জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ - প্রসঙ্গ গবেষণা

গবেষণা সর্বব্যাপি। গবেষণার ফলে যে কোন বিষয়েরই মান উন্নত হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিসাধক প্রতিটি শাখাতেই গবেষণার প্রয়োজন আছে। এই প্রবন্ধে শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষণার ওপর আমরা দৃষ্টি আবদ্ধ রাখব। শিক্ষা ও গবেষণা একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যখন কোনও নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়, তখন দেশের ভবিষ্যৎ গবেষণার ওপর তার প্রভাব এসে পড়বেই। কেন্দ্রীয় সরকার "জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০" (যাকে এই প্রবন্ধে জাশি২০ নামে অভিহিত করা হবে) গ্রহণ করার পর দেশের গবেষণার অভিমুখ কোন দিকে যাবে, সে বিষয়ে সবার অবহিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। বর্তমান প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য এই বিষয়টি খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার যে ২০২০ সালের শেষের দিকে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি বিভাগ (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ বা Department of Science and Technology বা DST) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নবপ্রবর্তনের কর্মসূচির একটি খসড়া নীতি প্রকাশ করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে Science, Technology and Innovation Policy বা STIP Policy document version 1.4। এই খসড়া নীতিকে বর্তমান প্রবন্ধে বিপ্র২০ নামে অভিহিত করা হবে। দেখা যাচ্ছে বিপ্র২০-এর গোড়াতেই (৭ নং পাতার ৪ নম্বরে) বলা হয়েছে এই খসড়া নীতি জাশি২০-এর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে। “STIP fully endorses the new National Education Policy (NEP) 2020, and wishes to ensure synergetic efforts of both policies towards this goal.” বোধ হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা নীতি বিশদে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনবোধে তাকে মূল শিক্ষানীতির সাথে জুড়ে না দিয়ে একটি পৃথক নীতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে গবেষণার ওপর আলোচনা তাই দুই ভাগে বিভক্ত করা হবে। প্রথম ভাগে দেখানোর চেষ্টা করব জাশি২০-তে বিজ্ঞান গবেষণাকে কি ভাবে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে বিপ্র২০-এর প্রস্তাবিত নীতিগুলি বোঝার চেষ্টা করব।

প্রথম ভাগঃ জাশি২০

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান

"জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০"র ৬৬ পাতার দলিলে ৬৫ বার বিজ্ঞানের (science) উল্লেখ আছে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক মেজাজ (scientific temper) বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির (scientific method) উল্লেখ আছে প্রায় ১৫ বার। কাজেই জাশি২০-এর প্রণেতারা দলিল লেখার সময় বিজ্ঞানকে অবহেলা করেছেন এমন অভিযোগ আনা যায় না। এবার দেখা যাক শিক্ষানীতির কোন্ কোন্ জায়গায় তারা বৈজ্ঞানিক মেজাজের অবতারণা করেছেন।

(১) শুরুতে Introduction-এ ৪ নং পাতার একেবারে শেষে বলা হয়েছে "শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল এমন মানুষ তৈরি করা যারা যুক্তিবাদী চিন্তা করবে, অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, সাহসী ও কর্মঠ হবে ও বৈজ্ঞানিক মেজাজের মাধ্যমে সৃষ্টিধর্মী চিন্তায় মনোযোগী হবে।"

(২) ৫ নং পাতায় বুলেট পয়েন্ট দিয়ে যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার মূল নীতিগুলি বলা আছে, সেখানে ethics-এর বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আবার বৈজ্ঞানিক মেজাজের কথা বলা হয়েছে।

(৩) ১৫ নং পাতায় ৪.২৩ ধারায় ছাত্রদের কি কি গুণ অভ্যাস করা উচিৎ তার একটা তালিকায় বৈজ্ঞানিক মেজাজ, প্রামাণিক তথ্য অনুযায়ী চিন্তা করা, সৃষ্টিধর্মী কাজের মাধ্যমে নতুনের প্রবর্তন করা ইত্যাদি সংযোজিত আছে।

(৪) ১৬ নং পাতায় ৪.২৯ ধারাতে বলা হয়েছে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনবোধও যেন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপ্রণালী প্রণয়নের সময় খেয়াল রাখা হয়।

(৫) ৩৪ নং পাতায় ৯.১.১ ধারাতে নির্দেশ আছে বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা ইত্যাদি বিষয় নির্বিশেষে একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষিতে এমন পাঠক্রম তৈরি করা উচিৎ, যা শিক্ষার্থীকে বৌদ্ধিক অনুসন্ধিৎসা, বৈজ্ঞানিক মেজাজ ও সৃষ্টির প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করে।

(৬) ৩৭ নং পাতায় ১১.৮ ধারায় সত্য, ধর্ম, প্রেম, অহিংসা এবং বৈজ্ঞানিক মেজাজের গুণগুলি যেন শিক্ষাব্যবস্থায় থাকে সেই বিষয়ে অবহিত করানো হয়েছে।

(৭) ৪৬ নং পাতায় ১৭.৮ ধারাতে শিক্ষায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

(৮) ৫৪ নং পাতায় ২২.১২ ধারা অনুযায়ী ছাত্রদের ভারতবর্ষের ১০০টি গন্তব্যস্থলে গিয়ে সেই স্থানগুলির ইতিহাস, প্রাচীনত্ব, বৈজ্ঞানিক অবদান ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু স্থানে বৈজ্ঞানিক মেজাজ, পদ্ধতি ও চিন্তাধারার উল্লেখ করা হয়েছে, তবে সেগুলি সবই সংস্কৃত ভাষার ওপর আলোচনার সময়। যেমন বলা আছে ভারতের সব ভাষাতেই সাহিত্য বিশাল এবং বিজ্ঞানসম্মত (৪.১৫), কারণ, এগুলি সবই সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত (৪.১৬)। সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার এত বিশাল যে ল্যাটিন এবং গ্রীক সাহিত্য একত্র করলেও তার ধারে কাছে পৌঁছাতে পারবে না (৪.১৭)। (এই তথ্যের সমর্থন তারা কোথায় পেয়েছেন, সেই বিষয়ে একটু বিশদ আলোচনা থাকলে ভাল হত।) এই জ্ঞানভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই জ্ঞানভাণ্ডারকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে(৪.২৭)। যেহেতু সংস্কৃত একটি বিজ্ঞানসম্মত ভাষা, কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূলধারার সাথে একে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে দিতে হবে। এই ভাষা উচ্চশিক্ষাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং তৃতীয় ভাষা হিসাবেও পড়ানো যেতে পারে (২২.১৫)। মোটামুটিভাবে জাশি২০তে যে সমস্ত স্থানে বৈজ্ঞানিক চেতনা, পদ্ধতি বা মানসিকতার কথা বলা হয়েছে, সেগুলি সবই ওপরের তালিকায় আছে। এর বাইরে নেই, কিংবা থাকলেও একই ধরণের প্রেক্ষিতে সেগুলির অবতারণা করা হয়েছে। বক্তব্য হল সংস্কৃত ভাষা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ভাষা কিনা আর কেনই বা তাকে এই বিশেষণ দেওয়া হয়েছে সেই সম্বন্ধে শিক্ষানীতিতে কোথাও কোন আলোচনা নেই। কাজেই আমাদের মত অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের এই দুরূহ তত্ত্ব বুঝে ওঠা বেশ কঠিন। সাধারণ বুদ্ধি থেকে বলতে পারি যে ভাষা একটা নিজস্ব প্রবাহে সৃষ্ট হয়। কেউ তার মেধা ও নৈপুণ্যের সাহায্যে একে বিশ্লেষণ করতে পারেন, একটা সুষ্ঠু ব্যাকরণ তৈরি করতে পারেন, কিন্তু ভাষা সৃষ্টি করতে পারেন না। একটি ভাষা বিজ্ঞানসম্মতভাবে বানানো হয়েছে, আর অন্য আর একটি ভাষা অবৈজ্ঞানিকভাবে সৃষ্ট হয়েছে এই ধরণের বক্তব্য আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে অযৌক্তিক বলেই মনে হয়। সেজন্য বলি ওপরের দুটি অনুচ্ছেদের মধ্যে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তুর সাথে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক নেই। এবার প্রথম অনুচ্ছেদের দিকে লক্ষ্য করা যাক। দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান মানসিকতার কথা একমাত্র একটি পটভূমিকাতেই উল্লেখিত হয়েছে। সেই একক প্রেক্ষিত হল শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠক্রম এমনভাবে গঠন করা দরকার যাতে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান চেতনা আরও প্রবল হয়। কথাটা খারাপ নয় বা তা কেউ অস্বীকার করতেও যাচ্ছে না। যখন কোনও চর্বিতচর্বন উক্তিকে খুব গুরুত্বের ঢং দিয়ে প্রকাশ করা হয়, তাকে ইংরাজিতে বলা হয় platitude। এখানেও যদি একবার বা দুবার platitude থাকত, তাহলে চলে যেত, কিন্তু পনের বার একই কথা শুনতে হলে বেশ বিরক্তিকর লাগে। মোট কথা 'বিজ্ঞান' ৬৫ বার উল্লেখিত হলেও জাশি২০তে বিজ্ঞান শিক্ষা কিভাবে হবে বা বিজ্ঞানের প্রসার কিভাবে ঘটবে, এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি মোটেই আলোচনার মধ্যে আসে নি। ৬৬ পাতার এই দলিলে খুব বেশী হলে এক থেকে দেড় পাতা (১৭ নং ধারা) গবেষণার ওপর ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও শুধুমাত্র বিরক্তিকর একই platitude। তবে ১৭.৩ ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া আছে। বলা হয়েছে যে ভারতে শিক্ষায় ব্যয় হয় GDP-এর ০.৭ শতাংশ, যেখানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে GDP-এর ২.৮ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করা হয়। ঈস্রায়েলে এই ব্যয়ের হার ৪.৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪.২ শতাংশ। ভারতে বহুদিন ধরে শিক্ষার বাজেট হত GDP-এর ১ শতাংশের কিছু ওপরে। জানা গেল তা আরও নাবিয়ে আনা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞানী

জাশি২০তে অনেক প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিকের নাম করা হয়েছে, যেমন চরক, সুশ্রুত, আর্য্যভট্ট, বরাহমিহির, ভাস্করাচার্য্য, ব্রহ্মগুপ্ত, মাধব, পিঙ্গলা, চক্রপাণি দত্ত ইত্যাদি। কোনও সন্দেহ নেই যে এরা সবাই নমস্য ব্যক্তি এবং ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চর্চ্চায় এদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় এদের স্মরণ করলে আত্মবিশ্বাস এবং দেশাত্মবোধ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্তমান ভারতে যারা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিৎ প্রস্তুত করলেন, তাদের নাম একবারের জন্যও স্মরণ করা হয় নি। জগদীশ চন্দ্র বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, সি ভি রমণ, শ্রীনিবাস রামানুজন, প্রশান্ত মহলানবিশ, হোমি ভাবা, এম বিশ্বেশ্বরাইয়া, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর বা বীরবল সাহনির নাম একবারের জন্যও উল্লেখিত হল না। সমগ্র শিক্ষানীতির ৬৬ পাতার মধ্যে বিজ্ঞান গবেষণাগারের কথা সম্পূর্ণ উহ্য। আই আই টি বা এন আই টির কথা বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আই আই টির মডেলে ঢেলে সাজানোর কথাও বলা আছে। কিন্তু যেসব ঐতিহাসিক গবেষণাগারগুলি বিজ্ঞানের জগতে ভারতবর্ষকে বিশ্বের মানচিত্রে নিয়ে এসেছিল, যেমন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, বসু বিজ্ঞান মন্দির বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্স (বিজ্ঞানে ভারতবর্ষের প্রথম নোবেল পুরস্কার এখান থেকেই এসেছিল), তারা জাশি২০তে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। নালন্দা, তক্ষশীলা বা বিক্রমশীলার নাম একাধিকবার করা হয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষের বর্তমান গবেষণাগারগুলির নাম বিসদৃশভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। মনে হয়, শিক্ষানীতির প্রণেতারা মনে করেছেন যে প্রকৃত শিক্ষার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানের চাইতেও প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানের ওপর জ্ঞানার্জন বেশী জরুরী। সক্রিয় গবেষণাগারগুলিকে উৎসাহিত করা বা ঝিমিয়ে পরা প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা সমগ্র শিক্ষানীতিতে কোথাও বলা হয় নি। বরঞ্চ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বলা হয়েছে, হয় তাদের নতুন শিক্ষানীতির সংজ্ঞা মেনে বিশ্ববিদ্যালয় মডেলে যেতে হবে, অথবা একটা কলেজে পরিণত হতে হবে অথবা কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত স্তবকের অংশীদার হতে হবে। জাশি২০তে ঘোষিত এই ধরণের স্তবকের পরিকল্পনা এখনও পর্য্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার জানান নি। একটি গবেষণাগার কখনই কলেজে পরিণত হতে চাইবে না। ভবিষ্যতে তাদের একমাত্র পন্থা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়া। কাজেই সাহা ইন্সটিটিউট, বসু বিজ্ঞান মন্দির, টি আই এফ আর ইত্যাদি স্বনামধন্য গবেষণাগারগুলিকে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে হবে। ১১.৪ ধারা অনুযায়ী এমন কি আই আই টিদেরও multidisciplinary হয়ে কলা ও সাহিত্য শিক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ঠিক কি রকম হবে এবং কতদিনের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করতে হবে, তার রূপরেখা জাশি২০তে পরিষ্কারভাবে দেওয়া আছে। সে সম্বন্ধে আগের পর্বে আলোচনা করেছি।

কেন আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণাকে এত অবহেলা করা হল?

