
হান কাং এর উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার
- 08 July, 2025
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
The Vegetarian বইটি সৌন্দর্য ও আতঙ্কের মিশ্রণ। এটা এমন এক গল্প যা অনেক জায়গাতেই বেশ নিষ্ঠুর ও অশান্তিকরস। এখানে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, রয়েছে যৌন হিংস্রতা, রয়েছে জোর করে খাওয়ানো। এইসব নির্যাতন থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি পর্যন্ত এখানে রয়েছে। যেটা জানতে চাইবো, আপনি এখানে কেন মানুষের অন্ধকার দিক ও আচরণ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হলেন?
আমি যে মানবতা ও পৃথিবী নিয়ে প্রশ্ন করতাম, তা তিনটি অংশে দুই বোনের নিঃশব্দ আর্তির মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। এক বোন (ইয়ং হে) মনুষ্য জাতির অংশ হতে চায় না, মাংস খেতে অস্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে সে একটি উদ্ভিদে পরিণত হয়েছ। আবার তার বোন (ইন হে) মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো তার বোনকে আঁকড়ে ধরতে চায়, কিন্তু সে নিজেও আবার নানা দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণায় জর্জরিত। যখন আমি উপন্যাসটা লিখি, তখন আমি প্রশ্নের শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে চাইছিলাম — উত্তর নয়। যে প্রশ্নটি আমাকে শুরুতে টেনেছিল, মানুষ হিসেবে অস্তিত্বের তাৎপর্য নিয়ে যে প্রশ্ন আমার মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তার গভীরে পৌঁছাতে গেলে এমন তীব্র দৃশ্য ও চিত্র ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছিল বলে আমার মনে হয়।
এই গল্পটি নানা ইমেজ, প্রতীক ও পুনরাবৃত্ত মোটিফে ভরপুর। আপনি কি এগুলো পরিকল্পিতভাবে রেখেছিলেন, নাকি এগুলো স্বাভাবিকভাবে গল্পের সাথে গড়ে উঠেছে? এদের গুরুত্ব কতটা?
যখন আমি কল্পকাহিনি লিখি, তখন ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতার ওপর অনেক গুরুত্ব দিই। আমি চিত্র, শব্দ ও স্পর্শের অনুভূতি পাঠকের কাছে জীবন্তভাবে পৌঁছে দিতে চাই। আমি নেক সময়েই উপন্যাস বাক্যে একটি বিদ্যুৎ প্রবাহ ঢেলে দিতে চাই। আমি দেখেছি পাঠকরা সেই প্রবাহ বুঝে ফেলে। এই সংযোগের অভিজ্ঞতা আমার প্রতিবারই মুগ্ধ করে।
আপনি The Vegetarian ২০০৭ সালে লিখেছিলেন। ২০১৫ সালে এর ইংরেজি অনুবাদের পর পশ্চিমী পাঠকেরা অনেকে এটিকে একটি রূপক হিসেবে দেখেছেন। এর মধ্যে কোরিয়ান সমাজের সামাজিক নিয়ম-কানুন, পিতৃতন্ত্রের সমালোচনা খুঁজে পেয়েছেন। ১৬ বছর পর আপনি কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে দেখেন?
আমি একমত যে এই উপন্যাসটি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি রূপক হিসেবে পড়া যেতে পারে। তবে আমি মনে করি না এটি শুধু কোরিয়ান সমাজের জন্য প্রযোজ্য। মাত্রার পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু এটি কি সর্বজনীন নয়? আমি শুধু যে কোরিয়ান সমাজের একটি চিত্র আঁকতে চেয়েছিলাম, এমন কিন্তু নয়।
The Vegetarian প্রচলিত কাহিনির কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইয়ঙ-হে-র গল্প তিনজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বলা হয়, অথচ তার নিজের কণ্ঠ প্রায় শোনা যায় না। কেন আপনি এইভাবে প্রধান চরিত্রটি তুলে ধরলেন?
ইয়ঙ-হে একজন চূড়ান্ত রকমের র্যাডিকাল ও শক্তিশালী চরিত্র। নিজেকে রক্ষা করার জন্য সে একটি উদ্ভিদে পরিণত হতে চায়। অথচ আয়রনি হলো, এই প্রচেষ্টা তাকে মৃত্যুর আরও কাছে নিয়ে যায়। আমি চাইনি ইয়ঙ-হে নিজে কথা বলুক; বরং চেয়েছি অন্য চরিত্রদের দৃষ্টিতে তাকে দেখতে — যে দৃষ্টির মধ্যে আছে ঘৃণা, আছে ভুল বোঝাবুঝি, আছে করুণা, আছে বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টি। আমি চেয়েছিলাম এই দৃষ্টিকোণগুলোর মধ্যে দিয়ে পাঠকরা নিজেরাই ইয়ঙ-হে-র সত্যকে খুঁজে বের করুক।
The Vegetarian আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারসহ Yi Sang সাহিত্য পুরস্কারও জিতেছে, এবং বছরের সেরা গ্রন্থের তালিকাতেও স্থান পেয়েছে। এমন একটি রচনা লেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে? এর ফলে আপনার পরবর্তী লেখক জীবনে কী প্রভাব পড়েছে?
