
২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেলজয়ী হান কাং এর নোবেল বক্তৃতা
- 07 July, 2025
- লেখক: রৌহিন
আলোর সূত্র
গত জানুয়ারি মাসে, কোথাও একটা যাব বলে আমি আমার স্টোররুমটি গোছাতে বসেছিলাম। সেই সময়ই আমি একটা পুরনো জুতোর বাক্স খুঁজে পাই, যার মধ্যে আমার সেই ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি ডায়েরি ছিল। আর ছিল কিছু ডাঁই করা জার্নাল, যার মধ্যে পেলাম একটি ছোট্ট প্যামফ্লেট, তার সামনের পাতায় পেনসিলে লেখা, “এ বুক অফ পোয়েমস”। বইটি খুবই সরু, পাঁচটি A5 মাপের কাগজ আধাআধি ভাঁজ করে স্টেপল করে আটকানো। শিরোনামটির নীচে আমি দুটো ঢেউ খেলানো লাইনও এঁকেছিলাম, তারপর বাঁ দিকে ছ ধাপ ওপরে একটি লাইন আর ডানদিকে সাত ধাপ নীচে আরও একটি। এটি কি কোনো প্রচ্ছদের নকশা বলা যায়? নাকি স্রেফ এলোমেলো আঁকিবুকি? সালটা – ১৯৭৯, পুস্তিকাটির পিছনে আমার নাম লেখা। ভিতরের পাতায় একই পরিস্কার হস্তাক্ষরে একে একে মোট আটটি কবিতা লেখা। প্রতিটা পাতার নীচে আলাদা আলাদা তারিখ দেওয়া, সময়ানুক্রমে। আমার আট বছর বয়সের লেখা সেই কবিতাগুলি স্বাভাবিকভাবেই বেশ নিস্পাপ এবং অমার্জিত, কিন্তু তার মধ্যেই, এপ্রিল মাসের তারিখ দেওয়া একটি কবিতা আমার নজর কাড়ল। সেটি শুরু হচ্ছে এরকমভাবে –
ভালোবাসা কোথায় আছে?
তা আছে আমার ধুকপুক করা হৃদয়ের ভিতর।
ভালোবাসা কাকে বলে?
সেই সোনালি সুতো যা আমাদের হৃদয়গুলি জোড়ে।
(Where is love?
It is inside my thump-thumping beating chest.
What is love?
It is the gold thread connecting between our hearts.)
এক পলকে আমার মন চলে গেল চল্লিশ বছর আগের সেই মুহুর্তটায় – সেই ছোট্ট প্যামফ্লেটটি বানানোর স্মৃতির সেই মণিকোঠায়। আমার সেই ঢাকনা-আলা ছোট কিন্তু শক্ত পেন্সিলটা, সেই পাতা মোছা ইরেজারের গুঁড়ো, আমার বাবার টেবিল থেকে চুপিচুপি নিয়ে আসা সেই বিরাট ধাতব স্টেপলারটা – সব। মনে পড়ল, যখন জানতে পারলাম আমরা সপরিবার সিওল চলে যাচ্ছি, তখনই মনে হল আমার যেখানে যত কবিতা লেখা আছে, টুকরো কাগজে অথবা খাতার মার্জিনে কিংবা মোটা মোটা পুরনো জার্নালের সব লেখালেখির ফাঁকে, সেগুলো সব এখনি এক জায়গায় করে না ফেললেই নয়। মনে পড়ে গেল, একবার এক জায়গায় হয়ে যাবার পর কেন জানিনা মনে হয়েছিল, আমার এই “বুক অফ পোয়েমস” যেন আর কেউ না দেখতে পায়।
পুস্তিকাটি এবং ডায়েরিগুলি আবার সেই বাক্সের মধ্যে রেখে ঢাকাটি বন্ধ করে দেবার আগে আমি আমার ফোনে সেগুলির একটা ছবি তুলে রেখেছিলাম। কারণ কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিল, তখনকার লেখা সেই কথাগুলোর সাথে এখনকার এই আমির কোথাও যেন একটা যোগসূত্র রয়ে গেছে। আমার বুকের ভিতর, আমার ধুকপুক করতে থাকা হৃদয়ের ভিতর, আমাদের মনের ভিতর। সেই সোনালী সূত্র – যা আমাদের জুড়ে রাখে, যে সূত্র আলো ছড়ায়।
*
এর চোদ্দ বছর পরে আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ এবং তার পরের বছর প্রথম ছোটগল্প প্রকাশের মাধ্যমে আমার লেখক জীবনের সূচনা হল। এর প্রায় পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হবে আমার প্রথম দীর্ঘ কাহিনীগ্রন্থ – যেটি লিখতে আমার সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর। কবিতা আর ছোটগল্প লেখার যে প্রক্রিয়াপর্ব, তা আমাকে তখন যেমন আকৃষ্ট করত, এখনও তেমনই, কিন্তু তবুও, উপন্যাস রচনা আমাকে একটু বিশেষভাবেই টানে যেন। আমার বইগুলি লিখতে সময় লেগেছে, এক বছর থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাত বছর পর্যন্তও, এবং আমার ব্যক্তিজীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের মধ্যে দিয়েই সে লেখাগুলি পৃথিবীর আলো দেখেছে। এই ব্যাপারটাই আমাকে আমার কাজের প্রতি আকৃষ্ট করে রাখে সবচেয়ে বেশী। কারণ যেভাবে আমি এই কাজের ভিতরে ঢুকে যাই, সেখানেই বাস করি, সেখানে নানান প্রশ্ন যা আমার মনে জেগে ওঠে, সেগুলির উত্তর পাওয়া এতই অপরিহার্য্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় যে এই আমার লেখালেখির জন্য আমার সংসারের প্রতি যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তাকে তখন ন্যায্য বিনিময় বলেই মনে হয়।
