গার্সিয়া মার্কেসের আখ্যান 'কলেরার দিনগুলিতে প্রেম'
- 07 August, 2023
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
১৯৬৭ সালে ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’ লেখার পরেই কথাকার হিসেবে গার্সিয়া মার্কেস বিশ্বজুড়ে চর্চিত হতে থাকেন। ১৯৮২ সালে নোবল পুরস্কার পাওয়ার পর সেই চর্চা বহুগুণিত হয়। বিশ্বের নানা ভাষায় গার্সিয়া মার্কেসের আখ্যানগুলি অনূদিত ও জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৮৫ সালে এই প্রেক্ষাপটেই প্রকাশিত হয় ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (El amor en los tiempos del cólera)। প্রথম স্প্যানিশ সংস্করণ ছাপা হয় বারো লক্ষ কপি। প্রস্তুতি রাখা হয় আরো আরো আড়াই লক্ষ কপি ছাপিয়ে নেওয়ার। একটি ভাষায় একটি উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের এই সংখ্যক মুদ্রণ বুঝিয়ে দেয়, সদ্য নোবল জয়ী ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’ এর লেখকের কাছে নতুন উপন্যাসের জন্য পাঠকদের কী বিপুল প্রত্যাশা ছিল। উপন্যাসটি প্রকাশের পর বোঝা যায় গার্সিয়া মার্কেস পাঠকদের এই প্রত্যাশার মর্যাদা রেখেছেন। সমালোচকেরা একযোগে জানান একশ বছরের নিঃসঙ্গতার মতোই আরেকটি অসামান্য ক্লাসিক আত্মপ্রকাশ করেছে গার্সিয়া মার্কেসের হাত থেকে। কেউ কেউ বলেন গার্সিয়া মার্কেস যদি ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’এর সাফল্যের পর নোবল নাও পেতেন, ‘ লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র মহত্বকে নোবল কমিটি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারতেন না। দ্রুতই নানা ভাষায় এটি অনূদিত হয় ও আবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে।
‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম’ উপন্যাসটিতে গার্সিয়া মার্কেস তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মতোই গল্প বলা শুরু করেন মাঝখান থেকে। যেখানে গল্প বলা শুরু হয়, সেখান থেকে এরপর আখ্যান পিছিয়ে যায় প্রায় পঞ্চাশ বছর। তারপর তা কয়েক পর্ব পেরিয়ে শুরুর দিনগুলিতে আসে ও তারপর আবার এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ফ্ল্যাশব্যাক বা অতীত কথনের পর্বটিই এই উপন্যাসের দীর্ঘতম পর্ব।
মাঝখান থেকে কাহিনী বলা শুরু করে তারপর পিছিয়ে ও এগিয়ে যাবার আখ্যানরীতি বজায় রাখলেও অন্যান্য অনেক আখ্যানে গার্সিয়া মার্কেস যে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন, যেমন প্রথম উপন্যাস ‘লিফ স্টর্ম’এ কোনও একজন কথকের বদলে তিনজনের জবানীতে ও তিনটি দৃষ্টিকোণে কাহিনী বলা, তা এখানে নেই। গার্সিয়া মার্কেসের আখ্যানের অন্যতম টেকনিক যে জাদুবাস্তবতা, তাও এখানে সেভাবে ব্যবহৃত হয় নি। গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস পাঠক যে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নানা আখ্যানে বারবার প্রবেশ করেন, দু একটি পার্শ্বিক উল্লেখ ছাড়া এখানে তাও তেমন প্রকট নয়। উপন্যাসের শেষে উন্নয়ন ও প্রকৃতির দ্বন্দ্ব নিয়ে, বাস্তুতন্ত্রের সমস্যা ও বিরল প্রজাতির প্রাণীকুলের বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা নিয়ে কিছু জরুরী কথা রয়েছে, যা এই সময়ের পাঠককে বিশেষভাবে আলোড়িত করে।
যে জলরাশির জনক ম্যাগডালেনা ছিল বিশ্বের বৃহত্তম নদীগুলির অন্যতম, এখন তা স্মৃতির একটা মরীচিকা মাত্র। কাপ্তান সামারিনো জানালো, পঞ্চাশ বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বন উজাড় করে ওরা নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে : নৌযানগুলির বয়লারসমূহ বিশাল বিশাল গাছের ঘন অরণ্যকে গিলে খেয়েছে। ওই বৃক্ষরাজির গুরুভারই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার প্রথম নদী ভ্রমণ ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলো। ফারমিনা ডাজা তার স্বপ্নের প্রাণীগুলি আর দেখবে না। শিকারিরা নিউ অর্লিয়ান্সের চামড়া পাকা করার কারখানাগুলির চাহিদা মিটাবার জন্য কু্মীরগুলিকে নির্মূল করে দিয়েছে। ওই প্রাণীগুলি খাল-খাড়ির পাশে নদীতীরে মুখ হাঁ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মড়ার মতো পড়ে থাকতো, প্রজাপতি আর ফড়িং ধরবার জন্য। গাছগাছালি ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে তীক্ষ্ণ শিস দেয়া টিয়া পাখির ঝাক আর পাগলের মতো চিৎকার করা বানরের পাল অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুশুক জাতীয় যে প্রাণীগুলি তাদের বিশাল স্তনে তাদের শিশুদের দুধ খাওয়াতো, নদীতীরে শুয়ে যারা পরিত্যক্ত নারীর গলায় ক্রন্দন করতো, তারা এখন এক বিলুপ্ত প্রজাতি। শিকারিরা নিছক ক্রীড়ার স্বার্থে বর্মাচ্ছাদিত বুলেট ছুঁড়ে তাদের নিঃশেষ করে দিয়েছে।
