স্কুল শিক্ষার সমস্যা সমাধান নিয়ে দুচার কথা

কিছুদিন আগেই হৈচৈ শুরু হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক অকৃতকার্য ছাত্রী ‘আমব্রেলা’ বানান জানে না, অনুরূপ ছাত্র এইচ এস-এর সম্পূর্ণ কথাটা কী বলতে পারেনি বলে। সম্প্রতি বিহারে একজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহজ ইংরেজি জানেন না, এরাজ্যে একজন প্রাথমিক শিক্ষককে অভিভাবকরা বিয়োগ অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন, তিনি পারেননি। ফলে সব মিলিয়ে শিক্ষার হাল যে খারাপ তা জানা গিয়েছে। ওদিকে শিক্ষার অধিকার আইনে  অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সকলকেই পরবর্তি শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার নীতির ফলেই দেশে শিক্ষা গোল্লায় গিয়েছে এতো অতি চর্চিত ব্যাখ্যান। এরাজ্যে প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার ফলও নাকি বিষময় হয়েছে।  এরাজ্যে তো শিক্ষক নিয়োগে অবারিত দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে। আলোচনাও চলছে যে ওই নিয়োগ দুর্নীতির ফলেই শিক্ষা গোল্লায় যাচ্ছে। কিন্তু যে ছাত্রীছাত্র এখন আমব্রেলা বানান বা  এইচএস এর পুরো কথা জানে না তারা তো ২০১৬-১৭-১৮ সালের নিয়োগ দুর্নীতির আগে নিযুক্ত শিক্ষকদের কাছেই পড়াশোনা করেছে। তাহলে নীতিনিষ্ঠ নিয়োগ পদ্ধতিতে নিযুক্ত শিক্ষকেরাও যথাযথ শেখাতে পারেননি। সব মিলিয়ে শিক্ষার পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন, অন্তত এরাজ্যে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, দ্বিমত রয়েছে কবে থেকে শিক্ষায় এই পতন শুরু হয়েছে তা নিয়ে। তেমন কোনো পরিসংখ্যান ব্যবহার না করে কয়েকটি টুকরো টুকরো নিবন্ধে চেষ্টা করা হবে শিক্ষার সমস্যাকে ধরতে ও সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করতে।

