ইতালিতে রবীন্দ্রনাথ : ফ্যাসিবাদের জাল ও জালমুক্তি

(এক)

"রবীন্দ্রনাথ, আপনি ইতালি কেন এলেন?"

পঁচানব্বই বছর আগে ইতালি সফরের পর ভিয়েনা-তে বসে ঠিক এই প্রশ্নটির মুখেই পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিকে ১৯২৬ সালে এই প্রশ্নটি করেছিলেন এক নারী। বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে বাঁচতে ইতালি থেকে সপরিবারে পালিয়ে এসে সুইজারল্যান্ডে থাকছিলেন সিনোরা সালভাদোরি। প্রশ্নটি তাঁরই করা। কিন্তু কথা হল, হঠাৎ রবীন্দ্রনাথকেই এই রকমের প্রশ্ন করতে গেলেন কেন ভদ্রমহিলা? তবে কি তিনি রবীন্দ্রনাথের ইতালি ভ্রমণের ঘটনায় হতাশ হয়েছিলেন? নাকি রবীন্দ্রনাথের কাছে আপামর পৃথিবীবাসীর প্রগতিশীল অংশের যে প্রত্যাশা ছিল, তিনি তা পূরণ করতে পারলেন না? সেই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিলই বা কেন, অথবা ভদ্রমহিলার প্রশ্নের জবাবে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন, সেই কাহিনী শোনবার আগে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েকটি বছর।

১৯১৬ সালে জাপান গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাপানের সংস্কৃতিজগত দেখে অভিভূত হলেই জাপানীদের উগ্র জাতীয়তাবাদ কবিকে আশঙ্কিত করেছিল। তাই টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি হলে বক্তৃতা দিতে তিনি সক্ষোভে জানালেন, "This political civilisation is scientific, not human. ... It betrays its trust, it waves its meshes of lies without shame, it enriches gignatic idols of greed in its temples, taking great pride in the costly ceremonials of its worship, calling this patriotism." [১] খবরের কাগজে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তৃতার কথা পড়ে ফরাসি লেখক রম্যাঁ রলাঁ তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন, "এই বক্তৃতাটি মানুষের ইতিহাসের একটি বাঁককে চিহ্নিত করেছে।" [২] জাপান যাওয়ার আগের বছর, ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল - 'ঘরে বাইরে'। সেখানে অন্যতম প্রধান চরিত্র নিখিলেশের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলিয়ে নিয়েছিলেন, "দেশকে সাদাভাবে সত্যভাবে দেশ বলেই জেনে, মানুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না, চীৎকার ক’রে মা ব’লে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়, তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয় যেমন নেশার প্রতি।" [৩] এই জাতীয়তাবাদী তত্ত্বকে বহু আগেই নাকচ করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৮ সালে এক বন্ধুকে লিখেছিলেন তিনি "হিরের দামে ঠুনকো কাচ কিনতে আমি নারাজ। জীবদ্দশায় মানবতার ওপর দেশপ্রেমকে তাই ঠাঁই দিতে চাই না।" [৪] স্পষ্টতই, উগ্র জাতীয়তাবাদের এই হিংস্র ধারণার প্রতি আজীবন ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই কি মিসেস সালভাদোরির মনে এই প্রশ্নের উৎপত্তি?

১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে প্রথমবার ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় তরুণ রবি ইতালি ঘুরে গিয়েছিলেন। নিঃশব্দে। তখন রবীন্দ্রনাথকে কেউ চিনত না। সত্যি কথা বলতে কি, ওই ইতালি সফর রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের জীবনে বিশেষ কোনও তাৎপর্যও বয়ে আনে না। তাই আমাদের কাহিনীর বিষয়বস্তু ১৯২৫ এবং ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইতালি সফর।

আসুন সে কাহিনীতে ঢোকবার আগে প্রথমেই আপনাদের পরিচয় করাই এই কাহিনীর অন্যতম প্রধান খলনায়ক কার্লো ফর্মিকির (Carlo Formichi) সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের দুইবার ইতালি সফরের সঙ্গে ইনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমটি ১৯২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এবং দ্বিতীয়টি পরের বছরই অর্থাৎ ১৯২৬ সালের মে-জুন মাসে। রবীন্দ্রনাথের এই দুইবার ইতালি যাত্রারই আয়োজক ছিলেন কার্লো ফর্মিকি। এখন প্রশ্ন হল, এই ফর্মিকি রবীন্দ্রনাথকে চিনলেন বা জানলেন কিভাবে?

রবীন্দ্রনাথ নিজে বিভিন্ন প্রসঙ্গে একাধিকবার বলেছেন যে ইতালিবাসীদের বিশেষ আমন্ত্রণেই তিনি ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইতালি ভ্রমণ করেছিলেন। জীবনীকার লিখেছেন, "মনে হয়, এই আমন্ত্রণের সূচনা হয়েছিল ১৯২৩-তে শান্তিনিকেতনে - P. A. Waring ও Melvin L. Broby নামক দুজন ব্যক্তি সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন ও তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যাবার জন্য সচেষ্ট হন।" [৫] এঁরা ভারততত্ত্ববিদ প্রোফেসর কার্লো ফর্মিকির সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক ও ভারতবিদ্যার ছাত্র হিসেবে ফর্মিকির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল ভারতে আসবার। এই স্বপ্নপুরণের লক্ষ্যে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ, প্রভু দত্ত স্বামী, জে ডি ইরানি ইত্যাদির সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেন। কিন্তু চিঁড়ে কিছুতেই ভিজছিল না। ফার্মিকির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ এল যখন রোমে তাঁর পরিচয় হল 'প্রবাসী'র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জামাই কালিদাস নাগের সঙ্গে। কালিদাস নাগের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতার সুবিধাটি নিলেন তিনি। এই রোমেই গিউসেপ্পে তুচ্চির সঙ্গেও পরিচিত হন কালিদাস। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে মুগ্ধ ফর্মিকি, কালিদাসের মাধ্যমে ১৯২১ সালেই রবীন্দ্রনাথকে ইতালি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। রোম থেকে ফিরেও ফর্মিকি ও তুচ্চির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল কালিদাসের। তাঁর লেখনি থেকে উদ্ধৃত করে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় পলাশ দত্ত জানিয়েছেন, "ইতালি থেকে আমার নতুন বন্ধু প্রফেসর ফর্মিচি ও ড. তুচ্চি আমাকে নিয়মিত লিখতে শুরু করলেন। আর ভারতের আদর্শ ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া এই দুই ইউরোপীয় পণ্ডিতের কাজে নিজেকে কিছুটা লাগানো যায় কি না সে বিষয়ে আমি সচেষ্ট ছিলাম।" [৬] ১৯২৪ সালে এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে চীন ও জাপান ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সফরে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন কালিদাস নাগ। সেইসময়েও ফর্মিকির সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল তাঁর, রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যতের ইতালি সফর নিয়ে। এই বিষয়ে ফর্মিকি 'India e Indiani' বইতে জানিয়েছিলেন, "নাগের সঙ্গে আমি উষ্ণ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম। বক্তৃতা দেয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফরের পরিকল্পনাটা তাঁর মাধ্যমেই প্রথম আসে। কবি ভারতে ফিরলেই তাঁর ইতালি-সফরের বিষযটি নিয়ে যথাউদ্যোগ নেবে বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কবির স্নেহধন্য নাগ।" [৭] ওই সফর চলতে চলতেই ওই বছরের ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনা সফরের আমন্ত্রণ পেলেন রবীন্দ্রনাথ, যা ফর্মিকিকে জানালেন কালিদাস নাগ। জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, কালিদাস নাগ জাপান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় পথে সুয়ামারু জাহাজ থেকে ফর্মিকিকে জানান, "দক্ষিণ আমেরিকা আমন্ত্রণ পেয়ে যাত্রাপথে অাগামী অক্টোবর মাসে রবীন্দ্রনাথ স্পেন ও ইতালিতে যেতে পারেন, তাঁরও যাত্রাসঙ্গী হওয়ার কথা।" [৮]

সম্ভাব্য ইতালি সফর নিয়ে ফর্মিকির সঙ্গে কালিদাসের চিঠি চালাচালি বৃথা যায়নি। এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ইতালি সফর করতে সম্মত হন। এবং সেই সফর হবে ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনা সফর থেকে ফেরার পথে। উৎসাহিত ফর্মিকি ইতালির শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক-বন্ধু উবার্তো পেস্টালোজ্জার কাছে আবেদন করেন রবীন্দ্রনাথের জন্য যাতে সরকারি আমন্ত্রণ পাঠানো যায়। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও মিলানের এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক গুইডো ক্যাগনোলা স্পনসরশিপের জন্য তৈরি হয়ে যান। তাঁদের আহ্বানে সম্মতি জানিয়ে ২০শে আগস্ট ১৯২৪ রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম করেন, "Shall visit Italy on my way back from South America next winter - Tagore." [৯] এই প্রসঙ্গে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ারসে স্থিতিকালীন রবীন্দ্রনাথ ২২শে ডিসেম্বর ১৯২৪এর একটি চিঠিতে এ্যানড্রুজকে লিখেছিলেন, "I know that in Italy I shall have a welcome ; for from various sourses I have heard that the people there are eagerly expecting me, and that my book are very widely read." [১০] জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ইতালি সম্বন্ধে কবির এই উদ্ভাসিত ধারণার উৎস তিনি জানেন না। তবে যতদূর মনে হয়, সম্ভবত কবির মনে এই রকমের কৃত্রিম ধারণার সৃষ্টি করিয়েছিলেন ওই ফর্মিকি, বন্ধু কালিদাস নাগের মাধ্যমেই।


(দুই)

১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাস। ইতালি তখন এক ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের কেন্দ্রস্থল। অবশ্য এই পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটা বছর পিছিয়ে যেতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর লীগ অব নেশনস গঠিত হয় তৎকালীন বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্রনায়কদের নেতৃত্বে। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বশান্তি রক্ষা করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল ভার্সাই চুক্তির (২৮শে আগস্ট, ১৯১৯) মাধ্যমে বনেদি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির হাত থেকে অনেক উপনিবেশ কেড়ে নিয়ে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল। ফলে দুনিয়া জুড়েই বিশেষতঃ ইউরোপে রাজনৈতিক শক্তির একটি ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হল এবং প্যারিস শান্তি সম্মেলনে সম্পাদিত চুক্তিগুলির দ্বারা আদৌ স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সর্বনাশা পরিণাম যথা লোকক্ষয়, সম্পত্তিবিনাশ, শিল্পের ধ্বংস, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি, বেকারত্ব প্রভৃতি ইউরোপের নানা দেশে সমস্যা তীব্রতর করে তুলল। ফলে অবধাতিতববাবে ওই সব দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উদ্ভব হচ্ছিল। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি বিশেষতঃ ইতালি ও জার্মানিতে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছিল। ইতালিতে এই শক্তির যারা উৎস তাদেরকে বলা হত ফ্যাসিস্ট এবং তাদের অনুসৃত নীতি হল ফ্যাসিবাদ। ল্যাটিন শব্দ 'ফাসেস' (Fasces) এবং ইতালীয় শব্দ 'ফ্যাসিও' (Fascio) থেকে উদ্ভূত হয়েছে 'ফ্যাসিসমো' (Fascismo)। এরই ইংরেজী প্রতিশব্দ হল ফ্যাসিজম (Fascism) যা বাংলায় ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত। ফ্যাসিও শব্দের অর্থ হল 'কাষ্ঠ খণ্ডের বান্ডিল' মতান্তরে 'গোছা বাঁধা' বা 'আঁটি'। প্রাচীন কালে রোমান সেনাদের প্রতীক ছিল একটি কুঠারের সঙ্গে আঁটি বাঁধা একগুচ্ছ দণ্ড, একে বলা হল ফ্যাসিও - এই ফ্যাসিও থেকেই ফ্যাসি শব্দের উৎপত্তি। ইতালীর প্রখ্যাত ফ্যাসিবিরোধী প্রবক্তা ও ঐতিহাসিক বেনেদেত্তো ক্রোচের (Benedetto Croce) মতে "Fascism was a ragbag collection of ideas, a sterile reaching towards a culture without basis." [১১] যার বঙ্গানুবাদ - ফ্যাসিবাদ হল খণ্ড খণ্ড ভাবধারার সমষ্টি ও একটি ভিত্তিহীন সংস্কৃতির দিকে পৌঁছানোর বন্ধ্যা মানসিক প্রয়াসমাত্র।

