
হান কাং এর উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্ট' : একটি পাঠ
- 07 July, 2025
- লেখক: অয়ন সেন
অমেয় জগতে/নিজস্ব নরক মোর বাঁধ ভেঙে ছড়ায়েছে আজ;/মানুষের মর্মে মর্মে করিছে বিরাজ/সংক্রমিত মড়কের কীট;/শুকায়েছে কালস্রোত, কর্দমে মিলে না পাদপীঠ।/অতএব পরিত্রাণ নাই।/যন্ত্রণাই জীবনে একান্ত সত্য, তারই নিরুদ্দেশে/আমাদের প্রাণযাত্রা সাঙ্গ হয় প্রত্যেক নিমেষে। - সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
Han Kang দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক লেখক যার লেখায় মানবজীবনের নিঃসঙ্গতা, বেদনাবোধ ও হিংসার প্রেক্ষিতে আত্মপরিচয়ের সংশয়দীর্ণ জটিলতা উন্মোচিত হয়। Han Kang-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত উপন্যাস 'The Vegetarian', যা ২০১৬ সালে Man Booker International Prize লাভ করে এবং তাকে বিশ্বসাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করে। এই উপন্যাসে এক নারীর হঠাৎ নিরামিষভোজী হয়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে তার ব্যক্তিগত স্তরে স্বাধীনতা ও মানসিক পরিস্থিতির সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে, যা নারীর শরীর ও ইচ্ছের উপর রাষ্ট্র তথা সমাজের দমনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্ন করে, তাকে বিদ্ধ করে। অপর একটি উপন্যাস 'The White Book' এক নিবিড় শোকনির্ভর গদ্যগ্রন্থ, যেখানে লেখক তার মৃত সদ্যোজাত বোনের স্মৃতি উদযাপনে সাদা রঙের বিভিন্ন রূপ ও প্রতীক ব্যবহার করে শোককে রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে। আবার 'Greek Lessons' উপন্যাসে তিনি মনের আরও গভীরে যেতে অভিলাষী, ভাষা হারানো এক নারী ও দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকা এক শিক্ষকের নির্বাক সংযোগের মাধ্যমে ভাষা-ভাষাহীনতা, সরবতা-নীরবতা ও সহমর্মিতার এক অন্তরঙ্গ, অভূতপূর্ব চিত্র এঁকেছেন।
হান কাং-এর লেখা পাঠকের মনে যে অভিঘাত সৃষ্টি করে, তাকে অস্তিত্ববাদী উপলব্ধি বলে শনাক্ত করতে কালক্ষেপ করতে হয় না, অন্যদিকে, আধুনিকতার নামে পশ্চিমায়নের প্রভাব থেকে তার লেখার ফারাক সহজেই বোধগম্য হয়। সমগ্র লেখা জুড়ে স্বকীয় অস্তিত্বের এই অনুরণন দেশকালের গন্ডী ছাপিয়ে ওঠে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা তারই স্বীকৃতি হিসেবে ধরে নিতে পারি। Human Acts ও তার ব্যতিক্রম নয়।
দক্ষিণ কোরিয়া, ১৯৮০। গোয়াংজু অভ্যুত্থান। নিষ্পাপ, তাজাতরুণ আদর্শবাদ একদিকে, অন্যদিকে ঘৃণিত নির্মম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। মানবজাতির ইতিহাসে এই পরিস্থিতি ফিরে ফিরে আসে যখনই দিনবদলের স্বপ্নগুলো মাথাচাড়া দেয়, শোষণমুক্ত সমাজের কল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকে তারুণ্য। পরিণতিও অবশ্য এক, চরম দমনপীড়নে নির্মূল হয় বিদ্রোহ।
ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭০ সালে গোয়াংজু শহরেই জন্ম হান কাং-এর। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের সময় নিতান্তই নাবালিকা তিনি। এর কয়েক বছর পরে, একটি ছবির বইয়ে গোয়াংজুর হত্যাকান্ডের বিভৎস ছবি দেখেন হান যা তার মনে মানবজাতি সম্বন্ধে এক স্থায়ী প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়: এই কি একজন মানুষের প্রতি অপরজনের কাজ? পরবর্তীকালে, Human Acts রচনার প্রস্তুতিপর্বে- শুধু গোয়াংজু নয়- বিশ্ব জুড়ে চলা রাষ্ট্রীয় হিংসার নানা বিবরণ, ইতিহাস পড়েন তিনি যার প্রতিফলন পাওয়া যায় এ লেখায়।
Human Acts-এর অধ্যায়গুলিতে পারস্পরিক সম্পর্কিত ঘটনাপরম্পরা ফুটে ওঠে কিছু খন্ডচিত্রের মাধ্যমে – পূর্বেই উল্লেখিত, ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু প্রদেশে একটি সহিংস ছাত্র বিদ্রোহ দমন করে রাষ্ট্র, যা এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। ডং-হো নামে একটি অল্পবয়স্ক ছেলে যখন মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়, তার বন্ধু খুঁজে বেড়ায় তার শবদেহ, মৃতের চেতনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে অস্বীকার করে, সে খুঁজে ফেরে আস্থার আশ্রয়, যখন পরিস্থিতির শিকার মানুষগুলো এবং শোকাহতরা দমন, অগ্রাহ্যতা এবং গণহত্যার পুনরাবৃত্ত যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়, নৃশংসতার