শ্রেণি সচেতনতার প্রশ্নটি উদারনৈতিক বামপন্থায় বিশ্বাসী গার্সিয়া মার্কেসের সমাজবিচার ও জীবনদর্শনের এক মৌলিক দিক। সোসালিস্ট রিয়ালিজমের দিকে তিনি বা লাতিন আমেরিকার কোনও বামপন্থী লেখকই সেভাবে হাঁটেন নি, কিন্তু ক্রিটিকাল রিয়ালিজমের মধ্যে থাকা সামাজিক সচেতনতার বিশ্লেষণী চেহারাটি তাঁদের আখ্যানে প্রায় সর্বদাই উপস্থিত। জাদু বাস্তবতার উপন্যাস টেকনিকের মধ্যেও এই সমাজ বাস্তবতা ও শ্রেণি রাজনীতি কীভাবে মিশে থাকে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে কিউবার লেখক আলেহো কার্পেন্তিয়েরের হাইতির দাস বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘এই মর্তের রাজত্ব’র মতো উপন্যাসে। ‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম’ আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফ্লোরেন্টিনোকে কেন কিশোরী ফারমিনা প্রত্যাখ্যান করেছিল, তার কোনও স্পষ্ট কারণ উপন্যাসে বলা নেই। ফ্লোরেন্টিনোকে ছেড়ে উরবিনোকে বিবাহ করায় ফারমিনার সম্মতির সুনির্দিষ্ট কারণও উল্লিখিত নয়। আমরা অনুমান করতে পারি ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠা ফারমিনা প্রথম কৈশোরের ভাবালুতা ছেড়ে জীবনের বাস্তব দিকগুলি নিয়ে ততদিনে ভাবতে শুরু করেছিল। সম্পদ, সামাজিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ভালো থাকার অঙ্কগুলিকে সে মিলিয়ে নিতে শিখছিল আর সেখান থেকেই পুরনো প্রেমিককে ছেড়ে নতুন এক মানুষের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে প্রবেশের দিকে সে এগোয়। ফ্লোরেন্টিনোর শ্রেণিগত অবস্থান যে তার প্রেমের পক্ষে এক বাধা এবং আগামীদিনে ফারমিনাকে পাবার সম্ভাবনা তৈরি করতে হলে যে তাকে ধনী হয়ে উঠতে হবে – এ সম্পর্কে তার মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা ছিল না। প্রথমদিকে প্রথম যৌবনে সে ধনী হবার সহজ রাস্তা হিসেবে সমুদ্রের তলায় ডুবে থাকা জাহাজের ধনসম্পদ উদ্ধারের অভিযানে সামিল হয়েছিল। প্রতারিত হবার ঠিক আগে এই পথ থেকে সে সরে আসে। যে জন্মদাতা পিতা তার মায়ে বিয়ে করেন নি, তার ভাই অর্থাৎ রক্তসম্পর্কের কাকা লিওর সূত্রেই শেষপর্যন্ত সে ধনী হয়ে উঠতে পারে। প্রথমে কাকার বিরাট জাহাজ কারখানার কর্মী, তারপর নিঃসন্তান কাকার উত্তরাধিকারী হিসেবে এর মালিক হয়ে। ফারমিনা ডাজার বৈধব্যের দিনগুলিতে তার বাড়িতে ফ্লোরেন্টিনোর পক্ষে প্রবেশ সহজ হয়েছিল সম্পদশালী হিসেবে সামাজিক সম্পর্কটিকে মজবুত করে নেওয়ার কারণেই। পরিচিত জনপদের শ্যেন দৃষ্টির বাইরে একটি গোটা জাহাজকে নিজেদের বার্ধক্য প্রেমের সহায়ক হিসেবে চালনা করতে ফ্লোরেন্টিনো পেরেছিল এর মালিকানা তাদের ছিল বলেই।
কিন্তু পরিবেশচেতনাই হোক বা নাগরিক শ্রেণি বিভাজনের দৃষ্টান্ত অথবা বারবারা লিঞ্চের মতো কৃষ্ণাঙ্গ এক নারী কীভাবে তার প্রেমিকা হল এই নিয়ে ফারমিনার উরবিনোর দিকে উদ্যত কিছু তির্যক বর্ণভেদমূলক ইঙ্গিৎ - এই উপন্যাসের চর্চিত বিষয় হয়ে ওঠেনি। আলাদা করে খুব গুরুত্বও পায় নি, যদিও প্রতিটিই সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে যথেষ্ট অভিনিবেশ দাবি করে। নারীপ্রশ্ন, সাংসারিক দায়দায়িত্ব ও সদর অন্দরে নারী পুরুষের বিভাজন অবশ্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্ব নিয়ে এখানে এসেছে। তবে উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছে প্রেম ও সেই সংক্রান্ত নানাকিছু। খুব সচেতনভাবে উনিশ শতকী রিয়ালিস্ট নভেলের আদলটিকে এই উপন্যাসে নিয়ে আসতে চেয়েছেন গার্সিয়া মার্কেস। উপন্যাসের চরিত্র পাত্রদের জীবনের একটা বড় অংশও কেটেছে উনিশ শতকেই।
উপন্যাস শুরু হয় বিশিষ্ট চিকিৎসক জুভেনাল উরবিনোর কাছে আসা একজনের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। যার মৃত্যু সংবাদ আসে সেই জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ আমুর ছিলেন ডাক্তার উরবিনোর বৃদ্ধ বয়েসের নিত্য সহচর, প্রতি সন্ধ্যার দাবা খেলার সঙ্গী। একদা কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধে উদারপন্থীদের হয়ে যুদ্ধ করা জেরেমিয়া পরবর্তী জীবনে বেছে নিয়েছিলেন চিত্রগ্রাহকের পেশা। মূলত ছোটদের ছবি তুলতেন তিনি। সায়ানাইডের ধোঁয়া টেনে কেন তিনি আকস্মাৎ তাঁর জীবনে ইতি টেনে দিলেন, তা বন্ধু চিকিৎসক উরবিনোর কাছে ছিল রহস্যই। তাঁকে মৃত্যুর ঠিক আগে লিখে রেখে যাওয়া একটি চিঠির সূত্র ধরে উরবিনো বুঝতে পারেন জেরেমিয়া তাঁর রোজকার আড্ডার সঙ্গী হলেও তার খবরাখবর তিনি খুব বেশি জানতে পারেন নি। এক তরুণীর সঙ্গে জেরেমিয়া যে ভালোবাসার সম্পর্কে আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন চিঠিটি পড়ার আগে অবধি তার কোনও ইঙ্গিৎ তার কাছে ছিল না। সেই তরুণীর থেকেই উরবিনো জানতে পারেন বার্ধক্যের আঘাতে বিপর্যস্ত হবার আগেই স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন জেরেমিয়া। উরবিনো বৃদ্ধ বন্ধুর এই অসম বয়সী প্রেমকে মেনে নিতে পারেন নি মন থেকে। তবে প্রেমের যে বয়েস হয় না, তা মানে না সামাজিক বিধিবিধানের গণ্ডীকে তা সেই তরুণীর প্রত্যয়ী বাচনে আখ্যানকার প্রতিষ্ঠা দেন। পরে উপন্যাসের চরম মুহূর্তে প্রসঙ্গটিকে আবার ফিরিয়ে আনবেন তিনি।
জেরেমিয়ার শেষকার্যের প্রস্তুতি যখন চলছে, তখন পূর্ব নির্ধারিত এক বিশেষ ভোজসভায় যেতে হয় ডাক্তার উরবিনোকে। ক্রমশ পাঠক হিসেবে আমরা জানতে পারি উরবিনো শুধুই একজন ডাক্তার নন, এই শহরের এক অত্যন্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ত্ব। শহরের সংস্কৃতি জগতের চেহারা চরিত্র নির্মাণে উরবিনোর ছিল বিপুল ও সক্রিয় নানা উদ্যোগ। উরবিনোর বাবাও ছিলেন এক প্রসিদ্ধ চিকিৎসক। এক কলেরা মহামারীর সময় দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গদের সেবা শুশ্রূষা করতে গিয়ে তিনি একপ্রকার আত্মাহূতিই দেন। উরবিনো পরবর্তীকালে আর এক কলেরা মহামারীর সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্র নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনকে পরামর্শ দেন। নিজেও সক্রিয় হয়ে ওঠেন প্রবলভাবে। অল্পের ওপর দিয়ে সে যাত্রায় রেহাই পাওয়ার পর ডাক্তার উরবিনো নগরীর অন্যতম শ্রদ্ধেয় মানুষ হয়ে ওঠেন।
