রবীন্দ্রনাথের শেষজীবন - অপরাহ্ণে পারের খেয়া ঘাটে

সমুখে শান্তি পারাবার

৩২ শ্রাবণ ১৩৪৮ (১৭ আগস্ট ১৯৪১)। রবিবার। এলোমেলো হাওয়া আর বৃষ্টিসজল ছিল সেদিনটা। আগের রাত থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কবির ভাষায় বলতে গেলে – ‘সজল হাওয়া বহে বেগে…আকাশ ঘেরে কাজল মেঘে।’ শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপাসনা বেদির পাশেই। কবির পারলৌকিক কর্মের বেদিটি নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ করের পরিকল্পনায় রচিত হয়েছিল। ‘শান্ত হোক, স্তব্ধ হোক, স্মরণসভার সমারোহ / না রচুক শোকের সম্মোহ’ — কবির ইচ্ছা ও অনুজ্ঞানুযায়ী খুব অনাড়ম্বর ভাবে। শ্রাদ্ধকর্তা ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। সব শেষে গরীব-দুঃখীদের অন্নগ্রহণ ও বস্ত্রদান ছিল।  

শুরুতে ‘তোমারি ইচ্ছা হউক পূর্ণ, করুণাময় স্বামী’ গানটি গাওয়া হয়। আরও কিছু গান, প্রার্থনা, উপনিষদের সূক্ত পাঠের পরে ক্ষিতিমোহন সেন এবং বিধুশেখর শাস্ত্রী একসঙ্গে ঋক্‌মন্ত্র পাঠ করেন। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় আশ্রমিকদের ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই’ গানের মধ্যে দিয়ে। তাঁরই সৃষ্টি ছিল তাঁর অধ্যাত্মকৃত্যের তর্পণ।

এর ১০ দিন আগে ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট) অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন কবি। পরের দিন সন্ধ্যায় তাঁর চিতাভস্ম নিয়ে আসা হয়েছিল শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীতে। বুকের কাছে চিতাভস্মের কাঁসার কলশিটি ধরে প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে নিয়ে আসেন বিশ্বভারতীর আশ্রম-সচিব সুরেন্দ্রনাথ কর। পিছনে বাকিরা নিঃশব্দে। পথের দু’ধারে স্থানীয় অধিবাসী আর ছাত্র-ছাত্রীরা করজোড়ে নীরব-প্রার্থনারত। উদয়নের সামনের বারান্দায় শ্বেতপাথরের চৌকির উপর পাতা আসনের উপর কলশটি রাখা হয়েছিল। বিশ্ববাসী শোকবিহ্বল। নিজ-রাজ্য, ভারতের বিভিন্ন প্রতিবেশী রাজ্যগুলি ছাড়াও সুদূর প্রবাস থেকেও এসেছিল শোকজ্ঞাপক বার্তা।

রবীন্দ্রনাথের নিরবচ্ছিন্ন শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি, জীবনের বিরাট কর্মযজ্ঞ নিয়ে চর্চার বর্ণমালা আজও অনিঃশেষ। এই লেখা রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছরের সংক্ষিপ্ত খণ্ডচিত্র। 

নিরন্তর স্রোতধারা অজানা সম্মুখে ধায়

১৩৪৩ সাল (১৯৩৬ — ১৯৩৭) 

১৯৩৬ থেকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন নিয়ে একটা বড়ো রদবদল হলো। প্রবল গরমের জন্য পঁচিশে বৈশাখ বিদ্যালয়-আশ্রমে গরমের ছুটি পড়ে যায়। রবীন্দ্র-জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান করলে অনেককেই গরমের ছুটির মধ্যেও থেকে যেত হত। তাই সে বছর থেকে নববর্ষের দিন কবির জন্মদিন পালনের রীতি শুরু হল এবং পাকাপাকিভাবে। ফলে এরপর থেকে বৈশাখে বছরে দু’বার করে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, আরেকদিকে তেমনই নিপাট পারিবারিক একজন। সৃষ্টির পাশাপাশি চলেছে তাঁর সংসারের সবরকম দায়-দায়িত্ব পালন। ওই বছর ২৫ এপ্রিল কবির ছোটোমেয়ে মীরা দেবীর একমাত্র মেয়ে নন্দিতার বিয়ে হলো কৃষ্ণ কৃপালিনীর সঙ্গে। এই বিয়ে উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে তিনি ‘পত্রপুট’ কাব্যটি নতুন দম্পতিকে উপহার দিলেন। এরপর ৭ মে, ১৯৩৬-এ রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে উঠলেন বরাহনগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়িতে। কলকাতায় আশ্রমিক সংঘের উদ্যোগে কবির জন্মজয়ন্তীতে আগত অতিথিদের কথা ভেবে প্রবল ঝড়জলের দুর্যোগ উপেক্ষা করেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। বরাহনগরে থাকতেই ২৩ মে একই দিনে লিখলেন দুটি কবিতা —  ‘দ্বৈত’ ও ‘শেষ প্রহরে’।

কবি শান্তিনিকেতন যখন ফিরলেন, তখন সেখানে প্রচণ্ড দাবদাহ। সঙ্গে জলকষ্ট। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, কালীমোহন ঘোষ, নিশাপতি মাঝি প্রমুখ একটি বড়ো জলাশয়ের ব্যবস্থা করে জলাভাব মেটাতে উদ্যোগী হলেন। রবীন্দ্রনাথ এই মহৎ কাজে কয়েকশো টাকা অনুদান দেন। এই সময়ই তাঁর চেষ্টায় বিশ্বভারতীতে লোকশিক্ষা চালু হয়।

গ্রীষ্মের ছুটির অবকাশে রবীন্দ্রনাথ নিজের মনে লিখে চলেছেন, পড়াশুনো করছেন, ছবি আঁকছেন। চিঠিপত্রের আদান-প্রদান তো আছেই। বরাহনগরে থাকাকালীন যে-কাব্যগ্রন্থের সূচনা হয়, তা শেষ হয় জুলাইতে। গদ্যছন্দে লেখা ‘শ্যামলী’। আসলে কবি তখন শান্তিনিকেতনে মাটির বাড়ি ‘শ্যামলীতেই’ বাস করছেন। বইটি উৎসর্গ করেন রানী মহলানবিশকে। তিনি আবার কলকাতায় এসে ১৫ জুলাই টাউনহলে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সভায় যোগ দেন। বর্ষায় কবির কলমে ফুটে উঠল ‘খাপছাড়া’ কবিতা, যা তিনি দিয়ে যান রাজশেখর বসুকে।

