প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান নিয়ে সঙ্ঘের গল্পকথার উৎস সন্ধানে

যুক্তি বা তথ্য দিয়ে প্রাচীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত আবিষ্কার খুঁজে পাওয়ার আজগুবি দাবিগুলি প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। উলটে একটা আজগুবি দাবি উত্থাপন করতে গিয়ে তার সপক্ষে আরও পাঁচটা বাজে গল্প দাঁড় করাতে হবে। মিথ্যার উপর আরও বড় মিথ্যার বোঝা একের পর এক জমতে থাকবে। নিজেদেরকে এইভাবে ক্রমাগত এক হাস্যকর জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে হয়। আমাদের চারপাশে এমন হাস্যকর অলীক কুনাট্য রঙ্গ আমরা প্রায়শই প্রত্যক্ষ করি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম দাবি উত্থাপনের প্রবণতা এল কোত্থেকে? সঙ্ঘ পরিবারই কি এর প্রধান কারিগর? এই প্রশ্নটিরও উত্তর খোঁজা দরকার।

[১] শুরু বঙ্কিম-বিবেকানন্দ থেকে

না। ওদের অনেক কাল আগে থেকেই ভারতে একদল প্রাচীনপন্থী অধ্যাত্মবাদী বলে আসছিলেন, বেদে সব কিছু আছে। দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানের আকর হচ্ছে ঋগবেদ। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা এখন যা কিছু আবিষ্কার করছেন তার সব কিছুই খুঁজলে বেদে পাওয়া যাবে। যাবেই। পরে আর একদল আবার এতে একটু সংশোধন এনে বললেন, না, ঋগবেদেই সব আছে এমনটা হয়ত নয়, তবে অন্য নানা প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থগুলি মিলিয়ে দেখলে এর সমস্ত কিছু যে পাওয়া যাবে তাতে কোনো সন্দেহই নেই। এই চিন্তাধারা বহুকাল ধরেই আমাদের দেশের এক বিরাট অংশের বুদ্ধিজীবীদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এক সময় যে রবীন্দ্রনাথও এ নিয়ে ব্যাপক রসিকতা করেছিলেন তাতেই বোঝা যায়, এর বিস্তার কতদিনের। সঙ্ঘ পরিবারের কুশীলবরা সেখান থেকেই এই ধারাটিকে আত্মস্থ করে নিয়ে এর সাথে তাদের নিজেদের অন্ধ বিশ্বাসজাত আরও অনেক মশলা যোগ করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

এই চিন্তাধারাটির উৎপত্তি হয়েছিল এক প্রতি-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদী হীনম্মন্যতাথেকে, যার রেশ এখনও মিলিয়ে যায়নি শুধু নয়, বরং কিছু কিছু কারণে আরও শক্তিশালী হয়ে চলেছে। ইংরেজ আমলে একদিকে বিদেশি শাসকের অধীনে পদে পদে শাসিতের অবমাননার জ্বালা, অপর দিকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সঠিক পথে সংগঠিত সংগ্রাম গড়ে তুলবার ব্যর্থতা—এই দুইয়ে মিলে এক মনস্তাত্ত্বিক সান্ত্বনার অবলম্বন হিসাবে বেদ-পুরাণের শ্রেয়তার সন্ধান। এ যেন অনেকটা সামনের দিকে যেতে না পেরে পিছন দিকে এগিয়ে চলা। বিশেষ করে, সিপাহি বিদ্রোহের পরাজয়ের ফলে এক নিদারুণ হীনম্মন্যতার গ্লানি যেন চেপে বসেছিল গোটা দেশের জনমানসে। সমসাময়িক কালে খুব কম সংখ্যক চিন্তাশীল ব্যক্তিই পেরেছিলেন এই মানসিকতার চক্র থেকে বেরিয়ে এসে সামনের দিকে তাকানোর মতো সাহস দেখাতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অক্ষয়কুমার দত্ত রাজেন্দ্রলাল মিত্র যখন বলছেন সামনের দিকে তাকাতে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন দেখাচ্ছেন “মা যা ছিলেন”, বিবেকানন্দ কম্প্র মন্দ্র স্বরে আহ্বান জানাচ্ছেন “হে ভারত ভুলিও না”, ইত্যাদি; যা কেবল পশ্চাদমুখী দৃষ্টিপাতেরই রসময়-আবেগাশ্রিত আলাপ। যার সার কথা হল: তোমাদের সঙ্গে আছে বিজ্ঞান প্রযুক্তি অস্ত্রশস্ত্র, আর আমাদের হাতে আছে আধ্যাত্মিক শক্তি, বেদান্ত, ব্রহ্ম, আদ্যাশক্তি মহামায়া। তোমাদেরটা জড়বাদ, দুদিন বই তো নয়। আমাদেরটা পারমার্থিক বিদ্যা, দেহাতীত, কালাতীত। এই রকম আর কি।

মুশকিল হল, ইংরেজদের অপরাবিদ্যার বাস্তব জোরটা এত বেশি যে বেশি দিন তাকেও পুরোপুরি পরমার্থ দিয়ে উপেক্ষা করে বসে থাকা যায় না। আম জনতাকেও বোঝানো যায় না। ফলে এর পর শুরু হল আর এক মানস-ক্রীড়া—ওরা যা কিছু আবিষ্কার করছে, উদ্ভাবন করছে, জানছে, ও সব কোনোটাই নতুন কিছু জ্ঞান নয়; এই সব আমরা অনেক আগেই অর্জন করে রেখেছি। বিশ্বাস না হলে পুরনো শাস্ত্রগুলো খুলে খুলে দেখ। পাতা ওল্টাও আর পড়। সব আমাদের ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিরা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন।

তা, সেগুলো সমস্ত গেল কোথায়?

