‘স্পুটনিক সুইটহার্ট’ - হারুকি মুরাকামির উপন্যাসের পাঠানুভূতি

সুমিরে লিখতে চায়। বেশ কিছু লেখার প্রথমটুকুই আছে আবার কয়েকটার শুধু সমাপ্তি। কিন্তু শুরু এবং শেষ দুটোই আছে এমন কোনো লেখা তার কাছে নেই। ওর রাইটার্সব্লক নেই। বরং ও প্রচুর পরিমাণে লিখতে পারে।কেবল বুঝতে পারে না কোনটা প্রয়োজন আর কতটা বাদ দিতে হবে। কখনও কখনও হতাশায় গোটা লেখাটাই টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। যদি সেসব শীতের রাত হত আর তার ঘরে ফায়ারপ্লেস থাকত তবে তার বাতিল লেখাগুলোর কল্যাণে ঘরে আরামদায়ক উষ্ণতা বিরাজ করত। সুমিরের ঘরে কেবল ফায়ারপ্লেস নেই তা নয়, একটি ফোনেরও বড় অভাব। ভদ্রস্থ কোনো আয়নার কথা নয় বাদই দিলাম। সুতরাং আমাকে ভোর চারটের সময় জাগিয়ে কোনো দরকারি কথা বলতে হলে তাকে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে টেলিফোন বুথে যেতে হয়। যদিও তা নিয়ে ওর কোনো অভিযোগ নেই। কিচিজোজির যে এককামরার ঘরে ও থাকে সেখানে রয়েছে নামমাত্র আসবাবপত্র আর অসংখ্য বই। সুমিরে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। দুপুর গড়ালেই সে ইনোগাশিরা পার্কের চারপাশে হেঁটে বেড়ায় ঠিক তেমনই প্রবল উৎসাহে যেমনভাবে তীর্থযাত্রীরা পবিত্র পাহাড়ের ভেতরে ভেতরে চলে যায়। রোদেলা দিনগুলোয় পার্কের বেঞ্চে বসে বই পড়তে পড়তে ব্রেড চিবোয় আর একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যায়। বর্ষা আর শীতকালে তার গন্তব্য আদ্যিকালের কফি হাউজ। সেখানে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কর্ণবিদারি শব্দের মাঝেও সে একটা জীর্ণ সোফার ভেতরে ডুব দিয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে...সন্ধ্যায় একটা বিয়ার আর কিছু খাবার কিনে নেয় ডিনারের জন্য। রাত এগারোটায় লিখতে বসে সুমিরে। তখন থার্মোফ্লাস্কে  গরম কফি , একটা কফিমগ , এক প্যাকেট সিগারেট আর একটি কাচের অ্যাশট্রে থাকে তার পাশে। তার অনেক কিছু লেখার আছে। বলার আছে অনেক গল্প। কেবল সে যদি সঠিক পথটা খুঁজে পেত....

কোনো কোনো উইক এন্ডে সে আমার অ্যাপার্টমেন্টে তার উপন্যাসের কিছু অংশ শোনাতে আসে। আমি , হ্যাঁ আমিই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যাকে সে তার পান্ডুলিপি দেখায়। আমি তাকে ভালোবাসি। অথচ জীবনের বাইশতম বসন্তে  সে আমাকে জানালো এই  প্রথমবার সে সত্যিই কাউকে ভালোবেসেছে যে বয়সে ওর চেয়ে সতেরো বছরের বড়,বিবাহিত এবং এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে তিনি একজন মহিলা। এ থেকেই সবকিছুর শুরু আর এখানেই সব শেষ । প্রায় শেষই বলা যায়।

হারুকি মুরাকামির উপন্যাস 'স্পুটনিক সুইটহার্ট'  পড়ার পর পাঠক ডুবে যেতে পারেন এক গভীর শূন্যতাবোধে। আমরা প্রত্যেকেই নিজের জগতে বন্দী। খুব কাছের মানুষটিও কি ছুঁতে পারেন আমাদের কিংবা আমরা তাঁকে ? এই অতলস্পর্শ বিরহ কিংবা বিচ্ছেদ বেদনা বোধহয় ছড়িয়ে আছে মহাশূন্যে। মহাজাগতিক বস্তুরা অদ্ভুত আকর্ষণে একে অপরের কাছে আসছে অথচ নিজেদের কক্ষপথে তারা একা, নিঃস্ব কেবল এক প্রাণহীন জড়পিন্ড ছাড়া কিছু নয়।

 উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তিনটি। সুমিরে যাকে কে ভালোবাসে, এই কে ' এর নাম গোটা উপন্যাসে কোথাও নেই।

তৃতীয়জন মিউ যাকে সুমিরে ভালোবাসে । কলেজে সুমিরের দুবছরের সিনিয়র 'কে' একটি স্কুলে পড়ায়।সুমিরের সঙ্গে 'কে' র অনেক মিল। বিশেষত  গোগ্রাসে বই পড়ার ব্যাপারটা তাদের কাছে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক। হাতে একটু সময় বাঁচলেই তারা কোনো নির্জন কোণে বসে অবিরাম বইয়ের পাতা উলটে যেতে থাকে। জাপানি উপন্যাস, বিদেশি উপন্যাস নতুন কোনো লেখা ক্লাসিক থেকে বেস্ট সেলার যাইহোক না কেন সেগুলো যদি মস্তিষ্কের কোষগুলোকে যথেষ্ট জারিত করতে পারে তবে তারা পড়তেই থাকবে। ওরা  লাইব্রেরি ঘুরে আর পুরোনো বইয়ের দোকানে পাতার পর পাতা সরিয়েই গোটা দিন কাটিয়ে ফেলতে পারে...

"I'd never come across anyone else who read so avidly...so deeply, so widely, as Sumire, and I'm sure she felt the same."

এত মিল যে বন্ধুর সঙ্গে এবং যার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হয় প্রেম, যৌনতা সহ সার্থক সৃজন নিয়ে সেই মানুষটি যে প্রবলভাবে সুমিরেকে চাইবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কে' জানে সুমিরে তার যৌন সঙ্গী হিসেবে একজন নারীকে চায়, তাকে নয়। এই অসহ্য কষ্ট থেকে বাঁচতে এক ছাত্রের মায়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কে। অথচ তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোতে সে সুমিরেকেই ভাবে।

মিউর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর সুমিরের জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে।তার সাজ পোশাক আগে ছিল কারুয়াকের উপন্যাসের চরিত্রের মতো। বড় মাপের হেরিং বোন কোট, না আঁচড়ানো চুল, একজোড়া বুট জুতো। এই ছিল সুমিরে । মিউ তাকে ফ্যাশানেবল পোশাক, জুতো, মেকআপে অভ্যস্ত করে তোলে। তাতে ওকে দেখতে সুন্দর লাগলেও পুরোনো সুমিরেই যেন বেশি ভলো ছিল বলে মনে হয় কে 'র।

মিউর ওয়াইন বিজনেস। ওর অফিসে সুমিরের চাকরি হয়। হঠাৎই মিউর সঙ্গে ও ইউরোপ ভ্রমণে যায়। সেখান থেকে  চিঠি লেখে। জানায় কত নতুন অভিজ্ঞতা , মুগ্ধতার কথা। যদিও মিউকে তখনও সে জানাতে পারেনি তার অনুভূতিগুলো। বেশ কিছুদিন কোনো খবর আসে না। কে অপেক্ষায় থাকে। হঠাৎই এক গভীর রাতে মিউর ফোন আসে। মিউ জানায় গ্রীসের এক দ্বীপ থেকে সুমিরে নিখোঁজ হয়ে গেছে...."Sumire has disappeared like smoke..."

ওখানে যায় 'কে'। সুমিরেকে খুঁজে পায়না কিন্তু তার লেখা দুটো ডকুমেন্ট পায়। মিউর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে সুমিরের লেখা থেমে গিয়েছিল।  তবে হারিয়ে যাওয়ার আগের কিছুদিন সে লিখছিল বলে মিউ জানায়। কে' র খুঁজে পাওয়া সেই লেখায় মিউর জীবনে বহু বছর আগে ঘটা এক আশ্চর্য ঘটনার কথা জানা যায়। যে ঘটনা তার জীবনকে আমূল বদলে দেয়। অথচ সেই ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা নেই... কখনও মনে হয় মিউ চরম শারীরিক নির্যাতনের শিকার আবার কখনও মনে হয় সবটাই ওর কল্পনা আবার কখনও অন্য জগতের অস্তিত্বের কথা মনে হয়। তবে সেই ঘটনার পর শারীরিক ও মানসিকভাবে মিউ বদলে যায়। চিরতরে হারিয়ে যায় আপন সত্তা। সুমিরে একদিন নিজের সব অনুভূতি প্রকাশ করলেও মিউ আর সাড়া দিতে পারে না। যে রাতে সুমিরে মিউর খুব কাছে আসে সেই ভোর থেকেই তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না...

