পুঁজিবাদের উদ্ভব ও প্রকৃতি নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্কের রূপরেখা
- 07 August, 2023
- লেখক: মিনহাজুল ইসলাম
"পুঁজিবাদ" নামক যে বিষয়টি, কম করে হলেও গত ১২০ বছরে বুদ্ধিমহলে সম্ভবত সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ। "পুঁজিবাদ" কে পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক জায়গা থেকে দেখার আকাঙ্ক্ষা এবং প্রচেষ্টা অনেক দিন যাবৎ চলছে আর অর্থনৈতিক ইতিহাস ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি সাংস্কৃতিক ইতিহাস বোঝা ও দায়। মার্কসের মতে "The Conditions of Economic system is the most important materialist conception of history and society", আর অ্যাডাম স্মিথের ভাষায় " Modern man merely an economic man", অর্থাৎ আধুনিক জমানার মানুষ মাত্রই সে অর্থনৈতিক জীব৷ এরিস্টটলের অমোঘ বাণী Man is a political animal কে স্মিথ সম্ভবত আরেকটু বাড়িয়েই বলেছেন "Modern man is an Economical animal", স্মিথ সাহেব গ্রীক দর্শনের একজন বড় পণ্ডিত, নীতিশাস্ত্র পড়াতেন, সেই হিসেবে " Economical animal" এর ধারণা টি তাঁর আবিষ্কার, যেখানে তিনি দাবিই করেছেন যে মানুষের অর্থনৈতিক সত্তা, যা কিনা উৎপাদন, বিনিময় এবং ভোগ, এই তিনটি চক্রের মধ্যেই পরিচালিত, যেই সত্তার বিকাশ আদিম পৃথিবীতে হয়নি, কিন্তু আগামী পৃথিবীতে তাই ই হবে। স্মিথের কথা মিথ্যা না হলেও, আংশিক সত্য। যতটুকু সত্য তা সর্বৈব সত্য, কিন্তু যতটুকু সত্য না অর্থাৎ অস্পষ্ট তাই হচ্ছে শুভংকরের ফাকি। স্মিথের কিছু বছর আগেই ফরাসি আরেক প্রতিভাবান দার্শনিক জ্যা জাক রুশো এই বিষয়টি আরো ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তার Discourse on Political Economy এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা The Social Contract এ তিনি এই যে আগমনী "অর্থনৈতিক মানব", এর গঠন, গতি-প্রকৃতি এবং তার হালহকিকৎ কী হবে সেই বিষয়ে এক ধরনের জটিল আলোচনার উত্থাপন করেন, রুশোর মতে অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যবাদ, কারিগরি শিল্প এবং কারাখানাবাদের মধ্যে দিয়ে মানুষের এক ভয়ংকর বিরাজনীতিকরণ হয়েছে, গণতন্ত্রের তলপেট থেকে সে সৃষ্টি করেছে এক অদ্ভুত "প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা" যা তার নাগরিক সার্বভৌমত্বের নীতি ও ভিত্তির সাথে দ্বান্দ্বিক। রুশোর মতে "রাজনীতিবিদ" নামক শ্রেণীর সৃষ্টি তখন থেকেই এবং নাগরিক সমাজ (Civil Society) ও রাজনৈতিক সমাজ (political society) এর মাঝে বিভক্তির সূচনা তখনই ঘটলো যা রুশোর মতে মানবজাতির জন্য একটি অকাম্য ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা।
রুশো "পুঁজিবাদ" শব্দটি ব্যবহার করেননি, এর কারণ অবশ্য তখনো ফরাসি দেশের অর্থনীতি অ-পুজিবাদী কৃষিভিত্তিক-বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু রুশো ইতিহাসবিদের মতো ইতিহাস এবং সমসাময়িক ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাই তিনি বুঝে গেছিলেন ইংরেজ দেশের কারখানাবাদ, বণিকবাদ ও বাণিজ্যতন্ত্রের হাওয়া অতি শীঘ্রই ফরাসি দেশের সুমিষ্ট সাদা মদীরার গ্লাসের আশপাশ দিয়ে বয়ে আসতে শুরু করেছে, যার প্রমাণ হলো রুশোর মতে "জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব ও সরাসরি সার্বভৌমত্ব চর্চা ও নাগরিক অধিবেশনের অবসান এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার আভাস। "পুঁজিবাদ সম্বন্ধে বোঝার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের ইতিহাস বোঝা খুবই জরুরি, যার সাথে স্মিথের Economical Animal ধারণাটির সম্পর্ক অতি গভীর৷ পুঁজিবাদ কিংবা পুঁজিবাদী ধারণা সম্পর্কিত যাই ই আমরা বলি সাথে সাথে আমাদের মাথায় মার্ক্সের লেখাজোকা ও তার চিত্র ভেসে ওঠে এবং এই ভেসে ওঠাটা যথেষ্ট স্বাভাবিক কারণ পুঁজিবাদী সমাজের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সমালোচক ছিলেন মার্ক্স এবং নিজেকে তিনি কখনই অর্থনীতিবিদ বলে দাবি করেননি। মার্কসের কাছে পুঁজিবাদ বিষয়টা নেহাৎ অর্থনৈতিক কোনো ঘটনা নয় বরং পুঁজিবাদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে গোটা মানবসভ্যতা এবং এর গতিপ্রকৃতির। এজন্য মার্ক্স নিজেকে একজন সমাজ বিশ্লেষক বা Social Critic হিসেবেই পরিচয় দিতেন।
মোটাদাগে মার্ক্সের মৃত্যুর পর এবং রুশ বিপ্লবের পরে গোটা পাশ্চাত্যে মার্ক্সবাদী বিভিন্ন দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, সংস্কৃতি বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে। পুঁজিবাদ কে নানা জন নানান ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু মোটামুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পুঁজিবাদ কে অর্থনৈতিক একটি ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ ভাবে অধ্যয়ন করা শুরু হয়নি। অর্থাৎ ইতিহাসের জায়গা থেকে দেখলে পুঁজিবাদের ইতিহাস কে অর্থশাস্ত্রের (Economics) তত্ত্বের ইতিহাসের আলোকে ব্যাখ্যা করার চলটা শুরু হয় মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এর পূর্বে অর্থনৈতিক জায়গা থেকে পুঁজিবাদের ইতিহাস ও উৎপত্তি নিয়ে যেসব আলাপ আলোচনা হয়েছে সেগুলো মূলত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকেই। অর্থনীতিবিদদের জমানা শুরুই হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং এই সময়েই কিছু মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ এবং কতিপয় ইতিহাসবিদেরা মিলে পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং এর একটি বাস্তব ইতিহাস রচনা করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।