গার্সিয়া মার্কেসের অনেক উপন্যাসে, তা সে ‘লিফ স্টর্ম’ হোক বা ‘নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল’ বা ‘ইন ইভিল আওয়ার’, এক চিকিৎসক চরিত্রকে আমরা পাই। চিকিৎসক উরবিনো এই আখ্যানে তিন প্রধান চরিত্রের একজন। উপন্যাসের প্রথম পর্বটি শেষ হয় তাঁরই আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনাটি দিয়ে। দ্বিপ্রাহরিক ভোজসভা থেকে সস্ত্রীক ঘরে ফিরে তিনি দেখেন তাঁর সাধের তোতাপাখিটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে তারই বাড়ির এক গাছের ডালে বসে আছে। হঠাৎ আশ্চর্য খেয়ালে তিনি মই বেয়ে উঠে উঁচু গাছের ডালে হাত বাড়িয়ে তোতাটিকে ধরতে যান। সেই সময়েই মইটি যায় পিছলে। অনেক উঁচু থেকে তিনি পড়েন ও স্ত্রী ফারমিনা ডাজার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
ডাক্তার উরবিনোর শেষকার্য সমাধা হবার পর বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা ফারমিনা ডাজার সামনে আসেন সাতাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। এই সাক্ষাতের সূত্রে কাহিনী পিছিয়ে যায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়। সে সময় ফারমিনা ডাজা পনেরো বছরের এক স্কুল ছাত্রী। তাকে ভালোবাসে উনিশ বছরের টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মী ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। প্রথম দিকে ফারমিনা ফ্লোরেন্টিনোর প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেয় নি। বাবার ভয় আর পিসির ঘেরাটোপ তাকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। কিন্তু পিসি এস্কোলাস্টিকার প্রশ্রয় ক্রমশ ফারমিনাকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ করে দেয়। তাদের ভালোবাসার আদান প্রদান চলতে থাকে চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে।
ফারমিনার নিরক্ষর বাবা লরেঞ্জো ডাজা পণ করেছিলেন মেয়েকে উচ্চবিত্ত ঘরে বিয়ে দেবেন। পিতৃপরিচয়হীন সামান্য চাকুরে ফ্লোরেন্টিনা আরিজার থেকে মেয়েকে বিচ্ছিন্ন করতে তিনি উঠেপড়ে লাগলেন। প্রথমেই প্রেমে প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে চিরতরে নির্বাসন দিলেন বোন এস্কোলাস্টিকাকে। পরে অনেক খুঁজেও ফারমিনা ডাজা তার হারিয়ে যাওয়া পিসির কোনও সন্ধান পায় নি। এরপরেও লরেঞ্জো ডাজা ফারমিনাকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারায় মেয়েকে নিয়ে দেশান্তরী হলেন। চলে গেলেন বহুদিন আগে মৃত তার স্ত্রীর গ্রামের বাড়িতে। সেখানে ফারমিনা বোন হিল্ডেব্রান্ডা স্যাঞ্চেঞ্জের মধ্যে খুঁজে পায় তার প্রাণের বন্ধুকে। লরেঞ্জো ডাজা মেয়েকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু ডাককর্মীদের সাহায্যে ফ্লোরেন্টিনো ফারমিনার যাত্রাপথ থেকে শুরু করে মামাবাড়িতে অবস্থানের সমস্ত তথ্যই পেয়ে যায়। হিল্ডেব্রান্ডাও বোনকে সাহায্য করতে থাকে, যোগাতে থাকে মানসিক ভরসা। ফারমিনা আর ফ্লোরেন্টিনার মধ্যে আগের মতো যোগাযোগই শুধু যে বজায় থাকে তা নয়, এই পর্বে ফারমিনা ফ্লোরেন্টিনোকে প্রেমিক থেকে প্রায় স্বামীর মর্যাদায় উন্নীত করে। একটি নাচের অনুষ্ঠানে যাবার আগে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে অনুমতি প্রার্থণার বিষয়টি ছিল এই মনোভাবেরই প্রকাশ।
কিন্তু বহুদিন ভিনদেশে কাটিয়ে ফারমিনাদের দেশে ফেরার পর পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। দেশে ফিরে দেখাসাক্ষাতের পরে ফারমিনা হঠাৎই অনুভব করে ফ্লোরেন্টিনোর জন্য সে আর কোনও টান অনুভব করছে না। এই নাটকীয় রদবদল কেন তার কোনও বিস্তারিত নির্দেশিকা উপন্যাসে নেই। প্রেমের প্রকৃতি বিচিত্র – এই সাধারণ সূত্রই এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে। নতুন এই পরিস্থিতিতেই প্যারিস থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরা ডাক্তার উরবিনোর সঙ্গে চিকিৎসা সূত্রে পরিচয় ঘটে ফারমিনার। ডাক্তার উদ্ভিন্নযৌবনা ফারমিনার প্রেমে পড়েন।
ডাক্তার হিসেবে ফারমিনার এক অসুখের সময় প্রথম যখন উরবিনো তাকে দেখেছিলেন তখন নেহাৎ ডাক্তারী পরীক্ষা নিরীক্ষার চৌকাঠটি তিনি পেরিয়ে গিয়েছিলেন।
“লোরেঞ্জো ডাজা নিজে বাইরের দরজা খুলে ডাক্তারকে তার কন্যার শয়নকক্ষে নিয়ে গেলেন। তিনি সেখানে এক অন্ধকার কোণায় বুকের উপর দু’হাত জড়ো করে বসে থাকলেন, মেয়ের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে নিজের অসমসৃণ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। ডাক্তার তার নিষ্কলুষ স্পর্শ নিয়ে আর সিল্কের শেমিজ পরিহিতা রোগী তার কুমারীর শিষ্টতা নিয়ে এই দুজনের মধ্যে কে যে বেশি অস্বস্তি ও বাধাগ্রস্ত মনে করছিল বলা শক্ত, কিন্তু দুজনের কেউই একে অন্যের চোখের দিকে তাকাচ্ছিলো না। ডাক্তার নৈর্ব্যক্তিক গলায় প্রশ্ন করলেন আর ও কাঁপাকাঁপা গলায় উত্তর দিল, ছায়ার মধ্যে বসে থাকা লোকটি সম্পর্কে উভয়েই ছিল সচেতন। অবশেষে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো রোগীকে উঠে বসতে বললেন। এবং গভীর যত্নের সঙ্গে তার রাতকামিজটা কোমর পর্যন্ত টেনে নামিয়ে দিলেন। শয়নকক্ষের অন্ধকারের মধ্যে শিশুর মতো স্তনাগ্রসহ তার উন্নত বিশুদ্ধ স্তনযুগল। বারুদের চমকানির মতো ঝলসে উঠলো, তারপরই ও দ্রুত নিজের দু’বাহু জড়ো করে উপরে তুলে তার বুক ঢেকে ফেললো, কিন্তু অবিচলিত ডাক্তার ওর দিকে না তাকিয়ে ওর বাহু দুটি খুলে দিলেন, তারপর সরাসরি ওর গায়ে কান লাগিয়ে, প্রথমে বুকে ও পরে পিঠে, ওকে পরীক্ষা করলেন।”