যারা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত তাদের একটা আক্ষেপ বা ছুতো রয়েছে যে, যারা পাঠগ্রহণ করতে আসে তাদের অনেকেই নির্দিষ্ট শ্রেণিতে পঠনের উপযুক্ত নয়। তাই তাদের শেখানো যায় না। যেহেতু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘নো ডিটেনশন’, এবং আগের শ্রেণিতে তারা শেখার ‘অযোগ্য’ তাই প্রায় কিছু না শিখেই তারা অষ্টম শ্রেণিতে উঠে যায়। তারপরে অনুর্ত্তীর্ণ হয়ে পড়া ছেড়ে দেয়, বা বিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে পরবর্তী শ্রেণিগুলিতে উঠে যায়, মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত। যাঁরা প্রথম শ্রেণি থেকে ফেল চালু করার পক্ষে তাঁরা কয়েকটি খুঁটিনাটি বিষয় ভুলে যান। প্রথমত, প্রথম শ্রেণিতে তো কোনো ছাত্ররই কিছু না শিখে এসে একদম নতুন করে শুরু করার কথা, তাহলে তারা কেন সেই প্রথম শ্রেণি বা শুরুর শ্রেণিতে কিছু শিখল না বা যথাযথ শিখল না? ওই শুরুতে না শেখার দায় কার? অবশ্যই সে দায় ছাত্রীছাত্র বা তার অভিভাবকদের হতে পারে না। কোনো দায়বদ্ধ সমাজেই বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বাড়িতে নিতে দেওয়া হয় না। বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই সম্পূর্ণ করা দস্তুর। ওই শিক্ষা সমাপনের জন্য যতটা সময় প্রয়োজন ততক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হবে, এবং অন্যদিকে সেই শিক্ষাদানের সময় সাপেক্ষে পাঠক্রম তৈরি হবে। যদি তেমনটা হত এরাজ্যে ও দেশে তাহলে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠা ছাত্রীছাত্ররা যথাযথ শিখেই উঠত। এভাবেই এগোত বিষয়টি। ফলে ফেল করানো বিষয়টি আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার যাঁরা চালক, পাঠক্রম নির্মাতা, বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের সময় ও শ্রেণিতে ছাত্রীছাত্র সংখ্যা নির্ধারণকারী ও  শিক্ষক তাদের অদক্ষতা প্রসূত ভাবনা থেকে আসে। তার থেকেই ‘সমালোচনা’ করা হয় ‘শিক্ষা গ্রহণ অযোগ্য’ ‘ফার্স্টজেনারেশন লার্নার’দের। শোনা যায়, বাবা মা নিরক্ষর বা অশিক্ষিত তাই বাড়িতে কিছু শেখে না, ফলে কিছুই পারে না। ছাত্রীছাত্রদের যে বাড়িতে শেখার কথা নয়, বিদ্যালয়েই শেখার কথা সেটা খেয়াল থাকে না। অন্যদিকে বিদ্যালয়ে শেখা সম্পূর্ণ হয় না বলে বাড়িতে পড়ানো বা প্রাইভেট ট্যুইশন শুরু হয়। প্রকারান্তরে শিক্ষার বেসরকারিকরণ ঘটে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি ছাত্রীছাত্রদের ফেল করানোর পক্ষে থাকা শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ামক-সমালোচকদের মাথায় থাকে না যে, যদি বিপুল সংখ্যক ছাত্রীছাত্র ফেল করত, না শেখার ফলে, তাহলে বিদ্যালয়গুলির শ্রেণিকক্ষে একধরণের ব্যাপক স্থান বৈষম্য সৃষ্টি হত। মনে রাখা দরকার, প্রথম শ্রেণিতে অনেকে অকৃতকার্য হলে পরবর্তী বছরে দ্বিতীয় শ্রেণি অনেকটাই ফাঁকা থাকবে ও প্রথম শ্রেণিতে স্থান সঙ্কুলান হবে না। তাই বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে সুষ্ঠভাবে চালাতে গেলে অনুর্ত্তীর্ণ রাখা কেবল ব্যতিক্রম হিসেবে থাকতে পারে।

দেশে বা রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগে বৈষম্য, কত শতাংশ বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় পাশ করল, আইআইটির প্রবেশিকা পরীক্ষায় কোন রাজ্য থেকে কে প্রথম হল, কতজন উত্তীর্ণ হল, আইআইএম বা আইআইটির ছাত্রীছাত্ররা কত উচ্চ বেতনের চাকুরি পেল এসব নিয়ে যত আলোচনা প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায় তার বিন্দুমাত্রও শিক্ষার গুণগত মান বিষয়ে আলাপ আলোচনায় দেখা যায় না। ‘প্রথম’য়ের মত দুএকটি অসরকারি সংস্থা বিদ্যালয় শিক্ষার হাল নিয়ে সমীক্ষা করে, কিন্তু কীভাবে ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সকল শিশুর জন্য সমমান ও গুণমানযুক্ত বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা যেতে পারে তা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা সরকারিস্তরে চোখে পড়ে না। যেধরণের নতুন নতুন শিক্ষানীতিই আসুক না কেন গ্রামের শিশু ও শহরের শিশুদের মধ্যে, ধনী পরিবারের শিশু ও গরীব পরিবারের শিশুদের মধ্যে, ইংরেজি মাধ্যম ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে বিপুল পার্থক্যকে মিটিয়ে দেওয়ার কোনো অন্তর্বস্তুই তাতে থাকে না। শিক্ষক সংগঠনগুলিও মূলত: তাঁদের পেশাগত দাবীদাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষাকে সুসংহত ও পরিপূর্ণ করে তোলার কোনো আন্তরিক এজেন্ডা সেখানে থাকে না। ফলে ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষার গুণগত ফারাক ক্রমাগত বাড়তে থাকে, শ্রেণি বিভক্ত সমাজে বিভাজনটিও পোক্ত হয়।

