চলচ্চিত্র বার্বি ও নারীবাদের বয়ান প্রসঙ্গে কিছু কথা

'বার্বি' নামক পুতুলের আবির্ভাবের ঠিক দশ বছর আগে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের উৎসমুখ সন্দর্ভ 'দ্য সেকন্ড সেক্স' প্রকাশিত হয়েছিল। আর প্রায় নব্বই বছর আগে নোরা নামে এক মেয়ে ইবসেনের নাটকে দড়াম শব্দে এযাবৎ কালের 'খেলনাবাড়ি'-র দরজা বন্ধ করে পথে নেমে এসেছিল। তার মনে হয়েছিল সাজানো সংসারে সে পুতুল মাত্র৷ এসবে বার্বির জন্ম আটকায়নি৷ কারণ পিতৃতন্ত্র ছিল মেইনস্ট্রিম, আজও আছে। অন্যদিকে, ধনতন্ত্রই ছিল মূলধারা, এবং তার বিজয়পতাকাও আজও উড্ডীন। 

ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের সঙ্গে বিজেপি-পূর্ব হিন্দুধর্মের এক মিল আছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। 'হিন্দুত্বের' আগে যে হিন্দুধর্ম ছিল, তাকে উদারও বলা চলে, আবার সর্বগ্রাসীও বলা চলে। যে যেভাবে ভাবতে চান। বৌদ্ধধর্ম ব্যাগড়া দিচ্ছে হিন্দুধর্মের একচেটিয়া প্রাধান্যে? বেশ তো, বুদ্ধকে বিষ্ণুর দশম অবতার বানিয়ে নিলেই চলে। এমন নজির হিন্দুধর্মে একাধিক। এতে হিন্দু সংস্কৃতি হয়েছিল বিচিত্র, বহুস্তরী ও সে কারণে টেকসই। ধনতন্ত্রের টেকসই হওয়ার কারণও তাই। তা যেকোনো মতকে বাহু প্রসারিত করে ডেকে নেয়। পিতৃতন্ত্রকেও। আবার নারীবাদকেও৷ যেকোনো কিছুকেই সে সাজিয়ে-গুছিয়ে বেচে দিতে সক্ষম। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র গোঁড়ামি নেই তার।  বিপ্লবও বেচা যায় সামান্য টিশার্টে৷ 'হোয়াই শুড বয়েজ হ্যাভ অল দ্য ফান' মর্মে বেচা যায় রঙিন 'মেয়েলি' স্কুটার। 

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কারণ, 'বার্বি' নামক ছবিটিও এমন এক আশ্চর্য প্রজেক্ট, যা বেচা হচ্ছে চড়া দামে। হু হু করে টিকিট বিকোচ্ছে। নোলানের 'ওপেনহাইমার' টুপি খুলে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, বার্বি সংস্কৃতির ফ্যান-রা গোলাপি জামা গায়ে এ ছবি দেখতে ছুটছে। ম্যাটেল ওই চলচ্চিত্রে বার্বি যেমন জামা-জুতো-মেক আপে সেজেছে, তেমন বেশে এর মধ্যেই নতুন বার্বিডল হাজির করেছে। আর তাও বিকোচ্ছে দেদার৷ আবার অন্যদিকে, বার্বি সংস্কৃতির বিরোধী যারা, তারাও ছবি দেখতে ভিড় করছেন। কারণ এ ছবি পরিচালকের ঘোষণা অনুযায়ী 'নারীবাদী ছবি' আর চিত্রনাট্য দেখে তা অস্বীকার করারও উপায় নেই। বস্তুত, চিত্রনাট্য প্রতিবাদী,  প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ;কিন্তু দৃশ্যায়ন ঝাঁ-চকচকে, মূলধারার সব আলো-মাখা— এতে এক আপাত বৈসাদৃশ্য আছে। কিন্তু বৈসাদৃশ্য বিকট নয় এক্ষেত্রে, কারণ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিষয় হিসেবে বাছা হয়েছে বার্বিকে, যে নিজেই রূপকথা। 

