চিলিতে রবীন্দ্রনাথের উত্থানের ইতিহাস

মিস্ত্রাল, নেরুদা এবং রামিরেসের পাশাপাশি চিলের আরেক লেখকের নামটিও জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের সাথে, তিনি আর্তুরো তররেস রিওসেকো। চিলেতে রবীন্দ্র-ভোগের পুরো ঘটনাক্রমের তিনি যেমন পর্যবেক্ষক তেমনি এর এক সংক্ষিপ্ত রূপরেখারও প্রণেতা তিনি; ‘চিলেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নামে এক প্রবন্ধে রয়েছে সেই রূপরেখা। এছাড়া তাঁর আরও দুটো প্রবন্ধের বইয়েও আমরা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখিত হতে দেখব রবীন্দ্রনাথের কথা।

নেরুদা কিংবা মিস্ত্রালের মতো ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী তিনি ছিলেন না বটে, তবে লাতিন আমেরিকার আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার ধারাটিকে যারা বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরেন তিনি তাদের অন্যতম। আঞ্চলিকতাবাদের বাইরে দাঁড়িয়ে সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে বিশ্ববোধের অনুভূতি যুক্ত করে তিনি লাতিন আমেরিকার সমালোচনা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। এই বিশ্ববোধের কারণেই হয়তো মিস্ত্রাল তাকে অভিহিত করেছিলেন ‘চিলের বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্ব’ (El Chileno universal)।

বিশ্ববোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত এই লেখকের জন্ম ১৮৯৭ সালের ১৭ অক্টোবরে চিলের তাস্কায় (Tasca)। পেশায় ছিলেন অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক। অধ্যাপনার বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে আমেরিকার মিনেসোটা, কলম্বিয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে যে কাজগুলোর জন্য তিনি লাতিন আমেরিকার সমালোচনা সাহিত্যে স্মরনীয় হয়ে আছেন সেগুলো হচ্ছে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ও লেখকদের নিয়ে তার প্রবন্ধের বইগুলো।

La-Hebra-en-la-Aguja-coverআর্তুরোর অসংখ্য বইয়ের মধ্য থেকে আমরা কেবল তিনটি বইয়ের দিকে তাকাবো, যেখানে তিনি প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনটি বইয়ের একটি ইংরেজিতে লেখা—New World Literature: Tradition and Revolt in Latin America (University of California Press, 1949)—যেখানে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের দিকপালদের নিয়ে আলোচনা রয়েছে। অন্য দুটি স্পানঞল ভাষায় লেখা—Grandes Novelistas de la America Hispanica (Vol 1-2, university of California Press, 1943)  ও La Hebra en la Aguja (Editorial Cultura, 1965)।

গত শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী দুই তিন দশক পর্যন্ত রবীন্দ্র-চর্চার যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল স্পানঞায় এবং লাতিন আমেরিকায় তার কিছুটা তিনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথের যারা প্রবল অনুরাগী ছিলেন তাদের কারো কারো সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা, যেমন হোসে বাসকনসেলোস, পেদ্রো এনরিকেস উবেনঞা এবং সর্বোপরি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। আর চিলেতে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে নেরুদা ও উইদোব্রোর মধ্যেকার সেই তীব্র বিবাদও যে তিনি জানতেন তা কেবল চিলের অধিবাসী হিসেবেই নয়, সাহিত্যের ঐতিহাসিক হিসেবেও সেটা অবধারিত। অবধারিত বলবার কারণ এই যে, লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তার একটা ইঙ্গিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ এক প্রবন্ধে, যদিও উইদোব্রো-নেরুদা বিবাদের কথা তিনি কোথাও উল্লেখ করেন নি।

কালানুক্রমিক হদিস নিলে লক্ষ করব আর্তুরোর লেখায় রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ প্রথমবারের মতো তার Grandes Novelistas de la America Hispanica গ্রন্থে দেখা যাবে। এই উল্লেখ এসেছিল চিলের কবি ও স্থপতি পেদ্রো প্রাদোর লেখা Karez-I-Rohsan (1923) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে। পরে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘চিলেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ শীর্ষক প্রবন্ধেও আরেকবার এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন: “ভীষণ গণ্যমান্য লেখকরাও প্রাচ্যরীতির প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, প্রেদ্রো প্রাদ্রো যিনি ১৯২৩ সালে Karez-I-Rohsan নামে যে বইটি লেখেন তার সাহিত্যিক কণ্ঠস্বরের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রকরণের কাছে রয়েছে ব্যাপক ঋণ।”

Escritores de fuerte prestigio se dejaron tentar por la manera orientalista como en el caso de Pedro Prado, que en 1923 escribe su libro Karez-I-Rohsan, tono literario que debe bastante a la tecnica de Tagore.