প্রতিবার যখন কোনো উপন্যাস লিখতে বসি, এই প্রশ্নগুলি আমাকে কুরে কুরে খায়। আমি যেন তাদের ভিতরেই বাস করি। যখন এইসব নতুন নতুন প্রশ্নের উদয় হওয়া শেষ হয় – তার মানে কিন্তু এই নয় যে তাদের উত্তরও সব পাওয়া যায় – কিন্তু তখনকার মত নতুন প্রশ্ন আসা বন্ধ হলে আমি টের পাই যে আমার লেখা এবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ততক্ষণে কিন্তু আমি আর সেই মানুষটি নই, যে এই লেখাটি শুরু করেছিল – এবং সেই পরিবর্তিত আমি আবার শুরু করি – নতুন প্রশ্ন নিয়ে। এভাবেই আসতে থাকে একের পর এক প্রশ্নের ধারা – যেন একটা শৃঙ্খলের মতন – অথবা বলা যায় ঢেউএর মতন – একটা আরেকটার সাথে জুড়ে, কখনো বা একটা আরেকটার ওপর দিয়ে – আর এইসব প্রশ্নমালায় ভেসে যেতে যেতে আমি লিখে যাই নতুন এক কাহিনীর বুনোট।
২০০৩ থেকে ২০০৫ - আমার তৃতীয় উপন্যাস, “দা ভেজিটেরিয়ান” লেখার সময়ে কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে বড়ই যন্ত্রণা দিচ্ছিল – “কোনো মানুষই কি কখনো সম্পূর্ণ নির্দোষ হতে পারে?” “কতদূর অবধি কেউ হিংসাকে এড়িয়ে থাকতে পারে?” “কেউ যদি মানুষ নামক প্রজাতির অংশ আর থাকতে না চায়, তাহলে তার গতি কী?”
হিংসা করবে না বলে প্রথমে সবরকমের মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে এবং ক্রমশঃ সম্পূর্ণ আহার পরিত্যাগ করে শুধু জল খেয়ে জীবনধারণ করত ইয়েং হাই – “দা ভেজিটেরিয়ান” গল্পের নায়িকা। সে ভাবত সে একটা গাছ হয়ে গেছে। অথচ সে দেখল, নিজেকে বাঁচানোর এই প্রক্রিয়ায় সে নিজেই খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইয়েং হাই এবং তার বোন, ইন হাই, যারা দুজনেই এই গল্পের যুগ্ম নায়িকা, তাদের এই যন্ত্রণাদায়ক যাত্রায় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে নিঃশব্দে চিৎকার করত, ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত, তবুও শেষ অবধি তারা দুজন একসাথেই ছিল। এই গল্পটি শেষ করেছিলাম একটি অ্যাম্বুলেন্সের দৃশ্যে, কারণ আমিও আশা করেছিলাম, এই কাহিনীর জগতে ইয়েং হাই শেষ পর্যন্ত বেঁচেবর্তে থাকবে। উজ্জ্বল সবুজ পাতায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে চলে যায় গাড়িটি, ভিতরে জাগ্রত চেতনা নিয়ে নির্ণিমেষে বাইরে তাকিয়ে থাকে বড় বোন – হয়তো সে কোনো সাড়া পাবার প্রতীক্ষা করে, অথবা হয়তো এইই তার প্রতিবাদ। পুরো উপন্যাসটিই জিজ্ঞাসার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে – তাকায়, দেখে, অস্বীকার করে। সাড়া পাবার প্রতীক্ষায় থাকে।
“দা ভেজিটেরিয়ান” এর পরের উপন্যাস, “ইঙ্ক অ্যান্ড ব্লাড” এ এই সমস্ত প্রশ্নগুলিই আবারও আসে ঘুরেফিরে, জন্ম নিতে থাকে আরও নতুন প্রশ্ন। হিংসা করব না বলে জীবন যাপনই করব না, এ এক অসম্ভব ভাবনা। আমরা কেউই শেষ অবধি গাছ হয়ে যেতে তো পারিনা। তাহলে কেমন করে বেঁচে থাকা যাবে? এই রহস্যোপন্যাসটিতে বারবার ইটালিক ছাঁদে রোমান হরফগুলি নিজেদের মধ্যে লড়াই করে গেছে, আর এই কাহিনীর নায়িকা, যিনি নিজেই মৃত্যুর ছায়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়ে চলেছেন, চেষ্টা চালিয়ে গেছেন নিজের জীবন বিপন্ন করেও প্রমাণ করতে যে তাঁর বন্ধুর আকষ্মিক মৃত্যু কোনোমতেই আত্মহত্যা হতে পারে না। এই উপন্যাসের শেষ দৃশ্য যখন লিখছি, মৃত্যু আর ধ্বংসের মধ্যে থেকে নায়িকা নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনছেন, তখন আমার মনেও এই প্রশ্নগুলিই ভাসছিল – শেষ অবধি টিঁকে থাকাই কী আমাদের চরম সার্থকতা নয়? বাস্তবে যা ঘটবে, ঘটছে, তার সাক্ষী থাকবে না আমাদের জীবন?
