ইরানের মেয়েদের আজাদীর লড়াই : জাফর পানাহীর চলচ্চিত্র ‘অফসাইড’

বেশীদিন আগের কথাও নয়। এনআরসি সংক্রান্ত নাগরিকত্বের প্রশ্নে ভারতরাষ্ট্র তখনও দাঁত নখ বের করে নির্ল্লজ্জভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি দেশের মানুষের প্রতি। সারা দেশে বিক্ষিপ্ত ভাবে বিক্ষোভ-প্রতিরোধ চললেও, জেএনইউ-জামিয়ামিলিয়া-হায়দ্রাবাদ-যাদবপুর ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে নিয়মিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শ্লোগান আঁকা হলেও, দেশের অধিকাংশ মানুষই তখন নিশ্চুপ ভারতরাষ্ট্রে নিয়মিত ঘটে চলা নানান রাষ্ট্রীয় ভায়োলেন্স নিয়ে। রাষ্ট্র এবং অধিকাংশ মানুষের কাছেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দ্বীপ-সদৃশ স্পেস গুলো রাষ্ট্রদ্রোহী-অ্যান্টিন্যাশনাল এবং শহুরে নকশালদের আড্ডা। সিনেমাহলে জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে এবং তাতে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানোর প্রসঙ্গে প্রায় মৌলবাদী হয়ে উঠছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক সাধারণ মানুষই – হেনস্থা হতে হচ্ছে অনেককে। ব্যক্তিগত ভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সিনেমাপ্রেমী হওয়ায় উল্লিখিত উভয়তরফের হেনস্থার সামনেই সময়ে অসময়ে পড়তে হয়েছে আমাকে। কলেজ-ইউনিভার্সিটির জীবন কৈশোর থেকে যৌবনে গিয়ে পৃথিবীকে চিনতে শেখার জীবন – আর যখনই বড় হচ্ছি আমরা – পৃথিবীকে দেখতে শিখছি – তখনই অজানা এক লৌহনিগড়ে বদ্ধ হয়ে যাওয়ার প্যারানইয়ায় ভুগতে শুরু করছেন ভারতবর্ষের হাজার হাজার মানুষ। 

এই সময়টাতেই, মনে আছে, জাতীয় পতাকা এবং তৎসহ দেশপ্রেমের সবরকম উপাদানের প্রতি একটু একটু করে বিতৃষ্ণা ধরতে থাকে আমার। যৌবনের প্রথম সময় বড় অস্থির – তখন কেউ আঘাত হানলে অভিমান হয় তীব্র; আর সেই তীব্রতাতেই সম্ভবত সেই আমি তখন 'রাষ্ট্র' আর 'দেশ'কে গুলিয়ে ফেলছি। রাষ্ট্রের লৌহনিগড়ের হুমকিতে তখন আমার কাছে 'জাতীয়তাবাদ' আর 'দেশপ্রেম' – এই শব্দগুলো এক হয়ে যাচ্ছে; দেশের কিছু অংশের মানুষকে নির্ল্লজ্জ রাষ্ট্রবাদী হয়ে যেতে দেখে বুঝি গোটা দেশটাকেই রাষ্ট্র ভেবে ফেলছি! মনে আছে সেই সময় সিনেমাহলে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে বিরাট আকৃতির গেরুয়া-সাদা-সবুজ জাতীয় পতাকা – আর তখনই হয়তো উঠে না দাঁড়ানোর কারণে পিছনের সিট থেকে পাকিস্তানে চলে যাও বলে হুমকি দিচ্ছেন এমন একজন মানুষ যাঁর সাথে আগামী দুই ঘণ্টা ফিল্ম দেখার মত একটা জরুরী অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেব আমি। সেই মানুষটা, জাতীয় পতাকা, আর রাষ্ট্রকে তখন আমি আলাদা করে দেখতে পারছিলাম না আর। খেলা দেখতে খুব একটা ভালো না বাসলেও মাঝে সাঝে ক্রিকেট–ফুটবল-টেনিস দেখি; তখনই টিভিতে দেখছি, ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন রাষ্ট্রনেতাদের সুরে ক্রীড়াপ্রেমীদের হুমকি দিচ্ছেন, ভারতে থেকে ভারতীয় ক্রিকেটারদের চেয়েও বিদেশী খেলোয়াড়দের বেশী ভালো বাসলে দেশ ছেড়ে চলে যাও। আমি চলচ্চিত্র প্রেমী, আমার মনে হচ্ছে – আরে, এরপর আমাকেও কেউ বলবে, ভারতে থেকে অভারতীয় ছবি বেশী দেখার জন্য, তাকে ভালোবাসার জন্য আমি ভারত থেকে চলে যাবো! ক্রিকেটারদের নিখুঁত দুসরা বা নয়নাভিরাম কভারড্রাইভ, আর সিনেমার ক্লোজ আপ-লং শটের আবার কোন দেশ হয় নাকী! এসব কী হচ্ছে!

