অমিয়ভূষণ মজুমদারের উপন্যাস রাজনগর

লিখেছেন মণীশ রায়

১৮৬০ সন। সিপাহী বিদ্রোহের রক্তমাখা দাগ তখনও লেগে রয়েছে লক্ষ্ণৌ, কানপুর, ঝাঁসি, মিরাট, ব্যারাকপুর, কিংবা দিল্লির পথে-প্রান্তরে। ভূমিকম্পের মতন এ মিউটিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিত নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। যদিও নির্দয়-নিষ্ঠুর হাতে বিদ্রোহ শায়েস্তা করা হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই আর পুরোনো স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে না শাসকগোষ্ঠী। নীলের বদলে চা কিংবা গায়েনায় গিয়ে ইক্ষুগুড়ের চাষ করতে অনেকে মনস্থির করে ফেলেছে। এদ্দিন যে প্রবল বিক্রমে চাবুক মেরে ও চাবুকের ভয় দেখিয়ে সাধারণ নিরীহ কৃষকের রক্ত চুষে নীলচাষ করেছে নীলকরেরা, তা অনেকখানি ঢিমে তেতালা হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে শুধু প্রান্তিক পর্যায়ের নির্যাতিত শোষিত কৃষক-শ্রেণি নয়, উপমহাদেশের শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি- রাজনীতির ভেতরও তীব্র অসন্তোষ ও দ্রোহবোধের জন্ম হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ছেলে-ছোকরার দল ইংরেজদের বিরুদ্ধেই লড়তে চাইছে।
 
অন্যদিকে, ব্রিটিশ রাজের চোখে অবিশ্বাস, সংশয় ও তীব্র প্রতিশোধ-স্পৃহা; যে করেই হোক এই বিদ্রোহকে সমূলে নির্মূল-নির্বাক করে ফেলতে হবে। থামিয়ে দিতে হবে ওদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। ফলত, এদেশীয় সাধারণ মানুষদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন শঙ্কা ও অবজ্ঞা যেমন বেড়েছে, তেমনি এ কথাও বলতে দ্বিধা নেই, জনমানুষের আত্মবিশ্বাস ও আত্মোপলব্ধির জায়গাটা সাথে সাথে অনেকখানি মজবুত হচ্ছে। নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে সবাই। যোগাযোগের মাধ্যম তখন গোরু, ঘোড়ার গাড়ি আর নৌকা। ইংল্যান্ড থেকে একটি খবরের কাগজ পালতোলা জাহাজে করে ভারতে ভেসে আসতে ছ’মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। ক্রিমিয়ায় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের ভেতর যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হচ্ছে, তাও বিশিষ্ট নাগরিকদের কান অবধি নিয়মিত পৌঁছে না। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সেবাচিত্র প্রতিটি ক্রিমিয়াফেরত গোরা সৈনিকের মুখে মুখে ফিরলেও লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প নাইটিংগেল সম্পর্কে ‘কোনো সৎ মহিলার পক্ষেই কি নিজের বাবা ভাই স্বামী ছাড়া আর কাউকে সেবা করা সম্ভব? বলুন, তা যায়? আর তিনি কিনা মে-ফেয়ারের মহিলা!’ মন্তব্য করে বিস্ময় প্রকাশ করছেন বাগচী মাস্টারের স্ত্রী মেমসাহেব ক্যাথারিন। স্টিম ইঞ্জিনের সম্ভাবনা পর্যন্ত নীলকর ডানকান সাহেব উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সমুদ্র পাড়ি দেবে কলের নৌকা? এ-ও সম্ভব? ইংরেজি ভাষা-সম্ভার থেকে ‘সেইল’ শব্দটাই তাহলে হাওয়া? পালাযাত্রার বদলে থিয়েটার মঞ্চস্থ হচ্ছে রাজনগরে রানির জন্মতিথি উপলক্ষে। চিকন-চাকন গোঁফহীন পুরুষগুলো নারী সেজে দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ কিংবা মাইকেল মধুসূদন দত্তের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে অভিনয় করছে। সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে সম্পন্ন-সম্ভ্রান্ত লোকজন অবিরাম সাহেবসুবাদের অনুকরণ করে চলেছেন। চুরুট ফুঁকছেন; দেদার কফি পান করছেন। রানি ভিক্টোরিয়ার সময় হলেও টেবিলের পায়া ধরে ডিনার সারার মতো মদ্যপানে আসক্তি বাড়ছে। বারাঙ্গনাপ্রীতি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সম্ভ্রান্ত নারী-পুরুষদের ভেতর তাস-দাবা খেলায় আগ্রহ অতিশয় তীব্র। স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা, যারা ক’দিন আগেও শিলোয়ারচুস্ত চোগা-চাপকান পরে মুসলমান উজির-নাজিরদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে মুরগি-মুসল্লম না খেলেও মদ্যপান করেছেন, তারা এখন ব্রিচ-কোট-বুট-হ্যাট পরে সাহেবি কেতায় মগ্ন, হাতে ঝুলছে রুপায় বাঁধানো মালাক্কান লাঠি বা ছড়ি। তাঁরা বিশ্বাসে হিন্দু হলেও, আচরণ, পোশাক- পরিচ্ছদ ও লেখাপড়ায় পুরো সাহেব। তাঁরা দক্ষ হাতে পিয়ানো বাজাচ্ছেন। লেমনসহ বার্গান্ডি বানিয়ে নারী-পুরুষ মিলে সিপ করছেন রাজঅন্তঃপুরে।
 