এল বার্ষিক ‘বর্ষামঙ্গল’ ও বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান। সেবারে এই অনুষ্ঠান হয়েছিল ভুবনডাঙায়। কবি ‘ঐ মালতীলতা দোলে’ সমেত আরও দুটি গান সংযোজন করে দিলেন। ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬-এ আবার কলকাতায় এলেন বরাহনগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়িতে। উদ্দেশ্য, খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া। কিন্তু জীবনের প্রান্তিককালেও রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন বিশ্রাম পাননি, হয়তো চানওনি। বিশ্রামের জায়গায় আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্বাধীনতাকামী নারী সংগঠনের জন্য অভিভাষণ লিখছেন, কখনো যোগীন্দ্রনাথ সরকারের অনুরোধে শিশুদের বার্ষিকীতে ভূমিকা লিখে দিচ্ছেন। ‘সবুজপত্র’-এর যুগ থেকে সেই পর্যন্ত সাহিত্য বিষয়ক সব প্রবন্ধ নিয়ে ‘সাহিত্যের পথে’ বইটির প্রকাশকাল আসন্ন ছিল — তার খুঁটিনাটি দেখা, ভবানীপুর আশুতোষ কলেজে ‘পরিশোধ’ নৃত্যনাট্যের আয়োজন, নিখিলবঙ্গ মহিলা কর্মী সম্মেলনে যোগদান, জওহরলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ১১ অক্টোবর বিকেলে শরৎচন্দ্রের অনুরোধে শরৎচন্দ্রের জয়ন্তী-উৎসবে উপস্থিত থাকা — সবই সমানতালে চলছে। সঙ্গে বিশ্বভারতীর মাঘোৎসবের আয়োজন ও তারই মধ্যে সেই উপলক্ষে ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক’, ‘শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান’ — এরকম তিনটি গান রচনা করলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭-এ পৌরোহিত্য করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এবং বক্তৃতা দিলেন সরাসরি বাংলায়। রবীন্দ্রনাথই প্রথম, যিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

কবির ব্যস্ততায় কেটে যায় দিনগুলি, মন ক্ষণিকের অবসর চাইলেও মুক্তি নেই। বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলনের উদ্বোধন করতে হয়, কখনো রামকৃষ্ণদেবের শতবার্ষিকীতে ভাষণ দিতে হয়, অনুরোধে লিখতে হয় বিশ্বসমস্যা নিয়ে ‘আফ্রিকা’র মতো কবিতা। নববর্ষ ও জন্মদিনকে সামনে রেখে ২৫ চৈত্র লেখেন ‘স্মরণ’ কবিতাটি।

বেলা যে পড়ে এল

১৩৪৪ (১৯৩৭ — ১৯৩৮)

এবারের নববর্ষে কবির জন্মদিন পালন ছাড়াও বিকেলে বিশ্বভারতীর চীনাভবনের দ্বার-উদ্ঘাটন হয়। আসার কথা থাকা সত্ত্বেও জওহরলাল অসুস্থতার কারণে এবং গান্ধীজী জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারেননি। ২৯ এপ্রিল, ১৯৩৭-এ বিশ্বভারতীতে ছুটি পড়লে রবীন্দ্রনাথ গেলেন আলমোড়া। সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, নন্দিনী, নন্দিতা এবং সেক্রেটারি হিসেবে অনিল চন্দ। সঙ্গে নিলেন রাশিকৃত বই আর আঁকার সরঞ্জাম, নন্দলাল বসুর আঁকা স্কেচ। এই স্কেচগুলিকে কেন্দ্র করে লেখা হলো ‘ছড়ার ছবি’, তার সঙ্গে বিজ্ঞানভাবনার ‘বিশ্বপরিচয়।’ লেখালিখির পাশাপাশি চলেছে আঁকা এবং  কুমায়ুনের শিল্পীদের ব্যবহার করা দেশিয় রঙ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আলমোড়ার বাড়িটি বেশ নির্জনে, কবি এই নির্জনতায় খুশি। আলমোড়াতে কবির নিকট প্রতিবেশী ছিলেন অধ্যাপক-কুটিরশিল্পে উৎসাহী বীরবল সাহানী, তিনি কবিকে অনুরোধ করে কবির শেষদিককার কয়েকটি কাব্য ‘দেশী’ কাগজে মুদ্রিত করান। আলমোড়ায় থাকাকালীন কবির জন্মদিন পালিত হলো আড়ম্বরহীনভাবেই। তবে আমেরিকান মেথডিস্ট মিশন-পরিচালিত বালিকা বিদ্যালয় ও ছেলেদের র‍্যাম্‌সে স্কুল পরিদর্শন করতে যেতে হয়। এর দিন কয়েক আগে ২২ বৈশাখ ১৩৪৪ ‘জন্মদিন’ নামে একটি কবিতা লেখেন। আলমোড়া থেকে কলকাতা ফেরার পথে সসঙ্গী কবি কাসমণ্ডার যুবরাজের আতিথ্য গ্রহণ করেন। ২৯ জুন কবি কলকাতা পৌঁছলেন। সেখান থেকে শান্তিনিকেতন।

কবি এই সময় কলকাতার সিটি কলেজের ছাত্র-অধ্যাপকদের অনুরোধে তাঁর অন্যতম প্রিয় আমেরিকার সাহিত্যিক হুইটম্যানকে নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য লেখা লিখলেন। এর সপ্তাহ দু’য়ের মধ্যে ২৬ জুলাই, ১৯৩৭ প্রজাদের আন্তরিক ইচ্ছায় আর নিজের আগ্রহে কবি সুধাকান্ত রায়চৌধুরীকে নিয়ে পতিসরে গেলেন পুণ্যাহ দিনে উপস্থিত থাকতে। সুধাকান্ত চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, সাম্প্রদায়িকতার সেই দুর্দিনে পতিসরে মুসলিমবহুল প্রজাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঠিক কোন্‌ আসনে। মুসলিম প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক সংযোগ এমনই ছিল যে, অতীতের পুরনো কথা বলতে বলতে সেদিন কবি এবং প্রজাদের আনন্দাশ্রুতে চোখ ভিজে যায়।  

পতিসরে থেকে কলকাতায় ফিরে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসব ও সংগীত বিভাগের দায়িত্বভার দিয়ে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি থেকে বোঝা যায়, সেইসময় এই বিভাগটি নিয়ে কবির ভালোলাগা ও সমস্যা — দুই-ই ছিল। ২ আগস্ট ১৯৩৭-এ কবি আন্দামানে দ্বীপান্তরিত রাজনৈতিক বন্দীদের অনশন সংক্রান্ত সহানুভূতি দেখানোর জনসভায় সভাপতি হয়ে টাউনহলে মৌখিক ভাষণ দেন। ১৪ আগস্ট সকালে শান্তিনিকেতনের কাছে সাঁওতাল গ্রামে হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন।

গোয়ালিয়র-মহারাজের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধের পর সবার সঙ্গে কথা বলে নিজের ঘরে গিয়ে কেদারায় বসে রবীন্দ্রনাথ অচৈতন্য হয়ে পড়েন। প্রস্টেট ও কিডনির সমস্যাও মাথাচাড়া দেয়। পরদিনই নীলরতন সরকার এলেন, তাঁর চিকিৎসায় কবি প্রায় ৫০ ঘণ্টার ঘোর কাটিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরে আসেন। এই হতচৈতন্য জগতের থেকে ফিরে আসার মধ্যে এক অধ্যাত্মলোকের রহস্যের অজানাকে তিনি অনুভব করেছিলেন। সুস্থ হবার দশ-বারোদিন পর থেকে এসবই ফুটে উঠেছে তাঁর ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে। অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গীকৃত ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটি প্রকাশিত হয় এই সময়েই।