একটা কথা এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন, ইতালিতে ফ্যাসিবাদের প্রবর্তক বেনিতো মুসোলিনি, এই কথাই সকলের জানা। ১৯১৯ সালে মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট পার্টির ভিত্তি স্থাপন করলেও ফ্যাসিবাদের জনক কিন্তু তিনি নন ; এর আবিষ্কর্তা হলেন ভিলফ্রেদো পারেতো। এই পারেতো ছিলেন দার্শনিক ফেডারিক নীৎসে ও নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লির অনুরাগী। তিনি মনে করতেন, সমাজ পরিচালনার ভার এই নায়কদের হাতেই থাকা উচিত। আর এজন্য জনতার মত প্রকাশ, চিন্তা করা, কোনো কিছু করার স্বাধীনতা না থাকাই সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনতার কাজ হবে শুধু নায়কের অনুগামী হওয়া। প্রফেসর অয়েলসোয়ার্থ ফাবিশের কথায়, "পারেতো সদাচারের নামকেও সাদা চোখে দেখতে পারতেন না। সত্য, ন্যায়, জনমত তার কাছে ছিল ঘৃণার বস্তু।" [১২] বেনিতো মুসোলিনি ছিলেন এই পারেতোর অন্যতম আদর্শগত ছাত্র। পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞাকে আরও তীক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে। সুস্নাত দাশ তাঁর 'ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা' গ্রন্থে জানিয়েছেন, ১৯৩৫ সালে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে পেশ করা সুবিখ্যাত 'যুক্তফ্রন্ট থিসিস'-এ জর্জ ডিমিট্রভ লিখেছিলেন, "ফ্যাসিবাদ হল লগ্নীপুঁজিরই শক্তি। এ হল শ্রমিকশ্রেণী, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবী অংশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী প্রতিহিংসার সংগঠন। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ হল জাতিদম্ভের নগ্নরূপ যা অপরাপর জাতির বিরুদ্ধে পাশবিক ঘৃণার প্ররোচনা দেয়। ... ফ্যাসিবাদের ক্ষমতালাভ এক বুর্জোয়া সরকার থেকে অপর এক সরকারে মামুলি উত্তরণ মাত্র নয়, এ হল বুর্জোয়াদের শ্রেণী কতৃত্বের একটি রাষ্ট্রীয় রূপ। ... ফ্যাসিবাদ অনেক ক্ষেত্রে জনগণকে আকর্ষিত করতে সমর্থ হয়। কারণ, জনগণের সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন ও দাবীগুলির কাছে সে মহা বাগাড়ম্বরে আবেদন করে। ... ফ্যাসিবাদ চরম সন্ত্রাসবাদীদের স্বার্থেই কাজ করে, কিন্তু জনগণের কাছে নিজেকে নির্যাতিত জাতিগুলির রক্ষকের ছদ্মবেশে উপস্থিত করে ... ফ্যাসিবাদ যে-কোনো মুখোশই ধারণ করুক, যে-কোনো রূপেই নিজেকে উপস্থাপিত করুক এবং যে-কোনো পথেই ক্ষমতায় আসুক, তবুও ফ্যাসিবাদ হল শ্রমিকশ্রেণীর এবং সমস্ত মেহনতী মানুষের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু।" [১৩]

যাইহোক, যা বলছিলাম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি মিত্রপক্ষে যোগদান করলেও প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আশানুরূপ সুযোগসুবিধা তারা পায় নি। যুদ্ধে ইতালির ছয় লক্ষ সেনা মারা গিয়েছিল অথচ ইতালির আলবেনিয়া উপনিবেশটি কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরে ইতালিতে প্রবল অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হল এবং সর্বস্তরে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই হয়ে উঠল বৈপ্লবিক এবং অগ্নিগর্ভ। চরম মূদ্রাস্ফীতি ঘটল, বেকার সমস্যা তুঙ্গে পৌঁছালো। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় ঘটে গেছে বলশেভিক বিপ্লব। ইতালিতেও ক্রমেই কম্যুনিস্ট এবং সোস্যালিষ্টদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। এই সময় বেশ কিছু সংখ্যক ছাঁটাই সৈনিক ও সমাজের লুপ্নেন শ্রেণীর কিছু মানুষকে নিয়ে মুসোলিনি তাঁর ফ্যাসিস্ট দলটি (Fasci-di Combattimenti) প্রতিষ্ঠা করলেন। কম্যুনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিকরা কলকারখানায় ধর্মঘট ও বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী ও সংগঠিত করে তুলছিল। শিল্পক্ষেত্রে, ডাক, রেল ও পরিবহন ব্যবস্থায় ধর্মঘট দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে উঠল। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর ইতালিতে এক ব্যাপক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হল। ৬০০ কারখানার মোট ৫ লক্ষ শ্রমিক এতে যোগ দিয়েছিল। এই সময়ে শ্রমিকশ্রেণীর একাধিপত্যে গভর্নমেন্ট এবং মালিকপক্ষ, উভয়ই অসহায় হয়ে পড়েছিল। এমনকি সৈন্যবাহিনীকেও বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না, অর্থাৎ বিপ্লবী দলগুলি দ্বারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের একান্ত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। "কিন্তু সেই সন্ধিক্ষণে সোসিয়েলিস্ট পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন সঙ্ঘগুলি কেবলমাত্র 'অর্থনৈতিক সমস্যার' উপর জোর দিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের প্রশ্ন উপেক্ষা করলেন - গভর্নমেন্ট দখল ও গঠনের পক্ষে যাহা ছিল অপরিহার্য। ... এভাবে শাসকবর্গ ও মালিকশ্রেণীর সহিত আপোষের দ্বারা গণবিপ্লবের আরম্ভকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হইল।" [১৪] বৈপ্লবিক শ্রমিক সংহতি এইভাবে আপোষ-রফার দ্বারা ভেঙে পড়বার পর মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করতে লাগল। তারা পরিপোষন পেল পুঁজিপতি, জমিদার ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীসমূহ দ্বারা। কিন্তু এর পরেও ১৯২১ সালের সাধারণ নির্বাচনে দেখা গেল সোস্যালিষ্টরা ১২২টি এবং কম্যুনিস্টরা ১১৬টি আসন দখল করেছে, যেখানে ফ্যাসিস্ট পার্টি পেয়েছে মাত্র ৩৫টি আসন। স্পষ্টতই, সমাজতন্ত্রীরা দলে অনেক ভারি থাকলেও দুর্বল নেতৃত্ব এবং আপোষপন্থী মনোভাবের ফলে তাঁরা পুনরায় সুযোগ নষ্ট করলেন। ১৯২২ সালের জুলাই মাসে টুরাটির নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরা এক কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করতে চাইল কিন্তু শর্তে বনিবনা হল না। তখন তারা জেনারেল স্ট্রাইক ডেকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইল। কিন্তু উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাবে তা ব্যর্থ হল। উপরন্তু  ফ্যাসিস্টরা তাদের শ্রমিক-মজুর বিরোধী হিংসাত্মক অভিযানের সুযোগ পেয়ে গেল। ইতালির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অসচেতন কম্যুনিস্টরা উঠতি ফ্যাসিবাদের দিক থেকে যে কোনো বিপদ আসতে পারে তা ভাবতেও পারলেন না। কাশীকান্ত মৈত্র তাঁর গ্রন্থে লিখেছে, তাঁরা মনে করতেন, "সোস্যাল ডেমোক্রাটদের প্রভাব নির্মূল করার জন্য সাময়িকভাবে ফ্যাসিবাদের মতো দক্ষিণপন্থী 'শ্বেত প্রতিক্রিয়া'র প্রয়োজনীয়তা আছে।" [১৫] মন্তব্যটি চরম বিতর্কিত এবং সকলে সহমত নাও হতে পারেন তবে এক বছরের মধ্যেই শ্বেত প্রতিক্রিয়া কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন পরস্পর বিবাদমান সোস্যালিষ্ট ও কম্যুনিস্টরা।

যাইহোক একের পর এক মন্ত্রীসভার পতন ঘটায় ক্রমেই গণতন্ত্রে জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছিল। প্রথমে অরল্যান্ডো, তারপর নিত্তি, গিওলিট্টি, এরপর বোনোমি - কেউই উইকেটে টিঁকে থাকতে পারলেন না। পার্লামেন্ট যেন উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ! সোস্যালিষ্ট ও কম্যুনিস্টদের নেতিবাচক রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ এই পরিস্থিতিতে মুসোলিনির নেতৃত্বেই দেশের সমস্যা সমাধান হতে পারে এই আস্থা রেখে ইতালির হাজার হাজার মানুষ ও মহাযুদ্ধ প্রত্যাগত সৈনিকরা তার দলে যোগদান করল। এই দলের সদস্যদের পরনে থাকত কালো শার্ট তাই এরা ব্ল্যাকসার্ট নামেও পরিচিত হল।

ফ্যাসিস্টদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ পর্ব শুরু হল অক্টোবর মাসে, যাতে রাজা, মন্ত্রীসভা, সেনানায়করা সকলেই জড়িত ছিলেন। ২৮শে অক্টোবর মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে 'মার্চ অন রোম' বা রোম অভিযানের আয়োজন করলেন। তিন লক্ষ সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক রোম নগরী অবরোধ করল। লুইগি ফ্যাকটার মন্ত্রীসভা নাম কে ওয়াস্তে এক সামরিক আইন জারি করল এবং সরকারি ভবন, ডাক ও তার বিভাগ, রেলওয়ে ইত্যাদি বিনা বিরোধতায় দখল করতে দেওয়া হল। রাজা ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে রোম নগরী রক্ষা করা সম্ভব নয় এই ঘোষণা করে মুসোলিনীকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানালেন। ১৯২২ সালের ৩১শে অক্টোবর ইতালির রাজা ভিক্টর তৃতীয় ইমান্যুয়েল বেনিতো মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রীপদে নিয়োগ করলেন।