(La Hebra en la Aguja, Arturo Torres Rioseco,   Editorial Cultura, 1965, p 26-27)

আর্তুরোর এই পর্যবেক্ষণের আগে পর্যন্ত আমরা রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত কেবল সেই সব লাতিন আমেরিকান লেখকদের কথা জানতাম যারা ইংরেজি অনুবাদে আমাদের কাছে পরিচিত, যেমন নেরুদা কিংবা মিস্ত্রাল। কিন্তু এদের বাইরেও যে আরও কেউ কেউ ছিলেন, হয়তো তারা অপেক্ষাকৃত গৌণ, কিন্তু সমকালে তারা নিজ দেশে ও নিজ ভাষায় ‘ভীষণ গণ্যমান্য’ ছিলেন।


ঐ সময়টায় যেহেতু রবীন্দ্রশৈলী একটা ফ্যাশন হিসেবে চালু ছিল, প্রাদো এবং কাস্ত্রো লেয়াল তাই রবীন্দ্রনাথের মতো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরে তা ব্যতিক্রমধর্মী এবং অপরিচিত এক প্রাচ্য কবির নামে চালিয়ে দেন


প্রাদোকে গণ্য এবং মান্য করার পেছনে তার সৃষ্টিশীলতার অভিনবতা একটা বড় কারণ। স্পানঞল ভাষায় তিনি বহু কাব্যগ্রন্থের প্রনেতা। প্রাদোই প্রথম কবি যিনি চিলেতে ফ্রিভার্স প্রবর্তন করেন ১৯০৮ সালে Flores de Cordo কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। আর ১৯১২ সালে La casa Abandonada কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে প্রবর্তক হয়ে ওঠেন গদ্য কবিতার। এ সবের বাইরেও কবিতা নিয়ে নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, Karez-I-Rohsan তার সেই রকম নিরীক্ষারই এক নজির। এই নিরীক্ষার জন্য তিনি ঋণের হাত বাড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। এই বইয়ের বৃত্তান্তটা আর্তুরোর ভাষায় এরকম :

মেহিকানো লেখক আন্তোনিও কাস্ত্রো লেয়ালের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা এক গদ্য কবিতার বই এটি; এটি আসলে এক সাহিত্যিক ধাপ্পা। বইটির ভূমিকা লিখেছেন পাউলিনা ওর্থ যিনি একই সঙ্গে কবির জীবনী লেখার পাশাপাশি বইটির অনুবাদও করেছেন। ধারণা করা যায় কারেস-ই-রোসান এক ইরানি কবি। ঐ সময়টায় যেহেতু রবীন্দ্রশৈলী একটা ফ্যাশন হিসেবে চালু ছিল, প্রাদো এবং কাস্ত্রো লেয়াল তাই রবীন্দ্রনাথের মতো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরে তা ব্যতিক্রমধর্মী এবং অপরিচিত এক প্রাচ্য কবির নামে চালিয়ে দেন। প্রাদো বইটির উৎপত্তি ও নিয়তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন :

“লক্ষ করেছি যে রবীন্দ্রনাথের নামে এমন অনেক গ্রন্থ রয়েছে যা আমাদের নাগালের বাইরে ছিল না। সামান্যতম গর্ব ছাড়াই মনে হতো যে আমার অনেক কিছুকেই কোনো রকম তুলনা ছাড়াই যে কেউ অস্বীকার করতে পারেন; কিন্তু এই বক্তব্যটা আমার হলে তা তুচ্ছ আর তা রবীন্দ্রনাথের হলে বিস্ময়কর এবং অন্য কারোর হলেও তাই।” (পৃষ্ঠা ১৯৫)

Es un libro de poemas en prosa, escrito en colaboracion con el escritor mexicano Antonio Castro Leal; es una supercheria literaria . La obra esta prologada por Paulina Orth, quien hace ademas la biografia del poeta y la traduccion. Se supone que Karez-I-Roshan es un poeta persa. Como por esos dias estaba de moda el estilo de Tagore, Prado y Castro Leal decidieron hacer algo parecido y atribuirlo despues a un raro y desconocido poeta oriental. Prado explica el origen y fortunas del libro:

Habia notado yo que mucho de lo publicado por la firma de Tagore no era cosa que no estuviera al alcance nuestro. Sin ningun asomo de orgullo creia que las muchas cosas mias podian resistir cualquiera comparacion; pero eso dicho por mi era trivial, y sorprendente dicho por Tagore y otro por el estilo.

Grandes Novelistas de la America Hispanica, Vol 1-2, Arturo Torres Rioseco, university of California Press, 1943, p 195

এই বইয়ের প্রধান চরিত্র কারেস-ই-রোসানের উৎপত্তি হিসেবে প্রাদো আমাদেরকে আরও জানাচ্ছেন যে কারেস একজন কল্পিত আফগান কবি যার রচনা প্রকাশিত হয়েছে মন্তেবিদেওতে বিবলেওতেকা ওর্মুস কর্তৃক। এসবই ছিল আসলে কল্পিত। এমনকি অনুবাদিকা পাউলিনাও একটি কল্পিত চরিত্র। তবে এই বইয়ের সবটাই কল্পিত হলেও এর মর্মে ও প্রকরণে ছিল বাস্তবের রবীন্দ্র-রচনার প্রবল উপস্থিতি।

আরও একবার, আর্তুরো রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করবেন ১৯৪৯ সালে রচিত তার New World Literature: Tradition and Revolt in Latin America গ্রন্থে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন তিনি নিজের বিশ্বাসের বিপরীতে অবস্থানকারী এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সামাজিক কবিতার গুরুত্ব এবং এই ধরনের কবিতার গণবোধ্যতার উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি খানিকটা তীব্র ভাষায় এর প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছেন :

“সামাজিক কবিতার যোগাযোগটা যদি সর্বাধিক গুরুত্বের হয়ে থাকে তাহলে এর চর্চা করাটা আমাদের তরুণ কবিদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। কেবল তীব্র কর্কশ চিৎকারই নিরাবেগ মানুষকে তার আশেপাশের ভয়ংকর দুর্ভোগ আর সীমাহীন অন্যায়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে পারে। যখন পৃথিবীর সৌন্দর্য ধ্বংস হচ্ছে, যখন আদিবাসীরা ন্যায্য অধিকারের জন্য রক্তাক্ত এমনকি মূলোৎপাটিত, যখন মানুষ শোষিত, মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে তখন চিরকালের মতো অন্তর্দর্শী থাকাকে কখনো কখনো কাপুরুষতা এবং ব্যর্থতাবোধ বলে মনে হয়। এমন অবস্থায় নীরব থাকাটা অসম্ভব। আমেরিকার কবি পারেন না, রবীন্দ্রনাথ যেমনটা আশা করেছিলেন, এমন ‘এক বাঁশি হতে যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের ঐকতান’ ধ্বনিত হয়ে উঠবে, বরং সে হবে এক হাতুড়ি, যা জাতীয় স্বার্থে বাখোয়াজ গণনেতাদের ঠোঁটে আঘাত করবে এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী হস্তকে প্রতিহত করবে।” (পৃঃ ১৬৩-১৬৪)

If the communication of social poetry is of the utmost importance, its cultivation should be obligatory for our young poets. Only the most strident cries can awaken impassive man to the existence of the countless injustices and the terrible misery that surround him. It seems cowardice, defeatism, at  times, to remain eternally introspective while people are suffering, while man is exploited, while the Indian is bled of his rightful possessions and deprived even of his soul, while the world is being ravaged of its beauty. It is impossible to remain silent. And the poet of America must not be, as Rabindranath Tagore desired, “ a flute through which passes the harmony of the world,” but rather a hammer which strikes the lips of the demagogue and the grasping fingers of the trafficker in national honor.”

(New World Literature: Tradition and Revolt in Latin America, Arturo Torres Rioseco,  University of California Press, 1949, p 163-64)

আর্তুরো যে প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন তাতে করে মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ বুঝিবা মানুষের এ ধরনের দুর্ভোগ ও যন্ত্রনায় নীরব ও উদাসীন এক কবি। এ ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ কর্কশ চিৎকারপূর্ণ কবিতা হয়তো লেখেন নি কিন্তু তাই বলে নীরব বা উদাসীন কখনোই ছিলেন না। কবিতায় যেমন, তেমনি প্রবন্ধে বক্তৃতায় তিনি মানুষের—তা সে মানুষ যত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরই হোক না কেন—অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন। আর্তুরোর নজরে তা পড়ে নি হয়তো। যাই হোক, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য, রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ব্যবহারের যথার্থতা নিরূপণ, বরং দেখতে চাই রবীন্দ্রনাথ কিভাবে এবং কী প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছেন আর্তুরোর লেখায়।

আর্তুরো তররেস সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ করেন ১৯৬৫ সালে La Hebra en la Aguja (সুইয়ে সুতা) গ্রন্থে। ১৭৪ পৃষ্ঠার এই বইটিতে পেদ্রো এনরিকেস উরেনঞা, হোসে বাসকনসেলোস, আলফনসো রেইয়েস, লেওপোল্দো লুগোনেস, আমাদো নের্বো, হোসে হুয়ান তাবলাদা, কাররাসকিহয়া, পাবলো নেরুদা, এররেরা ই রেইসিংসহ লাতিন আমেরিকার প্রথম সারির কবিদের সম্পর্কে স্বতন্ত্র প্রবন্ধের পাশাপাশি ‘চিলেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধও এতে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তার আগের উল্লেখ থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রাচ্যের এই কবির প্রতি লাতিন আমেরিকার অন্য লেখকদের মতো মুগ্ধতা তার ছিলো না। যদিও লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের উত্থানের পরম্পরা ও চর্চা তিনি মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু নিজে কখনো এই পরম্পরার অংশ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি কোনো আকর্ষণ বা মুগ্ধতা ছাড়া তিনি কেন হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লিখেছেন সেটা জানার কৌতূহল থেকেই আমাদের হাতে অজানা এমন কিছু তথ্য এসেছে যাতে এই কৌতূহলের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে।


বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, তার মতে রবীন্দ্রনাথের লেখা অতিমাত্রায় মরমী


রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি এন. চ্যাটার্জি নামের এক ভারতীয় ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যিনি লন্ডন থেকে তাকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি চিঠি লিখেছেন। এই এন. চ্যাটার্জি আসলে, নিমাই চট্টোপাধ্যায়। কবি শঙ্খ ঘোষ এবং অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বন্ধু তিনি। বহুদিন থেকেই তিনি লন্ডন-প্রবাসী। রবীন্দ্র-ভক্ত নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের বহুদিনের একটা পরিকল্পনা ছিলো পশ্চিমের বিভিন্নভাষী শীর্ষস্থানীয় লেখকদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত লেখা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করার। সেই উদ্দেশ্যে তিনি লেখা চেয়ে চিঠি লিখেছেন বহুজনকে। বার্ট্রান্ড রাসেল, আর্নল্ড টয়েনবি, ই. এম. ফর্স্টারের মতো লেখকরা তাতে সাড়াও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে যা অজানা ছিলো তা হলো স্পানঞল ভাষায় লেখক অধ্যাপকদের কাছেও তিনি লেখা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। যে পেরেস আইয়ালা স্পানঞল ভাষার ১৯১৩ সালের শেষের দিকে প্রথম রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্পানঞার ‘লা ত্রিবুনা’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাকেও নিমাই বাবু ১৯৫৭ সালের ২২ আগস্ট একটি চিঠি দিয়ে লেখা চেয়েছিলেন। এই চিঠির একটা স্পানঞল সংস্করণ প্রকাশ করেছেন প্রাবন্ধিক গবেষক আগুস্তিন কোলেতেস ব্লাঙ্কো। আর্তুরোকে লেখা চিঠির উল্লেখ থেকে এখন নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে একই রকমভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি লেখা চেয়ে নিমাই আর্তুরোকেও চিঠি দিয়েছিলেন। পেরেস আইয়ালা শেষ পর্যন্ত লেখা দিয়েছিলেন কিনা তা আমরা এখনও জানি না, কারণ নিমাই চট্টোপাধ্যায় তার পরিকল্পিত বইটি জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে পারেননি। আর্তুরো তররেস রিওসেকোও নিমাই বাবুর অনুরোধে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছিলেন কিনা তাও নিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না নিমাই বাবুর বইটি বের হয়। আমার ধারণা ‘চিলেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নিমাই বাবুর অনুরোধে সাড়া দিতে গিয়েই লিখেছেন। আর্তুরোর এই প্রবন্ধটি স্পানঞলভাষী অন্যান্য লেখকদের লেখা থেকে একটু আলাদা এই কারণে যে এতে তিনি রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন উপর গুরুত্ব দেন নি, বরং চিলেতে রবীন্দ্রপ্রভাবের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেছেন মাত্র। প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি বলেছেন:

আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্র-প্রবাহ এমন এক স্তরে নেমে এসেছে যে সাহিত্যের ইতিহাস সবেমাত্র এই ঘটনা স্মরণ করছে। সমসাময়িক ভাবুকদের মধ্যে প্রতিনিধিত্বশীল কেউ কেউ তার সম্পর্কে কী ভাবছেন তা লক্ষ করাটা বেশ কৌতূহলোদীপক। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, তার মতে রবীন্দ্রনাথের লেখা অতিমাত্রায় মরমী। কবির অতি মূল্যায়নকারী আর অবমূল্যায়নকারীদের মাঝে মধ্যবর্তী ভূমিকায় অবস্থিত ই. এম. ফর্স্টার লেখেন: “পশ্চিমে তার কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষম, যদিও এ অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের নিজেরই করা।” আর আর্নল্ড টয়েনবি নিশ্চিত করেন এই বলে যে, সাহিত্যের নানান ধারায় বহুকিছু আসে এবং হারিয়ে যায় কিন্তু তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনার থাকবে এক স্থায়ী প্রভাব।

প্রথম জন ইঙ্গিত করছেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এখনও তারিফ করার মতো লোক আছেন আর টয়েনবি যখন কবির সমকাল পেরিয়ে প্রভাবের কথা বলেন তখন খানিকটা ঠিকই বলেন, কারণ এর মানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত প্রকরণ ও বিষয়বস্তুকে আর বুঝাচ্ছে না, বরং ১৯১৩ সালে ভারতীয় কবি নোবেল পুরস্কারের পরপর ইউরোপ ও আমেরিকায় যে দার্শনিক ও নান্দনিক ভাবনাধারার আবির্ভাব ঘটে তাকেই বুঝানো হচ্ছে। আমাদের কাছে অবহেলিত এই প্রবণতার যথাযথ গবেষণা হওয়া দরকার। প্রথম সারির আন্দোলনগুলো, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদের সাফল্যের পর ইস্পানো জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে অস্বীকার করা সহজ, কিন্তু লাতিন আমেরিকা ও স্পানঞাতে গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হুয়ান রামোন হিমেনেথ, নেরুদার কিছু কবিতা এবং বিপুল সংখ্যক গৌণ লেখকদের লেখা পড়ার পর এই প্রভাবের অনুপস্থিতিকে প্রমাণ করা কঠিন।”

La boga de Tagore en nustras literaturas ha declinado a tal punto que las historias  de la literatura apenas lo recuerdan. Es interesante observer lo que piensan sobre el algunos representantes  del pensamiento contemporaneo. Bertrand Russell dice que los escritos de Tagore son demasiado misticos para su gusto; E. M. Forster, que esta colocado en un punto intermedio entre los campeones y los detractores del poeta, escribe: “ Su poesia no es communicable en traduccion al Occidente , aunque esa trduccion haya sido hecha por el mismo Tagore”; y Arnold Toynbee asegura que “en tanto que las modas literarias vienen y van, su obra tendra una influencia perdurable.”