১২ অক্টোবর, ১৯৩৭-এ রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এলেন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বরাহনগরের বাড়িতে রানী দেবীর তত্ত্বাবধানে প্রায় তিন সপ্তাহ যখন ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন জওহরলাল নেহেরু, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। গান্ধিজিরও আসার কথা ছিল; কিন্তু তিনি হঠাৎ অজ্ঞান ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। গান্ধিজির অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে কবি নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। প্রশান্তচন্দ্রর বাড়িতে একদিন সুভাষচন্দ্রও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তবে এই সময় ‘বন্দেমাতরম’ গানের উপর লেখা একটি চিঠি নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অনভিপ্রেত আক্রমণ ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ইতিমধ্যে ডিসেম্বরের গোড়ায় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এককালের নিবিড় বন্ধু ও গুণগ্রাহী জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ পান। পান শরৎচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদও।

১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮-এ বিশ্বভারতীতে হিন্দি ভবনের ভিত্তিস্থাপন অনুষ্ঠানে শারীরিক কারণে কবি উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাও অসুস্থ শরীরে ‘গীতবিতান’-এর দু’হাজার গানের বর্ণানুক্রমিক সাজানো, খুঁটিনাটি দেখা সবকিছুই সামলেছেন। এই সময় গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ আসে। তাঁর একান্ত আবাল্য সুহৃদ-আপনজনের এই মৃত্যুও তিনি অন্তরে গ্রহণ করলেন। পক্ষাঘাতে গগনেন্দ্রনাথ মূক ও পঙ্গু হয়ে যেভাবে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ১২ মার্চের একটি চিঠিতে রোটেনস্টাইনকে লিখছেন — ‘অক্ষম অবস্থায় শিল্পীর বেঁচে থাকা তো একরকমের মৃত্যু।’ ১৬ মার্চ, ১৯৩৮-এ দোলপূর্ণিমার পরদিন ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যের দল কলকাতা পৌঁছয়। সবার বারণ উপেক্ষা করে নিজের সৃষ্টিকে চাক্ষুষ করবার জন্য কবিও ১৯ মার্চ কলকাতায় আসেন। ‘চণ্ডালিকা’ অভিনয়ের প্রথম দিন সুভাষচন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। এবারের কলকাতাবাসের সময় ২২ মার্চ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির সাক্ষাৎ হয়। 

পূর্বাচলে অস্তাচলে অবসন্ন দিবসের দৃষ্টিবিনিময়

১৩৪৫ (১৯৩৮ — ১৯৩৯)

নববর্ষের দিনে আম্রকুঞ্জে কবির জন্মদিন পালন হলো। কিন্তু সেবছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। কবিমন সেই কারণে অস্থির। ১৯৩৮-এর ২৪ এপ্রিল কবি কালিম্পং যাত্রা করলেন। ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর ‘গৌরীপুর লজ’ কবির বাসের জন্য ছেড়ে দেন। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও তত্ত্বদর্শী শ্রীহীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গ কবির ভালো লেগেছিল। ২৫ বৈশাখ অল-ইণ্ডিয়া-রেডিয়োতে রাত্রি পৌনে ন’টার সময় কালিম্পং থেকে রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মদিন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন, টেলিফোনে সেটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এইদিন তিনি চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবিরশ্মি’ ১ম খণ্ড হাতে পান, এই বইয়ের কিছু সমালোচনা করে লেখককে এক চিঠিতে জানানও। এই সময়ই তিনি ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ বইটি লিখতে শুরু করেন। ১৯৩৮-এর ২১ মে মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ মংপুতে যান। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম মংপু-যাত্রা।

মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, ভোর পাঁচটায় চা খেয়ে রবীন্দ্রনাথ ন’টা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চিঠি লেখা ও ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ বইটি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মংপুতে থাকতে কবি সম্ভবত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মহাভারত সম্পর্কে বক্তৃতা রচনার উদ্যোগ নেন। এছাড়া ‘সেঁজুতি’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’ — এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের তিন-চারটে কবিতাও লেখেন। ৯ জুন মংপু থেকে রবীন্দ্রনাথ কালিম্পং আসেন। এখানেও পড়াশুনো চলতে থাকে, লেখেন ‘অদেয়’, ‘যক্ষ’, ‘মায়া’ কবিতাগুলি। নিজের লেখালিখির পাশাপাশি তৎকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যেরও খবরাখবর রাখেন। এই বয়েসে ক্লান্ত অবসন্ন কবি এক চিঠিতে যা লিখছেন তার সারকথা হলো —  সহজে অস্বীকার করতে পারেন না বলে প্রতিদিন অন্তহীন চিঠি, আশীর্বাণী, অভিমতের অনুরোধ, নবজাতকদের নামকরণ নানারকম বোঝা তাঁকে টানতে হয়। অনুরুদ্ধ হয়ে কালিম্পং থেকে বঙ্কিম-জন্মশতবার্ষিকী উৎসবে পাঠের জন্য একটি কবিতা লিখে পাঠান তিনি।

দু’মাস পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ফিরে আসেন। নীলরতন সরকারকে উৎসর্গ করা ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হলো। নিজেকে যেমন সৃষ্টিকর্মে, সামাজিক দায়িত্ব পালনে, বিশ্বভারতীর নানা কাজে ব্যাপৃত রেখেছেন, তেমনই প্রমথ চৌধুরী-ইন্দিরা দেবীকে লোকশিক্ষার উপর বই লিখতেও তাগাদা দিচ্ছেন। অন্যকে উৎসাহ দেওয়া কবির আজীবনের প্রকৃতি। এবছরের বার্ষিক ‘বর্ষামঙ্গল’, বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের জন্য ‘অরণ্যদেবতা’ নামের লিখিত ভাষণে দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথের অরণ্যসম্পদ ধ্বংসের মধ্যে পৃথিবীর সম্ভাব্য সর্বনাশের আগাম বার্তা পাওয়া যায়। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণতর হচ্ছে, তবু পূর্বলিখিত একটি ব্যঙ্গকৌতুক আর একটি প্রহসনের রূপান্তর করলেন, লিখলেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ কবিতাটি।   

রবীন্দ্রনাথ ভাবেন বিশ্রাম নেবেন, কিন্তু সে আর হয় না। কেশবচন্দ্র সেনের জন্মশতবার্ষিকীতে অভিমত পাঠালেন, কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুতে ভাষণ দিলেন — এইসব সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিশ্বভারতীর নানারকম সমস্যা মেটাতে হয় তাঁকে। ২৭ নভেম্বর ১৯৩৮-এ পুত্র রথীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে উপহারস্বরূপ একটি কবিতা লিখলেন। এরই মধ্যে তাঁর উদ্যোগে কলকাতায় শ্রীনিকেতন শিল্পভবনের স্থায়ী ভাণ্ডার হলো, যার দ্বারোদ্ঘাটন করতে ৮ ডিসেম্বর ১৯৩৮-এ সুদূর পাঞ্জাব থেকে আসেন সুভাষচন্দ্র বসু; কিন্তু শারীরিক কারণে কবি নিজেই উপস্থিত থাকতে পারলেন না। ১৯৩৯-এর ৯ জানুয়ারি বিশ্বভারতী আসেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম কিশোরমাণিক্য ও সুভাষচন্দ্র। রাজার জন্য ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যটি অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিনিকেতনে ভারতীয় রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে এই সময়ে — জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রের সাক্ষাৎ হলো ২ ফেব্রুয়ারি। তবে রবীন্দ্রনাথ এই আলোচনাপর্বে উপস্থিত ছিলেন কিনা জানা যায় না।   