আমার পঞ্চম উপন্যাস, “গ্রীক লেসনস” এ এই প্রশ্নগুলিকেই আরও এগিয়ে নিয়ে গেছিলাম। যদি আমাদের এই দুনিয়ায় বেঁচেবর্তে থাকতেই হয়, তাহলে ঠিক কোন মুহুর্তগুলির অবদান সেটাকে সম্ভবপর করে তোলে? এক নারী যিনি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং একজন পুরুষ যিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, তাঁদের নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকারের মধ্যে নিঃসঙ্গ হাঁটতে হাঁটতে একদিন পরস্পরের মুখোমুখি হন। এই কাহিনীতে আমি সেই মুহুর্তগুলিকে ধরতে চেয়েছি, যা আমাদের স্পর্শ করে যায়। নৈঃশব্দ ও অন্ধকারের নিজস্ব ধীর লয়ে চলতে থাকা এই উপন্যাস একটা উল্লেখযোগ্য বাঁকে এসে পৌঁছায় যখন মেয়েটির হাত পুরুষটির হাতের তালুতে লিখে দেয় কিছু শব্দ। সেই অনন্ত বিস্তারী মুহুর্তের আলোকেই এই দুই চরিত্র প্রথম তাদের হৃদয়ের কোমলতর প্রবৃত্তিগুলির উন্মেষ ঘটায়। যে প্রশ্নটি এখানে আমি তুলে ধরতে চেয়েছি, এমনটা কি সম্ভব যে মানুষের মনের এই কোমলতম প্রবৃত্তিগুলির মধ্যেকার যে অপরিহার্য উষ্ণতা, তাকে স্পর্শ করে, তাকে অনুভব করেই শেষ অবধি এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু হিংস্র পৃথিবীতে জীবনযাপন সম্ভব হয়ে ওঠে?
এই প্রশ্নের শেষে পৌঁছে আমি আরেকটা নতুন বই নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করি। সেটা ছিল ২০১২ র বসন্ত – “গ্রীক লেসনস” প্রকাশিত হয়েছে খুব বেশীদিন তখনো হয়নি। নিজেকে বলেছিলাম, এবারে এমন একটা উপন্যাস লিখব, যেটা আলো এবং উষ্ণতার দিকে আমাদের আরও এক ধাপ এগিয়ে দেবে। জীবন এবং বিশ্বকে আলিঙ্গন করে থাকা এই উপন্যাসকে আমি আরও বেশী করে উজ্জ্বল, স্বচ্ছ সংবেদনশীলতায় আবৃত করে তুলব। চটপট একটা জুৎসই নামও পাওয়া গেল, প্রথম খসড়াটি লিখতে শুরু করে প্রায় কুড়ি পাতা লিখে ফেলার পর নিজেকে থামিয়ে দিতে একপ্রকার বাধ্য হলাম। উপলব্ধি করলাম যে আমার ভিতর থেকে এই উপন্যাসটি লিখতে কেউ একটা বাধা দিচ্ছে।
তখন অবধি আমি গোয়াংজু নিয়ে লেখার কথা সেভাবে ভাবিইনি।
১৯৮০ সালে, আমার বয়স তখন ৯ বছর, আমার পরিবার গোয়াংজু ছেড়ে চলে আসে – গণহত্যা শুরু হবার মোটামুটি মাস চারেক আগে। এর কয়েক বছর পরে, আমার তখন বারো বছর বয়স হবে, হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি বইএর তাকে লম্বালম্বি উলটো করে রাখা বইটি – “গোয়াংজু ফোটো বুক”, ঘরে তখন বড়রা কেউ ছিল না। বইটিতে গোয়াংজুর নাগরিক এবং ছাত্রেরা, যাঁরা অভ্যুত্থানকারী সামরিক শক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে, বেয়নেটের খোঁচায় বা বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের ছবি ছিল। সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ চাপিয়ে যখন সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছিল, সেই সময়ে এই মৃতদের পরিবার এবং অন্য যাঁরা বেঁচে গেছিলেন, তাঁরা গোপনে এই বইটির প্রকাশনার মাধ্যমে সেই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্যের সাক্ষ্য তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। সেই বয়সে ওই ছবিগুলির রাজনৈতিক তাৎপর্য আমি অনুধাবন করতে পারিনি, কিন্তু ওই ধ্বস্ত মুখগুলি আমার মনে মানবজাতি সম্বন্ধে এক স্থায়ী প্রশ্নচিহ্নের জন্ম দিয়ে যায়ঃ এই কি একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের কাজ? আবার পরে যখন আরেকটা দৃশ্য দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সামনে রক্তদানের জন্য মানুষের শেষ না হওয়া দীর্ঘ লাইন, তখনওঃ এইই কি একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের কর্তব্য? এই দুই প্রশ্নের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, যে বৈপরীত্য, যে ধাঁধা, তার জট খোলা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।