এদিকে দিল্লির মসনদে তখনও মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ অধিষ্ঠিত; তিনি সাহেবদের করুণানির্ভর এক নিরুপায় কবি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভাতা নেন আর কবিতা লেখেন। আরেকজন উয়াজেদ আলি শাহ অযোধ্যা হারিয়ে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে গৃহবন্দি; ব্রিটিশদের কাছ থেকে হাত পেতে পেনশন নেন আর মনে রাখার মতন এক-একটি সঙ্গীত-জলসার আয়োজন করে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। যে সময়ে ফরাসি দেশের সম্রাাট নির্ভীকচিত্তে গিলোটিনে মাথা রাখছেন পরিবার-পরিজনসহ, সে সময়ে মোগল অধীশ্বর করুণা ভিক্ষা করছেন ব্রিটিশদের কাছে। রাজনগরের রাজকুমার রাজচন্দ্র যখন রাজতন্ত্র নিয়ে ‘সব রাজা জানে না, কিন্তু জানা তো উচিত যে, রাজা অনেকগুলো মানুষের স্বাধীনতার ধারণা, শক্তির ধারণা। সেটা গেলে রাজাই বা কোথায়? … সকলে কী চায় আর রাজা কী চায় তার মধ্যে পার্থক্য থাকবে না? সারা জীবন সকলের থেকে পৃথক, আর মৃত্যুর সম্মুখে একাকার, তা হয় না, হলে রাজা থাকে না, অন্যায় হবে।’ বলে মন্তব্য করেন তখন পাঠক মূলত লেখকের বিশ্লেষণ-শক্তিকেই প্রত্যক্ষ করেন।
 
তা সত্ত্বেও, সিপাহি বিদ্রোহ বৃথা যায়নি বলেই অনেকের বিশ্বাস। অনেকের কাছে এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পাঠ বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে। ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা জাগরণ বলতে যা বোঝায়, তা সিপাহি বিদ্রোহের ফল বলে অনেকে ধারণা করেন। পরিবর্তনের হাওয়ায় উদ্বেল হয়ে ওঠে তখনকার সমাজ। এর ফলে নীলকর সাহেবরা সদা সন্ত্রস্ত। মিশনারি পাদ্রি সম্প্রদায় গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ব্যস্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচারগুলোকে কেবলই ‘হিদেন’, ‘পেগান’ বলে নিয়মিত গালাগাল দিচ্ছেন আর অসহায়- অশিক্ষিতদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ধর্মান্তরিত করে চলেছেন। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হবার ঢেউ ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চাভিলাষী যুবকদের গায়েও লাগছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় দলে দলে তারা খ্রিশ্চান হচ্ছেন। যুক্তিবাদী শিক্ষক ডিরোজিওর চ্যালা হয়ে যাঁরা একসময় গোরুর হাড় ছুঁড়ে মেরেছেন ব্রাহ্মণদের দিকে, তাঁরা এখন হিন্দু সমাজের সমস্ত কুসংস্কারের অর্গল ভেঙে দিচ্ছেন। তাঁরাই আবার ব্রিটিশদের অত্যাচার- অনাচারের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে লড়ে চলেছেন।
 
টোল-পণ্ডিত ছাত্র হারাচ্ছেন। সবাই পাদ্রিদের তৈরি স্কুলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাইছে। স্মৃতি কিংবা ন্যায়শাস্ত্রের বদলে তারা ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ও ইংরেজি চর্চা করতে বেশি স্বস্তিবোধ করছেন। ‘মেটেরিয়া মেডিকা’র প্রভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। কবিরাজ- হাকিমদের ওপর আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। মানব সভ্যতার শিকড় খুঁজতে গিয়ে চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ ইতোমধ্যে (১৮৫৯) বেরিয়ে গেছে। বিচার-সংক্রান্ত কার্যক্রমও এখন পুরো সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। আগেকার কাজি-কোতোয়াল আর নেই, এখন ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টরের যুগ। ক্রীতদাস প্রথা রদ হয়েছে; চাইল্ড-লেবার নিয়েও পার্লামেন্টে কথা উঠছে। রানি ভিক্টোরিয়ার কাল বলে কথা।
 