প্রথমে তৈরি হয়েছিল ত্যাগ মাহাত্ম্যের গল্প। আমাদের ওসব পছন্দ হয়নি। আমাদের বনই পছন্দ। সেখানে তো আর বেশি কিছু লাগে না। তাই আবিষ্কার করেও সব আমরা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। জড়বাদ আমাদের সংস্কৃতিতে সহ্য হয়নি।

এটাও বেশিদিন চলল না। ইংরেজদের চালু করা সমস্ত জড় আমোদই আমাদের দেশের লোকে বেশ আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করেছে। তখন এল মুসলিম শাসনে হিন্দুদের ঐতিহ্যের সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার গল্প। ইতিমধ্যে এই গল্পটা ইংরেজ শাসকরা কয়েকজন লেখককে দিয়ে পাঠ্য বই লিখিয়ে বাজারে এনে ফেলেছে। ওরা প্রথমে মন্দির ভেঙেছে, তারপর আমাদের বিমান উড়িয়ে দিয়েছে, বিদ্যুৎ শিল্প নষ্ট করে দিয়েছে, আমাদের রেডিও ভেঙে দিয়েছে, ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর “চতুরঙ্গ” উপন্যাসে এই ধারণাটিকেও তীব্র ব্যঙ্গ করে অনেক কথা লিখেছিলেন।

বিজেপি  বা সঙ্ঘ পরিবারের মহাচিন্তকরা এখন এই গল্পগুলোকে আশ্রয় করে তাদের থিসিসগুলি জনারণ্যে ছাড়ছে এবং ছড়াচ্ছে। সব সময় যে সোচ্চারে বলছে তা নয়। কিন্তু ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু মন্দির যে মুসলিম শাসকদের হাতে ভাঙা পড়েছিল, তার যখন পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য আছেই, তখন সমস্ত মন্দির ওরা ভেঙেছিল বললেই বা আটকায় কে? তারপর যদি বলা হয়, ওরা প্রাচীন ভারতের সব কিছু অর্জন নষ্ট করে দিয়েছে তাও এই সনাতন ঐতিহ্যের দেশে বহু লোকেই প্রথমে গোগ্রাসে খাবে। সুতরাং, বিমান জিনপ্রযুক্তি স্টেমসেল আপেক্ষিকতা—সবই ছিল কিন্তু এখন আর নেই বললেও চলবে ভালোই।

এই হচ্ছে তাদের যাবতীয় আবিষ্কারের রহস্য। এই হচ্ছে তাদের প্রধান ভরসা। রবি ঠাকুরের পদ্যই লোকে এক আধটুক পড়ে। গানও দুচারখানা শোনে হয়ত। তাঁর গদ্য আর কটা লোকে পড়ে?

 

২। বৈদান্তিক ঐকান্তিকতা

আর একদল অধ্যাত্মবাদী ধর্মবিশ্বাসী চিন্তাবিদ আছেন, যাঁরা এতটা স্থূল সঙ্ঘমার্কা দাবিদাওয়া করেন না। তাঁরা সরাসরি বিজ্ঞানের কোনো তাত্ত্বিক আবিষ্কার বা বিশেষ কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ধারে কাছে না গিয়ে সাধারণভাবে দাবি করেন, আধুনিক বিজ্ঞান বস্তুজগত ও বিশ্বপ্রকৃতির জন্ম বিকাশ ও পরিবর্তনের সম্পর্কে যে ধ্যান ধারণা নিয়ম তুলে ধরছে, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে বেদান্ত নাকি সেই ধারণাগুলিই বহু প্রাচীন কালেই বলতে পেরেছিল।

এই দাবিটা আবার এমন যে বেশ কিছু বিদেশি পণ্ডিত ব্যক্তি, এমনকি খ্যাতনামা বিজ্ঞানীও, এর পৃষ্ঠপোষক। ফলে এর ইজ্জত অনেক বেশি। তাঁরা মনে করেন, আধুনিক বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলির সাথে প্রাচীন ভারতীয় বৈদান্তিক মতবাদের সাদৃশ্য নাকি খুবই প্রকট ও বিস্ময়কর।

