈরি 'স্বরাজ আশ্রমে'র একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন তিনিও।

ছিলেন জুলেখা বেগম, স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত প্রবীণ শিক্ষাবিদ এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী। 

 

ছিলেন বেগম হাজরত মোহানি, বেগম খুরশিদ খাজা, মুনিরা বেগম (মওলানা মাজহারুল হকের স্ত্রী), আমিনা কোরেশি, ফাতেমা কোরেশি, আবুল খাত্তাবের স্ত্রী আমিনা তায়াবিজি, আব্বাস তায়াবজির কন্যা রেহানা তায়াবিজি, শামসুদ্দিন তৈয়বির নাতনি হামিদা তায়াবিজি, বেগম সখিনা লুকমান (বদরুদ্দিনের মেয়ে), ফাতেমা তৈয়ব আলি, শফাত তৌহিদ আলি, শহীদ অনাশা বিবি (লুত্‍ফর মওলানা হাবিবুর রেহমানের স্ত্রী), সাফিয়া সাদ, বেগম কুলসুম শায়ানি, আসমত আরা খাতুন, সুঘ্রা খাতুন,  ফাতেমা ইসমাইল, সুলতানা হায়াত আনসারি,  জুয়ার আনসারি...তালিকা যে শেষ হয় না! এঁরা শুধু পুত্র-স্বামীদের উদ্বুদ্ধ করেননি, নীরবতার অবগুণ্ঠন ঝেড়ে ফেলে নিজেদেরও জড়িয়েছেন আন্দোলনে। 

 

আজ শাহিনবাগ দেখে, পার্ক সার্কাস থেকে আমরা শ্রদ্ধাবনত হব নিশ্চয়, কিন্তু ভুলে যাব না প্রতিরোধের দীক্ষা জিনে তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বহন করে থাকতে পারেন এই পর্দানশিনরাও।

 

 

ছবি পরিচিতি -

১. বেগম হজরত মহল

২. আজিজুন বাঈ

৩. আবাদি বানো বা বি. আম্মা

৪. আমাতুস সালাম

৫. হাজারা বেগম

৬. অরুণা আসাফ আলি