জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ - প্রসঙ্গ উচ্চশিক্ষা

প্রথম পর্বে বলেছিলাম স্কুলশিক্ষার উপক্রমণিকায় যা লেখা আছে তা "সতর্ক হয়ে না পড়লে অনেকেরই মনে হতে পারে যে এতদিন পর বোধহয় একটা সত্যিকারের জনহিতকর শিক্ষানীতি প্রণোদিত হল। কিন্তু খুব সুন্দর এবং ভালো কথাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক বিপজ্জনক পরিকল্পনা যার সাহায্যে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উৎপাটন করে সেখানে কিছু পরগাছা রোপণ করার চক্রান্ত চলেছে।" উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জাশী২০-এর দ্বিতীয় খণ্ডে ৯ নং ধারা থেকে ১৮ নং ধারা পর্য্যন্ত উচ্চশিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ৯ নং ধারায় শীর্ষক দেওয়া আছে "উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়: ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে নতুন এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী"। ৯.১ ধারায় নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে সংবিধানে যে গণতান্ত্রিক, সমদর্শী, সামাজিক চেতনাসম্পন্ন, সুসংস্কৃত এবং মানবিকতাবোধে সম্পৃক্ত ভারতের কল্পনা করা হয়েছে, যা সকলের জন্য স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে, তা একমাত্র সঠিক উচ্চশিক্ষার মাধ্যমেই আসতে পারে। ৯.১.১ উপধারায় বিস্তৃতভাবে বলা আছে একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা মাথায় রেখে এমন উচ্চমানের উচ্চশিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে যার ফলে সৎ, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের উদ্ভব হবে যারা এক বা একাধিক বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে উন্নতমানের চরিত্র গঠন করবে এবং একই সাথে সামাজিক ও সাংবিধানিক মূল্যবোধকে সবার ওপরে তুলে ধরবে। বৌদ্ধিক ঔৎসুক্য, বিজ্ঞানচেতনা ও সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গীকে মূলধন করে এরা বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নন্দনশাস্ত্র, সাহিত্য বা ভাষাতত্ত্বে স্বচ্ছন্দভাবে যাতায়াত করতে পারবে। তারা পেশাদারি বিদ্যা, প্রযুক্তি বিদ্যা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্যে বিভেদ ঘুচিয়ে ফেলবে। ৯.১.৩ উপধারায় আবার বলা আছে এমনভাবে উচ্চশিক্ষা দিতে হবে যাতে সবাই ব্যক্তিগত উন্নতির কথা না ভেবে সমগ্র দেশের এবং সমাজের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেয়।

(১) এরপর বর্তমান উচ্চশিক্ষার ত্রুটিগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৯.৩ ধারায় ভবিষ্যতে কিভাবে পরিবর্তন আনা হবে সেই বিষয়ে নয়টি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে আছে স্নাতক পাঠক্রমের কথা। এখন থেকে পাঠক্রম একদেশদর্শী না হয়ে নানাবিষয়ক (multidisciplinary) হবে। প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে স্কুলশিক্ষা পরিচালনা করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় light but tight সংস্থা থাকবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, কিন্তু ঐ সংস্থা কিভাবে গঠিত হবে সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আভাস কোথাও দেওয়া হয় নি। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষক ও প্রশাসক নির্বাচন এবং তাদের পদোন্নতি মেধার ভিত্তিতে করা হবে। তার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে ঐ light but tight সংস্থার ওপর।
(২) তবে দশম ধারাটি সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর শীর্ষক হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্বিন্যাস ও দৃঢ়ীকরণ। ১০.১ থেকে ১০.৩ ধারায় বলা হয়েছে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি আমাদের দেশে বর্তমানে বহুখণ্ডিত। জাশি২০-এর প্রধান উদ্দেশ্য হবে এগুলিকে কয়েকটি গুচ্ছে সংগঠিত করে প্রত্যেকটিকে বিশাল multidisciplinary বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা। ছাত্রদের স্বাধীনতা থাকবে তাদের পছন্দমত বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করার। যেমন তারা বিজ্ঞান থেকে একটি বিষয় নিতে পারে, এবং আরেকটি বিষয় সাহিত্য বা সঙ্গীত থেকে নির্বাচন করতে পারে। বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য, সাহিত্য থেকে ক্রীড়াশাস্ত্র সমস্ত বিভাগেই ছাত্ররা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারবে। জ্ঞানের এক বিভাগ থেকে অপর বিভাগে কোনও অলঙ্ঘনীয় দেওয়াল থাকবে না। এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হতে হবে অন্তত ৩০০০।

(৩) বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিক্ষা ও গবেষণা উভয় দিকেই তাদের কার্য্যধারা অব্যাহত রাখবে। যেখানে গবেষণা প্রাধান্য পাবে, তাদের বলা হবে গবেষণা-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় আর যেখানে ক্লাসরুম শিক্ষা প্রাধান্য পাবে তাদের বলা হবে শিক্ষণ-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়।

(৪) দেশে অবস্থিত মহাবিদ্যালয়গুলিকে পর্যায়ক্রমে স্বশাসনের সুযোগ দেওয়া হবে। এই কারণে একটি বিশেষ সর্বভারতীয় বোর্ড গঠিত হবে যারা এই বিবর্তনের পথে এগিয়ে চলার জন্য মহাবিদ্যালয়কে সঠিক নির্দেশ দিতে থাকবে এবং যখন বোর্ডের মনে হবে যে মহাবিদ্যালয়টি সম্পূর্ণভাবে এই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, তখন তাকে স্বশাসিত মহাবিদ্যালয় হিসাবে অনুমোদন দেওয়া হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি প্রধানত স্নাতক স্তরের শিক্ষার বিষয়ে বিশেষ প্রযত্ন নেবে। এরা স্বাধীনভাবে ছাত্রদের ডিগ্রী দিতে পারবে এবং তাদের ছাত্রসংখ্যা অত বিশাল না হলেও চলবে। ভবিষ্যতে এদের স্নাতোকোত্তর পর্যায়ে উন্নত করার চেষ্টা করা হবে।