ক্ষমতা দখল করে মুসোলিনি ভয় ও হুমকি দেখিয়ে এবং বাগ্মীতার জোরে পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে দেশশাসনের একছত্র ক্ষমতা আদায় করে নিলেন। ব্ল্যাকশার্ট বাহিনীকে সরকারি সংস্থায় রূপান্তরিত করবার প্রচেষ্টা হল। সংবাদপত্রের অধিকার বা রাজনৈতিক বিরোধিতার অধিকার সব কাগজে কলমেই রয়ে গেল। গোটা ১৯২৩-২৪ সাল ধরে ইতালিতে হিংসার তাণ্ডব চলল। ১৯২৪ সালের ১০ই জুন সোস্যালিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাত্তিয়োত্তি (Giacomo Matteotti) সংসদে মুসোলিনিকে চ্যালেঞ্জ করবার পরপরই নৃশংসভাবে খুন হলেন। সোস্যালিষ্টরা প্রতিবাদে পার্লামেন্ট বয়কট করল। অবশ্য তার আগেই ১৯২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক গুন্ডামি ও জুলুমবাজি করে ফ্যাসিস্ট দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে গিয়েছে। এই সুযোগে তিনি বিপুল সংখ্যক সোস্যালিষ্টদের সদস্যপদ খারিজ করে দিয়ে সেনেটের সভায় সদম্ভে ঘোষণা করলেন - "Who could have stopped me from proclaiming an open dictatorship? Who could have resisted a movement that represented not just 300000 party ticket holders but 300000 rifles?" [১৬]

এইভাবে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অমানবিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শরূপে ফ্যাসিবাদের আত্মপ্রকাশ সমস্ত মানব সভ্যতার এক করাল বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করল। সুস্নাত দাশ লিখেছেন, "সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হল, যে ইউরোপ ছিল সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা, উদারনৈতিকতা ও সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের ধারক ও বাহক, সেই ইউরোপই হয়ে উঠল এই নিকৃষ্ট মতাদর্শের সূতিকাগার।" [১৭] তবে পরবর্তীকালে দেখা যায়, মুসোলিনি-সৃষ্ট ইতালির ফ্যাসিবাদ ছিল নিকৃষ্ট ভাবাদর্শের হিমশৈলের চুড়া মাত্র, জার্মানিতে হিটলারকৃত নাৎসিবাদ ছিল মুসোলিনির স্বৈরাচার অপেক্ষাও ভয়াল।

ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই দ্বিতীয়বারের জন্য ইতালিতে পদার্পণ করলেন রবীন্দ্রনাথ।


(তিন)

ইতালির এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনা থেকে ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি স্পেনের বার্সিলোনা ঘুরে ইতালির জেনোয়া বন্দরে অবতরণ করলেন। রবীন্দ্রনাথের আসন্ন ইতালি ভ্রমণের সংবাদে বিভিন্ন শহরের অভ্যর্থনা সমিতিগুলির মধ্য ব্যস্ততা ছিল লক্ষণীয় - কে তাঁকে আগে নিয়ে যেতে পারবে, তার লাগি ছিল কাড়াকাড়ি - কিন্তু তিনি কোনও পরিচয় না দিয়ে প্রায় নিঃশব্দেই জেনোয়াতে নেমেছিলেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমস্ত শহরে তুমুল শোরগোল পড়ে গেল, খবরের কাগজগুলিতেও। ফর্মিকির ভাষায়, "আমি তো ভাবতেই পারতাম না, জেনোয়ার মতো শহর, যেখানে খালি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাধান্য, সেখানে কবিত্ব এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে।" [১৮] কবির এই জেনোয়া-পদাপর্ণ অবশ্য ইংরেজি ভাষার গণমাধ্যমেরও নজর এড়ায়নি। আমরা দেখবো, তিনি জেনোয়ায় পা রাখার একদিন পরই এ খবর প্রকাশ হচ্ছে ইংল্যান্ডের 'দ্য টাইমস' পত্রিকায় - "স্যার রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জেনোয়ায় পৌঁছেছেন এবং তিনি টানা কয়েকটি বক্তৃতা দেবেন যার প্রথমটি হবে মিলানে আগামীকাল রাতে।" [১৯]

ফ্যাসিবাদি মুসোলিনি ইতালির ক্ষমতা দখল করবার সপ্তাহখানেকের মাথায় ইতালিতে হাজির হওয়া রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কতটুকু বা জানতেন? বলতে গেলে, প্রায় কিছুই নয়। বিশেষতঃ তখনও ফ্যাসিবাদের আসল স্বরূপ তেমনভাবে প্রকাশ পায় নি, নিদেনপক্ষে সুদূর ভারতে তো নয়ই। রবীন্দ্রনাথের কাছে ইতালি, তখনও পর্যন্ত দান্তে-ভিঞ্চি-এঞ্জেলো-রাফায়েলের ইতালি, ইউরোপের রেনেসাঁসের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের স্বপ্নের ইতালি হয়েই ছিল। আর তাঁর এই না-জানার বিষয়টি অনুভব করতে পেরেছিলেন কার্লো ফর্মিকি। ২১শে জানুয়ারি, ১৯২৫ জেনোয়া থেকে ট্রেনে মিলানে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ফর্মিকির কাছে ইতালির তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। ফর্মিকি বলেন, প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইতালিতে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে বেনিতো মুসোলিনি এক রক্তপাতহীন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন এবং তাঁর দল ক্ষমতা দখল করে জনসাধারণের সহায়তায় দেশে শান্তি ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনে। "One should feel the anguish of an impending anarchy in order to fully realize the Italian people's gratitude to Fascism, and the necessity to perdon the inevitable use of violence involved in bridling a bolting horse." [২০] রবি-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, ফর্মিকির এই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্টভাবেই অনুমান করা যায়, তিনি যদি সরাসরিভাবে ফ্যাসিস্ট দলভুক্ত না-ও হন, নিদেনপক্ষে মুসোলিনির কার্যকলাপের সমর্থক ছিলেন।

পরের দিন ২২শে জানুয়ারি সকালে মিলানের হোটেলে এন. গুইডো কাগনোলা, প্রোফেসর বালিনি, ডঃ আলবার্তো পোগ্গি, প্রফেসর ফর্মিকি ইত্যাদি এবং স্থানীয় অভ্যর্থনা সমিতির সদস্যদের উপস্থিতিতে বিশ্বভারতীকে সাহায্যদানের বিষয়ে আলোচনা হয়। স্থির হয়, শান্তিনিকেতনে দুই বছরের জন্য ইতালীয় সাহিত্য পড়াবার একজন অধ্যাপক পাঠানো হবে এবং শান্তিনিকেতন লাইব্রেরির জন্য শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের গ্রন্থ পাঠানো হবে। ভারতীয় ছাত্রদের ইতালিতে পড়তে আসা এবং ইতালীয় ছাত্রদের বিশ্বভারতীতে পড়াশোনার সুবিধা করে দেওয়ারও ব্যবস্থা নেওয়ারও পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ওই আলোচনায় উপস্থিত থাকা এডিটর মোন্দাদোরি রবীন্দ্রনাথের একাধিক গ্রন্থের ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ প্রকাশের দায়িত্ব নিতে চান।

২২শে জানুয়ারি বিকালে রবীন্দ্রনাথ মিলানের এ্যাসোসিয়েশন হলে (Circolo Filologico Milanese) একটি বক্তৃতা দিলেন যাতে তিনি কিন্তু  ইতালির ফ্যাসিজমের সমর্থকদের প্রত্যাশার হিসেবে একটু বেসুরে গেয়ে ফেলেন। ওই বক্তৃতার শেষ অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "I have come to your door seeking the voice of humanity, which must sound its solemn challenge and overcome the clamour of the greedy crowd of slave-drivers. Perhaps it is already being uttered in whispers brhind closed doors, and will grow in volume till it bursts forth in a thundering cry if judgement, and the vulgar shout of brute force is silenced in awe." [২১] বক্তৃতাটি পরে 'The voice of humanity' নামে বিশ্বভারতী পত্রিকায় ছাপা হয় এবং এর বঙ্গানুবাদ 'মনুষ্যত্বের জাগরণ' নামে প্রবাসী-র শ্রাবণ ১৩৩২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বিশেষ অংশটির অনুবাদ প্রবাসী থেকে উদ্ধৃত করছি। "আমি আপনাদের দ্বারে মনুষ্যত্বের উষোদয়ের সন্ধানে আসিয়াছি। উদাত্ত আহ্বানে তাহা জাগিয়া উঠিবেই এবং দাস-শাসনকারী লোভমত্ত জনতার চিৎকারকে তাহা ডুবাইয়া দিবেই, হয়ত সে আহ্বান এখন বন্ধ দ্বারের মধ্যে অনুচ্চ স্বরে উচ্চারিত হইতেছে এবং অবশেষে তাহা ন্যায়ের বজ্রনির্ঘোষে বাজিয়া উঠিবে, সঙ্গে-সঙ্গে পাশবিক শক্তির ক্ষুদ্রতাপূর্ণ চিৎকার ভয়ে অবলুপ্ত হইয়া যাইবে।" [২২] ইতালির তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় ফর্মিকি বেশ বিব্রত বোধ করেছিলেন। গোঁড়া ফ্যাসিস্ট মতাদর্শীরা সমালোচনায় ফেটে পড়েন। ফর্মিকির ভাষায় "The enthuistic approval which had surrounded the poet in the beginning was replaced by harsh criticism, angry debates and the stirring up of suspicion and hate." [২৩] একটি কাগজে বিদ্রুপ করে বলা হল, "রবীন্দ্রনাথের শ্মশ্রুগুম্ফ মুন্ডন করা হলে স্যামসনের মতো তাঁর সমস্ত ক্ষমতা লোপ পাবে। [২৪] তবে সাধারণ ইতালিবাসীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদী আদর্শে বেঁধে ফেলা যে আদৌ সহজ কাজ নয়, তা মিলানবাসী আবার টের পেল ঠিক দুদিন পর, ২৪শে জানুয়ারি। এইদিন রবীন্দ্রনাথ ইতালির থেকে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে 'ইটালিয়া' নামে একটি কবিতা লিখলেন। কবিতাটি পরবর্তীকালে 'পুরবী' কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদ করে ফর্মিকির হাতে তুলে দেন, ফর্মিকি সেটি আবার ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। পরের দিন 'To Italia' ওখানকার সমস্ত লিডিং সংবাদপত্রে ছাপা হল। কবিতাটি হল,
"কহিলাম, ‘ওগো রানী,
কত কবি এল চরণে তোমার উপহার দিল আনি।
               এসেছি শুনিয়া তাই,
উষার দুয়ারে পাখির মতন গান গেয়ে চলে যাই।’
         শুনিয়া দাঁড়ালে তব বাতায়ন - ’পরে
         ঘোমটা আড়ালে কহিলে করুণ স্বরে,
                 ‘এখন শীতের দিন
কুয়াশায় ঢাকা আকাশ আমার, কানন কুসুমহীন।’
                   কহিলাম, ‘ওগো রানী,
      সাগরপারের নিকুঞ্জ হতে এনেছি বাঁশরিখানি।
            উতারো ঘোমটা তব,
বারেক তোমার কালো নয়নের আলোখানি দেখে লব।’
         কহিলে, ‘আমার হয় নি রঙিন সাজ,
       হে অধীর কবি, ফিরে যাও তুমি আজ।
              মধুর ফাগুন মাসে
      কুসুম-আসনে বসিব যখন ডেকে লব মোর পাশে।’
           কহিলাম, ‘ওগো রানী,
      সফল হয়েছে যাত্রা আমার শুনেছি আশার বাণী।
             বসন্তসমীরণে
   তব আহ্বানমন্ত্র ফুটিবে কুসুমে আমার বনে।
              মধুপমুখর গন্ধমাতাল দিনে
           ওই জানালার পথখানি লব চিনে,
                আসিবে সে সুসময়।
আজিকে বিদায় নেবার বেলায় গাহিব তোমার জয়।" [২৫]

