দুর্নীতি ও রাজ্যের শিক্ষা সমস্যার নানা দিক

স্কুল শিক্ষা নিয়ে দেশ তথা রাজ্য নানা সমস্যার সম্মুখীন দীর্ঘদিন ধরেই। ইদানীং এ রাজ্যে গূঢ় এক দীর্ঘকালীন এসএসসি দুর্নীতির সামান্য অংশ খোলসা হয়েছে। তারপর স্কুলশিক্ষা নিয়ে আপাতভাবে চর্চা বেড়েছে। কিন্তু সে চর্চা সঠিক দিশায় হচ্ছে কীনা ও তা আদৌ কোনো পরিবর্তনের হদিশ দিচ্ছে কীনা, তা ভাবার বিষয়।

শিক্ষা আমাদের দেশে রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ দায়িত্ব। স্কুলশিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাই সামান্য কিছু জাতীয় পরিসংখ্যান জেনে রাখা ভাল। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে প্রাথমিক স্তরে যদি ১০০ জন ভর্তি হয়, তাহলে মাধ্যমিক স্তর অবধি পৌঁছানোর আগেই গড়ে ২৫ জন স্কুলছুট হয়। উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৩০। দীর্ঘ লকডাউনের সময় এই সংখ্যা বেড়েছে, বলাই বাহুল্য। লকডাউনে প্রায় ৮৬% ছাত্রছাত্রী অনলাইন ক্লাসে বঞ্চিত থেকেছে এবং ক্রমশ স্কুলছুট হয়েছে। তাদের ফিরিয়ে আনার বিরাট কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

অন্যদিকে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষে সরকারি স্কুল ছেড়েছে ১.৩ কোটি ছাত্রছাত্রী। বেসরকারি স্কুলে ১.৭ কোটি ছাত্রছাত্রী বেড়েছে। সাম্প্রতিকতম জাতীয় শিক্ষানীতির কাঠামো এমনই যে, তাতে বেসরকারিকরণের প্রতি আছে প্রকট প্রশ্রয়। আরও বলে রাখি, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ থেকে ৬০০০ কোটি টাকা ছেঁটে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে স্কুলশিক্ষা নিয়ে মহামহিম কেন্দ্রীয় সরকার বড় যত্নশীল, এমন কথা বলা চলে না৷

এদিকে স্কুলশিক্ষায় নিয়োগের ভার তথা অর্থনৈতিক দায়িত্ব অনেকটাই রাজ্য সরকারের উপর৷ সেখানেও দেখা যাচ্ছে গভীর দুর্নীতি। এই দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৯ সালে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা ২৯ দিন অনশন করেছিলেন কলকাতার প্রেস ক্লাবের সামনে৷ অথচ ইডি এসে পৌঁছতে লাগল আরও তিনটি বছর। বোঝা দুষ্কর নয়, এর পিছনে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা যত আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাত। ঘটনাচক্রে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কোটি আবিষ্কৃত হতে খানিক নড়েচড়ে বসেছে জনগণ ও মিডিয়া, যদিও ওই অর্থ হিমশৈলের চূড়া মাত্র। প্রাইমারি, হাই ও হায়ার সেকন্ডারিতে উৎকোচের যে রেট চলছে বলে শোনা যায় ইদানীং, তার সর্বমোট বখরা ওর অনেক অনেক গুণই হবে। ফিরহাদ হাকিম সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, যে তৃণমূল নেতারা 'ওয়াশিং মেশিনে' ঢুকেছেন, তাদের বাড়িতে ইডি যায় না। বিজেপির দুর্নীতি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এসএসসি স্ক্যাম প্রসঙ্গে 'ওয়াশিং মেশিন'-এর প্রসঙ্গ ওঠা মানে নিজের দলের কলুষ বা দুর্নীতি স্বীকার করে নেওয়া। যতদূর মনে পড়ছে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করার দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি জানেন না টাকাপয়সার কথা। কিন্তু আরও বলেছিলেন, 'নিজের লোককে সবাই নেয়৷ কোন দল নিজের লোক নেয় না? আপনার একটা কোম্পানি থাকলে আপনি নিজের লোক নেবেন না?'