গভীরে তার স্বদেশ তখন খোঁজে আত্মস্বর আর অনুচ্চারিত প্রশ্নরা ঘুরপাক খায়: কেন ক্ষমতার বহিরঙ্গে থাকে শুধুই নৃশংসতা? কেন শোকাহতের প্রশ্নগুলিকে মূক করে দেওয়া হয় চিরতরে? কেনই বা স্মৃতির অস্তিত্বে আশংকিত হয় ক্ষমতাসীন শাসক? আর এই প্রশ্নেই – যা সর্বকালীন – দেশকালের গন্ডির সীমিতকরণকে ছাপিয়ে সর্বজনীন হয়ে ওঠেন হান কাং। বিভিন্ন চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এক মর্মস্পর্শী যাত্রায় পাঠককে সহযাত্রী করেন লেখক। একাধারে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও নৃশংসতার শিকার, প্রিয়জন হারানোর শোকে ব্যথিত ও আত্ম-পরিচয়ের সংকটে জর্জরিত এই চরিত্রগুলোর ক্রমপরিণতি যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিকৃষ্ট উদাহরণ বহন করে। এছাড়াও চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত মানসিক যন্ত্রণা, বীভৎস স্মৃতি পাঠককে অস্বস্তির সম্মুখীন করে, এই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ভাষা পায় তার লেখনীতে, ‘...কিছু স্মৃতির নিরাময় হয় না। কালপ্রবাহে ধূসর হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সেইসব স্মৃতি হয়ে ওঠে তা-ই যা অবশেষ হয়ে থেকে যায় বাকি সব কিছু ক্ষয়ে যাওয়ার পরও। পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন হয়, ইলেকট্রিক বাল্বের একের পর এক নিবে যাওয়ার মতো। আমি অবগত যে আমি একজন সুরক্ষিত মানুষ নই।’
যখন রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকদের উপরই আক্রমণ নামিয়ে আনতে দ্বিধা করে না, দেশপ্রেম নিয়ে ডং-হো’র মনে যে সংশয় প্রকাশ পায়, তা কি রূপভেদে আমাদের মনেও সঞ্চারিত হয় না যখন দেখি সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর ছবি ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারে! হান-কাং লেখেন, ‘... সেই মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করেছিলাম এই সব কিছু কিসের জন্য। এই অত্যাচার ও অনাহার কোন শব্দগুলোকে বার করে আনতে চাইছিল। আমরা তোমাদের বোঝাবো, তোমরা যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছ এবং জাতীয় সঙ্গীত গাইছ তা কতটা হাস্যকর ছিল। আমরা তোমাদের কাছে প্রমাণ করবো যে তোমরা নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ ছাড়া আর কিছুই নও। ক্ষুধার্ত পশুর শবদেহ ভিন্ন আর কিছুই নও।’
এখানেই শেষ নয়। আজও যখনই ধর্মের নামে নিধন হয় সাধারণ মানুষের, প্রতিবাদীদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় হাস্যকর নির্বোধ প্রশ্ন ... ‘তখন তো চুপ করে ছিলে, এখন কেন সেকুলারিজমের বুলি আওড়াতে এসেছো’ ইত্যাদি, তখন প্রতিবাদীদের মনে বিস্ময়মথিত প্রশ্ন জাগে স্বাভাবিকভাবেই, তবে কি সমসাময়িক ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে শুরু করতে হবে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের যাবতীয় হত্যার ইতিহাস আউড়ে? আর কত পিছিয়ে থেকে শুরু করতে হবে? কেন জানি না মনে হয়, হান এরই উত্তর দিয়েছেন আশ্চর্য পরিমিত ভাষায়, ‘.. There is no way back to the world before the torture. No way back to the world before the massacre.’
মনে পড়ে যায় ‘Passion of the Christ’ চলচ্চিত্রটির কথা। ছবি জুড়ে চলা নৃশংসতার উদযাপন বিশ্ব জুড়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই অসহনীয় একদেশীয় হিংসাকে মথিত করে উঠে আসছিল অহিংসার অব্যক্ত বাণী। যিশুর নীরবতা, চোখের মমতামাখা চাউনি, মানবজাতির প্রতি তাঁর অপার করুণাকেই দ্যোতিত করছিল বারবার। নোবেল বক্তৃতায় হান উল্লেখ করেছেন, লেখা চলাকালীন মাঝেমধ্যেই একটি সমাধিক্ষেত্র দেখতে যেতেন তিনি। হিমশীতল মৃতের স্মৃতির ভীড়ের বিপ্রতীপে জীবনের উষ্ণতা কত সুন্দর, তাই কি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে চাইতেন হান? তার নিজের কথায়, ‘.... এরপরে মাঝেমাঝেই আমি ওই কবরখানায় ফিরে ফিরে গেছি, ঘটনাচক্রে প্রতিবারেই আবহাওয়া ছিল পরিস্কার, উজ্জ্বল। চোখ বন্ধ করলেই সূর্যরশ্মি আমার চোখের পাতায় ব্যাপ্ত হয়ে যেত প্রতিবার। আমার মনে হত যেন এ আলো জীবনের নিজস্ব। অনুভব করতাম, সেই আলো এবং বায়ু যেন আমাকে অবর্ণনীয় এক উত্তাপে ঢেকে দিচ্ছে।’
নারকীয় অত্যাচারের ঘটনা মথিত করে হান এ লেখাতেও কি তুলে আনেন না সহনশীলতার বার্তা? সহনশীলতা, সহমর্মিতাও কি Human Acts নয়?