'ইটালিয়া' পাঠ করে ইতালির ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা এবং জনগন উল্লসিত হয়ে ওঠণ কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল, আসন্ন বসন্তকালীন নির্বাচনে কবি ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফর্মিকির ভাষায়, "Some other saw in Tagore's verses, purely and simply idilliac though they were, a malignant reference to the elections which were then supposed to be held in the spring, which the parties opposed to Fascism hoped would be unfavourable to the Government." [২৬] যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনোকালেই এই ব্যাপারে কোনও রা কাড়েন নি। আর ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের জন্য ইতালিবাসীদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও প্রায় কুড়িটি বসন্ত।

এইখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এবার রবীন্দ্রনাথ যেহেতু রোম সফর করেননি, সেইজন্য ১৯২৫ সালের সফরে মুসোলিনির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তবে রবীন্দ্রনাথের মিলানে অবস্থান সম্পর্কে মুসোলিনি নিঃসন্দেহে অবহিত ছিলেন।

ইতালিতে রবীন্দ্রনাথ থাকলেন ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আরও থাকবার কথা ছিল কিন্তু ২৪শে জানুয়ারি থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণে কবি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ডাক্তার তাঁকে ভ্রমণ স্থগিত রাখতে উপদেশ দেন। আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনে ইতালীয় জনতা তাঁকে বেশ পছন্দ করলেও সরকারি মহল কবির ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনও উৎসাহ দেখায় নি। জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, "মিলানের বক্তৃতায় শান্তিবাদ, আন্তর্জাতিকতা, য়ুরোপীয় রাজনীতির, বিশেষত বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে কবির স্পষ্ট নিন্দাবাদ - ইতালির তৎকালীন জবরদস্ত ফ্যাসিস্ত সরকারের মুলগত শাসননীতির বিরোধী। সুতরাং সরকারপক্ষ হইতে কবি অভিনন্দিত হইলেন না। ... আমেরিকার নেশন পত্রিকার একজন সাংবাদিক ইঙ্গিত করিয়া বলেন যে রবীন্দ্রনাথের তাড়াতাড়ি ইতালি ত্যাগের অন্যতম কারণ - ফ্যাসিস্ত সরকার তাঁহার মতামত পছন্দ করেন নাই।" [২৭] তবে অন্য জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল কিন্তু এই থিয়োরীর সঙ্গে সহমত হন নি। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের এই সফরের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের কোনও যোগ ছিল না, তাঁর কিছু বক্তব্য ফ্যাসিস্ট সংবাদপত্রে সমালোচিত হলেও সরকার তাঁর কথাবার্তা বা চলাচলের উপর কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করে নি। তাই এই বিতর্কটি নিতান্তই অকারণ। আপাতদৃষ্টিতে সেইরকম মনে হলেও পরবর্তীকালে বোঝা যায়, এই পুরো ব্যাপারটা অর্থাৎ বিশ্বভারতীকে সাহায্য অথবা রবীন্দ্রনাথের বইয়ের প্রচারের প্রলোভন ইত্যাদির পিছনে একটি বিরাট বড় রাজনৈতিক পরিকল্পনা কাজ করছিল। এই প্রসঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারী এলমহার্স্টের একটি মন্তব্য অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ১৯৬২-৬৩ সালে প্রকাশিত বিশ্বভারতী কোয়ার্টালির ২৮ তম খণ্ডে 'Rabindranath Tagore and II Duca Gallarati Scotti An Interview in Milan' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ এবং তিনি ইতালিতে পৌঁছানোর পরেই "... were met by an official delegation from the Italian Government, then in the hands of a Facist Dictatorship. The plan of this delegation was apparently to make the maximum of capital for Facist State out of Tagore's visit, by the customary manipulation of press interviews and the mis-reporting of speeches and discussions ... as soon as we reached Milan, Tagore began to feel that he was not going to be allowed to have his own by the government's emissaries and his heart began to react, as os often did, against any kind of undue pressure. Fortunately for us II Duca Gallarati Scotti, ... came to our rescue. He brought in skilled physicians who recommended exactly that course that Tagore must wished to follow, and an immediate return to India ... without further public meeting." [২৮] এলমহার্স্টের কথা যদি সত্য বলে মেনে নিতে হয় তাহলে এটি স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতা, চিকিৎসকের পরামর্শে সফর স্থগিত করে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে আসা এবং দেশে ফেরবার অব্যবহিত পরেই ইতালির আতিথেয়তার প্রশংসা করে পুনরায় ইতালি ভ্রমণের ইচ্ছাপ্রকাশ - এ সবই রবীন্দ্রনাথের নাটক ! জীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, ঘটনার প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এলমহার্স্ট সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী ইতালি সফর অর্থাৎ ১৯২৬ সালের সফরের ঘটনার প্রক্ষেপ ঘটিয়েছেন ১৯২৫ সালের সফরের বিবরণে, কারণ উভয়ক্ষেত্রেই তিনি রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী ছিলেন। কে জানে, হয়তো হতেও পারে তা।


(চার)

ইতালি ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ ইতালীয় ভারত-তত্ত্ববিদ কার্লো ফর্মিকিকে অনুরোধ করেছিলেন বিশ্বভারতীতে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য। ফর্মিকির সম্মতি পাওয়ার পর সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে কালিদাস নাগ তাঁকে অনুরোধ করেন তাঁর সঙ্গে একজন ইতালিয়ান ভাষাশিক্ষক অধ্যাপক এবং শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক কিছু বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে আসতে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং সেই সূত্রে কবি বিদেশ ভ্রমণকালে প্রায় প্রতিটি দেশেই এই কাজের সহযোগিতার জন্য আবেদন করেছেন। কাজেই ইতালির ক্ষেত্রে এই অনুরোধের কোনও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল না। "তবে ইতালির সহিত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কবিমনের একটি আগ্রহ ছিল এবং তাহা প্রাচীন ইতালির মহান সভ্যতা ও ঐতিহ্যের কথাই স্মরণ করিয়া।" [২৯]

বিশ্বভারতীতে নিযুক্ত হওয়ার জন্য দাপ্তরিক নিয়োগপত্র বা সরকারী আহ্বান অধ্যাপক ফর্মিকি পেলেন ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে। কিন্তু প্রস্তাবিত বিনিময় কর্মসূচিতে একজন ইতালীয় শিক্ষক এবং বইপত্রের সংস্থান সংস্থান তিনি কিছুতেই করে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত কোনও বিকল্পের সন্ধান না পেয়ে এবং প্রায় মরিয়া হয়েই ফর্মিকি সবকিছু ব্যাখ্যা করে ও সাহায্য চেয়ে মুসোলিনির কাছে চিঠি লিখলেন। পরিস্থিতিটা এবং ফর্মিকির মনের অবস্থাটি চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন কল্যাণ কুণ্ডু - "He was both delighted and apprehensive as he was unable to source funding for an Italian scholar for the proposed exchange programme. Furthermore, he was unable to purchase the Italian books he promised Tagore. The situation was a little embarrassing for Formichi as he was aware that other European visiting professors who preceded him donated substantial amounts of resources to Tagore’s University. Being desperate for funds and finding no other alternatives he ultimately wrote a letter directly to Mussolini explaining everything and requesting support." [৩০]

এই ঘটনার আগে পর্যন্ত মুসোলিনির কাছে ভারতসংক্রান্ত বিষয়ে কোনও উৎসাহ ছিল বলে আমরা দেখি নি। বিশ্বভারতীর প্রসঙ্গে ফর্মিকি মুসোলিনির শরণাপন্ন হলে, সম্ভবত তাঁর মনে একটি পরিকল্পনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। মুসোলিনি, রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীর ব্যাপারে রীতিমতো আগ্রহী হয়ে উঠলেন। বোধহয় তিনি মনে করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ এবং যিনি বিশ্বশান্তি ও স্বাধীনতার প্রবক্তা, তথা বিশ্বমানবতার প্রতীক ; তিনি যদি তাঁর এবং তাঁর ফ্যাসিস্ট দলের শাসন সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক মন্তব্য করেন, তা নিঃসন্দেহে বাইরের বিশ্বে অত্যন্ত সমাদৃত হবে।

অতএব মুসোলিনি অনেক ভেবে চিন্তেই তাঁর পাশার দান ফেললেন। তিনি সরকারি খরচে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ গিউসিপ্পি তুচ্চি-কে বিশ্বভারতীর জন্য মনোনীত করলেন এবং ফর্মিকিকে ইতালিয়ান চিত্রকলা ও সাহিত্য সংক্রান্ত অসংখ্য বই নিয়ে আসবার জন্য অনুমোদন দিলেন। তুচ্চি বহুভাষাবিদ, সংস্কৃত, চীনা এবং তিব্বতি ভাষায় বুৎপত্তি ছাড়াও ইনি ছিলেন বৌদ্ধ দর্শনে সুপণ্ডিত। জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে "ফর্মিকির এই আমন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মুসোলিনি ভারতের সহিত সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রথম সুযোগ গ্রহণ করলেন।" [৩১] স্পষ্টতই, এত বদান্যতার কারণ আর কিছুই নয়, রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ বক্তব্যের বিরুদ্ধতা ও সমালোচনা করেও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দল এবং তাঁর পেটোয়া বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই রবীন্দ্রনাথের নাম এবং প্রশংসাবাক্য ব্যবহারের সুযোগ নেওয়ার জন্যই বিশ্বভারতীর উদ্দেশ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

১৯২৫ সালের ২১শে নভেম্বর ফর্মিকি বোলপুরে এসে পৌঁছালেন। এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ - ফর্মিকি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে পা রেখেছিলেন তাঁর প্রভু মুসোলিনির একটি গোপন এ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করবার জন্যেই, যা হল রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিজমের প্রশস্তির কাজে ব্যবহার করা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অথবা তাঁর কাছে মানুষেরা কেউই এই প্রবঞ্চনা ধরতে পারেন নি। যদিও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বুঝতে পেরেছিলেন, "ঐ দুজন তথাকথিত 'ভারততত্ত্ববিদ' ইতালীয় অধ্যাপক ছিলেন মুসোলিনির একান্ত অনুগত ফ্যাসিবাদী বুদ্ধিজীবী, যারা কবিকে ইতালি ভ্রমণে প্ররোচিত করে তাঁর মুখ দিয়ে ফ্যাসিজম ও মুসোলিনির সমর্থনে প্রশংসাসূচক বিবৃতি আদায় করার জন্য ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার কতৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন।" [৩২] রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনার উত্তরে ফর্মিকি তাঁকে লেখা মুসোলিনির বার্তাটি পড়েন যাতে তিনি বলেছিলেন, "Illustrious Professor, while I express my lively satisfaction to you on account of the invitation you have received from the Visva-Bharati University, an institution which honours an Italian savant, the Italian science and the University of Rome. I am glad to entrust you with the charge of bringing in my name as a gift to that Institution which is the greatest centre of Indian culture, the books with the wish that this offering may always render more and more intense the cultural relations between Italy and the classical land of India, the cradle of the civilization of the world." [৩৩]
 