(৫) ১০.৭ ধারা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় সব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নিয়ে আসতে হবে। যারা তা পারবে না, তাদের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত মহাবিদ্যালয় হিসাবে পরিগণিত করা হবে। ১০.৮ ধারায় বলা হয়েছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যেক জেলায় অন্তত একটি করে এই ধরণের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে Gross Enrollment Ratio বা GER যা ২০১৮ সালে ছিল শতকরা ২৬.৩, তা ২০৩৫ সালে শতকরা ৫০-এ গিয়ে দাঁড়াবে। (GER-এর অর্থ একটি নির্দিষ্ট বয়স সীমার মধ্যে কতজন শিক্ষা পাওয়ার যোগ্য আর কতজন সত্যিই শিক্ষা পাচ্ছে তার অনুপাতের শতকরা হিসাব)। বলা হয়েছে (১০.৯ ধারা) সরকারী এবং বেসরকারী উভয় ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাশী২০-এর ভাবধারা অবলম্বন করে উন্নত করতে হবে। আর সেই প্রচেষ্টায় তারা উভয়েই সরকারের কাছ থেকে উৎসাহপ্রদ সাহায্য পাবে।

(৬) ১০.১১ ধারায় বলা হয়েছে যে বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শুধুমাত্র একটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় (Single-stream HEI)। কাদের এই ধরণের প্রতিষ্ঠানের ভেতর গণ্য করা যায়, সে সম্বন্ধে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা কোথাও দেওয়া নেই। খুব সম্ভবত Single-stream HEI বলতে বোঝানো হয়েছে অগণ্য টেকনিকাল কলেজ বা গবেষণাগারগুলিকে। এরা সরকারী অনুদানে চলুক বা বেসরকারী সাহায্যে চলুক, এদের প্রায় সবারই স্বশাসনের স্বাধীনতা আছে। বলা হয়েছে এরা যদি নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে নিজেদের উন্নত করতে না পারে, তাহলে এরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান হিসাবেই গণ্য হবে। দশম ধারার সর্বশেষ উপধারায় বলা হয়েছে যে এখন এদেশে বিভিন্ন ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে, যেমন Deemed University, Technical University বা Unitary University ইত্যাদি। এই রকম বিভিন্নতা আর থাকতে দেওয়া হবে না। সমস্ত বিভেদ ঘুচে গিয়ে এদের সবাইকে জাশি২০ প্রদত্ত মান অনুযায়ী উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে হবে।

প্রবর্তিত উচ্চশিক্ষাপাঠক্রম

একাদশ ধারা থেকে পাঠক্রমগুলি কি রকম হবে তার একটা ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে যে অনেকের ধারণা আছে যে liberal arts কথাটা বোধহয় প্রতীচ্য প্রভাবে এসেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে এই প্রকার শিক্ষাব্যবস্থার প্রাচীন মূলধারা আছে। যেমন বাণভট্টের কাদম্বরীতে শিক্ষাব্যবস্থা বলার সময় ৬৪ কলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বিজ্ঞান ও সাহিত্য সবই আছে। (আমি অবশ্য কাদম্বরীতে ৬৪ কলার উল্লেখ খুঁজে পাই নি। বাণভট্টের আগের শতাব্দীর লেখক বাৎসায়নের কামসূত্রে এর উল্লেখ আছে। কোনও সহৃদয় ব্যক্তি এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করলে আমি বাধিত হব।)

(ক) ১১.২ ও ১১.৩ ধারায় বলা হয়েছে স্নাতক স্তর থেকেই এমন ভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে যাতে, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, যন্ত্রবিদ্যা, গণিত সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এর ফলেই এমন সব ছাত্রছাত্রীরা গঠিত হবে যারা একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা অনুযায়ী সমস্ত বিদ্যায় চৌকস (all round development) হয়ে উঠবে।

(খ) ১১.৫ ধারায় বলা হয়েছে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম শেষ করে ফেলতে হয়। নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় সেই বাঁধন খুলে দেওয়া হবে। একজন চাইলে অনেক বার পাঠক্রমের মাঝপথে পড়া বন্ধ রেখে অন্য কিছু করতে পারে, আবার কিছুদিন বাদে ফিরে এসে পাঠক্রমে যোগ দিতে পারে (multiple entry and exit points)।

(গ) ১১.৭ ধারা অনুযায়ী সমস্ত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরণের বিষয় একযোগে পড়াতে হবে, যেমন ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন, ভারততত্ত্ব, শিল্পকলা, নৃত্যকলা, অভিনয়কলা, শিক্ষা, গণিত, সংখ্যাতত্ত্ব, বিশুদ্ধ ও ব্যবহারিক বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ক্রীড়াবিদ্যা, অনুবাদকরণ, ভাষান্তরকরণ এবং আরও অন্যান্য বিষয়। যে কোনও বিষয়ে খানিকটা শিক্ষায়তনে থেকে পড়া যাবে আবার বাকি অংশ open and distant learning-এর মাধ্যমে পড়ার অনুমতি দেওয়া হবে।

(ঘ) পরের ধারায় (১১.৮) বলা হয়েছে যে এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থার ফলে শিক্ষার্থীরা পরিবেশ বিজ্ঞান সম্বন্ধে সজাগ হবে এবং মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। এই মূল্যবোধ হল মানবিক, নৈতিক, সাংবিধানিক ও বিশ্বজনীন একাত্মতার মূল্যবোধ। সত্য, ধর্ম, শান্তি, প্রেম, অহিংসা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং মানবসেবার আদর্শে গড়ে ওঠার ফলে শিক্ষার্থীরা বিশ্বনাগরিকত্ব শিক্ষায় (Global Citizenship Education, GCED) শিক্ষিত হয়ে উঠবে।

(ঙ) বলা হয়েছে (১১.৯ ধারা) স্নাতক শিক্ষা ২, ৩ বা ৪ বছরের করা যেতে পারে। তবে ৪ বছরকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ১ বছর পড়ার পর তারা একটা শংসাপত্র নিয়ে শিক্ষায়তন থেকে বেড়িয়ে যেতে পারবে। ঠিক তেমনি ২ বা ৩ বছরের পরও পারবে। আবার তাদের পড়াশোনা করার ইচ্ছা হলে পরবর্তী যে কোনও সময় ভারতের যে কোনও শিক্ষায়তন থেকে পরবর্তী বছরের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। একই বিষয় নিয়ে পড়তে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। শিক্ষায়তন থেকে না পড়ে তারা open and distant learning-এর মাধ্যমেও পড়তে পারবে। তাতে তাদের স্নাতকের শংসাপত্র পাওয়ায় কোন বাধা থাকবে না। একটা (Academic Bank of Credit, ABC) সৃষ্টি করা হবে। সেখানে ভারতের যে কোনও ছাত্র সারা জীবন ধরে কত ক্রেডিট সংগ্রহ করতে পেরেছে তার হিসাব থাকবে। সেই অনুযায়ী শংসাপত্র দেওয়া হবে। ৪ বছরের কোর্সে শেষ বছরটি গবেষণামূলক থিসিস করা যেতে পারে।