অতএব ২০১২র সেই বসন্তে যখন আমি একটা উজ্জ্বল, জীবনকে আশ্লেষ করা উপন্যাস লিখতে বসলাম, সেই অসমাপ্ত সমস্যাটি আরও একবার আমার সামনে ফিরে এল। মানুষের প্রতি সেই গভীর আস্থা তো আমি বহুদিন আগেই হারিয়ে ফেলেছি, তাহলে কেমন করে আমার লেখায় এই বিশ্বকে আমি আলিঙ্গন করব? এগিয়ে যেতে হলে এই অসম্ভব প্রহেলিকার সমাধান আমাকে করতেই হবে, এটা আমি তখনই উপলব্ধি করলাম। এবং আমি এটাও বুঝলাম, একমাত্র লেখার মাধ্যমেই আমি এই দুর্লঙ্ঘ্য বাধাকে অতিক্রম করতে পারি।
সেই বছরের বেশীরভাগ সময় আমার কাটল এই উপন্যাসের ছবিটি মনের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে – ভবনায় ছিল, ১৯৮০ সালের মে মাসের গোয়াংজু শহর এই উপন্যাসের একটা স্তর হয়ে উঠবে। ডিসেম্বর মাসে আমি মাঙ্গোল ডং কবরখানাটি দেখতে যাই। সময়টা ছিল বিকেলবেলা, আগেরদিনই বেশ ভারী তুষারপাত হয়েছে। পরে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল ক্রমশঃ, আমি সেই হিমশীতল কবরস্থান থেকে বেরিয়ে আসি, দুটো হাত বুকের ওপর, আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি জড়ো করে। তখনই নিজেকে বলেছিলাম, আমার পরের উপন্যাসটি সোজাসুজি গোয়াংজুকে নিয়েই হবে, তার কোনো একটা স্তরমাত্র নয়। একটা বই পেয়েছিলাম, যাতে প্রায় নয় শতাধিক সাক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষদর্শীদের। পরবর্তী এক মাস প্রতিদন ন ঘন্টা করে পড়ে সেই বইটি আমি শেষ করেছিলাম। প্রতিটি সাক্ষ্য একাধিকবার, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর শুধু গোয়াংজু নয়, রাষ্ট্রীয় হিংসার বিষয়ে অন্যান্য বইগুলিও পড়া শুরু করি। তারপর এই বিষয়ের আরও গভীরে এবং অতীতেও যাবার তাগিদে পড়া শুরু করি বিভিন্ন গণহত্যা, যা মানুষ ঐতিহাসিকভাবে বারংবার সংঘটিত করে এসেছে বিশ্বজুড়ে, সেসবের ইতিহাস।
এই উপন্যাসটি নিয়ে গবেষণার সময়ে দুটি প্রশ্ন সবার আগে আমার মনে ভেসে উঠত। সেই দুটি প্রশ্ন, আমার মধ্য কুড়ির কোঠায় যা আমার প্রতিটি নতুন ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা থাকত –
বর্তমান কি অতীতকে সাহায্য করতে পারে?
জীবিত মানুষ কি মৃতদের বাঁচিয়ে তুলতে পারে?
আমার পড়া যত এগোতে থাকে, ক্রমশঃ বুঝতে পারি, এগুলো আসলে অসম্ভব প্রশ্ন। মনুষ্যত্বের প্রতি যে বিশ্বাসে আগেই ফাটল ধরেছিল, তার অবশিষ্টাংশগুলিও একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল যেন। উপন্যাসটি লিখে ওঠার আশাটুকুই শুধু বাকি ছিল বলা যায়, আর কিছুই না। সেই সময় এক অল্পবয়স্ক যুবক নৈশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ডায়েরির কিছু পাতা আমার হাতে আসে। লাজুক এবং শান্ত প্রকৃতির যুবা – পার্ক ইয়ং জুন ছিল গোয়াংজুতে মে ১৯৮০র সেই ঘটনার পরের দশদিনের অভ্যুত্থানের সময়ে গড়ে ওঠা স্বশাসিত নাগরিকদের সংগঠন “অ্যাবসোলিউট কমিউনিটি”র একজন সভ্য। অস্থায়ী প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টারের পাশেই YWCA বিল্ডিং এ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে জানত রাত ভোর হলেই সৈন্যরা ফিরে আসবে, তবুও সে সেখানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই শেষ রাতে তার ডায়েরিতে সে লিখেছিল, “হে ঈশ্বর, আমাকে এই বিবেক কেন দিলে, যে আমাকে শুধুই খোঁচা দেয়, যন্ত্রণা দেয়? আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম” ।
এই লাইনগুলি পড়তে পড়তে বিদ্যুত চমকের মত আমার মনের মধ্যে পরিষ্কার ছবি ফুটে উঠেছিল, কোন পথে এগোবে আমার উপন্যাস। এবং আমার সেই দুটি প্রশ্নও আবার নতুন করে বদলে নিতে হবে –
অতীত কী বর্তমানকে সাহায্য করতে পারে?