সর্বজনীন সমমানের শিক্ষার উপায়

শিক্ষক নিয়োগ, পাঠক্রম তৈরি, শিক্ষণ প্রণালী,  বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো, ছাত্রীছাত্রদের উপস্থিতি,  শিক্ষক-ছাত্রীছাত্র যোগাযোগ, ছাত্রীছাত্রদের মূল্যায়ন এই সমস্ত মিলিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষাকে সামগ্রিকে দেখার ভাবনা তৈরি করা দরকার। তেমনটা কী হয়? পাঠক্রম তো বহুলাংশেই রাজনীতিপ্রসূত। কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলো ও তাদের সমাজ সম্পর্কে ভাবনা কতটা উদার, বৈজ্ঞানিক অথবা রক্ষণশীল ও মৌলবাদি তার উপরে তো পাঠক্রম নির্ভর করেই থাকে। এছাড়াও সব ছাত্র সমগুণমানের শিক্ষা পাবে কিনা বা তারা সকলে তেমন শিক্ষা পাওযার যোগ্য কিনা সেটিও নির্ভর করে সমাজ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপরে। এদেশের বা রাজ্যের শিক্ষা প্রশাসক তথা এতাবতকাল পর্যন্ত শাসক রাজনৈতিক দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গীই ছিল যে দরিদ্র সাধারণ পরিবারের ছাত্রীছাত্রদের কেবল  বিদ্যালয়ে হাজির করাতে হবে, সাক্ষর করে তুলতে হবে। ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মিড ডে মিল ও পরবর্তীতে শিক্ষার অধিকার আইনের সুবাদে  ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে বিদ্যালয়ে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়, একই সঙ্গে শিক্ষার অধিকার আইন মেনে ছাত্রীছাত্রদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ফেল না করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাস, ওই বিদ্যালয়ে আনা, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ধরে রাখা, ও দুপুরে যেমন তেমন পেট ভরার মত খেতে দেওয়া- দায়সারা হল সরকারের। লক্ষণীয় যে, প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সরকার সকলেই যে তেমনটাই মনে করে তা প্রকাশ পায় যখন কোনো অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রী বা ছাত্র তেমন কোনো খুব ভালো ফল করে, প্রচার মাধ্যম বা সরকার তাকে খুব ফলাও করে বলতে থাকে। যদিও অর্থ করা হয় যে, ওই ছাত্রী বা ছাত্র সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে ভালো ফল করেছে। কিন্তু এটাও মেনে নেওয়া হয় যে, সকলের জন্য সমগুণমানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়নি, এবং তেমনটা করার প্রয়োজনও নেই কারণ যেটি আছে তাতেই ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ভালো ফল করতে পারে।