(চ) ১১.১০ ধারায় লেখা আছে যদি কেউ ৪ বছরের স্নাতক শিক্ষায় শেষ বছরটিতে গবেষণা করে তাহলে সে সরাসরি পি এইচ ডি গবেষণায় ঢুকে যেতে পারবে। না হলে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাগবে। এখন থেকে এম ফিল প্রোগ্রাম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। ১২ নং ধারায় কি পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করবে, সেই বিষয়ে বিস্তৃতভাবে বলা আছে। বলা হয়েছে যে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার সময় তাদের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে না। সারা বছর তারা কি রকম পড়াশোনা করেছে, সেই বিষয়ে শিক্ষকের মতামতের ওপর জোর দেওয়া হবে। Choice Based Credit Systemকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

(ছ) শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা এবং ক্যাম্পাসে অন্যান্য সুযোগসুবিধা (১২.৭) এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা এখানে এসে পড়ার জন্য আকর্ষণ অনুভব করে। ভারতের চিকিৎসাবিদ্যা, যোগশিক্ষা, ভারতীয় চিত্রকলা এবং আরও বহু বিষয় জানার জন্য বিদেশী শিক্ষার্থীরা খুবই আগ্রহী। এইভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের নাম ছড়িয়ে দিতে পারলে ভারত আবার "বিশ্বগুরু" নাম পুনরুদ্ধার করতে পারবে। (ভারত অতীতে কবে বিশ্বগুরু নামে খ্যাত হয়েছিল, সেই তথ্য বর্তমান লেখকের জানা নেই। কেউ তথ্যটি দিলে বাধিত হব।) পৃথিবীর সেরা একশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের সাথে চুক্তি করে হবে। যার ফলে ছাত্র ও শিক্ষক দুই দেশের মধ্যে আদান প্রদান হতে পারবে। ভারতীয় শিক্ষার্থীরা কিছুটা এখানে পড়ে এবং কিছুটা বিদেশে পড়ে ডিগ্রী নিতে পারবে।

প্রবর্তিত শিক্ষানীতি ও পাঠক্রমে গলদ কোথায়?

ওপরে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। নীচে সংক্ষিপ্ত আকারে সেগুলি আবার লিখছি। প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে

(১) একটি light but tight কেন্দ্রীয় সংস্থা থাকবে যারা শিক্ষক ও প্রশাসক নির্বাচন এবং তাদের পদোন্নতি মেধার ভিত্তিতে স্থির করবে। আমাদের এত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বা পদোন্নতি সব চাইতে বড় দুর্নীতির আঁতুরঘর। শুনতে যতই মধুর হোক না কেন, এর মাধ্যমেই জন্ম নেয় পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপোষণ। তার ওপর সারা ভারতবর্ষের সমস্ত পদগুলির হর্তাকর্তাবিধাতা যদি একটি সংস্থা হয়, তাহলে সেখানে কি পরিমাণে বেয়াইনি অর্থের প্রবাহ হবে, তা সহজেই কল্পনা করা যায়।

(২) সব চাইতে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নানাবিষয়ক (multidisciplinary) অধ্যয়নের ওপর। শুধু অধ্যয়নই নয়, ছাত্ররা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ পূর্বক(যেমন বিজ্ঞান থেকে কলা বা কলা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি) বিষয় নির্বাচন করার স্বাধীনতা পাবে। এর ফলে সমগ্র শিক্ষায়তনে একটিমাত্র টাইমটেবিল থাকবে না, প্রতিটি ছাত্রের জন্য আলাদা আলাদা টাইমটেবিল তৈরী করতে হবে। তাদের সেই অনুযায়ী ক্লাসরুম এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অল্প কয়েকশ ছাত্র হলে বা অল্প কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে নির্বাচনের স্বাধীনতা আবদ্ধ রাখলে কিছুটা সম্ভবপর হতে পারে। কিন্তু ৩০০০ ছাত্রের জন্য তা করা শুধু কঠিন নয়, অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। বর্তমান লেখকের এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে বলেই এত জোর দিয়ে কথাগুলি বলতে পারছি।
(৩) বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে গবেষণা-প্রধাণ ও শিক্ষণ-প্রধাণ এই দুই ভাগে ভাগ করার অসুবিধাগুলি তৃতীয় ও অন্তিম পর্বে আলোচনা করব।

(৪) মহাবিদ্যালয়গুলিকে স্বশাসিত করে ফেলার প্রস্তাব এই সরকার নতুন দিচ্ছেন না। পূর্বতন কংগ্রেস সরকার এই ভাবধারা চালু করেছিলেন। এর বিষময় ফল আমরা প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছি। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেই তা দেখা যাবে। বেশী দূরে যেতে হবে না। ইতিমধ্যেই অনেকগুলি কলেজ স্বায়ত্বশাসন পেয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স খুলে ফেলেছে। ফলে তাদের দু পয়সা অর্থাগমও হচ্ছে। বাস্তবিক অবস্থা হল, সেখানে কি পড়ানো হচ্ছে বা কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ কারও নেই (যদিও খাতায় কলমে অনেক কিছু লেখা আছে)। অথচ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে কলেজটি চলছে, তাদের ছাপা এবং সই করা সার্টিফিকেটে ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রি দেওয়া হয়। নবঘোষিত শিক্ষানীতিতে আর এক ধাপ এগিয়ে বলা হচ্ছে এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রয়োজন হবে না। কলেজ নিজেই তাদের ডিগ্রি দিয়ে দিতে পারবে।

(৫) এই প্রথম শিক্ষানীতিতে পরিষ্কারভাবে ঘোষিত হল যে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সরকারের কাছ থেকে অর্থসাহায্য পাবে। শুধু অর্থসাহায্যই নয়, সব রকম সহায়তাই পাবে। এতকাল নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই ধরণের সাহায্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি পেয়ে আসছিল, যেমন ট্যাক্সে সুবিধা দেওয়া বা সরকারের সহায়তায় বিশাল পরিমাণ জমি পাওয়া ইত্যাদি। এবার আর সেই সব মুখোশের প্রয়োজন থাকবে না। সরকারি আইন দেখিয়ে খোলাখুলি তাদের সাহায্য করা যাবে।

এবার প্রবর্তিত উচ্চশিক্ষাপাঠক্রমে কি কি বলা হয়েছে দেখা যাক।

(ক) প্রথমে বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এত বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হবে, যে তারা সমস্ত বিদ্যায় চৌকস হয়ে উঠবে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বৈপ্লবিক ধারণা। এর আগে কোনও শিক্ষাবিদকে এই কথা বলতে শুনি নি। অনেকগুলি বিষয়ে ভাসা ভাসা পল্লবগ্রাহী পাণ্ডিত্যের ফলে কেউ যে allrounder হয়ে উঠতে পারে তা জানা ছিল না। তাই যদি হয়, তাহলে Jack of all trades and master of none কথাটি চালু হল কি করে?

