নাগিনী কন্যার কাহিনী ও লাঙলহাটার বিল

(১)

কোনও সুদূর অতীতের কথা নয়। এমনকি বিগত শতাব্দীর কথাও নয়, সেদিনের কথা। ২০২১ এর পুজোর ছুটি, দীর্ঘ বন্দিত্বের পর বাড়ি যাওয়া। তারই মধ্যে সুযোগ খুঁজে কয়েকটি গ্রামে ঢুঁ মেরে আসা। এই গ্রামগুলি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারাশঙ্করের সাহিত্যের পটভূমি। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় হলেও তখন যেন ভরা বর্ষা। ঠিক সেই সময় ময়ূরাক্ষী আর কোপাই বন্যায় ভাসল। একদিকে লাভপুরের পূর্বপ্রান্তে লাঙলহাটার বিল জল থইথই অন্যদিকে ‘হাঁসুলী বাঁক’ নামে পরিচিত জায়গাটিও ডুবুডুবু। ফলে সড়কপথে লাভপুরের সঙ্গে লাভপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেল। ময়ূরাক্ষী বা কোপাইয়ের বন্যা যেমন বছর বছর হয়, তেমনি এই সময় সর্প দংশনের ঘটনাও বছর বছর ঘটে। বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে চাষিদের কাছে এ এক প্রকার পেশাগত বিপত্তি। জমির আলে অথবা নদীর চরে ঘাস কাটতে গিয়ে কেউটে সাপের ছোবল খাওয়া অতি সাধারণ ঘটনা। তবে মানুষ  হাসপাতালে যাওয়াকে প্রাধান্য দেয় বলেই সর্প দংশনে মৃত্যুর ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম ঘটে।

অবশ্য কানদুটো সেভাবে খোলা রাখলে সাপ সংক্রান্ত অসংখ্য লৌকিক বিশ্বাসও যে কানে আসবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। দেখা যাবে হাসপাতাল বা ওষুধের ভরসা করলেও বিষহরি, মা মনসা, জড়ি বুটি, ওঝা-বেদে-দৈব অথবা নানান তুকতাকের উপর বিশ্বাস আজও অদৃশ্য স্রোতের মতো বয়ে চলেছে সমাজের আনাচেকানাচে। এরকমই একটি ছোট অভিজ্ঞতাও তখন হল।

একদিন বিকেলে একটি বাড়িতে আটকা পড়লাম ঝিরঝিরে বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টি পুরোপুরি থামার জন্যে অপেক্ষা করছি। এমন সময় প্রতিবেশী একজন ভদ্রমহিলা ঢুকলেন চুবড়িভেজা হয়ে। তাঁর বাড়ি থেকে এবাড়ি আসার পথ সামান্য। গলিপথ। এটুকু আসতে অমন ভিজে গেলেন! ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করলেন। যাদের বাড়িতে তিনি এলেন তাদেরই পুরনো মাটির বাড়ির পাশের গলিটাই হল রাস্তা। তড়িঘড়ি আসবেন কি তাঁকে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে দুপা আসতেই তিনি দেখতে পেয়েছেন এদের পোড়ো বাড়িটার দেওয়ালের ফাটল থেকে একটি  সাপ মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। খড়ের চাল থেকে বিন্দু বিন্দু জল পড়ছে। সাপটি সেই জল পান করছে। ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করেছেন যতক্ষণ না সাপটি জলতেষ্টা মিটিয়ে গর্তে ঢুকে যায়।

লক্ষ করলাম, কী সাপ, কতবড় সাপ, বিষধর কিনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। উদ্বিগ্নও হল না। উপরন্তু গৃহস্বামী বললেন, ওই সাপটির জন্যেই তাঁর একটি বড় কাজ দীর্ঘদিন আটকে আছে। পুরনো বাড়িটি ভেঙে তিনি যে পাকা বাড়ি করবেন সে সবের ব্যবস্থা করে ফেললেও সাপটির জন্যে কাজে হাত দিতে পারছেন না। বাস্তুসাপ! তাকে গৃহ ছাড়া করলে গর্হিত অপরাধ হবে।