Lo anterior indica que Rabindranath Tagore todavia tiene admiradores y que Toynbee tiene alguna razon al referirse a una influencia que va mas alla de su tiempo, porque ya  no se trata de las formas y de las temas cultivados por Tagore mismo sino de una corriente de pensamiento filosofico y estetico que hace su aparacion en Europa y America despues de 1913, año en que el poeta hindu recibio el Premio Nobel. Esta tendencia, que ha sido descuidada entre nosotros, necesita ser estudiada con precision. Es muy facil negar la influencia de Tagore en el mundo hispanico despues del triunfo de las literaturas de vanguardia, en especial del surrealismo, pero es mas dificil probar que esa influencia no existio, al leer a Gabriela Mistral, Juan Ramon Jimenez, algunos poemas de Pablo Neruda, y un gran numero de escritores de menor talla, en America y en España.

(La Hebra en la Aguja, Arturo Torres Rioseco,   Editorial Cultura, 1965, p 22-23)

নেরুদা এবং হিমেনেথের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা আমরা মোটামুটি অবগত অনেক আগে থেকেই এবং মিস্ত্রালের উপর প্রভাব নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা না হলেও ভাসাভাসা-ভাবে এ বিষয়ে আমরা শুনে আসছি এতদিন যাবৎ। তবে আর্তুরোর আগে পর্যন্ত মিস্ত্রালের উপর প্রভাবের এই ব্যাপ্তি সম্পর্কে আসলে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু মিস্ত্রাল বা চিলেই নয়, আর্তুরো মনে করেন গোটা মহাদেশই এই প্রভাবের আওতায় চলে এসেছিল। আর্তুরোর আঁকা প্রভাবের এই মানচিত্রটি এ রকম:

বাঙালি কবির ধারাটা শুরু হবে স্পানঞায় সেনঞরা কামপ্রুবির অনুবাদগুলোর (১৯১৫) মাধ্যমে। ১৯১৭ সালে বলিবিয় লেখক মাদ্রিদে প্রকাশ করেন গীতাজ্ঞলির একটি অনুবাদ যার কাটতি নিশ্চয়ই (লাতিন) আমেরিকায়ও হওয়ার কথা। এরপর স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হয় তার সমাদর, একেবারে মেহিকো থেকে শুরু করে বুয়েনোস আইরেস পর্যন্ত। অসংখ্য বক্তৃতা, ভিন্ন ভিন্ন কবিতার অনুবাদ, দৈনিক এবং সাহিত্য সাময়িকীতে নানা প্রবন্ধ আর সবশেষে নীরস ভঙ্গিতে চলতে থাকে রবীন্দ্রশৈলীর বিরামহীন অনুকরণ যা মেজাজে যতটা না কাব্যিক তার চেয়ে বেশি বক্তব্যধর্মী। ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন সব ধরনের লোক যেমন, ধর্মীয় সংস্কারক, ধর্মযোদ্ধা, বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, স্কুলশিক্ষক, মরমী এবং ত্রাণকর্তায় বিশ্ববাসী কবিকুলকে আকৃষ্ট করেছিল রবীন্দ্রনাথের গদ্যের প্রতীকী ধরন।

la boga del poeta Bengali empezara en España con las traducciones de la señora Camprubi (1915). En 1917 el escritor boliviano Abel Alarcon publico en Madrid una traduccion del Gitanjali que debio de haber tenido alguna circulacion en America. Despues empezo a surgir el culto local, desde Mexico hasta Buenos Aires. Conferencias, traducciones de poemas aislados, articulos en revistas y periodicos, y por fin la constante imitacion del estilo Tagore en composiciones casi siempre insulsas, de tono mas profetico que poetico. Toda la gente que poseia espiritu apostolico: reformadores, cruzados, filosofos en ciernes, pedagogos, maestros de escuela, misticos poetas mesianicos, se sintieron atraidos por la forma simbolica de la prosa de Rabindranath Tagore.

(La Hebra en la Aguja, Arturo Torres Rioseco,   Editorial Cultura, 1965, p 23)

আর্তুরোর এই উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে প্রভাবটা কেবল একটি দেশে নয়, নয় কেবল সাহিত্যের অঙ্গনে, মূলত সংস্কৃতির নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিলো রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। সুতরাং গোটা লাতিন আমেরিকায় সংস্কৃতির নানান স্তরে রবীন্দ্রপ্রভাবের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রটি পেতে হলে দরকার ব্যাপক অনুসন্ধান। এটা অসম্ভব না হলেও বেশ দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে আর্তুরো পদ্ধতিবিষয়ক পরামর্শ হিসেবে বলেছেন: “স্পানঞলভাষী প্রতিটি দেশে এ বিষয়ক গ্রন্থের একটা পঞ্জি তৈরির মাধ্যমে শুরু করতে হবে; ১৯১৫ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাগুলো অনুসরণ করা এবং সবশেষে এই ধরনের অভিব্যক্তি ও বিষয় আমাদের পরিবেশে যে সব কারণে অজনপ্রিয় হয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করা।”

Habria que comenzar con una bibliografia de la materia, en cada pais de lengua castellana; seguir con un estudio de la poesia que aparece entre 1915 y 1930 y determinar por fin las causas que hacen impopular en nuestro ambiente este tipo de expression y de tematica.”