এমন সময়েই রামধনুর মতো শাহিনবাগ এলো – এলো সারা ভারত জুড়ে প্রতিরোধের অপরূপ এক মুহূর্ত, আর এই ব্যক্তি আমিটি – যার কাছে কীনা এতদিন দেশ-রাষ্ট্র-মানুষ-জাতীয়পতাকা সব এক হয়ে যাচ্ছিল, সেই আমিই দেখলাম, 'দেশ'-র মানুষ কীভাবে 'রাষ্ট্র'-র বিরুদ্ধে শিঁড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন – আর সেখানেও বটগাছের মত মাথার উপরে দাঁড়িয়ে এই ভারতের জাতীয় পতাকাই – গেরুয়া-সাদা-সবুজ। যে আমি এতদিন এই তিনটে রংকে নিজের অজান্তেই খানিক বিতৃষ্ণা করতে শুরু করছিলাম, এই প্রতিরোধের মুখে পড়েই আমার কাছে দেশ আর রাষ্ট্র'র বিভাজন স্পষ্ট হয়ে গেল – নিষ্পেষণের রূপক জাতীয় পতাকাকে আমি ভালোবাসার পতাকা হিসেবে চিনে শিহরিত হলাম। লকডাউন আসার আগের কয়েকটা মাস তাই আমার কাছে রাষ্ট্রের থেকে ‘নিজের দেশকে ফিরে কেড়ে নেওয়া’ দেখার মাস – আমি দেখছিলাম নবারুণের প্রায় রূপকথার লাইনগুলো কীকরে বাস্তব পৃথিবীতে শরীর পাচ্ছে - 

‘আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন’।

 

জাফর পানাহি'র ২০০৬ সালের ছবি 'অফসাইড' নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই দীর্ঘ ভূমিকার একটাই কারণ – ছোটবেলায় একবার দেখার পর এতদিন পরে আবার দেখার মুহূর্তে ছবিটি আসলে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল আমার গত দুই বছরের এই ব্যক্তিগত জার্নির অভিজ্ঞতাকে। যে আমি ব্যক্তিগত জীবনের পথে দেশ-রাষ্ট্র গুলিয়ে ফেলে নিজের দেশের অভূতপূর্ব প্রতিরোধের সামনে দাঁড়িয়ে আবার একটু একটু করে বুঝতে পারছিলাম কী করে রাষ্ট্রকে 'না' বলেও দেশের মানুষ এবং সেই মানুষের প্রতীক হিসেবে দেশীয় সিম্বলগুলো ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেওয়া যায় – সেই আমিই জাফর পানাহির ছবিতে দেখলাম একদল উন্মাদ-বিপ্লবী-মাতাল-প্রেমিক মানুষকে, যাঁরা একইভাবে, আমার দেশের শাহীনবাগের মানুষদের মত জাতীয় একটি সিম্বলকে আঁকড়ে ধরেই হটিয়ে দিচ্ছেন কতৃত্ববাদী-মৌলবাদী রাষ্ট্রকে। 'অফসাইড' গোটা ছবিটা তাই এক অর্থে সেই 'বিপ্লবের উৎসবের দিন'কে নিয়েই বানানো – ছবিটা কোনো বিপ্লব বা রাষ্ট্রদ্রোহ নিয়ে কথা বলে না; কথা বলে নিছক একটি ফুটবল ম্যাচ নিয়ে; আর জরুরী – এই উন্মাদ-বিপ্লবী-মাতাল-প্রেমিক সবাই, আমার দেশের শাহীনবাগের মত – নারী।