১৯৩৯-এ ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শ্রী-তে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য ও ‘তাসের দেশ’-এর অভিনয় দেখে কবি দুপুরেই শান্তিনিকেতন ফিরে আসেন। কারণ ওইদিন আওয়াগড়ের রাজা সূর্যপাল সিং — যিনি আজীবন বিশ্বভারতীকে অর্থসাহায্য করে, বড়ো বাড়ি নিঃস্বার্থভাবে দান করে পাশে থেকেছেন — তাঁর সেদিন শান্তিনিকেতনে সংবর্ধনা ছিল। এই সময় গদ্যসাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ যেন কিছুটা দূরে। তবে কবিতা লিখছেন, বসন্তোৎসবের জন্য গান লিখছেন। ১৩ মার্চ দক্ষিণ-ভারতের বিখ্যাত কবি বল্লথোল, যিনি মালায়লামের ‘টেগোর’ বলে পরিচিত ছিলেন, তিনি এসেছিলেন কবি-দর্শনে।   

নিভে নিভে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে

১৩৪৬ (১৯৩৯ — ১৯৪০)

নববর্ষে কবির জন্মদিনের পাশাপাশি বিকেলে দিনেন্দ্রনাথের স্মরণে ‘দিনান্তিকা’ নামে চা-চক্রের উদ্বোধন করলেন। পরদিন ১৬ এপ্রিল, ১৯৩৯,  রবীন্দ্রনাথ পুরী যাবেন বলে কলকাতায় এলেন। সেখানেও লোকে সভাসমিতির জন্য তাঁকে টানাটানি করেন। ১৯ এপ্রিল কবি পুরী যাত্রা করলেন। ছিলেন সার্কিট হাউসে, এখানেই তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত হবে — তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে ‘প্রবাসী’ নামের কবিতাটি লিখে পাঠান। পুরীতে তিন সপ্তাহের মতো ছিলেন তিনি। এখানে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ‘এপারে ওপারে’, ‘অত্যুক্তি’ প্রভৃতি কয়েকটি কবিতা লেখেন। পুরী থেকে ফিরে কবি মনোমোহন সেন ও মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যে মংপুতে একমাস থাকেন। সেখানে কবিতা লিখছেন, সাময়িক পত্রিকা পড়ছেন। সন্ধেবেলা সবার সঙ্গে সাহিত্য আলোচনাও করেন। দূর থেকে ভেসে আসা রেডিওর সুরতরঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। ১৩ জুন, ১৯৩৯-এ লেখেন ‘পরিচয়’ নামের দীর্ঘ কবিতা। কিন্তু দেশের রাজনীতির সংকট, বিদেশের রাজনৈতিক শক্তির আস্ফালন ব্যথিত করে কবিকে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সে সময়ের প্রবন্ধ, কবিতা, চিঠিগুলিতে।

মংপু থেকে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে সপ্তাহ তিনেক ছিলেন। ২৪ জুলাই, ১৯৩৯-এ শ্রীনিকেতনের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনার জন্য সব শ্রেণির কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হলেন। এর কাছাকাছি সময়ে বিশ্বভারতী প্রকাশনার অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নিলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুরনো লেখা পুনঃপ্রকাশের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত থাকেন। কিন্তু তাঁর কোনো আপত্তিই কেউ শোনেননি। তবে এই সময় কবিসৃষ্টি কিছুটা ব্যাহত হতে দেখা যায়। বাধ্যতামূলক কিছু চিঠিপত্র, ‘রাত্রি’ নামে একটি কবিতা লেখেন, আর ‘ডাকঘর’ নাটকের জন্য নতুন কয়েকটা গান সংযোজন করেন। ‘সমুখে শান্তিপারাবার’— এই নতুন গানটি শান্তিদেব ঘোষকে শিখিয়ে রহস্য করে কবি  বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর তো বেশি দেরি নেই, এই গান যেন তাঁর মৃত্যুতে কাজে লাগানো হয়। মৃত্যুর পদধ্বনি কি তবে তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন?

শান্তিনিকেতনে সুভাষচন্দ্রের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমন্ত্রণ এল মহাজাতি-সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের। ‘মহাজাতি-সদন’ নামটি কবিরই দেওয়া। ১৯৩৯-এর ১৮ আগস্ট তিনি মহাজাতি-সদনের ভিত্তিস্থাপন করেন। পরদিন চীন যাওয়ার আগে জওহরলাল নেহেরু জোড়াসাঁকোর ঠাকুবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এরপরে শান্তিনিকেতনে নানা কাজের মাঝে ‘বর্ষামঙ্গল’-এর জন্য প্রায় ১৫ টির মতো গান কয়েকদিনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন। যেমন — ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, ‘সঘন গহন রাত্রি’ প্রভৃতি।

১৯৩৯-এ ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যে মংপুতে ছিলেন। এই সময় দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক জটিলতা কবিকে ভারাক্রান্ত করেছে, যার ছবি পাওয়া যায় অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা ‘পত্রধারায়’। মৈত্রেয়ী দেবী কবির মংপুবাসের দিনিলিপিতে লিখেছেন — ‘কি আশ্চর্য পরিশ্রম করতে পারতেন এখন পর্যন্তও, ভাবলে আশ্চর্য লাগে।’ ভোর পাঁচটায় উঠে খুচরো কাজ সেরে লিখতে বসতেন। মাঝে ঘন্টা দেড়েক স্নান-খাওয়ার সময়টুকু বাদে একেবারে সন্ধের আলোজ্বালা পর্যন্ত কাজ করেই যেতেন। ‘শেষ কথা’ নামের বড়োগল্পটি লেখা, ছবি আঁকা, নানাধরনের কবিতা রচনা — সৃষ্টি চলতেই থাকে।

এইসময় বিশ্বভারতীর নানারকম সমস্যা কবিকে পীড়িত করছিল। তিনি কর্মী-পরিকাঠামোর রদবদল করেও বিশেষ কিছু সুরাহা করতে পারেননি। ১৯৩৯-এর ১৬ ডিসেম্বর শনিবার মেদিনীপুরের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট বিনয়রঞ্জন সেনের আহবানে রবীন্দ্রনাথ মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর-স্মৃতি-মন্দিরে দ্বারোদ্ঘাটন করেন ও একটি ভাষণও দেন। পৌষ উৎসবের আগেই দেশের কংগ্রেসের মধ্যে বিরোধ-ভাঙন রুখতে গান্ধিজিকে চিঠি দিয়ে মেটাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।

১৯৩৯-এর ৩০ ডিসেম্বর কবির পালিতা পৌত্রী নন্দিনীর বিবাহ হলো মহা-আড়ম্বরে। এই বিবাহ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তিনটি গান রচনা করেন। ১৯৪০-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি সস্ত্রীক গান্ধিজি এলেন, রবীন্দ্রনাথ মালা দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিলেন। সন্ধ্যার পর গান্ধিজি খুব মন দিয়ে দেখলেন ‘চণ্ডালিকা’ নাটক। গান্ধিজি ফিরে যাওয়ার আগে কবি তাঁকে একটি চিঠিতে তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীর প্রতি খেয়াল রাখার অনুরোধ জানান।