রুথ হ্যান্ডলার যখন বার্বিপুতুলের জন্ম দিচ্ছিলেন, তখন রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় মেয়েদের 'ঘর ওয়াপসি' চলছিল।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ।  ক্ষয়ক্ষতি যথেষ্ট হলেও, অর্থনৈতিক ভাবে আমেরিকাকে লাভবানই বলা চলে। পুরুষেরা ঘরে ফিরে এসেছে। এখন দুটি ঘটনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক, মেয়েদের আগের লিঙ্গনির্ধারিত ভূমিকায় ফিরে যাওয়া। অর্থাৎ চার দেওয়ালে ফিরে যাওয়া। আর দুই, থমকে থাকা জন্মহার বৃদ্ধি করা।  বস্তুত, সত্যিই  এরপর আমেরিকা-ইউরোপে জন্মহার বিস্ফোরণ বা 'বেবি-বুম' ঘটেছিল। যাইহোক, এসব সম্ভব করতে গার্হস্থ্যব্রতের জয়জয়কার করছে টিভিসোপ, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য৷ অথচ ততদিনে বদলেছে নারীর পোশাক-আশাক, যাপন, চাহিদা। একবার যে বহির্মুখী হয়েছে, তাকে ঘরে ফেরানো কি এতই সহজ? নারীর নবলব্ধ সত্তাকে খানিক প্রশ্রয় দিলে যদি বৃহত্তর হল্লাহাটি ঠেকানো যায়, নারীসুলভ ভূমিকা-পালন নিশ্চিত করা যায়, ক্ষতি কী? বার্বি সেই যুগের নারী, থুড়ি পুতুল। তথাকথিত স্বনির্ভর। অন্তত আড়াইশ পেশায় তাকে দেখা গেছে। পেশাগত পরিচয় সে বহন করতে শুরু করেছে জন্মের মোটামুটি এক দশক পর থেকেই। ১৯৬৫ সালে সে নভোচারী হয়েছে, মানে নীল আর্মস্ট্রং-এর আগে সে মহাকাশে গেছে।  কিন্তু আদতে সে অসম্ভব ফিগারের এক ব্লন্ড শ্বেতসুন্দরী। এককথায় চূড়ান্ত 'ফেমিনাইন'। এ'হেন 'বার্বি'-কে 'রিক্লেম' করা কি সম্ভব? পরিচালক গ্রেটা গারউইগের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল সেটাই। 

বার্বি-র শরীর নিয়ে অভিযোগ চিরকালীন। নারীবাদীরা এগারো ইঞ্চি পুতুলের ভাইটাল স্ট্যাট থেকে হিসেব কষে দেখিয়েছেন, পূর্ণদৈর্ঘ্যের নারী হলে বার্বির মাপজোক হত অবাস্তব : ৩১-১৮-৩৩।  বার্বিসুলভ বডিফ্যাট নিয়ে ঋতুমতী হওয়া অসম্ভব। বার্বির শরীরের অর্ধেকই পা-ময়, অথচ সরু, লম্বা, বাঁকা ঠ্যাঙের কারণে বার্বি  'নিজের পায়ে দাঁড়াতে'-ও অক্ষম। এই যে বার্বি-সৌন্দর্য, তার খুব একটা বদল ঘটেনি এত বছরে৷ হ্যাঁ, পলিটিকালি কারেক্ট হতে ম্যাটেল কাম্পানি কালো, হলদেটে, বাদামী বার্বি এনেছে। দু-একজনকে মোটা করেছে। গর্ভবতী বার্বি বা 'ড্র‍্যাগকুইন' বার্বিও আবির্ভূত হয়েছে। এরপর এসেছে 'হুইলচেয়ার-স্থিতা' বার্বি। এমনকী 'ডাউন সিন্ড্রোম' বার্বিও। ইয়ে, শুধু পলিটিকাল কারেক্টনেস অবশ্য কারণ নয়। এরা এসেছে, কারণ বাজারে কখনও 'বডি পজিটিভিটি' ধারণা বিকোচ্ছিল, কখনও 'এলজিবিটিকিউএ' বিষয় 'লোকে খাচ্ছিল ভাল। কখনও প্রতিবন্ধকতাকে বিশেষত্ব নামে ডাকা হবে কিনা সেই নিয়ে তর্ক চলছিল। কর্পোরেট ম্যাটেল সেই জনপ্রিয় আইডিয়াগুলো বিক্রি করে দেখেছে, কোনটায় কত লাভ! সেই বুঝে কোনো পুতুল রেখে দিয়েছে, কোনোটা বর্জন করেছে৷ লক্ষণীয় 'সৌন্দর্যের' হেরফের বড় একটা ঘটেনি। এমনকী ডাউনসিনড্রোম বার্বিও এতটাই সুন্দর যে তার শারীরিক বিশেষত্বর চেয়ে বিশেষ রঙা পোশাক দিয়েই তার 'সিন্ড্রোম' চিনতে হয়। এদিকে,  'ম্যাটেল'-এর বিজ্ঞাপনী ভাষায়, বার্বি হল তেমন, 'ছোট মেয়েরা বড় হয়ে যেমনটা হতে চায়।' নারীশরীর নিয়ে নারীরই মনে  হীনম্মন্যতা তৈরি হয়েছিল আগে থেকেই৷ ভিক্টোরীয় যুগে তারা আওয়ার গ্লাস ফিগারের সাধনায় আঁটো করসেট পরে পাঁজরার হাড় বেঁকিয়ে ফেলত শোনা যায়। এই হীনমন্যতার প্রসারণ বার্বিডল ঘটিয়েছে ছোটদের মধ্যেও। তারা যে শরীরের মতো শরীর পেতে চায়, তা বাস্তবসম্মত সুস্থ শরীর নয়, পুরুষের অলস ফ্যান্টাসি মাত্র। বস্তুত, যে জার্মান 'লিলি' পুতুল অনেকের মতে বার্বিপুতুলের অনুপ্রেরণা, সে শিশুতোষ নয়, সেক্সটয়-শপের পুতুল। 