বিদ্যালয় স্তরে সরকারি বিদ্যালয়ে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রাথমিকে টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ডিএলইড পাশ করতে হবে। ডিএলইড পড়ার ন্যূনতম যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল্য পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ (বিশেষ ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ছাড় আছে) পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকতার জন্য ন্যূনতম বিএড পাশ করতে হবে ও বিএড পড়ার জন্য স্নাতকে ৫০ শতাংশ (এক্ষেত্রেও ছাড় আছে) পেতে হবে। এই যে বিএড, ডিএলইড, পূর্বে পিটিটিআই উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যিক করা হোল, যা আগে ছিল না, তার ফলে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার কী উন্নতি হল তা যাচাই করা হয়েছে কখনো? যদি তেমন কোনো উন্নতি না হয়ে থাকে তাহলে ওই সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হল কেন? কেনই বা দেশের তথা রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সদর ও মফস্বল শহরে গাদা গাদা বিএড ডিএলইড পড়ানোর বেসরকারি (বানিজ্যিক?)  প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে গেল? প্রকাশ্যে ওই কোর্সগুলি পড়ার খরচ দু বছরে ২ লক্ষ টাকা বা তার বেশি। পিছনের দরজায় কত দিতে হয় কে জানে! ফলে, যে সমস্ত সাধারণ ঘরের স্নাতক স্নাতকোত্তর ছাত্রীছাত্ররা শিক্ষকতার পরীক্ষা দিয়ে চাকুরিতে নিযুক্ত হচ্ছিলেন তাঁদের পক্ষে সেটা অসুবিধেজনক হযে গেল। অন্যদিকে ওই সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির রমরমা শুরু হল। ওগুলির অনুমোদনের জন্য শাসক দলের মন্ত্রীশান্ত্রীরা ‘অনুদান’ও পেলেন। যে অর্থের একাংশ  হয়তো বা সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া ২০-২২ কোটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

বিদ্যালয়স্তরে শিক্ষক নিয়োগের শুরুতেই যে যোগ্যতার বিধিনিষেধ শুরু করা হয়েছে, কেবল এরাজ্যে নয়, সারা দেশে, উৎসুক ছাত্রীছাত্রদের এক বড় অংশই তার ফলে শিক্ষকতা করার জন্য পাথেয় যোগাড় করতে না পেরে সরে পড়ছে। যারা থাকছে তাদের বৃহদাংশ অর্থের বিনিময়ে যোগ্যতা অর্জন থেকে শুরু করে টেট-এসএলএসটি পাশ করা ও চাকুরি পাওয়ার জন্য  অর্থ প্রদান করতে রাজী হয়ে যাচ্ছে। কেবল নিয়োগই নয়, তার পরে নিজের সুবিধেমত জায়গায় পোস্টিং পেতে বা বদলি হতেও টাকা হাত ফিরছে।

শিক্ষক নিয়োগের প্রাক শর্ত হওয়া উচিৎ যে বিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য নিজ পছন্দের সুযোগকে কর্মপ্রার্থী ব্যবহার করবেন সেখানেই তিনি শিক্ষকতা করবেন আন্তরিকতার সঙ্গে। সরকারকে ওই শিক্ষিকা বা শিক্ষকের বিদ্যালয়ের অনতিদূরে থাকার যথাযোগ্য বন্দোবস্ত করতে হবে, অবশ্যই তার জন্য কোনো প্রাপ্য বেতন বা সুবিধের কাটছাট করা চলবে না। নিয়োজিত শিক্ষককেও দায়বদ্ধ হতে হবে যে বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষেই পাঠক্রমকে ছাত্রীছাত্রদের সম্পূর্ণ অনুধাবন করানোর। পাঠক্রম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা সর্বোচ্চ হতে হবে। রাজ্য তথা দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়নের বিষয়েও একদম সর্বনিম্ন শ্রেণির থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সব শ্রেণির শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ও সার্বিক ক্ষমতা দিতে হবে। এমনভাবে পাঠক্রম তৈরি করা দরকার যাতে একটি শ্রেণির জন্য বন্টিত পাঠক্রম সেই শ্রেণিতে পাঠরত সকল ছাত্রীছাত্রদের বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই  সম্পূর্ণ শেখাতে শিক্ষকরা  সমর্থ হন। ওই পাঠক্রমের সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের সময ও শ্রেণিকক্ষ পিছু ছাত্রীছাত্র সংখ্যা ও শিক্ষিকা শিক্ষক সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। মোদ্দা কথা পড়ুয়ারা পড়বে শিখবে লিখবে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে, বাড়িতে কোনো পড়াশোনার দরকার পড়বে না। সর্বনিম্ন শ্রেণি থেকে প্রথমে এমনটাই শুরু করতে হবে ও সেই শ্রেণির শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের দায় বদ্ধ করতে হবে যাতে সব ছাত্রীছাত্র যথাযথ শেখে। পরবর্তী বছরে অনুরূপে পরবর্তী শ্রেণির শিক্ষিকা শিক্ষকদের অনুরূপ দায়িত্ব নিতে হবে। এই ভাবে ১০-১২ বছর পরে সকল শ্রেণির পড়ুয়ারাই যথাযথ শিখে  বিদ্যালয়ের দরজা পার করবে। পড়ুয়াদের না শেখার দায় শিক্ষিকা শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনকেই নিতে হবে। অনেকেই, বিশেষত শিক্ষকগণ বলবেন যে, এমন দায় তাঁরা নেবেন কেন, যেখানে উপযুক্ত শিক্ষা পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত নেই। আগেই বলেছি, পাঠক্রম তৈরির অধিকার ও দায় মূলত: শিক্ষকদের, উপযুক্ত পরিকাঠামো যোগানের দায় সরকারের, পাওয়ার অধিকার পড়ুয়া ও শিক্ষকদের। ওই পরিকাঠামোর জন্য সরকারকে দায়ী করানোর অধিকার ও দায়িত্ব জনগণের।