ইংরেজি বছর শুরুর দিকে কবিকে সিউড়ি ও বাঁকুড়া যেতে হয়। ২৯ ফাল্গুন দ্বিজেন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে মন্দিরে কবির অভিভাষণ পাঠ করা হলো। ‘অস্পষ্ট’, ‘জবাবদিহি’, ‘আসা-যাওয়া’, ‘জ্যোতির্বাস্প’ পরপর কবিতাগুলি রচিত হয় এই সময়ই। ৫ এপ্রিল ১৯৪০-এ কবির একান্ত সুহৃদ এণ্ড্রুজের মৃত্যুসংবাদ আসে। এই সময় কবির সন্তানতুল্য সুরেন্দ্রনাথও মৃত্যুশয্যায়। এইসব মানসিক আঘাত কবি নীরবে আত্মস্থ করতে থাকেন শেষ বয়েসেও।    

ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় যাত্রার সময় বুঝি এলো

১৩৪৭ (১৯৪০ — ১৯৪১)

১৩৪৭ এর নববর্ষে তাঁর জন্মোৎসবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চাওয়া, তিনি কী করেছেন তাঁর মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ করলেন। ১৭ এপ্রিল, ১৯৪০-এ কলকাতা গেলেন, উদ্দেশ্য কালিম্পং-যাত্রা। ২০ এপ্রিল শেষবার দেখে এলেন মৃত্যুপথযাত্রী ভাইপো সুরেন্দ্রনাথকে। ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দেখা করতে এলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর নানা বিষয়ে আলোচন হয়। সেই বিবৃতি ১৩৪৭-এর ১২ বৈশাখ কিছু সাময়িক দৈনিকে প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষ অনুমান করেন এই বিবৃতির আক্রমণের অভিমুখ সুভাষচন্দ্রের দিকে। সেটা আদৌ না থাকায় রবীন্দ্রনাথ পাল্টা-বিবৃতি দিয়ে ভুল ধারণা ও বিতর্ক কিছুটা হলেও থামান।

রবীন্দ্রনাথ মংপুতে পৌঁছে নিজের মনে কবিতা, লিরিক, ছড়া ইত্যাদি লিখতে থাকেন। বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামীর অনুরোধে সহজ গদ্যে লিখলেন ‘ছেলেবেলা’। মংপুতে ৫মে ১৯৪০-এ কবির জন্মোসবের আয়োজন করা হয়, সেইদিন দুপুরে তিনি ‘জন্মদিন’ বলে তিনটি কবিতা লেখেন। কালিম্পং-এ বেশ কিছুদিন থেকে কলকাতায় ফিরলেন ২৯ জুন। রবীন্দ্রনাথের এই কলকাতাবাস-কালে ২ জুলাই, ১৯৪০-এ সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এই দুই মহাজীবনের এই-ই শেষ সাক্ষাৎ।

গ্রীষ্মের ছুটির পর বিশ্বভারতী খুললে রবীন্দ্রনাথ নিজে উঁচুক্লাসের ছেলেদের বাংলা ক্লাস নিয়েছেন। জীবনের উপান্তে এসেও তাঁর বিশ্রাম নেই, কারুর পাণ্ডুলিপি দেখে দেন, কারুর বইয়ের প্রশংসা লিখে দেন, কারুর লেখার সম্পাদনা করে দেন। ১৯৪০-এর ২৪ জুলাই বোলপুরে টেলিফোন কেন্দ্র বসলে দুপুরবেলা কবি গিয়ে তা উদ্বোধন করে আসেন। শ্রাবণে প্রকাশিত হয় ‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থ। ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৭-এ সিংহসদনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথকে ‘ডক্টর অব লিটারেচর’ বা সাহিত্যাচার্য উপাধি দেওয়া হয়। সেইদিন তুমুল বৃষ্টি, তবু সিংহসদন-হল ছিল পরিপূর্ণ, সন্ধেতে ‘শাপমোচন’ অভিনীত হয়েছিল।

কবির জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। দৃষ্টি-শ্রবণশক্তি ক্ষীণ, হাঁটাচলায় অসুবিধা বলে হুইলচেয়ার আশ্রয় করে ঘোরাঘুরি। লিখতে কষ্ট হয়, তবু আনন্দবাজার পুজোসংখ্যার জন্য লিখলেন ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি। হরেকরকম দায়-দায়িত্ব, সৃষ্টিশীলতার মাঝেই কবির মন মানসমুক্তি চায়। প্রতিমা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন — ‘হংসবলাকার দলে যদি নাম লেখা থাকত তা হলে উড়ে চলতুম মানসসরোরের দিকে।’ নিকটজনদের এবং ডাক্তার নীলরতন সরকার, বিধানচন্দ্র রায়ের বারণ-উপদেশ উপেক্ষা করে ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০-এ তিনি কালিম্পং যাত্রা করেন। কিছুদিন সেখানে সুস্থ থাকলেও ২৬ সেপ্টেম্বর কবি জ্ঞান হারালেন। প্রতিমা দেবী কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও শান্তিনিকেতনে অনিল চন্দকে ফোনে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক পরিস্থিতি জানালে প্রশান্তচন্দ্র তিনজন ডাক্তার নিয়ে নিজে এবং অনিল চন্দ সুরেন্দ্রনাথ কর, সুধাকান্তকে নিয়ে কালিম্পঙে পৌঁছলেন। সকলে কবিকে নিয়ে কলকাতা ফিরলেন ২৯ সেপ্টেম্বর। এটিই ছিল কবির শেষ ভ্রমণ।

কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ছিলেন, কার্যত অসুস্থ-শয্যাশায়ী হয়ে। শরীরে অসহ্য ব্যথা, জ্বর, একটা আচ্ছন্নতা। ওয়ার্ধা থেকে মহাদেব দেশাই গান্ধিজির বার্তা নিয়ে এলে অনিল চন্দ রবীন্দ্রনাথকে পড়ে তা বুঝিয়ে দিলেন। প্রতিমা দেবীর লেখা থেকে জানা যায় — ‘তাঁর চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল, চোখের জল তাঁর এই প্রথম দেখলুম।’ অশক্ত দুর্বল জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়ানো এ কোন্‌ রবীন্দ্রনাথ!

একটু সুস্থ হতেই অনুলিখনে লেখা হলো ‘রোগশয্যা’র ১০ টি কবিতা। এসেছে ভাইফোঁটা। ছোটোদিদি বর্ণকুমারী গৌরবর্ণ আঙুলে চন্দন দিয়ে কাঁপা-হাতে ফোঁটা দিলেন ভাইকে। রবীন্দ্রনাথের তখন বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নেই। কবির শেষ ভাইফোঁটা। ১৮ নভেম্বর কবি শান্তিনিকেতন ফিরলেন। সুধাকান্ত লিখছেন — ‘যন্ত্রণাকে অবিচলিতভাবে সহ্য করার অসাধারণত্ব দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।’ রোগীর ঘরকে বিমর্ষতামুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতেন মজার ছড়া বলে, কখনো হাস্য-পরিহাসে। অসুস্থতার মাঝেঅ কিন্তু বিশ্বভারতীর খবর রাখেন।