শুরুতে এই প্রশ্ন আমাকেও ভাবিয়েছিল। পরে ভেবে দেখলাম বর্তমান পটভূমিকায় এই পরিণতিই স্বাভাবিক। এই নতুন শিক্ষানীতির যারা প্রধান হোতা ছিলেন বা যে মন্ত্রীসভা এই নীতিকে গ্রহণ করেছে, তাদের সবাই বরাবর স্পষ্ট অভিমত দিয়ে এসেছেন যে ইংরেজদের দেওয়া শিক্ষায় ভারতবর্ষ ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। এর থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় গৌরবময় প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশাত্মবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলা এবং সেই সুপ্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডার থেকে তথ্য আহরণ করে সত্যিকারের বিজ্ঞানের শিক্ষা নেওয়া। জাশি২০র দলিলে সেই সাবধানবাণী বারে বারে উচ্চারিত হয়েছে। তাতে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে মুম্বাইতে রিলায়েন্স হাসপাতালের উদ্বোধন করার সময় বলেছিলেন গণেশের হাতির মাথা প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন। আর কর্ণ ছিলেন একজন টেস্ট টিউব বেবি। Junior HRD মন্ত্রী সত্যপাল সিং ২০১৮ সালে আউরাঙ্গাবাদে একটি বক্তৃতায় বলেন যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পূর্ণ ভুল, কারণ আজ পর্য্যন্ত বানর থেকে মানুষের জন্মের ঘটনা কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারে নি। তার মতে এরপর থেকে স্কুলে ও কলেজে বিবর্তনবাদ পড়ানো বন্ধ করতে হবে। ২০১৭ সালে রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানি একটি বক্তৃতায় বলেন গরু একমাত্র প্রাণী যারা নিশ্বাস নেবার সময় অক্সিজেন গ্রহণ করে আবার প্রশ্বাস ফেলার সময় অক্সিজেন ত্যাগ করে। ২০১৫ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসে একজন অবসরপ্রাপ্ত পাইলট একটি পেপার পাঠ করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল যে এরোপ্লেন তৈরির সমস্ত তথ্যই ঋষি ভরদ্বাজের "বৃহৎ বিমান শাস্ত্রে" লেখা আছে। ভারতীয় বিদ্যা ভবনের শিক্ষকরা সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন যার নাম 'ভারতীয় বিদ্যা সার'। বইটি AICTE সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে "বৃটিশরা দুশ বছরের ওপর আমাদের পরাধীন করে রেখে তারা যা শেখাতে চায়, তাই আমাদের শিখিয়েছে। এখন সময় এসেছে তার পরিবর্তন করার। সেই উদ্দেশ্যে বইটি লেখা হয়েছে।" বইয়ে একটি অধ্যায় আছে, যার নাম অবাস্তব বনাম বাস্তব। যেমন অবাস্তব হিসাবে বলা হয়েছে যে অনেকে বিশ্বাস করেন যে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ১৯০৩ সালে প্রথম বিমান তৈরির সূত্র আবিষ্কার করেন। কিন্তু বাস্তব হল বৈদিক যুগে মহর্ষি ভরদ্বাজ যন্ত্রসর্বস্ব নামে একটি পুস্তক লেখেন। তার একটি অধ্যায়ে বিমান তৈরির সূত্র দেওয়া আছে। অতএব রাইট ভাইদের ৫০০০ বছর আগে ভারতবর্ষে বিমান আবিষ্কার হয়েছিল। অবশ্য যন্ত্রসর্বস্ব বইটি এখন আর পাওয়া যায় না, কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে বইটি ছিল। (এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গকৌতুকের 'প্রত্নতত্ত্ব' শীর্ষক লেখায় "মধুসূদন শাস্ত্রীমহাশয় কর্তৃক উক্ত প্রবন্ধের প্রতিবাদ" অংশটি পাঠকদের পড়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।) আর একটি অবাস্তব শিক্ষা হল ব্যাটারির আবিস্কর্তা হিসাবে ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক ড্যানিয়েলের নাম বলা হয়। এও বলা হয় বিদ্যুতের তথ্য প্রথম দেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। দুটো বক্তব্যই ভুল। কারণ মহর্ষি অগস্ত্যের অগস্ত্যসংহিতা পুস্তকে এগুলির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। আরও একটি তথাকথিত অবাস্তব বিশ্বাসের কথা বলে প্রসঙ্গটি শেষ করব। অনেকেই মনে করেন স্যার আইজাক নিউটন ১৬৬৬ সালে মাধ্যাকর্ষণের সূত্র আবিষ্কার করেন। কিন্তু তা অবাস্তব। বাস্তব ঘটনা হল এই সূত্র বহু আগে ভারতবর্ষে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এমন কি ঋগ্বেদেও তার উল্লেখ আছে। আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক, যার ওপর নতুন শিক্ষানীতির সঠিক রূপায়নের দায় ন্যস্ত করা আছে, তিনি ২০১৯ সালের ১৮ই আগস্ট আর এস এস অনুমোদিত একটি উৎসবে (জ্ঞানোৎসব) ভাষণ দিয়েছেন। ঐ উৎসবে আর এস এস প্রমুখ, আর এস এসের নেতাগণ ছাড়াও অনেকগুলি আই আই টি ও এন আই টির ডাইরেক্টররা এবং UGC ও AICTEর প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। নিশঙ্ক আই আই টির ডাইরেক্টরদের বলেন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র যে সত্যিই ভারতে বহু হাজার বছর আগেও জানা ছিল সেই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য তারা যেন অবিলম্বে কিছু প্রোজেক্ট শুরু করে দেন। এই উৎসবের এক সপ্তাহ আগে মুম্বাইয়ে আই আই টির সমাবর্তনে ভাষণ দেবার সময় নিশঙ্ক দাবী করেছিলেন পরমাণু তত্ত্বের প্রথম আবিষ্কর্তা হলেন চরক। কিন্তু এখানে এসে তিনি ঘোষণা করলেন পরমাণু তত্ত্বের আবিষ্কার করেছিলেন কোন এক ঋষি প্রণব। এই ধরণের লোকেরা কিভাবে শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান প্রসারের কথা বলবেন? এরা চরমভাবে বিজ্ঞানবিরোধী। এদের কীর্তিকলাপের তালিকা অসীম। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের আক্রমণের সময় এরা একের পর এক অবৈজ্ঞানিক প্রচার করে গেছেন। যেমন বলা হল গোমূত্র ও গোবর খেলে করোনা সেরে যায়। প্রচুর লোক আমাজনে অনলাইন অর্ডার দিয়ে গোমূত্র আনালেন। কোন কোন জায়গায় আবার সাইনবোর্ড দিয়ে এগুলো বিক্রি হতে শুরু করল। কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের প্রচেষ্টায় সরকার এই কুকীর্তি বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল ২০২০ সালের জুলাই মাসে দাবি করলেন স্থানীয় একটি পাঁপড়, যার নাম ভাবিজি পাঁপড়, করোনা প্রতিষেধক হিসাবে কার্য্যকরি বলে প্রমাণিত হয়েছে। দুঃখের বিষয় তার কিছুদিন বাদে মেঘওয়াল নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ২৩শে জুন, ২০২০তে গুরু রামদেব ও আচার্য্য বালকৃষ্ণ সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন পাতঞ্জলী কোম্পানি করোনার ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারা তাদের ওষুধ সেখানে প্রদর্শন করে জানান যে সরকারের অনুরোধে এর দাম খুব কম রাখা হয়েছে। তারা দাবী করেন ২৮০ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে শতকরা ১০০ জন এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। অতএব উত্তরাখণ্ড সরকারের অনুমোদন অনুসারে তারা সেই ওষুধ বাজারে বিক্রি করছেন। উত্তরাখণ্ডের ড্রাগ কন্ট্রোলার প্রকাশ্যে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন। তার বিবৃতি অনুযায়ী পাতঞ্জলিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ইমিউনিটি বাড়াবার ওষুধের জন্য, করোনার ওষুধের জন্য নয়। ২৯শে জুন কিছু লোক রাজস্থানে আদালতে ৫ জনের বিরুদ্ধে জুয়াচুরি (৪২০ ধারা), আপত্তিজনক বিজ্ঞাপনের (৪ ও ৭ সেকশন) অভিযোগ আনেন। এই ৫ জন হল, রামদেব, বালকৃষ্ণ , জয়পুরের National Institute of Science & Research (NIMS)-এর অধিকর্তা বি এস টোমার, তার পুত্র অনুরাগ টোমার এবং ঐ সংস্থার উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিক অনুরাগ ভার্সনে। কারণ দাবী করা হয়েছিল ওষুধের clinical trial নাকি NIMS-এ হয়েছিল। কোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হল এরা সবাই যেন অবিলম্বে clinical trial-এর বিশদ তথ্য কোর্টে পেশ করেন। বাস্তব ঘটনা হল এই clinical trial-এর গল্প সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং মিথ্যা প্রচার। বেগতিক দেখে ৩০শে জুন পাতঞ্জলি জানাল যে তাদের বক্তব্য লোকে ভুল বুঝেছে। তারা করোনার কোনও ওষুধ আবিষ্কার করে নি। এত বড় একটা জালিয়াতি করা সত্ত্বেও কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনও শাস্তির নির্দেশ এল না। কারণ হল যারা জাশি২০ প্রণয়ন করেছেন, তারা ঠিক এই ধরণের বিজ্ঞান গবেষণাই চান। তাদের কাছে NIMS হল মডেল গবেষণাগার, যেখানকার বৈজ্ঞানিকরা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন করতে দ্বিধা করেন না। রামদেবের কাহিনী কিন্তু এখানেই শেষ হয় নি। ২০২০ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তাকে বারণ করা হল, তিনি যেন করোনিলকে কোভিডের ওষুধ হিসাবে প্রচার বা বিক্রয় না করেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এক বছরেই তার কোম্পানি এই ওষুধ বিক্রী করে ২৪০ কোটি টাকা আয় করেছে। শুধু তাই নয় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকরি এবং হর্ষবর্দ্ধনের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে করোনিলের ওপর তার "বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র" প্রকাশ করেন। পুনরায় সরকারের প্রশ্রয় পাওয়ার ফলে তিনি এবার এলোপাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে একটি ভিডিয়োর মাধ্যমে তীব্র আক্রমণ করেন। তিনি বলেন এই চিকিৎসা ব্যবস্থা হল নির্বোধদের বিজ্ঞান। তিনি বেশ কিছু ওষুধের নাম করে বলেন যে এই সব ওষুধ ব্যবহার করার ফলে লক্ষ লক্ষ করোনা রোগী সম্প্রতি মারা গেছেন। এই ওষুধগুলি ভারতের DCGI এবং ICMR কর্ত্তৃক অনুমোদিত। ভারতের মেডিকাল আসোসিয়েশন রামদেবের বিরুদ্ধে এক হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেছে। সম্প্রতি তারা প্রধান মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছে রামদেবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা জারি করার জন্য। তাদের কাছে প্রমাণ আছে যে রামদেব নিজে অসুস্থ হলে আলোপাথিক ওষুধ সেবন করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামদেবকে চিকিৎসকদের উষ্মার কথা জানান। বেগতিক দেখে রামদেব ক্ষমা প্রার্থনা করে আবার তার পুরানো গান গাইতে শুরু করেন। তিনি বলেন তাকে সবাই ভুল বুঝেছে। তিনি এমন কোনও কথা বলেন নি। বর্তমানে (২০২১ সালের মে মাসে) করোনার ভয়াবহ ব্যাপ্তিতে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার উঠেছে। সেই সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করেছেন তারা যেন নাইট্রোজেন থেকে অক্সিজেন বানাবার একটি প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তার এই সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক মন্তব্যে যখন সবাই ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করছিল, তখন একজন টুইট করে জানায় যে এতে হাসির কিছু নেই। মুম্বাই আই আই টি থেকে এই রকম একটা প্রচেষ্টা সত্যিই নেওয়া হয়েছে। অপর দিকে প্রকৃতিপ্রেমী কঙ্গনা রানাউত তার আশঙ্কার কথা ঘোষণা করেন। তার ভয় যদি সবাই এত বেশী অক্সিজেন নিতে থাকে তাহলে প্রকৃতির অক্সিজেনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অসুস্থ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের অক্সিজেনের যোগান দিলে পৃথিবীর অক্সিজেন ভারসাম্য ওলট পালট হয়ে যাবে, এই ধরণের অবৈজ্ঞানিক তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে পরিবেশিত হচ্ছে। এ কোন্ অন্ধকারময় অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের পরিবেশের দিকে ভারতবর্ষ এগিয়ে চলেছে? বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান মানসিকতা কেবলমাত্র অলংকার হিসাবে শোভা পাবে। বাস্তবে তার প্রতিফলন কখনও ঘটবে না।

বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলির ভবিষ্যৎ কি?

ভারতবর্ষে বিজ্ঞান গবেষণাগারের সংখ্যা কিছু কম নয়। শতাধিক বিজ্ঞান গবেষণাগার আছে যারা মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে চলে। জাশি২০র কোথাও বিজ্ঞান গবেষণাগার কথাটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। তবে ১০.১১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে Single Stream HEI-এর কথা। জাশি২০-এর সংজ্ঞা অনুসারে এই শব্দটির অর্থ এমন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে কেবল মাত্র এক বা অল্প কয়েকটি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করা হয়। কলকাতার ওপর অবস্থিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট, বসু বিজ্ঞান মন্দির বা সাহা ইন্সটিটিউট ইত্যাদি সবই এই পর্য্যায়ের অন্তর্গত। এই ধরণের শতাধিক গবেষণাগারের ভবিষ্যৎ কি? আগের পর্বে বিস্তৃতভাবে দেখিয়েছি যে জাশি২০তে ১০.১ ধারা অনুসারে গবেষণাগারগুলির কাছে একমাত্র বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়া। দু ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে, গবেষণা-প্রধান বা শিক্ষণ-প্রধান। তবে ছাত্রসংখ্যা অন্তত ৩০০০ হওয়া চাই। এই সব পরিবর্তনগুলি সম্পন্ন করার জন্য একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে এরা যেন multidisciplinary বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় আর ২০৪০ সালের মধ্যে ছাত্রসংখ্যা যেন অন্তত ৩০০০ করা হয়। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলে এই সব প্রতিষ্ঠানগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হবে। লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজরদারি রাখবে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা, যার নাম পরখ (PARAKH Performance Assessment, Review and Analysis of Knowledge for Holistic development)। গবেষণাগারের শিক্ষক এবং ছাত্ররা স্বভাবতই চাইবেন তাদের প্রতিষ্ঠানটি যেন গবেষণা-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় হয়। বর্তমানে এই গবেষণাগারগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে গবেষণার অনুদান পেয়ে থাকে, যেমন DBT, DST, DAE, ICAR, ICMR ইত্যাদি। নতুন শিক্ষানীতিতে প্রস্তাব করা হয়েছে যে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন করা হবে যারা কেন্দ্রীয়ভাবে গবেষণার অনুদান দেবে এবং পূর্বোক্ত যে বিভাগগুলির নাম বলা হল, তাদের অনুদান দেওয়ার পদ্ধতির ওপর নজর রাখবেন। এই সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছে National Research Foundation বা NRF। কি উদ্দেশ্যে NRF গঠিত হল, তার বিস্তৃত বিবরণ ১৭.৯ ধারায় দেওয়া আছে। আর ১৭.১০ ধারায় বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে যে রকম অনুদান দেওয়া হত, আপাতত সেটা চালু থাকবে। ভবিষ্যতে কি করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয় নি। তবে এই সমস্ত বিভাগ বন্ধ করে দিয়ে শুধু NRF-এর মাধ্যমেই গবেষণার অনুদান দেওয়া হবে, এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সরকারও বলছেন এবং জাশি২০তেও বার বার বলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে গবেষণার অনুদানের জন্য শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। তাদের প্রাইভেট অনুদান সংগ্রহ করতে হবে। প্রাইভেট অনুদান কারা দেবে? অবশ্যই বড় বড় কোম্পানি। মনে রাখতে হবে যে এই সব কোম্পানি তখনই অনুদান দেবে, যখন তাদের ব্যবসায়ের স্বার্থে গবেষণা পরিচালিত হবে। যেমন পাতঞ্জলি দিয়েছিল NIMSকে। সেই ধরণের অনুদান গ্রহণ করে বিজ্ঞান গবেষকরা তাদের অভীপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন কিনা, সে কথা যেন তারা ভাল করে চিন্তা করে দেখেন। মোটের ওপর বলা যেতে পারে যে জাশি২০তে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি গবেষণার কোনও রকম দিকনির্দেশ নেই। যতটুকু ভাসা ভাসা ছবি ফুটে উঠেছে তাতে বলা যায় যে এই শিক্ষানীতিতে আধুনিক বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ওপর ভারতে গবেষণা করাকে একেবারেই উৎসাহ দেওয়া হয় নি। বরঞ্চ প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের সাফল্য সম্বন্ধে অলৌকিক গল্পকথাগুলিকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টাকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগ - বিপ্র২০