এ রকম এক সময়ের গল্প হচ্ছে ‘রাজনগর’। শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় এটি এক রাজকীয় এস্টেটের বৃত্তান্ত। গবেষণার মন নিয়ে খুঁজলে কোচবিহারের কাছাকাছি কোথাও হয়তো এই ‘রাজনগর’ জনপদটি খুঁজেও পাওয়া যাবে। মূলত, এটি একটি উপন্যাস এবং লেখক অমিয়ভূষণ মজুমদার গভীর অধ্যয়ন ও তীক্ষè পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে ইতিহাসের ভেলায় চড়ে ঊনবিংশ শতকের হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান অধ্যুষিত ‘রাজনগর’ জনপদটির রাজাচার-লোকাচার, দ্বন্দ্ব- সংঘাত ও সমন্বয়ের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। তাঁর মননে পাবনা-পাকশী এবং কোচবিহার সমানভাবে প্রোথিত; সেই প্রভাব গড় শ্রীখণ্ড বা রাজনগরে দৃশ্যমান। তাঁর প্রিয় ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বাভাবিকভাবেই ঘটনার ঘনঘটা তাঁর উপন্যাসের যত্রতত্র মিলবে, এটা ধরেই নেওয়া যায়। কিন্তু বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানী কিংবা দুর্গেশনন্দিনীর কলেবরে রয়েছে রোমাঞ্চকর, নাটকীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ ঘটনার সমারোহ; এ জায়গায় বঙ্কিমের সঙ্গে অমিয়ভূষণের পার্থক্য হচ্ছে, তিনি শুধু ঘটনা নয়, ঘটনার চেয়ে এর পারিপার্শ্বিক খুঁটিনাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বেশি আন্তরিক ও উৎসাহী। এ প্রসঙ্গে একটি প্রচলিত লোকগল্পের অবতারণা করা যেতে পারে। একবার বাঙালির ইতিহাস খ্যাত লেখক ড. নীহাররঞ্জন রায় আর মনোজ বসু সাহিত্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে বেড়াতে গেছেন কোচবিহারে। সেখানেই আড্ডা জমেছে তিনজনার। নিশিকুটুম্ব-এর লেখক তুমুল জনপ্রিয় কথাশিল্পী মনোজ বসু অমিয়ভূষণকে জানালেন, প্রচুর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটির ফলে তাঁর গল্প-উপন্যাস বেশ দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে। সাধারণের জন্য বলতে গেলে ‘নো এন্ট্রি জোন’ তাঁর সাহিত্যজগৎ। একটুখানি সহজবোধ্য হলে ভালো হয় বলে উপদেশও ঝাড়লেন। পাশ থেকে ড. নীহাররঞ্জন রায় উত্তর দিলেন, সবাই একরকম লিখলে কীভাবে হবে, কেউ কেউ আমাদের জন্যও তো লিখবেন, নাকি? এ জবাবের ভেতরই প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে অমিয়ভূষণ কোন ধারার লেখক, তার ইঙ্গিত। কমলকুমার মজুমদার, জগদীশ গুপ্ত এবং অমিয়ভূষণ মজুমদারকে একই ঘরানার ব্যতিক্রমধর্মী দুর্বোধ্য লেখক হিসেবে ধরা হয়। পাশে বহু উচ্চারিত ঢোঁড়াই চরিত মানসখ্যাত সতীনাথ ভাদুড়ীর নামও জড়িয়ে থাকে। কেউ অধুনা মহাকাব্যিক গদ্যরীতির স্রষ্টা দেবেশ রায়ের নামও উল্লেখ করেন। এঁদের গদ্যে চিন্তা ও ভাষার জটিলতা মিলেমিশে থাকে বলে এ ধরনের একটি ঢালাও মন্তব্য শুরু থেকেই রয়ে গেছে। এই আলোকে বিচার করলে কমলকুমার মজুমদারকে ‘লাল জুতা’ গল্পের জন্য যেমন দুর্বোধ্য ভাবা যায় না তেমনি রাজনগর কিংবা গড় শ্রীখণ্ড-নয়নতারা উপন্যাসকে কোনোভাবেই অবোধ্য বলা যাবে না। অমিয়ভূষণ আটত্রিশ বছরের সক্রিয় লেখক জীবনে কম করে হলেও পঁচিশখানা শুধু উপন্যাসই লিখে গেছেন। এর ভেতর বাহাত্তর-চুয়াত্তরে প্রকাশিত রাজনগর উপন্যাসটি কি সত্যি পাঠকের জন্য অনতিক্রম্য এক গল্প?
 
প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। তাহলে তিনি যে রাজনগর উপন্যাসের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি মনোসামাজিক পটভূমি তৈরি করেছেন তা কি পাঠকের জানাশোনার বাইরের কোনো অলীক-অসম্ভব জগৎ? উপন্যাসে বিধৃত রানিমা বিশখা (বৈশাখে জন্ম হওয়ায়) ও তাঁর ফিরিঙ্গি প্রেমিক জাঁ পিয়েত্রো কিংবা রেভারেন্ড চন্দ্রকান্ত এন্ড্রুজ বাগচী এবং তাঁর স্ত্রী ক্যাথারিন বা সংক্ষেপে কেট কিংবা রাজচন্দ্র-নয়নতারা আখ্যান কি খুব অপরিচিত আমাদের কাছে? এস্টেটের কর্ত্রী রানিমা যখন আপন পিসতুতো ভাই নিখোঁজ জাঁ পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন নিজের বুকের রক্তচন্দন দিয়ে, তখন কি পাঠক চমকায় না? তখন কি প্রশ্ন জাগে না সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেওয়া ফরাসডাঙ্গার লাপাত্তা এই ফরাসি সৈনিকটি কে তবে? তাঁর সহচর বুজরুক, গোবর্ধন কারা? রানিমার সাথেই বা তাঁর কিসের সম্পর্ক? ধীরে ধীরে পাঠক ঠিকই জানতে পারেন, অকুতোভয় জমিনদার জাঁ পিয়েত্রো রানিমার পিসি জ্ঞানদার ছেলে। বাবা ফরাসি সাহেব হলেও মা দিশি ব্রাহ্মণকন্যা। রানিমা যখন চতুর্দশী, তখন পিয়েত্রোর প্রেমে মজেছিলেন। বাগচীমাস্টারের কুঠিতে জাঁ পিয়েত্রো ব্যবহৃত পিয়ানোখানার ওপর যে ‘বিয়াচে’ নামাঙ্কিত রয়েছে, সেটি আর কেউ নন, স্বয়ং রানিমা। পিয়েত্রো আদর করে প্রিয়তমা চতুর্দশীকে বিয়াত্রিচে বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু মামাতো ভাইবোন হওয়ায় কোনোদিনই তাদের মিলন হয়নি। এ যাতনা কি পাঠক টের পান না উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে? সমস্যা হচ্ছে, অমিয়ভূষণ কখনওই কোনো গল্প একসঙ্গে বলে ফেলে খালাস হতে চান না। তিনি নানাখানে তাঁর গল্পগুলো ছিটিয়ে রাখেন। পাঠককেই সেগুলো কুড়িয়ে নিতে হয়। তাতে পাঠকের গল্পতৃষ্ণা মোটেই উপদ্রুত হয় বলে মনে হয় না। বরং পথের পাশে দামি হীরকখণ্ড কুড়িয়ে পাওয়ার মতো রহস্যময়তায় ছাওয়া থাকে তাঁর গল্পসম্ভার। রানিমার একমাত্র সন্তান রাজচন্দ্র; এস্টেটের উত্তরাধিকারী। কিন্তু সহসা পাঠক জানলেন এস্টেটের যে চল্লিশভাগ মুনাফা দিয়ে শেয়ার কেনা হয়, সেগুলো রাজচন্দ্রের পাশাপাশি কায়েতবাড়ির কুমার মুকুন্দর নামেও ক্রয় করা হয়। পাঠকের মনে স্বাভাবিক প্রশ্ন, কেন? পরে জানা গেল, রাজনগরের রাজার প্রাসাদে আশ্রিতা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বে বিপুল পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী কায়েত ঘরের এক বালবিধবা অপরূপ সুন্দরী কাদম্বিনী। সেই আমলে রাজঅন্তঃপুরে রানি ছাড়াও আরও সুন্দরীরা নানাকারণে আশ্রিতা হিসেবে বসবাস করতেন। তাদের কেউ কোনোভাবে রাজার অঙ্কশায়িনী হতে পারলে দর্পিতা হিসেবেই তার অহংকার প্রকাশ পেত সবার কাছে। এটা একধরনের পরম সৌভাগ্য হিসাবে ধরে নেওয়া হতো তখন। কাদম্বিনী সে রকমই এক উদাহরণ। তাঁরই গর্ভে রাজার ঔরসজাত সন্তান এই মুকুন্দ, যিনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের সঙ্গে চীনের তাইপেং বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কর্নেল হয়ে বাড়ি ফেরেন। তবে রাজবাড়ি কাদম্বিনীর মান-মর্যাদাকে কখনওই খাটো করে দেখেনি। বরং কায়েতবাড়ির সঙ্গে রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভেতর দিয়ে দুর্মুখের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল শুরুতেই। মুকুন্দই রাজনগরের জ্যেষ্ঠ রাজকুমার। সেই রহস্য উন্মোচিত হওয়ায় কেউ কি উপন্যাস পাঠের রোমাঞ্চ-পুলক কম বোধ করেছেন? সার্বভৌমপাড়ার নয়নতারার সঙ্গে রাজচন্দ্রের প্রেমজ সম্পর্ক কি কম আনন্দ দেয় পাঠককে? নয়নতারাকে নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে যখন রাজচন্দ্র বিলমহলে প্রজাদের গোরু-মহিষ-জান রক্ষা করতে কুমির শিকার করে নিজের শৌর্য-বীর্যের প্রমাণ রাখেন, সেই বর্ণনা কি কম উত্তেজনাপূর্ণ?
 