ডাক্তার উরবিনো মুখে বলতেন যে-রমণীর সঙ্গে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার জীবনযাপন করবেন তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি কোন আবেগ অনুভব করেন নি। তিনি যে ওর লেস বসানো আকাশ-নীল শেমিজ, ওর জ্বরতপ্ত দুটি চোখ, কাঁধের উপর দিয়ে নেমে আসা ওর দীর্ঘ কেশরাশি দেখেছিলেন তা তার মনে আছে কিন্তু ঔপনিবেশিক জেলায় কলেরা শুরু হতে পারে ওই দুশ্চিন্তায় তিনি এতো মগ্ন ছিলেন যে ওর উদ্ভিন্ন যৌবন তার চোখেই পড়ে নি, তিনি শুধু লক্ষ করছিলেন ওর শরীরের কোথাও ব্যাধিটির সামান্যতম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা সে বিষয়েই। কিন্তু এই দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ আছেই, বিশেষত এরপর থেকেই যখন বারবার রোগীকে পরীক্ষার আছিলায় তিনি পৌঁছে যেতে থাকেন ফারমিনার বাড়িতে আর বিশেষ আলাপ জমান তার বাবার সঙ্গে।
শহরের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত যুবক ধনী, অভিজাত পরিবারের সন্তান উরবিনোর সঙ্গে সাধারণ ঘরের কিন্তু অপরূপ সুন্দরী ফারমিনার বিয়ে হয় মহা সমারোহে। বিয়ের রাতেই ইউরোপে মধুচন্দ্রিমার উদ্দেশ্যে নব দম্পতি রওনা হয়ে যান। এরপর ফারমিনা আর ফ্লোরেন্টিনো সমান্তরাল জীবন কাটিয়েছেন। ডাক্তার উরবিনো ও ফারমিনা ডাজার দাম্পত্য জীবনের নানা তথ্য ও অনুভব উপন্যাস পাঠকের কাছে বিস্তারিতভাবেই পৌঁছে দিয়েছেন আখ্যানকার। বিয়ের পরে ইউরোপ যাত্রাকালে জাহাজের সুরম্য এক কামরায় প্রথম শরীরী মিলনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে এর শুরু।
সে মজা পেয়ে এত স্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠলো যে ডাক্তার ওই সুযোগ গ্রহণ করে ওকে আলিঙ্গন করলেন এবং প্রথমবারের মত ওর ওষ্ঠচুম্বন করলেন। সেও তার উত্তর দিল আর তখন তিনি আলতো ভাবে চুম্বন করতে থাকলেন ওর গাল, ওর নাক, ওর চোখের পাতা : তিনি চাঁদরের নিচে হাত ঢুকিয়ে ওর যোনির চারপাশের সোজা অকুঞ্চিত কেশরাশিতে হাত বুলালেন। ও তাঁর হাত সরিয়ে দিল না, কিন্তু নিজের হাতটা সতর্কাবস্থায় রাখলো যেন তিনি আর অগ্রসর হতে না পারেন।
ফারমিনা বললো, ‘অনেক হয়েছে, আর চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা দানের দরকার নেই।‘
‘না’, তিনি বললেন, ‘এবার শিক্ষাদান হবে প্রেমলীলায়।
তিনি চাদরটা সরিয়ে নিলেন, ও যে বাধা দিল না শুধু তাই নয়, পায়ের এক দ্রুত ঝটকায় খাট থেকেই সে ওটা ফেলে দিল। ওর অসহ্য গরম লাগছিল। ওর শরীর ছিল নমনীয় ও ঢেউখেলানো, পোশাক পরা অবস্থায় যেমন দেখাতো তার চাইতে বেশি ধীর ও অচপল, ওই শরীরে অরণ্যের প্রাণীর একটা নিজস্ব গন্ধ পাওয়া গেল, ওই গন্ধ ওকে বিশ্বের আর সব রমণী থেকে স্বতন্ত্র করে তুললো। আলোর মধ্যে প্রতিরক্ষাহীন ফারমিনা অনুভব করলো যে তার সারা মুখ একঝলক রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে এবং সেটা লুকাবার একটা পথই সে দেখলো, সে দুই হাতে তার স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে তাকে একটা সুদীর্ঘ গাঢ় চুম্বনে সিক্ত করলো, দুজনের প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম হলেই তার সমাপ্তি ঘটে।
তিনি যে ওর প্রেমে পড়েন নি এ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি ওকে বিয়ে করেছিলেন কারণ তার অহঙ্কারী মেজাজ আর গাম্ভীর্য আর শক্তিমত্তা দ্বারা তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাছাড়া, তাঁর নিজের অহমিকা দ্বারাও তিনি তাড়িত হয়েছিলেন, কিন্তু ও তাঁকে প্রথম বার চুম্বন করার পরই তিনি নিশ্চিত হন যে পরস্পরকে সত্যিকার ভালোবাসার কারণ আবিষ্কারের পক্ষে তারা কোন অন্তরায়ের সম্মুখীন হবেন না। সে রাতে সকাল পর্যন্ত তারা অনেক কথা বলেছিলেন, কিন্তু ওই প্রথম রাতে কিংবা পরবর্তী কোন সময়ে তারা ওই বিষয় নিয়ে কখনো কোন আলাপ করেন নি। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত, তাদের দুজনের কেউই ভুল করেন নি।
অবশেষে সকালের দিকে তারা যখন ঘুমিয়ে পড়লেন, ফারমিনা তখনো কুমারী, কিন্তু আর বেশিক্ষণ সে তা থাকলো না। পরের রাতে ডাক্তার তাকে নক্ষত্রখচিত ক্যারিবীয় আকাশের নিচে ভিয়েনার ওয়াল্টজ নাচ শেখালেন, তারপর তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। ফারমিনা আগেই গিয়েছিল। ডাক্তার বাথরুম থেকে শোবার ঘরে ফিরে দেখলেন যে তার স্ত্রী শয্যায় তার জন্য অপেক্ষা করছে, নগ্নদেহে। এবার সে অগ্রণী ভূমিকা নিল এবং নিজেকে উজাড় করে দিল, কোন রকম দুঃখ বা শঙ্কা ছাড়া, উত্তাল সমুদ্রে কোন অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ নিয়ে, বহুশ্রুত রক্তাক্ত উৎসবের কোন চিহ্ন ছাড়াই, শুধু চাঁদরে লেগে থাকলো মর্যাদার একটা গোলাপ। তারা দুজনই সঙ্গম করতো চমৎকার ভাবে, প্রায় একটা অলৌকিক ব্যাপারের মতো এবং এটা তারা করতে থাকে দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত, গোটা সফর ব্যাপী এবং প্রতিবারই তা ক্রমান্বয়ে উন্নততর হতে থাকে, তারা যখন লা রোশেলে এসে পৌঁছল তখন তাদের দেখে মনে হল তারা যেন অনেক দিনের পুরনো প্রেমিক যুগল।
ফারমিনার স্বামী ও সংসার নিয়ে নানা জটিলতার পর্ব এসেছে। সে সব কখনো কখনো সহ্যের সীমাও ছাড়িয়েছে। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা ভালোবাসা আর কতটা অভ্যাসের তা নিয়ে ফারমিনা অনেক ভাবনাচিন্তাও করেছেন। সাংসারিক কাজের মধ্যে থাকা দৈনন্দিনতার নানা ক্লান্তি প্রায়শই তাকে ঘিরে ধরত। সংসারে নারীর কাজ আর পুরুষের কাজের প্রচলিত বিভাজন, যা নারীবাদী সমালোচনায় বারবার উঠে আসে, তা ফারমিনা ডাজার চিন্তাতেও উদ্ভাসিত।