আলোচ্য প্রসঙ্গে এই দাবিটিরও সত্যতা পরীক্ষা করার দরকার আছে।

ইউরোপের খ্রিস্টীয় ধর্ম দর্শনের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে। বাইবেলের দুটো ভাগ দেখে নিলেই জানা হয়ে যায় প্রাচীন জ্ঞানীরা কী কী জানতেন এবং বলে গেছেন। আদিম গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ খুনোখুনি লুটপাট থেকে শুরু করে প্রেম ভালোবাসা বিতরণ পর্যন্ত মানুষের চিন্তার উত্তরণের একটা বেশ স্পষ্ট ছবি তাতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞান নিয়ে, অণুপরমাণু নিয়ে বলার মতো কথা প্রায় নেই বললেই চলে। সেই জন্য এরকম দাবিও কেউ উত্থাপন করতে পারেন না যে আধুনিক বিজ্ঞানের কোনো হিরেমুক্তো তাতে ছড়ানো আছে। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে একথা বলা যায় না। শুধু যদি বৈদিক ঔপনিষদিক ও পৌরাণিক সাহিত্যের আয়তন বিবেচনায় রাখা যায়, সেটাই এক বিপুল ব্যাপার। বেদ চারখানা, উপনিষদ তেরটা (প্রাচীন ও প্রধান ধরে), পুরাণ অন্তত আঠেরটা। এদের প্রত্যেকটায় শুধু ধর্মবিশ্বাসের কথাই নেই; সেই সঙ্গে আছে খাদ্য পানীয় বিবাহ দাম্পত্য যৌনতা থেকে শুরু করে সৃষ্টি তত্ত্ব পর্যন্ত যাবতীয় জ্ঞানের কথা। প্রত্যেকটাই এক একটা (এখনকার ভাষায়) নলেজ ব্যাঙ্ক। এহ বাহ্য! এদের মধ্যে আবার এক একটা বিষয়ের বক্তব্যে পারস্পরিক কোনো মিল নেই। এ যা বলে ও তা বলে না। হয়ত উল্টোটাই বলে। এমনকি একই উপনিষদের মধ্যেও দু জায়গায় দু রকম সৃষ্টি তত্ত্বের হদিশ আছে। কোনটা যে প্রাচীন ভারতের জ্ঞান হিসাবে ধরা হবে, তা কে বলে দেবে?

যাঁরা উপরের দাবিগুলি করেন তাঁরা কী করেন? এটাও এক চরম কৌতুহলের বিষয়।

তাঁরা সহজ রাস্তা ধরেন। উকিলদের রাস্তা। যে মামলায় যে আইনের ধারা উপধারা অথবা যে পুরনো মামলার রায়ের উল্লেখে আদালতে সুবিধা হবে তাঁরা সেই ভাবেই কেস সাজিয়ে ফেলেন। রায় যাতে মক্কেলের পক্ষে যায়। আগের দিন কী বলেছেন, অন্য মামলায় তাঁর সওয়াল কী ছিল, কিংবা, এমনকি একই আইনের আগের দিন তিনি কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা নিয়ে তিনি থোড়াই পরোয়া করেন।

এখানেও তাই। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা দেখে নেন, বিজ্ঞান এই মুহূর্তে কী বলছে। সেই অনুযায়ী তাঁরা উৎস গ্রন্থ বা প্রয়োজনীয় সূত্র হাতড়ে বেড়ান। যেমন, বিশ শতকের ষাটের দশকের আগে বিগ ব্যাং প্রচলিত বা জনপ্রিয় তত্ত্ব ছিল না। এই চিন্তাবিদরাও কেউ বেদ উপনিষদ পুরাণ থেকে সেই অনুযায়ী বিশ্বতত্ত্ব খোঁজেননি। আকাশ জল বা পরম শূন্য থেকেই জগত সৃষ্টির কথা বলেছেন। ১৯৩০-এর দশকে মেঘনাদ সাহার সমালোচনার জবাবে অনিল বরণ রায়ের লেখায় সেই জন্য মহাবিস্ফোরণমূলক বিশ্বতত্ত্বের কোনো বৈদিক ঔপনিষদিক পৌরাণিক সূত্র নেই। ১৯৬০-এর পরে যখন থেকে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং-এর কথা বলতে শুরু করলেন, অমনি এই পণ্ডিতরাও প্রাচীন শাস্ত্র থেকে সেই উদ্ধৃতিগুলিই দিতে লাগলেন, যেগুলি এর সাথে খানিকটা মিলে যায়। গরম থেকে ঠান্ডায় যাওয়ার কথা যেখানে আছে সেই গুলোকে সামনে নিয়ে আসার দ্বারা। বিজ্ঞানে যদি অসীম ও সসীম ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে, এঁরাও প্রাচীন পুঁথি থেকে অনন্ত ও সান্ত বিশ্ব সম্পর্কে যে দুরকম মতামত আছে তা তুলে ধরতে থাকেন।