অর্থাৎ দুর্নীতির মতো স্বজনপোষণেরও স্বাভাবিকীকরণ হচ্ছে।

এসএসসি স্ক্যাম শুধু বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী নয়, বঞ্চিত শিশুদেরও অপরিসীম ক্ষতি করেছে৷ প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল চাকরি দেওয়ার নাম করে আখের গোছানো। তা করতে গিয়ে প্রথম দিকে নিযুক্ত হয়েছেন অযোগ্যরা। নেট মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ও সত্যতা যাচাই না করা একটি অডিও ক্লিপে স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার 'ফেল প্রার্থী'-দেরই চাকরি দেওয়া হচ্ছে, যার দর হাঁকানো হচ্ছে (হাই স্কুলের ক্ষেত্রে) কুড়ি লাখ৷ 'পাশ প্রার্থী'-দের পাঠানো হচ্ছে ওয়েটিং লিস্টে বা স্রেফ কোথাওই তাদের রাখা হচ্ছে না। অডিও ক্লিপের ভাষায় এই তথাকথিত 'ফেল প্রার্থীদের' হাতেই তাহলে আমরা আমাদের শিশুদের তুলে দিচ্ছি?

অতঃপর, কোর্টে যখন যোগ্যরা মামলা করেছেন, তখন নিয়োগ প্রক্রিয়াই গেছে  থমকে৷ নিয়োগ বন্ধ আর শিক্ষক বদলির যৌথ চাপে প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষক সংখ্যা যাচ্ছে কমে। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতে মারাত্মক অসংগতি দেখা যাচ্ছে৷ বদলি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। শিক্ষক যদি আঞ্চলিক হন, যদি স্কুল ও তার পরিপার্শ্বের সঙ্গে স্থায়ীভাবে সম্পৃক্ত হন, তবে নির্দিষ্ট সময়ে যাতায়াত করার চেয়ে সেটি বেশি মঙ্গলময় শিক্ষক ও স্কুল উভয়ের পক্ষে। কিন্তু শূন্যস্থান ভরাট করার জন্য দরকার ছিল নতুন নিয়োগও, যা আপাতত আদালতের আইনি জটিলতায় সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার এজন্য কোর্টকেসগুলিকে দায় করছে বটে, কিন্তু কোর্টকেস করার কারণ তৈরি করেছে তারাই।

আশি ও নব্বই-এর দশকে এবং তারও আগে স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটিকে ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়ার কথা শোনা যেত। এই ঝোঁক বাড়ল সরকারি শিক্ষকরা বেতন কাঠামোর আওতাভুক্ত হওয়ার পর, শাঁসালো চাকরির লোভে। অগত্যা, যোগ্য শিক্ষক বাছতে ও এইসব আঞ্চলিক দুর্নীতি কমাতে ১৯৯৭ সাল থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের যাত্রা শুরু হল। এটি ছিল সেসময় সবচেয়ে দ্রুত চাকরি পাওয়ার পরীক্ষা৷ ফর্ম ফিলাপ থেকে শুরু করে লিখিত, মৌখিক পরীক্ষার শেষে ফলপ্রকাশ ও নিয়োগ — সবটাই একবছরের মধ্যে হত এবং এই একই প্রক্রিয়া প্রতি বছরই চলত। কারণ প্রতিবিছরই শিক্ষকরা অবসর নেন, শূন্যপদ ভরাট করার প্রয়োজন পড়ে।

নতুন সরকার প্রথম এসএসসি পরীক্ষা আয়োজন করেন ২০১২ সালে। তারপর ২০১৬ সালে। অর্থাৎ, প্রথমত, দুটি পরীক্ষার মধ্যে সময়ের ব্যবধান বেড়ে যায়। দ্বিরীয়ত, দুর্নীতির অভিযোগ ও কোর্টকেসের ফলে যদি বা পরীক্ষা হয়, নিয়োগ আর হয় না৷ অথচ তা নিয়ে যখন ২৯ দিন ব্যাপী অনশন হয়, কিংবা আন্দোলন করেন টেট পরীক্ষার্থীরা, বা হবু প্রাইমারি শিক্ষকরা, তখন তাঁদের পাশে বৃহত্তর নাগরিক সমাজ দাঁড়ায় না। ওদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকহীনতায় ভুগতে থাকে ছাত্ররা। সামগ্রিক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোর বদলে গালমন্দ খেতে থাকে মুষ্টিমেয় কিছু 'ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার', এক্ষেত্রে শিক্ষকরা।