এই বাস্তব ইতিহাস রচনা করার বাসনা থেকেই সৃষ্টি হয় একটি বিতর্কের যাকে বলা হয় বিখ্যাত "Transition Debate" বা উত্তরণ বিতর্ক। অর্থাৎ সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ ইতিহাসের ঠিক কোন পর্যায়ে, কোন সময়ে, কোন সমাজে এবং কোন কোন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ঘটেছিলো তা নিয়ে সৃষ্টি হয় তুমুল বিতর্কের এবং সেটা হয় খোদ মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের মাঝেই। তার আগেই একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটা হলো পুঁজিবাদের উৎপত্তি নিয়ে কিন্তু শুধু মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকেরাই গবেষণা করেননি বরং অ-মার্ক্সবাদী ঘরানাতেও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন এবং তারা তাদের স্ব স্ব গবেষণার মাধ্যমে তাদের যুক্তি মাফিক পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ওয়ের্নার সোমবার্ট নামক জার্মান অর্থনীতিবিদ প্রথম মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণের বাইরে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদের উৎপত্তির তত্ত্ব বিস্তারিতভাবে আনলেন। তিনি মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সমালোচনা করে ভিন্ন ভাবে পুঁজিবাদের উৎপত্তিকে দেখার চেষ্টা করেন। তবে মার্ক্সের সাথে একমত হয়ে তিনিও বলেছেন যে পুঁজিবাদ কেবল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয় বরং একটা সমাজিক ব্যবস্থাও। কিন্তু এর অর্থনৈতিক উৎস ঠিক ঐতিহাসিক ভাবে এতটা সরলীকৃত নয় যেরকম টা মার্ক্স মনে করতেন (সামন্তবাদের পর পুঁজিবাদ এরকম আর কি)। Modern Capitalism (1894) বইতে তিনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আকারে পুঁজিবাদের উৎপত্তি আলোচনার বদলে পুঁজিবাদকে একরকমের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চরিত্র হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছেন। তার মতে পুঁজিবাদের উৎপত্তির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিলো ইউরোপীয় হস্তশিল্পী (Handicraft) ও কারুশিল্প (Artisanship), উভয়ের বিকাশ। সোমবার্টের মতে পুঁজিবাদের উৎপত্তি মূলত এক ধরণের "উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব" এবং "অর্থের মাধ্যমে অর্থ সৃষ্টি" করার বাসনা। সোমাবার্ট ১৫০০-১৬০০ সালের মধ্যেকার ইউরোপীয় সামন্ত ও জমিদারদের সঙ্গে হস্তশিল্পী ও কারিগরদের সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে পুঁজিবাদের এই বিকাশের পেছনে জমিদারদের দ্বারা প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও তাদের জমির অংশবিশেষ ঐ বিভিন্ন উঠতি বণিকদের কাছে হস্তান্তর হতে লাগলো, তারা স্বেচ্ছায় তা করতো কারণ জমিদার ও সামন্তপ্রভুদের সেই উদ্যোক্তা হওয়া এবং অর্থ দিয়ে অর্থ উপার্জন করার গুণ, বুদ্ধি কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই ছিলোনা। সেই কারণে তারা বণিকশ্রেণীর পেছনে প্রচুর পরিমাণ সম্পত্তি ও অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং এর ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদের উৎপত্তি হয়। উল্লেখযোগ্য এই যে সোমবার্ট কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট জায়গা, সময় বা কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনা কে এখানে পুজিবাদের উৎপত্তির কারণ হিসেবে দেখা থেকে বিরত থেকেছেন কারণ তিনি সরলীকৃত ইতিহাসের পক্ষপাতী ছিলেন না।
অন্য দিকে জার্মান আরেকজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ এবং সোমাবার্টের গুরু জর্জ শ্মোলার কিন্তু সোমবার্টকে সমালোচনা করেন কারণ তার মতে হস্তশিল্প এবং কারুশিল্প ইউরোপীয় সমাজে ও উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রকট (ডমিন্যান্ট) ছিলোনা, বরং এই শিল্প ও কারিগরির উত্থান ঘটে আরো পরে। শ্মোলারের মতে এই শ্রেণীর অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছিলো মূলত যখন দূর সমুদ্রের বড় বড় বাণিজ্যপথগুলো আবিষ্কৃত হলো এবং বাণিজ্যের সূচনা হলো তখন। এই শ্রেণীর মধ্যে একটি মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি হলো, ফলে পুরাতন গরীব কারিগররা অধিক দামে তাদের উপরের স্তর অর্থাৎ মধ্যশ্রেণীর বণিকদের কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতো যাতে করে দূর সমুদ্রের বাণিজ্যের বাজারে এসকল পণ্য বিক্রি করা সম্ভব হয়। এখানে শ্মোলার গুরুত্ব দিচ্ছেন উক্ত মধ্য শ্রেণীর বণিকদের উপর, কারিগর কিংবা হস্তশিল্পীদের উপর নয়, কারণ এই কারিগর শ্রেণী আর কিছু দিন পরেই শ্রমিকে পরিণত হয়, যাকে মার্ক্স অন্যভাবে বলেছিলেন "Proletarianization"।
ঠিক সেই সময়ে আরেক প্রখ্যাত জার্মান তাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও সেটার ঐতিহাসিক বিকাশ নিয়ে আরেক তত্ত্ব নিয়ে হাজির করেন। ওয়েবারের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো মূলত প্রাচীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তার পিএইচডি থিসিস ছিলো মূলত মিশর, রোম, পারস্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। কিন্তু সে সেখান থেকে পরবর্তীতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপত্তি নিয়ে একটি বিখ্যাত বই লেখেন (Protestant Ethics and the spirit of capitalism) যেখানে তিনি ইউরোপের খ্রিষ্ট ধর্মের সংস্কার অর্থাৎ প্রটেস্টাণ্টিজমের আবির্ভাব কে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপত্তির একটি মূখ্য কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ সম্ভব হয়েছে একমাত্র প্রটেস্টাণ্ট ধর্মের পরেই এবং ওয়েবার দেখিয়েছেন যে ঠিক কোন কোন দেশ গুলোতে প্রটেস্টাণ্ট ধর্মের উত্থান ঘটেছে এবং সেই দেশ গুলোইতেই পুঁজিবাদের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়েছো। তার মতে ক্যাথলিক ধর্মচিন্তায় ব্যবসা বিষয়টি হারাম এবং ধর্মীয়ভাবে ঘৃণিত ও অপরাধের শামিল। এই যে ক্যাথলিক ধর্মীয় মূল্যবোধ এই মূল্যবোধকে প্রতিস্থাপিত করলো প্রটেস্টাণ্ট মূল্যবোধ যার মূল মন্ত্রই ছিলো " work is worship" অর্থাৎ ইশ্বর কর্মজীবী কে পছন্দ করেন, ইশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের কে সৃষ্টি করেছেন, এখন আমরা আমাদের মতো উৎপাদন করবো ও সমাজ গড়বো ভালো ভাবে জীবনযাপন করার জন্য এবং এতেও ইশ্বরের সন্তুষ্টি ই লাভ হবে। এই গভীর প্রটেস্টাণ্ট মর্মবাণী ই পুঁজিবাদের উত্থানের পেছনে সবচেয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। The religion of india এবং the sociology of religion বইয়ে, ভারতে বা পৃথিবীর অন্যত্রে কেনো পুঁজিবাদ বিকশিত হয়নি এর কারণ হিসেবে কিন্তু সে সেই ধর্মীয় সংস্কার এবং বিশেষ প্রটেস্টাণ্ট জাতীয় মূল্যবোধের অভাব কেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ওয়ের্নার সোমবার্ট ই আবার ওয়েবারের এই তত্ত্ব কে সমালোচনা করলেন৷ তার মতে প্রটেস্টাণ্টিজম পুঁজিবাদের কারণ নয়, বরং এর ফলাফল। সোমবার্টের সমালোচনার আরো একটি বড় বিষয় ছিলো যে ওয়েবার যে পুঁজিবাদের কথা বলছে তা পনেরো