‘তাকে যদি কোনো কিছু বিরক্ত করতো তাহলে সেটা ছিল দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়ার অন্তহীন পালা। শুধু যে ঠিক সময়ে খাবার পরিবেশন করতে হবে তাই নয়, পরিবেশিত খাবারকে হতে হবে নিখুঁত এবং তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়াই তাঁর যা পছন্দ ঠিক তাই পরিবেশন করতে হবে। গার্হস্থ্য জীবনের অসংখ্য অর্থহীন নিষ্প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ফারমিনা যদি কখনো তাঁকে জিজ্ঞাসা করতো তাহলে তিনি খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বলতেন, “দিও একটা কিছু।”তাঁর অমায়িক ভঙ্গিতে তিনি সত্যি কথাই বলতেন, সত্যিই তাঁর চাইতে কম স্বৈরাচারী কোনো স্বামীর কথা কল্পনা করা যায় না, কিন্তু খাবার সময় হলে দেখা যেতো যে একটা কিছু হলে চলতো না, তাঁর যা পছন্দ ঠিক তাই টেবিলে থাকা চাই, যেমন ভাবে চান অবিকল তেমন ভাবে।
… ঊষার অন্ধকার লগ্নে তাঁর জামার বোতাম নেই দেখলে ফারমিনা তাঁকে বলতে শুনতো, “একটা মানুষের দুজন স্ত্রী থাকা উচিত, একজন ভালোবাসার জন্য, অপরজন জামার বোতাম লাগাবার জন্য।”
স্বামীর অবুঝপনায় ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ফারমিনা তাঁর কাছে একটা একবার ভিন্ন ধরনের জন্মদিনের উপহার চাইলেন - ডাক্তার উরবিনো একদিনের জন্য সংসারের যাবতীয় কাজের ভার নেবেন। মজা পেয়ে ডাক্তার সম্মতি জানালেন এবং সত্যি সত্যিই ভোর থেকে গৃহের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। টেবিলে তিনি চমৎকার প্রাতরাশ পরিবেশন করেন,তবে ভুলে যান যে ডিম-ভাজা তাঁর স্ত্রীর সহ্য হয় না, আর ওই বিশেষ কফিটা তিনি পান করেন না। তারপর তিনি জন্মদিনের দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য নির্দেশ দেন, আটজন অতিথি হবে। তিনি বাড়িঘর পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন করার নির্দেশ দেন, আর তিনি যে এসব কাজতাঁ র স্ত্রীর চাইতে ভালো ভাবে করতে পারেন তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এত কঠোর প্রয়াস চালান যে দুপুর বারোটার আগেই বিন্দুমাত্র বিব্রত বোধ না করে তিনি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। প্রথম মুহূর্ত থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন যে কোথায় কোন জিনিসটা আছে, বিশেষ করে রান্নাঘরে, সে সম্পর্কেতাঁর ক্ষীণতম ধারণা নাই। একটা জিনিস পাবার জন্য ভৃত্যকুল তাঁকে সব জিনিস ওলট-পাল্ট করতে দিল, কারণ তারাও খেলাটায় অংশ নিচ্ছিল। বেলা দশটা বেজে গেলেও দুপুরের খাবারের ব্যাপারে তখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি, কারণ বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ তখনো চলছিল, শোবার ঘর গোছানো হয় নি, বাথরুম ঘষা-মাজা এখনো বাকি। তিনি নতুন টয়লেট পেপার দেয়া, বিছানার চাদর বদলানো এবংবাচ্চাদের জন্য কোচোয়নকে গাড়ি আনবার কথা বলতে ভুলে যান। চাকর-দাসীদের কার কি কাজ সে ব্যাপারে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, বাবুর্চিকে বললেনবিছানা করতে আর শোবার ঘরের পরিচারিকাকে রান্না করতে। বেলা এগারোটার দিকে, অতিথিবর্গের আসবার সময় হয়ে এলে, বাড়ির চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে সজোরে হাসতে হাসতে ফারমিনা ডাজা সংসারের কর্তৃত্বভার আবার নিজের হাতে তুলে নিল, তবে বিজয়ীর ভঙ্গিতে সে হাসে নি, ইচ্ছা হলেও, বরং গার্হস্থ্য অঙ্গনে স্বামীর অসহায়তা দেখে তাঁর প্রতি তার করুণাই হয়।
ডাক্তার উরবিনোর প্রকৃতি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ধরা পরে। তিনি সাংসারিক কাজ যে জরুরী একটা বিষয় এবং সেখানে যে তিনি চরম অপটু তা মেনে নেন না। বরং পুরুষতন্ত্রের স্বভাবসিদ্ধ বয়ানে একটু তিক্ততার সঙ্গেই সবসময় যে কথা বলতেন এখনও তাই বললেন, “তুমি যদি রোগীকে সারাবার চেষ্টা করতে তাহলে তোমার অবস্থা আমার তুলনায় অনেক বেশি খারাপ হত।” অর্থাৎ বাইরের জগতের ‘জরুরী কাজগুলো’ তার মতো পুরুষদের আর ঘরের ‘মামুলি কাজকারবার’ ফারমিনার মতো নারীদের।
ফারমিনা এই আপাত মজার পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বোঝেন ‘এভাবে ছাড়া অন্য কোনওভাবে একসঙ্গে বাস করা কিংবা ভালোবাসা সম্ভব নয়, আর এ পৃথিবীতে ভালোবাসার চাইতে দুঃসাধ্য আর কিছুই নেই’।
এর আগে ফারমিনা যখন শাশুড়ি ননদের সঙ্গে একত্র সংসারে ছিলেন তখন নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে তিনি পড়েছেন। নিজের সংসারে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকার সময়েও তার মধ্যে নানা মনস্তাপের মুহূর্ত এসেছে। কিন্তু সে সব সহনশীলতার মাত্রা ততদিন ছাড়ায় নি, যতদিন না ডাক্তার উরবিনো এক তীব্র তীক্ষ্ণ পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা বারবারা লিঞ্চের সঙ্গে। আখ্যানকার উরবিনো-বারবারা লিঞ্চের আতপ্ত শরীরী সম্পর্কের অন্তরঙ্গ বর্ণনা হাজির করেছেন আখ্যানে।
‘শনিবার দিন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো সাক্ষাতের নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে এসে উপস্থিত হল, মিস লিঞ্চ তখনো তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য কাপড়জামা পরে তৈরি হন নি। ডাক্তার উরবিনো প্রচণ্ড স্নায়বিক চাপ অনুভব করছিলেন, পারীতে মৌখিক পরীক্ষার জন্য হাজিরা দেবার পর তাঁর আর কখনো এরকম অবস্থা হয় নি। বারবারা তার ক্যানভাস খাটে শুয়ে পড়লো, তার পরনে সিল্কের পাতলা একটা অন্তর্বাস জাতীয় পোশাক, তার সৌন্দর্যের যেন কোন সীমা পরিসীমা নাই। তার সব কিছুই ছিল বড়োসড়ো, তীব্র, তার মোহিনী নারীর ঊরু, তারধীরে ধীরে আগুন ধরানো ত্বক, তার বিস্ময়কর স্তনযুগল, তার নিখুঁত দন্তপার্টি ও স্বচ্ছ মাড়ি, তার সমগ্র দেহ থেকে যেন সুস্বাস্থ্যের একটা ভাপ বিকীর্ণ হচ্ছিল …