(খ) বলা হয়েছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনও শিক্ষা শেষ করার বাধ্যবাধকতা আর থাকবে না। শিক্ষার্থীরা যে কোনও বৎসরান্তে ঐ বছরের কোর্স শেষ করার একটা সার্টিফিকেট নিয়ে বেড়িয়ে যেতে পারবে। তারপর তারা যা খুশি করতে পারে। পরে আবার যখন ইচ্ছা হবে তখন আবার পড়াশুনা শুরু করতে পারে। কিন্তু ঐ কলেজেই পড়তে হবে এমন কোনও বিধিনিষেধ নেই। ভারতের যে কোনও শিক্ষায়তনে পরের বছরের কোর্স শুরু করতে পারে। সব চাইতে মজার ব্যাপার হল, তাকে যে একই বিষয় নিয়ে পড়তে হবে এমন কোনও কথা নেই। মনে করা যাক সে প্রথম বছর অঙ্ক নিয়ে পড়াশুনা করল, দ্বিতীয় বছর সঙ্গীত নিয়ে সার্টিফিকেট পেল। তৃতীয় বছর সাহিত্য নিয়ে পড়ল। তিন বছর পরে সে কিন্তু স্নাতক ডিগ্রিই পাবে। এই নিয়ম চালু করার ফলে বর্তমান সরকার কি বিশেষ সুবিধা পাবে, তা একটু আলোচনা করা যাক। multiple exit points-এ যারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য পড়াশোনা স্থগিত রাখবে, তাদের সব সময় শিক্ষার্থী হিসাবেই গণ্য করা হবে। বিশাল ভারতবর্ষে প্রচুর ব্যবসা চালানোর জন্য অনেক লোকবল প্রয়োজন। সমস্ত যুবক যুবতী যদি শুধু লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে এই সব ব্যবসা চালানো অসম্ভব। exit points-এ বেড়িয়ে আসা ছেলেমেয়েরা কিছুদিনের জন্য কল কারখানায় বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে। হয়ত তাদের মায়নার বদলে একটা ফেলোশিপ দেওয়া হবে। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্ম অব্যাহত থাকবে। কারণ প্রতি বছর নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা এক বা দু বছরের জন্য লেখাপড়া থেকে অবসর নিয়ে কিছু পারিশ্রমিকের পরিবর্তে এই কাজগুলি চালিয়ে যেতে পারবে। যেহেতু এরা ঐ সময় শিক্ষার্থী হিসাবেই গণ্য হবে, কাজেই GER-এর হিসাবে আমাদের দেশ হৈ হৈ করে এগিয়ে যেতে থাকবে। কিছুদিনের মধ্যেই GER-এর নিরিখে আমরা শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত দেশগুলির সমকক্ষ হয়ে যাব বা তাদের থেকে এগিয়ে যাব। ইউনেস্কো থেকে ভারতবর্ষকে মডেল দেশ হিসাবে অভিহিত করা হবে।

(গ) একবার ভেবে দেখুন বিভিন্ন বিষয় একযোগে পড়াতে হবে বলে যে বিষয়সূচী দেওয়া আছে, তা কটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে পড়ানো সম্ভবপর। আসল চাবিকাঠি আছে শেষ লাইনে। অনেকগুলি বিষয়ই থাকবে ইন্টারনেটে বা কিছু অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেগুলি ODL করে পড়ে নিলেই হবে। এই রকম অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে শুরু হয়ে গেছে। এরা ডিগ্রি দেয়। এদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন জায়গায় কোর্স পড়ানো হয়, কিন্তু এদের কোনও অফিস নেই। সেগুলি সব virtual।

(ঘ) বিশ্বনাগরিকত্ব শিক্ষা কেবল গালভরা বুলি মাত্র। এগুলির জন্মদাতা হল ইউনেস্কো। প্রথমে শেখানো উচিত কিভাবে একজন শিক্ষার্থী সৎ ভারতীয় হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারে। শিক্ষার মূল অভিমুখ সেই দিকেই থাকা উচিত। একজন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত লোকের পক্ষেই বিশ্বনাগরিকতার মূল্যবোধ যাচাই করা সম্ভবপর। সেজন্য পাঠক্রমের পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

(ঙ) যেহেতু শিক্ষার্থীরা ভারতের যে কোনও স্থানে যে কোনও শিক্ষায়তন থেকে যে কোনও সময় যে কোনও বিষয় নিয়ে পড়ার স্বাধীনতা পাবে, কাজেই তাদের Academic Bank of Credit বা ABC-এর রেকর্ড রাখা অবশ্যই জরুরী। কিন্তু প্রশ্ন হল তাদের মূল্যায়নে সমতা রক্ষা করা যাবে কি? একই বোর্ডে একই পাঠক্রমের মাধ্যমে পড়ানো ছাত্রদের যখন ঐ বোর্ডের শিক্ষকদের দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়, তখন তার ভেতরই আকাশ পাতাল পার্থক্য প্রতি বছর আমাদের নজরে আসে। সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন স্থানের শিক্ষকদের মূল্যায়নে সমতা আনা প্রায় আকাশ কুসুম কল্পনা, ফলে ক্রেডিটের রেকর্ডেরও খুব একটা মূল্য থাকবে না। এগুলি একেবারেই আলঙ্কারিক ভূষণ হবে।