রেভারেন্ড চন্দ্রকান্ত এন্ড্রুজ বাগচী রাজনগর জ্ঞানদা স্কুলের হেডমাস্টার। ধর্মে খ্রিস্টান; কিন্তু তাঁর মন উদার; বিচারশক্তি নিরপেক্ষ এবং মানবকল্যাণ ভাবনায় মগ্ন; সমসাময়িক খ্রিস্টধর্ম চর্চায় তাঁর জ্ঞান অগাধ। উইলবারফোর্স কিংবা বাক্সটন, যাঁরা বেনিয়া সাহেবদের একচেটিয়া ক্রীতদাস ব্যবসা লোপ করার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বাগচী তাঁদের ইভানজেলিস্ট বা ডিসেন্টার বলে সম্মান প্রদর্শন করছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিল্প-বিপ্লবের পর ধর্মপ্রচারকদের হেয় চোখে দেখা হতো খোদ ইংল্যান্ডে; টিটকারি মারা হতো তাঁদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে। এ প্রসঙ্গে বাগচীমাস্টার বেন্থামের ‘সমাজের অন্যায় দূর করলে যদি সেন্ট বলে বিদ্রুপ করা হয় তবে তিনি সেন্ট অথবা ইভানেজেলিস্ট হতে আপত্তি করবেন না’ উক্তিটি সবাইকে বলে বেড়ান। আবার নয়নতারার দাদা ন্যায়রত্ন মহাশয় যখন বলেন, ‘বৃক্ষ জমি অনুসারে বৃদ্ধি পায়। মন অনুসারে মহাভারতের বৃদ্ধি’ তখন অমিয়ভূষণ মজুমদারের নানারূপ ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনারই প্রতিফলন ঘটায়। বাগচীমাস্টার শুধু খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব নয়, তিনি মিশ্ররক্তের এদেশীয় খ্রিস্টানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। সিপাহি যুদ্ধে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের শৌর্যের কোনো মূল্যই দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি, ইংল্যান্ড থেকে আগত গোরা সৈনিকদের সমান বেতন-ভাতা দাবি করায় দশ হাজার অ্যাংলো অফিসার ও আদার র‌্যাঙ্কসদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গ্রামেও তাঁরা না ঘরকা না ঘাটকা। কোনো পক্ষই না রাজপরিবার, না সাহেবরা তাদের আপন করতে পারছেন। তবু স্থানীয় জনগণের সাথে মেশার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন ডিরোজিও ঘরানার পাদ্রি বাগচীমাস্টার। অবসর পেলেই তিনি স্কুলের হিন্দু শিক্ষক ও পোস্টমাস্টার চরণদাসকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের গরিব-দুঃখী রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে বেড়ান। মধ্যপ্রদেশ আগত বাগচীর গায়ের রং কালো হলেও তাঁর স্ত্রী ক্যাথারিন সুন্দরী ও বিদুষী মেমসাহেব। তাঁর বাবা মধ্যপ্রদেশের কোনো খ্রিস্টান মিশনের প্রধান ছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় এককাপড়ে দু’জন বেরিয়ে পড়েন এবং রাজনগরে এসে আশ্রয় নেন। রাজকুমার রাজচন্দ্র সুযোগ পেলে পাদ্রির স্ত্রী আধুনিকমনস্ক ক্যাথরিনের হাতে তৈরি কফি পান করতে করতে নানাবিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন তাঁদের কুঠিতে এসে। সেগুলো কি কম চিত্তাকর্ষক? ভালো ইংরেজি জানার কারণে তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী হেডমাস্টার বাগচী রানিমার সুপারিশে একসময় রাজকুমারের সেক্রেটারিও নিযুক্ত হন। অন্যদিকে, তাঁরই অধস্তন শিক্ষক সর্বরঞ্জন কুসুমপ্রসাদ নিয়োগী প্রচণ্ড রক্ষণশীল এক খ্রিস্টান। সর্বরঞ্জন হিন্দুদের পৌত্তলিকতা, তাঁদের কুসংস্কার নিয়ে সদা চিন্তিত। তিনি মদ্যপানের ঘোর বিরোধী। তার মুখভরা দাড়ি সম্পর্কে কেটের মন্তব্য, মনে হয় এ যেন তার দাড়ি নয়, অন্য কারও। সর্বরঞ্জন হিন্দুদের পূজা-পার্বণ তথা পৌত্তলিকতা নিয়ে যখন তীব্র সমালোচনায় মুখর, তখন বাগচীমাস্টার সহসা বলে ওঠেন, সকল ধর্মেই কিছু না কিছু প্রতীক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, যেগুলোর অপব্যাখ্যা যখন তখন হতে পারে। এ প্রসঙ্গে রোমান ক্যাথলিকদের হিন্দুদের মতো মাদার ম্যারি, যিশুখ্রিস্টের মূর্তির সামনে নতমস্তকে সাকার উপাসনারও উদাহরণ টানেন। এমনকি, রানিমার দেওয়া লাঞ্চে দ্রব্যগুণে মত্ত নীলকর ডানকান হোয়াইট এবং ক্রিমিয়া যুদ্ধফেরত তরুণ সৈনিক কীবল যখন হিন্দুদের প্রতিমা পূজা নিয়ে বিদ্বেষ প্রচার করছিলেন, তখনও এই খ্রিস্টান বাগচী মশায় তাঁদের সামনে খ্রিস্টানদের প্রতীকী ‘ইউক্যারিশ ওয়েফারের’ উদাহরণ টেনে তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন। অথচ নিজে খ্রিস্টান। তবু যুক্তি ও ব্যাখ্যা ছাড়া কিছু গ্রহণ করতে নারাজ। বই পাগল দেওয়ানজি হরদয়ালও তীক্ষ পর্যবেক্ষণ ও ধীশক্তি সম্পন্ন এক ঊর্ধ্বতন রাজকর্মচারী। তিনি সংস্কারহীন অকৃতদার মানুষ। রাজবাড়ি সংলগ্ন তাঁর ঘর ও লাইব্রেরি। হরদয়াল লাইব্রেরিতে বসলে রাতের বয়স কত তা টের পান না। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমসাময়িক সকল বইপত্র তাঁর এখানে মেলে। প্রশাসনিক ক্ষমতা কিছুটা সংকুচিত হলেও তিনি রানিমার দক্ষিণহস্ত। রাজবাড়ির সমস্ত বিপদে-আপদে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য।
 