এক কথায়, ছবিটা আমার গত দুইবছর ব্যপী দৈনন্দিন জার্নির অনুভবকে দুই ঘন্টায় আবার যেন ফিরিয়ে আনল।

আশা করি 'অফসাইড' ছবির ব্যপারে সবাই কমবেশী জানেন। ইরানে ধর্মীয় শাসনের ফলে ফুটবল সহ যে কোন খেলার স্টেডীয়ামে মেয়েরা দর্শক হিসেবে ঢুকতে পারেন না। ধর্মরক্ষাকর্তাদের বানানো আইনে বলে, এতে করে মেয়েরা নাকী ছেলেদের গালাগালি শুনে আর হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় খেলতে দেখে অপবিত্র হয়ে যেতে পারেন! বিশ্বের কোনো আধুনিক দেশের মানুষ এহেন রিডিকিউলাস নিয়মকে সম্মান করে বেশীদিন থাকতে পারেন না – তাই ফুটবল পাগল ইরানে প্রতিটি বড় বড় ফুটবল ম্যাচের দিনে মেয়েরা রাষ্ট্রের সাথে একপ্রকার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন। রাষ্ট্র যত বলে মেয়েদের ঢুকতে দেব না, তত ফাঁকফোকর গলে মেয়েরা খেলা দেখতে যাবেনই। জাফর পানাহি নিজে তাঁর বারো বছরের বাচ্চামেয়েকে নিয়ে খেলা দেখতে গিয়ে একসাথে ঢুকতে না পারার কিছুক্ষণ পরে দেখেন ওঁর মেয়ে ঠিক ওঁর কাছে চলে এসে বলছে – মেইন গেট দিয়ে ঢুকতে না পারলেও কিছু না কিছু পথ তো আছেই! ১৯৯৭ সালে ইরানের জাতীয় ফুটবল দল যখন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ড্র করে বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করার ছাড়পত্র পায়, সেইদিন ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন – ছেলে-বুড়ো-তরুণী সকলে। মেয়েরা অনেকেই প্রকাশ্যে হিজাব খুলে ফেলে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে যেন মুক্তির সন্ধান নিতে চাইছিলেন – পুলিশ-মিলিটারির অনেকেও রাস্তায় মানুষের সাথে উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। এরপরে, সেই খেলোয়াড়েরা দেশে ফিরে আসার পর রাষ্ট্র যখন বিরাট সম্মর্ধনার আয়োজন করে, তখনও স্টেডিয়ামের বাইরে প্রায় হাজার পাঁচেক মেয়েরা একজোট হয়ে বাহুবলে আর সংখ্যার জোরে পুলিশকে হটিয়ে মাঠে ঢুকে পড়েন। প্রাচ্যের এক দেশে থেকে ধর্মীয় অনুশাসনের প্যারানইয়ায় ভুগতে থাকা আমদের শিহরণ হয় আরেক ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্রের ভেতরে এহেন খবর শুনতে – আমরা বুঝতে পারি ইরানে খেলা নিছকই খেলা নয় – বরং বৃহত্তর এক মুক্তির দিনের, বিপ্লবের উৎসবের প্রতীক।

যেখানে বাস্তব এত রঙিন, প্রতিরোধ এত রূপকথার মত; সেখানে একটু চেষ্টা করলেই যে অসামান্য প্রতিরোধের সিনেমা জন্ম নেবে, তা আর আশ্চর্য কী! জাফর পানাহি এই বাস্তবের মধ্যেই প্রায় ডকুমেন্টারি ছবি বানাবার মত করে এক চিলতে ফিকশনাল এলিমেন্ট ঢুকিয়ে দেন – এরকমই একটা খেলার দিনে পাঁচ-ছজন তরুণী খেলা দেখতে এসে স্টেডিয়ামের তরুণ মিলিটারি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছেন। ছবিতে রিল টাইম-রিয়েল টাইম প্রায় এক – অর্থাৎ দেড় ঘণ্টার ফুটবল যতক্ষণ চলে, সেই একই সময়ে আমরা আটকে পড়া এই জনাছয়েক মেয়ের গল্প দেখি, যাঁদের ব্যারিকেড দিয়ে নির্মিত অবস্থায় কারাগারের মধ্যে আটকে রাখতে প্রায় হিমসিম খাচ্ছেন তরুণ সৈন্যের দল। এর মধ্যেই একটি মেয়ে কায়দা করে পালায়, সৈন্যরা সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে যায় তাঁদের ডিউটি শেষ হচ্ছে না বলে – গোটা ছবি জুড়ে স্টেডিয়াম ভরা দর্শকদের উত্তপ্ত গনগনে আওয়াজ প্রায় ড্রামবিটের মত করে ভেসে থাকে সাউন্ডট্র্যাকে – আর খেলা শেষে ইরানের জয়ের আনন্দে সেই মেয়েদের যখন কতৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে, তখন রাস্তায় বেড়িয়ে পড়া অসংখ্য উৎসবমুখর মানুষের বাজি-পটকা-উল্লাসের মাঝে সেই মেয়েরা কায়দা করে চম্পট দেয়। কাঁপা কাঁপা ফুটেজের শেষ কিছু ইমেজে আমরা দেখি, সেই মেয়েরা মানুষের মুক্তির উৎসবে মিলে গেছে।