মৃত কী জীবিতকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে?
আমি যখন পরে লিখছিলাম, যা পরবর্তীকালে “হিউম্যান অ্যাক্টস” হয়ে দাঁড়াবে, কিছু কিছু মুহুর্তকে আমি অনুভব করেছিলাম যখন সত্যিই অতীত বর্তমানকে সাহায্য করছিল, মৃত বাঁচাচ্ছিল জীবিতকে। এরপরে মাঝেমাঝেই আমি ওই কবরখানায় ফিরে ফিরে গেছি, ঘটনাচক্রে প্রতিবারেই আবহাওয়া ছিল পরিস্কার, উজ্জ্বল। চোখ বন্ধ করলেই সূর্যরশ্মি আমার চোখের পাতায় ব্যাপ্ত হয়ে যেত প্রতিবার। আমার মনে হত যেন এ আলো জীবনের নিজস্ব। অনুভব করতাম, সেই আলো এবং বায়ু যেন আমাকে অবর্ণনীয় এক উত্তাপে ঢেকে দিচ্ছে।
ওই ছবিগুলি দেখার পর থেকে দীর্ঘদিন এই প্রশ্নগুলি আমার মনের মধ্যে রয়ে গেছে – “মানুষ এতটা হিংস্র হতে পারে কিভাবে? আবার একই সঙ্গে এই সর্বগ্রাসী হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়ই বা কিভাবে সেই মানুষই? মানুষ নামক প্রজাতিটির আসল বৈশিষ্ট তাহলে ঠিক কোনটি? একদিকে এই ভয়াবহতা, অন্যদিকে সম্ভ্রমবোধ, মানুষের এই পরস্পরবিরোধী দুই বৈশিষ্ট্যের মাঝের শূন্যস্থানটি পুরণ করার জন্য আমাকে অগত্যা মৃতের সাহায্য নিতে হয়। ঠিক যেভাবে আমার এই “হিউম্যান অ্যাক্টস” উপন্যাসের ডং হো নামের শিশুটি তার মায়ের হাত ধরে টানতে থাকে তাকে সূর্যের কাছে টেনে নিয়ে যাবে বলে।
যাঁরা মরে গেলেন, যাঁরা শোক পেলেন, অথবা যাঁরা বেঁচে গেলেন, তাঁদের সাথে যা যা ঘটেছে, তার কোনোটিই ফিরিয়ে দেবার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। আমি যা করতে পারি, তাঁদেরকে আমার আবেগ, আমার সংবেদনশীলতা, যে জীবন আমার দেহে,আর ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, তার স্পর্শটুকু দেওয়া। আমার উপন্যাসের শুরুতে এবং শেষে, একটি মোমবাতি জ্বেলে দেবার কথা আছে। উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে পৌরসভার জিমন্যাশিয়ামে যেখানে মৃতদের শরীরগুলি রাখা আছে এবং তাদের অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখানেই আমরা দেখতে পাই পনেরো বছরের ডং হো সেই শরীরগুলির ওপর সাদা চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে আর একটা করে মোমবাতি জ্বেলে দিচ্ছে। সেই মোমের শিখার ভিতরের হালকা নীলাভ অংশটির দিকে সে চেয়ে থাকছে।
কোরিয়ান ভাষায় এই উপন্যাসটির শিরোনাম “সোনিয়ন-ই ওন্ডা”। শেষ শব্দটি, “ওন্ডা” হল “ওডা” ক্রিয়াপদের বর্তমান রূপ – যার অর্থ “আসা”। যে মুহুর্তে সোনিয়নটি, অর্থাৎ বালকটিকে দ্বিতীয় পুরুষে, ”তুমি” বলে ডাকা হল, সে তুমি খুব ঘনিষ্ঠ হোক বা ততটা ঘনিষ্ঠ না-ই হোক, সে সেই আধো-আলো আধো অন্ধকারে জেগে ওঠে, বর্তমানে ফিরে আসে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আসলে একটি আত্মার পদক্ষেপ। পায়ে পায়ে সে এগিয়ে আসে, আরও কাছে – আসতে আসতে হয়ে ওঠে বর্তমান। মানুষের নিষ্ঠুরতা ও সম্ভ্রমবোধের মত দুই চরম বিপরীত প্রবৃত্তি যখন একটি নির্দিষ্ট শহরের এক নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলতে বলতে একদম চরমে পৌঁছায়, তখন সেই নামটি, গোয়াংজু, আর কোনো নির্দিষ্ট শহরের নাম, শুধু একটা প্রপার নাউন থাকে না, তা হয়ে দাঁড়ায় কমন নাউন – এই বইটি লেখার সময়ে আমি এভাবেই শিখেছি। স্থান, কালের বাধা পেরিয়ে সে আমাদের কাছে আসে, আসতেই থাকে – সর্বদাই এই বর্তমানে এসে পৌঁছাতে থাকে – এমনকি এখন, এই মুহুর্তেও।
অবশেষে ২০১৪ সালে যখন বইটি প্রকাশিত হল, পাঠকদের বেদনার অনুভব, যা তাঁরা আমাকে জানিয়েছিলেন, আমাকে বিস্মিত করেছিল। যে যন্ত্রণা এই বইটি লেখার প্রতিটি পর্বে আমি অনুভব করেছি নিজে, তার সঙ্গে পাঠকের এই কষ্ট কোথায় কিভাবে মিলে গেল, তা বুঝতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছিল। এই বেদনার উৎসটা কী হতে পারে? আমরা কী তাহলে কোথাও না কোথাও মানবতার ওপর বিশ্বাস রাখতেই চাই, তাই যখন সেই বিশ্বাসের ভীত নড়ে যায়, তখন তা আমাদের ব্যথাতুর করে তোলে এইভাবেই? ভালোবাসাই কি এই বেদনার জন্ম দেয়, কিছু বেদনা কি প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসারই সাক্ষ্য দেয়?