বিপ্র২০-এর প্রকাশনের ইতিহাস

এবার আমরা আলোচনা করব Science, Technology and Innovation Policy document version 1.4 বা বিপ্র২০ নামক ৬৩ পাতার একটি দলিল নিয়ে। দলিলটি ২০২০ সালের শেষের দিকে DST-এর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়। বেশ কয়েকটি দিক থেকে দেখতে গেলে দলিলটিকে অদ্ভুত বলেই মনে হয়। দলিলটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। মূল মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত হয় নি। সাধারণত এই ধরণের খসড়া দলিলে তার প্রণেতাদের নাম, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা যোগাযোগ করার ঠিকানা দেওয়া থাকে। এখানে সে সবের বালাই নেই। দলিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করা থাকলেও যতদূর জানা যাচ্ছে ডক্টর অখিলেশ গুপ্তা নামক একজন বিজ্ঞানী আমলার নেতৃত্বে DSTতে কর্মরত কিছু বিজ্ঞানীর সহযোগীতায় দলিলটি প্রস্তুত করা হয়েছে। আপাত স্বয়ম্ভু এই দলিল DST-এর পক্ষ থেকে ২০২০ সালের অন্তিম পর্বে জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। দাবী করা হয়েছে যে আত্মনির্ভর ভারত গড়ার লক্ষ্যে বিগত ছয় মাস ধরে প্রচুর আলাপ আলোচনার করা পর এটি তৈরি হয়েছে। বিগত বিজ্ঞান প্রযুক্তি নীতি থেকে অনেকটা সরে এসে এই নীতি এমনভাবে গঠন করা হয়েছে যাতে সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাননীতিগুলির সমপর্য্যায়ভুক্ত বলে একে গণ্য করা যেতে পারে। নীতিটি প্রণয়নের জন্য পরামর্শ সমিতি ৬ মাসে প্রায় ৩০০ বার আলোচনায় বসেছেন অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে তারা প্রায় দুটি করে সভা করেছেন। তাছাড়া চল্লিশ হাজারের বেশী ভবিষ্যৎ উপভোক্তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রকাশিত এই বিজ্ঞপ্তিতে আহবান করা হয়েছিল যে যদি কেউ মতামত জানাতে চান তাহলে তারা যেন ২০২১ সালের ২৫শে জানুয়ারির মধ্যে ই-মেল করে জানান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সংগঠন অনুরোধ করেছিল মতামত জানাবার শেষ তারিখের মেয়াদ যেন অন্তত দু মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং আঞ্চলিক ভাষায় পলিসির অনুবাদ যেন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সে সব কিছু করা হয় নি। শুধু মতামত দেওয়ার শেষ তারিখ মাত্র ৬ দিন বাড়িয়ে ২০২১ সালের ৩১শে জানুয়ারি স্থির করা হয়।

বিপ্র২০-এর মূল বক্তব্য কী ?

২০২০ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নীতির সম্পর্কে DST-এর বক্তব্য নিচে দেওয়া হল।

(১) ভারত সরকার ১৯৫৮ সালে প্রথম বিজ্ঞান নীতি এবং ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রযুক্তি নীতি ঘোষণা করেন। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব দিয়ে যৌথভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি সর্বপ্রথম ঘোষিত হয় ২০০৩ সালে। ২০১৩ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নবপ্রবর্তনের (innovation) একটি নীতি ঘোষিত হয়। এই সব নীতিগুলির ধারাকে অব্যাহত রেখে বর্তমান নীতিকে আরও আধুনিক করে তোলার জন্য নতুন বিপ্র২০ সৃষ্ট হয়েছে।

(২) বিপ্র২০তে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহার এবং তৃণমূল স্তরে আবিষ্কারের ওপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে শিল্প ও সমাজের সাথে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত করতে হবে। গড়পরতা দিনে দুটো করে সভা করে এবং ৪৩ হাজার উৎসাহী ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে ও তাদের দেওয়া প্রায় এক লাখ অভিমত আলোচনা করে এই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রথম বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের অভিমতও বিস্তৃতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কোনও কমিটিতে যাতে লিঙ্গবৈষম্য না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে। তরুণ ও প্রবীণদের মধ্যেও সমতা রাখা হয়েছে। মোট ১১টি অধ্যায়ে খসড়া নীতিকে লেখা হয়েছে। নীচে কয়েকটি অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল।

প্রথম অধ্যায় : উন্মুক্ত বিজ্ঞান :

এই প্রথম সরকারি সাহায্যে গড়ে ওঠা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তথ্যভাণ্ডার দেশবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। সরকারি অনুদানে যে সব গবেষণা করা হবে, সেগুলির ফলাফল (অর্থাৎ গবেষণাপত্র, পুস্তকের অনুচ্ছেদ, পাণ্ডুলিপি, গবেষণালব্ধ তথ্য ইত্যাদি) সরকারি মহাফেজখানা INDSTAতে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হবে। বিশ্বের নামী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পত্রিকাগুলির সাথে কেন্দ্রীয় সরকার এমন ব্যবস্থায় আসবেন, যাতে ঐ পত্রিকাগুলি দেশের সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে ব্যবহার করার সুযোগ পান।

দ্বিতীয় অধ্যায় : গবেষণার সামর্থ্যের বিস্তৃতি :

গবেষণার মান ও পরিমাণকে অনেক বিস্তৃত করা হবে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় (engaged universities) সৃষ্টি করা হবে, যারা সামাজিক কল্যাণের জন্য জ্ঞানের আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় (interdisciplinary) ঘটিয়ে নতুন দিশার সন্ধান দেবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ইণ্ডাষ্ট্রির সাথে যুক্তভাবে গবেষণা করতে হবে যাতে গবেষোণান্তে গবেষকরা নতুন ব্যবসায়ের উদ্যম নিতে পারে।


তৃতীয় অধ্যায় : অর্থের উৎস :

কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতেই হবে। এই অর্থের সাহায্যে বিভাগগুলি তাদের প্রয়োজনীয় গবেষণার কাজ করিয়ে নিতে পারবে। বিদেশী বৃহৎ কোম্পানীগুলিকে উৎসাহ দেওয়া হবে, তারা যেন এই দেশে গবেষণার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে কিছু শিল্প ও ব্যবসায়ের সূচনা করতে পারে। দেশী শিল্পপতিরা যদি গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করে, তাহলে তারা বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাবে।

চতুর্থ অধ্যায় : গবেষণা :

শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে আকর্ষণ করার জন্য তাকে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইণ্ডাষ্ট্রীতে যুগ্মভাবে নিযুক্ত করা যেতে পারে। দেখতে হবে একই গবেষণার পুনরাবৃত্তি না হয় এবং বিষয় নির্বাচনে গ্রামীণ উন্নতিকরণ প্রাধান্য পায়। ডিজিটাল প্লাটফর্মকে ব্যবহার করে আমলাতান্ত্রিক বিষয়গুলি সরলীকৃত করা হবে।

পঞ্চম অধ্যায় : নব আবিষ্কার ও নব ব্যবসা :

সমাজে প্রচলিত জ্ঞানভাণ্ডারকে সম্মান দেখিয়ে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাক্রমগুলির যথোপযুক্ত পরিবর্তন করতে হবে। তৃণমূল স্তরের আবিষ্কর্তাদের বৈজ্ঞানিকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করানো হবে। দেখতে হবে পেটেন্ট নেওয়া বা অন্যান্য আইনানুগ অধিকার থেকে ঐ আবিষ্কর্তারা যেন বঞ্চিত না হয়।

ষষ্ঠ অধ্যায় : প্রযুক্তির উন্নতি ও ভারতীয়করণ :

বিদেশ থেকে যে সব প্রযুক্তি বা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়, চেষ্টা করতে হবে সেগুলির ভারতীয়করণ করতে। কৌশলগত প্রযুক্তির (strategic technologies) কতটা অংশ বিদেশ থেকে আনা হবে আর কতটা ভারতীয়করণ করা হবে তা একটি সরকারি বোর্ড স্থির করবে। সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে সমতা ও অন্তর্ভুক্তির কথা। অষ্টম অধ্যায়ে বিজ্ঞান প্রচার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার কথা নবম অধ্যায়ে বলা আছে। যাদের ফিরে আসা সম্ভবপর নয়, তারাও যাতে দেশের গবেষণায় অংশ নিতে পারে তার চেষ্টা করতে হবে। শেষ দুই অধ্যায়ে সমগ্র দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কিভাবে পরিচালিত হবে সেই কথা আলোচিত হয়েছে।