(La Hebra en la Aguja, Arturo Torres Rioseco,   Editorial Cultura, 1965, p 23)

সন্দেহ নেই যে পদ্ধতি হিসেবে এটি ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে। কিন্তু সহজ নয় সমগ্রকে হাতের মুঠোয় পাওয়া। তবে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করার অসম্ভবতা সত্ত্বেও তিনি চিলের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব ও প্রভাবের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র ও ভাষ্য হাজির করেছেন তার প্রবন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে:

“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিমত প্রজন্মগত আবেগে রঞ্জিত। রবীন্দ্রনাথের গৌরবের মধ্যগগনের সময়টাতে আমার সাহিত্যিক জীবনের শুরু। সেনোরিয়া কামপ্রুবির অনুবাদসমূহের কারণে এবং তার স্বামী হুয়ান রামোনের কদরের ফলে ভারতীয় কবির নামটি গোটা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তার ধর্মীয় দর্শন, প্রপঞ্চসমূহের বিন্যাসকারী অনির্বচনীয় শক্তি ও সৃষ্ট সবকিছুতে এবং জগতের ঐকতানে তার বিশ্বাস, অবিনাশী মৌল উপাদানে তার আস্থা, প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসা—এগুলো এমন কিছু বৈশিষ্ট্য যা প্রতীকবাদ-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গৃহীত হয়েছিল। আমরা যারা ১৯১৮ সালে আমাদের সাহিত্যিক জীবন শুরু করেছিলাম তারা তার রহস্যময় সংগীতিক সুর, বিশুদ্ধ ভাববাদ ও অনবদ্য প্রকরণশৈলীকে অল্প সময়ের জন্য নিজেদের করে নিয়েছিলাম। আমরা তার কল্পনাধর্মী রূপক ও প্রতীকবাদকে গ্রহণ করেছিলাম এবং চর্চা করেছিলাম নতুন নতুন বিষয়ে পরিপূর্ণ কবিতার, যেমন মাটির মগ, মাটির জগ, প্রদীপ, বাঁশের বাঁশি, বীজ, কলি, শস্যের আঁটি, ইত্যাদি। এগুলোর সাথে সম্পর্কিত ক্রিয়া ও বিশেষণের সম্পর্ক রেখেই তা করতাম। তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রূপকও আমরা নিয়েছিলাম। যেমন, জগতের নতুন বীণা, গানের পবিত্র ধারা, বোধের নতুন দরজা, স্মৃতির পাখি ইত্যাদি।


স্পানঞল ভাষার জগতে আজ আর কেউ-ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করেন না। এই বছর কয়েক আগেও তার কবিতা স্কুলের বইগুলোতে পাঠ্য ছিল। আজ তার সেটাও নেই


সে সময় আমরা মনে করতাম রবীন্দ্রনাথ একটা নতুন বার্তা নিয়ে এসেছেন, নিয়ে এসেছেন মিষ্টি ও অদ্ভুত কবিতা আর আমরা তার অনুকরণ করতাম নির্লজ্জের মতো এবং কেউ কেউ তো এক্ষেত্রে কোনো সীমারেখাই মানে নি। স্পানঞা এবং ইস্পানো-আমেরিকায় তার জনপ্রিয়তা ছিলো বিপুল আর কী অদ্ভুত ব্যাপার, কোনো বড় কবির উপরই তার প্রভাব গভীর এবং স্থায়ী ছিল না। তবে পাঠকদেরকে প্রভাবিত করেছিল ঠিকই, বিশেষ করে কোনো-এক-কারণে রোমন্টিক লোকজন, স্কুল-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী, আবেগপ্রবণ নারী, নব্যপ্লাতোন গৌণ কবিকুল এবং শিশু-কিশোরদের জন্য লেখিকারা তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আজ, মনে হয় এই প্রভাবটা আর নেই। আমি নিশ্চিত যে হুয়ান রামোন হিমেনেথ, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং পাবলো নেরুদা কবিতার এই ধরনটাকে অবিলম্বে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মনে হয় না বাইয়ে ইনক্লান, আসোরিন, কিংবা মিরো এর শিকার হয়েছিলেন। নের্বোর মরমীবাদ একই ধরনের কবিতা উপহার দিতে পারত। সম্প্রতি-বিস্মৃত মধ্য আমেরিকায় গৌণ কিছু কবি হয়তো হাস্যকর প্যারোডির মাধ্যমে অনুকরণ করেছিলেন তার। প্রথম সারির নারী কবি হুয়ানা দে ইবারবোউরোউ, আলফনসিনা স্তোর্নির উপর রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রভাব দেখি না। যাই হোক, স্পানঞল ভাষার জগতে আজ আর কেউ-ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করেন না। এই বছর কয়েক আগেও তার কবিতা স্কুলের বইগুলোতে পাঠ্য ছিল। আজ তার সেটাও নেই।”