সেই বছরই জুন মাসে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নে আমি একটা প্রকাণ্ড সমতল ভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, আমার সারা গায়ে কুচি কুচি বরফ ঝরে পড়ছিল। হাজার হাজার গাছের কালো কালো কাণ্ড দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে ছিল, আর প্রতিটা কাণ্ডের পিছনে ছিল একটি করে কবর। একটা সময় দেখলাম আমি জলের ওপর পা ফেলছি, আর পিছনে তাকিয়ে দেখি সেই সমতল্ভূমির একপ্রান্ত থেকে সমুদ্র ছুটে আসছে আমার দিকে – যে প্রান্তটিকে আমি দিগন্ত ভাবছিলাম। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এরকম একটা জায়গায় এত কবর কেন? সমুদ্রের কাছাকাছি যে সব কবর, তাদের হাড়গোড়গুলি তো ভেসে যাবার কথা! আমার কি উচিৎ নয় এখনই অন্তত সেই হাড়গোড়গুলিকে অন্ততঃ কিছুটা ওপরের দিকের কবরগুলিতে রেখে দেওয়া? কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? আমার হাতে তো একটা শাবলও নেই! জল ততক্ষণে আমার গোড়ালি অবধি উঠে এসেছে। এই সময় আমি জেগে উঠলাম। বাইরে তখনো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মন বলল, এই স্বপ্নটা আমাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলে গেল। আমার সেই স্বপ্নটা খাতায় লিখে ফেলার পর মনে হল, আমার পরবর্তী উপন্যাসের সূচনা হয়তো এটাই হতে চলেছে।
এই কাহিনী শেষ অবধি কোন পথে যাবে, সে সম্বন্ধে কোনো স্বচ্ছ ধারণা আমার ছিল না তখন। যাই হোক, আমি ওই স্বপ্নটা থেকে হতে পারে এরকম বেশ কয়েকটি গল্পের সূচনা খসড়া করছিলাম, কাটাকাটি করছিলাম। অবশেষে ২০১৭ র ডিসেম্বরে আমি জেজু দ্বীপে একটা ঘর ভাড়া করি এবং পরবর্তী দুই বছর আমার সময় কাটে সিওল আর জেজু আইল্যান্ডে ভাগাভাগি করে। সমুদ্রের ধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, কখনো বা গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে – প্রতি মুহুর্তে জেজুর আবহাওয়াকে তীব্রভাবে অনুভব করতে করতে – তার হাওয়া, আলো, বরফ, বৃষ্টি – এ সব কিছুকে বুঝতে বুঝতে আস্তে আস্তে সেই উপন্যাসটি আমার মনের মধ্যে ফুটে উঠল। “হিউম্যান অ্যাক্টস” এর সময়ের মতই এবারেও আমি অনেক সাক্ষ্য পড়ছিলাম – এবারে কোনো ধ্বংসকাণ্ডের হাত থেকে বেঁচে ফেরা মানুষদের। প্রথমে সেই লেখাগুলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপরে আস্তে আস্তে তার ভিতরে ঢুকে, তার বিস্তারিত বিবরণ থেকে চোখ না সরিয়েও একটু যেন বাইরে থেকে সেই বর্ণনাগুলি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এসব অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করা বোধ হয় সম্ভবই নয়। অবশেষে লেখা হল সেই বই, যা পরে “উই ডু নট পার্ট” নামে প্রকাশিত হবে। সেই দিগন্ত বিস্তৃত গাছের কাণ্ডের আর এগিয়ে আসা সমুদ্রের স্বপ্নটি দেখার প্রায় সাত বছর পরে প্রকাশিত হয়েছিল এই বইটি।
এই বইটা নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার নোটবুকে কয়েকটি নোট রেখেছিলাম –
জীবন বাঁচতে চায়। জীবন ঊষ্ণ।
মরে যাওয়া মানে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। মুখের ওপর পড়া তুষারকে গলে যেতে না দিয়ে জমিয়ে রাখা।
মেরে ফেলা মানে কাউকে ঠান্ডা করে দেওয়া।
ইতিহাসের মানুষ এবং মহাবিশ্বের মানুষ।
বায়ু এবং সমুদ্রের স্রোত। তাদের বৃত্তাকার চলন সারা বিশ্বকে যুক্ত করে রাখে। আমরা সংযুক্ত। আমি প্রার্থনা করি যে আমরা সকলে সংযুক্ত।
উপন্যাসটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে এক অনুভূমিক যাত্রা – যা এই কাহিনীর কথক কিয়ুংঘার সাথে সাথে আমাদের নিয়ে চলে সিওল থেকে তার বান্ধবী ইনসেওনের জেজু দ্বীপের পাহাড়ের ওপরের সেই বাড়িতে – প্রবল তুষারপাতের মধ্যে তার পোষা পাখিটাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। দ্বিতীয় পর্বের যাত্রাপথ উল্লম্ব – কিয়ুংঘা আর ইনসেওনকে নিয়ে নেমে যায় মানবতার অন্ধকারতম এক রাতে – ১৯৪৮ সালের সেই রাত যেদিন জেজু দ্বীপের অধিবাসীদের দলে দলে হত্যা করা হয়েছিল – এবং তারপরে আরও নীচে – সমুদ্রের তলদেশে। তৃতীয় তথা শেষ পর্বে তারা দুই বন্ধু সমুদ্রের তলদেশে জ্বেলে দেয় একটি মোমবাতি।