বারবারা বললো, ‘আমার ধারণার অর্থ এই নয় যে আপনি ওটা করতে পারবেন না। আমার মতো এক গরিব কালো মেয়েকে এতো বিখ্যাত একজন লোক লক্ষ করেছেন, এ কী ভাবা যায়। ডাক্তার বললেন, ‘তোমার কথা না ভেবে আমার একটি মুহূর্তও কাটে নি’। এই স্বীকারোক্তি ছিল এতোই কাতর ও কম্পমান যে এটা হয়তো অনুকম্পার উদ্রেক করতে পারতো কিন্তু বারবারা হেসে উঠে সে আঘাতটা কাটিয়ে দিল। তার হাসিতে শোবার ঘরটি আলোকিত হয়ে ওঠে। হাসতে হাসতে সে বললো, ‘আপনাকে হাসপাতালে দেখার পর থেকেই আমি তা জানি, ডাক্তার। আমি কালো হতে পারি কিন্তু বোকা নই।’
কাজটা সহজ হয় নি। মিস লিঞ্চ চাইলো তার সম্ভ্রম যেন রক্ষিত হয়, সে চাইলো নিরাপত্তা এবং ভালোবাসা, ওই ক্রম অনুসারে, আর তার বিশ্বাস এসব তার প্রাপ্য। সে তাকে প্রলুব্ধ করার সুযোগ দিল ডাক্তার উরবিনোকে, কিন্তু তাকে তার ভেতরের খাস কামরায় ঢুকতে দিল না, এমনকি সে যখন বাড়িতে একা তখনও না। ডাক্তারকে তাঁর নীতিমালা ইচ্ছা মতো লঙ্ঘন করার সুযোগ দিয়ে সে তাঁকে হাতের স্পর্শ দ্বারা ও বুকে কান লাগিয়ে পরীক্ষা কাজ চালাতে দিল, কিন্তু তার কাপড়-জামা না খুলে। ডাক্তারের দিক থেকে, একবার টোপ গেলার পর তিনি আর ছাড়তে পারলেন না, ব্যাপারটা একটা দৈনন্দিন অভিযান হয়ে দাঁড়ালো। বাস্তব কারণেই মিস লিঞ্চের সঙ্গে এই সম্পর্ক অব্যাহত রাখা ডাক্তারেরপক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে কিন্তু এটা বন্ধ করার মতো যথেষ্ট শক্তি তিনি পেলেন না, পরবর্তী সময়ে যেমন আরো অগ্রসর হবার মতো শক্তিও তিনি পাননি। এই পর্যন্তই ছিল শেষ সীমারেখা। …
তার উত্তেজিত প্রেমিককে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখা মাত্র মিস লিঞ্চ নিজের শোবার ঘরে চলে যেতেন। ডাক্তারকে যেসব দিনে তিনি প্রত্যাশা করতেন সেসব দিনে জ্যামেইকা থেকে আনা লাল ফুলের নকশা আঁকা কুঁচি দেয়া একটা চমৎকার লম্বা স্কার্ট পরে থাকতেন, কিন্তু নিচে কোনো অন্তর্বাস পরতেন না, একেবারে কিচ্ছু না, ভাবতেন, এই সুবিধাটুকুর ফলে ডাক্তারের ভয়-ভীতি দূর হবে। কিন্তু তাঁকে খুশি করার জন্য ওর সব উদ্যোগ ডাক্তার নষ্ট করে ফেলতেন। ঘর্মাক্ত কলেবর, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তিনি ওর পেছন পেছন শোবার ঘরে এসে প্রবেশ করতেন, তারপর সব কিছু ছুড়ে ফেলতেন মেঝের উপর, তাঁর হাতের লাঠি, তাঁর ডাক্তারি ব্যাগ, তাঁর পানামা হ্যাট, তারপর হাঁটুর নিচ পর্যন্ত প্যান্ট নামিয়ে তিনি ভয়-তাড়িত সঙ্গম ক্রিয়াটুকু সমাধা করতেন, তখনো ঊর্ধ্বাঙ্গে কোট চাপানো, তার বোতাম আটকানো যেন কোন বাধার সৃষ্টি না করতে পারে, ওয়েস্টকোটে ঘড়ির সোনার চেইনটাও লাগানো, পায়ে জুতো পরা, সব ধরা-চূড়া ঠিক আছে, আনন্দ লাভের চাইতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাবার জন্যই যেন তিনি বেশি উদগ্রীব। আর বারবারা লিঞ্চ নিজেকে আবিষ্কার করতো ঝোলানো অবস্থায়, সে তার নিঃসঙ্গতার সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথেও ঠিক মত পৌঁছায় নি, আর ডাক্তার এরই মধ্যে তাঁর প্যান্টের বোতাম লাগিয়ে ফেলেছেন, তাঁকে দেখাচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত, যেন জীবন মরণের মধ্যবর্তী রেখায় দাঁড়িয়ে তিনি পরিপূর্ণ ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করেছেন, যদিও আসলে তিনি একটা দৈহিক ক্রিয়ার বেশি কিছুই সম্পন্ন করেন নি, যা প্রেমের একটা অংশমাত্র।
এই পরকীয়া অচিরেই ধরা পড়ে ফারমিনা ডাজার কাছে। তিনি দু বছরের জন্য তার আত্মীয় পরিজনদের কাছে চলে যান স্বামী সংসার সন্তানদের ত্যাগ করে। দু বছর পর ডাক্তার উরবিনো যখন তাকে ফিরিয়ে আনতে যান সেখানে ও নিজের অনুতাপ প্রকাশ করেন, ফারমিনা ফিরতে সম্মত হন। এরপর নানা ছোটখাটো বিষয়ে নানা সাংসারিক সমস্যা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বড় ধরনের বিপর্যয় আর আসে নি এবং প্রৌঢ় দম্পতি পরস্পর পরস্পরের অবলম্বন হয়ে বেঁচেছেন।
ফারমিনার দাম্পত্য জীবনে ফ্লোরেন্টিনো কেন্দ্রিক চিন্তা শত জটিলতার মধ্যেও সেভাবে আসেই নি। কালেভদ্রে কখনো সামাজিক পরিসরে দেখাসাক্ষাৎ হলেও সাধারণ পরিচিত একজনের মতোই ফ্লোরেন্টিনোর সঙ্গে তিনি স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময় করেছেন মাত্র।
অন্যদিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোনওদিনই ফারমিনাকে ভুলতে পারেন নি। তিনি ফারমিনার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বা যোগাযোগ করেন নি ঠিকই, কিন্তু ফারমিনা আগাগোড়া তার মনে ও নজরেই ছিলেন। একসময় চির কৌমার্যের ব্রত নিয়েছিলেন সদ্য ফারমিনাকে হারিয়ে ফেলা ফ্লোরেন্টিনো। এক জাহাজ যাত্রায় অতর্কিতে এক নারী অন্ধকারে তাকে টেনে নেয় নিজের শয্যায় ও নিজের কামনা চরিতার্থ করে। ফ্লোরেন্টিনোর কৌমার্য হারানোর সেই মুহূর্তটি আখ্যানকার এক অসামান্য বর্ণনায় হাজির করেন।