যখন মাটি খুঁড়ে কেঁচো উঠতে শুরু করল (কেউটে পর্যন্ত পৌঁছনো যায়নি বলেই ধারণা), তখন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর কুবেরের ধনে সাধারণ মানুষ 'চোখের জল, রক্ত, ঘাম' দেখছেন। তবে ঘুষ যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষকতার অযোগ্য বলে জানা গেছে আদালতে কেস চলাকালীন৷ ২৭০ জন প্রাইমারি শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন কোর্টের নির্দেশে৷ হাইস্কুল মিলিয়ে সংখ্যাটা, শোনা যাচ্ছে, ১২৫৯ জন। এঁদের হাতেই আমরা সন্তানদের তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছি। এঁদের নিয়োগের পিছনে পার্টি আনুগত্য-স্বজনপোষণ-টাকা সবই কাজ করেছে, বোঝা যাচ্ছে। এদের অন্যতম হলেন তৃণমূল বিধায়ক পরেশ অধিকারীর মেয়ে। কেউ শিক্ষক হওয়ার জন্য জমি বেচেছেন, পুঁজি ভেঙেছেন। এভাবে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এসএসসি মানদণ্ডেই কিছু অযোগ্য ব্যক্তি। আবার যাঁদের হয়ত যোগ্যতা ছিল পরিশ্রম ছিল পরীক্ষায় পাশ করার, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ দালাল ধরেছেন। এক ভাইরাল অডিও ক্লিপে শুনতে পাই, ওয়েটিং লিস্টে থাকা প্রার্থী দালালকে ফোন করছেন, আর দালাল বলছেন, 'অমুক দিন ফেল ক্যান্ডিডেটদের ছাড়া হবে। আপনি তো ওয়েটিং লিস্ট।' তারপর কুড়ি লাখ টাকা চাইছেন দালাল৷ যদি ক্লিপটি সত্য হয়, তবে সাদা খাতা জমা দিয়ে আসা বহু প্রার্থী আজ শিক্ষক, যখন কিনা ওয়েটিং লিস্টে থাকা প্রার্থী কুড়ি লাখ জোগাড়ে ব্যস্ত। সেই ওয়েটিং প্রার্থী শেষ পর্যন্ত টাকা জোগাড় করেছিল কীনা আমরা জানি না। কিন্তু সে যে বর্ণিত ফেল ক্যান্ডিডেটদের থেকে ভাল পরীক্ষা দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার মতো কেউ কেউ হয়ত পরিশ্রম করে উৎকোচ না দিয়েই চাকরি পেত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতির ফলে মুড়ি-মিছরির একই দর— কুড়ি লাখ। আবার যাঁরা যোগ্য এবং ঘুষ দেননি, সেই সংখ্যা বহু হাজার। তাঁরা শিক্ষক সংগঠনে ও ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীরা বর্তমান শিক্ষকদের কাছে আর্জি জানাচ্ছেন, অযোগ্যদের নাম তাঁদের কাছে জমা দিতে নিজ নিজ স্কুল থেকে।