শতকে ইতালি তে বিদ্যমান ছিলো কিন্তু ইতালির নগর রাষ্ট্র গুলোতে প্রটেস্টাণ্ট ছিলোন! তাহলে কিভাবে ওয়েবার এই মতে উপক্রম হলেন যে প্রটেস্ট্যান্টিজমের ফলে পুঁজিবাদের উত্থান হয়েছে! অন্যদিকে সোমাবার্টের সমালোচক তার গুরু জর্জ শ্মোলারের মতে পুঁজিবাদের উৎপত্তি মূলত সমুদ্র বাণিজ্যের পথের সৃষ্টি এবং দূরদেশ গুলোর সাথে বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন পদ্ধতি। শ্মোলার মূলত প্রখ্যাত বেলজিয়ান ঐতিহাসক হেনরী পিরেনের তত্ত্ব ব্যবহার করেছিলেন। পিরেনের বই "Economic history of medieval Europe" বইতে তিনি ইউরোপীয় বাণিজ্য অর্থনীতি আলোচনা করতে যেয়ে সেটার পেছনে সমুদ্র পথের আবিষ্কার এবং মেডিটেরিয়ান সাগরে আরবদের আধিপত্যের অপসারণ ও সেখানে ইউরোপীয়দের ডমিন্যান্সের আবির্ভাব সেগুলো আলোচনা করেছেন। শ্মোলারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই রকম বিপুল পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো পুঁজিবাদের। অ-মার্ক্সবাদী ঘরানার এই সকল তাত্ত্বিকগণই তাদের তাত্ত্বিক অবদানের জন্য স্বীকৃত হলেও এদের সকলের তত্ত্বের মধ্যেই বেশ কিছু সাধারণ গোলমাল আছে এবং উক্ত গোলমালের কারণ টা তাদের নিজেদের চিন্তার প্রেক্ষাপটের সীমাবদ্ধতা। মার্ক্সবাদী ঘরানার পুঁজিবাদের ইতিহাস এবং উৎপত্তি সংক্রান্ত তাত্ত্বিকদের মধ্যে রাজনৈতিক, ইতিহাসবিদ এবং অর্থনীতিবিদেরা ছিলেন। প্রথম দিকে পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে আলাপ তুলেছিলেন চেক দার্শনিক কার্ল কাউটস্কি, তার The Agrarian Question বইতে। কাউটস্কি কিন্তু পুঁজিবাদের উৎপত্তি অনুসন্ধান করেননি বরং তার বক্তব্য ছিলো কৃষি অর্থনীতি তে পুঁজিবাদের বিকাশ সম্ভব কিনা কারণ তখন তর্ক চলছিলো যে কৃষিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আনা সম্ভব হবে কিনা, অর্থাৎ কৃষিতান্ত্রিক অর্থ ব্যবথা মাত্রই কি সামন্ততন্ত্র? নাকি সেটাতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটা সম্ভব? লেনিনের মতে মার্ক্স কৃষি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশ নিয়ো লেখেননি কিন্তু কাউটস্কি মার্ক্সের এই অসমাপ্ত কাজ টা করে দিয়ে মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক জগতের একটা পূর্ণতা দান করেছেন। কাউটস্কি এবং লেনিন, উভয়ের মতেই পুঁজিবাদের বিকাশ কে একরৈখিক ভাবে দেখাটা সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক গোঁড়ামি। রাশিয়ায় রাজতন্ত্র ছিলো এবং এটার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিলো কৃষিভিত্তিক তার মানে এই নয় যে রাশিয়া সামন্ততান্ত্রিক। লেনিন তার The Development of capitalism in Russia বইতে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন হেগেলীয় একধরনের টোটাল হিস্ট্রির দৃষ্টি দিয়ে, যে ইউরোপীয় পুঁজিবাদের বিকাশ কে খণ্ডভাবে দেখার সুযোগ নাই, বরং ইউরোপীয় পুঁজিবাদ ও কারখানা-ব্যবস্থার বিকাশ হয়েছে দেখেই রাশিয়াতে সেটা হয়নি, অর্থাৎ লেনিন পুঁজিবাদ কে সর্বপ্রথম "বৈশ্বিক" জায়গা থেকে দেখতে শুরু করলেন এবং কাউটস্কির বরাত দিয়ে লেনিন ঘোষণা করলেন যে পুঁজি হলো একটি বৈশ্বিক শৃঙ্খলের মতো, "and Russia, Russia is the weakest chain of capitalism". সুতরাং কাউটস্কি লেনিনের আলোচনা ও বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে কারখানা ছাড়া যে পুঁজিবাদের বিকাশ সম্ভব না এটা তত্ত্ব সর্বাংশে সঠিক নয়। এই আলোচনার সূত্র ধরে লেনিন-কাউটস্কি মনে করেন সোভিয়েত রাশিয়া তে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আনা সম্ভব কারণ প্রয়োজনীয়ভাবে যে মার্ক্সের আশা অনুযায়ী ইউরোপে সমাজতন্ত্র আগে আসবে এবং তারপর ইউরোপের থেকে অনুন্নত দেশ গুলোতে সমাজতন্ত্র সিরিয়ালি আসবে এই ধরণের বলদ মার্কা সরলরৈখিক উদ্ভট ঐতিহাসিক তত্ত্বের লেনিন-কাউটস্কিরা মোটেই বিশ্বাস রাখতেন না। কিন্তু তাদেট এই আলাপে পুঁজিবাদের বিকাশের বিভিন্ন দিক এবং রূপ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া গেলেও ঠিক পুঁজিবাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় হিসেবে অর্থশাস্ত্রের বিকাশ ঘটছে মাত্র, "অর্থনীতিবিদ" শব্দটা তখনো শোনা যাচ্ছিলো না সেভাবে। বলা চলে মার্ক্সবাদ এবং মার্ক্সের তত্ত্ব বুঝতে হলে তার সবচেয়ে বিশ্লেষিত বিষয় "পুঁজিবাদ" কে বুঝতে হবে এবং তাকে বুঝতে হলে তার উৎপত্তি এবং ইতিহাস কে বুঝতে হবে। ইউরোপের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সেই দায়িত্ব টা নিলেন যাদের মধ্যে ছিলেন এরিখ হবসবম্, রডনি হিলটন, ই.পি থম্পসন, ক্রিস্টোফার হিল প্রমুখ। এই ইতিহাসবিদেরা মোটামুটি একমত ছিলেন যে ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদের আনুষ্ঠানিক উদ্ভব ঘটেছিলো এবং এই ইংরেজ ঐতিাসিকগণ মার্ক্সীয় ধারায় ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাস লেখা শুরু করলেন। এরিখ হবসবমের চার খণ্ডে ইউরোপের ইতিহাস যার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ The Age of revolution এবং the age of capital, যেখানে তিনি আধুনিক ইউরোপ যার বিকাশের ভিত্তি হলো দার্শনিক ভাবে এনলাইটেনমেন্ট এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব যার আরেক ভিত্তি হলো শিল্প-পুঁজিবাদ (Industrial capitalism) এর বিবর্তন কে ব্যাখ্যা করেন। তবে হবসবম বাদে ঐ ঘরানার সকল মার্ক্সবাদী মূলত নজর দেন মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসের দিকে কারণ তাদের মতে সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপ কে বুঝতে পারলেই পুঁজিবাদী ইউরোপকে বোঝা সম্ভব, সেজন্য প্রয়োজন সামন্ততন্ত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ। ই.