উপরের অনুচ্ছেদে যা লেখা হয়েছে তা আজকের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অবাস্তব ও অনেকের কাছে অনাকাঙ্খিত ঠেকছে। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই কেবল শিশু কিশোররা লেখাপড়া করে সব শিখবে এমনটা ভাবাই যায় না। গৃহশিক্ষক বা কোচিং ব্যতিরেকে পড়াশোনাও অবাস্তব শোনায়। এদেশে সব থেকে ‘বুদ্ধিমান’ ছাত্রীছাত্র বলে পরিগণিত আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্য পড়ুয়াদের কোচিং না নিলে চলে না। তার জন্য ফিটজি, আকাশ, সুপার থার্টি সমেত কোটার মত গোটা একটা শহর ‘করে খাচ্ছে’। ফলে আমাদের মত অর্বাচীনরা শ্রেণিকক্ষে পড়া শেষ করার কথা বললে শুনবে কে? তবুও বলতে হবে কারণ সেটাই হতে পারে একমাত্র সার্বজনীন সমমানের শিক্ষার পথ।

সর্বজনীন সমমানের শিক্ষা - প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর, ধনী-নির্ধন সকল পড়ুয়াকে সমভাবে দেখা না দেখার

শহরগুলির, বিশেষত কলকাতা, হাওড়া, শিলিগুড়ি, আসানসোল, দুর্গাপুরের মত শহরগুলির বিদ্যালয়গুলির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে (যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সরকার বেতন দেয় এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন বা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমে নিয়োগ করে) পড়ুযাদের সংখ্যা কমছে। বহু বিদ্যালয় পড়ুয়াদের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির অধিকাংশেই পড়ার জন্য আকুতি বাড়ছে, বহু পড়ুয়া ভর্তি হতে গিয়ে নিরাশ হচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়াদের বেতন নেই, অন্যান্য খরচও কম, শিক্ষিকা শিক্ষকরাও বহুবিধ যাচাইএর মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত হয়ে নিযুক্ত হন, তাঁদের বেতন ও অবসরের পরে পেনশন সরকার নির্ধারিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী হয়। বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বেতন  অনেক গুণ বেশি, সাথে অন্যান্য খরচও প্রচুর, শিক্ষিকা শিক্ষকরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পছন্দমত নিযুক্ত হন, তাঁদের বেতন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বেতনক্রম মেনে হয না, অবসরের পরে কোথাও কোথাও পেনশন পাওয়া গেলেও তা সরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় নগণ্য। এছাড়া, যত দামি বিদ্যালয় তত বেশি খরচ প্রাইভেট ট্যুইশনের জন্য। বোঝা যায় না, নাম করা বেসরকারি বিদ্যালয়ে কী এমন ভালো পঠনপাঠন হয় যে, বেশি খরচের প্রাইভেট ট্যুইশন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