বিপ্র ২০ তে অসঙ্গতি

নীতি প্রণয়নের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে

নীতি প্রণয়নের যে সব পদ্ধতি সাধারণত মানা হয়, সেগুলি উপেক্ষা করে এই খসড়া নীতি জনসাধারণের কাছে পেশ করা হয়েছে। সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি প্রণয়ন করার সময় কোনও একটি মন্ত্রকের অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা থাকেন এবং তাদের নাম সর্বসমক্ষে ঘোষণা করা হয়। কমিটির সৃষ্ট খসড়া প্রস্তাব মন্ত্রকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। সর্বশেষে তা মন্ত্রীসভার দ্বারা অনুমোদিত হয়। কোনও মন্ত্রকের নির্দেশে গঠিত কমিটির দ্বারা বিপ্র২০ তৈরি হয় নি। খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের একটি বিভাগ, যার নাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ বা DST। তার সাথে সহযোগিতা করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য বিজ্ঞান উপদেষ্টার অফিস বা PSA। যদিও দাবী করা হয়েছে যে এই নীতি রূপায়ণ করা হলে আমাদের দেশ পৃথিবীর মুখ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দেশের প্রথম তিনটির মধ্যে একটি বলে পরিগণিত হবে, কিন্তু কোনও মন্ত্রকই এই নীতি প্রকাশনের দায়িত্ব নেয় নি। কারা কমিটিতে ছিলেন সেই নাম প্রকাশ্যে বলা হয় নি। জানা গেছে DST-এর এক বিজ্ঞানী আমলা ও তার সহযোগী বন্ধুগণ এই প্রস্তুতি কমিটিতে ছিলেন। দাবী করা হয়েছে যে এই নীতি রূপায়িত হলে কৃষি, শিল্প এবং উর্জা উৎপাদনে বিপ্লব আসবে। কিন্তু সেই বিপ্লব সংঘটিত করার দায়িত্ব কে নেবে ? DST না PSA ? কৃষিমন্ত্রক, শিল্পমন্ত্রক বা উর্জামন্ত্রক কেউ এই নীতি প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট নেই। খসড়া নীতির তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সব কটি সরকারি বিভাগকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। এই নীতি প্রণয়ন কমিটিতে তাদের স্থান কোথায়? যদি ধরেও নেওয়া যায় যে কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দেবেন সবাইকে এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখার জন্য এবং সবাই তা যথাযথভাবে পালন করবেন, কিন্তু সেটা ত' হবে রাজস্বনীতি (fiscal policy)। সরকার ত' মুদ্রানীতি (monetary policy) তৈরি করতে পারেন না। টাকা আসবে কোথা থেকে? এই দুই নীতির মিশ্রণের (policy mix) জন্য অর্থমন্ত্রককে থাকতেই হবে। তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ কোথাও চোখে পড়ল না। মোটকথা বিপ্র২০ একটি গোঁজামিল দেওয়া নীতি। এই নীতি কখনই কার্য্যকরী করা যাবে না। এতে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কি ধরণের পদক্ষেপের মাধ্যমে একে রূপায়িত করা যেতে পারে, সেই প্রসংগ সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকারের উচিত অবিলম্বে একে বাতিল করে সঠিকভাবে নতুন নীতি প্রণয়ন করা। অর্থমন্ত্রকের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নীতি কখনই নির্দ্ধারণ করা যায় না।

শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার ফলে কি দেশের সমস্ত হিত সম্ভবপর?

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার বিষয়ে যদি কোনও নতুন নীতি তৈরি করতে হয়, তাহলে সেখানে সবার আগে বলা দরকার দেশে কি ধরণের গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে এবং কারা সেই গবেষণার ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করবেন। বিপ্র২০-এর পটভূমিকায় বলা হয়েছে যে এই নীতি কার্য্যকরী হওয়ার পর আত্মনির্ভর ভারত গড়ার লক্ষ্যে গবেষণাকে পরিবেশ সচেতন করা হবে অর্থাৎ এমন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হবে যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জল, বাতাস, নদী, জঙ্গল, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং শক্তির উৎসগুলিকে আমরা দূষণমুক্ত রেখে যেতে পারি (৮ পাতায় ১৩ নম্বর)। জাতীয় জল, কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে যাতে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জীবনের মান উন্নত হয়। কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং কারখানার শ্রমিকদের সম্মানজনক মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে যার ফলে তাদের সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয় (৮ পাতায় ১৫ নম্বর)। নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে হবে এবং সমগ্র জনসাধারণ যাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পান তার ব্যবস্থা করা হবে (৮ পাতায় ১৭ নম্বর)। ভারতের আভ্যন্তরীন বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য আমদানী কমিয়ে রপ্তানীর পরিমাণ বাড়াতে হবে (৮ পাতায় ১৮ নম্বর)। হঠাৎ পড়লে বোঝা মুস্কিল যে এটা কি সত্যিই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর গবেষণার নীতি না কোনও নির্বাচনী ইস্তেহার। এই সব বড় বড় আশ্বাসের চর্বিতচর্বনের উদ্গার না তুলে বিপ্র২০-এর প্রথমেই বলা উচিত ছিল, আগামী দিনে ভারতে কোন্ কোন্ গবেষণার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে আর সেই জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান কোথা থেকে আসবে। ৮ পাতায় ১০ নম্বরে বলা হয়েছে, দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির কথা মাথায় রেখে বড় মাপের বিজ্ঞানকে (megascience) অগ্রাধিকার দিতে হবে। পৃথিবীর কোনও দেশের বিজ্ঞান নীতিতে megascience করার কথা ঘোষণাপত্রে থাকে না। এগুলি সাধারণত করা হয় বিজ্ঞানীদের চাপে বা দাবীতে। যখন বিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রনায়কদের বোঝাতে সক্ষম হন যে প্রচুর ব্যয়সাধ্য একটি গবেষণা করতে পারলে জ্ঞানের জগতে নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে, তখন অনেক অনুরোধ বা উপরোধের পর সেগুলির অনুমোদন পাওয়া যায়। প্রথম থেকেই কোনও দেশ স্থির করে রাখে না যা তাদের megascience করতেই হবে।

প্রথম অধ্যায় : মুক্ত বিজ্ঞান

প্রস্তাবিত নীতিতে সব চাইতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে "উন্মুক্ত বিজ্ঞানের" ওপর। বলা হয়েছে সরকারের অনুদানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে সব গবেষণা করা হবে, সেগুলি প্রতিটি পর্য্যায়ে উন্মুক্ত রাখা হবে। প্রবন্ধ বা গবেষণা-পত্র থেকে শুরু করে গবেষণা চলাকালীন আহরিত তথ্য বা অন্তিম গবেষণালব্ধ জ্ঞান, সব কিছুই এমনভাবে উন্মুক্ত রাখা হবে যাতে যে কোনও লোক যে কোনও সময় এই তথ্যগুলি ব্যবহার করতে পারবেন। শুনে মনে হয়, সত্যিই এ অতি সাধু প্রস্তাব। আমাদের দেশের গবেষণাগারগুলিতে সরকারের অনুদানপুষ্ট গবেষণায় শেষ পর্য্যন্ত কি ফল লাভ হয়, তা সাধারণ লোকের একদম অজানা। জানতে হলে পার্লামেন্টে প্রশ্ন তুলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক থেকে তার উত্তর আনিয়ে নিতে হয়। উত্তরগুলি প্রায়শই ধোঁয়াশায় ঢেকে থাকে। সঠিক তথ্য পাওয়া খুব দুষ্কর। সরকারি তহবিলের একটা বিরাট অংশ আমাদের দেওয়া ট্যাক্স থেকে আসে। কাজেই আমাদের টাকা গবেষণায় কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তার ফলে আমাদের দেশ কিভাবে উপকৃত হচ্ছে এই তথ্য জানার অধিকার আমাদের সবার আছে। সাধারণত সরকার বা গবেষণাগারগুলি এই দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যায়। উন্মুক্ত বিজ্ঞান প্রথা চালু হলে এই দায়বদ্ধতা এড়ানো যাবে না। কিন্তু এর একটা খুবই বিষময় দিক আছে। যে কোনও গবেষণার ব্যয় ও পরিশ্রমের সিংহভাগ যায় প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষাতে। একেবারে শেষে আসে অন্তিম অনুসিদ্ধান্ত। বিজ্ঞান ও বিশেষত প্রযুক্তির গবেষণায় এই অন্তিম অনুসিদ্ধান্তকে সর্বসাধারণের কাছ থেকে ইচ্ছা করেই গোপন করে রাখতে হয়। নাহলে এই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে লোভী ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে মুনাফা লুটে নিতে পারে। সরকারি মহাফেজখানা INDSTAতে এই সব তথ্য জমা পড়লে বৃহৎ ব্যবসায়ী, বিশেষত MNCদের সেই তথ্য আহরণ করতে বিন্দুমাত্রও সময় লাগবে না। আমাদের দেশের গবেষণালব্ধ তথ্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেশি ও বিদেশি ব্যবসায়ীদের হস্তগত হয়ে যাবে এবং তারাই আমাদের দেশের বাজার অধিকার করে বসবে। কাজেই উন্মুক্ত বিজ্ঞানের প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধু বলে মনে হলেও এর ভেতর একটা চক্রান্ত লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়। খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা না করে এই ধরণের বিপজ্জনক প্রস্তাবের ভেতর প্রবেশ না করাই উচিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পত্রিকাগুলিকে দেশবাসীর কাছে বিনামূল্যে পরিবেশনার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে নিশ্চয়ই অনেকে উপকৃত হবেন, কিন্তু প্রস্তাবটি ধোপে টিঁকবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। ভারতীয় পত্রিকাগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার হয়ত রাজী করাতে পারবেন, কিন্তু বিদেশী পত্রিকাগুলি হয় রাজী হবে না, অথবা এমন দর চাইবে, যেটা দেওয়া সম্ভবপর নয়। কাজেই এই প্রস্তাবটি কার্য্যকরী করতে গেলে অনেক দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হবে এবং শেষ পর্য্যন্ত মনে হয় না বিশেষ কোনও ফললাভ হবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: গবেষণার বিস্তৃতি