এভাবেই অমিয়ভূষণের আঁকা রাজবাড়ির সঙ্গে প্রশাসনিক ভবন তথা কাছারিবাড়ির প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভাগ্য যেমন জড়িত, তেমনি প্রতিটি রায়ত ও পেশাজীবীরও রয়েছে রাজবাড়ির সঙ্গে ওতপ্রোত যোগাযোগ। তিনি এক একটি দৃশ্যপট তৈরি করেছেন এবং পাঠকের সামনে সরস করে বর্ণনাও করেছেন সেসব। গোরুর গাড়ির ভেতর নায়েব-ই রিয়াসাত ও নায়েবপত্নীর কথোপকথন, রাজবাড়ির দেওয়া প্রতিটি ককটেল ও ডিনার পার্টির বিশদ বর্ণনা, পুরনারী হৈমর সেবা ও সাহসিকতা, রানিমার জন্মতিথির বিশাল আয়োজন, রাজরাজড়ার সাহেবি পোশাক-আশাকের পরিচিতি, লা-মোহরার, জমানবিশ, খাস-বরদারের মতো রাজবাড়ির তখনকার নানা পদ ও পদবির বিবরণ, নায়েব ও তাঁর কাছারির কর্ম সম্পাদনের প্রশাসনিক চিত্র, শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার পুঙ্খানপুঙ্খ বর্ণনা পাঠকের সামনে এক আনন্দময় জগতের সন্ধান দেয়। এমন কি, ক্লাইমেক্সে পৌঁছে অমিয়ভূষণ মজুমদার যেভাবে একটার পর একটা ঘটনার অবতারণা করে গেছেন, তা কি উপন্যাসের চালিকাশক্তি নয়?
রাজনগরে রানিমার কাছারিবাড়ি বনাম নীলকর সাহেবদের ভেতর ক্ষমতার একটা দ্বন্দ্ব তো ছিলই শুরু থেকে। বিশেষ করে পিয়েত্রোর অন্তর্ধানের পর তা আরও তীব্র হয়ে ধরা দেয়। অমিতচারী নীলকর ডানকান হোয়াইট, মোরেলগঞ্জের দেওয়ান দুষ্ট মনোহর সিং, অত্যাচারী লেঠেল জুড়ান পাইকদের নিয়ে যা খুশি করে বেড়াচ্ছে রাজনগরে। ইন্ডিগো কমিশনে সাধারণ মানুষের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা শুনে ডানকানদের মাথা গরম। অত্যাচারীদের থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ার শঙ্কায় অস্থির। এরা নায়েব-কাছারির ধার ধারে না। যখন খুশি অন্যের জমি দখল করে রাস্তা কাটছে। কারও তোয়াক্কা না করে মিশনারিদের সুবিধা দিতে জমি জবরদখল করছে। এসব ব্যাপার নিয়ে মহাবিরক্ত ও ক্ষুব্ধ রাজকুমার রাজচন্দ্র; প্রতিশোধ নিতে নয়নতারাকে উপহার দেবে বলে মোরেলগঞ্জে জমি ক্রয় করেন এবং কেনা সেই জমিতে দিঘি কাটার জন্য লোক পাঠান। যেদিন কোদাল নিয়ে রাজচন্দ্রের লোকজন দিঘি কাটতে যায়, সেদিন জুড়ানের লোকজনের বল্লম-সড়কির আঘাতে ও কীবলের গুলি খেয়ে ঘটনাস্থলেই দুই শ্রমিক মারা যায়। সঙ্গে সঙ্গে আক্রোশে ফেটে পড়ে পুরো গ্রাম। গ্রামবাসী বিন্দার হাতে নীলকর ডানকানের সকল দুষ্কর্মের সঙ্গী জুড়ান পাইক নিহত হয়। কালেক্টর ম্যাকফার্লান অকুস্থলে উপস্থিত উত্তেজিত বাগচী মশায়ের পায়ে গুলি করেন। ডানকান বাগচীর স্ত্রীকে প্রস্টিটিউট বলে গালি দেওয়ায় রাজচন্দ্র তাকে ঘোড়ার ক্রপ-চাবুক দিয়ে চাবকান। বিদ্যাসাগরের কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে চরণ দাস বিধবা বনদুর্গাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন, সেই দাসকেও কালেক্টরের পেয়াদা ডেকে নিয়ে যায়। ইন্ডিগো কমিশনে সাক্ষ্য দেওয়াই তাঁর অপরাধ। অমর্ত্য দাস ফ্যাক্টরির সামনে পিকেটিং করায় ডানকানের লোকেরা জোর করে তাকে উলঙ্গ করে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করায় এবং তাকে পাগল হিসেবে সাব্যস্ত করে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে স্টিম জাহাজ অ্যালবাট্রসে করে মরিশাসে অগস্ত্যযাত্রার মতো করে পাড়ি জমায় সে। এদিকে বিশালদেহী গজামণ্ডল চরণদাসকে খুঁজতে গিয়ে দেওয়ান মনোহর সিংকে তাঁর আটচালা বাড়িসুদ্ধ জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। এ সকল ঘটনার জন্য কালেক্টর সাহেব দায়ী করেন রাজচন্দ্রকে। দেওয়ান হরদয়াল টাকা দিয়ে, আইনের প্যাঁচে ফেলে ম্যাকফার্লানকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন। তবু রাজচন্দ্রকে অন্তরীণ থাকতে হয় পিয়েত্রোর কুঠিতে।
 