এঁদের যাঁরা পাঠক, তাঁরাও স্বভাবতই বিশ্বাসী মানুষ। প্রাচীন ভারতের পুঁথিপত্রে আধুনিক জ্ঞানের হদিশ পেয়েই তাঁরা খুশি। তা নিয়ে ঝাড়াই বাছাই যুক্তি তর্ক বিচার বিশ্লেষণ তাঁদের পছন্দের জিনিস নয়। খ্যাতনামা বিদ্বান লোকেরা বলছেন, অতএব নিঃসংশয়ে মেনে নাও—এই হচ্ছে তাঁদের মনোভাব। ফলে চিন্তাটা সহজেই গ্রাহক পেয়ে যায়। বিজ্ঞানের পেশাগত দরবারে একটা পারস্পরিক-যাচাই প্রতি-যাচাইয়ের ব্যবস্থা আছে। সেটাকে কারোর পক্ষেই পাশ কাটিয়ে কোনো দাবি উত্থাপন করা সম্ভব নয়। এই জায়গায় সেই সমস্যা নেই। কোনো প্রকাশ্য মঞ্চে নিজের কথাকে যুক্তি তথ্য সূত্র দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে এবং প্রতর্কর সামনে পড়তে হচ্ছে না। কে মানল, কে মানল না, তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। ওনারা বলে খালাশ, এনারা পড়ে খালাশ। দু পক্ষই খুশি।

যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের পক্ষে, আমাদের হচ্ছে মুশকিল। আমরা এত সহজে এই সব কথা মেনে নিতে পারি না। বিচার করতে চাই, যুক্তি তথ্য পেতে চাই। যথোপযুক্ত সূত্র পেতে চাই। সূত্রগুলিকেও যাচাই করে নিতে চাই। সমস্ত বিষয় বিশ্লেষণ করতে চাই। নিঃসন্দেহ হতে চাই। জ্ঞানের রাজ্যে, সত্যান্বেষণে ফাঁকি যে চলে না। ফাঁকি দেবই বা কাকে। সঠিকভাবে বাছবিচার করে না জানলে ঠকাতে হবে তো নিজেকেই। মিথ্যা জিনিস জেনে বসে থাকব। মাথায় ভুল জিনিসের আবর্জনা জমে থাকবে। দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাসের ফানুস—ফেটে গেলে যে বিচ্ছিরি পচা গন্ধ ছড়াবে। নিজেদেরই খারাপ লাগবে।

ফলে আমরা বিচার করতে বসে ভাবি: এত দুরূহ সব চিন্তা যাঁরা করতে পেরেছিলেন, তাঁরা এবং তাঁদের উত্তরপুরুষ গত দু তিন হাজার বছর ধরে দেশের কোথাও একটাও ভালো রাস্তাঘাট বানাতে পারলেন না; মাটির রাস্তা নষ্ট করবে না—এইভাবে গরুর গাড়ির চাকার নকশা বদলাতে পারলেন না—এরকম হল কেন? লোডশেডিং-এর সময় মোমবাতি ধরাতে গিয়ে আবিষ্কার করি, গড়ে চারটে দেশলাই কাঠি নষ্ট না করে একটা কাঠিতে আগুন ধরাতে পারি না। বিদ্যুৎ ব্যবহার করার সময় প্লাগ-হোলে প্লাগ ঢোকাতে গিয়ে লক্ষ করি, কোনোটা এমন ঢিলে যে ভালো করে আটকায় না; আবার, কোনো কোনোটা এত টাইট যে ঢুকতেই চায় না। এরকমই বা কেন হয়? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় সমস্যা যে দেশের জ্ঞানীরা সমাধান করে ফেলতে পেরেছিলেন দু তিন হাজার বছর আগে, তাদের বংশধররা এই সব ছোটখাটো ব্যাপারেও কেন ব্যর্থ? বেদ-বেদান্ত তপোবন বর্ণাশ্রম সরস্বতী আরএসএস ইত্যাদি প্রকরণগুলি না থাকা সত্ত্বেও জাপান যা করতে পেরেছে, চিন এখন যা করতে পারছে, আমাদের দেশের পক্ষে তার কিছুই করা সম্ভব হল না কেন?

আরও দু পা এগিয়ে গিয়ে ভাবি, আচ্ছা দেখা যাক, বেদান্তের কোনো সূত্র থেকে বিজ্ঞানের একটা সামান্য কোনো সূত্রও কি বের করা যায়? ‘তত্ত্বমসি’ থেকে নিউটনের গতিসূত্র? ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’ থেকে বয়েলের গ্যাসের সূত্র? ‘সোহহং’ থেকে ফ্যারাডের কোনো একটা মাত্র নিয়ম? বা এই রকম অন্য একটা কিছু? প্রাচীন জ্ঞানের কোনোটা থেকে যদি আধুনিক জ্ঞানের একটা কিছুও বের করা যায়, তাহলে বুঝতে হবে, কিছুমাত্র হলেও সাদৃশ্য বা সাযুজ্য আছে। দাবিদারদের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সেই চেষ্টা করে রেখেছেন। খুঁজে বেড়াই। কিন্তু হায়! শুধু যে চেষ্টা করেন না তাই নয়, দাবিদাররা কেউ এমনকি বোঝেনও না যে এটা তাঁদের তরফে করে দেখানোর দরকার আছে। বৈদান্তিক মহাজ্ঞানীদের কী দুর্দশা!