সে অন্যমনস্ক ভাবে টয়লেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় খাবার ঘরের ভেতর দিয়ে যখন সে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ পাশের একটা ঘরের দরজা খুলে গেল আর বাজপাখির থাবার মতো একটা হাত চকিতে বেরিয়ে এসে তার জামা খামচে ধরে তাকে ক্যাবিনের ভেতরে টেনে নিলো। অন্ধকারের মধ্যে সে একটি নগ্ন রমণীকে আবছাভাবে দেখতে পেল, তার কাল বিহীন শরীর গরম ঘামে ভিজে গেছে, নিঃশ্বাস ভারি, সে তাকে তার শয্যায় চিৎ করে ঠেসে ধরলো, তার বেল্ট খুলে নিলো, প্যান্টের বোতামগুলি খুলে দিল, তারপর নিজেকে তার উপরে বিদ্ধ করলো, যেন একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ছে, তারপর কোনো রকম গৌরব ছাড়াই তার কুমারত্ব হরণ করে নিলো। কামনার এক অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দুজনই এক অতল গহ্বরের শূন্যতার ভেতর ডুবে গেল, যেখান থেকে ভেসে এলো চিংড়ি মাছে পূর্ণ লবণাক্ত এক জলাভূমির গন্ধ। তারপর ও তার ওপর এক মুহূর্ত শুয়ে থাকলো, হাঁপালো, আর তারপর অন্ধকারের মধ্যে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল।
আকস্মিকভাবে কৌমার্য ভাঙার এই অভিজ্ঞতাটির পর অবশ্য এক নারী থেকে আরেক নারীতে গমন করেছেন ফ্লোরেন্টিনো। পঁচিশটি ডায়রী লিখেছিলেন তিনি। সেখানে মোট ছশো বাইশজন রমণীর সঙ্গে রতিক্রিয়ার কথা রয়েছে। উপন্যাসে তাদের কয়েকজনের নাম পরিচয় সামনে এনেছেন আখ্যানকার। লিওনা ক্যাসিয়ানি, সারা নোরেগা, অলিম্পিয়া জুলেটা, প্রুডেন্সিয়া পিত্রে, অ্যাঞ্জেন আলফারো, আউসেন্সিয়া সান্তানদার, আমেরিকা ভিসুনা প্রমুখদের কেউ নিতান্ত স্বল্পকাল ফ্লোরেন্টিনোর সঙ্গিনী ছিলেন, কেউ বা কয়েক দশক। কিন্তু এই সমস্ত অভিসার বা সম্পর্কের স্রোত ফারমিনার জন্য অপেক্ষাকে কখনোই লঘু করে নি। ফারমিনাকে সামান্য একবার দূর থেকে দেখেও ফ্লোরেন্টিনা আকুল হয়েছেন। একবার এক রেস্তোরাতে খেতে গিয়ে সবান্ধব ফারমিনা দেখতে পান তিনি। এক আয়নায় ভেসে থাকা ফারমিনার প্রতিচ্ছবিটি দু ঘন্টা ধরে তিনি শুধু দেখেন তাই নয়, পরে রেস্তোরা মালিককে নানাভাবে বুঝিয়ে অনেক টাকার বিনিময়ে সেই আয়নাটি নিজের সংগ্রহে নিয়ে আসেন শুধু এই কারণে যে সেখানে ফারমিনার প্রতিচ্ছবিটি অতক্ষণ ধরা ছিল।
“ওই রাতের পর প্রায় এক বছর ধরে সে রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে নিরন্তর ধরণা দেয়, তিনি যা চান সে তাঁকে তাই দেবে, অর্থ কিংবা কোন অনুগ্রহ, জীবনে যা তাঁর সব চাইতে বেশি কাম্য তাই সে দেবে, তিনি যদি তার কাছে ওই আয়নাটা বিক্রি করেন। কাজটা সহজ হয় নি, কারণ বৃদ্ধ ডন সাঙ্কো প্রচলিত একটি লোককাহিনীতে বিশ্বাস করতেন, এই আয়নার ফ্রেম তৈরি করেছে ভিয়েনার আসবাব নির্মাতারা, এরকম দুটি আয়না আছে, অন্যটির মালিক মেরি আঁতোয়ানেৎ, সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ তার হদিস জানে না, ডন সাঙ্কোর এই আয়না অতুলনীয় এক জোড়া রত্নের একটি। অবশেষে তিনি যখন আত্মসমর্পণ করেন, তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সেটা নিজের বাড়িতে এনে স্থাপন করলো, তার পরম সুন্দর ফ্রেমের জন্য নয়, শুধু এই জন্য যে ওই আয়নার মধ্যে দু’ঘণ্টার জন্য অবস্থান করেছিল তার প্রিয়তমার প্রতিবিম্ব।”
ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর মৃত্যুর পর সাতাত্তর বছরের প্রৌঢ় ফ্লোরেন্টিনো বাহাত্তর বছরের প্রৌঢ়া ফারমিনার কাছে আবার প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। মাঝে কেটে গেছে পাঁচ দশকেরও বেশ সময়। প্রথমে ফারমিনা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানই করেন। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনোর লেখা চিঠিগুলি তাঁকে আবার দ্রবীভূত করতে শুরু করে। এরপর প্রতি মঙ্গলবার ফারমিনার বাড়িতে আসতে থাকেন ফ্লোরেন্টিনো। মাঝে পা ভেঙে ফ্লোরেন্টিনো বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকার সময় তাদের সাক্ষাৎ সাময়িক বন্ধ হয় ও এই অবকাশেই ফারমিনা আরো বেশি করে বুঝতে পারেন তিনি এখনো ফ্লোরেন্টিনোকে কতটা ভালোবাসেন। এই পর্বেই ফারমিনার মেয়ে দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার এই আশ্চর্য বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে সম্পর্কে বিরূপ ও তির্যক মত প্রকাশ করলে ফারমিনা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন ও আর কখনো ঢুকতে নিষেধ করেন। মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কও কার্যত শেষ করে দেন আর বুঝিয়ে দেন সামাজিক বিধিনিয়মকে মাথায় রাখার বদলে নতুন জীবন ও প্রেমকে বেছে নিতে তিনি কতটা ব্যগ্র। ফ্লোরেন্টিনার সঙ্গে এরপর এক জাহাজযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন তিনি, জাহাজের সুরম্য কামরার দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার শরীরী মিলনও ঘটে।
সে তার আঙ্গুলের ডগা দিয়ে তার বিবর্ণ ঘাড়, কঠিন বন্ধনীর মাঝে আটকানো তার বুক, তার কটিদেশের ক্ষয়িষ্ণু হাড়, তার শিরাবহুল উরু, সব সাদরে আবিষ্কার করতে থাকলো। ফারমিনা ডাজা এই আদর গ্রহণ করলো চোখ বন্ধ করে, সে কেঁপে উঠলো না, নিয়মিত বিরতি দিয়ে ধূমপান ও সুরা পান করতে থাকলো। অবশেষে, ওর প্রণয় স্পর্শ যখন তার পেটের ওপর দিয়ে প্রসারিত হল, ততক্ষণে যথেষ্ট আনিসেৎ সে গলাধঃকরণ করেছে, ফারমিনা ডাজা বললো, ‘যদি করতেই চাই তবে এসো করে ফেলি, কিন্তু বড়দের মতো করে করি।
সে ওকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলো, আলো না নিভিয়েই, কোনো রকম কপট বিনয় ছাড়াই, সে তার কাপড়-জামা খুলতে শুরু করলো ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে, চেষ্টা করছে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, এবারও যে ব্যাঘকে সে নিধন করেছে তার চামড়া নিয়ে কী করবে ঠিক করতে পারছে না। ফারমিনা বললো, তাকিও না। ছাদের উপর থেকে তার চোখ না সরিয়ে ফ্লোরেন্টিনো জিজ্ঞাসা করলো, কেন?