উপন্যাসের শেষ ও পরিশেষের দৃশ্যগুলো দ্রুতই ঘটে গেছে বলে মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। যেমন, ছাড়া পাওয়ার পর রানিমা চাইছেন, গুণাঢ্য মহাশয়ের কন্যা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত সুন্দরী সুলক্ষণাকে যেন রাজচন্দ্র বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়েতে রাজি নন স্বয়ং রাজকুমার। বালবিধবা ও জনৈক সাহেবের প্রাক্তন বান্ধবী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হৈমর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের রাতে তাঁকে মদ্যপ অবস্থায় হৈমর সাথে আবিষ্কার করেন রাজমাতা। শেষ পর্যন্ত সেই রাতেই মেয়েটির বিয়ে হয় কায়েতবাড়ির রাজকুমার কর্নেল স্যার মুকুন্দবিলাস স্মৃতি খাঁ, কেসিবির সাথে। মনমরা রানিমা বুকের ভেতর পিয়েত্রোকে নিয়ে মহাভারতের কুশীলবের মতন হিমালয়ের মানস সরোবরের দিকে মহাপ্রস্থানের পথে বের হয়ে পড়েন। সঙ্গে রহস্যময় অস্তিত্ব নয়নতারা। নয়নতারার বুকেও কি পিয়াত্রোর মতোই রয়েছেন রাজচন্দ্র? ঝড়ের সময় বুক দিয়ে আগলে যে রাজচন্দ্রকে সে বাঁচিয়েছিল, সেই রাজকুমারের স্মৃতি নিয়ে কি নয়নতারাও তুষারপাতের ভেতর মানস সরোবরের দিকে এগিয়ে চলেছেন? উপন্যাসের এই শেষটুকু মহাকাব্যের মতন পাঠক মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়।
 
পাঠক শেষবারের মতো স্যার রাজচন্দ্র ও হৈমকে দেখতে পায় যোগাযোগের নতুন বিস্ময় রেলগাড়ির দামি কোচে। আগের মতোই বার্গান্ডি-স্যান্ডউইচ, ওয়াইন-হুইস্কি নিয়ে চুরচুর রাজকুমার। রাজনগরে নতুন রেলস্টেশন উদ্বোধন উপলক্ষে সব সাহেব-সুবারা এসেছেন রাজার অতিথি হয়ে। ফের হুলস্থূল ব্যাপার। বাইশ বছরের রাজচন্দ্র এখন প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের প্রৌঢ়। ১৮৬০ থেকে ১৮৮৩ সন। পার্থক্য কী? রেলবগির ভেতর ছিলেন এক কমবয়সী কুমার। তিনি মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছেন রাজনগরে। তেমন কাউকে চেনেন না এখানকার। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত উজ্জ্বল প্রাণবন্ত এক যুবক। তিনি-ই রাজচন্দ্রকে জানালেন, ‘আপনাদের জেনারেশনে কিন্তু সর্বভারতের বোধটা ছিল না। … সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে, তখন আপনাদের বয়স সম্ভবত আমার এখনকার বয়সের মতো ছিল, আপনারা কিছু করতে পারেননি, কারণ তখন মারাঠা, শিখ, বাঙালি, হায়দ্রাবাদী, দিল্লিওয়ালা এসব স্বার্থ পৃথক ছিল।’
 
রাজচন্দ্র তাকিয়ে রইলেন যুবকের দিকে। এই কি রাজচন্দ্র-নয়নতারার ভালোবাসার সাক্ষী কুমার? অনেক ইশারা-ইঙ্গিতের মতো অমিয়ভূষণ এখানেও রহস্য ছিটিয়ে রেখেছেন। এ রকম রহস্যময়তা কি বঙ্কিমের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব?
 