বক্তব্যটি ফর্মিকির নামে হলেও মুসোলিনি মুল উদ্দেশ্যটি এখানে পরিস্কার ফুটে উঠেছে, তা হল, বিশ্বভারতীর প্রশংসা করবার ছলে রবীন্দ্রনাথের তোষামোদ করা। সে যাইহোক, শান্তিনিকেতনের অতিথিশালায় ২২শে নভেম্বর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মসমিতির বৈঠকে মুসোলিনির চিঠিটি আবার পঠিত হয় এবং বিশ্বভারতীর তরফে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক তারবার্তা প্রেরণের প্রস্তাব নেওয়া হয়। মুসোলিনির এ অভাবনীয় অভিব্যক্তিতে রবীন্দ্রনাথ এতই অভিভূত হয়ে পড়েন যে তখনই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাকে টেলিগ্রাম পাঠালেন। সেই তারবার্তায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, "Allow me to convey to you our gratitude in the name of Visva-Bharati for sending us through Prof. Formichi your cordial appreciation of Indian civilization and deputing Prof. Tucci of the Univercity of Rome for acquainting our student with Italian History and Culture ... I assure you that such an expression of sympathy from you as the representative of the Italian people will open up a channel of communication for exchange of culture between your country and ours having every possibility of developing into an event of great historical significance." [৩৪]

মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর 'বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে জানিয়েছেন, তখন আমেরিকা প্রভৃতি ইংল্যান্ডের মিত্র দেশগুলির পত্রপত্রিকায় 'ভারতে ফ্যাসিজম' বা 'ভারতে ফ্যাসিজমে ইংরেজের সংকট' ইত্যাদি নামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। তার মধ্যে শান্তিনিকেতনে ইতালির প্রফেসরদ্বয়ের প্রতি ইঙ্গিতও থাকতো। এই প্রসঙ্গে ফর্মিকি ও তুচ্চির বিশ্বভারতীতে যোগদান উপলক্ষে বিলাতের পত্রিকা 'সানডে ক্রোনিকল' এর একটি খবর উল্লেখ করা যায়। 'ভারতে ফ্যাসিস্ট কর্মকেন্দ্র' শিরোনামে ওই পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যাতে লেখা হয়েছিল, "Fascism is taking a grip on India. The cause is Italian propaganda, the object of which is obscure, but the results of which are incalculable. Some month ago Sgr. Carlo Formichi, an Italian professor was sent, for some obscure reason, to study Indian philosophy at the Visvabharati Institute of Dr. Sir Rabindranath Tagore in Santiniketan of Bengal. During his stay he came into contact with the young Zemindars of Bengal in Calcutta and the Talukdars of U.P. in Benaras, both belonging to the aristocracy and landowning classes, and the result has been that Fascist centres are to be formed in those cities." [৩৫] নেপাল মজুমদারের মতে, ওই পত্রিকার সাংবাদিক নিঃসন্দেহে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন। ফর্মিকিকে শান্তিনিকেতন পাঠানোর বিষয়ে মুসোলিনির গূঢ় অভিসন্ধি থাকতেই পারে, কিন্তু ফর্মিকি বাংলা ও যুক্তপ্রদেশের (উত্তরপ্রদেশ) জমিদারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ভারতে ফ্যাসিস্ট কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছিলেন, এমন প্রচার করাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মৈত্রেয়ী দেবী - "ঐ সময়ে শক্তিশালী ইংরেজ ইতালির এই অভ্যুত্থান, ইউরোপের রাষ্ট্রমঞ্চে একজন সুদক্ষ নেতার আবির্ভাব সুচক্ষে দেখে নি। মুসোলিনিও ইংরেজের অনুরাগী ছিলেন না, চোখা চোখা সত্য-শাণিত বাক্যবাণে ভারতবর্ষের সঙ্গে ইংরেজের দুর্ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।" [৩৬] স্বভাবতই, অধিকাংশ ভারতবাসী সেই সময়ে ইতালি সম্বন্ধে সহানুভূতিশীল ছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে ইতালির ফ্যাসিবাদের স্বরূপ প্রকাশ করে দেওয়ার পরেও আমরা দেখেছি সুভাষচন্দ্রের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ইতালির সহায়তা নিতে।

অধ্যাপক কার্লো ফর্মিকি মাত্র তিন মাসের জন্য অতিথি অধ্যাপক হিসেবে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। ৩রা মার্চ, ১৯২৬ উত্তরায়ণে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। ১০ই মার্চ তিনি কলকাতা ত্যাগ করে স্বদেশযাত্রা করেন। তাঁর হাত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির উদ্দেশ্যে একটি দীর্ঘ চিঠি পাঠান কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, যাতে তিনি লিখেছিলেন, "On the eve of the departure of Professor Carlo Formichi, may I be allowed to send you through him our message of deep and cordial appreciation of what Italy has contributed to the growth of Visva-bharati." [৩৭]

এর কিছুদিন পরেই আরম্ভ হবে রবীন্দ্রনাথের তৃতীয়বার এবং সবচেয়ে বিতর্কিত ইতালি সফরের পালা।


(পাঁচ)

আগের সফরকালীন দেয় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পরের বছরই রবীন্দ্রনাথের ইতালিতে আর একটি সফর হওয়ার কথা ছিল। অধ্যাপক ফর্মিকি তার দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কবির পুনরায় ইতালি আসার ইচ্ছার কথা জানালেন এবং রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী ইতালি সফরের সব ব্যবস্থা পাকা করবার উদ্দেশ্যে ১৯২৬ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফর্মিকি ইতালি রওনা দিলেন। এবার মুসোলিনির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেল। সরকার এবার সরাসরি কবির দিকে আতিথ্যের হাত বাড়িয়ে দিল। ৬ই এপ্রিল রবীন্দ্রনাথের কাছে মুসোলিনির নিমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছালো।

ঠিক এই সময় ইতালির পরিস্থিতিটা আমরা একবার পর্যালোচনা করে নিই। ফ্যাসিবাদ তখন মধ্যগগনে। সংবাদপত্র, মুদ্রাযন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজনৈতিক সংগঠন, সরকার বিরোধী সমালোচনা - সব কঠোর হাতে অবদমিত হয়েছে। ধর্মঘট ও গণ আন্দোলন নিষিদ্ধ। মাসখানেক আগেই ব্ল্যাকশার্টদের হাতে খুন হয়ে গেছেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রখ্যাত লিবেরাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জিওভান্নি আমেন্দোলা (Giovanni Amendola) প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নিত্তি (Francesco Nitti) কোনোরকমে প্রাণ হাতে করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সোস্যালিষ্ট ও কম্যুনিস্টদের উপর শ্বেতসন্ত্রাস চলছে পূর্ণমাত্রায়। অবাধে চলছে ব্ল্যাকশার্ট বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, গুম, খুন-জখম। এককথায় সারা ইতালি জুড়ে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। 'ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে নেপাল মজুমদার লিখেছেন, "সমস্ত গণতান্ত্রিক জগতের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তখন ইতালির উপর। এহেন সময় রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বমৈত্রী ও বিশ্বশান্তির সাধকের ইতালি পরিদর্শনের সংবাদে গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীমহল সচকিত হইয়া ব্যাপারটি অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। ইউরোপের পত্র-পত্রিকায় এমনকি ভারতবর্ষেও 'অমৃতবাজার', 'পাইওনিয়ার' প্রভৃতি পত্রিকাগুলি এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করিল। প্রশ্ন থাকিয়া যায়, রবীন্দ্রনাথ কি ইতালির শাসন-ব্যবস্থা ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছুই জানিতেন না? ইউরোপের বিশেষত ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছুকাল হইতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা হইতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ উহার কিছু কিছু পাঠ করিয়া থাকিলেও ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকাগুলির সত্যনিষ্ঠা ও সাংবাদিক-সততা সম্পর্কে খুবই সন্দেহভাব পোষণ করিতেন।" [৩৮] কারণ এর আগে আমরা দেখেছি, ফর্মিকি ও তুচ্চির বিশ্বভারতীতে যোগদান উপলক্ষে ইংরেজ পত্রিকাগুলির অতিরঞ্জিত ও অাজগুবি খবরে কবিকে যথেষ্ট বিরক্ত ও অস্বস্তি বোধ করেছিলেন।

এইরকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে ইতালি যেতে দেখে এদেশের এবং পাশ্চাত্যের চিন্তাশীল এবং রবীন্দ্র-অনুরাগী ব্যক্তি-মাত্রই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না, কি করে মুসোলিনির উগ্র-জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবাদের মিলন সম্ভব। যাইহোক, ১৯২৬ সালের মে মাসের মাঝামাঝি রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় ইতালি সফর আরম্ভ হল। ১৫ই মে জাহাজে উঠে ৩০শে মে ইতালির নেপলস বন্দরে পৌঁছালেন। এবারের সঙ্গী অনেক - পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধু প্রতিমা ঠাকুর, ঘনিষ্ঠ সঙ্গী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, তাঁর জীবনসঙ্গিনী নির্মলা মহলানবিশ, শ্রীনিকেতনের সচিব প্রেমচাঁদ লাল, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষ এবং ত্রিপুরার রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মণ। ওই ৩০শে মে তারিখেই অমৃতবাজার পত্রিকা লিখল, "যদিও রবীন্দ্রনাথ ও মুসোলিনি ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি-অধিকার ব্যক্তিত্ববিকাশেরই সহায়ক মনে করেন, তথায় রবীন্দ্রনাথ কখনওই মুসোলিনির উগ্রপন্থাকে সমর্থন করিতে পারেন না।" [৩৯]

এইখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মুসোলিনির আহ্বানে কোথাও আদৌ সরকারি সফরের কথা উল্লেখ ছিল না। ফর্মিকিও ব্যাপারটা পুরো চেপে যান। সৌরীন্দ্র মিত্র জানিয়েছেন, "নেপলসে অবতরণ করে তিনি প্রথম জানলেন যে, আসলে তিনি ফ্যাসিস্ত সরকারের অতিথি। তখন অবশ্য আর পশ্চাদপসরণের পথ ছিল না।" [৪০] রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণকর্তা আসলে কে, সেই নিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি হয় কলকাতার পত্রপত্রিকায়। এইখানে কলকাতার 'মর্ডান রিভিউ' পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় পত্রিকার সম্পাদক কি লিখছেন, দেখা যাক। "১৯২৬ সালের মে মাসে বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ কবির পুনর্বার ইটালি গমনের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য ইটালি যাত্রার ব্যবস্থা করলেন। বিশ্বভারতীর কর্মসচিবদ্বয় দেখলেন ইটালীয় সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত অনুকুল। তাঁরা কবির ইটালি ভ্রমণের সর্বরকম সুবিধা করে দিতে প্রস্তুত। ... যখন জাহাজ নেপলস-এ পৌঁছল তখন মুসোলিনি কবিকে সরকারের আতিথ্য গ্রহণ করতে নিমন্ত্রণ করলেন। সে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা হল। স্পেশাল ট্রেনে করে কবিকে (ও কবির ভ্রমণ-সহচরদের) রোমে নিয়ে যাওয়া হল। ... বিশ্বভারতীর সচিবদের কাছ থেকে যে বিবরণ পাচ্ছি তাতে বোঝা যাচ্ছে যে ইটালীয় সরকার কবিকে রাজোচিত সংবর্ধনা জানিয়েছে। ... ভারতবর্ষ থেকে ইটালি অভিমুখে যাবার সময় কবি অবশ্য সরকারী আতিথ্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। বিশ্বভারতীর সচিবদ্বিগের প্রদত্ত বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে কবির মত পরিবর্তনের কারণ যাই হোক না কেন, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠানকে ইটালিতে পরিচয় করবার পক্ষে এ কাজ উপযুক্ত হয়েছে। ... কবি প্রতিশ্রুত ছিলেন বলেই ইটালি গিয়েছিলেন, ইটালীয়ান সরকারের কাছ থেকে তাঁর নিমন্ত্রণ হঠাৎও আসেনি বা পূর্বব্যবস্থামতও ঘটেনি, ঘটনাচক্রে স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। ... রবীন্দ্রনাথ যদি মনে করেন তাঁর বিশ্বকল্যাণকার্যের কোনো বাধা হবে তাহলে সরকারী নিমন্ত্রণ কখনো নেবেন না। যাত্রার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, অন্তত আমাদের তাই ধারণা, যে তিনি সরকারী আতিথ্য নেবেন না। কি করে পরে বিশ্বভারতীর কতৃপক্ষরা (সচিবদ্বয়) তাঁকে এ আতিথ্য নিতে মত করিয়েছিলেন তা জানি বা, হয়ত তাঁদের আশা ছিল এতে বিশ্বভারতীর সাহায্য হবে এবং সেইজন্যই তাঁরা কবিকে এই 'speculative step' নিতে প্ররোচিত করেন। আমাদের বরাবরই একটু আশঙ্কা ছিল, কিন্তু আমরা তাঁর পরামর্শদাতাদের বিবেচনার উপর নির্ভর করেছিলাম। কার্লো ফর্মিকি, অধ্যাপক তু্চ্চি, প্রশান্ত মহলানবিশ, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁরা সকলেই ছিলেন।" [৪১] একই প্রসঙ্গে 'প্রবাসী'-ও জানিয়েছে, "কবি যখন ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করেন তখন ইতালির রাজসরকারের অতিথিরূপে সেখানে যাইবার তাঁহার ইচ্ছা ছিল না। বিশ্বভারতী কর্ম-সচিবগণের প্রেরিত সংবাদ হইতে এইটুকু জানা যায় যে কবির মনোভাব পরিবর্তন যে কোন কারণেই ঘটুক না কেন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠানকে ইতালিতে পরিচিত করিবার পক্ষে মুসোলিনি কতৃক এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা ভালই হইয়াছিল।" [৪২] প্রসঙ্গত, বাংলা পত্রিকা প্রবাসী এবং ইংরেজি পত্রিকা মর্ডান রিভিউ, উভয়ের সম্পাদক একজনই - রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদক রামানন্দ, লেখক রবীন্দ্রনাথকে কেবল শ্রদ্ধাই করতেন না, প্রবাসীর 'বিবিধ প্রসঙ্গ' এবং মর্ডান রিভিউএর 'নোটস' এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে প্রচারও করতেন। আর যেটা করতেন তা হল, রবীন্দ্রবিরোধিতার সমস্ত প্রচেষ্টাকে বানচাল করা। এখানে সম্পাদকের বক্তব্যে সেই প্রচেষ্টারই নিদর্শন দেখি - পশ্চিমের অন্যান্য দেশের মিডিয়ার মতো ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিতেও যখন রবীন্দ্রনাথের তৃতীয়বার ইতালি ভ্রমণ নিয়ে কিছুটা হলেও সমালোচনার ঢেউ উঠেছিল, তখন বারংবার, কখনও ঘটনাচক্র বলে, আর কখনও বা সচিবদ্বয়ের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ব্যাপারটা ম্যানেজ করবার প্রচেষ্টা হয়েছে। কারণ এরপর এনড্রুজের কাছে ফ্যাসিস্ট মতবাদের নিন্দা করে লেখা কবির একখানি চিঠি প্রকাশি হলে 'মর্ডান রিভিউ' অন্ততঃ সে সংবাদ প্রথমে অবিশ্বাস্য ভেবেছিল - মৈত্রেয়ী দেবী এমনটিই জানিয়েছেন।

যথারীতি এরপর আরম্ভ হল পুরোদস্তুর সরকারি ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথের ইতালি ভ্রমণ যার মধ্যে ছিল মুসোলিনির সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎকার, সরকারের গঠনমূলক কর্মকাণ্ড পরিদর্শন এবং বিভিন্ন নারী পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাতের নামে মুসোলিনির এবং তাঁর ফ্যাসিবাদী সরকারের অকুণ্ঠ প্রশস্তি শ্রবণ। মুসোলিনি তাঁকে যেটুকু দেখাতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ সেটুকুই দেখলেন, তিনি যেটুকু বোঝাতে চাইলেন ইনি সেটুকুই বুঝলেন ! এবং আমরা দেখবো, ফ্যাসিস্ট সরকার তথা মুসোলিনির প্রতি সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতাবশত এবং খানিকটা প্রতারণা ও বিভ্রান্তির শিকার হয়ে রবীন্দ্রনাথ ইতালি উদ্দেশ্যে যে সমস্ত প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন তা-ই শতগুনে পল্লবিত করে ইতালির ফ্যাসিস্ট মিডিয়া এমন প্রচারের ঢক্কানিনাদ আরম্ভ করে দিল যে, বিশ্ববাসীর মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের একজন প্রবল সমর্থক।

সে ধারণা এখনও কিছুসংখ্যক মানুষের মনে বর্তমান।


(ছয়)

৩০শে মে রবীন্দ্রনাথ সদলবলে এক্যুলিয়া জাহাজে নেপলসে পৌঁছালে দেখা গেল, অধ্যাপক ফর্মিকি এবং স্থানীয় রাজকর্মচারীরা মুসোলিনির আমন্ত্রণ নিয়ে কবিকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত। সেই দিনই স্পেশাল ট্রেনে তাঁদের রোমে নিয়ে যাওয়া হল। রোমের গ্র্যান্ড হোটেলে সরকারি খরচে তাঁদের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "বাবা এবারকার সফরে সর্বত্রই রাজকীয় সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন। তখনকার পত্র-পত্রিকায় সে-সব সংবর্ধনার কথা বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল।" [৪৩] যতোই হোক, সরকারি অতিথি বলে কথা।

পরেরদিন ৩১শে মে মুসোলিনির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎকার।

অনিকেত মহাপাত্র তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ স্ববিরোধিতায় : দু-একটি প্রশ্ন' শীর্ষক প্রবন্ধে সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের কথা তুলে এনেছেন। আলোচনার শুরুতেই মুসোলিনি এক ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়লেন - "আমি তাদেরই একজন, যারা আপনার সমস্ত লেখার ইতালীয় অনুবাদ পড়েছে এবং আপনার গুণগ্রাহীদের অন্যতম।" [৪৪] আর এতেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঘায়েল হলেন। আর ঘায়েল হবেন নাই বা কেন? যদিও রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যদিও ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের একাধিক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাঁর গুণমুগ্ধ ; তবুও বেনিতো মুসোলিনির ন্যায় একজন পৃথিবীবিখ্যাত রাষ্ট্রপ্রধানকে একনিষ্ঠ পাঠকরূপে পাওয়া যেকোনো রচনাকারের পক্ষেই অত্যন্ত শ্লাঘার কথা। এ যেন একজন স্রষ্টার ইগোর চুড়ান্ত পরিতৃপ্তি ঘটল। সত্যি কথা বলতে কি, কবি মুসোলিনিতে মজে গেলেন।

রবীন্দ্রনাথও মুসোলিনিকে ধন্যবাদ জানালেন বিশ্বভারতীর জন্য দুর্লভ গ্রন্থসমুহ এবং দুইজন অধ্যাপককে প্রেরণ করবার জন্য। হোটেলে ফিরে আসবার পথে রবীন্দ্রনাথের কাছে মুসোলিনি সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা হয়েছে, জানতে চাইলেন অধ্যাপক ফর্মিকি। রবীন্দ্রনাথ জানালেন, "Without any doubt he is a great personality. There is such a massive vigour in that head that it reminds one of Michael Angelo’s chisel. Moreover, there is a simplicity in the man which makes it hard to believe that he is really the cruel tyrant many indulge in depicting." [৪৫] ফ্যাসিস্টদের মুখপত্র 'ট্রিবিউনা' পত্রিকায় ২রা জুন প্রকাশিত হল, মুসোলিনি সম্বন্ধে কবির এই মনোভাব। কবিকে কিছু লিখে দিতে বলা হলে, তিনি লিখে দিলেন, "ইতালীর মৃত্যুহীন আত্মা অগ্নিস্নান হইতে চিরোজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উত্থিত হইবে, এই স্বপ্ন আমি দেখিতেছি।" [৪৬]

আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথকে ইতালিতে যা দেখানো হয়েছিল এবং যা বোঝানো হয়েছিল, তাতে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদি শাসনের মধ্যে তিনি নিন্দনীয় বিশেষ কিছু দেখতে পেলেন না। আসলে আগে থেকে সবকিছু বেশ সাজিয়েগুছিয়ে তাঁর পাতে পরিবেশন করা হয়েছিল, এই আরকি। সচরাচর এমনটিই করেন এঁরা, বছরখানেক আগে এদেশেের একটি রাজ্যে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রপ্রধানের সফরকালে রাস্তার ধারে উঁচু পাঁচিল তুলে বস্তি ঢাকা দেওয়ার নির্লজ্জ প্রচেষ্টার ঘটনাটি নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। যাইহোক, সব মিলিয়ে খুব খারাপ লাগলো না রবীন্দ্রনাথের। ফ্যাসিবাদ কেমন লাগছে, জিজ্ঞাসা করা হলে রবীন্দ্রনাথ বললেন, "It is for me to study and not criticise from outside. I am glad of the opportunity to see for myself the work of one, who is assuredly a great man and a movement that will certainly be remembered in history." [৪৭] রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিল ইতালির ফ্যাসিস্ট প্রেস। এক সপ্তাহ পরে ৭ই জুন, রোমের গভর্নর ক্যাপিটোলে (L Capitolium) নগরীর বিশিষ্ট ভদ্রদের আহ্বান করে কবিকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করলেন। পরের দিন Unione Intellectuale Italiana নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে আহুত সভায় তিনি 'দ্য মিনিং অফ আর্ট' শীর্ষক বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার বিষয়টি ছিল মুসোলিনির প্রস্তাবিত। ১০ই জুন রোমান সম্রাটদের সময়ে নির্মিত প্রাচীন রোমের বিখ্যাত মুক্ত রঙ্গালয় কলোসিয়ামে কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হল Annual choral concert of school children পরিদর্শনের জন্য। মুসোলিনির উপস্থিতিতে পঁচিশ- ত্রিশ হাজার লোক তুমুল হর্ষধ্বনি করে কবিকে অভিনন্দন জানালেন। কবি তো আপ্লুত। বিকালে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদুতদের সঙ্গে আলোচনাকালে ফর্মিকিকে কবি বললেন, "As long as Mussolini lives, Italy can be said to be safe. Now I know what I shall answer when, after crossing the Italian border, I hear people speak ill of your country." [৪৮] বিড়ম্বনা হল, সীমান্ত পার হওয়ার কয়েকদিন পর যখন রম্যাঁ রলাঁ তাঁকে মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদের আসল স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করিয়েছিলেন, তখন খোদ রবীন্দ্রনাথকেই মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদ সম্বন্ধে খারাপ কথা বলতে হয়েছিল !

