কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলীযাত্রা : নবজাগরণের অন্য ভাষ্য

কমলকুমার মজুমদারের সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা। এই উপন্যাসের বিষয় ও কাহিনি নতুন নয়, বরং সাদামাঠা। অন্তর্জলীর উদ্দেশ্যে শ্মশানে আনীত জীর্ণ বৃদ্ধ সীতারাম, কুলরক্ষার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে বিবাহবদ্ধ সদ্যযৌবনা যশোবতী এবং শ্মশান-পরিচর্যাকারী ডোম বৈজুনাথ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। পার্শ্বচরিত্রদে  র মধ্যে রয়েছে যশোবতীর পিতা, জ্যোতিষী, সীতারামের দুই পুত্র, কবিরাজ এবং সীতারামের কুলপুরোহিত, আর কীর্তনগায়কের দল।

                   অন্তর্জলী এবং সহমরণ- দুটিই উনিশ শতকের হিন্দুসমাজের পুরাতন বর্বর প্রথা, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই উপন্যাসে কোথাও এই প্রথার সমালোচনা করা হয় নি। এইখানে কমলকুমারের বিতর্কিত হিন্দুয়ানির গোঁড়ামি লক্ষিত হয়- পাঠকের এমনটা মনে হওয়া সম্ভব। কিন্তু তা নয়, লেখক উপন্যাসে কোথাও অন্তর্জলী বা কৌলীন্যপ্রথার সমর্থন করেন নি, বরং কবিরাজ বিহারীনাথ ও বৈজুনাথের সংলাপে বারংবার কৌলীন্যপ্রথার বর্বরতা ও সুবিধাবাদী ধর্ম ও সমাজরক্ষকদের কটাক্ষ করা হয়েছে। তবে লেখকের পরিপ্রেক্ষিত ও উদ্দেশ্য যেহেতু আলাদা, সেহেতু এই প্রথানির্ভর ঘটনাগুলি উপলক্ষ্যমাত্র। কী সেই উদ্দেশ্য?

                 আমাদের আগের আলোচনায় কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। সংক্ষেপে বলা যায়, উনিশ শতকের আধুনিকতাকে সমালোচনা করতে গিয়ে বাঙালিত্বের যে মডেলটি লেখক বিকল্প হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলির কেন্দ্রে ছিল প্রাগাধুনিক বাঙালির সমাজবদ্ধতা ও ভক্তিপ্রাণতা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ-কেন্দ্রিক ভক্তি আন্দোলনের ভিতর তিনি প্রাচীন বাংলার সেই সমাজবৈশিষ্ট্যগুলিকেই পুনর্জীবিত হতে দেখেছিলেন বলে এই উপন্যাসের ভাববিগ্রহরূপে রামকৃষ্ণ এবং কাব্যবিগ্রহরূপে রামপ্রসাদকে স্মরণ করেছেন। এইখানে বলে রাখা ভাল, কমলকুমারের উপন্যাসচিন্তার অন্যতম প্রেরণা এই ভাব ও আঙ্গিকের একাত্মতাসাধন। এই উপন্যাসে তার প্রথম সার্থক রূপায়ণ লক্ষ করি।

                  “আলো ক্রমে আসিতেছে”—অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের সুপরিচিত আরম্ভোক্তি। দিনের আলো নিয়ে সকাল আসছে, কিংবা ‘নবচেতনা’র আলো আসছে- দুইভাবেই পাঠক ব্যাখ্যা করতে পারেন। বস্তুত, এক বিরাট পটভূমি জুড়ে ক্রমাগত আলোর আকাঙ্ক্ষা এক সময়ে সমগ্র বঙ্গভূমি জুড়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। উনিশ শতকের যাবতীয় যুক্তি, বুদ্ধিবাদের বিপ্রতীপে মানবীয় প্রেম ও প্রাণের স্ফূর্তিকে ঈশ্বরীয় চেতনায় আলোকিত করার আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ নবজাগরণের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন। কমলকুমার তাঁর সাহিত্যপ্রকল্পে বাঙালির শুদ্ধতার নির্যাসটুকু বাঙালির গল্প বলার ঢঙে পরিবেষণ করেছেন পাঠকের সামনে। কোন পাঠক? ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন পাঠক, যাঁরা ইংরাজি নভেলের অনুকৃত ও ইংরাজি বাক্যের অন্বয়াশ্রিত গদ্যে বিগত দুশো বছর ধরে সাহিত্যরুচি গড়ে তুলেছেন।