তারপরও রাজনগর উপন্যাসটি অবোধ্য কিংবা দুর্বোধ্যÑ এরকম অভিযোগ কি পাঠক আনতে পারেন? উপন্যাস-পাঠ সমাপ্ত হওয়ার পরও কি এর রেশ থেকে যায় না পাঠক-মনে? রাজচন্দ্রের সাহস ও একগুঁয়েমি, রানিমার অন্তর্দাহ, নয়নতারার অবগুণ্ঠিত প্রেম, বাগচীর সদাচার, হরদয়ালের প্রজ্ঞা, ডানকানের ক্রূরতা, সর্বরঞ্জন কিংবা শিরোমণির সংস্কার, হৈমর সেবা ও প্রগলভ ভালোবাসা, চরণের দেশপ্রেম ও সারল্য কি পাঠশেষের পরও আটকে রাখে না পাঠক মনকে? তাহলে কি দুর্বোধ্যতা ভাষাজটিলতায় আটকে রয়েছে? কথিত আছে, একবার রাজশেখর বসু (পরশুরাম) নাকি নাক সিঁটকেছিলেন তাঁর ভাষা ও ব্যাকরণের অপপ্রয়োগ দেখে। কথাটা কতদূর সত্য তা প্রমাণসাপেক্ষ। তাও যদি এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে তো পাল্টা প্রশ্ন করা যায়, ভাষা ও ব্যাকরণ তো পরিবর্তনীয় উপাদান। শেক্সপিয়ারের ভাষা তো এখন কেউ ব্যবহারের কথা চিন্তাও করেন না। কিন্তু সাহিত্যের যে রস তিনি পাঠককে বিতরণ করেছিলেন তা কি আত্মার অস্তিত্বের মতোই সর্বকালে অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি? একটি অশুদ্ধ বানান কিংবা দুটি ভুল বাক্য নিয়ে যেসব ব্যাকরণ বিশারদগণ মাথা গরম করেন, তাঁরা সাহিত্য-রসের সন্ধান করেন কখনও? একই প্রশ্ন উঠেছে কমলকুমার মজুমদারের বেলায়। কিন্তু ‘লাল জুতা’ গল্পপাঠের সময় মনেই হয় না, তিনি দুর্বোধ্য এক লেখক। এমনকি, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে তাঁর বিখ্যাত অন্তর্জলি যাত্রা কিংবা গোলাপসুন্দরীকে খুব বেশি অবোধ্য মনে না হওয়াই স্বাভাবিক বোদ্ধা পাঠকের। সত্যি বলতে কী, এ সময়ের একজন পাঠক শুধু সাদা-সরল গল্পটাই পড়তে চাইছেন না। তিনি এর চেয়েও বেশি কিছু, যা তাঁর অন্তরাত্মাকে প্রস্ফুটিত যেমন করবে, তেমনি সমসাময়িক সময় ও মানুষকে নানারকম আলোর বলয়ের ভেতর টেনে এনে বিচার-বিশ্লেষণ করবে। একটি চরিত্র বা একটি ঘটনা কেবল উত্তরবঙ্গের কোনো এক এস্টেট রাজনগরের নয়, এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও বলিষ্ঠ যোগাযোগ থাকবে পুরো পৃথিবীর এখানে-ওখানে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার। তবেই তো পাঠক বুঝতে সক্ষম হবেন, চরিত্রটি আসলে কতটুকু শক্তিশালী ও সমকালীন।
 
রাজনগর উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে পাঠকের বাংলা সাহিত্যের আরও একটি উপন্যাসের কথা মনে হতে পারে। সেটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সর্বশেষ উপন্যাস শেষ প্রশ্ন। পাল্টাপাল্টি যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে জীবন-জিজ্ঞাসাকে শানিত করে গল্প-প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল অনেকখানি অনুসৃত হয়েছে রাজনগর উপন্যাসে। অমিয়ভূষণ মজুমদার তাঁর গল্প-প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন একের পর এক চরিত্র ও সমসাময়িক ঘটনার চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে। এখানে খ্রিস্টান পাদ্রি যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন হিন্দু রাজা-রানি। ফিরিঙ্গি পিয়েত্রোর সবল অস্তিত্ব যেমন বিদ্যমান, তেমনি রানিমার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার ঝলক মেলে ক্ষণে ক্ষণে। উপন্যাসের সংলাপের ভেতর দিয়ে লেখক ইংল্যান্ডের ধর্ম-আন্দেলন, ইউরোপীয় শিল্প-বিপ্লব এবং খ্রিস্টান পুরোহিত সম্প্রদায়ের এদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকলাপ যেমন এঁকেছেন, তেমনি ব্রিটিশরাজের ছাতার ভেতর থেকেও স্থানীয় তাঁতশিল্প ও এর সাথে জড়িত মুর্শিদাবাদ থেকে আসা অজ্রস্র মুসলিম ওস্তাদ-কাটনিগণ কীভাবে কলের কাপড়ের কাছে মার খাচ্ছে, কীভাবে তাঁতনির্ভর রাজনগরের অর্থনীতির চাকা ব্রিটিশ বেনিয়াদের চক্রান্তে মুখ থুবড়ে পড়ে ধুঁকছে তাও আঁকতে ছাড়েননি। ‘কি এক মিলের কাপড় হয়েছে, তাই নাকি বাবুভায়াদের ফ্যাশোয়ান। সাপনে কাচো, গরমে ইস্তিরি চালাও। কে আর তিনগুন দাম দিয়ে রেশম কিনছে’ সংলাপটির ভেতর লুকিয়ে রয়েছে রাজনগরের বর্তমান অর্থনৈতিক দৈন্যদশার চিত্র। ধানে, তিলে, গুড়ে রাজনগরের খ্যাতি নয়, তাঁতের প্রসারই ছিল এ এলাকার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি; সেই তাঁতশিল্পের কঙ্কাল পড়ে রয়েছে এখন। সেখানেও আলো ফেলতে ভোলেননি লেখক। ইন্ডিগো কমিশনের হুজ্জোতির পর ডানকানরা কীভাবে নীলের ব্যবসা ছেড়ে চায়ের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, তাও তিনি লক্ষ্য করছেন।
 