প্রবল অতৃপ্তিই যেন চরিত্রগুলোর নিয়তি... ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় অথচ প্রিয় মানুষ কাছে থাকলেও তাদের মাঝে রয়ে যায় অলঙ্ঘ্য সীমা। মানুষ একা থেকে আরো একা হয়ে যায়...সুমিরে হয়ত সেই বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া মিউর 'lost part' এর কাছেই রয়েছে...

Miu with black hair and a healthy sexual appetite. Perhaps they've come across each other there, loving each other, fulfilling each other...

 

কিংবা হঠাৎই সে হয়ত খুঁজে পেয়েছে অন্য জগতে প্রবেশের পথ। তারপর বন্ধ হয়ে গেছে সেই দরজা। সুমিরেকে খুঁজে না পেয়ে কিছুদিন পর ফিরে আসে কে। মিউ তাকে জাহাজে ছাড়তে আসে। ওরা দুজনেই বিশ্বাস করে সুমিরে বেঁচে আছে। হয়ত ওরা তাকে দেখতে পাচ্ছেনা। জাহাজ এগোতে থাকে সমুদ্রের গভীরে। তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মিউ ক্রমশ ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হয়ে মিলিয়ে যায় একসময় । আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হয় এই চোখের আড়ালে চলে যাওয়া মানুষটা আছে অথবা নেই। সুমিরেও কি তাই? থাকা না থাকার মাঝের এই দূরত্ব...এই সংকট এই অসহ্য অস্তিত্ব বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন...

"Why do people have to be this lonely? What's the point of it all ? Millions of people in this world , all of them yearning, looking to others to satisfy them , yet isolation themselves. Why ? Was the Earth put here just to nourish human loneliness ?

 

এটাই মানুষের নিয়তি। জীবনের গভীর নির্মম সত্য। সুমিরে ফিরে আসেনি আর। মিউর সঙ্গেও আর কখনও কথা হয়নি কে' র। একদিন ভোর রাতে সুমিরের ফোন আসে। অল্পক্ষণ কথা বলার পর ফোন কেটে যায়...পড়ে থাকে অনন্ত অপেক্ষা...কেবল কে বুঝতে পারে সুমিরে জীবনের অনেকটা পথ যেন হেঁটে ফেলেছে।পরিচয় হয়েছে সেইসব ব্যথার সঙ্গে যা চিনতে শেখায় জীবনকে। হাঁটতে শেখায় বন্ধুর পথে একা...

মুরাকামির লেখার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। একই লেখা বিভিন্ন পাঠকের কাছে আলাদা আলাদা অর্থ নিয়ে আসে।এমনকি পুনর্পাঠেও বদলে যেতে পারে ভাবনা। যেমন এই উপন্যাসটির শেষটুকু নিয়ে বিভিন্ন পাঠক বিভিন্ন মত প্রকাশ করেন। কেউ বলেন সুমিরে ফিরে এসেছে। কেউ বলেন সুমিরে ফেরেনি আর কখনই। কে একেবারে শেষে যে ফোন আসার কথা বলে তা স্বপ্ন না সত্যি? এইখানে দ্বিধান্বিত পাঠক। তর্ক চলতে থাকে। ভাবনাও। কিছু অমীমাংসিত রহস্য পাঠককে অস্থির করে রাখে...জীবন, স্বপ্ন, সত্যি, মিথ্যা, লৌকিক অলৌকিক সব একাকার হয়ে যায়। এই উপন্যাস জীবনের মতোই বিস্ময়কর। অমীমাংসিত। তাই বারবার ফিরে আসতে হয় এই লেখার কাছে...কারণে অকারণে...