এ ইতিহাস ফিরে দেখা বোধ করি দরকার ছিল,  কারণ বিনির্মাণের আগে নির্মিতের মূল নির্মাণ্টি সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান থাকতে হয়। কীভাবে বার্বিকে দেখেছেন পরিচালক? 'বার্বি' ছবিতেও বডি-ইমেজ সমস্যা অবধারিত ভাবে এসেছে। মৃত্যুভাবনা আসতেই বার্বির পায়ের পাতা 'ফ্ল্যাট' হয়ে যায়। জঙ্ঘায় দেখা গেছে সেলুলাইট। সকালবেলায় মুখে হয়েছে দুর্গন্ধ। অথচ এসব কি স্রেফ স্বাভাবিক নয়? বুঝতে বাকি থাকে না, এইভাবে 'স্বাভাবিক' আর 'অদ্ভুতের' সংজ্ঞা গুলিয়েছে মেয়েদের।

কিন্তু এসবের মূলে ছিল মৃত্যুচিন্তা।  খুশিয়াল পার্টিতে বার্বি (মারগট রবি) সহবার্বিদের বলেছিল, 'তোমরা কি মৃত্যুর কথা ভাব?' কোলাহল থেমে গিয়েছিল। বার্বির বার্বিত্ব থেকে নেমে আসা, মডেল নারী থেকে মানবী হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন দিয়ে। মেয়েরা কি এত গূঢ় দার্শনিক কথা ভাবে? অস্তিত্ববাদী দার্শনিক বলতে যাদের কথা মনে পড়ে, তারা কেউ মেয়েমানুষ নন। এমনকী ব্যুভোর নিজেও অস্তিত্ববাদী হলেও, পরিচিতি তাঁর নারীবাদী হিসেবে। 

'উইয়ার্ড বার্বি'-র পরামর্শে বার্বি মনুষ্যলোকে যায় সমস্যা সমাধানে। যে মানুষ তাকে নিয়ে খেলছে, তার দুশ্চিন্তা ও হতাশা রোগ কাটাতে পারলেই বার্বি পাবে সেলুলাইটহীন ত্বক আর হিল তোলা জুতো পরার উপযোগী পা। বার্বির সঙ্গে যায় প্রণয়াভিলাসী লেজুড় কেন্।  তারা গিয়ে দেখে, সেখানে লিঙ্গসম্পর্কের উলটপুরাণ। মেয়েদের ফিকে এমন দৃষ্টি হানছে পুরুষ, যেন সে বস্তুবিশেষ। অথচ বার্বিল্যান্ডে বার্বিরাই সর্বেসর্বা, কেন-রা ছায়ামাত্র। কেন্ কিন্তু বেশ লাগে পুরুষ শাসন। এই সুযোগে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির রূপরেখা আঁকেন পরিচালক। কেন্ 'পৌরুষ' শিখে দেশে ফেরে আর বার্বিকে তুলে নিয়ে যায় 'ম্যাটেল'। তাদের খাঁচা এড়িয়ে বার্বি যখন বার্বিল্যান্ডে ফেরে, তখন নব্যপুরুষ কেন্-রা বার্বিদের হটিয়ে দিয়েছে পার্লামেন্ট আর সেই 'ড্রিম হাউজ' থেকে, যা বার্বিডল পেয়েছিল বিংশ শতকের ষাটের দশকে। ম্যাটেল-এর 'বার্বি'জ ড্রিম হাউজ' আলোচনার আরেক পরিসর খুলে দিতে পারে৷ তখন সত্যিকার মেয়েদের কিন্তু নিজস্ব বাড়ি ছিল না। নকল বার্বি কি তাহলে আসল মেয়েদের ক্ষোভ প্রশমনের সেফটি-ভালভ?