দ্বিতীয় অধ্যায়ে গবেষণার বিস্তৃতি ঘটাবার প্রকল্পে engaged universities তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিষয়টি কি, একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। এই শব্দসমষ্টির ব্যবহার বেশি পুরানো নয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে এই সব ধারণা নিয়ে লোকে চিন্তাভাবনা করছে। বিষয়টি শুরু হয়েছিল ইউনাইটেড কিংডমে, কিন্তু তারপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। মূল বক্তব্য হল, বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র পঠনপাঠনের স্থান নয়। পারিপার্শ্বিক সমাজের সাথে যুক্ত হওয়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কর্ত্যব্য। যে অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত, সেই অঞ্চলের আর্থসামাজিক সঙ্কট ও প্রগতির সাথে তাকে একযোগে কাজ করে যেতেই হবে। ধরা যাক কোন একটি বিস্তৃত অঞ্চলে জনসাধারণের প্রধান আয়ের উৎস ছিল চামড়ার জুতা তৈরি করা এবং রপ্তানি করা। কিন্তু ইদানিং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতার ফলে তাদের সেই কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঐ অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার একটি মূল লক্ষ্য হবে কিভাবে সস্তায় ভাল মানের চর্মজাত শিল্প সেখানে গড়ে তোলা যায় এবং জনসাধারণের আয়ের পথ খুলে দেওয়া যায়। এই গবেষণা শুধু পরীক্ষাগারে বসে করলে হবে না। প্রতি মূহূর্তে পরীক্ষালব্ধ ফল স্থানীয় জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে, তাদের অভিমত সংগ্রহ করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে গবেষণার অভিমুখ পরিবর্তিত করতে হবে। মোট কথা এই গবেষণা কয়েকজন বৈজ্ঞানিক গজদন্তমিনারে বসে করবেন না, তাতে সাধারণ লোকেদের যথেষ্ট অবদান থাকবে এবং তারাও গবেষণার বিষয়বস্তুতে উৎসাহভরে অংশগ্রহণ করবে। ইংরেজীতে একে বলা হয় public engagement, যার অর্থ "the involvement of specialists listening to, developing their understanding of, and interacting with, non-specialists"। যে বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরণেরpublic engagement করে তাদের বলা হয় engaged universities। বিপ্র২০তে বলা হয়েছে নতুন নীতিতে এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হবে। এই নীতির ২.৩ ধারায় বলা হয়েছে এই উদ্দেশ্যে প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগারে নতুন উচ্চশিক্ষামূলক গবেষণাকেন্দ্র (HERC) স্থাপন করা হবে। একই সাথে সহযোগীতামূলক গবেষণাকেন্দ্র (CRC) সৃষ্টির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক, বৃহৎ শিল্পপতি, লঘু ও মধ্যম পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের একযোগে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে এবং নামী গবেষণাগারগুলিকে গবেষণা-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। আবার এক ভয়ানক বিপদকে আহবান জানানো হচ্ছে। শিল্পপতিরা যদি গবেষণার বিষয় এবং কৌশলের ভেতর নাক গলাতে শুরু করে তাহলে অচিরেই ভারতবর্ষ থেকে মৌলিক গবেষণার সংস্কৃতি চিরতরে মুছে যাবে। যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য যেন-তেন-প্রকারেন মুনাফা অর্জন করা, তারা খামোখা দেশের জনগণের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে কেন?
মনে রাখা দরকার আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগার ইতিমধ্যেই সচেতনভাবে বা নিজেদের অজ্ঞাতসারে অনেকগুলি বিষয়ে পারিপার্শ্বিক সমাজের সাথে নিজেদের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকে একীভূত করে ফেলেছে। হয়ত প্রতিষ্ঠানের মূল কর্ত্তৃপক্ষের দিক থেকে সেরকম কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ এখনও জারি হয় নি, কিন্তু আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগার তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে তারা engaged university-এর আদলেই গড়ে উঠেছে। কাজেই নতুন করে engaged university গড়ে তোলার অকারণ প্রচেষ্টা কেন? ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর্ কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি অনুধাবন করলেই দেখা যাবে তাদের আদর্শের সাথে engaged university-এর আদর্শের বিশেষ তফাৎ নেই। ঠিক একই কথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। আমাদের দেশের পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগারগুলি প্রতিষ্ঠার সময় তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য যে জনসাধারণের সার্বিক উন্নতিবিধান সে কথা প্রায়শ: ঘোষিত হয়েছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় এই বিষয়ে এতটাই জোর দেওয়া হয়েছিল যে পাঠ্যবিষয়গুলি নির্বাচনেও প্রচলিত ধারাকে অনুকরণ না করে সামাজিক প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কেন বিশ্বভারতী তৈরি করেছিলেন, সে কথা সবারই জানা। বর্তমান উপাচার্যের অসাধারণ কৃতিত্ব এই যে তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে একটি রাজনৈতিক তরজার আখড়াতে পরিণত করতে পেরেছেন। বিদেশ থেকে engaged university, public engagement ইত্যাদি গালভরা jargon আমদানী না করে আমাদের পুরাতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য ও আদর্শ সঠিকভাবে অনুধাবন করলে একই ফল পাওয়া যাবে। মুস্কিল হল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক হাজার বছরের পুরাতন ভারত ছাড়া আর কোনও ভারতের আদর্শ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। বিগত শতাধিক বৎসরে ভারতের শিক্ষাপদ্ধতিতে বা বিজ্ঞান গবেষণায় যে অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছে, তাকে তারা ইংরাজের দাসত্ব করার মনোবৃত্তি ছাড়া আর কোনও আখ্যা দিতে চান না। আর একটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রস্তাব করা হয়েছে যে বেশ কিছু সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেট সেক্টরের অনুদানপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে engaged university-এর স্তরে নিয়ে আসা হবে। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে এই অলীককল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারা কখনই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। গবেষণার অন্তিম ফল ইণ্ডাস্ট্রিতে কাজে লাগানো যেতেই পারে, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ইণ্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত করে দিলে হাঁসজারুর সৃষ্টি হবে।

