জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ - প্রসঙ্গ স্কুলশিক্ষা

২০১৬ সালের খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার পত্রিকায় শারদ সংকলনে (২০১৬) একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম "জুলাই (২০১৬) মাসে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর থেকে সাধারণের অবগতির জন্য তা প্রকাশ করা হয়েছে। খসড়ার ওপর মতামত পাওয়ার পর দলিলটি সংসদে আলোচনার জন্য যাবে।" তখনও কেউ ভাবতে পারে নি যে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার গণতন্ত্রের ন্যূনতম সংস্কৃতিকেও মর্যাদা না দিয়ে, সাংসদদের একবারের জন্যও আলোচনায় বসার সুযোগ না দিয়ে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার আত্মাভিমানে শুধুমাত্র মন্ত্রীসভায় আলোচনা করেই এই বিল গ্রহণ করবেন।

"শিক্ষা" বিষয়টি কেন্দ্র এবং রাজ্যের যৌথ দায়িত্বে আছে, কাজেই উচিত ছিল বিল পাশ করার আগে রাজ্যগুলির কাছ থেকে মতামত নেওয়া। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছে যে ২৯ জুলাই, ২০২০তে নতুন শিক্ষানীতির বিলটি পাশ হয়ে গেছে। যে কমিটি এই শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তুত করেছিল, তার চেয়ারপারসন ছিলেন ইসরোর ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান কে কস্তুরিরঙ্গন। মূল রিপোর্ট ছিল ৪৮৪ পাতার একটি দলিল। এই বিশাল রিপোর্টের একটি ৬৬ পাতার নির্যাস "জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০" নামে গৃহীত হয়েছে (বর্তমান প্রবন্ধে যাকে জাশি২০ বলে অভিহিত করা হবে)। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নিশঙ্ক উপাচার্যদের বলেছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই নীতি রূপায়ন করতে, কারণ সবার সাথে আলোচনা করেই নীতিটি গৃহীত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেছেন আড়াই লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সমস্ত রাজ্যের শিক্ষাদপ্তরের সাথে আলোচনা করে তাদের মতামত নিয়েই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ই আগস্ট ২০২০)। তার এই দাবী একেবারেই সত্যি নয়। নিঃসন্দেহে তিনি কিছু পরিসংখ্যানকে ভুলভাবে পরিবেশন করার চেষ্টা করেছেন।

মুখবন্ধ

স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আমাদের দেশের শিক্ষানীতিগুলির ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। স্বাধীনতার পর পরই এল রাধাকৃষ্ণান কমিশন (১৯৪৮-৪৯), তারপর মুদালিয়র কমিশন (১৯৫২-৫৩), তারপর কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬)। অধ্যাপক কোঠারি শিক্ষার সমস্ত দিকগুলি নজরে রেখে একটি বিস্তৃত রিপোর্ট পেশ করেন। বুনিয়াদি শিক্ষার বিষয়ে তিনি দুটো মূল্যবান সুপারিশ করেন। একটি হল সর্বজনীন বিদ্যালয় গঠন আর দ্বিতীয়টি হল সংবিধানের ৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদে (Article 45) যে নির্দেশিকা আছে তা পালন করা। ভারতবর্ষে শোষণহীন সমাজ তৈরীর করার জন্য এই দুটো সুপারিশ এত গুরুত্বপূর্ণ, যে এগুলো একটু আলোচনা করে নিতে চাই।
সর্বজনীন বিদ্যালয়ঃ (Common School System) সুপারিশে বলা হয়েছিল যে বুনিয়াদি শিক্ষার ব্যাপারে সরকারের সর্বপ্রথম কর্ত্তব্য পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে (অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের মধ্যে) সারা দেশে প্রতিটি অঞ্চলে সর্বজনীন বিদ্যালয় বা পাড়ার স্কুল (Neighbourhood School) তৈরী করা। এই স্কুলগুলিতে আশেপাশের সমস্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে। কোনও জাতপাত, ধর্ম, আর্থিক বা সামাজিক অবস্থানের জন্য ভেদাভেদ থাকবে না। পাঠক্রম মোটামুটিভাবে সারা দেশে একই থাকবে, তবে স্থানীয় পরিবেশ অনুযায়ী কিছু সামান্য পরিবর্তন করা যেতে পারে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শিক্ষকের সংস্থান, খেলার মাঠ, পানীয় জল, শৌচালয়, গ্রন্থাগার ইত্যাদির ব্যবস্থার পূর্ণ দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। বিদ্যালয়গুলিকে এতটাই উন্নত মানের করা হবে যে প্রাইভেট স্কুলে যাবার জন্য লোকের আর আগ্রহ থাকবে না। তখন প্রাইভেট স্কুলগুলিও ধীরে ধীরে সর্বজনীন বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হবে। কমিশন সুপারিশ করেছিল GNP-এর অন্তত ৬ শতাংশ যেন শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়। সেই বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ খরচ করা হবে স্কুল শিক্ষার জন্য, বাকি অংশ উচ্চ শিক্ষার জন্য। পরবর্তীকালে এই অনুপাত প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা যেতে পারে। প্রাক-প্রাথমিক বা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। যদি মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে খুব অসুবিধা হয়, তাহলে আপাতত ঐ অঞ্চলের প্রধান ভাষায় শিক্ষা দিতে হবে। দ্বিতীয় কোনও ভাষা এই সময় শেখানো চলবে না। পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণীতে দুটো ভাষা শেখানো যেতে পারে। একই সাথে তিনটে ভাষা শেখানোর যে প্রস্তাব সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল, তা একমাত্র উঁচু ক্লাসে গিয়ে কার্যকরী করা যেতে পারে।

শিক্ষার অধিকার - সংবিধানের ৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্দেশ আছে, সমস্ত শিশুর ১৪ বছর বয়স পর্য্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিৎ। এই ধারার কথা মাথায় রেখে কমিশনের সুপারিশ ছিল, মাধ্যমিক স্তর পর্য্যন্ত সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব রকম শিক্ষা অবৈতনিক করা হোক। শুধু তাই নয়, সবাইকেই প্রয়োজনীয় বই, খাতাপত্র বা জামাকাপড় বিনামূল্যে সরকার থেকে দেওয়া হোক।

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৬৮) গ্রহণ করলেন। ঘোষিত হল যে এরপর থেকে প্রতি পাঁচ বছর বাদে বাদে শিক্ষানীতি কতটা কার্য্যকর হল তা দেখা হবে এবং পরিমার্জিত নতুন শিক্ষানীতি প্রস্তুত করা হবে। পাঁচ বছর বাদে যখন অভিযোগ উঠল যে কোনও সুপারিশই কার্যকর করা হয় নি, তখন বলা হল, "শিক্ষা” রাজ্যের বিষয়, কাজেই সুপারিশগুলি রূপায়নের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হল। তার এক বছর বাদে এল কুখ্যাত ৪২তম সংশোধনী। যে কোনও কারণেই হোক, ইন্দিরাজি এই সংশোধনীতে শিক্ষাকে কেন্দ্র ও রাজ্যের যুগ্ম দায়িত্বে নিয়ে এলেন। কাজেই ১৯৭৬ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে শিক্ষার বিষয়ে দায়িত্ব না নেওয়ার কোনও অজুহাত রইল না। ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি রামমূর্তি কমিটির মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬) ঘোষণা করলেন। বলা হল, এখন থেকে শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতপাতের বৈষম্য বা লিঙ্গবৈষম্য আর থাকবে না। কোঠারি কমিশনের পর প্রায় তিন দশক কেটে গেল, উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তনই হল না। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হয়ে জনার্দন রেড্ডি কমিটি গঠন করে আবার জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৯২) তৈরী করালেন। ১৯৮৬ বা ১৯৯২ সালের শিক্ষানীতিতে কোঠারি কমিশনের সুপারিশের বাইরে নতুন প্রায় কিছুই ছিল না। কমিটিগুলির উচিৎ ছিল সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরা। শিক্ষানীতি অনুযায়ী যা যা করার কথা ছিল, সরকার যে তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারে নি, এই সহজ সত্যটি উল্লেখিত হল না। কমিশনের সুপারিশগুলি অবহেলিত হয়ে পরে রইল।

কেন কোঠারি কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা হয় নি?

শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে গেলে সরকারের অনেক দায়িত্ব এসে যায়। দায়িত্ব এড়াবার জন্য শাসকগোষ্ঠীর থেকে একটা অজুহাত খাড়া করা হল। বলা হল, যেহেতু এটা সংবিধানে নিছক একটা নির্দেশিকা, কাজেই তা মানতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এরপর সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন সংগঠন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার সমর্থনে আন্দোলন করতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, ২০০২ সালে সংবিধানের ৮৬তম সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে তিনটি ভাগ ছিল। (ক) মৌলিক অধিকার হিসাবে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা হল, যার নাম Article 21A। এতে বলা হল এখন থেকে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্য্যন্ত শিশুদের অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে। (খ) ৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদে একটা সংশোধনী আনা হল, ৬ বছরের নীচের শিশুদের বড় হয়ে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন এবং শিক্ষার দায়িত্ব সরকার যেন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। (গ) তৃতীয়টি ছিল ৫১-এ অনুচ্ছেদে একটা সংশোধনী, যাতে বলা হল শিশুদের বাবা, মা বা অভিবাবকদের দায়িত্ব থাকবে যাতে ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা অবৈতনিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। আবার বাধা দেওয়া শুরু হল। বলা হল এই অধিকারকে কার্য্যকারী করার জন্য একটি আইন প্রণয়ন না করলে কিছু করা যাবে না। অবশেষে সংসদে ২০০৯ সালে “শিক্ষার অধিকার” (Right to Education RTE Act) আইন হিসাবে পরিগণিত হল। বর্তমানে পরিস্থিতি হল, আমরা পছন্দ করি বা না করি, সরকার যেমনভাবে চেয়েছিলেন, ঠিক সেইভাবেই আইন পাশ হয়ে গেছে। আমাদের উচিৎ "শিক্ষার অধিকার” আইন সম্বন্ধে সবাইকে সচেতন করা, যাতে আমরা যে অধিকার পেয়েছি, সেটা যেন সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে পারি। একই সাথে আইনে যে সব অধিকার বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার জন্যও সমান্তরালভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

এতক্ষণ পর্যন্ত যে সব শিক্ষানীতির কথা উল্লেখ করেছি, যেমন কোঠারি কমিশনের সুপারিশ, ৬৮ বা ৮৬ বা ৯২-এর শিক্ষানীতি, এই সবগুলি প্রায় একই ধাঁচে তৈরী। খুব একটা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নেই। সেগুলি ঠিকভাবে রূপায়িত করা হয় নি, কিন্তু নিঃসন্দেহে তাদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। এখনও যদি এদের সুপারিশগুলি কার্য্যকর করা যায়, তাহলে দেশের নিশ্চয় মঙ্গল হবে। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই। কিন্তু এবারের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির ধরনধারণ একেবারেই আলাদা। ২০১৬ সালের খসড়া নীতির সাথে বর্তমানে প্রকাশিত নীতির একটা বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আগেরটা ছিল একেবারেই ঢিলেঢালা অগোছালো লেখা। ২০২০র রূপান্তরিত নীতি কিন্তু খুব শক্ত বাঁধুনিতে বাঁধা। সতর্ক হয়ে না পড়লে অনেকেরই মনে হতে পারে যে এতদিন পর বোধহয় একটা সত্যিকারের জনহিতকর শিক্ষানীতি প্রণোদিত হল। কিন্তু খুব সুন্দর এবং ভালো কথাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক বিপজ্জনক পরিকল্পনা যার সাহায্যে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উৎপাটন করে সেখানে কিছু পরগাছা রোপণ করার চক্রান্ত চলেছে। আমরা এবার জাশি২০-এর মূল প্রস্তাবগুলি নিয়ে আলোচনা করব। নীচে যেখানেই 'ধারা' কথাটি পাওয়া যাবে বুঝে নিতে হবে যে সেটা জাশি২০-এর ধারা।

(ক) এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে দেশের সব শিশু শিক্ষার সমান সুযোগ পাবে (ধারা ৬.১)। কারণ এর ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।


(খ) সমাজের অগ্রণী অংশের সঙ্গে পশ্চাদপদ অংশের বিশাল বিভেদ আছে। এই বিভেদ সৃষ্টির কারণ বিবিধ। যেমন ভৌগোলিক অবস্থান (মফস্বল শহরের বা গ্রামীণ বা প্রান্তিক অধিবাসীদের সাথে শিক্ষিত শহরের অধিবাসীদের বিভেদ), আর্থ-সামাজিক অবস্থান (যেমন পরিযায়ী গোষ্ঠী, হতদরিদ্র, অনাথ, কুৎসিত পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের সাথে স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের বিভেদ), সামাজিক অবস্থান (যেমন SC/ST/OBC বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়), লিঙ্গ বৈষম্য (যেমন মহিলা ও রূপান্তরকামীরা) বা শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতা (যেমন দিব্যাঙ্গ) ইত্যাদি। শিক্ষানীতির সাহায্যে এই অসাম্য ধীরে ধীরে দুর করতে হবে। (ধারা ৬.২)


(গ) যে "শিক্ষার অধিকার" বিল পূর্বতন সরকার সংসদে অনুমোদন করে গিয়েছেন, সেই অনুসারে ৩ থেকে ১৪ বছর পর্য্যন্ত প্রতিটি শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। জাশি২০তে আরও এক ধাপ এগিয়ে ৩ থেকে ১৮ বছর পর্য্যন্ত সমস্ত শিশুর অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষার ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এই জন্য প্রচলিত ১০+২-এর বদলে ৫+৩+৩+৪ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে স্কুল শিক্ষা ৬ থেকে ১৮ বছর পর্য্যন্ত বিস্তৃত। নতুন পদ্ধতিতে ৩ থেকে ৫ বছর অবধি শিশুকে বাড়িতে না রেখে স্কুলে ভর্তি করা হবে। ৬ বছরে এখনকার মতই তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে ৮ বছরে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হবে। এই প্রথম পাঁচ বছর অর্থাৎ ৩ থেকে ৮ বছর অবধি পাঠক্রমের নাম দেওয়া হয়েছে ভিত্তিস্থাপক শিক্ষা। এরপর তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি (৮ থেকে ১১ বছরের) পাঠক্রম হল প্রস্তুতিকরণের শিক্ষা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্য্যন্ত (১১ থেকে ১৪ বছর) মধ্যবর্তি শিক্ষা। নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি মাধ্যমিক শিক্ষা। এইভাবেই ১০+২-এর বদলে ৫+৩+৩+৪ শিক্ষাক্রম আনা হচ্ছে। এযাবৎ কাল শিশুরা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করত ৬ বছর বয়সে। নতুন পদ্ধতিতে শিশুর ৩ বছর বয়স হলেই তাকে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। (ধারা ১.১ ও ১.২)