ক্রমে ক্রমে জানতে পারলাম সাপটি খরিশ সাপ। দেখলাম এমন বিপজ্জনক বিষধর প্রাণী নিয়ে ও বাড়ি কেন গোটা পাড়ায় কারও কোনও উদ্বেগ নেই। সাপটি পাড়ার সকলের চেনা। নর ও নাগের এমন সহাবস্থান যেন গৃহপালিত কোনও পশুর সঙ্গে পাশাপাশি থাকার মতো। ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ সাপ কারও কোনও ক্ষতি করবে না। বাড়িতে আপনাআপনি গজিয়ে ওঠা ফনিমনসা গাছই তার প্রমাণ। গাছটির প্রতি আলাদা করে নজর পড়ে নি। কথাটা শুনে পড়ল। ডালপালা ছড়িয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বেড়ে উঠেছে। মা মনসা জ্ঞানে গাছটিকে পুজো করা হয়। সাপটিও ইচ্ছে মতো বের হয়। কেউ সামনে পড়লে, পাশ কাটিয়ে যায় নাহলে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না সাপ পথ ছেড়ে দেয়।

(২)

পূর্বজন্মের স্মৃতির মত হঠাৎ আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। তখন আমাদের আশপাশের গ্রামগুলিতে পাকাবাড়ি কদাচিৎ দেখা যেত। বাড়িগুলি ছিল মূলত মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। কিছু কিছু বাড়ি শতাব্দীপ্রাচীন। কিছু পোড়ো বাড়িও ছিল। হয়ত তার ওয়ারিশ নেই বা দূরে কোথাও থাকে। সেসব বাড়িগুলিতে আমাদের খেলতে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তার কারণ ওই বাড়িগুলি ছিল সাপের বাসা।

সেই সময় বছরে দুএক বার আমরা ডুগডুগির (ডমরুর) শব্দ শুনে পড়া ফেলে ছুটে গিয়েছি। ডমরু, ভেঁপু, একতারার শব্দ অথবা ফেরিওয়ালার বিশেষ ডাকে সবাই যেমন পড়া ফেলে ছুটে যেত সেই রকম। ডুগডুগির শব্দ মানে বিশেষ এক ধরণের মানুষের আগমন ঘটেছে গ্রামে। তারা সাপুড়ে বা বেদে। যেন কোন অচেনা পৃথিবী থেকে আসে। তাদের চেহারা, ভাষা, জীবনযাপন সবই রহস্যময়। কালো রুক্ষ গায়ের চামড়া, রক্তিম চোখ আর প্রায় অর্ধনগ্ন শরীরে তারা আসে, সাপের নাচ দেখায় আর ধান অথবা চাল নিয়ে চলে যায়। কোথা থেকে আসে তারপর কোথায় চলে যায়, সেসব আমরা বুঝতে পারতাম না। কৌতূহল ছিল তাদের কাঁধের বাঁকে। বাঁকের দুদিকে ঝুলত থাক দেওয়া একটার পর একটা বেতের ঝাঁপি। বড় থেকে ছোট হিসেবে সাজানো। যেখানে লোক জমত ওরা ঝাঁপি নামাত। তারপর একএকটা ঝাঁপি খুলে বের করত সাপ। নানা আকার আকৃতির সাপের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে তাদের নাচাত। ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে একটা হাঁটু বিশেষ কায়দায় এগিয়ে দিত অমনি ফনা তুলে সাপ ছোবল মারত। তখনই জানতে পারি ওসব সাপের বিষ নেই। বেদেরা নিয়মিত সাপেদের কামিয়ে নেয় অর্থাৎ বিষ গেলে নেয়। ওদের ঝাঁপিতে কতরকম জড়িবুটি থাকে। তাই দিয়ে ওরা সাপকে নিস্তেজ করে দিতে পারে।

পাড়ায় একটি পোড়ো বাড়িতে ঘন ঘন সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখা যায় শুনে একবার একদল বেদে অতি উৎসাহে সাপ ধরতে নেমে পড়েছিল। আগ্রহ থাকলেও তাদের কারসাজি চোখে দেখা সম্ভব হয় নি। বিশাল দুইখানি খরিশ সাপ হাতে ঝুলিয়ে বিজয়গর্বে ওদের বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম শুধু।    

পরবর্তী জীবনে দেখলাম, সেই হঠাৎ উদয় হওয়া এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া একদল আদিম বর্বর মানুষ সভ্যসমাজের মনে বিশেষ রেখাপাত না করলেও স্থান পেয়েছে তারাশঙ্করের সাহিত্যে। কাহার, সাঁওতাল, হাড়ী বা ডোম ইত্যাদি নানা প্রান্তিক জনজাতির মতো সাপুড়ে বা বেদেদের বিচিত্র জীবনযাপন তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা অনেকগুলি কাহিনীতে। যার মধ্যে ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।

‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। তার আগের বছর ‘সত্যযুগ’ নামে একটি কাগজের পূজাবার্ষিকীতে অসমাপ্ত কাহিনীটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাহিনী নির্মাণের প্রসঙ্গে তারাশঙ্কর তাঁর ছোটগল্প ‘যাদুকরী’র উল্লেখ করে বলেছেন, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ এবং ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ এই দুটি উপন্যাস রচনায় গল্পটি এবং তার পটভূমি তাঁকে প্রভূত প্রেরণা যুগিয়েছিল।

‘যাদুকরী’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১ সালে শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায়। অবশ্য তার আগে সাপ ও সাপুড়ে সম্প্রদায় নিয়ে একাধিক গল্প তারাশঙ্কর লিখেছিলেন। ‘নারী ও নাগিনী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালে শারদীয়া দেশ প্রত্রিকায়। শনিবারের চিঠির ১৯৩৭ সালের বৈশাখ সংখ্যায় ‘রাজসাপ’ এবং ১৯৩৯ সালের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বেদেনী’। পরবর্তী সময়েও তাঁর যে সব গল্পে বেদে সম্প্রদায় স্থান পেয়েছে তা ১৯৪৯ সালে শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত ‘বেদের মেয়ে’, ১৯৫৩ সালে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ‘বরমলাগের মাঠ’ এবং ১৯৫৯ সালে ‘জয়যাত্রা’য় ‘সাপুড়ের গল্প’।   

(৩)

কেবল মাত্র ছোটগল্প নয়, তারাশঙ্করের একাধিক উপন্যাসে বেদে সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ রচনার বহু পূর্বেই যেন নাগিনী কন্যার আভাস পাওয়া যায় ১৯৩৭ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘আগুন’ উপন্যাসে। সেখানে বিচিত্র এক মানবীর বিবরণ দিয়েছেন তারাশঙ্কর, ‘অদ্ভুত মিষ্টভাষী এই যাযাবর জাতিটি। এমন মিষ্ট কথা আমি জীবনে কোন জাতির মুখে শুনি নাই। আর মোহময় একটা রহস্য যেন এই অনাবৃতদেহ জাতিটির সর্বাঙ্গ ঘেরিয়া মাখানো আছে। বর্বরা যাযাবরীরা মোহময়ী, সর্বাঙ্গে যেন মোহজড়ানো... যাযাবরী আমাকে মোহগ্রস্তই করিয়াছিল। কিন্তু অনুশোচনা হইতেছে না।’ ‘আগুন’ উপন্যাসের আরও একটি জায়গায় দেখা যায়, ‘আজও আমার মনের ছায়াপটে যাযাবরী নাচিতেছে। ইচ্ছা হইতেছে ছায়াপটের এই অংশটুকু দীর্ঘ, সুদীর্ঘ, জীবনব্যাপী দীর্ঘ হউক।’        

‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’র নেপথ্যে ‘যাদুকরী’ গল্পের ভূমিকার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ‘যাদুকরী’ তাঁর অভিজ্ঞতাপ্রসূত গল্প। গল্পটি যখন ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় গল্প’ নামক সংকলনে স্থান পায়। সেই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘যাদুকরী যাদের নিয়ে লেখা- তারা আমাদের ও-অঞ্চলের একটি সম্প্রদায়। বিচিত্র সম্প্রদায়। ওদের নিয়ে গল্পটি লেখার পর- এই ধরণের সম্প্রদায় নিয়ে বড় রচনার ইচ্ছা এবং সাহস পেয়েছি। ... এই সম্প্রদায়টি আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাদের জন্যে মনে মনে বেদনা অনুভব করি। ... ওই যাদুকর যাদুকরীদের ভালবাসতাম। ... এদের সঙ্গে ঘুরেছি, এদের গ্রাম আমাদের গ্রামের খুব কাছে- সে গ্রামের কিছু জমিদারী অংশ আমাদের ছিল, সে গ্রামে গিয়েছি, তাদের বাড়ির দাওয়ায় উঠানে বসেছি; ওদের সম্পর্কে প্রবাদ কাহিনী, ইতিহাস সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। ওদের সম্পর্কে পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন লিখেছেন- ওরা রাঢ়ের সিদ্ধল নগরীর রাজা ভবদেব ভট্টের গুপ্তচর হিসেবে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াত।’