Mi opnion personal acerca de Rabindranath Tagore esta teñida de fervor generacional. Yo naci a la vida literaria cuando Tagore estaba en el apogeo de su gloria. Con las traducciones de Zenobia Camprubi y la admiracion de su esposo, Juan Ramon, el nombre del poeta hindu se difundio por todo el continente. Su filosofia religiosa, su creencia en la armonia del universo, en la unidad esencial de todo lo creado, en el poder inefable que ordena los fenomenos, su fe en un elemonto vital indestructible, su amor a la naturaleza, fueron caracteristicas aceptadas por una generacion que venia detras del simbolismo. Nosotros –los que empezamos nuestra vida literaria por 1918—adoptamos temporalmente su estilo de exquisite forma, de un puro idealismo y de un misterioso tono musical. Nosotros aceptamos sus alegorias y su simbolismo imaginistico, y cultivamos una poesia llena de objetos nuevos: vasos de arcilla, cantaros, lamparas, flautas de caña, simientes, capullos, gavillas, etcetera, con sus correspondientes verbos y adjetivos; y tomamos de el una gran cantidad de metaforas, como el arpa neuva del mundo, el arroyo sagrado del canto, las puertas de los sentidos, los pajaros del recuerdo, etcetera.

Nuestra opinion en aquel tiempo era que Tagore traia un nuevo mensaje, una poesia dulce y extraña y le imitamos sin rubor y algunos sin medida. Su popularidad fue grande en España y en Hispanoamerica y Cosa curiosa! No ejercio influencia profunda o duradera en ningun gran poeta. La ejercio si en los lectores, sobre todo en la gente romantica, cruzados de una causa, maestras de escuela, estudiantes, señoritas sentimentales, pequeños poetas neoplationicos, poetisas adolescentes. Hoy, creo que esa influencia ha pasado. Estoy seguro de que poetas como Juan Ramon Jimenez, Gabriela Mistral, Pablo Neruda, trataron de olvidar muy pronto esa moda poetica. No creo que Valle Inclan, ni Azorin, ni Miro fueran victimas de ella; el misticismo de Nervo podria ofrecer cierta concepcion similar de poesia; algunos poetas menores de Centroamerica, hoy olvidados, acaso le imitaran en parodias ridiculas. No veo nada de Tagore en las poetisas mayores: Juana de Ibarbourou, Alfonsina Storni. Sea como fuere, hoy ya nadie se acuerda en el mundo de lengua española de Rabindranath Tagore. Hasta hace algunos años sus poemas todavia aparecian en antologias escolares. Hoy, ni siquiera eso.

এটা ঠিক যে এখন তিনি আর পাঠ্যপুস্তকে নেই, নেই প্রধান বা গৌণ কবিদের উদ্দীপক হিসেবেও। তবে পুরোপুরি বিলীনও হয়ে যান নি রবীন্দ্রনাথ লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের পাঠ্যতালিকা থেকে। সাংস্কৃতিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান দুটি দেশ মেহিকো এবং আর্হেন্তিনা থেকে এখনও প্রায় প্রতি বছর তার কোনো না কোনো গ্রন্থের নতুন নতুন সংস্করণ বের হচ্ছে। স্পানঞা থেকেও বেরুচ্ছে তার বই। সাধারণ মানুষের কাছে যে তার চাহিদা এখনও ফুরিয়ে যায় নি তার কিছু নমুনা হিসেবে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রক্ষিত কয়েকটি বইয়ের প্রকাশ তারিখসহ উল্লেখ করতে চাই।