খেলাধূলা বিষয়ক চলচ্চিত্র আমরা হামেশাই দেখে থাকি, কিন্তু খুব কমই সেই ছবির পরিচালকের নাম জাফর পানাহি হন। তাই 'অফসাইড' ছবি প্রাথমিক স্তরে ফুটবলকে কেন্দ্র করে যেমন কিছু উন্মাদ মেয়েদের গল্প, তেমন ছবিটি যত এগোয়, পেঁয়াজের খোসার মত স্তর ছাঁড়িয়ে নিলে দেখা যায় – ফুটবল খেলা এখানে ছবির 'কন্টেন্ট'-এ নেই, বরং আছে ছবির 'ফর্ম'-এ। অর্থাৎ ছবিটিতে কী বলা হচ্ছে (কন্টেন্ট) তার সঠিক উপলব্ধি তখনই পাওয়া যায়, যদি সেই বলার ধরণ এবং আঙ্গিককে (ফর্ম) আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি – তাই ফুটবল এবং তাকে কেন্দ্র করে উন্মাদনা ছবিটিতে প্রায় আঙ্গিক হয়ে যায়, আর ছবিটির শৈলী হয়ে যায় ফুটবল ম্যাচের মত – আর এই বাইরের খোসা ছাড়িয়ে নিতে থাকলেই আমাদের নজরে পড়ে, খেলার আড়ালে ছবিটি আসলে স্বাধীনতার কথা বলছে।

তাই গোটা ছবিতে ইমেজে কয়েক মুহূর্ত ছাড়া একবারও ফুটবল ম্যাচ সরাসরি আসে না। বরং পানাহি জোর দেন এই কটি বন্দী মেয়ে এবং তাঁদের রক্ষক সৈন্যদের কথোপকথনে। স্টেডিয়ামেরই মধ্যে এক পাশে, খুব বেশী হলে তিরিশ-ফুট বাই তিরিশ ফুটের একটি জায়গার মধ্যেই তিনি ক্যামেরা সীমাবদ্ধ রাখেন (এছাড়া কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই) – আর যত ছবি এগোয় বন্দী মেয়েদের ভালোবাসার পাশাপাশি আমরা সৈন্যদেরও উর্দির আড়ালে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে শুরু করি। মনে রাখা দরকার, বেশীরভাগ প্রতিবাদী চলচ্চিত্র, অধিকাংশ সময়ে ন্যায্য কারণেই রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের রক্ষক কর্মচারীদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় – কিন্তু পানাহি'র ক্যামেরা সেই মেয়েদের মতই এই সৈন্যদের নিয়েও একইরকম সংবেদনশীল। তাই গোটা ছবিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিরোধের স্লোগান বোনা থাকলেও ছবিটিতে কোনো মানুষ 'ভিলেন' নেই – রাগ উপচে পড়লেও কোনো একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নেই যাকে কেন্দ্র করে রাগ মিটিয়ে নেওয়া যায়। বরং 'রাষ্ট্র' নামক এই বিমূর্ত সত্ত্বাটিকে মূল খলনায়ক বানিয়ে ফেললেও পানাহি'র ক্যামেরা সেই রাষ্ট্রের রক্ষকদের প্রতি আশ্চর্য সহমর্মী – গ্রাম থেকে আসা একাকী যুবকের যে গল্প পানাহি 'দ্য হোয়াইট বেলুন' ছবিতে অসমাপ্ত রেখেছিলেন, সেই গল্পই যেন এখানে পূর্ণতা পায়। উর্দির আবরণে কঠোর সৈন্য যুবক মন খারাপ করে মাটিতে বসে পড়ে গ্রামের বাড়িতে ওর মায়ের জন্য, চাষের জমি আর গরুগুলোর জন্য। চলন্ত বাসে বন্দী মেয়েদের খেলার কমেন্টারী শোনানোর জন্য প্রাণপণে রেডিওর অ্যান্টেনা ঠিক করা উর্দিধারী সৈন্যদের দেখতে দেখতে আমরা বুঝতে পারি, কোথায় গিয়ে রাষ্ট্রর চেয়ে তার রক্ষকও আলাদা – তাঁরাও মানুষ, তাঁরাও আমার দেশেরই অংশ।