The Vegetarian লেখার সময়কার তিন বছর আমার জীবনের খুব কঠিন সময় ছিল। আমি কখনো ভাবিনি এই উপন্যাস এত পাঠকের কাছে পৌঁছাবে। তখন আমি নিশ্চিতও ছিলাম না যে আমি উপন্যাসটি শেষ করতে পারব বা লেখক হিসেবে টিকে থাকতে পারব কি না। আমার আঙুলে মারাত্মক বাতের ব্যথা ছিল, তাই প্রথম দুটি অংশ ধীরে ধীরে ফেল্ট-পেন দিয়ে লিখেছিলাম, আর শেষ অংশটি লিখেছি উল্টো করে ধরা দুটি বলপয়েন্ট পেন দিয়ে টাইপ করে।
আজও উপন্যাসটির ‘সাফল্য’ নিয়ে কথা শুনলে আমার অস্বস্তি হয়, কারণ মূল চরিত্র ইয়ঙ-হে শব্দটি ‘সাফল্য’-র সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না।
তবু, কোনোভাবে আমি সেই সময়টাকে পার করে উপন্যাসটি শেষ করতে পেরেছিলাম। এরপর আমি পরবর্তী উপন্যাসে যেতে পেরেছি। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে ইয়ঙ-হে-র বোন অ্যাম্বুলেন্সের জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে – ‘একটি উত্তরের অপেক্ষায়, যেন কোনো কিছুর প্রতিবাদ করছে।’ আমি মনে করি, পুরো উপন্যাসটাই যেন কোনো উত্তর চায় এবং কোনো কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। উপন্যাস লেখার পর যেসব প্রশ্ন থেকে যায়, সেগুলোই আমাকে পরবর্তী লেখায় ঠেলে দেয়। তাই আমি আমার চতুর্থ উপন্যাস শুরু করেছিলাম The Vegetarian-এর শেষ প্রশ্ন দিয়েই: আমরা কীভাবে মানুষের জীবনকে গ্রহণ করি — যা একইসঙ্গে এত সুন্দর এবং এত হিংস্র ?
আর সেই চতুর্থ উপন্যাসের শেষ প্রশ্ন থেকেই আমার নতুন উপন্যাসের শুরু। এভাবেই আমি এখন পর্যন্ত লিখে চলেছি। এই গ্রীষ্মে আমি একটি নতুন উপন্যাস শুরু করেছি, শেষ প্রান্তে কী পাব — সেটি জানার অপেক্ষায় আমিও আছি।
আপনি কোরিয়ান সাহিত্যের কোন তিনটি বই এর অনুবাদ পশ্চিমের ও পৃথিবীর পাঠকদেরকে পড়তে পরামর্শ দেবেন এবং কেন?
আমি তিনটি বই পাঠকের জন্য সুপারিশ করতে চাই:
- One Hundred Shadows — হোয়াং জুং-উনের লেখা, অনুবাদ করেছেন জং ইয়েওন
- Concerning My Daughter — কিম হে-জিনের লেখা, অনুবাদ করেছেন জেমি চ্যাং
- Cursed Bunny — বোরা চুং-এর লেখা, অনুবাদ করেছেন অ্যান্টন হার
এই তিনটি বই-ই বাস্তবতা ও মানুষের অভ্যন্তরীণ জগৎকে নির্লিপ্তভাবে না দেখে সরাসরি তাকিয়ে দেখে। সেই কারণেই এই তিনটি বই এর অনুবাদ পড়ার কথা বলব।
(২০২৩ সালে এই ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল বুকার কর্তৃপক্ষের তরফে। সাক্ষাৎকারটি নেবার পরের বছর হান কাং নোবেল পুরস্কার পান। সে কারণেই এই সাক্ষাৎকারে অন্যান্য পুরস্কার প্রসঙ্গ এলেও নোবেল এর কথা আসে নি।
সঙ্গের ছবিতে দ্য ভেজিটেরিয়ান উপন্যাসের ইংরাজী অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ এর এর সঙ্গে হান কাং।)
তরজমা - সৌভিক