                   পরিপ্রেক্ষিত হইতে সৃষ্ট হয়ে ভেঙে পড়া যেমন বুদ্বুদের চরিত্র, মানুষের জীবনও সেই অকল্পনীয় দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে ওঠা বুদ্বুদ্‌তুল্য- লয় ও ক্ষয়ের গুণবিশিষ্ট, নশ্বর। তা বলে মানুষের জীবন তুচ্ছ নয়, কারণ ‘ভক্তের শরীর ভগবতী তনু’ এবং ‘সর্ব্বজীবে সর্ব্বভূতে তিনি বিরাজমান’- মানুষের শরীর ও মনকে ভগবৎমুখী করে তোলার শিক্ষা নিজের জীবনে প্রকট করে তুলেছিলেন রামকৃষ্ণ। এই উপন্যাসের আলোচনার মধ্যে মাঝে মধ্যেই তাঁর নাম উঠবে, কারণ তিনি এই উপন্যাসের ভাববিগ্রহ। ভাব ও প্রকাশের সংযোগসাধন, চিহ্ন ও চিহ্নায়িতের, আধেয় ও আধারের, শব ও শক্তির – এই ক্রমে কমলকুমার তাঁর সাহিত্যপথে অগ্রসর হয়েছেন। আমাদের আলোচ্য উপন্যাসে সীতারাম পরিপ্রেক্ষিত থেকে সৃষ্ট বুদ্‌বুদ্‌প্রায় জীবনের প্রতীক, যে জীবন মানুষের ইহকালের আমিত্বে শূন্যগর্ভ কলসের মতো অহংধ্বনিতে মাতোয়ারা- অসংখ্য ঘুণাক্ষরের হিজিবিজি আঁকা শরীরের ধুকধুকে প্রাণটুকু সম্বল করে যে জীবন তার কোষাগারের চাবিগাছা আঁকড়ে থাকে, আবার এই জীবনেরই সৌভাগ্যে বিদ্যা স্ত্রীরত্ন যশোবতী সেই চাবিগাছা ধুলোয় ছুঁড়ে ফেলে তাকে মোহবন্ধন থেকে মুক্তি দেন। রামকৃষ্ণ বলেছেন- “মানুষ কি কম গা!’ অহং বন্ধনমুক্ত মানুষের জীবনকে তিনি ঈশ্বরদর্শনযাত্রার যাত্রী করে তুলতে চেয়েছেন। সে জীবনের স্মৃতি মহামূল্যবান, ঘটাকাশতুল্য শরীরের মস্তিষ্কে সারা জীবন ধরে স্মৃতি জমা হতে থাকে, জমতে থাকে জীবনের প্রতি মায়া, পার্থিব সংস্কার। মৃত্যুর সাথে সাথে সেই ঘটাকাশ পটাকাশে মুক্ত হয়ে যায়, বুদ্‌বুদ মিলিয়ে যায় তার পরিপ্রেক্ষিতে। এভাবেই গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে অন্তর্জলী যাত্রা হয়ে ওঠে ঈশ্বরদর্শনযাত্রা, পরমকাঙ্ক্ষিত মনুষ্যজীবনের যা বিনা অন্য উদ্দেশ্য নাই।

                  বাকি রইল বৈজুনাথ ও যশোবতী। আখ্যানের উপরিভাগে তাদের মৌহূর্তিক দুর্বলতার গল্প, যশোবতীর কাছে যা দুর্বলতা- বৈজুর কাছে তা স্বাভাবিক প্রাণধর্ম। বৃদ্ধ সীতারামের চিতায় চড়বে অনিন্দ্যসুন্দরী লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো সদ্যযৌবনা যশোবতী- বৈজু তা মেনে নিতে পারে না। কোনো নিরপেক্ষ স্বার্থবুদ্ধিহীন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই তা মেনে নিতে পারে না। বৈজু নিজের মতো করে এই অসম বিবাহের প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু সে জাতে চাঁড়াল- অচ্ছুত, অন্ত্যজ। বিয়ের পরেও সে যশোবতীকে পালাতে সাহায্য করবে- এমন প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু যশোবতী কুলস্ত্রী, সতীত্বের সংস্কার সে আজন্ম লালন করে এসেছে। উপরন্তু, তৎকালীন সমাজে কুলীন মেয়েদের বোঝানো হত, সতী হয়ে স্বামীর চিতায় সহমরণে গেলে অক্ষয় স্বর্গবাস হয়। সতী হওয়া সে সম্ভবত নিজের চোখে দেখেছিল- সতীরা সমাজে দেবীত্বের মর্যাদা পান, দেবীত্ব অর্জনের লোভ তার অবচেতনে কোথাও কাজ করেছে। বিপরীতপক্ষে, সমাজে বিধবা মেয়ের যন্ত্রণাও সে নিশ্চয় প্রত্যক্ষ করেছিল। সে জানত, পিত্রালয়ে বা শ্বশুরালয়ে বিধবা মেয়ের স্থান নেই, তার কুলীন পিতা অসহায়, অনেক গহনা পণ দিয়ে তার বিয়ে হয়েছে- শ্বশুরালয়ে সতীনপুত্ররাই কর্তা, গহনাই তাদের একমাত্র লক্ষ। আর সহমরণকামী সতীর পলায়ন তখনকার সমাজে যে কতোটা নিন্দনীয়, নিন্দনীয় শুধু নয়, পলায়নকারিণী সমাজে পরিত্যজ্য- এমনটাই সে জানত। ফলে, একমাত্র সহমরণই তার সামনে একমাত্র পথ। বৈজুকে সে স্পষ্টভাবেই বলেছে- তার কোথাও কেউ নেই।