(ঘ) যেহেতু ৩ থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মস্তিষ্ক দ্রুত বিকাশ লাভ করে, এই সময় থেকে তাকে সঠিকভাবে শিক্ষা না দিতে পারলে পরে তার গ্রহণক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। এখানেই প্রয়োজন ভিত্তিস্থাপক শিক্ষা। ১.২ ধারায় বলা হয়েছে, এই শিক্ষা হবে নমনীয়, বহুপার্শ্বিক, বহুস্তরিত। খেলা, কাজ বা অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হবে। শেখানো হবে বর্ণমালা, ভাষা, সংখ্যা, গণনা, রঙ, আকার ইত্যাদি। অঙ্গনের অভ্যন্তরে এবং বহিরঙ্গনে খেলার ব্যবস্থা থাকবে। যুক্তিবাদী চিন্তাধারায় অভ্যস্ত করতে তাদের ধাঁধাঁ বা জটিল প্রশ্নের সমাধান করতে শেখানো হবে। এছাড়া আঁকা, রঙ দেওয়া, হাতের কাজ ইত্যাদি দৃষ্টিনন্দন শিল্পে অভ্যস্ত করা হবে। তাদের নাটক, পুতুলনাচ, সঙ্গীত এবং নৃত্যে অনুরাগী করা হবে। তাদের সামাজিক যোগ্যতায়, সংবেদনশীলতায়, পারস্পরিক ব্যবহারে, ভদ্রতায়, সামাজিক নৈতিকতাবোধে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচ্ছন্নতায়, সবাই মিলেমিশে কাজ করার প্রবৃত্তিতে উৎকর্ষতা সাধন করতে হবে। তাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা স্কুলেই থাকবে। লক্ষ্য রাখতে হবে সবার সঠিক পুষ্টি হচ্ছে কিনা। না হলে তাদের অতিরিক্ত পুষ্টির (supplementary nutrition বা SN) যোগান দিতে হবে। ভাবতেও ভাল লাগে আমাদের দেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তন করা হচ্ছে।

প্রথম সন্দেহ -- শিক্ষক কোথায়?

ওপরে যে শিক্ষানীতির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে তার (গ) এবং (ঘ) অনুচ্ছেদ দুটি প্রাণ মন ভরে দেয়। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে এত উচ্চ মানের শিক্ষা আমরা দেব কিভাবে আর কারাই বা দেবে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে প্রথম তিন বছরের শিক্ষা হবে বালবাটিকায়। বর্তমানে অঙ্গনওয়ারিগুলিই বালবাটিকার কাজ করবে। অঙ্গনওয়ারির কর্মীরা এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পাবে। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হলে তারাই শিক্ষক হিসাবে কাজ করবে। পরবর্তি দু বছরের ভিস্তিস্থাপক স্তরে এরাই শিক্ষকতা করবে অর্থাৎ পুরো পাঁচ বছর এরা দেখভাল করবে। এদের বলা হবে Early Childhood Care and Education বা ECCE শিক্ষক। ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রতি বছর মোটামুটি আড়াই কোটি শিশু জন্মায়। খুব কমপক্ষে যদি দু কোটি শিশুও প্রতি বছর বেঁচে থাকে, তাহলেও পাঁচ বছরে অন্তত দশ কোটি শিশুকে ECCE শিক্ষকরা শিক্ষা দেবেন। এই ধরণের উচ্চমানের শিক্ষা দিতে হলে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত রাখা হবে ৩০ঃ১ (ধারা ২.৩)। এই হিসাব অনুযায়ী ত্রিশ লক্ষের ওপর ECCE-trained শিক্ষক লাগবেই। বলা হয়েছে নতুন শিক্ষানীতির সব কটা দিকই ২০৩০ সালের মধ্যে রূপায়ন করতে হবে। যদি ধরা যায় যে দশ বছর সময় হাতে আছে, তাহলেও প্রতি বছর তিন লক্ষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তার ব্যয়ভার কে বহন করবে? সমাধান হিসাবে-এ বলা হচ্ছে অঙ্গনওয়ারির বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে যারা ১০+২ পাশ করে এসেছে, তাদের ৬ মাসের একটা অনলাইন কোর্স পড়িয়ে নিলেই তারা উচ্চমানের শিক্ষক হয়ে উঠবে (ধারা ১.৭)। আর যারা পাশ করা নয়, তাদের জন্য লাগবে একবছরের অনলাইন কোর্স। এই কোর্সগুলি তারা স্মার্ট ফোনের সাহায্যে তাদের বর্তমান কাজ করার সাথে সাথে পড়ে নিতে পারবে। শুধু তাদের পরীক্ষা নেবে একটি কেন্দ্রীয় টিম। শিশুশিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করার প্রণালী নিয়ে যখন সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, তখন কি সুন্দর সহজ সমাধান আমরা দিয়ে দিলাম। বলা হয়েছে এই ধরণের উচ্চমানের ECCE Cadre তৈরির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের (ধারা ১.৭)। সামান্য হিসাব করলেই বোঝা যাবে যে উচ্চমানের ECCE Cadre তৈরির জন্য আর্থিক সঙ্গতি কোনও রাজ্য সরকারের নেই। ফলে শিক্ষক তৈরি হবে না, RTEও কার্য্যকরী হবে না। তবে এই ব্যর্থতার দায়িত্ব চাপানো হবে রাজ্য সরকারের ওপর। আরও একটা কথা। কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যাবে যে ১০+২ যারা পাশ করেছে তাদের ছয় মাসের অনলাইন কোর্স পড়িয়ে বা যারা কিছুই পাশ করে নি তাদের এক বছরের কোর্স পড়িয়ে কোনও উচ্চমান কেন নিম্নমানের শিক্ষকও তৈরি করা সম্ভব নয়। একমাত্র সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তত দু বছরের কোনও কোর্স পড়িয়ে হয়ত উচ্চমানের শিক্ষক সৃষ্টি হতেও পারে। এত শিক্ষক শিক্ষণ একমাত্র সম্ভবপর যদি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে আগ্রহীদের একটা কোর্স পড়িয়ে দেয়। যদি দু-এক লাখ টাকা কোর্স ফি হয়, তাতেও অসংখ্য শিক্ষার্থী ছুটে আসবে। এমনিতেই এখন স্কুলের একটা কাজ পাবার জন্য দু এক লাখ টাকা তোলা দেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এখানে ত' পাশ করলেই চাকরি। সারা ভারতে লক্ষ লক্ষ ECCE Cadre-এর প্রয়োজন হবে। এই ব্যবসায়ে লাভ অচিন্তনীয়। অনেক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যেই ECCEর সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ইত্যাদি দেবার প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলেছেন। না এটা আমার কল্পনাপ্রসূত কথা নয়। এই মূহূর্তে ইন্টারনেট খুলে ecce training institutes in india বলে সার্চ করলেই অন্তত ২৪টি বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে যেখান থেকে এই শিক্ষা দেওয়া হবে। তালিকায় আছে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ তাদের উপাচার্য অনুরাগ বেহার Draft NEP তৈরির কমিটিতে ছিলেন। এরা অবশ্য মাত্র দেড় লাখ টাকা নেবে পড়ানোর জন্য। এছাড়া আছে Mumbai Montessori Teacher Training Institute/ECCE (accredited by USA), মিরাটের APS College (এরা নেবে এক লাখ একাত্তুর হাজার টাকা), জলন্ধরের LPU নেবে এক লাখ আঠার হাজার টাকা। কলকাতার AP Teacher Training Institute (collaboration with Lamar University, USA) এবং মুম্বাইয়ের বিদ্যানিধি Education Trust -- এই দুই জায়গায় কিন্তু সরাসরি দেখা করা যাবে না। প্রথমে chat করে দরাদরি ঠিক হয়ে গেলে তবে দেখা করতে পারবে। যে সব কলেজ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে স্মার্টবোর্ডে পড়াবে, তাদের ফি নাকি দশ লাখ অবধি উঠতে পারে। অতএব বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তিস্থাপনের স্তরেই একটা বড় রকম ব্যবসার ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় সন্দেহ -- দুই সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি অনুমোদন