সেবার জীবনের শেষ ৭ পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকতে পারলেন না বলে দুঃখ করে বলেছিলেন — ‘আমি আশ্রমে উপস্থিত আছি অথচ ৭ পৌষের উৎসবের আসন গ্রহণ করতে পারিনি এরকম ঘটনা আজ এই প্রথম ঘটল।’ রবীন্দ্রনাথের অসুস্থ দিন কাটে কখনো নানারকম ভাবনায়-সাহিত্যসৃষ্টিতে, কখনো অনিদ্রায়। কবির শেষ মাঘোৎসবে পাঠ করা হলো কবির অভিভাষণ। এই দিন কবি দুটি কবিতা লেখেন। ১৯৪১ এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে লেখেন ‘গল্পসল্প’। এরই মাঝে আসন্ন বসন্তোৎসবকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে শৈলোজানন্দ ও শান্তিদেবকে পরামর্শ-উপদেশ দিয়েছেন।

নববর্ষ সমাগত। কবির জন্মদিনও। তাঁর কাছে একটি গান চাওয়া হলো। আগে রচিত একটি বড়ো কবিতাকে ছোটো  করে তাতে সুর সংযোজনায় তৈরি হলো, ‘ঐ মহামানব আসে।’ কিন্তু তখন ওই মহামানবেরই যাওয়ার সময় আসন্ন।

জ্বলন্ত শিখা মৃত্যু পরাইল মোরে জীবনের পশ্চিমসীমায়

রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রিয়জনবিয়োগ বারবার কঠিন থেকে কঠিনতম আঘাত হেনেছে। মৃত্যু-বেদনার সীমাহীন তরঙ্গ পেরিয়ে সৃষ্টির সাধনায় শান্ত সমাহিত থেকেছেন কবি। জীবনের উপান্তে এসে যে-তিনটি শোক কবির গতিময়তায় ক্ষণিক স্তব্ধতারূপে দেখা দিয়েছিল, সেগুলি হলো শান্তিদেব ঘোষের পিতা কালীমোহন ঘোষ, আশ্রমবন্ধু এণ্ড্রুজ এবং সন্তানতুল্য ভাইপো সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু।

কালীমোহন ঘোষ রবীন্দ্রনাথের গ্রাম-উদ্যোগ পর্বে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন, তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর, সহায়ক, ভাবের বাহক, সহকর্মী তো বটেই। রবীন্দ্রনাথ কালীমোহন ঘোষের মৃত্যু সংবাদ পান ১২ মে, ১৯৪০-এ, কালিম্পঙে থাকতে। সেখান থেকে পুত্র শান্তিদেব ঘোষকে এক চিঠিতে (১৯ মে) কালীমোহন ঘোষের নিঃস্বার্থ অবদান স্মরণ করে লিখেছিলেন — ‘তোমার পিতার মৃত্যুসংবাদে গুরুতর আঘাত পেয়েছি।’ চিঠির একথা বর্ণে-বর্ণে সত্যি ছিল।

এণ্ড্রুজ সাহেবের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বা তারপরের কবির প্রতিক্রিয়া জানা যায় রাণী চন্দ এবং মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা থেকে। রাণী চন্দ ৫ এপ্রিল ১৯৪০-এ লিখেছেন —  রবীন্দ্রনাথকে আশ্রমের একান্ত আপনজন দীনবন্ধু এণ্ড্রুজের মৃত্যুসংবাদ দিলে, তিনি কোলের উপর হাত দু’খানি রেখে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন। পরে অতি ধীরে বললেন, এণ্ড্রুজ মারা গেছেন। অনেক কালের বন্ধু ছিলেন। সুখে দুঃখে আমাদের এখানকার জীবনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন — এণ্ড্রুজের মৃত্যুর কিছুদিন পর একদিন দুপুরে এণ্ড্রুজকে নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা দেখে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবির গলা বুজে এসেছিল, বাইরের দিকে চেয়ে চুপ করে তিনি বসে রইলেন।

কবির শোকের উচ্ছ্বাস ছিল না, ছিল অন্তর্দাহ। তাঁর শোক-তালিকায় শেষতম সংযোজন ছিল ৩মে, ১৯৪০-এ ভাইপো সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু। সুরেন্দ্রনাথের অসুস্থতায় কবি উদ্বিগ্ন যেমন হয়েছেন, তেমনি এক দাহও কাজ করেছে — ইন্দিরা দেবীকে কখনো লিখছেন, সুরেনের জন্য তিনি কীরকম উদ্বিগ্ন, কখনো রথীন্দ্রনাথকে লিখছেন, সুরেন্দ্রনাথের জন্য মনটার ভিতর তাঁর বৃথা ছটফট করতে থাকে। অসুস্থ সুরেন্দ্রনাথকে শেষবারের মতো দেখতেও গেছিলেন তিনি। তবে ৫ মে কবির জন্মদিন থাকায় সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ কবিকে সঙ্গে-সঙ্গে জানানো হয়নি। পরদিন মৃত্যুসংবাদ জেনে ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লেখেন — ‘তোরা বোধ হয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি ভালোবেসে ছিলুম।’ বৃদ্ধ বয়েসে রবীন্দ্রনাথ যেন আরেকবার পুত্রশোক পেলেন। লিখলেন —  ‘রাহুর মতো মৃত্যু শুধু ফেলে ছায়া।’                                   

আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে

১৩৪৮ (১৪ এপ্রিল — ৭ আগস্ট ১৯৪১)

রোগক্লিষ্ট অশক্ত রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যজীবনের শেষ নববর্ষে ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থ ও ‘গল্পসল্প’ প্রকাশিত হলো। এ দুটি তাঁর ইহজীবনের শেষ মুদ্রিত বই। এই জন্মোৎসবে সকালবেলায় ভাষণ হলো রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’। পাঠ করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। রাণী চন্দ জানাচ্ছেন, নবর্ষের ভোরবেলায় শালপাতার ঠোঙায় বেল-জুঁই-কামিনী তুলে উদয়নের বারান্দায় কবির হাতে দিয়ে তিনি প্রণাম করলেন। কবি ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললেন, ‘আজ দেখছি পিছন ফিরে — কত বোঝা যে জমা হয়েছে; বোঝা বেড়েই চলেছে।’ তিনি বুঝেছিলেন সক্ষমতার সুর-তাল-ছন্দ কাটছে। নাহলে প্রায় একই সময়ে কোনো এক বিকেলে প্রতিমাদেবীকে কেন বলেছিলেন — ‘মা-মণি, আমি ক্রমশই নেমে যাচ্ছি,… আমার নিবে-যাওয়ার সময় এসেছে, ...।’

রোগশয্যাতেও প্রতিদিন কিছু না কিছু বলেন, পাশে যিনি থাকেন, লিখে রাখেন। এবারের ২৫ বৈশাখের জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে ২৩ বৈশাখ, ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামের দীর্ঘ কবিতাটিকে কাটছাঁট করে তাতে সুর সংযোজন করলেন, তৈরি হলো — ‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের তৈরি জীবনের এই শেষ গানই তাঁর জন্মদিনের অনিবার্য গান হয়ে উঠল, যে-গানে অসীমের চিরবিস্ময়ের মাঝে আত্মোন্মোচনের বাণী আঁকা। শেষ পঁচিশে বৈশাখের জন্মদিনটি অনাড়ম্বরে পালিত হলো। এর কয়েকদিন পর ত্রিপুরা-দরবার থেকে রাজপ্রতিনিধিরা এসে তাঁকে ‘ভারত-ভাস্কর’ উপাধি দিলেন।