'অফসাইড' ছবিতে, তাই পরোক্ষভাবে হলেও, ফুটবল ম্যাচের মতই জরুরী হয়ে যায় একধরণের 'সলিডারিটি'র বোধ – আমরা দেখি তরুণ প্রজন্মের যুবক-যুবতীরা রাষ্ট্রের নিয়ম ভাঙতে একে অপরকে সাহায্য করছে। লুকিয়ে একটি মেয়ে খেলার মাঠে যাওয়ার বাসে চুপ করে বসে থাকে, সেই বাসেরই অপরিচিত এক খেলাপাগল যুবক অন্য ছেলেদের তাকে বিরক্ত করতে বারণ করে। পালানোর নামে ছেলেদের টয়লেটে যে মেয়েটি খানিকক্ষণ লুকিয়ে থাকে, তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে টয়লেট করতে আসা কিছু অত্যুৎসাহী আগ্রহী খেলাপাগল যুবকই। পুরুষের টয়লেট, ফুটবল স্টেডিয়াম ইত্যাদি স্পেস যখন সাধারণ ভাবে একধরণের 'ম্যাস্কুলিনিটি'কে ধরে রাখে, যখন সাধারণত পুরুষ-ভর্তি স্পেসে অনেক মেয়েরাই ন্যায্য কারণেই অস্বস্তি বোধ করেন তখন 'অফসাইড' ছবিটি চমক লাগায় আমাদের – রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে নিয়মভাঙা মেয়েদের পাশে সলিডারিটি জানাতে তৈরী থাকছেন নতুন প্রজন্মের পুরুষরাও। এমনকী সৈন্যদের সাথেও মৃদু, প্রায় না বলা একটি সলিডারিটি তৈরী হয়; তারা বয়স্ক এক ব্যক্তিকে মেয়েদেরকে মারতে যাওয়ায় তারা বাঁধা দেয়, বহু কষ্ট করে চলন্ত বাসে রেডীওর অ্যান্টেনা হাত বাড়িয়ে ধরে থাকে তারাই, বাস থামিয়ে জল আনতে গিয়ে বন্দী মেয়েদের জন্য সরবতও কিনে আনে তারা। এমনকী মেয়েদের বন্দী করে যখন পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই বাসের একমাত্র পুরুষ বন্দী ছেলেটি প্রথমে মেয়েদের সাথে থাকতে অসম্মানিত বোধ করছে বললেও দ্রুত বুঝতে পারে এরা আসলে ওর মতই খেলাপাগল–সমমনস্ক। তাই সিগারেটের কাউন্টার থেকে শুরু করে খেলা শেষের মূহুর্তের উত্তেজনা, জয়ের আনন্দে বাজি ফাটানো থেকে শুরু করে দুঃখী একটি মেয়ের জন্য বাজী এনে দেওয়া – গায়ে কাঁটা দেওয়া কিছু মূহুর্ত নির্মাতারা তৈরী করেন যেখানে রাষ্ট্রের নিষ্পেশনের বিরূদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার থেকে যায় এই সলিডারিটি। আমাদের মনে পড়ে ইতিহাসের কথা, ১৯৯৭ সালে ঐ সংবর্ধনের দিন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যে মেয়েরা মাঠে ঢুকেছিলেন, তাঁদের স্টেডিয়ামে প্রবেশকে চিৎকার করে স্বাগত জানায় উপস্থিত যুবকের দলই।