১১ই জুন কবিকে নিয়ে যাওয়া হল ইতালির রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে।১৩ই জুন কবির উপস্থিতিতে একটি থিয়েটারে ইতালীয় ভাষায় 'ডাকঘর' অভিনীত হল। ওই দিনই মুসোলিনির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পুনরায় দেখা হল। কবি ইতালির সর্বময় কর্তাকে বললেন, "Material wealth and power cannot make a country immortal, she must contribute something which is great and which is for everybody, and which does not merely glorify her own self." [৪৯] শোনা যায়, মুসোলিনি কোনো উত্তর দেন নি। না দেওয়ারই কথা - এসব বেসুরো মানবতাবাদী কথা তাঁর পছন্দ হবে কেন? রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, "Your Excellency, you are the most slandered man in the world." [৫০] মুসোলিনির মুখ থেকে জবাব এল - আমি তা জানি, কিন্তু আমি কী করতে পারি? আহা, বেচারা !


(সাত)

এই সফরেই রবীন্দ্রনাথের একান্ত আগ্রহে প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক ও ঐতিহাসিক বেনেদেত্তো ক্রোচের (Benedetto Croce) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা করবার ব্যবস্থা করল ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার। ক্রোচে প্রথমদিকে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারকেই সমর্থন করেছিলেন তবে ১৯২৪ সালে ফ্যাসিস্টদের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ গিয়াকোমো মাত্তোত্তির (Giacomo Matteotti) হত্যাকাণ্ড মুসোলিনির প্রতি ক্রোচের মানসিকতাকে প্রবল নাড়া দেয়। ১৯২৫ সালের মে মাসে ক্রোচে ফ্যাসিস্ট বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের ইশতাহারের অন্যতম স্বাক্ষরকারী হওয়ার পর তাঁকে কার্যত গৃহবন্দী করে রেখেছিল মুসোলিনি সরকার।

এই সাক্ষাৎকারের ব্যাপারটা বেশ মজাদার। একটা কথা বলতে ভুলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ-মুসোলিনির বৈঠকে সর্বদা ফর্মিকি উপস্থিত থাকতেন দোভাষী হিসেবে, কারণ মুসোলিনি ইংরেজি বুঝতে পারলেও বলতে পারতেন না। শোনা যায়, কবি মহান ইতালীয় দার্শনিক ক্রোচের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, মুসোলিনি মুখ খোলবার আগেই অধ্যাপক ফর্মিকি জোরে সুরে আপত্তি জানিয়েছিলেন - অসম্ভব ! অসম্ভব ! মুসোলিনি বরাবরের মতোই চতুর, তৎক্ষণাৎ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ক্রোচের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে আদেশ দিলেন। কিন্তু নানা অজুহাতে ফর্মিকি বাধার সৃষ্টি করতে থাকেন, অবশেষে এক তুরুণ সৈনিকের সহযোগিতায় একদিন ভোররাত্রে হোটেলের নিভৃত কক্ষে উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটে। এবার ঘটনাটি শোনা যাক প্রত্যক্ষদর্শী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে - "একদিন কথায় কথায় মিসেস মোডি বললেন (মিসেস ভন মোডি, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পুরানো পারিবারিক বন্ধু), বাবা রোম পর্যন্ত এসেও বিখ্যাত দার্শনিক ক্রোচের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই ফিরে যাবেন, সে কি কখনো হয় ! বাবার খুব ইচ্ছা যাবার আগে ক্রোচের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কি করে তা সম্ভবপর হবে? ক্রোচের সঙ্গে বাবার পূর্বপরিচয় নেই, তিনি যে ঠিক কোথায় থাকেন আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে প্রফেসর ফর্মিকির বিশেষ উৎসাহ আছে বলে মনে হল না। ইতিমধ্যে মিসেস মোডি ইতালীয় সেনা-বিভাগের এক তরুণ অফিসারকে এনে হাজির করলেন। অফিসারটি বললেন, ক্রোচের সঙ্গে তাঁর ভালো-রকম আলাপ পরিচয় আছে, বাবার কাছে তাঁকে এমনভাবে হাজির করে দেবেন যে কাকপক্ষীও সে বিষয়ে কিছু জানতে পারবে না। সৈন্যবাহিনীর অফিসার হিসেবে তাঁর আনুগত্য রাজার কাছে, মুসোলিনির কাছে নয় - এই সুযোগে মুসোলিনিকে একহাত নিতে পারবেন মনে করে তিনি বেজায় খুশি। বাবা তাঁকে বললেন, অত তাড়াহুড়ো করে কাজ নেই, তিনি নিজেই বরং মুসোলিনিকে বলবেন, ক্রোচের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে। বাবা সত্যিই কথাটা পাড়লেন তাঁর কাছে। মুসোলিনি সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু ব্যবস্থা করার জন্যে ফর্মিকিকে হুকুম দিয়ে দিলেন। অনুমতি তো পাওয়া গেল, এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, মুসোলিনির অনুচরদের চোখে ধুলো দিয়ে কি করে ক্রোচের সঙ্গে বাবা মন খুলে আলাপ করতে পারেন। এবারও সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন সেই তরুণ অফিসার। তিনি বিমানযোগে নেপলস গিয়ে পরদিন ভোর পাঁচটার সময় ক্রোচেকে নিয়ে হোটেলে হাজির। একটি প্রাণীরও নিদ্রাভঙ্গ হয় নি তখন, সুতরাং সেই জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষটির সঙ্গে বাবা অবাধে বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে নানান প্রসঙ্গ আলোচনা করতে পারলেন। ক্রোচের সঙ্গে বাবা প্রাতরাশে বসেছেন, এমন সময়ে ফর্মিকি এসে উপস্থিত। আমি তখন বারান্দায় বসে পাহারা দিচ্ছি। ফর্মিকি আমার মুখেই শুনলেন, বাবা একজন অতিথির সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে রত আছেন, সে অতিথি স্বয়ং ক্রোচে। তখন তাঁর যা অবস্থা হল তা হল অবর্ণনীয়। অক্ষম ক্রোধে দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন, মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন।" [৫১] শোনা যায়, এই সাক্ষাৎকারের সময় ক্রোচে নাকি দর্শন, কাব্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে অঢেল আলোচনা করলেও, ইতালির রাজনীতি সম্বন্ধে একটিও কথা বলেন নি রবীন্দ্রনাথকে। তিনি কি বিশ্বাস করতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথকে? এই ঘটনা জানতে পেরে রম্যাঁ রলাঁ জ্যাক মেসলিনকে লিখিত একটি পত্রে সক্রোধে লিখেছিলেন, "একথা যদি মনে করা হয় যে ক্রোচে কিছু বলেন নি তার কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বাস করতে পারেন নি, তাহলে সেটা ঘোরতর অসম্মানসূচক - রবীন্দ্রনাথের প্রতি যতোটা না হোক, তাঁর নিজের প্রতি।" [৫২] ক্রোচে না হয় অসহায় ছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখের ভাষা কি পড়তে পারলেন না প্রখর সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথ? এই প্রসঙ্গে আগের সফরে মিলানের ডিউক গালারাতি স্কোত্তির (Duca Gallarati Scottie) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথোপকথনটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার সময় মুসোলিনির আজ্ঞাবহ ফর্মিকি একবার পাশের কামরায় উঠে গেলে স্কোত্তি বলেন - মুখ বন্ধ, কথা বলা নিষেধ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "Duke Scottie of Milan, told me that his mouth was shut. Formichi told me that Duke Scottie was an incorrigible anti-fascist. While I had been talking with the Duke, from time to time, he got extremely nervous so that I did not get an opportunity of having a quiet talk with the Duke." [৫৩] এইখানেই প্রশ্ন জাগে, ইতালির এই দমবন্ধকরা পরিস্থিতি কি একটুও অনুভব করতে পারেন নি 'অচলায়তন'-এর স্রষ্টা?

মুসোলিনির সঙ্গে শেষবারের সাক্ষাৎকারের সময় নাকি নিজের ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি তুলেছিলেন মুসোলিনি। মুসোলিনির ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল নিমীলিত-চোখ, আত্মমগ্ন কবির পাশ ফেরানো মুখ। অনেক দিন এই দুর্লভ ছবিটির কোনও খোঁজ ছিল না। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, ছবিটি রয়েছে তিরুবনন্তপুরমের কাছে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী জি রামচন্দ্রন প্রতিষ্ঠিত মাধবী মন্দিরম লোকসেবা ট্রাস্টের সংগ্রহশালায়। প্রশ্ন জাগে, মুসোলিনির তোলা ছবি কী করে রামচন্দ্রনের হাতে এল? উত্তরটি দিয়েছিলেন, দিলীপ মজুমদার, আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় বছর দুইয়েক আগে। দিলীপবাবু জানিয়েছেন, "তিরুবনন্তপুরমের সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়ার সময় প্রধান শিক্ষক কুলন্দি স্বামীর মুখে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনেন জি রামচন্দ্রন। ১৯২০ নাগাদ তিরুঅনন্তপুরমে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তাঁর সঙ্গে রামচন্দ্রনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ়। শান্তিনিকেতনে গিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছে রামচন্দ্রনের, কবিকে জানান অ্যান্ড্রুজ়। রবীন্দ্রনাথ সম্মতি দেন। ... ওই বছরেই ডিসেম্বরে দাদা রঘুবীরনকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ... শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় গাঁধীজির সঙ্গে দেখা হয় রামচন্দ্রনের। অসহযোগ, চরকার ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গাঁধীর মতান্তর থাকলেও রামচন্দ্রন সমর্থন করতেন গাঁধীকেই। রামচন্দ্রন তখন শান্তিনিকেতনে ছাত্রসভার সম্পাদক। এক বিতর্কসভায় জোরালো ভাষায় খণ্ডন করেন রবীন্দ্রনাথের মত। পরের দিনই তাঁকে ডেকে পাঠান কবি। স্বাধীন ভাবে মনের কথা বলার জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে বলেন বিচারবুদ্ধি ও আত্মার স্বাধীনতার পথ সব সময় খোলা রাখতে। এই রামচন্দ্রনই পরে প্রতিষ্ঠা করেন মাধবী মন্দিরম লোকসেবা ট্রাস্ট। ট্রাস্টের বর্তমান ম্যানেজিং ট্রাস্টি সিস্টার মৈথিলী জানিয়েছেন, মুসোলিনির তোলা সেই আলোকচিত্র অ্যান্ড্রুজ়কে উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে রামচন্দ্রনকে সেই ছবিটিই দেন অ্যান্ড্রুজ়।" [৫৪]

মুসোলিনির জীবনীকার ডেনিস ম্যাক স্মিথ জানিয়েছেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের চৌম্বকশক্তি ছিল অসাধারন। "His personal magnetism worked best with those who saw him rarely ; nevertheless he could always impress a visitor when he tried and all the fascist leaders remembered how they had at times fallen under a real spell." [৫৫] রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। তবুও গোটা সফরে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি মুসোলিনি সম্বন্ধে একাধিকবার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও ফ্যাসিস্ট শাসন বা ফ্যাসিবাদ সম্বন্ধে কোথাও কোনও মতামত দেন নি। কিন্তু ব্যক্তি মুসোলিনির উদ্দেশ্যে অসতর্কভাবে করা বিক্ষিপ্ত প্রশংসাসূচক মন্তব্যগুলিকে ফ্যাসিবাদের প্রতি প্রশংসার সমার্থক বলে চিহ্নিত করে ঘোষণা করল ইতালীয় প্রেস। ইতালির কাগজ পত্রে ফলাও করে প্রকাশ পেতে থাকল তা। এমনটাই চাইছিলেন মুসোলিনি। নিন্দনীয় এই ব্যাক্তি তখন নানা উপায় দেশ বিদেশের মনিষীদের প্রশংসা কুড়োতে নানা ফন্দি বার করে চলেছেন। স্বভাবতই, এসব পড়ে পাশ্চাত্যের আপামর প্রগতিশীল সমাজ অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল, একই সঙ্গে হতাশও। সবচেয়ে বিড়ম্বনা হল রবীন্দ্রনাথ অথবা তাঁর সঙ্গিসাথীরা কেউই এ সব সংবাদ জানতে পারছিলেন না।