গরমের ছুটিতে শান্তিনিকেতন এলেন সাহিত্যিক জ্যোতির্ময় রায় এবং সপরিবারে বুদ্ধদেব বসু। তাঁরা যখন গেছেন, কবি তখন নতুন ছোটোগল্প শেষ করেছেন। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব ভাবা হয়ে আছে। বুদ্ধদেব বসু ভেবেছিলেন, অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ হয়তো দু’একটির বেশি কথা বলবেন না। কিন্তু নিটোল সুন্দর কণ্ঠস্বর রোগের কারণে কিছুটা ক্ষীণ হলেও, স্পষ্ট উচ্চারণে, ললিত ভঙ্গিতে তিনি একটার পর একটা প্রসঙ্গ পাড়তেন। কথার জন্য তাঁকে কখনো হাতড়াতে হত না। সব বিষয়ে কথা বলতেন, শুধু রোগের কথাটি ছাড়া। বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথের শেষজীবন’ প্রবন্ধে লিখেছেন — ‘মুখ তাঁর শীর্ণ, আগুনের মতো গায়ের রঙ ফিকে হয়েছে, কিন্তু হাতের মুঠি কি কব্জির দিকে তাকালে বিরাট বলিষ্ঠ দেহের আভাস এখনো পাওয়া যায়।…এই অপরূপ রূপবান পুরুষের দিকে এখন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়, যেমন ক’রে আমরা শিল্পীর গড়া কোনো মূর্তি দেখি।’ বুদ্ধদেব বসুদের চলে আসার দিন তাঁরা দেখে এলেন কবি রোগশয্যায়, বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুপ করে। সেবারে কবি তাঁদের বলেছিলেন, ‘এখন আমি আর-কিছুই করি না, শুধু দেখি।’ অথচ অনন্ত-পিয়াসী কবি তখন শারীরিক অসুস্থতায় ঘরবন্দী।

এরই মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের মুখে বলে যাওয়া আর রাণী চন্দের লেখায় ‘ঘরোয়া’র পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে ২৭ জুন অবনীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লেখেন — ‘মনের মধ্যে মরা গাঙে বান ডেকে উঠল।’ অন্য আরেকটি চিঠির সঙ্গে বইটির ভূমিকাও লিখে দেন। জীবনসায়াহ্নে এসে সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার বাঁকবদল-বিবর্তনের মাঝেই রবীন্দ্রনাথকে ভারতের প্রতি এক বিদেশির অপমানের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। মিস রাথবোনের ভারতের নিন্দে করা এক খোলা চিঠির উত্তর খোলা-চিঠিতেই দিলেন তিনি। ভারতের ইংরেজি সব কাগজে ৫ জুন প্রকাশিত হলো সেই প্রতিবাদ-চিঠিটি।

রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র কাজ নিয়ে মগ্ন থাকতে চাইলেও ক্রমেই জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। প্রতিমা দেবী লিখছেন — ‘আষাঢ় মাস পড়তেই বাবামশায় খোলা আকাশে বর্ষার রূপ দেখবার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন, তখন তাঁকে উত্তরায়ণের দোতলায় নিয়ে আসা হল।’ এরই মাঝে অ্যালপাথি ডাক্তারদের মত নিয়ে কবিরাজ বিমলানন্দর তত্ত্বাবধানে কবিরাজী চিকিৎসা শুরু হয়েছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসাতেই উপশম হচ্ছে না। এই সময় কলকাতা থেকে এলেন প্রশান্তচন্দ্রর স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহধন্যা রানীদেবী (নির্মলকুমারী)। ওই সময় তাঁর সাহচর্যটুকু কবির কাছে আনন্দময় হয়ে উঠেছিল।

কলকাতা থেকে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রকাশ সরকার ছাড়াও আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এলেন। অপারেশানের ব্যাপারে তাঁরা সকলেই একমত। শেষ পর্যন্ত ২৫ জুলাই (৯ শ্রাবণ) কবিকে কলকাতা নিয়ে যওয়া হলো। তখনকার ই.আই. রেলওয়ের অধিকর্তা কবির জন্য সেলুন-কারের ব্যবস্থা করে দিলেন। যাত্রার আগে উদয়নের সামনে সারিবদ্ধ সবাই — স্তব্ধ, অশ্রুসজল শ্রদ্ধানিবেদনের মধ্যে দিয়ে কবিকে বিদায় জানালো। বিশ্বভারতী ছাড়ার সময় কবিরও চোখে জল। পিছনে পড়ে রইল স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতন, তাঁর নিজের হাতে গড়া বিশ্বভারতী।

পথশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন, ঘুমন্ত কবিকে স্ট্রেচারে করে মহর্ষিভবনের দোতলায় পাথরের ঘরে রাখা হলো। সঙ্গে রইলেন রথীন্দ্রনাথ, অনিল চন্দ, সুরেন্দ্রনাথ কর, মীরা দেবী, নাতনি নন্দিতা, রানী চন্দ, নির্মলকুমারী, নাত-বৌ অমিতা প্রমুখ। অবনীন্দ্রনাথ ও আরো অনেকেই দেখা করতে আসছেন।

পরদিন অপেক্ষাকৃত সুস্থ কবি, অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করলেন। ২৭ জুলাই ১১ শ্রাবণ রানী চন্দকে বললেন, সকাল বেলায় অরুণ আলোর মতো মনে হয়েছে একটি কবিতা, লিখে রাখতে। রানী চন্দ লিখলেন —

‘প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে —

কে তুমি,

 মেলেনি উত্তর।...’

শুনতে চেয়েছিলেন ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’ কবিতাটি। ২৯ জুলাই আশঙ্কাভরে জানতে চেয়েছেন, অপারেশানে তাঁর ব্যথা লাগবে কিনা। সেদিন বিকেলের দিকে আবার রানী চন্দকে মুখেমুখে বলে গেলেন আরেকটি কবিতা — ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে এসেছে আমার দ্বারে।’ ৩০ জুলাই অপারেশানের দিন জীবনের সর্বশেষ কবিতাটি রচনা করে গেলেন। অনুলিখনে রানী চন্দ — ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি...।’ বললেন, অপারেশানের পরে কবিতাটি ঠিকঠাক করে দেবেন। সে আর হলো কই! কবিতাটি ডিক্টেশান দেওয়ার পর শান্তিনিকেতনে অসুস্থ প্রতিমা দেবীকে চিঠি লিখিয়েছেন। শেষে নিজে কাঁপা হাতে স্বাক্ষরটুকু করলেন — ‘বাবামশাই।’ এটি তাঁর জীবনের শেষ স্বাক্ষর।