রাজনগর উপন্যাসটি পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে গত শতকের সত্তর দশকের গোড়ায় আর এটি গ্রন্থ হিসেবে বাজারে এসেছে তিরাশি সনে। ১৮৬০ সন থেকে ১৮৮৩ সন-ব্যাপী মোট তেইশ বছরের কড়চা এটি। একটি রাজপরিবার ঘিরে তেইশ বছরের চালচিত্র এ উপন্যাস। সতেরো পরিচ্ছদবিশিষ্ট বড় একটি উপন্যাস এটি। শুরু হয়েছে ফিটন- গোরুর গাড়ি দিয়ে আর শেষ হয়েছে অ্যালবাট্রসের মতো স্টিমারটির কুতঘাটে নোঙর করা আর রাজনগরে রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে। এটি বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস না হলেও ইতিহাস আশ্রিত গল্প তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সময়কে ধরার জন্য অমিয়ভূষণের যে নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা তা সত্যিই ধন্যবাদ দেওয়ার মতো।
 
তিনি গল্পটা প্রথানুরাগীদের মতো করে বলেন না। চরিত্রের সুষম বিন্যাস তাঁর উপন্যাসে অনুপস্থিত। অনেকক্ষেত্রেই পাঠককে নিজের কল্পনার ওপর নির্ভর করে টর্চ ফেলে ফেলে রাস্তা চলতে হয়। তবে ডিটেইলের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার মতো। তিনি যখন কোনো একটা গল্প বলতে শুরু করেন তখন কপালের টিপটা বা গালের জুলফিটাও বাদ যায় না। ‘সাদা ব্রোকেটের টেবিলক্লথে ঝকঝকে হেমন্ত দুপুরের আলো’ কিংবা ‘সুতরাং একদিন পরই নয়নতারা রাজবাড়ির পালকিতে ফরাসডাঙ্গা চলেছিল। তখন শীতের আরামদায়ক উষ্ণতার মধ্যাহ্ন।’ বাক্যগুলো অমিয়ভূষণের রোমান্টিকতাকেই প্রশ্রয় দেয়। তিনি নিড়ানি দেওয়া জমির ভেতর নানা জায়গায় ছড়িয়ে রাখেন গল্পের উপকরণ। পাঠককে সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়। এ অনেকটা লুকোছাপা খেলার মতন রহস্যময়। পাঠক কোনো না কোনো গল্পের ভেতর রয়েছেনই। এর ভেতর থেকেই কখনও ইঙ্গিতময়তা, কখনও এক চিমটি রহস্য মেশানো কাহিনির টুকরো মিলিয়ে এ উপন্যাস। তাতে করে চাইলেই পাঠক নিজেও গল্পটি মনের ভেতর বাড়াতে কমাতে পারেন। লেখক গল্পটাকে কম গুরুত্ব দেন বলে কারও কারও মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিমানুষ ও সমাজ নিয়ে তিনি যে বিশ্লেষণের ছক আঁকেন, যে ডিসকোর্সের অবতারণা করেন একর পর এক, সেটি কলকাতার রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের জনহিতকর সংস্কৃতি চর্চাই হোক বা মিশনারি বা ব্রাহ্ম ধর্মচর্চা হোক - সবখানেই তিনি রয়েছেন। তাঁর এ আলোচনা-বিশ্লেষণই প্রথাগত গল্প বলাকে আলাদা এক মাহাত্ম্য এনে দিয়েছে। আরও সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, অমিয়ভূষণের কথনরীতি যত না ভাষা জটিলতা বা চিন্তাস্রোতের অস্বচ্ছতার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর স্বেচ্ছাধীন উপস্থাপনা কৌশলের জন্য। এমন এলোমেলো ও ইচ্ছেমাফিক চলে তাঁর গল্প ও চিন্তাস্রোতের ট্রাফিক যে তা অনেকক্ষেত্রেই খেই হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র অমিয়ভূষণ কখনওই তাঁর লেখাকে শুধু রগরগে গল্প দিয়ে বিরক্তিকর ও ভারী করে তোলেননি। তিনি বারবার করে তাঁর প্রতিটি চরিত্রের সংলাপে ডিসকোর্স সেঁটে দিয়েছেন। ব্রিটিশদের সম্পর্কে এরকমই একটি মূল্যায়ন উপন্যাস থেকে এখানে বিধৃত করা হলো :
 
‘…বার্ক-শেরিডানের বক্তৃতা তো গ্রন্থাকারেই হরদয়ালের লাইব্রেরিতে। তারা জানতো অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকায় যারা আদিবাসীদের গুলি করা আর পশু শিকার করা একই মনে করে এবং সে রকম গুলি করে এসে লাঞ্চ বা ডিনারে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, স্ত্রীদের সঙ্গে হাসি-তামাশা প্রণয় করে, বাইবেল পড়ে, যারা ধর্মের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমেরিকা গিয়ে সেখানকার রেডইন্ডিয়ানদের নির্মূল করে নিজেদের মহাবীর মনে করেছিল, যারা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে জাহাজের খোলে ভরে ক্রীতদাস চালান দেয়, আর যারা সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে, তারা একই ইংরেজ জাতি। সে জাতে হিগিন-বোথামের মতো দাস ব্যবসায়ী এবং উইলবারফোর্সের মতো ক্রীতদাস মুক্তির আন্দোলনে সমর্পিত-প্রাণ মানুষ আছে, নীলকর ডানকান আছে, আর্চি হিল আছে, উইলিয়াম জোন্স, হেয়ার, বাটন আছে। …’
 
এভাবেই অমিয়ভূষণ মজুমদার তাঁর উপন্যাসের আঙ্গিককে উপস্থাপনাগত কারণে জটিল করে তুলেছেন। গল্প লুকানো এবং লেখকের নিজস্ব ভারী চিন্তার অনুপ্রবেশ - দুটোই অমিয়ভূষণকে জটিলতার দিকে ধাবিত করেছে। এখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ কিংবা বিমল করের উপন্যাসের সুবিন্যস্ত, সুশৃঙ্খল ও সহজপাচ্য গল্প-কাঠামোর তুলনায় অমিয়ভূষণকে আলাদা করে বিচার করা যায়।