লাভপুরের অদূরে শীথলগ্রামই যে সেকালের সিদ্ধল নগরী তা তারাশঙ্করের লেখাতেই পাওয়া যায়।

‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’র রচনাকালে তারাশঙ্কর বিচিত্র মানসিক অবস্থায় ছিলেন। তাঁর মন তখন প্রবলভাবে অশান্ত। সে সময় তিনি সর্বদা আত্মমগ্নতায় ডুবে থাকতেন। আহারে রুচি ছিল না। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও তা সাময়িক। ক্ষণিকের মধ্যেই তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন। প্রতিষ্ঠার স্বাদও আর তাঁকে মুগ্ধ করত না। ‘কী চাই?’,  ‘কে আমি’, অথবা ‘এই জীবনের উদ্দেশ্য কী!’ এমনই কিছু মৌলিক প্রশ্ন তাঁকে কুরে কুরে খেত। তখনই ‘বসুমতী’ থেকে পুজোসংখ্যার জন্য উপন্যাস লেখার তাড়া এসেছিল। মানসিক অস্থিরতার কারণে সে লেখা শেষ করতে দেরি হয়ে যায়। তাঁকে জানানো হয় যে উপন্যাসটি বসুমতী ছাপবে না। তারাশঙ্কর যেন রেহাই পান। লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই অসমাপ্ত লেখাই টাইমস অফ ইন্ডিয়ার বাংলা কাগজ ‘সত্যযুগে’ ছাপা হয়। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ লেখাটির প্রচুর প্রশংসা হয়। অনেকগুলি কাগজে সমালোচনা বের হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রাজশেখর বসু এবং প্রমথনাথ বিশীর প্রতিক্রিয়া। রাজশেখর বসু বলেছিলেন এমন ধরণের বই তিনি একমাত্র ইংরাজি ভাষাতেই পড়েছেন। যার পাত্রপাত্রীরা সমুদ্রের উপকূলে দ্বীপাঞ্চলে বসবাস করে। তাদের জীবনযাপন বিচিত্র। নৌকা করে মাছ ধরে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর এদের পেলেন কোথায়? তাঁরা কি আজও আছে? তাদের সঙ্গে এমন নিবিড় করে কীভাবেই বা মিশলেন তারাশঙ্কর!

হিজলের বন এবং বিলের বর্ণনায় মুগ্ধ প্রমথনাথ বিশী আশ্চর্য হয়েছিলেন যে দীর্ঘকাল শান্তিনিকেতনে থেকেও শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি এমন বিল আছে বলে তিনি শোনেন নি।

(৪)

তারাশঙ্করের অধিকাংশ লেখা বাস্তবাশ্রয়ী হওয়ায় সহজেই তাঁর কাহিনীর পটভূমি চিহ্নিত করতে পারত পাঠক। একই সঙ্গে আঞ্চলিক বলে বদনামও করত। কিন্তু তারাশঙ্কর তাঁর ‘আমার কথা’ গ্রন্থে বলেছেন ‘‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ থেকে আমার লেখা সবদিক থেকে আঞ্চলিক বাস্তবতাকে ছাপিয়ে কল্পনাকে আশ্রয় করেছিল বেশী।’ ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’ বারো আনারও বেশি কল্পনা। বাকিটা তথ্য নির্ভর। এই তথ্যের বেশ কিছুটা তাঁর শৈশবের স্মৃতি থেকে আহরণ করা।

‘সাঁতালী ওদের গ্রামের নাম। হিজলবিলের ধারে ভাগীরথীর চরভূমির ঘাসবন ঝাউবন দেবদারু গাছের সারির আড়ালে, ওই হাঙরমুখি নালার ঘাট থেকে চলে গেছে এক ফালি সরু পথ, দুদিকে ঘাসবন, মাঝখানে পায়ে পায়ে বনপথ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে ওই বিষবেদেদের সাঁতালী গ্রামের মাঝখানে, বিষহরি মায়ের থান অর্থাৎ স্থান পর্যন্ত।’ তারাশঙ্করের বর্ণিত এই সাঁতালী গ্রামেই আছে মা মনসার আটন। এই হিজল বিলের মা মনসার আটনের সঙ্গে মা মনসার ব্রতকথার বর্ণনার প্রভূত মিল। কোথায় এই হিজল বিল?