তখন নিঃসন্দেহ হই, সমস্ত দাবিটাই ভুয়ো। মোদী কোম্পানির দাবিগুলি একটু বেশি রকম স্থূল। ঘাপলাবাজিটা ধরা সহজ।  অধ্যাত্মবাদীদের দাবিগুলি সেই তুলনায় হয়ত একটু পালিশ করা। কিন্তু মূল চরিত্রে দুটো একই। সবই আন্তর্গ্রহ ভ্রাম্যমান জ্বালানি বিহীন বৈদিক বিমান!!  

 

আসল গৌরব

তার মানে কি এই যে আমাদের প্রাচীন ভারতের দিক থেকে সত্যিকারের গর্ব করার মতো সম্পদ কিছুই নেই? না। শেষ করার আগে সেই ব্যাপারেও কিছু কথা তুলে ধরব। কেন না, প্রাচীন ভারতের গর্ব করার মতো কিছু সম্পদ নিশ্চয়ই আছে। তবে তা প্রাচীন যুগেরই অর্জন। তাই দিয়ে আজকের কাজও যেমন চলবে না, আজকের যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের সঙ্গে তার তুলনা করাও চলে না। কিন্তু সমকালীন যুগের অর্থে তার গুরুত্ব খুবই বেশি।

প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতা। এক বিশাল অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত এই তাম্র-ব্রোঞ্জ নবপলীয় সভ্যতা আজও পৃথিবীর এক পরম বিস্ময়। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত মেহেরগড় গ্রামীন সংস্কৃতি (আনুমানিক ৭০০০-৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে বিকশিত হয়ে মোটামুটি দুই হাজার বছর (৩৫০০-১৮০০ খ্রিঃ পূঃ) ধরে বিদ্যমান এই নগর সভ্যতা শিল্প সংস্কৃতি কৃষি বাণিজ্য প্রাসাদ প্রাচীর সড়ক নর্দমা জল-নিকাশি ব্যবস্থা মুদ্রা লিপি বাটখারা—ইত্যাদি ধাতু যুগোত্তর সমস্ত রকম বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। পূর্বোক্ত লেখক অরুণাভ মিশ্র এই সভ্যতার চালচিত্রটি তাঁর রচনায় সংক্ষেপে খুব সুন্দরভাবে উপস্থিত করেছেন। [মিশ্র ২০১৫] দুঃখের কথা হল, এর অধিকাংশ বড় প্রত্নক্ষেত্রগুলো ভৌগোলিকভাবে বর্তমান পাক-ভূখণ্ডে পড়ে যাওয়ায় ভারতবাসীরা যেন এক অদ্ভুত অনীহায় এর ইতিহাসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ভারত এবং পাকিস্তান—দুই দেশেরই মানুষ যে এই সুউন্নত সভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসাবে এক স্থায়ী গর্ব বোধ করতে পারে—এই বোধটা সীমান্তের দুই পারেই সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মানস-জঞ্জালে চাপা পড়ে গেছে। বিজেপি-ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই এই অযৌক্তিক মানসিকতা আমাদের গ্রাস করে রেখেছে। বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে অবশ্য এই মানসিকতাকে আরও পরিকল্পিতভাবে এক বিশেষ লক্ষ্য থেকে চাগিয়ে তোলা হচ্ছে। তার সাথে তারা চেষ্টা করছে, হরপ্পা সভ্যতাকে বৈদিক সংস্কৃতিরই ধারাবাহিক বিকাশ হিসাবে দেখিয়ে এর কৃতিত্ব থেকেও সংকীর্ণ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদকে পুষ্ট করতে।

দ্বিতীয়ত, বৈদিক সংস্কৃতি। হরপ্পা সভ্যতার অন্তকালের সময়ে এবং তার কিছু পর থেকেই বৈদিক জনজাতিগুলির ইরান ও আফঘানিস্তান হয়ে সিন্ধুর পারে আগমন। আরও সিন্ধু নদ পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখে এগিয়ে এসে গঙ্গা-যমুনা প্লবাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি নির্মাণের পর আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ কাল থেকে তারা বৈদিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যের জন্ম দিতে শুরু করে। তার মধ্যেও ছিল এক সমুন্নত কৃতিত্ব। সেই সব কৃতিত্বকে চিহ্নিত করে নিতে পারলে আমাদের তা নিয়েও গর্ব কিছু কম হবে না।