একদিকে যখন দুর্নীতির এহেন নর্মালাইজেশন দেখতে পাচ্ছি, অন্যদিকে তেমনই আছে দুর্নীতির বাস্তুতন্ত্র বোঝার চেয়ে যৌন কেচ্ছায় মানুষের বেশি আগ্রহ। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গিনীদের সাজপোষাক-ভাইটাল স্ট্যাট- রূপের তুলনামূলক আলোচনা যত হচ্ছে, তাদের কৃত দুর্নীতি বা সামগ্রিক ভাবে দুর্নীতির আলোচনা তত হচ্ছে কই? মিম নিয়ে আপত্তি নেই৷ তা হতেই পারে অসহায় মানুষের একমাত্র জায়েজ প্রকাশভঙ্গি। কিন্তু সেই মিম দুর্নীতিতে যত না আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী শিক্ষামন্ত্রীর যৌন পারদর্শিতায়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এই লঘুকরণ স্বয়ং সরকারের ইচ্ছায় মিডিয়ার সহযোগিতায় ঘটছে কীনা৷

এর উপর আছে শিক্ষামন্ত্রীর সেই সঙ্গিনীদের স্লাট শেমিং। এমনকী চাকরিপ্রার্থীদের গ্রুপেও তার প্রাদুর্ভাব। চাকরিপ্রার্থী যেখানে নারীরাও, সেখানে দুর্নীতিবিরোধিতার এ কেমন পিতৃতান্ত্রিক ভাষা? দুর্নীতিগ্রস্ত নারীকে দুর্নীতিগ্রস্তই বলা হোক, বেশ্যা-টেশ্যা নয়, এটা কি খুব বেশি চাওয়া? স্লাট শেমিং কিন্তু যৌনকর্মীরও প্রাপ্য নয়, অপরাধী নারীরও নয়। বেশ্যাবৃত্তি শব্দটি পেশাপরিচয় হিসেবে চলতে পারে। কিন্তু 'বেশ্যা' শব্দটি খিস্তি হিসেবে পরিত্যাজ্য।

আবার ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া অযোগ্য শিক্ষকরা ধরা পড়তে শুরু করতেই 'কাকতালীয় ভাবে' বেড়ে গেছে শিক্ষক নিগ্রহ। এ হল সেই ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার'স ডাইলেমা। ডায়মন্ড হারবারে ইংরেজির মাস্টারমশাই মার খেলেন এক একাদশ শ্রেণির ছাত্রের কাছে, কারণ সে ইংরেজিতে ফেল করেছিল৷ মুর্শিদাবাদের এক শিক্ষক সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে বকাবকি করায় মার খেয়েছেন। আর, দক্ষিণ দিনাজপুরের এক শিক্ষিকার শাড়িটি খুলে নিয়েছে তাঁর এক ছাত্রীর পুরুষ অভিভাবক, স্টাফরুমে ঢুকে। যখন তার বিরোধিতা করা হল, শিক্ষক সংগঠনগুলি ডেপুটেশন পাঠালো, তখন শোনা গেল ভিক্টিমব্লেমিং। ওই শিক্ষিকাই কিছু করেননি তো? এ হল শিক্ষক জাতির প্রতি সামগ্রিক অবিশ্বাস, যা হয়ত ঘুষকাণ্ডের পরোক্ষ ফল৷ প্রশ্ন হল, এমন কী করে থাকতে পারেন কোনো শিক্ষিকা যার জন্য শাড়ি খুলে নেওয়া সঙ্গত? কোনোকিছুতেই ওই কাজ ন্যায্য হয় কি? এই শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে চাকরি পাননি কিন্তু! (পেলেও ওই কাজ ন্যায্য হত না)। এ'হেন শিক্ষকনিগ্রহ শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নতি ঘটাবে ভেবেই বোধহয় মিডিয়াও চুপ রইল। অবশ্য অভিযুক্তর বাড়িতে সেক্স টয়ের উল্লেখ যত রগরগে, পঞ্চাশোর্ধ শিক্ষিকার বস্ত্রহরণ ততটা নয়। একইভাবে 'অপা'র নামকরণ রহস্যোদ্ধার জনগণের জন্য যত জরুরি, তত জরুরি নয় শিশুদের জন্য সুশিক্ষকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

একান্ত অনন্যোপায় হয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রমুখরা অবস্থানকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। কিন্তু গোড়াতেই গলদ। শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল দলের সর্বোচ্চ স্তরের নেতা হতে পারেন, কিন্তু এই সরকারের কেউ নন। হবু শিক্ষকদের আশ্বাস দেওয়ার এক্তিয়ার তাই আছে শিক্ষামন্ত্রীর এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অভিষেকের সঙ্গে আলোচনায় ব্রাত্য বসুর উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি জানান যে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নয়, ব্রাত্য বাবু তৃণমূল দলের সহ সভাপতি হিসেবে অভিষেকের সঙ্গে ছিলেন।