ডাক্তাররা আগেই পরামর্শ করে অপারেশানের তারিখ ঠিক করে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মহর্ষিভবনের দোতলায় পুবদিকের বারান্দায় পর্দা ঘিরে প্রস্তুত করা হয়েছিল অস্থায়ী অপারেশান থিয়েটার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে কিছুই জানানো হয়নি। সাড়ে দশটা নাগাদ ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে জানালেন। চমকে উঠেও সম্মত হতে বাধ্য হলেন, কিছুটা অন্যের সিদ্ধান্তের কাছে অত্মসমর্পণ। ১১ টা ২০ থেকে ১১ টা ৪৫ — মাত্র ২৫ মিনিট মতো লেগেছিল। অপারেশান করেছিলেন ললিতকুমারই। মেডিক্যাল বোর্ডে ছিলেন বিধান রায়, অমিয় সেন, সত্যসখা মৈত্র, এবং জ্যোতিপ্রকাশ সরকার। অপারেশানের পরে নিঃসাড় রবীন্দ্রনাথ, মাঝেমধ্যে শুধু বলেছেন ব্যথা করছে জ্বালা করছে। ৩ আগস্ট থেকে অবস্থার অবনতি হলো। কিডনি ঠিক মতো কাজ করছে না। ৪ আগস্ট প্রতিমা দেবী এসেছেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ডেকে বললেন, ‘বাবামশাই আমি এসেছি।’ একবার চোখ দুটি জোর করে টেনে পুত্রবধূকে দেখলেন।

৫ আগস্ট মঙ্গলবার থেকে পুরোপুরি অচৈতন্য। কিডনি কাজ করছে না। সন্ধের দিকে এলেন নীলরতন সরকার এবং বিধান রায়। নীলরতনবাবু কেবল কবির ডানহাতে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন, কবির মতোই অপারেশান করানোয় যাঁর অমত ছিল। দু’জন ডাক্তার অসহায়ভাবে বুঝতে পারলেন অগ্নিশিখাটি নিভন্ত। স্যালাইন দেওয়া হলো। অক্সিজেনও এনে রাখা আছে। ৬ আগস্ট সমানে কাশি আর হিক্কা। ছোটোদিদি বৃদ্ধা বর্ণকুমারী দেবী ভাইয়ের মাথার কাছে বারবার আসছেন। কবির অবস্থা আরও সংকটজনকহয়ে উঠল। জানলায় তখন রাখিপূর্ণিমার চাঁদ।

৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ) বৃহস্পতিবার জোড়াসাঁকোবাড়ি আত্মীয়পরিজনে, বন্ধু-ভক্ত-অনুরাগীতে লোকারণ্য। অমিয়া ঠাকুর চাঁপাফুল ছড়িয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের শালে ঢাকা পা দু’খানিতে। পায়ের কাছে বসে বিধুশেখর শাস্ত্রী ‘ওঁ পিতা নোহসি’ মন্ত্র পড়ছেন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় খাটের পাশে উপাসনা করছেন, হেমন্তবালা দেবী কবির কপালে তুলসীর মালা, গঙ্গামাটি ছুঁইয়ে দিলেন। বিধান রায় আর ললিত মোহন এসে শেষবারের মতো দেখে গেলেন। বেলা ৯ টায় অক্সিজেন চালু করা হলো। কানের কাছে পড়া হচ্ছে কবির জীবন-মন্ত্র — ‘শান্তম্‌ শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌।’ কমতে লাগল তাপমাত্রা। নিঃশ্বাস ক্ষীণ। দুপুর ১২ টা ১০, কবির ডান হাতটা কাঁপতে কাঁপতে কপালের কাছে গিয়ে পড়ে গেল। ‘জীবনশেষের শেষ-জাগরণসম ঝলসিছে মহাবেদনা — / নিমেষে দহিয়া যাহা-কিছু আছে মম তীব্র ভীষণ চেতনা।’ থেমে গেল হৃদস্পন্দন। রবীন্দ্রনাথকে স্নান করিয়ে সাদা বেণারসী-জোড় আর গরদের পাঞ্জাবি পরানো হলো, পাট করা চাদর গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ের মালা দিয়ে সাজানো হলো। রাজবেশে সজ্জিত কবিকে নিয়ে সাড়ে তিনটে নাগাদ শ্মশানযাত্রা শুরু হয়েছিল।

মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর আগেই এক পঁচিশে বৈশাখ দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন — ‘বাঁশি যখন থামবে ঘরে, / নিববে দীপের শিখা, / এই জনমের লীলার পরে / পড়বে যবনিকা, / সেদিন যেন কবির তরে / ভিড় না জমে সভার ঘরে, / হয় না যেন উচ্চস্বরে / শোকের সমারোহ।’ কবি যা চেয়েছিলেন ঠিক তার উল্টোটাই হলো। রেডিওতে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক পরিস্থিতির নিয়মিত খবর দেওয়া চলছিল। সবাই আপডেট পাচ্ছিল। তাও ভাগ্যিস এখনকার মতো ‘লাইভ’ দেখানোর চল ছিল না। তাতেই বা কম কী! অসংযত জনতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। কবির মরদেহ সমেত খাট জনসমুদ্রে পড়ে পৌঁছে গেল নিমতলা শ্মশানে। তবে অন্ত্যেষ্টির সেই দিনের ঘটনা নিয়ে বিতর্কও আছে।

ভিড় ঠেলে নিমতলা শ্মশান পর্যন্ত যেতে পারেননি অসুস্থ রথীন্দ্রনাথ। বরং ভিড়ে আরও অসুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। মুখাগ্নি করেন মেজোদাদা সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ। অথচ এমন শোভাযাত্রা, এমন অসংযমী শোকপ্রকাশ, এমনকি, কলকাতায় তাঁর শেষকৃত্যও চাননি রবীন্দ্রনাথ। রানী মহলানবিশকে বলেওছিলেন সে কথা — ‘তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, ‘বন্দেমাতরম’— এইরকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে। সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না।…আমার দেহ শান্তিনিকেতনের মাটিতে মিশে যাবে এই আমার আকাঙ্ক্ষা।’ কবির সেই ইচ্ছে মর্যাদা পায়নি অনভিপ্রেত এই ঘটনায়। অন্ত্যেষ্টির অসংযমী শোকের উচ্ছ্বাসে চাপা পড়ে যায় কবির আকুল ইচ্ছেটি।  

      ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে’ যিনি চলে গেলেন, আমাদের সেই নিত্য ‘অভয় আশ্রয়’, উত্তরণের পথ দেখানো রবীন্দ্রনাথের দেহ তো পঞ্চভূতে বিলীন হলো; কিন্তু ‘মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও’ বীজমন্ত্র দেওয়া, দুঃখের তিমিরেও মঙ্গলালোক-সন্ধানী রবীন্দ্রনাথ নামের অবিনশ্বর অস্তিত্বটি? ‘অজঃ নিত্য, শাশ্বত, অয়ম, পুরাণঃ’ — এঁর জন্ম নেই, ইনি নিত্য, অক্ষয়, অনাদি। তাঁর মৃত্যুও নেই।  “তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে।’

 

সহায়ক বই :

১। রবীন্দ্রজীবনী (চতুর্থ খণ্ড), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশ শ্রাবণ ১৩৬৩।

২। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ আগস্ট ২০০৭।

৩। জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ, কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত, সিগনেট প্রেস, প্রথম সংস্করণ মে ২০১৩।

৪। রবীন্দ্র-কাব্য-পরিক্রমা, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ওরিয়েণ্ট বুক কোম্পানি, প্রথম সংস্করণ ভাদ্র ১৩৫৪।

৫। রবীন্দ্রনাথ, শ্রীসুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রকাশক এস সি সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ,  ১ আষাঢ় ১৩৫৯।

৬। প্রবন্ধ সংকলন, বুদ্ধদেব বসু, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২।

৭। আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, শ্রীরাণী চন্দ, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রথম প্রকাশ ২২ শ্রাবণ ১৩৪৯।