পি থম্পসনের বিখ্যাত বই The Making of the English Working Class, রডনি হিলটনের The decline of the serfdom in medieval England, Class conflict and the crisis of feudalism, ক্রিস্টোফার হিলের The Century of Revolution, 1603-1714, Reformation to industrial revolution, বই গুলো মূলত ইউরোপীয় তথা ইংল্যান্ডের সামন্ততন্ত্র এবং তার বিরুদ্ধে ইংরেজ প্রলেতারিয়াতদের বিপ্লবের ইতিহাস যার মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিকাশ এবং শিল্প-পুজিবাদের সূচনা কে কেন্দ্র করে অসামান্য ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ। কিন্তু এর পূর্বেই একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়ে গেছিলো যেই সমস্যাটি ইতিহাসবিদদের নজরে পড়ার পূর্বে অর্থনীতিবিদদের নজরে পড়েছিলো তা হলো সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিতন্ত্রে যে উত্তরণ ঘটেছিলো ইউরোপে তা কিভাবে ঘটেছিলো সেটার খাটি অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা, অর্থাৎ ইতিহাসবিদেরা যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তা অর্থনৈতিক হলেও অর্থনীতি কে পাশ কাটিয়ে মূলত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিলো কিন্তু অর্থনীতিবিদদের দাবি ছিলো যে এতে আসলেই নৈব্যক্তিকভাবে "পুঁজিবাদ" একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে এর উৎপত্তি এবং বিকাশ টা বিশেষ ভাবে বোঝা হচ্ছেনা এবং এই যে বিশেষ ভাবে যে বোঝা হচ্ছেনা এটা গোটা মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক জগতের একটা বিশাল সংকট কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পাশ্চাত্য ও আমেরিকা নতুন করে যখন বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সম্প্রসারণে প্রতিজ্ঞ হচ্ছিলো তখন পুঁজিবাদের রূপ বদলাচ্ছিলো এবং তা পূর্বের তুলনায় আরো বেশি সাংঘাতিক ও ভয়াবহ ভাবে গোটা দুনিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করার দিকে ঝুকছিলো, যেটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদেরা তীব্র ভাবে উঠেপড়ে লেগেছিলো কিন্তু কি করে সম্ভব সেটা যদি পুঁজিবাদের সঠিক উৎপত্তি এবং বিকাশ ই না বোঝা সম্ভব হয়? ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো বিতর্ক। বিতর্ক টা ঠিক যে ইতিহাসবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের মাঝে হলো এমন না বরং বিতর্ক টা মার্ক্সবাদীদের মাঝেই শুরু হলো। ১৯৪৫ সালের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদ মরিস ডব Studies in the development of capitalism বইটি লিখেন যেটা সারা দুনিয়ায় সকল মার্ক্সবাদী এবং অ-মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদদের গভীর ভাবে নজর কাড়লো। মূলত ডব এই বইটা লিখেছিলেন তার পূর্বে আরেক প্রখ্যাত মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদ পল সুইজির লেখা বিখ্যাত বই The Theory of capitalist development বইয়ের সমালোচনা করে। যদিও ডবের মূল লক্ষ্য সুইজি কে সমালোচনা করা ছিলোনা কারণ সুইজির সব ধারণার সাথে তিনি দ্বিমত পোষণ করেননি, শুধুমাত্র পুঁজিবাদের উৎপত্তির বিষয় টি নিয়ে সুইজির সাথে তীব্র ভাবে দ্বিমত পোষণ করেন এব তাকে সমালোচনা করেন। শুরু হলো সেই বিখ্যাত "উত্তরণ বিতর্ক" (Transition Debate) বিতর্কে উক্ত ইংরেজ ঐতিহাসিকেরাও যোগ দেন এবং এই বিতর্কের সমাধান হোক বা না হোক কিন্তু এই বিতর্কের মধ্যে দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছিলো সেটা হলো পুঁজিবাদের উৎপত্তি নিয়ে অ-মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের চিন্তার দৈন্যতা এবং অসারতা। ডব শুরুতেই পুঁজিবাদ (capitalism) কে "বাণিজ্যবাদ" (commercialism) থেকে পৃথক করলেন এবং তার মতে বাণিজ্যবাদ মানবসভ্যতার সূচনালগ্নেই ছিলো, যেই অর্থ ব্যবসা বাণিজ্যের বিষয়টি মানবসভ্যতার শুরু থেকে ছিলো ঠিক সেই অর্থে। ওয়ের্নার সোমবার্ট, জর্জ শ্মোলার কিংবা ম্যাক্স ওয়েবার তারা পুঁজির উৎপত্তির পেছনে যে যুক্তি গুলো দিয়েছেন সেগুলো তেমন একটা ফেলনা নয় কিন্তু তারা আসলে মূলত আধুনিক ইউরোপীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা কে পুঁজিবাদ মনে করেছিলেন। পুঁজিবাদের যে নিজস্বতা অর্থাৎ পুঁজির নিজস্ব গতিপ্রকৃতি তাদের বোধের বাহিরে ছিলো। বাণিজ্য মাত্রই তা পুঁজিবাদ নয় যদিও সেখানে মুনাফার বা অতিরিক্ত মূল্যের সঞ্চয়ন থাকে তবুও সেটাকে পুঁজিবাদ বলা যায়না। ইতালি এবং বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডে যে ব্যবসা বাণিজ্যের উৎপত্তি হয়েছিলো এবং নগরকেন্দ্রিক ও বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য গড়ে উঠেছিলো সেটা ঠিক পুঁজিবাদী ছিলো না বরং সেটা ছিলো বণিকবাদ কিংবা বাণিজ্যবাদ, অর্থাৎ ইতিহাসবিদ এলেন মেইকসিন্স যাকে বলেছেন "Non-capitalist commercial system" (অ-পুজিবাদী বাণিজ্যিক ব্যবস্থা), এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো সেই সকল বণিকতন্ত্র ও বাণিজ্য ছিলো মূলত বিলাসী পণ্য ও বিবিধ কাঁচামাল সম্পর্কিত যেগুলোর ভোক্তা ছিলো মূলত নির্দিষ্ট দেশের রাজকীয় ও আভিজাতিক পরিবার, সাধারণ মানুষ নয় কারণ সাধারণ মানুষের চাহিদার মেটানোর জন্য সেই সব বাণিজ্য অসম্ভব ছিলো, এমনকি সাধারণ মানুষের "চাহিদা" তখনো বাজারকেন্দ্রিক ছিলো না। তাহলে পুঁজিবাদের উৎপত্তি কোথায়? ডব এবং উক্ত ইংরেজ ঐতিহাসিক তথা রডনি হিলটন, হবসবম, থম্পসন, তাদের মতে পুঁজিবাদের একদম প্রাথমিক উৎপত্তি মূলত "ইংরেজ দেশীয় অনন্য কৃষিব্যবস্থায়" (Unique English domestic agrarian system)।
প্রশ্ন উঠে তাহলে ইংরেজ কৃষিব্যবস্থায় কি এমন ঘটেছিলো যাকেই মূলত ডব এবং ইংরেজ ইতিহাসবিদেরা পুঁজিবাদ এবং বাজার অর্থনীতির একটি প্রাথমিক উৎপত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন? ইতিহাসবিদ রডনি হিলটন এবং এলেন মেইকসিন্সের মতে ইউরোপে মধ্যযুগে সাধারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হতো মূলত ভূস্বামী এবং ভূ-শ্রমিকের সম্পর্কের ভিত্তিতে, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে Serfdom সেটা। এই ভিত্তিতে ভূমিহীন কৃষক যে ভূস্বামীর জমিতে চাষ করবে এবং তাকে খাজনস্বরূপ ফসল দিবে এর থেকে একটা অংশ ভূস্বামী তাকে দান করবে তার নিজের খেয়ে পড়ে বাচার জন্য। মার্ক্সের মতে এইখানে উদ্বৃত্ত ফসলের অংশ টা ভূস্বামী নিয়ে নিতেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে তৎকালীন সময়ে এটাই ছিলো মূলত কৃষি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি৷ এছাড়া তখনো ইউরোপীয় পতিত জমির ধারণা ছিলো এই যে ঐ সকল পতিত জমিতে কৃষকেরা চাষ করে নিজের ফসল ফলায়ে নিজের রুজিরোজগার পরিচালনা করবে। কিন্তু রডনি হিলটনের মতে ১৪ শতকের দিকে যখন ভয়ংকর মহামারী দেখা গেলো এবং প্রচুর মানুষ মারা যেতে লাগলো এতে করে কৃষক তথা ভূমি মজুরের সংকট দেখা গেলো। এর পাশাপাশি কৃষকরাও বিদ্রোহ করা শুরু করলো তাদের বিদ্যমান মজুরি ও ভূস্বামী কর্তৃক শোষণের বিরুদ্ধে, যেটা ১৩৮৮ এর কৃষক বিদ্রোহ নামে রডনি হিলটনরা অভিহিত