তারাশঙ্কর বলেছেন হিজল নামে একটি বিখ্যাত বিল মুর্শিদাবাদে এক সময় ছিল। তবে ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ লেখার প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বেই তাতে নদীর জল ঢোকা বন্ধ করে আখচাষের জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। সে বিল তিনি চোখে দেখেন নি। যে বিল তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন এবং কাহিনী নির্মাণের সময় কল্পনায় রেখেছিলেন তা তাঁর গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে লাঙলহাটার বিল। লাঙলহাটার কাছে কুয়ে ও ময়ূরাক্ষীর সঙ্গমস্থল। দুটি নদীর মিলিত জলধারা জমা হয় এই বিলে। এই বিল যেমন শীতকালে পাখির আগমনের জন্য বিখ্যাত তেমনি সাপের উৎপাতের জন্যেও কুখ্যাত।   

লাঙলহাটার বিলকে ঘিরে কিছু কাল্পনিক কাহিনী তারাশঙ্কর তাঁর শৈশবে শুনেছিলেন। যেমন ওই বিলেই আছে মা মনসার আটন। তাই সেখানে মনসাপুজো হয়। ওই অঞ্চলের চারিপাশে ঘাসবনে নানা রকমের সাপ ঘুরে বেড়ালেও তা ধরা নিষিদ্ধ। বরং অন্য জায়গা থেকে সাপ ধরে এনে এখানে ছেড়ে দিলে মা মনসার আশীর্বাদ পাওয়া যায়। এই বিলেই তারাশঙ্কর ‘কাদাচরা’ পাখির ছোঁ মেরে সাপ ধরা দেখেছিলেন। দেখেছিলেন তাঁর আর এক কাহিনী ‘ডাক হরকরা’র নায়ক দীনু ডোমকে ওই বিল থেকে সাপ ধরার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে এবং সেই সাপ পুনরায় ওই বিলে ছেড়ে দিয়ে সুস্থ হতে। আর দেখেছিলেন ওই অঞ্চলের জাত বেদেদের। লক্ষ করেছিলেন রাধিকা নামের এক বেদেনীকে। সেই বেদেনীর বর্ণনা পাওয়া যায় ‘আমার কথা’য়, ‘রাধিকা বেদেনী ছিল ছোটখাটো মেয়েটি, নিকষের মত কালো কিন্তু কী অপরূপ শ্রী। মাথায় অপর্যাপ্ত করকরে মোটা কোঁকড়া চুল, তার মধ্যে তার সিঁথিটি আজও আমার মনে আছে। ... ওদের সাপ ধরাও দেখেছি। ওই রাধি বেদেনীকেই ধান ভরা খেতে পলায়নপর কেউটেকে তেড়ে ধরতে দেখেছি।’

এইসব তথ্যকে কাঠামো করে তার সঙ্গে তারাশঙ্কর মিশিয়েছিলেন নানা ছোট বড় জনশ্রুতি, কিংবদন্তি ও পুরাণের কথা। অসংখ্য শাখাপ্রশাখায় বিন্যাস করে কাহিনী নির্মিত হয়ে লাভ করেছিল বনস্পতির রূপ। আদিম জীবনযাপনে অভ্যস্ত এক জনজাতির কামনা-বাসনা, নীতি-দুর্নীতি, পাপপুণ্য, বিশ্বাস ও কুসংস্কার সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে সমৃদ্ধ হয়েছিল কাহিনী।

‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’তে বিষ-বেদে সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে। এদের সমাজে নাগিনীকন্যার একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। তাঁকে ব্রহ্মচারিণী বা তপস্বিনীর ধর্ম পালন করতে হয়। তাঁকে মা মনসার মানসকন্যা হিসেবে মান্য করা হয় এবং ভর হওয়া কালীন তার মুখ থেকে যে কথা বের হয় তাঁকে দৈববাণী হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তার কথার উপর কারও আদেশ চলে না এমনকি সমাজের প্রধান শিরবেদের কথাও না। যদিও শিরবেদে সদা সতর্ক থাকে যাতে নাগিনীকন্যার দেহ কোনও পুরুষ স্পর্শ না করে। পুরুষের স্পর্শে কেবল নাগিনীকন্যাই নয় সমগ্র সমাজই কলুষিত হয়। অর্থাৎ তাদের সমাজের যার যা কিছু ন্যায় অন্যায়, পাপপুণ্য সবই নাগিনীকন্যার পুণ্যেই রক্ষা হয়। নাগিনীকন্যা যে কেউ হতে পারে না। বিশেষ লক্ষণ দেখে তাঁকে নির্বাচন করা হয়। একজন নতুন নাগিনীকন্যার আবির্ভাব হলেই পুরনো নাগিনীকন্যাকে আসন ছেড়ে দিতে হয়। বাকি জীবন সে গ্রামের প্রান্তে কুঁড়ে ঘরে বিষহরির ধ্যান করে কাটিয়ে দেয়। সাধারণত একজন শিরবেদের আমলে দুই থেকে তিনজন নাগিনীকন্যার সময়কাল পার হয়ে যায়। এ কাহিনীতে দুইজন নাগিনীকন্যার কথা বিবৃত হয়েছে। একজন শবলা যার সময় শিরবেদে মহাদেব এবং অন্যজন পিঙলা যার শিরবেদে গঙ্গারাম।