তিনটি ক্ষেত্রে এই অর্জন সমকালীন বিশ্বের অনেক দেশের থেকেই এগিয়ে থাকবে। সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান, গণিত। সেগুলো এক এক করে একটু সবিস্তার বলি।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঋগবেদ প্রাচীন ভারতের একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে একদল অরণ্যচারী যুদ্ধবাজ পশুপালক ভ্রাম্যমান মানবগোষ্ঠী যে সম্পূর্ণ মুখে মুখে এই রকম একটা বিরাট কাব্যসম্ভার রচনা করতে পেরেছিল, তাকে শ্রুতি-স্মৃতি-আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তির এক সামূহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় এক সহস্র বছর সংরক্ষণ করতে পেরেছিল, এবং অবশেষে লিপি উদ্ভাবন ও লিখন-কৌশল আয়ত্ত করার পর তাকে খণ্ডে খণ্ডে লিখে রাখতে পেরেছিল—এ জিনিস আমার জানায় বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। এই বিপুল সম্ভার সৃষ্টি, তার সংরক্ষণ এবং তার গ্রন্থন—তিনটি ক্ষেত্রেই এগুলো এক একটা বিরাট কীর্তি। এই বিশাল সাহিত্যকে ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে এর প্রাপ্য মর্যাদা বোধ হয় পুরোটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কেন না, ধর্মগ্রন্থ হিসাবে এর কোনো যোগ্যতাই নেই। না আছে পূজাপাঠ, না আছে আত্মা পরমাত্মার কথা, না স্বর্গ নরক, না পাপ পুণ্য, না মোক্ষলাভের কথা—ধর্মের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই সব কোনো অনুষঙ্গই এতে নেই। এতে আছে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি, যথা, সূর্য, পাহাড়, নদী, ঊষা, অগ্নি, ইত্যাদির উচ্চ প্রশংসা ও প্রশস্তিমূলক কবিতা। তাদের কেন্দ্র করে নানা রকম আবেগের প্রকাশ। এতে আছে বিপুল ভোজনের ভালোমন্দের কথা। এতে রয়েছে খাদ্য শস্য সংগ্রহ ও লুটপাটের সমস্যার কথা। সূর্য পাহাড় নদী প্রমুখ যাদের দেবতা বলা হয়েছে তারা মানুষেরও অধম—হিংসা বিদ্বেষ লোভ ক্রোধ কামনা বাসনায় তারা মানুষের দশ হাত উপর দিয়ে যায়। প্রাচীন কালের মানুষের স্বতস্ফূর্ত কাব্য হিসাবে বৈদিক সূক্ত বা কবিতাগুলি সত্যিই অতুলনীয়। কিন্তু ধর্মীয় সাহিত্য বা শাস্ত্র হিসাবে প্রাচীনত্ব ছাড়া এর কোনো মূল্যই নেই।

এই শেষ কথাটা আর একটু স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া ভালো। পৃথিবীর সমস্ত দেশের সমস্ত যুগের মানুষেরই প্রাচীনের প্রতি, প্রাচীনত্বের প্রতি একটা বিশেষ সম্ভ্রমবোধকাজ করে। পুরাকালে আবার প্রাচীন মানেই ছিল পবিত্র। এই জন্যই পাথরের পাত্র, পাথরের মূর্তি খুব পবিত্র। এই জন্যই পূজাপার্বনে লোকে তামা কাঁসা পেতলের বাসনপত্র ব্যবহার করে। সেই একই আবেগ-সরণি ধরেই এই দেশের মানুষের কাছে ঋগবেদ তার প্রাচীনত্বের সুবাদে কাব্যসাহিত্যের পরিচয় খুইয়ে কালক্রমে ধর্মসাহিত্য হয়ে বসে আছে।

আর একটা জিনিসও খুব চিত্তাকর্ষক। হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মনে করে, বেদই হিন্দুদের যাবতীয় ধর্মীয় রীতিনীতির উৎস। আর বাস্তবে, হিন্দুদের একটাও ধর্মীয় আচরণে অনুষ্ঠানে দেবদেবীতে ঋগবেদের বা সেই যুগের কোনো উপাদানই নেই। পূজাপাঠে বৈদিক মন্ত্র বলে যেগুলি উচ্চারিত হয় তারও সিংহভাগই আসলে অবৈদিক, বিভিন্ন পৌরাণিক উৎস থেকে সংগৃহীত। যেটুকু এদিক ওদিকে বেদের অংশ বলে দেখা যায়, তার মধ্যে ব্যাপক জোড়াতালির ছাপ একেবারে স্পষ্ট। বিশ্বাসের সঙ্গে আচরণের এতখানি অসামঞ্জস্য হিন্দু ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্মেই দেখা যায় না। এই অসঙ্গতির একটাই কারণ—বৈদিক সাহিত্যের প্রকৃত ঐতিহাসিক মূল্য নিরূপন করতে না পারা। কিন্তু এর সঠিক মূল্যমান জানলে এর জন্য গৌরবের ভাগ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত ভাষাবিজ্ঞান। সংস্কৃত বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র ধ্রুপদী ভাষা, যার জন্ম হয়েছে কিছু চিন্তাশীল মানুষের অত্যন্ত সুচিন্তিত বিচার বিশ্লেষণ সংশ্লেষণের হাত ধরে। বৈদিক ভাষা ছিল আদতে মৌখিক অসংগঠিত অবিন্যস্ত ভাষা। তার মধ্য থেকে শব্দমূল ধাতুমূল খুঁজে খুঁজে বের করে সমস্ত ভাষা কাঠামোকে সুন্দরভাবে ব্যাকরণ নির্মাণ করে সংগঠিত করার এটা একমাত্র উদাহরণ। পৃথিবীর অন্য সমস্ত প্রাচীন ভাষাই নামাঙ্কিত হয়েছে জাতিগোষ্ঠী বা অঞ্চল বাচক শব্দ দিয়ে। সংস্কৃত ভাষাই বোধ হয় সেই কালের একমাত্র ব্যতিক্রম যা প্রত্যয়ান্ত ক্রিয়াবাচক শিরোনাম ধারণ করে রয়েছে। সেই সচেতন নির্মাণ প্রয়াসের কারণেই এই ভাষার লিপি প্রকরণে প্রায় সমস্ত উচ্চারণ যোগ্য স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জন ধ্বনিকে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। স্বর ধ্বনিগুলি উচ্চারণের ক্রমপরিণতি অনুযায়ী বিন্যস্ত। অ আ ই ঈ উ ঊ এ ঐ ও ঔ ইত্যাদি। ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলিকেও মুখের ভেতরে উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী এক চমৎকার ক্রমবিন্যাসে বর্গাকারে সাজানো হয়েছে। এই ভাষার সংগঠনে বিশ্লেষণী সূক্ষ্মতা আরও বেশি করে ধরা পড়ে যখন দেখি, র-ফলা থেকে রেফ এবং ঋ-কারকে আলাদা করে চেনানো হয়েছে(এই ভাষাতেই শিবরাম এবং শিব্‌রাম থেকে শিব্রাম-কে উচ্চারণের অর্থে আলাদা করা সম্ভব হয়েছিল)। এবং এই সমস্ত বিকাশ ঘটেছে আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। এটা ভাবলেই তো আমাদের বুকটা গর্বে ভরে ওঠা উচিত।