করেছেন। রডনি হিলটনের মতে উক্ত মহামারী, কৃষকদের বিদ্রোহ এবং তার ফলে ইংল্যান্ডে কৃষি ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে নতুন মজুরী ও শ্রম আইন করা হলো এর মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদরে উত্থানের একটি দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেছিলো৷ ঠিক সেই সময়ে তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যুগের সূচনা হচ্ছিলো, ভারত ও আমেরিকা আবিষ্কৃত হলো, নতুন নতুন বাণিজ্য পথের আবিষ্কার হওয়া শুরু হলো, আস্তে আস্তে একটি আন্তজার্তিক বাণিজ্যের বাজার তৈরি হলো যেরকম টা এর আগে বাণিজ্যের ইতিহাসে ঘটেনি। একটা পর্যায়ে সমগ্র ইউরোপে ব্যবসা ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসা শুরু করলো। ইংল্যান্ডের আভিজাত্য ভূস্বামীরা এই বিষয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ফলে তারা চিন্তা করলেন কৃষি জমি গুলোকে আরো উন্নত ভাবে চাষ করে যদি অধিক শস্য ফলানো যায় এবং এছাড়া মেষপালন করে সেগুলোর চামড়া অধিক মূল্যে রপ্তানি করা যায় তাহলে তাদের অধিক পয়সা কামানোর সুযোগ হয়ে যাবে। এই ধরনের চিন্তার ফলে ভূস্বামীরা সেই সকল পতিত জমি দখল করা শুরু করলেন এবং প্রত্যেকেই তাদেট নিজেদের জমিতে বেড়া দেওয়া শুরু করলেন এবং কৃষি জমি থেকে তাদের জন্য ই না বরং রপ্তানি ও দেশের অন্যান্য জায়গায় ফসল বাণিজ্য করার কঢা চিন্তা করলেন। এটাকে রডনি হিলটন সহ আরো মধ্যযুগের ইতিহাসবিদেরা নাম দিয়েছিলেন "Enclosure" অর্থাৎ মার্ক্সরে মতে "This enclosure system was the first initiative for the process of proletarianization" কৃষকদের কে তাদের নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হলো, তারা যার জন্য কাজ করতেন তারা তাদের কে কাজ থেকে বিচ্যুত কর শুরু করলেন, একমাত্র ঐ সকল কৃষকদের রাখলেন কাজে যারা তথাকথিত "কর্মক্ষম ও দক্ষ", এডাম স্মিথ উৎপাদনশীল (Productive) ও অনুৎপাদনশীল (unproductive) শ্রমের উদাহরণ দিতে গিয়ে এই enclosure বা বেড়া দেওয়ার ঘটনাটি স্মরণ করেছিলেন তার বই তে৷ ফলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী তার কর্ম থেকে বিচ্যুত হলো। অর্থাৎ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে তারা আগে নিজের খাবার এবং বসবাস নিজের শ্রমের ভেতর দিতে সরবরাহ করতেন, এখন সেই কৃষক কে শহরে ঘুরে ঘুরে, দরজায় দরজায় যেতে হচ্ছে কাজ পাওয়ার জন্য তার নিজের " শ্রমের" বিনিময়ে, অর্থাৎ ইতিহাসে প্রথম "শ্রম" নিজেই একটি পণ্যে পরিণত হলো, যেটা এর আগে শুধু খাওয়া ও বাস করার সুযোগের একটি মাধ্যম ছিলো এবং শ্রমের পণ্যের রূপান্তর হওয়ার সাথে সাথে "মানুষ" নিজেই একটি পণ্যে পরিণত হওয়া শুরু করলো একই সাথে মানুষ একটি নতুন সামাজিক সম্পর্কে ঢুকতে শুরু করলো যেটাকে মার্ক্স বলেছেন social relation of the production of commodity (পণ্য উৎপাদনের ভিত্তিতে সামাজিক সম্পর্ক)। এমন একটি অনন্য উৎপাদন ব্যবস্থা ইংল্যান্ডে শুরু হলো যেটার ভিত্তি হলো মজুরি-শ্রম (wage labour)। এই যে এক ধরণের অনন্য দেশীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার ভিত্তি হলো বাজার এবং মুনাফা, মজুরি-শ্রম এবং উদ্বৃত্ত মূল্য সঞ্চয়ন, এটাই পুঁজিবাদের আদি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলো। তবে এলেন মেইকসেন্স এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছেন যে এই যে "উদ্বৃত্ত" (surplus) এর ধারণা এটা কোথা থেকে এসেছে এবং এটার কি নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা? উত্তর মেইকসেন্স নিজেই দিয়েছেন, ইংল্যান্ডের সতেশো শতকের দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ জন লকের বই থেকে। জন লক কে উদারনৈতিক সরকার ব্যবস্থার অন্যতম একজন প্রবক্তা বলা হয়। রাজনৈতিক দর্শন ও আধুনিক ইউরোপীয় সরকার ব্যবস্থার ইতিহাস বুঝতে হলে জন লকের চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া অতি জরুরি। লজ রাজতন্ত্র বিরোধী ছিলেন, গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন এবং খোদ বাইবেলের বরাত দিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপনের অধিকার, তার ব্যক্তগত সম্পদের অধিকার এবং তার ব্যক্তিগত সুখ হাসিলের অধিকার গুলোর নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার দেওয়া "theory of improvement" এর তত্ত্বের একটি চূড়ান্ত রূপ হলো উপনিবেশবাদ। লকের মতে পৃথিবী ইশ্বর মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষ এখানে চাষবাস করবে, উৎপাদন করবে, নৈতিক ও সামাজিক চুক্তি করে নিজেদের মতো বসবাস করবে, কিন্তু যেসকল মানুষ জন উন্নতমানের ও উর্বর জমিতে বাস করে কিন্তু সেই জমি নিয়ে তাদের কোনো ধারণা নাই, অথচ যাদের ধারণা আছে তাদের সেই নৈতিক অধিকার আছে যেয়ে সেই জমি দখল করে সেটাকে উন্নত করা এবং সাথে সেই সকল অজ্ঞ মানুষদেরকেও উন্নত করা। আপাতদৃষ্টিতে দারুন কথা মনে হলেও জন লকের শিষ্যরা এবং ভাবশিষ্যরা এই কথার ভিত্তিতে অবাধে উপনিবেশ স্থাপন করেছেন যুগের পর যুগ। অর্থাৎ পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক অতি গভীর। এটা মার্ক্স তার ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডের একদম শেষ যে অধ্যায় "Theory of colonialism" এ উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করেছেন। মরিস ডব এবং উক্ত ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা মনে করেন পুঁজিবাদের আনুষ্ঠানিক উৎপত্তি হয়েছে ইংল্যান্ডেই। অর্থাৎ কৃষিতে পুঁজিবাদী আচরণ ও বৈশিষ্ট্য এবং তার ভেতর দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, বিপ্লব, বিদ্রোহ, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে শিল্প-পুজির বিকাশ ঘটেছে ইউরোপে। সমস্যা টা হলো যে আরেক মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদ পল সুইজি এই ব্যাখ্যা স্বীকার করেননি। মূলত তার মতে পুঁজিবাদের উৎপত্তি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ আবিষ্কার ও নতুন নতুন বাণিজ্যিক বাজার তৈরি হওয়ার মধ্যে দিয়েই হয়েছে। তিনি মূলত পুঁজিবাদের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেলজিয়ান ইতিহাসবিদ হেনরী পিরেনের তত্ত্ব কে ব্যবহার করেছিলেন যেটা অন্যান্য অ-মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদেরাও ব্যবহার করেছেন। সুইজির মতে ১৪-১৬ শতকের