আর একটি সন্দেহ মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। শিক্ষানীতিতে অনেক বার বলা হয়েছে "সমাজের সমস্ত শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে একই রকম উচ্চ মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের সারা জীবন ধরে শিক্ষার সুযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।" কিন্তু সমস্ত শিশুদের একই রকম শিক্ষা কি সম্ভবপর হবে? ১.৪ ধারাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে প্রথম পাঁচ বছরের ভিত্তিস্থাপক শিক্ষা মূলত অঙ্গনওয়ারিতেই দেওয়া হবে। ভিত্তিস্থাপক স্তরে একটু অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা কিন্তু অঙ্গনওয়ারিতে যাবে না, কারণ ভারতবর্ষের অঙ্গনওয়ারির অবস্থা মোটেই ভাল নয়। ২০১৭-১৮ সালে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি বিভিন্ন রাজ্যে random survey করেছিল। সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বর্ণনা করছি, কারণ বুনিয়াদি শিক্ষায় এই রাজ্যের অবস্থান বেশ কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাল। ২০৬টি অঙ্গনওয়ারিতে গিয়ে দেখা গেল ৪২টি হয় বন্ধ বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাকী ১৬৪টির মধ্যে মাত্র ১৫টির পাকা ঘর ছিল। ৯৪%-এর ছিল একটি মাত্র ঘর, যেটা রান্না করার কাজে ব্যবহৃত হয়। মাত্র শতকরা ৩০ ভাগের ব্যবহার করার মত শৌচালয় ছিল। বাকী ৭০ ভাগের কোনও শৌচালয়ই ছিল না। অন্তত শতকরা ১২ ভাগ জায়গায় পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল না। ১৬৪ অঙ্গনওয়ারির কর্মীর মধ্যে মাত্র ১৪ জনের নামকেওয়াস্তে প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট ছিল। বিশেষ পুষ্টি (Supplementary Nutrition বা SN) দেওয়ার ব্যবস্থা শতকরা ৮৫ ভাগ অঙ্গনওয়ারীতে ছিল না। SN-এর জন্য ৪৭৯৫ জন শিশুর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ১৬৭২ জন সেই সুবিধা পেয়েছিল। ফলে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের শিশুরা কখনই এসব জায়গায় যাবে না। তাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে বিশেষ ধরণের স্কুল, যেখানে "সত্যিকারের" পড়াশোনা হয়। অর্থাৎ একেবারে গোড়া থেকে দু ধরণের শিক্ষা সমান্তরাল ভাবে চলবে। গরীব লোকদের জন্য অঙ্গনওয়ারী শিক্ষা, আর বড়লোকদের জন্য বিশেষ স্কুল। গত চার পাঁচ বছর থেকে ইন্টারনেট ঘাঁটলে দেখা যায় যে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদেশী ব্যবসায়ীদের জানাচ্ছে যে অচিরেই ভারতবর্ষে প্রাক-বুনিয়াদি শিক্ষার এক বিশাল ব্যবসায়ের সুযোগ বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির সহায়তা নিয়ে তারা যদি মূলধন বিনিয়োগ করে, তাহলে বিরাট মুনাফার সম্ভাবনা আছে। Eurokids, Little Millenium, Kids Campus, Sesame School(USA) এবং আরও অনেক বিদেশী সংস্থা প্রকাশ্যে তাদের কোম্পানির franchiseএর আহবান জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। Shanti Educational Initiative বাজারে তাদের শেয়ার বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। তারা এবং Mount Litera School (যাদের franchise হল Kidzee) দাবী করছে যে এই ব্যবসায়ে মুনাফা অসীম, কারণ ভবিষ্যতে তারাই K-12 school (অর্থাৎ উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়) করার অনুমতি পাবে। বিদেশী গাভীরা অসীম প্রান্তর জুড়ে কচি কচি ঘাসের সন্ধান পেয়ে গেছে। তারা এখন দলে দলে ছুটে আসছে কে কতটা গলাধঃকরণ করতে পারে সেই প্রতিযোগীতায়। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দুহাত তুলে অভ্যর্থনা করার জন্য তৈরী। কোন সন্দেহ নেই যে সরকারী অনুমোদন নিয়েই একেবারে গোড়া থেকে দু ধরণের শিক্ষা সমান্তরাল ভাবে চলবে।

শুধু কি প্রাথমিক স্তরেই দু ধরণের স্কুল তৈরি হবে? না তা নয়। একেবারে বুনিয়াদি শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্য্যন্ত সমস্ত স্তরেই দু ধরণের সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে। বিষয়টা আর একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। ৪.১১ ধারাতে প্রথম বাক্যটি হল "শিশুরা নতুন ও কঠিন তত্ত্ব সব চাইতে ভালভাবে বুঝতে পারে মাতৃভাষার মাধ্যমে।" কাজেই শিক্ষার ভিত্তিস্থাপন হওয়া উচিৎ একমাত্র মাতৃভাষায় বা স্থানীয় ভাষায়। ঐ একই ধারায় চার নম্বর বাক্যটি হল "Wherever possible, the medium of instruction until at least Grade 5, but preferably till Grade 8 and beyond, will be the home language/mother tongue/local language/regional language." খুব সাবধান হয়ে বাক্যটি পড়া প্রয়োজন। প্রথমত বলা হয়েছে "যেখানে সম্ভবপর" সেই সব জায়গায় পঞ্চম শ্রেণি পর্য্যন্ত ত' বটেই, পারলে পরে অষ্টম শ্রেণি এবং তার পরও মাতৃভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া হবে। কোঠারি কমিশনের রিপোর্টে একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু "যেখানে সম্ভবপর" কথাটি ছিল না। বলা হয়েছিল পঞ্চম শ্রেণি পর্য্যন্ত শিক্ষা মাতৃভাষাতেই দিতে হবে। যদি কোনও বিদ্যালয় তা না করে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু গৃহীত শিক্ষানীতি অনুসারে "যেখানে সম্ভবপর নয়", সেখানে কি হবে? অঙ্গনওয়ারিতে না যাওয়া অসংখ্য বাচ্চারা যারা নামকরা প্রিস্কুলে পড়বে, তারা কি ভাষায় লেখাপড়া করবে? অবশ্যই ইংরাজিতে এবং তার সাথে হিন্দিতে। ইচ্ছা হলে একটি তৃতীয় ভাষা শিখতে পারে। কিন্তু "যেখানে সম্ভবপর" সেই সব বিদ্যালয়ে একেবারে শেষ ধাপ পর্য্যন্ত সমস্ত শিক্ষাই মাতৃভাষায় দেওয়া যেতে পারে। তার সাথে কিছুটা ইংরেজি বা অন্য ভারতীয় ভাষা থাকলে থাকতেও পারে। এই ধরণের বিদ্যালয়গুলি কোথায় হবে সেই আলোচনা পরে করছি। মোট কথা প্রিস্কুলের শিশুরা এবং অঙ্গনওয়ারীর শিশুরা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পথে সমান্তরাল ভাবে বেড়ে উঠবে। এই ব্যবস্থা এখন যে নেই, তা নয়, কিন্তু নয়া শিক্ষানীতির সাহায্যে এই সমান্তরাল শিক্ষাপ্রক্রিয়ার ওপর একটা সরকারি অনুমোদনের সিলমোহর দেওয়া হবে।