(চ) দেখা যাচ্ছে নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে চার বছরের স্নাতক হওয়ার পরই সরাসরি পি এইচ ডি করতে পারবে। ডক্টরেট করার সময় সীমা কমিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা পূর্বতন সরকারের থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেক শিক্ষায়তনে বলা হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে পি এইচ ডি শেষ করে ফেলতে হবে, না হলে তাদের ফেলোশিপ বন্ধ করে দেওয়া হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার অনুদানের মাত্রা প্রতি বছর কমাতে থাকত। অর্থাৎ শিক্ষার্থী যত বরিষ্ঠ হবে, ততই তার মাসিক অর্থোপার্জন কমতে থাকবে। এইভাবে একটা চাপ সৃষ্টি করা হত যাতে ছাত্ররা তাড়াতাড়ি ডক্টরেট শেষ করে ফেলে। অর্থাৎ মনে করা হত, চাপ না দিলে গবেষকরা ডক্টরেট ডিগ্রী পেতে ইচ্ছাকৃত দেরী করবে। এই ধারণা একমাত্র তারাই করতে পারে যারা কোনওদিন গবেষণার সাথে যুক্ত নন। প্রতিটি ছাত্রছাত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডক্টরেট শেষ করে ফেলতে। অনর্থক এই চাপ সৃষ্টি করে মানসিক উত্তেজনা বাড়ালে আখেরে তাদের ক্ষতিই করা হয়। আমি জানি না, কেন্দ্রীয় সরকারের খুব চটজলদি ডক্টরেট তৈরীর এই আগ্রহ কেন। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু প্রদর্শন করে বাহবা নেবার ব্যাপার আছে। এই প্রহেলিকা বর্তমান লেখকের চিন্তাশক্তির বাইরে।

১২ নং ধারায় ছাত্র মূল্যায়নের বিষয়ে আর একটি ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক কথা বলা আছে। বলা হচ্ছে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে তাদের মূল্যায়নের প্রয়োজন নেই। তারা সারা বছর কেমন পড়াশুনা করেছে, তাতে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এই মূল্যায়ন অর্থপূর্ণ তখনই হয়, যখন ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা খুব কম থাকে এবং একই শিক্ষক তাকে বহু সময় ধরে নিরপক্ষভাবে লক্ষ্য করে থাকে। কিন্তু যে প্রেক্ষিতে এই ধরণের মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে এই ব্যবস্থা অর্থের বিনিময়ে ভাল ক্রেডিট পাওয়ার রাস্তা খুলে দেবে না ত'?

(ছ) বলা হচ্ছে পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এমন চুক্তিতে আবদ্ধ হবে যে শিক্ষার্থীরা কিছুটা এখানে পড়ে বাকিটা বিদেশে পড়ে ডিগ্রী পেতে পারবে। একেবারে প্রথম শ্রেণির বিদেশি শিক্ষায়তন ছাড়া অনেক মোটামুটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ই খুব খুশী হবে যদি প্রতি বছর কিছু ছাত্র নিজের পয়সা খরচ করে তাদের টিউশন ফি দিয়ে সেখানকার কোনও একটি কোর্স পড়তে যায়। এর ফলে তাদের অনায়াসে কিছু অর্থাগম হবে, অথচ কোনও দায়িত্বই নিতে হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমি একটি উদাহরণের উল্লেখ করতে চাই। এই ধরণের আরও উদাহরণ নিশ্চয়ই আছে। তবে মনে হয় একটা উদাহরণেই সবার চোখ খুলে যাবে। হরিয়ানার সিধ্রাওয়ালিতে হিরো কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত বি এম এল মুঞ্জাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এ ভর্তির বিজ্ঞাপন দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। এখানে প্রতি বছর হোস্টেল ফি এক লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা। কিন্তু টিউশন ফি দু রকম। বলা হয়েছে GLP সহ সার্টিফিকেট নিলে তিন বছরে লাগবে ৯ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা, কিন্তু GLP না নিলে মাত্র ৬ লক্ষ টাকা। আমি অবাক হলাম একই কোর্সের ছাত্রদের কাছ থেকে দু রকম ফি কি করে নেয়। আর GLP জিনিষটাই বা কি? সবিস্ময়ে internet-এ দেখলাম GLP অর্থ Good Laboratory Practice। এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয় সিঙ্গাপুর থেকে। কিন্তু একজন বি এ ছাত্রর জন্য এই মূল্যায়ন কি গুরুত্ব বহন করে? পরে বুঝলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে GLPর অর্থ Global Leadership Programme। এটা একটা তিন সপ্তাহের কোর্স লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে থেকে দেওয়া হয়। সাড়ে তিন লাখ টাকা বেশী দিলে ছাত্ররা এই কোর্স পড়ার সুযোগ পাবে। তবে এই টাকার বিনিময়ে তাদের তিন সপ্তাহ হোস্টেলে থাকতে দেবে আর লাঞ্চ দেবে, বাদবাকি সব খরচ, অর্থাৎ ভিসা বা যাতায়াতের বিমান ভাড়া থেকে রাত্রের খাবার পর্য্যন্ত সব নিজেদের ব্যবস্থা করতে হবে। কি সুন্দর সিদ্ধান্ত। ছাত্রটির একটি অতিরিক্ত সার্টিফিকেট হয়ে গেল আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রায় কিছুই না করে বেশ কিছু টাকা অতিরিক্ত রোজগার করতে পারল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি এই সিদ্ধান্ত কোনও আইন ভেঙ্গে করে নি। জাশী২০র ১২.৮ ধারার একদম শেষ বাক্যে বলা আছে, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আহরিত কোনও যোগ্যতা আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে শিক্ষার্থীর ডিগ্রি দানের জন্য সহায়ক বলে গণ্য করতে পারে।

১২ নং ধারাতে আরও বলা আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো এত আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, যাতে বিদেশী ছাত্ররা এখানে এসে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় বোধহয় এই প্রচেষ্টা অসম্ভব। এদেশে বিদেশী ছাত্র কিছু পড়তে আসে, কিন্তু তা যৎসামান্য। তাছাড়া বিদেশীদের আকর্ষণ করতে হলে উন্নত মানের হোষ্টেল, ক্যান্টিন, চূড়ান্ত মাত্রায় ইন্টারনেটের সুবিধাভোগ ইত্যাদি সুবিধাগুলি ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকতে হবে। ভাল শপিং মল বা নাইট ক্যান্টিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত আন্তর্জাতিক স্তরে রাখতে হলে প্রচুর পরিমাণে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া বেশ কিছু দেশী ও বিদেশী স্বনামধন্য ব্যক্তিকে অতিথি শিক্ষক হিসাবে আহ্বান জানাতে হবে। এর জন্য প্রচুর অর্থের যোগান চাই, যা সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভবপর নয়। অতএব একমাত্র প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এই ধরণের একটা প্রচেষ্টা নিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু সেখানে সব ছাত্রকেই প্রচুর টাকা দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। শুধুমাত্র বিদেশী ছাত্রদের নিয়ে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী অন্তত ৩০০০ ছাত্রসংখ্যায় না পৌঁছুতে পারলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় আখ্যা দেওয়া যাবে না। আমাদের মত ছাপোষা লোকদের মনে হয় এই প্রস্তাব কার্যকারী করা কখনও সম্ভবপর নয়। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল আমাদের মত লোকেরা এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন নি। যারা করেছেন, তারা ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য সম্বন্ধে সবিশেষ সচেতন। তারা খুব ভালভাবেই জানেন যে যথেষ্ট লাভের আশা না থাকলে কেউ এই প্রচেষ্টায় এত টাকা বিনিয়োগ করবে না। তাই সন্তর্পনে বিশেষ ঢাকঢোল না পিটিয়ে গত দশ-বার বছর ধরে এরা অনেকগুলি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষামূলকভাবে খুলে ফেলেছেন। দেখা যাক সেগুলির বর্তমান অবস্থা কি। সেগুলি কি ৩০০০ ছাত্রসংখ্যায় পৌঁছাতে পেরেছে? সেগুলিতে কি বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা অর্থব্যয় করে পড়তে আসে? বাস্তব অবস্থা শুনলে আমার মত অনেকেরই চোখ কপালে ঠেকবে।

  • লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভারসিটি ২০০৬ সালে পাঞ্জাবের ফাগওয়ারাতে শুরু হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৬০০ একরেরও বেশী জমি নিয়ে বিস্তৃত। বর্তমানে এর ছাত্রসংখ্যা ত্রিশ হাজারের ওপরে, তার মধ্যে ৬০০০ ছাত্র বিদেশী, তারা ৭০টি বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। ভারতের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের (বর্তমানে যাকে পুনর্বার শিক্ষা মন্ত্রক হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে) তত্ত্বাবধানে National Institute Ranking Framework প্রতি বছর ভারতে অবস্থিত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে র‍্যাঙ্কিং দেয়, যাকে বলা হয় NIRF র‍্যাঙ্কিং। তাতে লাভলি প্রথম ১০০-এর মধ্যে সব সময় থাকে।
  • হরিয়ানার সোনিপাথের ও পি জিন্ডাল ইউনিভারসিটি ২০০৯ সালে শুরু হয়েছিল। এখন তার ছাত্রসংখ্যা ৬৬৫০, বেশ কিছু বিদেশী ছাত্র ১৭টি দেশ থেকে পড়তে এসেছে।এখানে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত ১ঃ৮, অর্থাৎ প্রতি ৮ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক আছেন। বর্তমানে ৮৩২ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৪% শিক্ষক বিদেশী। তারা এসেছে ইউ এস এ, ইউ কে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স ও জার্মানী থেকে।
  • পারুল ইউনিভারসিটি গুজরাটের বদোদরায় ২০০৯ সালে ১৫০ একরের ওপর বিস্তৃত ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছিল। এখন সেখানে ২৮০০০ ছাত্র পড়ছে, তার মধ্যে বিদেশী ১২০০। তারা ৫০টি বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে।
  • হরিয়ানার গুরগাঁও-এ ৬০ একরের ওপর বেশী জমি নিয়ে ২০১৩ সালে শুরু করেছিল জি ডি গোয়েঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়। এখন তার ছাত্রসংখ্যা ৩০০০ ছাপিয়ে গেছে। ৪৫টি দেশ থেকে সেখানে ছাত্ররা পড়তে আসে।
  • অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ২০১৪ সালে। বর্তমানে তার ছাত্রসংখ্যা ২৫০০। ২৭টি দেশ থেকে সেখানে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে।

দেখা যাচ্ছে আমাদের ধারণাগুলি ভুল। প্রতি বছর বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ক্ষমতা ভারতবর্ষের অনেক অভিভাবকেরই আছে। এত বিদেশী ছাত্র কোথা থেকে এল? এরা বেশীর ভাগ আসে আফ্রিকা ও সার্কের দেশগুলি থেকে। এদের দেশে পড়ার মত ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই হয়। এরা আগে ইউরোপে বা আমেরিকায় পড়তে যেত। এখন ভারতে বিশাল ক্যাম্পাস, সুন্দর হোস্টেল ও অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পাড়ি জমাচ্ছে। এখানে পড়ার খরচও তুলনামূলকভাবে কম। সেই জন্য এই সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে।
আমাদের এতটা ভুল ধারণা হল কেন? তার কারণ আমরা যাদের সাথে চলাফেরা ওঠাবসা করি, তাদের প্রায় কারোরই লক্ষ টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সাধ্য নেই। কিন্তু শতকরা দশভাগ অভিভাবক আছে, যারা তাদের সন্তানদের একটু তথাকথিত 'সুন্দর' পরিবেশে রেখে, 'সত্যিকারের' শিক্ষা দিয়ে বড় করার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে দ্বিধাবোধ করেন না। ভারতবর্ষ এত বড় দেশ যে শতকরা দশভাগ খুব একটা কম সংখ্যা নয়, অনেক ইউরোপীয় দেশের জনসংখ্যার চাইতে বেশী। কাজেই এই সব প্রাইভেট ইউনিভারসিটিগুলি যথেষ্ট ছাত্র পাবে এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই পরিগণিত হবে। অতএব ১০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষার ব্যবসা জাঁকিয়ে বসুক। পূর্বতন রাজীব সরকার এবং বর্তমান মোদী সরকারের প্রসাদধন্য এই ব্যবসায়ীদের দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি হোক। তাতে আমাদের আপত্তি করার কিছুই নেই। কতকিছু নিয়েই ত' লোকে দুহাতে কামাচ্ছে, যেমন খনিজ সম্পদ, জল, অরণ্য এবং আরও কত কি। কিছু লোক না হয় শিক্ষা বিক্রী করে পয়সা করুক। এই সব শিক্ষাব্যবসায়ীদের নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

 

কী নিয়ে আমরা চিন্তিত ?