কাহিনীটি যদিও দুই বন্ধুর যাত্রাপথের সাথেই এগিয়ে চলে, কিন্তু যে মুহুর্তে তারা মোমবাতি হাতে ঘুরে দাঁড়ায়, সেই মুহুর্তে বোঝা যায় এই কাহিনীর আসল নায়িকা আসলে ইনসেওনের মা, জেওংসিম – যিনি কিয়ুংঘা এবং ইনসিওন, দুজনের জীবনের সাথেই বিভিন্নভাবে জড়িত। তিনি সেই জেজু হত্যাকাণ্ডের একজন উত্তরজীবি (সার্ভাইভার), যিনি তাঁর প্রিয় মানুষটির একটি হাড় অন্ততঃ উদ্ধার করতে শেষ অবধি লড়ে গেছেন, যাতে তাঁর ঠিকঠাক অন্ত্যেষ্টিটুকু করতে পারেন অন্ততঃ। তিনি কখনো শোকপ্রকাশ বন্ধ করে দেননি, সমস্ত বেদনার ভার বয়ে তিনি বিস্মৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। তিনি কখনো বিদায়বাণী উচ্চারণ করেননি। যন্ত্রণা এবং প্রেমের সমান সমান গাঢ়ত্ব এবং উত্তাপ নিয়ে তিনি জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন। যে প্রশ্নগুলি আমি এখানে তুলতে চেয়েছি, সেগুলি হল – আমরা কতদূর অবধি ভালোবেসে যেতে পারি? আমাদের সীমা কোথায়? শেষ অবধি মানুষ হয়ে থাকার জন্য আমাদের কতটা ভালোবেসে যেতে হবে?
“উই ডু নট পার্ট” এর কোরিয়ান সংস্করণটি প্রকাশ হবার পর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে, আমার পরবর্তী উপন্যাসটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এবং তারপরের যে বইটি আমি কল্পনায় এনে রেখেছি, সেই ভাবনাটি দীর্ঘ সময় ধরে আমার ভিতর লালিত হচ্ছে। এই উপন্যাসটি আনুষ্ঠানিকভাবেই “দা হোয়াইট বুক” উপন্যাসটির সাথে জড়িত। বইটি আমি লিখেছিলাম আমার বড় বোন, যে কিনা তার জন্মের মাত্র দুই ঘন্টা পরেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়, তাকে আমার জীবনের একটা অংশের ভাগ দেবার অভিপ্রায়ে, এবং সেই সময়ে আমাদের সেই বন্ধনগুলি, যারা আজও অচ্ছেদ্য, তাদের দিকে আরও গভীরভাবে তাকানোর উদ্দেশ্যে। যেমন সবসময়েই হয়, এই লেখা শেষ হতে কত সময় লাগবে তা অনুমান করা আমার নিজের পক্ষেও অসম্ভব। তবুও আমি লিখে যাব, যত আস্তেই হোক না কেন। যে সব বই ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে, সেগুলিকে ছেড়ে এগিয়ে যাব, নতুন পথের সন্ধানে। ততদূর পর্যন্ত, যতক্ষণ না একটা বাঁক নেবার পর পিছনে ফিরে তাকালে আর তারা আমার দৃষ্টিসীমায় ধরা দেবেনা। ততদূর, যতটা আমার জীবন আমাকে নিয়ে যাবে।
আমি যখন দূরে চলে যাব, আমার বইগুলি তাদের নিজস্ব জীবন যাপন করবে, আমার থেকে মুক্ত হয়ে, তাদের নিজের নিজের নিয়তির দ্বারা চালিত হয়ে। সেই দুই বোনের মত, যারা একসাথে বসে আছে অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে, কাচের ওপারে ঝলসাচ্ছে সবুজ আগুন। সেই মেয়েটির মত, যে শ্রীঘ্রই তার ভাষা খুঁজে পাবে, নিস্তব্ধতার মধ্যে, অন্ধকারে ছেলেটির হাতের তালুতে নিজের আঙুল দিয়ে লিখতে লিখতে। আমার সেই বোনের মত, যে জন্মের দুই ঘন্টা পরেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেল, অথবা আমার সেই মায়ের মত, যে তার কাছে বারবার প্রার্থনা করছিল, “মরে যেও না, দয়া করে মরে যেও না” বলে – একেবারে শেষ সময় অবধি। সেইসব আত্মারা কতদূর যাবে – যারা আমার দুচোখের পাতা আবৃত করেছিল কমলা রঙের সেই উষ্ণ সূর্যরশ্মিতে? সেই মোমবাতিগুলি কতদূর ভ্রমণ করবে – যারা জ্বলেছিল প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরে পরে, স্থান-কাল পার করে প্রতিটি হিংসার পরে? বাহিত হয়েছিল তাদের হাতে হাতে, যারা নাকি কখনো বিদায় সম্ভাষণ করবে না বলে পণ করেছিল? তারা কি এগিয়ে যাবে, এক দীপ থেকে আরেক দীপ, এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে, একটা সোনালী সুতোর মতন?