তৃতীয়ত, গণিতে শূন্যের আবিষ্কার ও প্রয়োগ। সকলেই জানেন, আধুনিক গণিতে, এবং বিজ্ঞানেও, শূন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। শূন্য ছাড়া বীজগণিতের বিকাশ ঘটানো প্রায় সম্ভব ছিল না। গাণিতিক ধারণা হিসাবে শূন্যের আবিষ্কার ঠিক কখন বা কোন দেশে প্রথম হয়েছিল তা বর্তমানে সঠিকভাবে বলা মুশকিল। ভারতীয় ইতিহাসবিদরা একে ভারতেরই বহু প্রাচীন কালে ঠেলে দেবার চেষ্টা করলেও তার কোনো নিশ্চিত-দৃষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। শূন্য শব্দটির ব্যবহার অনেক দিনের হলেও তার মধ্যে কোনো গাণিতিক বোধ লক্ষ করা যায় না। আকাশ বা স্থান বোঝাতে শূন্যের ব্যবহার করা হলেও তার মধ্যে গাণিতিক শূন্যের পরিচয় নেই। মোটামুটি পঞ্চম শতকে আর্যভাটের সময় থেকে এর গাণিতিক ব্যবহার পরিদৃষ্ট হতে থাকে। কিন্তু আর্যভাটও শূন্যের ব্যবহার না করেই বহু অঙ্ক লিখে গেছেন। তবে এই ক্ষেত্রে একটি কথা সংযোজন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি চিনের কয়েকজন গণিতজ্ঞ দাবি করেছেন, চিন দেশেই প্রথম শূন্যের ধারণার আবিষ্কার হয়েছে। ওখানেও একটু অন্য রকম ভাবে স্থানমান পাতন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছিল। [Lam and Ang 2004] এর ভিত্তিতে ইদানীং কালে কেউ কেউ মনে করছেন, চিনে আবিষ্কৃত হয়ে গণিতের এই ধারণাগুলি ইন্দোচিন ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার) হয়ে পূর্ব দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল। [Kaplan 1999; Nanda 2016] হয়ত সেই সময় থেকে ধীরে ধীরে শূন্যকে ব্যবহার করে সংখ্যার স্থান-মান পাতন পদ্ধতি বিকশিত হতে শুরু করে। বড় বড় সংখ্যা লেখার ক্ষেত্রে এটা যে কত বড় একটা সুবিধা হয়ে দেখা দিয়েছিল, আজ আর অনেকেই বুঝতে পারবেন না, যদি সেই সময়ের অ-শূন্য সংখ্যা লিখন পদ্ধতির ব্যাপারে খোঁজখবর না রাখেন। এই শূন্যের ধারণা এবং তার ভিত্তিতে দশমিক স্থান-মান পাতন পদ্ধতি বাণিজ্যিক লেনদেনের সূত্রে ভারত থেকে আরব হয়ে ইউরোপে পৌঁছায় আনুমানিক নবম শতাব্দে। আর তারপরে, একাদশ শতক থেকেই দেখা যায়, বীজগণিতের ব্যাপক বিকাশ শুরু হয়ে যায় সেখানে। এই বিষয়টা সারা বিশ্বে বিজ্ঞানের ইতিহাসে ইতিমধ্যেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নথীভুক্ত হয়ে আছে। আমরা যদি চিনকে সঙ্গে নিয়ে প্রাচীন ভারতের এই অবদানের জন্য বুক বাজিয়ে গর্ব করি, কেউ তাতে আপত্তি জানাবে না।