কারণ যা দেখবে তা তোমার ভালো লাগবে না।
তখন সে ওর দিকে তাকালো, দেখলো কোমর পর্যন্ত তার অনাবৃত শরীর, যেমন কল্পনা করেছিল সেই রকমই। কাঁধের চামড়া কোঁচকানো, স্তন ঝুলে পড়েছে, পাজরের উপরে শিথিল তুক যেন ব্যাঙের তুকের মতো বিবর্ণ ও ঠাণ্ডা। এই মাত্র খুলে ফেলা ব্লাউজটা দিয়ে বুক ঢেকে ফেলে ও আলো নিভিয়ে দিলো। তখন সে তার নিজের পোশাক একটা একটা করে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলো আর ও সঙ্গে সঙ্গে আবার সেগুলি খিলখিল করে হাসতে হাসতে তার দিকে ছুঁড়ে দিল।
ফারমিনা ডাজার মনে পড়ে যায় তার স্বামীর বলা এই কথাগুলো ছিল কত অমোঘ সত্য - ‘আমরা পুরুষরা সংস্কারের হতভাগ্য দাস, কিন্তু একটি নারী যদি কোনো পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হবার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে এমন কোনো দেয়াল নেই যা সে লঙ্ঘন করতে পারবে না, এমন কোনো দুর্গ নেই যা সে ধ্বংস করবে না, এমন কোনো নৈতিক বিবেচনা নেই যা সে একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলবে না।’
গার্সিয়া মার্কেস কলেরার দিনগুলিতে প্রেম উপন্যাসে মূলত প্রেমের বয়স নিরপেক্ষ সার্বিকতার কথাই বলতে চান। উনিশ শতকী আখ্যানের আদলে এই উপন্যাস নির্মাণ করলেও শেষপর্যন্ত এই আখ্যান তার কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসে। যুবক যুবতীর প্রেমের বাস্তববাদী পরিসরটুকুকে অতিক্রম করে এই উপন্যাসের শেষাংশ। সাতাত্তর ও বাহাত্তরের দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার প্রেম, যারা সামাজিকভাবে বিবাহ সম্পর্কের বাইরে দাঁড়ানো, যাদের একজনের আবার পুত্র কন্যা সমেত ভরা সংসার আছে, উপরোন্ত যিনি সদ্য বিধবা হয়েছেন কয়েক মাস আগে – নিঃসন্দেহে বিশ্বসাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।
প্রেম সম্পর্কে আরো নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও দার্শনিক বিচার রয়েছে এই উপন্যাসে। প্রেমের কোনও বয়েস হয় না, ফারমিনা ডাজার সিদ্ধান্তের সূত্রে এটা মেনে নেওয়া যতটা সহজ, ততটাই কী সহজ ফ্লোরেন্টিনোর জীবন যাপন থেকে তাকে এক দায়বদ্ধ প্রেমিক হিসেবে স্বীকার করা ?
ফ্লোরেন্টিনোর সঙ্গে একদা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া সঙ্গীত শিক্ষক অ্যাঞ্জেল আলফারোর একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। তিনি ফ্লোরেন্টিনোকে বুঝিয়েছিলেন, একজন অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রে জড়িয়ে থাকতে পারে, একইসঙ্গে তাদের সবার দুঃখবেদনাকে অনুভব করতে পারে এবং এর দ্বারা তাদের কারোর প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় না। এই বাক্যটি এক গৌণ চরিত্রের মুখে উচ্চারিত হলেও একটি বীজবাক্য স্বরূপ। তাই গার্সিয়া মার্কেস স্প্যানিশে ঠিক কী লিখেছিলেন তা দেখা যাক।
'Se puede estar enamorado de varias personas a la vez, y de todas con el mismo dolor, sin traicionar a ninguna.' এডিথ গ্রসম্যানের বিখ্যাত ইংরাজী অনুবাদ সংস্করণে এর রূপান্তর হয়েছে এভাবে - “one can be in love with several people at the same time, feel the same sorrow with each, and not betray any of them.”
ফ্লোরেন্টিনো শুধু একাধিক জনের সম্পর্কে জড়িয়েছিল তাই নয়, সে এই সমস্ত সম্পর্কের একটির কথাও ফারমিনা ডাজাকে পুনর্মিলনের দিনগুলিতে জানায় নি। বরং নিজের কৌমার্যকে সে রক্ষা করে রেখেছে ফারমিনার জন্য, এমনটাই তাকে বুঝিয়েছে।
‘ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোনো মেয়ের সঙ্গে সহবাস করেছে এ খবর ফারমিনা ডাজা কখনো পায় নি, তবু সে হাল্কা ভাবে ওকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই ও বিনা দ্বিধায় দৃঢ় কণ্ঠে জানালো, আমি তোমার জন্য আমার কৌমার্য অক্ষুণ্ণ রেখেছি’।
ফারমিনা ডাজা অনুভব করেছিল ফ্লোরেন্টিনোর এই দাবি সত্য হতে পারে না। কিন্তু এই মিথ্যেকে তার প্রতারণা বলে মনে হয় নি, বরং এই অনৃত ভাষণ এক্ষেত্রে তাকে খুশিই করেছিল।
‘ফারমিনা ডাজা কথাটা এমনিতেও বিশ্বাস করতো না, সত্য হলেও না, কারণ তার সব প্রেমপত্রই ছিল অনুরূপ উক্তিতে পূর্ণ, যেখানে প্রকাশভঙ্গির ঔজ্জ্বল্য ছিল অর্থের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবু ও যে রকম দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা বললো তাতে সে খুশি হল’। সাধারণ মনস্তত্ত্বকে এভাবে বারবার ডিঙোতে থাকে আখ্যান।
এখানে প্রেম আর কলেরার মতো রোগকে যে শুধু নামকরণে একাকার করে দেওয়া হয় তাই নয়, ফারমিনার দাম্পত্য প্রেম ও পাঁচ দশক পরে কিশোর প্রেমের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের মুহূর্তগুলি আক্ষরিকভাবেই কলেরার আতঙ্কের দিনকালের সঙ্গে একাকার হয়ে থেকেছে। রোগের সঙ্গে যেমন প্রেমের সমীকরণ সাধারণভাবে মেলে না, তেমনি মাঝ সত্তরের এপাশ ওপাশ দাঁড়ানো নরনারীর উত্তুঙ্গ শরীরী প্রেমও স্বাভাবিক নির্মাণকে পেরিয়ে যায়। আবার পাঁচ দশক পরে এই ফিরে পাওয়া প্রেমের দিনকালেও যেভাবে হঠাৎই আমেরিকা ভিসুনার আত্মহত্যার খবর আসে আর তা ফ্লোরেন্টিনোকে ভেতর থেকে অপরাধী করে যায়, তাও আখ্যানে নিয়ে আসে এক অন্য মাত্রা। ফ্লোরেন্টিনা ফারমিনার প্রেম যখন রূপকথার মতো নতুন দিনের আলো খুঁজে নিচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই একদিকে কলেরায় মৃত দেহগুলি নদীতে তাদের চোখের সামনে অকাতরে ভেসে যায়, অন্যদিকে জানা যায় আমেরিকা ভিসুনার আত্মহত্যার মর্মান্তিক খবর। সে নিজে যদিও তার আত্মহত্যার জন্য কাউকে দায়ী করে যায় নি, আর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার জন্যই তার এই আত্মহত্যা এটা ধরে নেবার সুযোগ ছিল, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনা নিজে অনুভব করে এই মৃত্যুর জন্য সে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। দূর সম্পর্কের এই আত্মীয়ের অভিভাববকের দায়িত্ব বর্তেছিল তার ওপর। কিন্তু আরো অসংখ্য নারীর মতো এই সদ্য কিশোরীর সঙ্গেও শরীরী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সত্তরোর্দ্ধ ফ্লোরেন্টিনো। ফারমিনা ডাজা জীবনে ফিরে আসার পর সেই সম্পর্ক থেকে ফ্লোরেন্টিনা সরে আসে সহজেই, কিন্তু এই অবহেলা জীবনকে সদ্য চিনতে শেখা আমেরিকা ভিসুয়ানার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি। সে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ফ্লোরেন্টিনোর জন্য অনুতাপ আর প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে যায়। রূপকথায় পর্যবসিত হতে হতেও ফ্লোরেন্টিনোর প্রেমজীবন নানা পরিপ্রশ্নে নতুন করে বিদ্ধ হয়। সব মিলিয়ে এই আখ্যান হয়ে ওঠে তাই আরো একটি ছক ভাঙা নির্মাণ, যার জন্য গার্সিয়া মার্কেস বরাবরই বিখ্যাত।