শিক্ষায়তনগুলির বর্তমান অবস্থা

ভারতীয় বিদ্যালয়গুলিতে বর্তমানে কি সঠিক সংখ্যায় এবং সঠিক পরিবেশে শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন? না একেবারেই না। ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে (UNESCO Institute of Statistics: Monitoring Global needs for 2015; released in June 2019) বলা হয়েছে ভারতবর্ষে স্কুল শিক্ষকের সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে কম। বলা হয়েছে যে অবিলম্বে (২০১৫ সালে) ভারতে ২০ লক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। শুধুমাত্র বিহারে দরকার প্রায় আড়াই লক্ষ শিক্ষকের। উত্তর প্রদেশেও দরকার প্রায় সমপরিমাণ শিক্ষকের। পশ্চিমবঙ্গে গত চার বছর ধরে প্রায় তিন লক্ষ সফল পরিক্ষার্থী নিয়োগ পাওয়ার অপেক্ষায় প্রতীক্ষার সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। দেশের অনেক রাজ্যে এক বছরের চুক্তিতে সামান্য মাসিক বেতনে অস্থায়ী শিক্ষক (para teachers) নিয়োগ করা হচ্ছে। এইভাবে নিম্নতম বেতনে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করে আমরা কি প্রস্তাবিত অতি উচ্চমানের শিক্ষা শিশুদের দিতে পারব? বাইরের রিপোর্ট দেখার দরকার নেই। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে আজ আমরা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন পর্য্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের শিক্ষাগত অনেক তথ্য আসে Unified District Information System for Education বা U-DISE থেকে। তাদের ২০১৬-১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে অন্তত এক লক্ষের ওপর বিদ্যালয় আছে যেখানে মাত্র একজন শিক্ষক আছেন। এই বিদ্যালয়গুলির অধিকাংশেরই (৮৫%) অন্তত পাঁচটি শ্রেণি আছে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি। ফলে শিক্ষককে বিভিন্ন শ্রেণি একত্র করে নিয়ে পাঠাভ্যাস করাতে হয়। বাকি বিদ্যালয়গুলিতে পাঁচের অধিক শ্রেণি আছে। সেখানে অবস্থা আরও কঠিন। এই প্রসঙ্গে Child Relief and You বা CRY-এর একটি রিপোর্ট উল্লেখ করা যেতে পারে (Times of India, August 19, 2013)। যদিও রিপোর্ট একটু পুরানো, তাহলেও অবস্থার খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। এরা ১৩টি রাজ্যের ৭১টি জেলায় ৭৫০টি বিদ্যালয়ের ওপর random survey করেছিল। তার মধ্যে তিনটি বড় শহর দিল্লী, কলকাতা এবং চেন্নাই ছিল। এরা যা দেখেছিল, তার সারমর্ম হল –

(ক) শতকরা ৭৫ ভাগ বিদ্যালয়ে টেবিল, চেয়ার বা বেঞ্চ নেই।

(খ) শতকরা ৪১ ভাগ বিদ্যালয়ে ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় ক্লাস নেওয়া হয়, কারণ ঘরের অবস্থা ক্লাস নেওয়ার অনুকূল নয় অথবা শিক্ষকের অভাবে বিভিন্ন শ্রেণি একসাথে মিলিয়ে পড়াতে হয়।
(গ) ১১%-এর শৌচাগার নেই। যেখানে শৌচাগার আছে, তার মধ্যে ৩৪% ব্যবহারের অযোগ্য। ৭০% স্কুলে শৌচাগারের কাছে জলের ব্যবস্থা নেই। একটু উঁচু শ্রেণিতে পাঠরতা মেয়েদের শৌচাগারের প্রয়োজন হলে বাড়ী চলে যেতে হয়।

(ঘ) ২০%-এর পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই।

(ঙ) ৮০% বিদ্যালয়ে শৌচাগার পরিষ্কার করার কোন ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র নিম্নজাতি বা উপজাতি সম্প্রদায়ের শিশুরা যেখানে পড়ে, সেখানে ঐ শিশুদের শৌচালয় পরিষ্কার করার কাজে লাগানো হয়।
(চ) ৪৪% বিদ্যালয়ে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। বিশেষ করে পূর্ব ভারতে ৭৪% বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ নেই।

(ছ) শতকরা ৭৪ ভাগ বিদ্যালয়ে কোনও গ্রন্থাগার নেই।

(জ) শতকরা ৬০ ভাগ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠের ব্যবস্থা নেই।

(এই রিপোর্টের পাশাপাশি শিক্ষানীতির ৫.৯ ধারায় স্কুলগুলিতে কি পরিবেশ দেওয়া হবে বলে অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেটা একবার পড়ে দেখা উচিৎ।)

এই মূহূর্তে শতকরা ২৫ ভাগ স্কুলে কোনও ব্ল্যাকবোর্ড নেই। তবে মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন (India Today Feb 20, 2019) যে মান্ধাতার আমলের ব্ল্যাকবোর্ডের আর দরকার হবে না। এখন থেকে শুরু হয়ে গেলoperation digital blackboard বা স্মার্ট বোর্ড, যার সাহায্যে internet-এ প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করা যাবে, ক্লাসে বসেই television দেখা যাবে বা e-books পরা যাবে। তিনি বলেছেন অবিলম্বে নয় লক্ষ স্কুলে এই সুযোগ দেওয়া হবে।

বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা

জাশি২০র একেবারে গোড়ায় ৬নং পাতাতে বলা হয়েছে এখন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা কি কি প্রাথমিক নীতি মেনে চলবে। অনেকগুলি নীতির কথা বলা হয়েছে। আমি তার মধ্যে মাত্র চারটির কথা এখানে উল্লেখ করব।

(ক) পাঠক্রমে থাকবে নমনীয়তা (flexibility) অর্থাৎ প্রত্যেক ছাত্র নিজস্ব প্রতিভা ও পছন্দ অনুসারে তার নিজের পাঠক্রম স্থির করে নেবে।

(খ) এখন থেকে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মধ্যে, পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত (curricular) ও পাঠক্রমের বহির্ভুত (extra-curricular) কার্যকলাপের মধ্যে, বৃত্তিমূলক (vocational) ও তত্ত্বমূলক (academic) শিক্ষার মধ্যে কোনও পার্থক্য করা হবে না, যাতে শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভেতর রুদ্ধদ্বার প্রাচীরের অবসান ঘটে।