Tagore book cover-1 বর্তমান নিবন্ধটি যে বই থেকে সংগৃহীত

স্পানঞার Edicomunicaciones প্রকাশনী থেকে হোর্সে রোতনের-এর অনুবাদে ১৯৯৯ সালে বেরিয়েছে Rabindranath Tagore: Obras Escogidas (নির্বাচিত রচনা) যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে Gitanjali, The Gardener, Stray Birds এবং The Crescent Moon নামক কাব্যগ্রন্থগুলো। স্পানঞা থেকেই ১৯৯৮ সালে Biblioteca EDAF থেকে মাউরো আরমিনঞার অনুবাদ ও ভুমিকাসহ El jardinero (The Gardener) প্রকাশিত হয়। স্পানঞারই আরেক প্রকাশনী Edimat Libros থেকে একই গ্রন্থ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ইবানা গ্রাসিয়েলা মাইয়ো’র দীর্ঘ ভুমিকাসহ। অনুবাদকের নামের কোনো উল্লেখ নেই এতে। স্পানঞার Los Pequeños libros de la Sabiduria সিরিজ থেকে Herbert F. Vetter কর্তৃক নির্বাচিত, Albert Schweitzer-এর ভুমিকাসহ এস্তেবে সেররার অনুবাদে Del Alba al Crespusculo (উদয়াস্ত, এটির ইংরেজি শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে The heart of God,  পাশাপাশি ফরাসি ভাষায় লেখা রয়েছে De l’aube au crespuscule; সম্ভবত ফরাসি শিরোনামের অর্থ ধরে স্পানঞল ভাষায় এই শিরোনাম) নামে একটি বই প্রকাশিত হয়—প্রথম সংস্করণ ২০০০ সালে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৬ সালে। মাদ্রিদের Alianza Editorial প্রকাশনী আজও সেনোবিয়া কামপ্রুবি আর হুয়ান রামোন হিমেনেথের যৌথ অনুবাদগুলো বের করে যাচ্ছে। El cartero del rey , El asceta , El rey y la reina শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের তিনটি নাটকের সংকলনটি ১৯৮৩, ৮৬, ৯১, ৯৪, ৯৫, ৯৭, ২০০৪ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। এদেরই অনুবাদে একই প্রকাশনী থেকে La Cosecha, Regalo de amante, Transito, La fujitiva শিরোনামে চারটি কাব্যগ্রন্থের সংকলনটি ১৯৮৪ , ৯৪, ৯৬ এবং ২০০৫ সালে প্রকাশি হয়। সেনোবিয়া-হিমেনেথের অনুবাদে তারা Ciclo de la Primavera শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের নাটকের বইটি প্রকাশ করে ১৯৮৩, ১৯৯৫ এবং সর্বশেষ ২০০৭ সালে। একই অনুবাদক ও একই প্রকাশনী থেকে Las piedras hambrientas শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় প্রথমে ১৯৮৪ সালে এবং পরে ২০০৮ সালে। স্পানঞার Edicomunicacion থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনী হচ্ছে চার খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ও উপন্যাসসহ ২৪টি গ্রন্থের সংকলন Rabindranath Tagore: Obras Selectas (নির্বাচিত রচনা), যার মোট পৃষ্টা সংখ্যা ১৯০০। এটি প্রথমে ১৯৮৬, পরে ১৯৮৮, ১৯৯৯ এবং সর্বশেষ বেরিয়েছে ২০০৩ সালে। এরকমই চার খণ্ডে রবীন্দ্ররচনার আরেকটি সংকলন ২০১০ সালে প্রকাশ করেছে Frente y Vuelta প্রকাশনী। Obras Selectas শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের নাটক, উপন্যাস ও কবিতাসহ ১০টি গ্রন্থের একটি সংকলন ফ্রান্সিস্কো কাউদেত ইয়ার্সার ভুমিকাসহ প্রথমে ২০০১ এবং পরে ২০০৪ সালে আরেকটি সংস্করণ প্রকাশ করে Edimat প্রকাশনী। আর্হেন্তিনার Longseller প্রকাশনী থেকে Camino Espiritual শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের একটি বই বের হয় প্রথমে ১৯৯৯ সালে পরে ২০০৪ সালে পরিবর্ধিত সংস্করণে আবারও বের হয়। মেহিকোর Editores mexicanos unidos রাফায়েল দাবিদ হুয়ারেস ওনঞাতে-এর ভূমিকাসহ El cartero del rey, La Luna nueva, El jardinero, y otros শিরোনামে একটি সংকলন প্রথমে ১৯৯৮ সনে এবং পরে ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নাটক, গল্প ও কবিতাসহ মোট চারটি গ্রন্থ। এই প্রকাশনী এর আগে Cuentos শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি বই বের করেছিলো। মেহিকোর জনপ্রিয় প্রকাশনী Editorial Porrua থেকে ১৯৬৫ সালে La luna nueva, El jardinero, El cartero del Rey, Las piedras Hambrientas y otros cuentos শিরোনামে Sepan Cuentos সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালে বের হয় এর ১৩তম সংস্করণ। এই সংস্করণের মুদ্রণ সংখ্যা ৫০০০ উল্লেখ করা হয়েছে। দানিয়েল মোরেনোর দীর্ঘ ভূমিকাসহ এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের The Crescent Moon, The Gardener, ডাকঘরক্ষুধিত পাষাণ গ্রন্থগুলো। আর্হেন্তিনার Lumen প্রকাশনী থেকে শিশুদের জন্য Minilibros de autoayuda সিরিজে El supreme bien, El amor y la infancia এবং Como alcanzar la sabiduria শিরোনামে তিনটি বই বেরিয়েছিল ১৯৯৫ সালে । রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাকে সচিত্রকরণের মাধ্যমে লিদিয়া মারিয়া রিবা’র অনুবাদে vergara & Riba Editoras নামক আর্হেন্তিনার প্রকাশনী থেকে Una cancion para mi hijo বেরিয়েছিল প্রথমে ২০০৩ সালে এবং পরে ২০০৪ সালে মার্চে আরেকটি সংস্করণ ।

এখানে হাতের কাছে যা পাওয়া গেল কেবল সেটুকু উল্লেখ করা হলো। আমি নিশ্চিত এর বাইরেও আরও বহু গ্রন্থ আছে যার হদিস নিতে গেলে এক দীর্ঘ গ্রন্থপঞ্জি হয়ে দাঁড়াবে।

এ ছাড়া তার বিভিন্ন কবিতার শিশুতোষ সংকলন তো আছেই, যা প্রতি বছরই বের হচ্ছে। এই সংক্ষিপ্ত তালিকাটি দেয়ার উদ্দেশ্য কেবল এটা দেখানো যে সাধারণ পাঠকদের কাছে তিনি এখনও আত্মার খোরাক হয়ে আছেন।