অতঃপর কেন্ (রায়ান গসলিং) সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স আর ম্যান্সপ্লেনিং-এর ক্যারিকেচার হয়ে ওঠে। কেন্-রা বার্বিদের কপোলা-র 'গডফাদার' বোঝায়। স্টিরিওটাইপের পর স্টিরিওটাইও গড়েন গারউইগ, ভাঙবেন বলেই। আবার যে কেন্ নারীশাসিত সমাজে অবহেলিত ছিল, সে কেনের যন্ত্রণায় সমবেদনার আঙুল ছোঁয়ান গ্রেটা। হয় টক্সিসিটি, নয় ছায়াজীবন, এই কি তার ভবিতব্য? ছবির শেষে নিজের সত্তার খোঁজ করে কেন্ও, বার্বির প্ররোচনায়। এ কাজ গ্রেটা পারেন বোধহয় একারণেই যে দ্বিতীয় তরঙ্গ এখন অতীত। তিনি তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদী। দ্বিতীয় যদি আগ্রাসী হয়, তৃতীয় হল উদার,  ইনক্লুসিভ। ততদিনে জেন্ডার স্টাডিজের অঙ্গ হয়েছে 'মেন'স স্টাডিজ'-ও।

ফেবল্-এর মতো সরল বিষয়বস্তু, চরিত্রের বদলে ক্যারিকেচার আর স্টিরিওটাইপের ব্যবহার, ঘটনার ঘনঘটার অভাব, ক্যামেরা ও শব্দপ্রক্ষেপণে বৈচিত্রহীনতা ছবিটিকে ক্লিষ্ট করেছে নিঃসন্দেহে। বস্তুত, ছবি হিসেবে দেখলে শিল্পকর্ম হিসেবে দেখলে বার্বি হতাশ করে। সংলাপ শুধু না, সিনেমায় শব্দগ্রহণ ও ক্যামেরাও কথা হয়৷ কিন্তু এ ছবিত্রকিন্তু জেগে থাকে শুধু সংলাপ। ধারালো, দীপ্ত, ব্যাঙ্গাত্মক সংলাপ। 

ছবিতে বার্বি বলেছিল, 'বার্বির সৌজন্যে নারীবাদের জয় হয়েছে।' বার্বিল্যান্ডে তখন প্রেসিডেন্ট, নোবেলজয়ী, ডাক্তার বা নভোচারী বার্বিদের আনাগোনা।  তবু বার্বির দাবি যে আয়রনিকাল, তা স্পষ্ট করতে পরিচালক আমাদের 'ম্যাটেল' কাম্পানির পুরুষসর্বস্ব বোর্ডমিটিং-এ হাজির করেন। শুধু আয়রনি নয়, উইট আর হিউমারেও গারউইগ সিদ্ধহস্ত। সিইও (উইল ফেরেল) সগৌরবে জানান, তাঁদের জেন্ডার-নিউট্রাল টয়লেট আছে; পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে দুজন সিইও ছিলেন নারী। কর্মচারী বলে, 'আমার মতামতের দাম নেই, আমাকেও নারী ধরতে পারেন।' এমন মিছরির ছুরি ছড়ানো ছবি জুড়ে। বাজারের 'অদৃশ্য হাত' বার্বিকে 'স্বাধীন স্বাধীন' খেলতে দেয়, কারণ নারীস্বাধীনতা বিকোয় ভাল। যেখানে ফেমিনিস্ট সন্দর্ভ ও স্কলারেরা পুঁজিবাদের হাতের দানা খায়, সেই পরিসরটিকে পরিচালক 'প্লাস্টিক ওয়ার্ল্ড' বলে অব্যর্থভাবে চিহ্নিত করেন। এই কৃতিত্ব তাঁকে দিতেই হয়। কিন্তু ছুরিকে মিঠে হতে হয় কেন? 