মধ্যে পুরো ইউরোপে একধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ নতুন বাণিজ্য পথ আবিষ্কারের ফলে মেডিটেরিয়ান সাগরে আরবদের যে আধিপত্য তার বিনাশ ঘটে, ইউরোপীয়রা সাগরের আধিপত্য নেয় এবং এভাবে সমগ্র ইউরোপের ব্যবসা বাণিজ্যিক (দেশীয় ও আন্তর্জাতিকপরিসের) ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন আসে যার ফলে এক ধরণের অবাধ বানিজ্যের পথ সুগম হয় এবং অবাধ আমদানি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়। পিরেনের এই বাণিজ্যিক মডেল (Commercial model) তত্ত্ব ব্যবহার করে সুইজি দেখিয়েছেন যে আন্তজার্তিক বাজার ও বাণিজ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ইউরোপের পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটে। অর্থাৎ এক সময় আন্তজার্তিক বাণিজ্য হতো ধনী ও আভিজাতিক লোকজনদের চাহিদা মেটানোর জন্য কিন্তু পরবর্তী তে সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য যখন এই বাণিজ্যের রূপান্তর ঘটলো তখনই সৃষ্টি হলো উদ্বৃত্ত মূল্য ও উদ্বৃত্ত উৎপাদনের বোধ এবং সেই বোধ থেকে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও কৌশলের আবিষ্কার থেকে শুরু করে ইউরোপে বিভিন্ন নগর ও বন্দরের উৎপত্তি হওয়া শুরু হলো এবং একটা পর্যায়ে অতিমাত্রায় প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে শিল্প-পুঁজির সূচনা ঘটলো। অন্যদিকে মরিস ডবদের মতে পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত কারণ মূলত সামন্ততন্ত্রেরের ভেতর থেকে, অর্থাৎ সামন্ততন্ত্রের ভেতরকার যে তীব্র দ্বন্দ্ব এবং ফাটল সেই ফাটলের পরিণতি হিসেবে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ ও পুঁজিবাদের উত্থান। ইংরেজ দেশে কৃষি তে পুঁজিবাদের উত্থান ঐ কারণেই হয়েছিলো। আভিজাতিকেরা অতি উদ্বৃত্ত মুনাফা ও অর্থ সঞ্চয় করতে গিয়ে কৃষকদের ঘরছাড়া করেছিলো, উচ্ছেদ করেছিলো, সেই কৃষকেরাই ১৬ শতকের ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে রাজতন্ত্রেট বিরুদ্ধে বিপ্লব করে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিলো, পার্লামেন্টের সূচনা ঘটেছিলো। সামন্ততন্ত্রের সম্পত্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ভেতরকার যে তীব্র বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দ্বের পরিণতি হিসেবে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক চাহিদা মেটানোর বিষয়টা সামন্ততন্ত্রের বিরোধী কিছু নয় কিন্তু নতুন একটি বাজার ব্যবস্থা, শ্রমব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নির্মাণের আকাঙ্খা সকলেরই ছিলো এবং ছিলো সেই বঞ্চিত, অত্যাচারিত, শোষিত কৃষকদের যাদের ঐতিহাসিক পরিচয় হয়েছিলো "শ্রমিক" হিসেবে, অর্থাৎ যারা "শ্রম" নামক পণ্য বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে। রডনি হিলটনের মতে পুঁজিবাদের একদম বিশেষ উৎপত্তি নিয়ে মার্ক্স কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা দেননি কিন্তু ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডের শেষ আট টি অধ্যায় ও তৃতীয় খণ্ডের প্রথম তিনটি অধ্যায় পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি, যেখানে মার্ক্স পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক উৎপত্তি কে একটি ঐতিহাসিক সামাজিক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। উত্তরণ বিতর্কের মধ্যে দিয়ে অ-মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের প্রায় সবগুলো তত্ত্ব ই খারিজ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, কারণ তারা পুঁজিবাদ বা পুঁজি কে একটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলোন এবং পুঁজিবাদ ও বাণিজ্যবাদকে একই ভেবেছিলেন।
পল সুইজি কে মরিস ডব এবং অন্যান্য মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদেরা অ-মার্ক্সবাদর বা ডানপন্থী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন, সুইজিও এই সকল অভিযোগের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তার monthly review পত্রিকায় একেকটি প্রবন্ধ লিখে। মার্কিন সরকারের হয়ে কাজ করার জন্য সুইজি মার্ক্সবাদীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন, যদিও উত্তরণ সম্বন্ধে এবং পুঁজিবাদের উদ্ভব সম্পর্কিত তত্ত্বকে সম্পূর্ণ রূপে খারিজ করে দেওয়া সহজ নয়। অ-মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের মধ্যে ফরাসি শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ফের্নোন্দ ব্রদেল পুঁজিবাদ কে আবার বাজার ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে আলাদা মনে করতেন। কারণ তার মতে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি পুঁজিবাদ-পূর্ব সমাজব্যবস্থায় ও ছিলো কিন্তু, মার্ক্সের ভাষা ব্যবহার করে তিনি বলেছেন যে মজুরি-শ্রমের যে প্রথা সেটা ছিলোনা। পুঁজিবাদের মধ্যে দিয়ে জমি ও সম্পদের অর্থনৈতিক ও যৌক্তিক বিন্যাস হয় এবং যার ফলে উদ্বৃত্ত মূল্য ও উদ্বৃত্ত শ্রমের ক্ষেত্রে একটি নতুন বাজারের উন্মোচন ঘটে ইউরোপে, যার পরিণতিই হলো পুঁজিবাদ এবং যেটা সম্ভব হতোনা যদি না রাষ্ট্রগুলোর সাথে পুঁজিবাদের একটি সংমিশ্রণ না ঘটতো। ব্রদেলের ইতিহাসতত্ত্ব ছিলো পূণ-ইতিহাস (Total History) অর্থাৎ যার মধ্যে শুধ অর্থনীতি নয়, বরং রাজনীতি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত। ব্রদেল সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মাঝে খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাক, চলাফেরা এবং বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যার কারণে তার ইতিহাস ছিলো মূলত পূর্ণ ইতিহাস যদিও তিনি শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব কে ততোটা গুরুত্ব দেননি কিন্তু মার্ক্সের প্রতি তার ভক্তি অসীম ছিলো একমাত্র ঐ ক্যাপিটাল বইটি লেখার জন্য। কারণ ব্রদেলের মতে ক্যাপিটাল বইটি নেহাৎ কোনো সমাজ বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা নয়, বরং এটা আদতে একটি ইতিহাসগ্রন্থ, আরো স্পষ্ট ভাবে বললে এটা ইতিহাসেরও ও ইতিহাস গ্রন্থ, কারণ এই গ্রন্থে থাকা তত্ত্ব দিয়ে সমগ্র ইতিহাস কে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করা এবং পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা গেছে। মার্ক্সবাদীদের মধ্যকার উত্তরণ বিতর্কে পরবর্তী তে রবার্ট ব্রেনার, ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন, এ.