আমরা বুঝতে পারি, আপাত ভাবে জাতীয় একটি ইভেন্ট হলেও, রাষ্ট্রের থেকে সে মুহূর্তের নিয়ন্ত্রণ আসলে কেড়ে নিচ্ছেন সে দেশের সাধারণ মানুষেরাই। লেখার শুরুতে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রাষ্ট্র-দেশের যে পার্থক্যতে পোঁছানোর উপলব্ধির কথা বলেছিলাম – এ ছবিটি (এবং যতদূর সে দেশের মানুষের কথা বুঝতে পারা যায়) যেন সেই রাষ্ট্রীয় গর্বের দিনটিকেই পরিবর্তির করে ফেলে রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে সমবেত হওয়ার দিনে। তাই ফুটবলপাগল তরুণীরা যখন দেশের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে গলা ফাটান, বলেন 'আমরা জিতছি' – তখন সেই 'আমরা'র অস্তিত্ব যেন রাষ্ট্রকে এক ধাক্কায় হটিয়ে দিয়ে দেশের মানুষদের নিয়ে বৃহত্তর একটি সলিডারিটি কল্পনা করে নেয়। এই 'আমি' এবং 'আমরা' এখানে দেশ – দেশের মানুষ, রাষ্ট্রের কতৃত্ববাদী চোখরাঙানীর কোনো স্থান এখানে নেই।  ভারতের মতই ইরানের তেরঙ্গাও তাই মানুষের সমবেত উচ্ছ্বাস আর বিপ্লবের উৎসব পালনের দিন হয়ে যায় – যত ছবি এগোয় তত আমরা মুক্ত, স্বাধীন, প্রায় অলৌকিক একটি প্রতিরোধের সম্মুখীন হই যাকে সম্পূর্ণ কব্জা করা সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রেরও অসাধ্য।

তাই ছবিতে কয়েক মুহূর্তে একটি অলৌকিক সময় আসে। তিরিশ ফুটের সেই ব্যারিকেডের অস্থায়ী কারাগারে বন্দী থাকতে থাকতে এবং সৈন্যদের মুখে 'রিয়ার এক্সিট' দিয়ে দেখতে পাওয়া একটুকরো খেলার রানিং কমেন্টারি শুনতে শুনতে মেয়েরা সেই ব্যারিকেডের মধ্যেই যেন একটুকরো ফুটবল ম্যাচ বানিয়ে নেয়। নিজেদের নাম দেয় ইচ্ছেমতো ফুটবল তারকার নামের মত – সৈন্যদেরও ডেকে নেয় ওদের সাথে। সেই সঙ্কীর্ণ স্পেসটিকে ভাগ করে দুই ভাগে, - নিজেরা খেলার নিয়মকানুন নিয়ে আলোচনা করতে করতে একটি নকল ফুটবল ম্যাচ শুরু করে দেয় যেন। আমরা বুঝতে পারি, রাষ্ট্রের রিডিকিউলাস আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে ছবিটি সেই আইনকে প্রায় ছাপিয়ে বেরিয়ে যায়, যেখানে খেলা দেখতে না পারলেও বন্দীত্বেই তাঁদের ছোট্ট কিন্তু আবেগে ভরপুর, সমান্তরাল একটি ফুটবল ম্যাচ তৈরী করার স্পর্ধা তৈরী হয়। সেখানেই পানাহি'র হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা অনুসরণ করে আসল ম্যাচের সমান্তরালে ঘটে যাওয়া এই নকল ম্যাচের প্লেয়ারদের – স্টেডিয়ামের জোরালো গর্জন সাউন্ডট্র্যাকে যেন এই নকল ম্যাচেরই শব্দ হয়ে যায়। হয়তো অলৌকিক বলেই মূহুর্তটি বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না – কিন্তু আমাদের মনে পড়ে যায় আন্তোনিয় গ্রামশির কথা, যাঁর মাথাকে শাসন করার অধিকার কারও নেই – কতৃত্ববাদী মৌলবাদী রাষ্ট্রেরও নয়।

 