শিরবেদের উপর কোনরকম সামাজিক বাধানিষেধ থাকে না। সবরকম অন্যায়, পাপ অথবা নোংরামি করেও শিরবেদের আসন অটল। তার সব পাপ ধুয়ে যায় নাগিনীকন্যার পুণ্যের জোরে। তাই শিরবেদের পাপের পাল্লা যত ভারী হয়, নাগিনীকন্যার উপর পাহারা তত কড়া হয়ে ওঠে। তবুও দেবী সাজিয়ে রাখা নাগিনীকন্যার দেহে মানবীর চাহিদা প্রকাশ পায়। তার দেহ থেকে বের হয় চাঁপাফুলের সুবাস। চিরকুমারী নাগিনীকন্যার যৌনক্ষুধাকে এমনই প্রতিকীভাবে বর্ণনা করেছেন তারাশঙ্কর, ‘... নাগ সেই গন্ধের টানে এসে হাজির হয়, দুজনে মিলন হয়, খেলা হয়, জীবধর্মের অভিলাষ মেটেঃ নাগনাগিনী অভিলাষ মিটিয়ে চলে যায় আপন আপন স্থানে। ভালবাসা তো নাই সেখানে! কিন্তু নাগিনীকন্যে যখন মানুষের রূপ ধরে মানুষের মন পায় তখন দেহের অভিলাষ মিটলেই মনের তিয়াস মেটে না, মন চায় ভালবাসা, সে তো ভাল না বেসে পারে না।’

এ কাহিনীতে শবলা আর পিঙলা দুজনের দুরকম পরিণতি ঘটেছে। শবলা কামনার আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে আর পিঙলা নিজের ধর্ম বজায় রেখে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের তপস্যা করেছে এবং শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে। একসময় ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’ একাধারে দু’জন নারীর ধর্মরক্ষা ও ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষার আখ্যান হয়ে উঠেছে। যদিও আখ্যান জুড়ে একটি বিশেষ জনজাতির পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে ছত্রে ছত্রে, বর্ণিত হয়েছে তাদের প্রবৃত্তিতাড়িত জীবনযাপনের খুঁটিনাটি তথ্য। সর্পকুল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবুও কি শেষপর্যন্ত এই কাহিনী কেবল সর্পকুলের ইতিহাস হয়ে উঠেছে অথবা বেদে সম্প্রদায়ের ইতিহাস?

সামগ্রিকভাবে বিচার করলে বোঝা যায় রাঢ়বাংলার ধুলোমাটিতে বেঁচে থাকা বিলুপ্তপ্রায় একটি জনজাতির কথা লিখতে গিয়ে তারাশঙ্কর একটি নতুন জগত নির্মাণ করেছেন। সুমথনাথ ঘোষের মতে,  প্রাচীন গুহার মধ্যে বিচিত্র চিত্রকলা বা ভাস্কর্য আবিষ্কারের মতো ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’ তারাশঙ্করের এক অভিনব আবিষ্কার। ‘তারাশঙ্করের এ এক মহাসৃষ্টি, বিশ্বসাহিত্যে একক, অনন্যসাধারণ, অতুলনীয় বললেও অত্যুক্তি হয় না।’    

তথ্যঃ

১। তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড); সাহিত্য সংসদ।   

২। নাগিনী কন্যার কাহিনী; তারাশঙ্কর রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড); মিত্র ও ঘোষ।

৩। আমার সাহিত্য জীবন; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

৪। আমার কথা; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; অনামিকা পাবলিশার্স।