যাই হোক, উপরের অনুচ্ছেদে কখনো বাণিজ্যিক বিদ্যালয় লেখা হয়নি, সচেতনভাবেই হয়নি। কারণ, আমাদের দেশে মুনাফার জন্য বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যায় না। কিন্তু সকলেই জানে যে, ওই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই মুনাফা করে থাকে। সাধারণত, সোসাইটি বা ট্রাস্টের দ্বারা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলা হয়, যে সোসাইটি বা ট্রাস্ট কোনো কোম্পানির দ্বারা গঠিত হয়। কোম্পানি প্রতিষ্টানগুলির সম্পত্তির মালিক হয়, ও সেগুলি ব্যবহারের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে ও মুনাফা করে। ফলে ঘুরপথে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই বিদ্যালয়গুলি খোলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। যে পরিমাণ অর্থ নগদে দেখা গেছে তার কয়েকগুণ নিশ্চয়ই এখনো লুকোনো আছে, যা ভবিষ্যতে দেখা যেতেও পারে নাও পারে। লক্ষ্যণীয় ‘উন্নত’ শিক্ষা প্রদানকারী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গঠনের মধ্যেই লুকোছাপা রয়েছে। সেগুলি ‘মুনাফার জন্য নয়’, কিন্তু মোটা অঙ্কের বেতন পড়ুয়াদের কাছ থেকে নেয়। মুনাফাও করে। ফলে, অনুমোদন পাওয়ার জন্য ক্ষমতাবান ‘শিক্ষামন্ত্রী’ কে খুশি করা তাঁদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

বহুদিন ধরেই শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা শুনে আসছি আমরা। শিগ্গিরি আমরা না কি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হব। এখন তা ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলে শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ ১৯,২০০ কোটি ডলার বা ১৫, ৩৬, ০০০ কোটি টাকা। হচ্ছে তার অর্ধেকেরও কম, ৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে  পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ভিত্তিক আভ্যন্তরীণ উৎপন্নের পরিমাণ ১৫.১১ লক্ষ কোটি টাকা। ৬ শতাংশ হিসেবে শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ ৯১ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালের সংশোধিত হিসেব অনুসারে ব্যয় করা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, ৪৩ শতাংশের মত।  কেবল তুলনার জন্য চিনের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিমাণকে দেখা যেতে পারে। চিনে শিক্ষা খাতে ২০২১ সালে  সরকারি ব্যয় হয়েছিল ৩.৭৬ ট্রিলিয়ন য়ুয়ান, যা ৪৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। চিনের জনসংখ্যা ভারতের থেকে সামান্যই বেশি। ফলে চিনে মাথা পিছু শিক্ষা খাতে ব্যয় ভারতের থেকে ৬ গুণের বেশি। পশ্চিমী দেশগুলির মাথাপিছু ব্যয়ের কথা বলে নিজেদের লজ্জা না দেওয়াই ভালো। এই পরিসংখ্যান থেকে এদেশে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাই যাচ্ছে।