                 যশোবতী- বৈজুর যে বৃত্তটি উপন্যাসে তৈরি হয়েছে, তা যশোবতী বা বৈজু- কারোরই পরিকল্পিত ছিল না। প্রচলিত উপন্যাসের রোমান্সের যে সমীকরণ, এই উপন্যাসে তা খাটে না। উপন্যাসের আকস্মিক মুহূর্তে বৈজু ও যশোবতীর মিলন ঘটে, কিন্তু সে মিলন যশোবতীর দেহাভিমানজাত- সে দেহাভিমান এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, একসময় মুগ্ধতার ভিতর বৃদ্ধ সীতারামের জীবন-মৃত্যুতে তার কিছু আসে-যায় না। পরে সম্বিৎ ফিরলে সংস্কারজনিত পাপবোধ এবং শিশুস্বভাব বৃদ্ধের প্রতি মানবিক করুণাবশে সে নদীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিতার আগুনে আত্মবিসর্জনের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত গঙ্গার জোয়ারে ভেসে যাওয়ায় পরিণতি পায়। একটি বিষয় এখানে লক্ষ করার মতো- আগুনে প্রাণবিসর্জনের যে ভীতি, জলে জীবন বিসর্জনের ক্ষেত্রে তা লক্ষিত হয় না, বরং মানবিক কারণে অর্থাৎ অসহায় বৃদ্ধকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় যশোবতী জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিতার আগুনে জোর করে জ্যান্ত মানুষকে চাপিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে যে পৈশাচিকতা আছে, অপরের ইচ্ছা চাপিয়ে দেবার যে বর্বরতা আছে, কমলকুমার কোনোভাবেই সেই বর্বরতাকে জয়ী করেন নি, বরং মানবিক কারণে স্বেচ্ছামৃত্যুতে যশোবতীর জীবন সার্থকতা লাভ করেছে, ব্যক্তি- ইচ্ছা---যে ইচ্ছা কোনো সমাজগত বা যৌথ অবচেতনা দ্বারা, পাপ-পুণ্য সংস্কার দ্বারা চালিত নয়, শুধুমাত্রই আত্মগত প্রেরণার দ্বারা জাত, কোথাও যেন তারই জয় ঘোষিত হয়েছে যশোবতীর আত্মবিসর্জনে। উপন্যাসটি যে সময়ের পটভূমিতে লেখা, সতীদাহ তখন আইনত নিষিদ্ধ। তবু গ্রামে গঞ্জে চৌকিদারকে ঘুষ দিয়ে এই বর্বর প্রথা যে আরো কিছুদিন চালু ছিল, উপন্যাসে তার ইঙ্গিত পাই। উনিশ শতকের খণ্ডিত আলোকায়নকে কমলকুমার সমর্থন করেন না, বরং বিরোধিতা করাই তাঁর সার্বিক উদ্দেশ্য। কিন্তু আলোকায়নের তথা আধুনিকতার মূলগত নির্যাস যে মানবিকতা, তারই  প্রতিফলন দেখি যশোবতীর মৃত্যুসংক্রান্ত আখ্যাননির্মাণে। এই কারণেই কমলকুমার আধুনিকেরও আধুনিক। মানবতা যেখানে মুল অভিপ্রায়, সেখানে ডোমের কখনো ব্রাহ্মণকন্যাকে ভালোবাসতে মানা নেই। বৈজু যশোবতীকে ভালোবেসেছে অবশেষে, সে ভালোবাসায় কোনো প্রাপ্তির আশা, পরিণতির আশা তো অকল্পনীয় বটেই, কোনো ব্যক্তিস্বার্থসিদ্ধিরও উদ্দেশ্য ছিল না। এই ভালোবাসাই স্বর্গীয়, কিন্তু তা নরদেহে সম্ভব। কোনো ‘আইডিয়াল’ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল না বলে লেখক সহজেই বৈজু-যশোর মিলন দেখাতে পেরেছেন, তাই তাদের বৃত্তকে কোথাও বায়বীয় মনে হয় না, অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক মানবীয়ই মনে হয়। ‘জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন’ এবং ‘মানুষ কি কম গা!’- এই দুই আপ্তবচনের ‘মিসিং লিংক’ হল ভালোবাসা, যাকে অবলম্বন করে মানুষ ঈশ্বর দর্শনের পথে যায়। কমলকুমারের সমস্ত উপন্যাসে এই ভালোবাসা আধৃত হয় শিশুসুলভ মনে, কারণ মানবজগতে শিশুমন সর্বাপেক্ষা পবিত্র। তাই তাঁর বেশিরভাগ রচনাতেই শিশুচরিত্র, নয়তো শিশুস্বভাব মানুষের উপস্থিতি। সীতারাম মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ,তার প্রতি যশোবতীর আচরণ অনেকটাই মাতৃসুলভ। বৈজুর মতো সরল চরিত্র উপন্যাসে আর নেই। সে আহারনিদ্রাসর্বস্ব, শিশুরাও তাই।