(গ) প্রাথমিক নীতিতে শিক্ষাকে multidisciplinary (নানাবিষয়ক) করতে বলা হয়েছে। বলে রাখা ভাল multidisciplinary শব্দটির সাথে আমার বিশেষ পরিচয় নেই। আমি পরিচিত interdisciplinaryশব্দটির সাথে। কিন্তু শিক্ষানীতিতে multidisciplinary অন্তত ৭০ বার ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এর সাথে interdisciplinaryর কি তফাত ভাল করে বোঝার চেষ্টা করলাম। International Bureau of Education (IBE-UNESCO) অনুযায়ী কোনও একটা সমস্যা যদি interdisciplinary পদ্ধতিতে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বিভিন্ন discipline-এর অভিজ্ঞরা একসাথে আলোচনা করে পরস্পরের সাথে মত বিনিময় করে একটা অভিন্ন সমাধান সূত্র দেবার চেষ্টা করেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল NMR Imaging, যা শারীরতত্ত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতের সমবেত প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে। আর multidisciplinary পদ্ধতিতে বিভিন্ন discipline-এর অভিজ্ঞরা একসাথে আলোচনা না করে, যার যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে সেই অনুযায়ী আলাদা আলাদা সমাধান সূত্র দেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে কিভাবে গাড়ী থেকে কার্বন নিষ্ক্রমণ কমানো যায়, সে বিষয়ে রসায়নবিদরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একটা সমাধান দেন, আবার ইঞ্জিনিয়াররা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অন্য একটি পরস্পর নিরপেক্ষ সমাধান দেন । কেন এই দ্বিতীয় পদ্ধতি শিক্ষানীতির প্রণয়নকারীদের কাছে এত ভাল লাগল যে শব্দটি ৭০ বার ব্যবহার করতে হল, ঠিক বুঝলাম না। বাক্যটিতে holistic (সামগ্রিক) শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এই শব্দটিও ৪০ বার ব্যবহার করা হয়েছে। কস্তুরিরঙ্গনের রিপোর্টে যত জায়গায় liberal শব্দটি আছে, জাশি২০তে তাকে পালটে holistic করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে প্রচলিত অর্থে যে holistic শিক্ষার উল্লেখ করা হয়, তা কিন্তু interdisciplinary, মোটেই multidisciplinary নয়। জাশি২০তে holistic শিক্ষার এক নতুন ব্যখ্যা দেওয়া আছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন "education is the manifestation of perfection already in man"। সেই কথার প্রতিধ্বনি করে ৪.৪ ধারায় বলা হয়েছে প্রতিটি শিশুর ভেতরে পূর্ণ জ্ঞানের বীজ লুকিয়ে আছে। সামগ্রিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল সেই বীজটিকে জাগিয়ে তোলা। কাজেই প্রতিষ্ঠানটির মূল্যায়ন করার সময় পাঠক্রমে কি আছে সেটা না দেখে, দেখতে হবে ছাত্রদের ভেতর শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতনতা কতটা বেড়েছে। (ঘ) আর একটি প্রাথমিক নীতির উল্লেখ করব। বলা হয়েছে যদিও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে যাতে তারা নতুন ধরণের ভাবনা থেকে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আনতে পারবে, কিন্তু সবার ওপর একটা ‘light but tight’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকবে যার মাধ্যমে এই পরিবর্তনগুলির সততা এবং স্বচ্ছতা জনসাধারণের গোচরে নিয়ে আসা হবে। এই ‘light but tight’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংজ্ঞা কোথাও দেওয়া হয় নি। কিন্তু বারে বারে এই কথাটি শিক্ষানীতিতে এসেছে। শিক্ষানীতির আট নং অধ্যায়ে (৮.১ – ৮.১০) রাজ্যগুলি কিভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করবে তার রূপরেখা দেওয়া আছে। সবার ওপরে থাকবে রাজ্যের স্কুল শিক্ষার ডিপার্টমেন্ট। তাদের তৈরি SSSA (State School Standard Authority) খেয়াল রাখবে রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে নিম্নতম মান রক্ষা করা হচ্ছে কিনা। ৮.৭ ধারায় বলা হয়েছে ভাল বেসরকারি স্কুলগুলিকে বিশেষভাবে উৎসাহ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তাদের কণ্ঠরোধ করার যেন চেষ্টা করা না হয়। স্কুলে কি পড়ানো হচ্ছে (input) সেটা বড় কথা নয়, শিক্ষার্থীরা কেমন শিখছে (output) সেটাই বড় কথা। ৮.১০ ধারা অনুযায়ী সেই পরিমাপের দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের গঠিত PARAKH (Performance Assessment, Review and Analysis of Knowledge for Holistic development) এবং NCERT-এর ওপর।

বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা

ওপরে উল্লেখিত প্রাথমিক নীতি (খ)তে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার (alternative schooling) রূপরেখা দেওয়া আছে। অনেক ধরণের বিকল্পের কথা বলা আছে। কিন্তু যে বিকল্পের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে তা হল বৃত্তিমূলক শিক্ষা। ১৬.১ ধারা থেকে ১৬.৪ ধারা পর্য্যন্ত শুধুমাত্র বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের দেশে সমগ্র শিক্ষার্থীর শতকরা মাত্র ৫ ভাগ বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে। জাশি২০ অনুযায়ী জার্মানীতে এই হার ৭৫%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯৬%। সুতরাং অতি দ্রুত এই হার বাড়াতে হবে। স্থির করা হয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে সমগ্র শিক্ষার্থীর শতকরা ৫০ ভাগ বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
এছাড়া গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে Open and Distant Learning বা ODL-এর ওপর। ৩.১ ধারায় বলা হয়েছে GER বা Gross Enrolment Ratio-এর কথা, যার অর্থ হল একটি বয়স-বন্ধনীর মধ্যে কতজন শিশু দেশে আছে আর তার মধ্যে শতকরা কতজন নির্দিষ্ট শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। দেখা যাচ্ছে সর্বশিক্ষা অভিযানের (যাকে এখন সমগ্র শিক্ষা বলে অভিহিত করা হয়) কল্যাণে প্রাথমিক স্তরে GER প্রায় ১০০% । কিন্তু যত ওপরের শ্রেণিতে ওঠা যায় ততই GER ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। ৯-১০ শ্রেণিতে এর মান দাঁড়ায় আশি শতাংশের কম এবং ১১-১২ শ্রেণিতে এর মান ৫৬%। অর্থাৎ প্রাথমিক পর্য্যায়ে যত ছাত্র ভর্তি হয়, তার শতকরা ৪৪ ভাগ মাধ্যমিকের আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়। এদের বলা হয় drop out বা স্কুল ছেড়ে দেওয়া ছাত্র। ছাত্রছাত্রীদের এই স্বেচ্ছা নিষ্ক্রমণের অনেক কারণ আছে। সে সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। তবে প্রধানত অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এর মূল কারণ। ২০১৭-১৮ সালের National Sample Survey Office বা NSSO সার্ভে অনুযায়ী ৬-১৭ বছরের বয়স-বন্ধনীতে প্রায় ৩ কোটি ২২ লক্ষ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। ৬.২.১ উপধারায় বলা হয়েছে তপশীলি জাতি ও উপজাতিদের ক্ষেত্রে drop out-এর ছবিটি আরও ভয়াবহ। কেবলমাত্র SC/ST নয়, OBC, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, দিব্যাংগ শিশুরা এবং আরও অনেকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে ক্রমাগত দুরে সরে যাচ্ছে। ৬.২ ধারায় তাই বলা হয়েছে Socio-Economically Disadvantaged Groups বা SEDG-এর কথা। এর মধ্যে অনাথ, শিশু শ্রমিক, শিশু ভিক্ষুক, যৌন ব্যবসায়ে পাচার হওয়া মেয়েরা, লিঙ্গ পরিবর্তনকামীরা, এমন কি পরিযায়ী শ্রমিকদের সন্তানরাও অন্তর্ভুক্ত (ধারা ৩.২) বলে গণ্য করা হবে। ৩.৫ ধারায় সমাধান সূত্র হিসাবে বলা হচ্ছে SDEGদের সরাসরি স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করায় অনেক অসুবিধা আছে। তাদের জন্য রাজ্যগুলি মাতৃভাষায় Open and Distant Learning (ODL)-এর মাধ্যমে নতুন ধরণের ডিগ্রী দেবে। যেমন A, B এবং C লেভেল সার্টিফিকেট দেওয়া হবে, যেগুলি ধরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ, পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ এবং অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণের সমপর্যায়ের। একজন ছাত্র বা ছাত্রী যদি B লেভেল পাশ করে তবে তাকে বলা হবে সে এরপর যে কোনও স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করল। ঠিক একইভাবে মাধ্যমিকের সমপর্যায়ের সার্টিফিকেট ODL থেকে দেওয়া যেতে পারে।