জে ফ্রাঙ্ক যুক্ত হয়েছিলেন যাকে উত্তরণ বিতর্কের দ্বিতীয় প্রজন্ম বলা চলে। পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং পুঁজিবাদের বিকাশ নিয়ে এই বিতর্ক টি সবচেয়ে তীব্র রূপ ধারণ করেছিলো এবং এই বিতর্কের মধ্যে দিয়ে খোদ পুঁজিবাদ কেই একটি নতুন আঙ্গিকে দেখা শুরু হয়েছিলো। ১৯৭৬ সালের দিকে রবার্ট ব্রেনার একটি প্রবন্ধে ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন ও এ.জে ফ্রাঙ্ক কে তীব্র আক্রমণ করেন। ব্রেনার মূলত আক্রমণ টা করেন পল সুইজিকে এবং ঐ সকল তাত্ত্বিকদের যারা পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং এর বিকাশ কে "আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, প্রযুক্তির উদ্ভব, জনসংখ্যা তত্ত্ব এবং নগরায়ন তত্ত্ব" দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। হিস্ট্রি জার্নাল, পাস্ট এন্ড প্রেজেন্টে, ১৯৭৬ সালে রবার্ট ব্রেনার Agrarian class structure and economic development in pre-industrial Europe নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং তার পরের বছরেই নিউ লেফ্ট রিভিউ পত্রিকায়
The origins of capitalist development: A critique of Neo-Smithian Marxism নামে আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন এবং তার পাচ বছর পরে ১৯৮২ সালে The Agrarian roots of European capitalism নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন যেখানে সে তার পূর্বোক্ত দুইটি প্রবন্ধের উপর আসা সমালোচনা ও প্রশ্নের জবাব দেন। ব্রেনার মূলত ওয়ালারস্টাইন, এজে ফ্রাঙ্ক ও পল সুইজি সহ ট্রাডিশনাল মার্ক্সবাদী দের আক্রমণ করেন। তার মতে পুঁজিবাদ নিতান্তই একটি ইউরোপীয় ঘটনা যার সাথে ইউরোপের বাহিরের কোনো ঘটনার সাথে সম্পর্ক নাই বললেই চলে। অর্থাৎ, ব্রেনারের মতে পুঁজিবাদের উৎপত্তি রাতারাতি হয়নি এটা সত্য কিন্তু এর উৎপত্তি ও বিকাশ উপনিবেশবাদ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নগরায়নের মাধ্যমে হয়েছে এটা তিনি মানতে নারাজ, বরং তার মতে ১৪-১৬ শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের গ্রাম সমাজে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং সেই পরিবর্তন ই হলো পুঁজিবাদের মূল গোড়া। রডনি হিলটনদের মতো করে ব্রেনারও ইংল্যান্ডের কৃষিতো ঘটে যাওয়া যে বিপ্লব তাকেই পুঁজিবাদের উৎপত্তি হিসেবে দাবি করেন তবে হিলটনদের সাথে তার পার্থক্য হলো তিনি তাদের মতো জনসংখ্যা ও শ্রমিকের অভাবের ফলে, কৃষকেরা বিদ্রোহ করেন এবং এতে করে সামন্ততন্ত্র ভেঙে পড়ে এই ধারণার সাথে একমত না, বরং ব্রেনার এখানে মধ্যযুগের ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রকে এক ভাবে দেখেননি, একেকটি দেশের সামন্ততন্ত্র একেকরকম কিন্তু ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতি তে এবং গ্রাম সমাজেরর উৎপাদন ব্যবস্থায় সেই পরিবর্তন আসলো না কেনো যেটা ইংল্যান্ডে এসেছিলো? ব্রেনারে মতে এখানেই মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব। ফ্রান্সের কৃষকদের উৎপাদনের সাথে সম্পর্ক হিসেবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা ইংল্যান্ডের কৃষকদের তুলনায় অনেক বেশি ছিলো এবং ফ্রান্সের কৃষকেরা যথেষ্ট সফল ছিলো ইংরেজ কৃষকদের তুলনায় কিন্তু সমস্যা হলো এই সফলতা ই ফ্রান্সে পুঁজিবাদে বাধা দিয়েছে এবং ইংল্যান্ডের কৃষকেরা অর্থনৈতিক ভাবে অসফল হলেও, ইংল্যান্ডের ভূস্বামীদের অর্থনৈতিক উদ্ভাবনী ও উদ্যোক্তপূর্ণ মানসিকতা এবং এর পরিণতি হিসেবে কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, অতিরিক্ত লাভ করার আকাঙ্খা থেকে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ অর্থাৎ the process of proletarianization এর ফলে ইংল্যান্ডের কৃষকেরা অতি দ্রুত মজুরে পরিণত হোন এবং ইংল্যান্ডের গোটা কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামের সমাজ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যেই পরিবর্তন ই ইউরোপীয় পুঁজিবাদের গোড়া। অর্থাৎ ব্রেনারের মতে পুঁজিবাদের আদি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো ইউরোপীয় গ্রাম সমাজে, বিশেষ করে ইংরেজ গ্রাম সমাজে এবং এই গ্রাম সমাজের পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে নগর সমাজে তার বিশেষ প্রভাব পড়ে এবং ব্রেনার উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভূমিদাসত্বের বিলোপসাধনের ইতিহাস তুলে ধরেছে যা ১৬৮৮ সালে ঘটে, অর্থাৎ ইংল্যান্ডে ই প্রথম এটা ঘটে এবং এর পরিণতি হিসেবেই সৃষ্টি হয় পুঁজিবাদী বাজারভিত্তিক ও মজুরী-শ্রম ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা৷ ব্রেনারের মতে বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার ব্যবহার, নগরায়নের উৎপত্তি এবং আন্তজার্তিক বাণিজ্যের প্রভাব, উপনিবেশবাদ এগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এগুলো একটিও পুঁজিবাদের উৎপত্তির মৌলিক কারণ নয়, বরং এগুলো পরবর্তীতে শিল্প-পুঁজিবাদ কে ত্বরান্বিত করেছে, নবরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে বিখ্যাত আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন ১৯৬০ এর দশক থেকে পুঁজিবাদের ইতিহাস কে সম্পূর্ণ অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। ফের্নোন্দ ব্রদেলের মতো ওয়ালারস্টাইন ও সামগ্রিকবাদী পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। সমাজবিজ্ঞান ও ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে ওয়ালারস্টাইন "বিশ্বব্যবস্থা-বিশ্লেষণ" (world-system Analysis) পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন যেই পদ্ধতিতে পুরো বিশ্ব ও বিশ্বের থাকা মানুষের ইতিহাস ও বিকাশ কে একদম সামগ্রিক ভাবে ও সমানুপাতিক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হবে এবং মানবসভ্যতা ও তার সৃষ্ট সকল জ্ঞান ও বিজ্ঞান এবং ব্যবস্থা কে একটি শৃঙ্খল অথবা একটি পূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে দেখে তাকে ব্যাখ্যা করা হবে। পুঁজিবাদের উৎপত্তি নিয়ে ওয়ালারস্টাইন তার History and capital বইতে কিছু বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তার মতে পুঁজিবাদের সকল বৈশিষ্ট্য তথা মজুরী-শ্রম