 

জাপানের জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিড়ালের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। কখনও তারা আসে কোনো ঘটনার পূর্বাভাস হয়ে। কখনও হোলি স্পিরিট কিংবা গাইডিং সোল। মুরাকামির লেখাতেও তারা আসে। সুমিরে খবরের কাগজের একটি ঘটনা পড়ে শোনায় মিউকে যেখানে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার মৃত্যুর পর তার একমাত্র সঙ্গী বিড়ালেরা খাবারের অভাবে তার মৃতদেহ খেতে খেতে নরখাদক হয়ে ওঠে...

সুমিরে একবার একটি বিড়ালকে পাইন গাছে উঠতে দেখেছিল। সে আর কখনও নেমে আসেনি...

"What do mean...never came back?" asked Miu.

"It just disappeared. Like smoke."

 

সুমিরে হারিয়ে যাওয়ার পর মিউ কে' কে ঠিক এই কথাই বলে ... disappeared like smoke

 

গ্রীসের ওই দ্বীপে গভীর রাতে এক রহস্যময় সুরের হাতছানিতে কে ' বেরিয়ে পড়ে। হয়ত কোনো দূর পাহাড়ে সে পেতে পারে সুমিরেকে। তারাভরা আকাশ ছড়িয়ে আছে ঘুমন্ত শহরের উপর। কে হাঁটছিল। পাহাড়ের পথ...একদিকের ঢাল ছুঁয়েছে সমুদ্র, বন্দর। অপরদিকে অন্ধকার ঘন। কোথাও কেউ নেই। সুর থেমে গেছে। অনুরণন রয়ে গেছে কানে। কে বুঝতে পারে না যা সে শুনেছে তা কি এই জগতের নাকি অন্য জগতের কোনো ইশারা। পাহাড়ের উপর থেকে চাঁদকে খুব কাছে মনে হয় তার। হয়ত এই চাঁদের আলোতেই মিউ দেখেছিল নিজের দ্বিতীয় সত্তা। এটাই হয়ত সুমিরের বিড়ালটাকে কোথাও নিয়ে গিয়েছিল। হয়ত সুমিরেকেও।

কটেজে ফিরে নির্ঘুম রাতে ওর মনে হয় ওর যেন মৃত্যু হয়েছে কোনো বন্ধ অ্যাপার্টমেন্টে আর বিড়ালগুলো আবারও নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করছে...হৃদয়, মন, মস্তিষ্ক সবই ওদের লুব্ধ গ্রাসে...

"And with each lick of their tongues, my mind ... like a shimmer of hot air ...flickered and faded away."

 

মুরাকামি আশ্চর্য কৌশলে পাইনগাছে উঠে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বিড়ালের গল্পে ইশারা দিয়ে যান অন্য জগতের...যে জগতে পৌঁছে যেতে পারে সুমিরে। এমন অজস্র ইঙ্গিত ছড়িয়ে থাকে গোটা গল্পে। পাঠক খুঁজতে থাকুক, ডুবতে থাকুক সেই রহস্যে। আমাদের এই ধুলো মাটির জীবনের প্রতি বাঁকেও অপেক্ষা করছে এমন কত বিস্ময় কত ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি...

 

তাই মুরাকামির লেখার নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা, শূন্যতাবোধ বিষাদকে ছাপিয়ে জীবনকে উপলব্ধি করতে, আবিষ্কার করতে শেখায় একান্ত নিজের করে। সে কোথাও আছে যাকে আমি প্রবলভাবে চাই...আকুল হয়ে খুঁজি...

" বিছানা থেকে নামলাম। পুরোনো ফ্যাকাশে পর্দাটা টেনে সরিয়ে জানলা খুলে দিলাম। মাথাটা বের করে আকাশের দিকে তাকালাম। আমি নিশ্চিত ঘোলাটে রঙের আধখানা চাঁদ আকাশে ঝুলে আছে। বেশ । আমরা দুজনেই এক চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি , একই পৃথিবীতে। বাস্তব আমাদের এক সারিতেই বেঁধে রেখেছে। আমাকে কেবল সেই সূত্রটিকে অতি সাবধানে টেনে আনতে হবে নিজের কাছে।

আমি হাতের আঙুলগুলিকে মেলে ধরলাম আর তাকিয়ে রইলাম দু'হাতের পাতায়। আমি রক্তের দাগ খুঁজছিলাম। কোথাও কিছু নেই। না গন্ধ, না স্পর্শ। কিন্তু সে আছে। নীরবে। চুঁইয়ে নামছে গভীরে।"