চিনের মত যদি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে বাধ্য করা যেত শিক্ষা খাতে অনুরূপ ব্যয় করত তাহলে দেশের সর্বসাধারণের শিক্ষার মান কত ভালো হতে পারত। অতটা না ভেবে যদি জিডিপির ৬ শতাংশ হিসেবে ওই ব্যয় ১৫ লক্ষ কোটি টাকাও হত, তাহলেও অন্তত গ্রাম শহরের সাধারণ বিত্তের বা গরিব ঘরের পড়ুয়াদের উন্নত শিক্ষার পরিকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হত। কেবল তাই নয়, চিনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বার্ষিক বেতন গড়ে ১৭৭ হাজার চিনা য়ুয়ান যা ভারতীয় টাকার অঙ্কে  প্রায় ২১ লক্ষ টাকা। সামগ্রিক শিক্ষকদের গড় বেতন ভারতীয় টাকার অঙ্কে ৩০ লক্ষ টাকা। গড় বেতনের দিক দিয়ে এদেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা চিনের তুলনায় ৯ ভাগের ১ ভাগ পেয়ে থাকেন। কেবল তাই নয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনের ক্ষেত্রে ভারতীয় শিক্ষকদের গড় বেতন প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনায় ৬ গুণ, চিনে তা আড়াইগুণ। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেতন বৈষম্যও কম।

যদি এদেশে ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সবার জন্য সমমানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করার আন্তরিক ইচ্ছে সরকারগুলির থাকে, তাহলে যা করা দরকার

১. পুরো বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারি করা সর্বোত্তম উপায়। যদি তা না করা যায়, তাহলেও সরকারি বিদ্যালয়ে শ্রেণি কক্ষেই পাঠক্রমকে সমাপ্ত ও কেবল শ্রেণিকক্ষেই পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করে সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে সর্বোত্তম করে তুলতে হবে।  অবশ্যই পড়ুয়া শিশুদের নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা আবশ্যিক করতে হবে। কোনোমতেই সরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে অভিভাবকরা বাছাবাছি করতে পারবেন না।

২. কেবল মিড ডে মিলের মত যেনতেন প্রকারের খাবার নয়, সকল পড়ুয়াকে বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সুস্বাদু বৈচিত্রপূর্ণ আকর্ষণীয় কিন্তু স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার দিতে হবে।

৩. আগেই বলেছি, পাঠক্রম তৈরির বিষয়ে শিক্ষকদের গুরুত্ব সর্বোচ্চ, তদনুসারে পাঠক্রম তৈরি করতে হবে। এবং শিক্ষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকাঠামো যোগান দিতে হবে সরকারকে। উপযুক্ত বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার,প্রসাধন কক্ষ, শৌচাগার,  কম্পুটার, যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের সীমা মেনে চলা-এসবই পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত

৪. সকল শিক্ষক শিক্ষিকাকেই বিদ্যালয়ের সন্নিকটে থাকার সুচারু বন্দোবস্ত করতে হবে সরকারকে। কেবল শিক্ষিকা-শিক্ষকের প্রয়োজনে বা তাগিদে বিদ্যালয় পরিবর্তন চলবে না।

৫. শিক্ষিকা-শিক্ষকদের দায়িত্বশীল করতে হবে শ্রেণিকক্ষেই পাঠ সমাপন করাতে।

৬. শিক্ষিকা-শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্বিক স্বচ্ছতা রাখতে হবে। তাছাড়া নিয়োগের সময়ে শিক্ষিকা-শিক্ষকদের ওয়াকিবহাল করতে হবে যে, শ্রেণিকক্ষের সমস্ত পড়ুয়াদের সর্বোত্তম শিক্ষণের দায়িত্ব তাঁদের।

৭. শিক্ষিকা-শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য সংগঠিত ক্ষেত্রের সমস্তরের কর্মীদের মধ্যে ও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষিকা-শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে।

৭. সর্বোপরি সরকারি শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক কিন্তু সর্বোচ্চ মানের হতে হবে।

অবশ্যই এসব করতে সরকারকে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষাখাতে  জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করলে সেই ব্যয়ের অনেকটাই করা সম্ভব। জিডিপি নিরপেক্ষ ভাবে সকলের জন্য উন্নত সর্বোচ্চমানের শিক্ষাকে যদি সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার  দেয়, তাহলে সেই অনুযায়ী শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে।

আসলে প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর, ধনী-নির্ধন সকল পড়ুয়াকে সমভাবে দেখা না দেখার।