ব্যবস্থা, মুনাফালাভ, শ্রেণীসংগ্রাম, উৎপাদনশক্তি, বাজার এই সকল কিছুই সভ্যতার শুরু থেকেই ছিলো, শুধু একটা জিনিসই ছিলো না, সেটা হলো পুঁজির সঞ্চয় এবং সেই সঞ্চয়ের পুনরায় লগ্নি (Accumulation of capital and reinvestment of the capital), অর্থাৎ পুঁজি বিনিয়োগ করে সেখান থেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হবে এবং সেই মূল্যের সংযোগে আবার পুঁজির পুনর্বিনিয়োগ, এই চিন্তা টা "একটি সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে" কোনো সময় ছিলোনা, যেটা শুরু হয়েছে আধুনিক কালে অর্থাৎ আঠারো শতকের গোড়ার দিকে এবং যার সাথে সম্পর্ক রয়েছে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবিস্তারের। ওয়ালারস্টাইনের মতে পুঁজিবাদ ও উদারনৈতিক যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তা আদতে উদারনীতি ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নয়, বরং বাস্তবে তা একচেটিয়া (monopolistic) ও কতিপয়-চেটিয়া ভিত্তিক (oligopolistic)। পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বব্যবস্থার অবস্থার জায়গা থেকে দেখলে পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় অবস্থান ইউরোপ ও আমেরিকা তে, এবং এর প্রান্তিক অবস্থান তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে। ওয়ালারস্টাইন তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোকে শ্রমিক দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং এই দেশ গুলো তার মতে উৎপাদন-ভিত্তিক (manufacture-based), আর প্রথম বিশ্বের দেশ গুলো পুঁজি-ভিত্তিক (capital-based) এবং এই কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশে কখনই উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ সম্ভব হয়না৷ পুঁজির কেন্দ্রীয় (central) ও প্রান্তিক (periphery) এর বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক। তার The underdevelopment of development বইটিতে তিনি নির্ভরশীলতার তত্ত্বের (Dependency theory) প্রস্তাবনা করেন। তিনি দেখান যে আন্তজার্তিক বাজারে এশিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকান ও আফ্রিকান দেশ গুলো শুধু শ্রম সরবরাহ করে এবং তাদের নিজেদের দেশে উৎপাদিত শ্রেষ্ঠ কাঁচামাল ও ফসল গুলো তারা রপ্তানি করেন কিন্তু এতে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেনা, তারা নিজেরা নিজেদের উৎপাদিত ফসল থেকে বঞ্চিত হোন এবং তারা নিজেরাই উন্নত দেশ গুলোর পুঁজি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে যা আবার তাদেরকেই শোষণ করে। ইউরোপ ও আমেরিকার পুঁজিবাদের বিকাশ কে ফ্রাঙ্ক এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশের জন্মলগ্ন থেকেই এই কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণা ছিলোই এবং বিশ্ব অর্থনীতি আজো এই কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণা দিয়েই চলছে। এছাড়াও ফ্রাঙ্ক মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্র কে একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন, তার মতে এশিয়া আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় মধ্যযুগীয় কিরূপ সামন্ততন্ত্র ছিলো এবং তার সাথে ইউরোপীয় সামন্তবাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো কিনা, থাকলে সেটা কিরকম?
ভারতে পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে একটা বিতর্ক আছে, অনেকদিন আগে থেকেই। তবে ভারতের সামন্ততন্ত্র ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র থেকে অনেক বেশি আলাদা ও স্বতন্ত্র ছিলো। এক্ষেত্রে ইরফান হাবিব, রামশরণ শর্মা, রোমিলা থাপারদের গবেষণা পড়া বাঞ্ছনীয়। ১৯৭৬ সালে ওয়ালারস্টাইন From Feudalism to Capitalism: Transition or Transitions? নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিতন্ত্রে রূপান্তর বিষয়ে যে বিতর্ক তার বেশ কিছু দুর্বল এবং সমস্যাজনক জায়গা তুলে ধরেন। ওয়ালারস্টাইনের মতে মার্ক্সবাদী নামক মার্ক্সের শিষ্যরা বেহুদাই সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিতন্ত্রের রূপান্তরের পেছনে একটি একক মৌলিক কারণের পেছনে ছুটছে যেটা নিতান্তই অর্থহীন। কোনো একক কারণে এই রূপান্তর হয়নি, কিংবা ইউরোপের সকল দেশে বা স্থানে একই ভাবে রূপান্তর ঘটেনি বরং ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন কারণে রূপান্তর ঘটেছে এবং এই ভিন্নতার মাঝে শ্রেণীসংগ্রাম যদিও খুবই সাধারণ তবুও সামগ্রিক ভাবে দেখলে কোনো একক সাধারণ কারণ খোজাটাই অর্থহীন। ১৯৭৭ সালে প্রবন্ধে ব্রেনার মূলত সুইজি, ওয়ালারস্টাইন ও ফ্রাঙ্কের তত্ত্ব গুলোকে আক্রমণ করেছিলেন এবং নতুন করে আরেকটি বিতর্কের সূচনা করেন যাকে পণ্ডিতেরা ব্রেনার বিতর্ক (The Brenner Debate) নাম দিয়েছিলেন। ওয়ালারস্টাইনে ও ফ্রাঙ্কের সাথে মোটাদাগে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে ব্রেনারের এবং পরবর্তী তে ব্রেনারের গুরুত্বপূর্ণ ঐ তিনটি প্রবন্ধ ই ছাপা হয় "The Brenner Debate Agrarian Class Structure and Economic Development in Pre-Industrial Europe" নামে সংকলনটি তে, যেখানে এমএম পোস্টন, জন হ্যাচার, গি বোয়া এবং ইম্যানুয়েল লি রয় লড্যিরের প্রমুখ সবার প্রবন্ধ আছে এবং এদের মধ্যে কয়েকজন আবার ব্রেনারকে সমালোচনা করেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, পুঁজিবাদ কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে মার্ক্সের মতে আমাদের জানা উচিত পুঁজিবাদের ইতিহাস এবং প্রাক-পুজিবাদী সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজের পার্থক্য। সেই জন্য আমাদের কে খুজতে হয় পুঁজিবাদের আসল উৎস এবং এর বিকাশের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহ আর উক্ত কারণ গুলো খুজতে যেয়েই সৃষ্টি হয় বিতর্কের। এডাম স্মিথ, ম্যালথাসও বিশ শতকরের গোড়ার দিকের শ্মোলার, সোমবার্টদের এবং বিশ শতকের শেষার্ধের নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতিবিদদের মতে পুঁজিবাদ মানুষের প্রাকৃতিক চরিত্র বিশেষ, সেই হিসেবে তাহলে বলা যায় পুঁজিবাদী শোষণ থেকে বাঁচার জন্য এবং একটি ভবিষ্যত শোষণমুক্ত দুনিয়া তৈরি করার জন্য "পুঁজিবাদের ইতিহাস, বিকাশ, বর্তমান গতিপ্রকৃতি এবং এর অন্তর্নিহিত ভিত্তি" বিশ্লেষণ করাও মুক্তিকামী বুদ্ধিমানের প্রাকৃতিক চরিত্র হওয়া উচিত।