তবে এই সাক্ষাৎ ঘিরে প্রশ্নগুলো বর্ষিত হোক সরকারের প্রতি। হবু শিক্ষকদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য 'বিশ্বাসঘাতক' দেগে দেওয়া অনুচিত বলেই নিবন্ধকার মনে করেন। চাকরিপ্রার্থীর আন্দোলন চাকরি পাওয়ার জন্য, সরকার বদলানোর জন্য। দ্বিতীয় কাজটিতে যদি সফল হওয়ার দায় অবস্থানকারীদের নয়, বা এই নির্দিষ্ট আন্দোলনের নয়। সে দায়িত্ব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির।

এসএসসি-র স্ক্যাম এক অদ্ভুত জটিল জট। এতগুলো পরীক্ষা— প্রাইমারি টেট, আপার প্রাইমারি টেট, নবম দশম এসএলএসটি, একাদশ দ্বাদশ এসএলএসটি এবং ফিজিকাল-ওয়ার্ক এডুকেশন টিচার এম্পলয়মেন্ট। পরীক্ষা হয়েছে আবার ২০১২ ও ২০১৬ তে। এই এতগুলো পরীক্ষায় এতরকম কারচুপি। তার জন্য এতগুলো কোর্টকেস। সরকারের ক্ষমতায় কুলোবে কি তুড়ি মেরে চাকরি দেওয়া? যদি সর্বোচ্চ সদিচ্ছা থাকে নিজেদের দলকে বাঁচানোর, তাহলেও খুব কঠিন এই জট ছাড়ানো। আর যত ছাড়ানোর চেষ্টা করবেন, ততই নিজেদের দুর্নীতি ধরা পড়বে।

অতএব শিশুর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি দেখে যাওয়া ছাড়া কী আমাদের গতি নেই? বলে রাখা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গে প্রাইমারি শিক্ষক আছেন সাড়ে তিন লক্ষর কিছু বেশি। হাই স্কুল শিক্ষক আছেন দেড় লক্ষের কাছাকাছি৷ এই মুহূর্তে শিক্ষকতার শূন্যপদ নাকি সত্তর হাজার। একটা কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় ধরা যাক শূন্যপদের দশগুণ প্রার্থী পরীক্ষা দেয়৷ আর পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা দশ কোটির কিছু বেশি৷ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ভুক্তভোগী কত? সাত লাখ? দশ লাখ? তারা মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ? তাদের সঙ্গে বর্তমান শিক্ষকদের জুড়লে সংখ্যাটা কী দাঁড়ায়? পাটিগণিত বলছে, তা মোট জনসংখ্যার এক থেকে দুই শতাংশ বড়জোর। অতএব বাকি আটানব্বই শতাংশ রসালো আলোচনাতে আর শিক্ষক নিগ্রহেই স্বচ্ছন্দ।

যারা স্টেকহোল্ডার, তারা আইনের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ কিন্তু মামলা লড়া আর আন্দোলন করায় তফাত আছে। আবার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আর মোবিলাইজেশনেও তফাত আছে। দুটো একজায়গায় হলে তবে আন্দোলন জোরদার হয়। স্টেকহোল্ডার, অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন করার লোক যখন কম,  তখন একটাই কঠিন পথ খোলা থাকে— ঘরে ঘরে গিয়ে বোঝানো যে বাচ্চাদের সর্বনাশ হচ্ছে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কৃত মোবিলাইজেশন তত প্রবল হচ্ছে কই? প্রতিকারের আগে যদি হউ প্রতিবাদ, তবে প্রতিবাদের আগে লাগে সচেতনতা। কালক্ষেপ না করে শিক্ষাক্ষেত্রের অন্ধকার সম্পর্কে গণ সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ কি শুরু করা যায়?