লেখকের বক্তব্য

আমাদের দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা ODL-এর মাধ্যমে প্রান্তিক জনগণকে শিক্ষা প্রদান করার কথা বহুবার আলোচিত হয়েছে এবং সীমিত হলেও কিছু কাজ করা হয়েছে। কাজেই এই ধরণের প্রচেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাব। কিন্তু জাশি২০তে যেভাবে তা করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে পশ্চাদপদ অংশের শিক্ষা হবে ODL-এর মাধ্যমে। বলা হচ্ছে সরকারি বিদ্যালয়ে, বিশেষত কিছু কিছু গ্রামীণ বিদ্যালয়ে, প্রথম থেকে মাধ্যমিক পর্য্যন্ত সব শিক্ষাই মাতৃভাষায় দেওয়া হবে। এই সব বিদ্যালয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটানো হবে। অর্থাৎ সরকার থেকেই স্থির করে দেওয়া হবে কারা মূলস্রোতে পড়বে আর কারা বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থায় চলে যাবে। উদাহরণস্বরূপ ১.৮ ধারায় বলা হয়েছে উপজাতি ও জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রমশালা তৈরি করা হবে এবং সেখানে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার প্রণয়ন করা হবে। এই সব বিদ্যালয়ের জন্য আবশ্যিক সর্তাবলী শিথিল করে দেখা হবে (the requirements of the schools will be made less restrictive – ৩.৬ নং ধারা)। এই ধরণের অনেক বাক্য শিক্ষানীতির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কারা কি ধরণের লেখাপড়া করবে, সেটা নিশ্চয়ই শিক্ষানীতির বিচার্য বিষয় নয়। কিন্তু তাই ঘটতে চলেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা চিরকালই শিক্ষাকে উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করে এসেছে। শুনতে অনেকের কাছে আশ্চর্য লাগলেও তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল কলকাতা। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য নেটিভ্ হিন্দুরা চাঁদা দিয়েছিলেন এক লক্ষ তেরো হাজার টাকা। ফলে এর পরিচালনার ভার ছিল বাঙ্গালী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে। একবার পরিচালক সমিতির ইংরেজ সভ্যরা দেশীয় সভ্যদের মতামত অগ্রাহ্য করে একটি বাঈজির ছেলেকে এখানে ভর্তি করে। কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত ছাত্র কলেজ ছেড়ে দিয়ে একটা নতুন কলেজ তৈরী করে সেখানে চলে যায়। অবশেষে কলেজের অধ্যক্ষ ছেলেটিকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বহিস্কৃত করে হিন্দুসমাজের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে কলেজ বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। এমন কি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন, তখনও সেখানে উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। তিনি অনেক লড়াই করে বৈশ্যদের প্রবেশের অধিকার অর্জন করতে পেরেছিলেন, কিন্তু শূদ্রদের জন্য পারেন নি। স্বাধীন ভারতে সংবিধান অনুসারে শিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই সিদ্ধান্ত মোটেই সমর্থন করেন না। এতদিন বাদে তারা বোধহয় সরকারি অনুমোদন নিয়ে নিজেদের পছন্দ অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থা পত্তন করতে চলেছেন। ভবিষ্যৎ ভারতে নিম্নবর্ণের শিশুরা তথাকথিত বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে কারখানায় পরিশ্রমসাধ্য কাজ করবে। উচ্চবর্ণের শিশুরা সরকার পরিচালনার কাজে নিযুক্ত হবে। তারাই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শিক্ষিত হয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবিদের সৃষ্টি করবে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় দু ধরণের ভারতীয় সৃষ্টি হবে। একদল উচ্চশ্রেণীর, অপর দল অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর। এই বিভাজন এখনকার সমাজেও আছে। কিন্তু এখনও আমাদের দেশে কোনও লোক সমাজের যে অবস্থান থেকেই আসুক না কেন, যদি তার যোগ্যতা থাকে তাহলে অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রতিপত্তির দিক থেকে শীর্ষে চলে যেতে পারে। বর্তমান শিক্ষানীতিতে এই দুই ধরণের ভারতীয়দের মধ্যে একটা অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলে দেওয়া হবে, যাতে কোনও দিনই নীচের মানুষেরা ওপরে যাওয়ার সুযোগ না পায়। এই নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীদের প্রধান এজেন্ডা জাতিভেদপ্রথা কায়েম রাখা, ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করা আমাদের দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

কি যুক্তিতে ১০+২ থেকে ৫+৩+৩+৪ এতগুলি ভাগ করা হল?

এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু গৃহীত শিক্ষানীতির কোথাও দেওয়া নেই। দেখা যাক, এই রকম স্তরীভূত শিক্ষাক্রম (tiered learning) পৃথিবীতে কোথায় গ্রহণ করা হয়েছে এবং কেন গ্রহণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন জানিয়েছে কানাডার অন্টারিওতে (Ontario Ministry of Education. (2013). Learning for all: A guide to effective assessment and instruction for all students, Kindergarten to Grade 12. Toronto।

এর মূল কারণ হিসাবে বলা হয়, যদি ক্লাসে কোনও ছাত্রের কিছু বিষয়ে ঘাটতি থাকে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করে বিশেষভাবে শিক্ষাদান করে সেই ঘাটতি মেটানোর ব্যাপারে এই পদ্ধতি খুব কার্যকরী (Adams, C. M., & Pierce, R. L. (2003). Teaching by tiering. Science and Children, 41(3), 30–34)। প্রশ্ন হল আমাদের দেশে কি একই উদ্দেশ্যে এই শিক্ষাক্রমকে স্বাগত জানানো হয়েছে? একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষকের যোগান এতই অপ্রতুল যে পিছিয়ে থাকা ছাত্রদের জন্য বিশেষ ক্লাসের সংস্থান করা অধিকাংশ বিদ্যালয়ের কাছে আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। তাহলে কি জন্য আমরা এতগুলি স্তর তৈরী করতে যাচ্ছি? শিক্ষানীতিতে এই বিষয়ে আলোচনা আছে ৪.১ ধারায়। বলা হয়েছে শিশুদের মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। তাই শিশুদের ৩ থেকে ৮ বছরের ধীশক্তি, ৮ থেকে ১১ বছরের থেকে আলাদা। ঠিক তেমনি ১১ থেকে ১৪ বছরের মস্তিষ্কের বিকাশ ১৪ থেকে ১৮ বছর থেকে আলাদা। তাই এই চারটি বিভাগের শিশুদের তাদের উপযোগী চার ধরণের পাঠক্রম তৈরি করা হবে। মনে হয় এই সব পাঠক্রমের রচয়িতারা শিশুদের মগজের কার্য্যপ্রণালী সম্বন্ধে এতই অভিজ্ঞ, যে ৮-১১ বছরের শিশুর মস্তিষ্ক থেকে ১১-১৪ বছরের শিশুর মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম তফাত তাদের নজর এড়ায় না। বলা বাহুল্য এই যুক্তি একেবারেই হাস্যকর। তবে আসল কারণ বোঝার জন্য বিরাট গবেষণার প্রয়োজন নেই। এতক্ষণ যা যা আলোচনা করেছি সেগুলোকে একটু গুছিয়ে সংক্ষিপ্তসার করলেই কারণটা পরিষ্কার হয়ে আসবে। নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী
(ক) তিন বছর বয়সে শিশুরা বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রথম পাঁচ বছর (ভিত্তিস্থাপক স্তর) একদল শিশু, যাদের অর্থের সংস্থান নেই তারা বিনামূল্যে সরকারি অঙ্গনওয়ারীতে মাতৃভাষায় পড়বে। আর এক দল যাদের সামর্থ্য আছে তারা ইংরাজি মাধ্যমে Preschool-এ পড়বে।

(খ) প্রথম পাঁচ বছর শেষ হওয়ার পর তারা সবাই একটি সার্টিফিকেট পাবে এবং পরবর্তি তিন বছরের প্রস্তুতিকরণ স্তরে শিক্ষা নিতে পারবে। এই সময় থেকেই বিদ্যালয়গুলিকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে তাদের পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষাক্রম তৈরি করার। সেই পাঠক্রম holistic এবং multidisciplinary হচ্ছে কিনা তা তদারকি করবে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা। এর ফলে গোটা দেশের শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে একটি light but tight কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে। এই স্তরেই বিকল্প শিক্ষা (যা মূলত বৃত্তিমূলক শিক্ষা) চালু করা যাবে। কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোন শিশুরা মূলস্রোতে পড়বে আর কারা বিকল্প শিক্ষা নেবে।