এতক্ষণ পর্য্যন্ত যে সব 'সুন্দর' পরিবেশ সম্পন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা বললাম, সেখানে পড়ার খরচের বহর কি রকম সে সম্বন্ধে পাঠকদের একটু ধারণা দেওয়া যাক। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে অনেকগুলি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এবং খুব ভালভাবেই চলছে। যেমন, অশোকা (সোনিপত), ও পি জিন্ডাল (সোনিপত), ক্রিয়া (অন্ধ্র প্রদেশ), Flame (পুনে), জি ডি গোয়েঙ্কা (গুরগাঁও), বি এম এল মুঞ্জাল (গুরগাঁও) , আমিটি (নয়ডা, কলকাতা), লাভলি (জলন্ধর), পারুল (ভরোদরা), Bennett (নয়ডা), সারদা (নয়ডা), মানব রচনা (ফরিদাবাদ) , চন্ডিগর বিশ্ববিদ্যালয় (চন্ডিগর), আজিম প্রেমজি (বাঙ্গালোর) ইত্যাদি ইত্যাদি। ধরা যাক কোন শিক্ষার্থী বি এ (Bachelor of Arts) ডিগ্রি পাওয়ার জন্য এর কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাহলে তার কত টাকা খরচ হবে? আমি বি এ ডিগ্রীকেই মাপকাঠি করে খরচের ধারণা দিতে চাই, কারণ সবাই জানি বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তুলনায় সাহিত্যে পড়াশোনা করা খরচ অনেক কম। নীচে একটা তালিকা দিলাম। তার থেকেই বিষয়টির গুরুত্ব টের পাওয়া যাবে।

  • অশোকা: প্রতি বছর টিউশন ফি ৭ লক্ষ পঁচাশী হাজার টাকা, হোস্টেল ফি (খাবার বাদে) ১ লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার টাকা। ভর্তি ফি ইত্যাদি সহ তিন বছর পড়তে মোট খরচ ২৯ লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা।
  • ও পি জিন্ডাল: প্রতি বছর টিউশন ফি সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা, হোস্টেল ফি ২ লক্ষ চল্লিশ হাজার (শতকরা ১০ ভাগ প্রতি বছর বাড়বে), ভর্তি ফি ইত্যাদি সহ মোট খরচ ২৭ লক্ষ টাকা।
  • KREA, Sri City, A.P.: মোট টিউশন ফি সাড়ে উনিশ লক্ষ টাকা। হোস্টেল ফি দেওয়া নেই।
  • Flame, পুণে: মোট খরচ প্রতি বছর ৮ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। তিন বছরে ২৪ লক্ষ ৩০ হাজার হওয়া উচিৎ। কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে বি এ কোর্স চার বছরের হতে পারে, তাহলে খরচ পড়বে ৩২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।

সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ফি লিখে অনর্থক পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না। তবে কোন জায়গাতেই টিউশন ফি বছরে দু লাখের কম নয়। এইবার কয়েকটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

(১) প্রেসিডেন্সি, কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর টিউশন ফি দু হাজারের আশেপাশে। নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সেই ফি ১০০ থেকে ৩০০ গুণ বেশী।

(২) কলকাতা, যাদবপুর ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় মুখ্যত রাজ্য সরকারের অনুদানে চলে। যদি রাজ্য সরকার ভেবে থাকেন যে তারা অনুদান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সচল রাখবেন, তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। কারণ, কোন্ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে আর কারা অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ হিসাবে কাজ করবে, সেই বিষয় শেষ সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রের accreditation board। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে প্রাথমিক মতামত নেওয়া হতেও পারে। কিন্তু কেন্দ্রের বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে। জাশি২০তে ৯.৩ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে একটা “light but tight” কর্ত্তৃত্ব সৃষ্টি করা হবে। তারাই স্থির করবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভাল ভাবে চলছে আর কারা চলছে না। তাদের মতানুযায়ী যদি জে এন ইউ বা যাদবপুরকে নিম্নমানের বলে চিহ্নিত করা হয়, আর বেদ বিজ্ঞান সোধ সংস্থানকে উচ্চমানের শিক্ষায়তন বলা হয়, তবে তাই হবে। শেষোক্ত সংস্থাটির নাম আমি উল্লেখ করলাম, কারণ এর নাম আমি আগে কখনও শুনি নি। হয়ত আপনারাও শোনেন নি। কারণ খুব সম্প্রতি এই সংস্থাটি ব্যাঙ্গালোরে সৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এদের কর্তাব্যক্তি নয়া শিক্ষানীতি প্রণয়নের কমিটির সভ্য ছিলেন।

(৩) আগেই উল্লেখ করেছি যে নয়া শিক্ষানীতি অনুসারে বি এ এবং বি এস সি ডিগ্রি ২ বছরে, ৩ বছরে বা ৪ বছরে দেওয়া যেতে পারে। তবে ৪ বছরের ডিগ্রিকে সব সময় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। দেখলাম কিছু শিক্ষাবিদ এই প্রস্তাবের প্রশংসা করে বলেছেন, এর ফলে নাকি আমাদের ছাত্ররা বিদেশে পড়াশোনা করতে গেলে কিছু সুবিধা পাবে। আমাদের ছাত্রদের শতকরা কত জন প্রতি বছর বিদেশে পড়াশোনার জন্য যাত্রা করে? কিন্তু মজার ব্যাপার এটা এখনও প্রস্তাবের আকারে আছে, আর এর মধ্যেই অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ বছরের কোর্স চালু করে দিয়েছে। কি আশ্চর্য্য তৎপরতা! আজিম প্রেমজি, ফ্লেম, তাদের brochure-এ এই কথা ঘোষণা করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, জাশী২০ প্রণয়ন কমিটির সভ্যদের মধ্যে অনেকেই নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে যুক্ত আছেন বা ছিলেন।