তৃতীয় অধ্যায়: অর্থের উৎস

তৃতীয় অধ্যায়ে গবেষণার অর্থ কিভাবে আসবে তার একটা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। বিপ্র২০-এর সমগ্র নীতির কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই যে গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করবেন। কোথাও বলা নেই যে জিডিপির কত শতাংশ গবেষণার খাতে খরচ করা হবে। শুধু বলা আছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সব কয়টি বিভাগকেই গবেষণার জন্য বাজেটে টাকা রাখতে হবে। এই টাকার সাহায্যে তারা নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে গবেষণা করিয়ে নিতে পারবেন। কি অদ্ভুত প্রস্তাব। ধরা যাক কোনও একটি রাজ্যে পশুপালন বিভাগ লক্ষ্য করল যে তাদের মেষবংশ অদ্ভুত অসুখে মৃত্যু হওয়ার ফলে নিঃশেষিত হতে চলেছে। তাদের প্রয়োজন এই বিষয়ে গবেষণা করে মেষগুলিকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে রাজ্য পশুপালনবিভাগের বাজেটের সাহায্যে এই ধরণের গবেষণা করা আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র। তাছাড়া সমস্ত সরকারি বিভাগের প্রতি বছর গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সেই বাজেটের টাকা কোথায় যাবে? যেগুলি গবেষণাপ্রধান মন্ত্রক যেমন আণবিক শক্তি বা মহাকাশ বিজ্ঞান, তাদের ত' পুরো বাজেটই গবেষণার কাজে ব্যয় হয়। তাদের জন্য এই নতুন নির্দেশিকা কি কাজে লাগবে? রাজ্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগ থেকে অতি ক্ষুদ্র বাজেটের মধ্যে পরস্পর সঙ্গতিহীন নির্দেশ আসবে গবেষণার জন্য। এইভাবে কি কোনও গবেষণার নীতি করা যায়? বলা হয়েছে দেশী ও বিদেশী শিল্পপতিরা গবেষণার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করলে তাদের উৎসাহ প্রদান করা হবে। আবার বলি শিল্পপতিরা নিজেদের মুনাফা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তারা একমাত্র নিজেদের অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা দেখলে সেখানে বিনিয়োগ করবে। দেশের জন্য তারা ভাবতে যাবে কেন? বিশেষত MNC-দের ত' কোনও নিজের দেশ নেই। তাদের দেশাত্মবোধ আসবে কিভাবে?

চতুর্থ অধ্যায়: গবেষণা

চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ প্রতিভাদের আকর্ষণ করার জন্য তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইণ্ডাস্ট্রি ও সরকারি চাকরিতে যুগ্মভাবে নিয়োগ করা হবে। এইভাবে প্রলোভন দেখিয়ে কখনই সত্যিকারের প্রতিভাকে আকর্ষণ করা যায় না। তাছাড়া একই ব্যক্তিকে সরকারি বেতন এবং বেসরকারি ইণ্ডাস্ট্রির বেতন দেওয়া মানে সুবিধাবাদের পথ খুলে দেওয়া। কোনও আত্মমর্যাদাবিশিষ্ট বিজ্ঞানী এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। মুস্কিল হল যখন দেশের শাসনব্যবস্থা বেনিয়াদের হাতে চলে যায়, তখনই এই ধরণের অদ্ভুত সব প্রস্তাব আসতে থাকে।

এখানে আরও বলা হয়েছে গবেষণার বিষয়বস্তু নির্বাচন করার সময় গ্রামীণ উন্নতিকরণ যেন প্রাধান্য পায়। যারা কিছুটা গবেষণার সাথে যুক্ত আছেন, তারা সবাই জানেন যে গবেষণার বিষয়বস্তু এইভাবে নির্বাচিত হয় না। সমস্ত গবেষণার (যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা বাদে) মূল লক্ষ্য হল সব মানুষের মঙ্গল সাধন। কোন না কোন ভাবে যে গবেষণা মানবজাতির উপকারে আসবে, তাকেই নির্বাচিত করা হয়। গ্রামীণ মানুষ ও শহুরে মানুষের জন্য আলাদা গবেষণা হয় না। এমন হতেই পারে যে কোন একটি গবেষণালব্ধ ফল গ্রামের মানুষের বেশী কাজে লাগল। কিন্তু গবেষণা শুরু করার সময় এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা হয় না। এই ধরণের কথাবার্তা যে বিপ্র২০তেই প্রথম শুনছি তা নয়, এর বহু আগেও অনেকেই এইসব কথা বলতেন। অনেকদিন আগে একটা ব্যঙ্গাত্মক লেখা পড়েছিলাম aerodynamics and rural development। ঠিক যেমন লেখকদের অর্ডার দিয়ে পছন্দমাফিক লেখা পাওয়া যায় না, তেমনি গবেষককেও ওপর থেকে নির্দেশ দিয়ে গবেষণা করানো যায় না। তাকে তার পছন্দের স্বাধীনতা দিতেই হবে।

পঞ্চম অধ্যায়: নব আবিষ্কার ও নব ব্যবসা:

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে প্রত্যন্ত গ্রামের তথাকথিত অশিক্ষিত লোকেরাও অনেক সময় চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন। সেই আবিষ্কারের ফসল সমগ্র সমাজ ভোগ করে, কিন্তু যিনি আবিষ্কর্তা তিনি কোনও কৃতিত্ব পান না। সেইজন্য প্রস্তাব রাখা হয়েছে, এই ধরণের আবিষ্কারের কথা জানতে পারলে আমাদের কর্তব্য হল সেই তৃণমূল স্তরের বিজ্ঞানীকে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া, যাতে সে পেটেন্ট ইত্যাদির সুবিধা নিতে পারে। প্রস্তাবটি সাধু, তবে তার জন্য যে সমাধানের কথা ভাবা হয়েছে তা একেবারেই অবাস্তব। পেটেন্টের আবেদন করে তারপর তার অনুমোদন পাওয়া মোটেই সহজসাধ্য বিষয় নয়। প্রথমত সেই আবেদনের সাথে একজন বিজ্ঞানীর নামের সংযোগ রাখতেই হবে। দ্বিতীয়ত, আবেদন করার পদ্ধতি বেশ জটিল। এতটাই জটিল যে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বুঝে ওঠাই মুস্কিল। তৃতীয়ত, এর জন্য বিশেষভাবে শিক্ষিত আইনজ্ঞের সাহায্য দরকার। ফলে গ্রামের একটি সাধারণ মানুষকে এই জটিল পদ্ধতির সাথে জড়িয়ে দিলে আখেড়ে আবার কিছু দুর্নীতির জন্ম নেবে। তার থেকে অনেক ভাল হবে, যদি ঐ বুদ্ধিমান লোকটিকে সরকারি সাহায্য দিয়ে উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করে একজন বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

উপসংহার

আমার মনে হয় আলোচনায় এখানেই ইতি টানা দরকার। অধ্যায়ের পর অধ্যায় নিয়ে দীর্ঘ সমালোচনা পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাবে। খুব সংক্ষেপে এই কথাই বলা যায় যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সৃষ্ট বিপ্র২০ নীতি অত্যন্ত ঢিলেঢালা অগোছালো বাক্যাড়ম্বরের সমাহার মাত্র। এখানে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কিভাবে সেগুলি রূপায়ণ করা সম্ভবপর সে সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত নেই। যে প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত দেওয়া আছে, সেগুলি হয় অবাস্তব নয় হাস্যকর। সব চাইতে বড় কথা এই নীতি সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কোন্ মন্ত্রক দেখাশোনা করবে সে সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ উল্লেখ নেই। সরকারের উচিত এই নীতি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে কোনও একটি মন্ত্রকের অধীনে নতুন নীতি প্রণয়ন করা এবং মন্ত্রীসভার দ্বারা সেই নীতি অনুমোদিত করা। একটি সরকারি বিভাগ থেকে সৃষ্ট নীতিকে মেনে চলতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা অন্যান্য মন্ত্রক নিতে যাবে কেন?

[লেখাটি মহাভারত ম্যাগ নামক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।]


(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় মহাভারত পত্রিকায়।)