পৃথিবীতে বার্বি খুঁজে পেয়েছিল সেই মেয়েকে, যে তাকে নিয়ে খেলা করে। কিশোরী সাশা নয়, তার মা গ্লোরিয়া। সেই জোড়া মা-মেয়েকে নিয়ে বার্বি ফিরছিল বার্বিল্যান্ডে। তাদের খুশি করে নিজের সেলুলাইট দূর করতে হবে যে! তাদের যখন বার্বি নিজের গোলাপি জগতের সাতকাহন শোনাচ্ছে, তখন কিশোরী সাশা জিজ্ঞাসা করে, 'অদৃশ্য হাত কি খেলা করে তোমাদের নিয়ে?' গ্রেটা গারউইগের নারীবাদী প্রকল্প 'বার্বি'-র সমস্যা ও সম্ভাবনা এই প্রশ্নটিতে নিহিত।

আপাতভাবে সাশা-গ্লোরিয়ারাই সেই অদৃশ্য হাতের অধিকারী, যারা বার্বিপুতুল  নিয়ে খেলে। আবার প্রশ্নটি অস্তিত্ববাদীও। সেই মৃত্যুজিজ্ঞাসার মতো। রাজা লিয়ার বলেছিলেন, 'দুষ্টু বালকের হাতে পতঙ্গ যেমন, ঈশ্বরের কাছে আমরাও কি তেমন?'  কিন্তু 'অদৃশ্য হাত'-এর প্রশ্নে আরেক অবধারিত সন্দেহ জাগে, যা গারউইগ নিজেই উস্কে দিয়েছেন।

 প্রশ্নটি যদি আত্মজিজ্ঞাসা হয়? গারউইগ নিজে কতটা স্বাধীন 'বার্বি প্রকল্পে'? 'ম্যাটেল' সহ একাধিক ব্র‍্যান্ড-এর  সঙ্গে বিপণন-চুক্তিতে আবদ্ধ যে ছবি, তারও কি হাত-পা বাঁধা নয়? বেয়াড়া প্রশ্নগুলো তাকে ঢেকে দিতে হতই ক্যান্ডি-রঙা ঠাট্টায়। 

আর যদি 'অদৃশ্য হাত' না ধরতেন পরিচালক? তবে আপোষহীনতার ঘরে টিক পড়ত, কিন্তু 'বার্বি' একটা বিগ-বাজেট 'ঘটনা' হত না। রিপাব্লিকানরা ক্ষুব্ধ হত না। 'টক্সিক ম্যাসকুকিনিটি', 'ম্যান্সপ্লেনিং' বা 'বডি ইমেজ' নিয়ে জনসংস্কৃতি ব্যস্তসমস্ত হত না। পরিচালকের এজেন্সি নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু তাঁর পদ্ধতি ও প্রাপ্তি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো তত সহজ নয়৷ 

গ্রেটার বার্বি কিন্তু শেষ পর্যন্ত বার্বিল্যান্ড ত্যাগ করে। রুথ হ্যান্ডলারের হাত ধরে সে গোলাপি আর ধূসর জগতের সীমান্তপ্রদেশে দাঁড়ায় গোধূলিবেলায়। সে আর পুতুল থাকতে চায় না। স্রষ্টা অবাক হয়ে দেখেন, মানবীসত্তায় অভিষিক্ত হতে চায় তার  'মানবীর চেয়ে শ্রেয়' সৃষ্টি। তিনি নাচার, কারণ 'দ্য অভার ইজ ডেড।' আইডিয়া' যতই অবিনশ্বর বা উন্নততর হোক, অন্যের 'আইডিয়া' হওয়ার চেয়ে নিজেই আইডিয়াবাজ মানবী হওয়ার অনিশ্চয়তাকে অন্তত একজন বেছে নেয়।  ফ্ল্যাট পায়ে ফ্ল্যাট জুতো গলিয়ে, সদ্যপ্রাপ্ত যোনি নিয়ে সে গায়নোকলজিস্টের কাছে যায় শেষ দৃশ্যে। বার্বিদের যোনি থাকে না, মানবীর থাকে। যোনি আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। যৌন অধিকার, মাতৃত্বের অধিকার, জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাতের অধিকার…কতকিছুর ক্রিয়াভূমি! বার্বি, অতএব, কঠিনতর অভিযানে বেরোলো,  এমন ইঙ্গিত দিয়ে গ্রেটা যবনিকা টানেন। 

গ্রেটা চেষ্টা করেন অন্তত। ধনতন্ত্রের বুকের উপর বসে তার ও পিতৃতন্ত্রের চামড়া ছাড়ানো সহজ কাজ নয়৷ কতটা কঠিন, তা যদি উপলব্ধি করা যায়, তবে বোঝা যায়, গ্রেটা প্রশ্নপত্রের কাঠিন্যমাত্রার সাপেক্ষে মন্দ ফল করেননি।