যাই হোক, শতকরা দশভাগ ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়ের এতটাই সামর্থ্য আছে যে তারা এই সব দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারবেন। আমরা ভাবছি বাকি ৯০ শতাংশ অভিভাবকদের ছেলেমেয়েরা কোথায় উচ্চশিক্ষা নেবে। এই বিষয়ে জাশী২০তে কোনও বিশদ নক্সা আঁকা নেই। আমি এরপর যা বলব, সেটা নিছক আমার কল্পনা মাত্র। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রণেতারা এসব কিছু বলেন নি। এই কল্পনা কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। গত কয়েক দশক ধরে ভারতবর্ষে স্কুলগুলির যে গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে এবং স্কুলগুলির মান নির্দ্ধারণে অভিভাবকদের মানযন্ত্রে যে অদ্ভুত পরিবর্তন হচ্ছে তা লক্ষণীয়। প্রথম জোয়ার এল এক অদ্ভুত মিথের (myth) প্রচারে। একে মিথ না বলে মিথ্যাও বলা যেতে পারে। বলা হল ইংরাজি মাধ্যমে না পড়ালে সত্যিকারের শিক্ষা হয় না। তাই প্রতিটি শহরেই অসংখ্য ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল গজিয়ে উঠল। এই মিথ কিন্তু এখনও যথেষ্ট সমাদৃত। আজকেও কেউ একবার ভাবেন না যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বর্তমান রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ, ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন সবাই কিন্তু স্কুলে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করেছেন। দ্বিতীয় জোয়ার এল স্কুলের আভিজাত্য নিয়ে। সাধ্যের বাইরে হলেও নামকরা পাবলিক স্কুলে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করাতে পারলে বাবা মা নিজেদের ধন্য মনে করতে শুরু করলেন। যারা এইসব স্কুলে ঢুকতে পারল না, তারা বাধ্য হয়ে পাড়ার স্কুলে পড়ল। অথচ এই পাড়ার স্কুলগুলির অধিকাংশই এক সময় ভাল স্কুল বলে খ্যাত ছিল। এই পূর্বতন অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আমার মনে হয় বাকি ৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীরা আপ্রাণ চেষ্টা করবে এই সব দামী শিক্ষায়তনে ভর্তি হবার জন্য। কিন্তু তাদের সাধ্যের বাইরে বলে ভর্তি হতে পারবে না। তাহলে কি তারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হবে? বাস্তবে তা ঘটবে না। মাত্র দশ শতাংশ বড়লোকের অর্থ শোষণ করে প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা ক্ষান্ত দেবে তা মনে হয় না। আরও অন্তত ত্রিশ শতাংশ অভিভাবক আছেন, যারা অর্থনৈতিক দিক থেকে মধ্যবিত্ত। সেখানেও কম টাকা নেই। সেখানেও শোষণ করতে পারলে অনেক ব্যবসায়ী মুনাফা লুটতে পারবে। তাই আরও অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হবে, যারা একটু কম টাকা নিয়ে একটু কম 'সুন্দর' পরিবেশে, একটু কম 'সত্যিকারের' শিক্ষা দিয়ে ছাত্র যোগাড় করবে। এসব জায়গায় বছরে ষাট হাজারের কাছাকাছি টাকা দিয়ে বি এ পড়া যাবে। এরা হবে দ্বিতীয় স্তরের বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম স্তরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাস বিশাল, কারও ৬০ একর, কারও ১৫০ একর। এরা প্রথমেই প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তবে ব্যবসায় নেমেছে। দ্বিতীয় স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলির ক্যাম্পাস হবে ছোট, প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যে সব অভিবাবকদের কাছে প্রথম স্তর নাগালের বাইরে, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন দ্বিতীয় স্তরে তাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার জন্য। এর পর আসবে তৃতীয় স্তর। 'জনহিতকর' প্রতিষ্ঠানগুলি কিছু বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে, যেমন আর এস এস পরিচালিত বিদ্যাভারতী, পাতঞ্জলী, তিরুপতি ইত্যাদি। এসব স্থানে প্রাচীন ভারতের সুমহান ঐতিহ্যের কথা শিক্ষার্থীদের হৃদয়ঙ্গম করানো হবে। অনেকে আদর্শের কারণেই এখানে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাবেন। এ সব জায়গায় পড়ার খরচ দ্বিতীয় স্তরের কাছাকাছিই হবে। চতুর্থ স্তরে থাকবে বর্তমানের বৃহৎ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এরা আকারে আর একটু ছোট হবে, কর্মীসংখ্যা যথেষ্ট সংকোচন হবে, ছাত্রদের টিউশন ফি কিছুটা বাড়বে যাতে সরকারি সাহায্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠান চালানো যায়। এই সমস্ত স্তর যোগ করলে উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক ছেলেমেয়েদের সিংহভাগ এই চার স্তরের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। বাকি পড়ে থাকবে যাদের উচ্চশিক্ষার জন্য কোনও খরচ করার সামর্থ্য নেই। তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার আশা পরিত্যাগ করবে। কিন্তু অনেকেই আসবে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার এদের জন্য বিভিন্ন বৃত্তি ঘোষণা করবে এবং পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর গোষ্ঠীদের জন্য প্রায় বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ করে দেবার জন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হবে। এগুলিই হবে বর্তমান সরকারের শোকেস। কিন্তু নিঃসন্দেহে এই গোষ্ঠীর ছাত্রদের প্রধানত বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য অনুপ্রাণিত করা হবে। মনে রাখা দরকার যে জাশি২০র ১৬ নং ধারা পুরোটাই বৃত্তিমূলক উচ্চশিক্ষার ওপর লেখা হয়েছে। ১৬.৫ ধারায় বলা হয়েছে যে ২০৩৫ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্র বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে উচ্চতর ডিগ্রি পাবে। এই ধরণের শিক্ষার ব্যয় সরকার এবং প্রাইভেট কোম্পানিরা বহন করবে। কোম্পানির সুবিধা এর সাহায্যে তারা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মীদের প্রশিক্ষণ অল্প খরচেই করিয়ে নিতে পারবে। সরকারের সুবিধা তারা দেখাবে যে তাদের সরকার পূর্বতন সরকারগুলির তুলনায় GER কতগুণ বাড়াতে পেরেছে। এ সবই আমার কল্পনা। যদি তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, আমি সব চাইতে সুখী হব।
আমি হতাশাগ্রস্ত। আমার মনে হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রণয়নের পর বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চার দিকে কারও আগ্রহ থাকবে না। কেবলমাত্র প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা কিছু বিড়ালতপস্বী জন্ম নেবে। সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বা ঐতিহ্য কর্পূরের মত উবে যাবে। শিক্ষার সমস্ত অভিমুখ হবে কোম্পানিতে চাকুরী যোগাড় করার দিকে। সেটা কিছু খারাপ নয়। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে অর্থোপার্জন করতেই হবে। তবে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এই সময় সবাই চাকরী পাবে তো? নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দেওয়ার আগে সরকার যেন শিক্ষান্তে চাকরীর অবস্থা পর্য্যালোচনা করে দেখেন।

স্কুলশিক্ষার উপসংহারে যে কথা বলেছি তারই প্রতিধ্বনি করে বলতে চাই, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার যে ঐতিহ্য বিগত অর্দ্ধ শতাব্দী ধরে ভারতে তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল, নব শিক্ষানীতির এক ফুঁৎকারে তা চিরকালের মত অবলুপ্ত হয়ে যাবে। শিক্ষা এখন থেকে বিক্রয়যোগ্য পণ্যদ্রব্য হিসাবে পরিগণিত হবে। শিক্ষার মত পবিত্র প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার চরম অপরাধের মূল্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বহন করতে হবে। এই পাপের ক্ষমা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদের ক্ষমা করবে না। আমার লেখার দ্বিতীয় পর্বের এখানেই সমাপ্তি টানছি। পরবর্তি তৃতীয় ও অন্তিম পর্বে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির পটভূমিতে বিজ্ঞান গবেষণার অবস্থা কি রকম দাঁড়াবে, সেই সম্বন্ধে আলোচনা করব।


(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় মহাভারত পত্রিকায়।)