গত জানুয়ারি মাসে ঘর গোছাতে গিয়ে জুতোর বাক্সের মধ্যে যে ছোট্ট প্যামফ্লেটটি খুঁজে পেয়েছিলাম, তাতে আমার সেই অতীতের আমি, ১৯৭৯ সালে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিল,
ভালোবাসা কোথায় আছে?
ভালোবাসা কাকে বলে?
অথচ ২০২১ এর শরতে, যখন “উই ডু নট পার্ট” প্রকাশিত হল, তখন আমি আমার অন্তরের দুটি মূল সমস্যাকে ভাবছিলাম এরকমভাবে –
এই দুনিয়া এত হিংস্র এবং বেদনাদায়ক কেন?
অথচ তা সত্ত্বেও এই দুনিয়া এত ভীষণরকম ভালোই বা কিভাবে?
বহুদিন ধরে আমার মনে হয়েছে, এই দুই বাক্যের মধ্যের যে টানাপোড়েন, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সেটাই আমার লেখার মূল চালিকাশক্তি। আমার প্রথম উপন্যাস থেকে শুরু করে একদম শেষতমটি পর্যন্ত একের পর এক প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে উঠেছে, বদলে গেছে, নতুন করে জেগেছে, তবুও এই দুটি প্রশ্নই ধ্রুবকের মত স্থির থেকে গেছে। কিন্তু দুই কি তিন বছর আগে থেকে আমার মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করে। আমি কি আসলে ২০২৪ এ “হিউম্যান অ্যাক্টস” এর কোরিয়ান সংস্করণটি প্রকাশ হবার পর থেকেই মাত্র, নিজেকে ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন করা আরম্ভ করেছি? যে বেদনা আমাদের জুড়ে রাখে, তাকে নিয়ে প্রশ্ন করা? আমার শুরু থেকে একদম শেষতম উপন্যাসে আমার যে খোঁজ, তার গভীরতম স্তরটি কি সেই ভালোবাসারই খোঁজ নয়? এমনটা কি হতে পারে যে ভালোবাসাই আমার জীবনের মৌলিকতম, অন্তরতম সুর?
১৯৭৯ সালের সেই বাচ্চা মেয়েটি লিখেছিল, ভালোবাসা আছে “আমার হৃদয়” নামক একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে (“তা আছে আমার ধুকপুক করা হৃদয়ের ভিতর”)। আর ভালোবাসা কাকে বলে র উত্তরে সে লিখেছিল, “সেই সোনালি সুতো যা আমাদের হৃদয়গুলি জোড়ে” ।
আমি লিখি আমার সমস্ত শরীর দিয়ে। আমার সমস্ত সংবেদনশীলতা দিয়ে, শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, স্বাদের যাবতীয় অনুভূতি, কোমলতা এবং উষ্ণতা, বেদনা এবং শীতলতা, সব ব্যবহার করে। আমার শরীর ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর হয়, আমার হৃদপিণ্ড স্পন্দিত হয়, আমি হাঁটি, দৌড়াই, হাওয়া এবং বৃষ্টিধারা এবং তুষারপাত আমার ত্বকে অনুভব করি, কারো হাতে হাত রাখি – সবই আমার লেখার উপাদান হয়ে ওঠে। আমার প্রতিটি বাক্যে আমি মানুষ হিসাবে আমার সেই তীব্র অনুভূতিগুলিকে আবিষ্ট করে দেবার চেষ্টা করি। যেন আমি কোনো বৈদ্যুতিক স্রোত পাঠাচ্ছি। যখন বুঝতে পারি, আমার পাঠকের হৃদয়েও সেই বিদ্যুৎ সঞ্চারিত, আমি বিস্মিত হই, আপ্লুত হই। এই সব মুহুর্তে আবারও অনুভব করি, ভাষার সূত্রে কিভাবে আমরা একে অপরের সাথে সংযুক্ত হতে পারি, আমার মধ্যের সেই প্রশ্নগুলি কেমন করে সেই জীবন্ত বিদ্যুতের মতন আমার পাঠকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলে। যাঁরা আমার সাথে এই সোনার সুতোয় জড়িয়ে আছেন, এবং যাঁরা আগামীতে যুক্ত হবেন, তাঁদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
অনুবাদ - রৌহিন