                         সীতারাম, বৈজু ও যশোবতী আসলে মানুষের চরিত্র নয়, চরিত্রের উত্তরণ। উপন্যাসের প্লটও তাই শক্ত কাহিনির বাঁধনে বাঁধা নেই। তা কিছুটা কমলকুমারের উদ্দিষ্ট আঙ্গিকের কারণে, বাকিটা এই কাহিনির সুতোটুকু অবলম্বন করে সিনেমা দেখানোর মতো এক বৃহত্তর দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের তুচ্ছতা ও সার্থকতা একইসঙ্গে উদ্‌ঘাটন করতে। যতোক্ষণ মানুষ অহংকারী, ততোক্ষণ এই মহাবিশ্বে তার উপস্থিতি বুদ্বুদ্‌তুল্য ভঙ্গুর। যখন সে অহমিকা ত্যাগ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভালোবাসতে শেখে, তার মধ্যে মানবীয় প্রেমের পথ ধরে ঈশ্বরভক্তির বিকাশ হয়। প্রাগাধুনিক বাংলায় মানুষ নিজের চাইতে গোষ্ঠীকে, ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে সমষ্টিগত যাপনকে প্রাধান্য দিয়েছে, সমষ্টিও কখনো অন্যায়ভাবে ব্যক্তিত্ববিকাশের বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি- অন্তত সাধারণের সমাজে। উপরন্তু, মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিই তার পাপ-পুণ্যের নির্ণায়ক ছিল, কোনো ঠুনকো সংস্কার নয়। পুরাণ কথকতার আসর থেকেই প্রাগাধুনিক বাংলার মানুষ ঠিক-ভুলের বিচারবোধ অর্জন করে নিত। কমলকুমার লক্ষ করেছেন, শিশু, নারী, অন্ত্যজ মানুষ—যারা প্রাণধর্মের নির্দেশে চালিত হয়, যাদের স্বাভাবিক আবেগ আছে, স্বতঃস্ফূর্ত হাসিকান্না আছে, তারাই মানুষোচিত মূল্যবোধগুলি ধরে রাখে। শবরীমঙ্গলের মাধালি কিংবা অন্তর্জলী যাত্রার বৈজুনাথ কিংবা যশোবতী- এই শ্রেণির প্রতিনিধি। যশোবতীর মধ্যেও আমরা পুরাতন সংস্কারের নির্মোক খসে গিয়ে শুদ্ধ মানবতার স্ফূরণ লক্ষ করি। সে ছিল ভাবের ঘোরে, যে ভাব সংস্কারের দ্বারা জাত। কিন্তু ভাবেরও শক্তি আছে, সে শক্তি কীটের মতো আহারসর্বস্ব বৈজুর মধ্যে ভালোবাসা সঞ্চার করতে পারে। অন্যদিকে বৈজু আহারনিদ্রাসর্বস্ব জীবের প্রতীক, যে আহার ও নিদ্রা স্বাভাবিক জৈব ধর্ম- তার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই, নীচতা নেই। শব যেমন শক্তির স্পর্শে শিব হয়, বৈজু তেমনি যশোবতীর স্পর্শে ভালোবাসা শেখে।

                          এই উপন্যাসের আখ্যান এবং আঙ্গিক একে অপরের সাথে অছেদ্য। ভেবে দেখুন, আমরা যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে উপন্যাস পড়তে অভ্যস্ত, সেই ভাষায় কি অন্তর্জলী যাত্রা লেখা আদৌ সম্ভব ছিল? আবার এই উপন্যাস যে ভাষায় লেখা হয়েছে, সেই ভাষায় বাজারচলতি কাহিনি লেখা সম্ভব নয়। কেন? আশা করছি পরবর্তী সংখ্যায় এর উত্তর দিতে পারব।