(গ) এই চারটি ভাগের যে কোনও একটি শেষ হলেই শিক্ষার্থী একটি সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। পরে যখন প্রয়োজন তখন শিক্ষাক্রমে আবার প্রবেশ নিতে পারবে (ধারা ৩.৩ ও ৪.২) । অন্তর্বর্তিকালীন অবস্থায় এদের শিক্ষার্থী বলেই গণ্য করা হবে। এর ফলে ব্যবসায়ে এবং কারখানায় বিভিন্ন স্তরের শ্রমিকের যোগান অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এরা শিশু শ্রমিক বলে অভিহিত হবে না। আইনের পাশ কাটিয়ে এরা কারখানায় শিক্ষার্থী (apprentice) বলেই ধরা হবে। হয়ত কাজের জায়গা থেকেই একটা সার্টিফিকেটও দিয়ে দেওয়া হবে।
আমার ধারণা এই শিক্ষানীতির আসল উদ্দেশ্য দুটো।

(১) প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হল, যে সব পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য কিছু টাকা খরচ করতে সক্ষম, সেই শিক্ষা ব্যবস্থা যেন পুরোপুরি বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অনেকেরই ধারণা নেই যে আমাদের দেশে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় কত কোটি কোটি টাকার ব্যবসা লুকিয়ে আছে। এই ব্যবসা কয়েকটি পূর্বপরিকল্পিত পুঁজিপতিদের উৎসর্গ করে দেবার জন্য বর্তমান সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং বদ্ধপরিকর।

(২) দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল জাতপাত, ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হবে। হিন্দুত্ববাদীদের ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে এই শিক্ষানীতিকে কাজে লাগানো হবে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পরবর্তি যুগে যৎসামান্য হলেও যেটুকু শিক্ষার সুযোগসুবিধা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে, নিপীড়তদের মনে যেটুকু আশার আলো জেগেছে, তা যেন চিরতরে নির্বাপিত হয়। এখন থেকে কারা মূলস্রোতে পড়াশোনা করবে আর কারা বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে যাবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড।
যেহেতু এই শিক্ষানীতিতে উপকৃত হবে কেবলমাত্র কিছু বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং হিন্দুত্ববাদীরা, কাজেই সরাসরি ভাবে এই তিক্ত প্রস্তাব জনগণের সামনে না রেখে তাকে সুমিষ্ট আবরণে সুদৃশ্য মোড়কে মুড়ে অনেক মনোগ্রাহী করে সরকার পেশ করেছে। কিছুদিন বাদে সুমিষ্ট আবরণের ভেতর থেকে তিক্ত প্রস্তাবগুলি যখন আত্মপ্রকাশ করবে, সেই সময় যাতে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে না ওঠে, তার জন্য সরকার আত্মরক্ষার জন্য কিছু বর্ম বা ঢাল বা অজুহাত শিক্ষানীতিতে প্রস্তুত করে রেখেছে। কয়েকটি অজুহাত প্রকাশ্যে আছে, কিছু আবার সামান্য অপ্রকাশ্যে রাখা আছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে।

প্রথম অজুহাত হল সমগ্র শিক্ষানীতি জুড়ে এমন একটা ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে বর্তমান সরকার কোনও নতুন নীতি সৃষ্টি করছে না। তারা কেবলমাত্র আগেকার ঘোষিত শিক্ষানীতিগুলির যে যে অংশ এখনও কার্য্যকারী হয়ে ওঠে নি, সেগুলিকেই পূর্ণরূপ দেবে। এর সাথে ইতিমধ্যে সংযোজিত হয়েছে শিক্ষার অধিকার আইন। তাকেও ত' আগেকার সরকারগুলি শুধুমাত্র মৌখিক সমর্থন জানিয়ে গেছে। এতদিন বাদে বর্তমান সরকার সেগুলিকে কার্য্যে পরিণত করে দেখাবে। এই অভিযোগ কখনই অস্বীকার করা যায় না যে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার বছরের পর বছর ধরে কোঠারি কমিশনের সুপারিশগুলি কার্য্যকর না করে বস্তুতপক্ষে তার ঠিক বিপরীত শিক্ষাপদ্ধতি দেশে অবাধে প্রবেশ করতে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারিকরণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। সেই সুযোগ বর্তমান সরকার সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে চায়।
দ্বিতীয় অজুহাতটি সহজে চোখে পড়বে না। কিন্তু বিপুল শিক্ষানীতির প্রায় প্রতি পাতায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মত তার উপস্থিতি বিভিন্ন বর্ণে গন্ধে প্রকাশিত হচ্ছে। বিগত দশ বছরের ওপর UNESCO (United Nations Educational Scientific and Cultural Organization) উন্নীত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলিতে কি ধরণের পাঠক্রম চালু করা উচিৎ, সেই বিষয়ে অনেক কনফারেন্স, মিটিং বা কমিটি করেছে। ২০১৫ সালের মে মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার Incheon শহরে World Education Forum নামক UNESCO-গঠিত একটি সংস্থা "২০৩০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ" তার একটি সংজ্ঞা স্থির করে। একেই বলা হয় Incheon Declaration। এর মূল বক্তব্য হল "সমাজের সমস্ত শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে একই রকম উচ্চ মানের শিক্ষা নিশ্চিত কর এবং তাদের সারা জীবন ধরে শিক্ষার সুযোগ অব্যাহত রাখ।" শুধুমাত্র ইঞ্চিয়ন ঘোষণাপত্র নয়, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসে UNESCOর আর একটি সভায় ২০৩০ সালের মধ্যে একটি পরিকাঠামো গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়, যার নাম framework for action for the implementation of Sustainable Developmental Goal 4 বা সংক্ষেপে SDG4। এই মহৎ উদ্দেশ্যে UNICEF প্রস্তুত করেছে Early Childhood Care and Education বা ECCE প্রোগ্রাম। মজার বিষয় হল, নয়া শিক্ষানীতির কোথাও ইঞ্চিয়নে গৃহীত ঘোষণাপত্র বা প্যারিসে গৃহীত পরিকাঠামোর সংজ্ঞার উল্লেখ নেই। কিন্তু গোটা দলিল জুড়ে এই সব দুর্বোধ্য শব্দগুলি, যেমন inclusive and equitable quality education, SDG4, ECCE ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যখনই এই ধরণের শব্দ বা ধারণা নিয়ে আপত্তি তোলা হবে, তখনই সরকার জানিয়ে দেবে যে তারা নিরুপায়, কারণ তারা কেবলমাত্র UNESCOর নির্দেশাবলী পালন করেছেন।

উপসংহার

জাশী২০-এর প্রেক্ষিতে স্কুল শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা আপাতত এখানেই শেষ করলাম। পরবর্তী অংশে উচ্চ শিক্ষানীতি নিয়ে কিছু বলার অপেক্ষায় রইলাম। শিক্ষাব্যবস্থার প্রচণ্ড দরদী সেজে এই শিক্ষানীতি প্রস্তুত করা হয়েছে, যার আসল উদ্দেশ্য কর্পোরেট ও হিন্দুত্ববাদীদের তোষণ ও পোষণ। তাই বলতে ইচ্ছা হয়
যত চালাকি তোমার
জানতে নাইকো বাকি আর
যত কার্দানি শয়তানী
সবই ফাঁক

[জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদ সংকলন (২০২০)তে ৫-১৩ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আমার একটি লেখার যথেষ্ট প্রভাব এই প্রবন্ধে আছে।]

(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় মহাভারত পত্রিকায়।)