এই তিনটি জায়গায় ভারতের অবদান একেবারেই অনন্য। কিন্তু এর বাইরেও প্রাচীন ভারতে আরও কিছু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটেছিল। যেমন, ধাতুবিদ্যা, ভেষজজ্ঞান, শল্য চিকিৎসা, ইত্যাদি। এই সব ক্ষেত্রে অগ্রগতির ইতিহাস পৃথিবীর আরও কিছু দেশের সঙ্গে সমান্তরালভাবে ঘটেছে। যাঁরা তথ্য এবং সত্যের ভিত্তিতে গর্ব প্রকাশ করতে চাইবেন, তাঁদের সে সম্পর্কে সতর্ক হয়ে দাবি পেশ করতে হবে। আর সঠিক তথ্য জানা থাকলে আমাদের আর মিথ্যা দাবি করে যেতে হবে না।

 

আজ এই অবধি

পরিশেষে, যেখান থেকে এই আলোচনা শুরু করেছিলাম সেখানে একবার ফিরে যাওয়া দরকার। প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অবদান। একে তো আমাদের মিথ্যা দাবির সংখ্যা বেড়ে গিয়ে সত্যিকারের অবদানগুলিকে কার্যত ভুলেই যাওয়া হচ্ছে। তার উপর আমরা যে বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মৌলিক অবদানের প্রশ্নে প্রথম বিশ্বের তুলনায় বহু যোজন পিছিয়ে আছি, এই সত্য তো কোনো মিথ্যা জাঁকজমক করেই ঢেকে রাখা যাবে না। আধুনিক পৃথিবীতে যা কিছু আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন হচ্ছে—সে মাছ কাটা কাচিই হোক আর সেল ফোন—আমরা যে তার কোনো কিছুই নিজেরা অন্যদের আগে বানাতে পারছি না, সবই যে ওরা করে ফেলার পর আমরা শুধু নকল করছি, এই কথাটা ভুলে গেলে চলে না। যত দিন এই পরিস্থিতি বহাল থাকবে, আমাদের মিথ্যা দাবিই করে যেতে হবে।

কিন্তু যদি আমরা বুঝতে পারি, আমাদের গলদটা কোথায়, কেন আমরা মৌলিক আবিষ্কার করতে পারছি না, তাহলে অচিরে হয়ত মৌলিক কিছু একটা করে দেখাতে পারব। বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবার হয়ত আরও বেশ কিছু দিন চেষ্টা করে যাবে যাতে আমরা এটা করতে না পারি। মিথ্যা গর্ব আর মিথ্যা দাবিতেই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকি। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা আর কত কাল এই ভাবে নিজেদের ঠকাব। আর কত দিন আমরা উন্নত দুনিয়ার সামনে নিজেদের হাস্যাস্পদ করে রাখব।

সময় তার দাবি জানাতে শুরু করে দিয়েছে।

আসুন, আমরা তাতে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দেবার চেষ্টা করি।।

 

তথ্যসূত্র

 

অরুণাভ মিশ্র (২০১৫), “প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চার সত্যাসত্য”; মার্ক্সবাদী পথ, বর্ষ ৩৪ সংখ্যা ৩; ফেব্রুয়ারি ২০১৫।

সমরেন্দ্র নাথ সেন (১৯৯৪), বিজ্ঞানের ইতিহাস (অখণ্ড); ২য় খণ্ড; শৈব্যা প্রকাশন, কলকাতা।

Robert Kaplan (1999), Nothing That Is: A Natural History of Zero; Oxford University Press, New York.

Lam Lay-yong and AngTian-se (2004), Fleeting Footsteps: Tracing the conception of Arithmetic and Algebraa in Ancient china; World Scientific Publishers, Singapore.

H. S. Mukunda; S. M. Deshpande, H. R. Nagendra, A. Prabhu, and S. P. Govindraju (1974).“A critical study of the work "VyamanikaShastra".”Scientific Opinion: 5–12.  এই প্রবন্ধটি এখন আকাশজালেও পাওয়া যায়:

http://cgpl.iisc.ernet.in/site/Portals/0/Publications/ReferedJournal/ACriticalStudyOfTheWork-VaimanikaShastra.pdf]

Meera Nanda (2016), Science in Saffron: Skeptical essays on histry of science; Three Essays Collective, Gurgaon.

Biman Nath (2015), “Calculus and India”; Frontline, 23 January 2015. Also available at: http://www.frontline.in/science-and-technology/calculus-india/article6751482.ece

Chandra Kant Raju(2015), “Not out of Greece”; Frontier, Vol. 47 No. 25, 28 December 2014 -3 January 2015. Also available at: http://www.frontierweekly.com/articles/vol-47/47-25/47-25-Not%20Out%20Of%20Greece.html#sthash.yQN3xKtv.dpuf

Chandra Kant Raju (2015a), “Frontline’s Calculus of Caste”; Kafila, 14 April 2015. Also available at: http://kafila.org/2015/04/14/frontlines-calculus-of-caste-c-k-raju/

MeghnadSaha (1952), “The Reform of Indian Calender”; Science and Culture; Vol. 18 No. 2; also published as a pamphlet.

Rajnath Singh (2015),Access the site:

http://www.ibtl.in/blog/2041/modern-physics-found-its-direction-from-vedanta-philosophy