বরং নিষ্পেষণের মধ্যে জীবনের সন্ধানের চিরন্তন রূপক হিসেবে জেগে থাকে খেলা – ফুটবল। আগেই বলেছি ফুটবলকে কেন্দ্র করে মানুষের উন্মাদনার কথা – এ প্রসঙ্গে জাফর পানাহির নিজের কথা মনে পড়ে – 'ইরানে খেলার স্টেডিয়ামই একমাত্র যায়গা যেখানে মানুষ প্রাণপণে চিৎকার করতে পারে। লৌহনিগড় থেকে নিজেদেরকে ছেড়ে দিতে পারে, যা খুশি তাই করতে পারে। সমস্ত চেপে রাখা শক্তির যেন মুক্তি ঘটে সেখানে। কখনও যদি রাজনৈতিক কোনো জমায়েতের সাথে খেলার দিন একই সাথে পড়ে – তখন যেন বারুদে অগ্নি-সংযোগ ঘটে – সেই জমায়েতেও মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে'। তাই 'অফসাইড' ছবিটি দেখতে দেখতে এবং তাকে কেন্দ্র করে পড়তে গিয়ে বোঝা যায়, 'খেলা', এক্ষেত্রে 'ফুটবল' – এর গুরুত্ব রাজনৈতিক ভাবে কতটা অসীম। তাই পানাহি'র ছবির একমাত্র লোকেশন - এই খেলার মাঠ – এই স্টেডিয়ামই যেন হয়ে ওঠে বৃহত্তর অর্থে মুক্তির প্রতীক। পানাহি আরও বলেন, এই ছবিটিও কীভাবে সিনেমা হলে দেখাতে পারেননি তিনি – কিন্তু পাইরেটেড সিডি'র হাত ধরে ‘অফসাইড’ ছবিটি সারা ইরান জুড়ে, শহর থেকে গ্রামে, ফুটপাথে ফুটপাথে, সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। ছবিটির কিছুদিন পরে, কীভাবে এই একই স্টেডিয়ামে ঢুকতে না পারার প্রতিবাদের পথ হিসেবে মেয়েরা এই ছবিটির নাম বেছে নেন! তাই রাষ্ট্র যে ছবিকে দেখাতে দেয় না – তাঁকে বুকে আকড়ে ধরেন সে দেশের মানুষ; জাফর পানাহীর ছোট্ট মেয়ে যেমন বলেছিল, মেইন গেট দিয়ে ঢুকতে না পারলেও কিছু না কিছু পথ খুঁজে নেওয়াই যাবে।

আর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে আরেকটি অসামান্য মিল উল্লেখ না করলেই নয়। ইরানের এই জাতীয় স্টেডিয়াম যা বাস্তব এবং সিনেমায় এত জরুরী, প্রায় রূপকের মত অর্থবিশিষ্ট হয়ে ওঠে; যেখানে দিনের পর দিন পুলিশের সাথে মারপিট করে কখনও মাঠে ঢুকে পড়েছেন মেয়েরা, পানাহি বানিয়ে ফেলেছেন গোটা একটা ছবি – যা গোটা একটি জাতির মানুষের কাছে মুক্তির প্রতীক – তার নাম – 'আজাদী স্টেডিয়াম'।

চিত্র পরিচিতি - বহু দশক পরে আবার খেলার মাঠে উপস্থিত ইরানের মেয়েরা

 

 

টীকাঃ

১) কবিতার এই পংক্তিতে ‘নারী’ শব্দটার ব্যবহারে আমার রাজনৈতিক আপত্তি আছে – এই শব্দটা ‘নারী’কে খানিক অবজেক্টিফাই করে দেশের অন্যান্য ভালোবাসার ‘বস্তু’র সাথে এক করে দেখে। পিতৃতান্ত্রিকতার প্রকাশ সন্দেহ নেই, তথাপি কবিতাটার এই অংশের অনবদ্য আবেগের বিস্ফোরণের জন্য এটি ব্যবহার না করে পারা গেল না।

যেসব প্রবন্ধ বা বই এই লেখাটি তৈরী করতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেঃ

মানস ঘোষ, চলচ্চিত্রে তৃতীয় দুনিয়াঃ ইরান। (মূলত এই প্রবন্ধটিঃ চেনা বাস্তব, অচেনা ছবিঃ জাফর পানাহি'র চলচ্চিত্র)
Dissident Cinema: A conversation between Jafar Panahi and Jamsheed Akrami
H. E. Chehabi, “A Political History of Football in Iran”.