তবুও ইতালিতে অবস্থানকালেই বিশেষতঃ ভ্রমণের শেষদিকে কবির পার্ষদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন - ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। রথীন্দ্রনাথের ভাষাতেই পড়া যাক, "আমরা রোমে থাকতে থাকতেই সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাবার কয়েকটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিছু সভা সমিতিতে বাবা ভাষণ দিয়েছিলেন। অধ্যাপক মহলানবিশ ও আমার কেমন জানি সন্দেহ হল, খবরের কাগজের বিবরণে বাবার কথাবার্তা ঠিকঠাক ছাপা হচ্ছে না। আমাদের পুরানো বন্ধু আঁদ্রে কার্পেলেস সেই সময়ে ইতালিতে এসেছেন তাঁর সদ্য পরিণীত সুইডিশ স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে। ... আঁদ্রে ইতালীয় ভাষা পড়তে পারতেন, তাঁর কাছে জানা গেল আমাদের সন্দেহ অমূলক নয়। ... রিপোর্টগুলি অনুবাদ করবার জন্য এক অস্ট্রীয় মহিলাকে নিযুক্ত করা হল - যিনি ইংরেজি ও ইতালীয় দু্ইই জানেন। কিন্তু তাঁর অনুবাদও সন্তোষজনক ঠেকল না। শেষপর্যন্ত জানা গেল, মহিলাটি আসলে মুসোলিনির বেতনভোগী এক গুপ্তচর। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দাগিরিতে এঁর বেশ নামডাক আছে।" [৫৬] পরে আর কাউকে ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদগুলি অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিনা, তা অবশ্য আর জানান নি রথীন্দ্রনাথ।

সম্ভবত ১৫ই জুন, রবীন্দ্রনাথ ফ্লোরেন্স ভ্রমণের উদ্দেশে রোম ত্যাগ করলেন, কয়েকদিন ফ্লোরেন্সে থাকবার পর করলেন তুরিন সফর। ২২ জুন ১৯২৬, ইতালির সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার সময় কবি মুসোলিনিকে টেলিগ্রাম করলেন, "I take leave with hearty thanks to Your Excellency, and to the Italian people represented by Your Excellency, for your generous hospitality and kind sentiments towards me." [৫৭] এই বার্তা প্রেরণ করে রবীন্দ্রনাথ সদলবলে ট্রেনে করে রওনা হয়ে গেলেন সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।

ওখানেই দেখা হবে রম্যাঁ রলাঁর সঙ্গে, আরম্ভ হবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের আর এক পর্ব।


(আট)

মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন রম্যাঁ রলাঁর (Romain Rolland) চিঠিপত্রে বোঝা যায়, "তিনি অধীর হয়ে কবির জন্য অপেক্ষা করছিলেন - ফ্যাসিজমের ভয়ানক গহ্বর থেকে কবিকে কি করে উদ্ধার করা যায়।" [৫৮] রলাঁর এই অধীরতার কারণ কি? আমরা দেখেছি, ইতিমধ্যে ইতালি বা ব্যক্তি মুসোলিনির উদ্দেশ্যে কবি যে সব প্রশস্তিবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, সে সব অনায়াসে ফ্যাসিবাদের প্রতি আরোপ করে, ইতালির ফ্যাসিস্ট প্রেস অক্লান্তভাবে মিথ্যা প্রচার করে গেছে যে রবীন্দ্রনাথ একজন আদ্যন্ত ফ্যাসিজমের সমর্থক। এই প্রচারে ধোঁকা খেয়ে যায় ইউরোপের অন্যান্য সোস্যালিষ্ট সংবাদপত্রগুলিও। এই অপপ্রচারের গুরুত্ব বুঝে ৭ই জুলাই রম্যাঁ রঁলা বন্ধু কালিদাস নাগকে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের যুদ্ধ ও উগ্র জাতীয়তাবিরোধী বক্তৃতাগুলির পর ইউরোপের বিদগ্ধ গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে গুরু বলে, ন্যায়ধর্ম ও মুক্তির আইকন বলে মেনে নিয়েছিলেন ; তাঁরা কি পরিমাণে বিভ্রান্ত হলেন যখন জানলেন, আমেন্দোলা ও মাত্তিয়োত্তির হত্যাকারী সেই পাশবিক ঘৃণ্য মুসোলিনির সরকারি আতিথ্য নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ - "The splendid aura surrounding Tagore in Europe owes less to the beauty of his poetical works ... than to the exalted prophetic quality of some of his speeches, notably some discourses during the war, when he rose up intrepidly against the errors and crimes of the Western civilization. These words responded to the innermost feelings of the best and most clairvoyant minds of the west ; ... That time onwards, Tagore was greeted by the elite of Europe as the guiding star - the embodiment of justice and liberty. Imagine their utter confusion when they learnt that Tagore had accepted to be the state guest of someone who incarnates tyranny of the most brutal, oppressive and lethal kind - the assassinator of Amendola and Matteotti - Mussolini." [৫৯]

এইখানে রলাঁ সম্বন্ধে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা না বলে থাকতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি, এই রম্যাঁ রলাঁ সম্পর্কে আমাদের চিরকাল ভুল বুঝিয়ে এসেছেন আমাদের দেশের ভাববাদী লেখকের দল। রলাঁকে তাঁরা বিবেকানন্দর একজন গুণমুগ্ধ ইউরোপীয় ভক্ত বলেই প্রচার করে এসেছেন চিরদিন তাঁরা। এই মিথটি চমৎকারভাবে ভেঙেছিলেন সরোজ দত্ত। ১৯৪৬ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক থাকাকালীন তিনি অনুবাদ করেন রম্যাঁ রলাঁর পত্রপ্রবন্ধ 'I will not rest' এর। নাম দেন 'শিল্পীর নবজন্ম'। এই বইয়ের ভুমিকায় সরোজ বাবু লিখেছিলেন, "গান্ধী-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জীবনীকার নিরীহ এক ধর্মপ্রাণ আদর্শবাদী হিসেবে তাঁহাকে পুস্তক-পত্রিকাতে, সভা-সমিতিতে চালু করিবার চেষ্টা হইয়া থাকে। রাশিয়া ও কমিউনিজমের নামও যে তিনি জীবনে কোনোদিন উচ্চারণ করিয়াছেন কিংবা ফ্যাসিজম লইয়া মাথা ঘামাইয়াছেন তাহার কোনো উল্লেখই করা হয় না।" [৬০] ঘটনাটা বাস্তবিকই তাই-ই। অথচ জীবন সায়াহ্নে এই রম্যাঁ রলাঁ হয়ে উঠেছিলেন কম্যুনিজমের অনুসারী। কজন জানি, ১৯৩২ সালে রলাঁ যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ওয়ার্ল্ড কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। কজন জানি, দীর্ঘদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে ফরাসি শিল্পীদের রাষ্ট্রদূত হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কজন জানি, ১৯৩৫ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির আমন্ত্রণে মস্কো গিয়ে জোসেফ স্টালিনের সাথে দেখা করেন তিনি, যাঁকে তিনি তাঁর সময়ের সেরা মানুষ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন ! কিন্তু নিজের মানবতাবাদী সত্ত্বা তিনি বিকিয়ে দেন নি কখনও। এটাও কি জানি, যে স্ট্যালিনকে প্রশংসা করেছিলেন রলাঁ, তবুও বাম বিরোধী কর্মী ও লেখক ভিক্টর সার্জকে মুক্তি দেওয়ার প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন তিনি?

মুল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। অবশেষে ২২শে জুন, ১৯২৬ ইতালি থেকে কবি সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করলেন। এলেন ভিলান্যুভে। সেদিনই রাত্রে দেখা হল দুজনের। রম্যাঁ রলাঁ নিজের দিনপঞ্জীতে লিখেছেন, "প্রথমদিকে কথায় কথায় ইতালির ফ্যাদিবাদের বিষয়টি ছুঁয়ে যাওয়া হল। রবীন্দ্রনাথের ইতালীয় বন্ধুদের প্রতি, বিশেষ করে বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ফর্মিচির প্রতি, মহলানবিশ অত্যন্ত নির্মম, তিনি তাঁর চরিত্রের দুর্বলতা এবং মুসোলিনির প্রতি তাঁর দাসত্বের কঠোর সমালোচনা করলেন। কিন্তু তাঁরা ইঙ্গিত দিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির ছলাকলায় ভুলেছেন, তাঁর কাছে মুসোলিনি নিজেকে সরল ও স্বাভাবিক বলে দেখিয়েছেন।" [৬১] এর থেকে বোঝা যায়, কবির সঙ্গীরা ইতালিতে থাকতে থাকতেই ফ্যাসিবাদের স্বরূপ বুঝে ফেলেছিলেন, স্রেফ রবীন্দ্রনাথই বোঝবার চেষ্টা করেন নি, নাকি বুঝেও চুপ ছিলেন?

এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন রথীন্দ্রনাথ। সম্ভবত ইতালি সফরের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এক ধরনের অস্বস্তিবোধ অনুভব করতে আরম্ভ করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "বাবার ইতালি সফল সম্পর্কে ফ্যাসিস্ট কাগজে যে-সব অপপ্রচার হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের ক্ষোভের সীমা ছিল না। মুসোলিনির অনুচরবৃন্দের অন্যায় অত্যাচার সম্বন্ধে কিছু কিছু কানাঘুষোও শুনেছিলাম, সে-সব যে মোটেই মিথ্যে নয়, তা বেশ বোঝা গেল স্কোত্তির প্রেরিত কাগজপত্র থেকে। (ডিউক স্কোত্তি মুখোমুখি আলোচনায় মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হলেও কয়েকদিন পরে তাঁর এক নিকট আত্মীয়াকে দিয়ে ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের প্রমাণ হিসেবে কিছু নথীপত্র রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন) আপাতদৃষ্টিতে যাকে লোকের সুখ সমৃদ্ধি বলে মনে হচ্ছে, তার নেপথ্যে অনেক গ্লানি লুকিয়ে আছে। বাবা যতদিন ইতালিতে থাকবেন ততদিন তাঁর পক্ষে মুখ খোলা শক্ত, যদিও ইতিমধ্যে ফ্যাসিস্ট কাগজে বাবাকে মুসোলিনির পরম অনুরাগী প্রতিপন্ন করার জন্য বিধিমত চেষ্টা চলছে। বাবা তো গৃহস্বামীর ঘরে বসে আতিথ্যের অপমান করতে পারেন না, তাই তিনি ইতালি থেকে বেরোবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।" [৬২] কিন্তু ঘটনা হল, রবীন্দ্রনাথ ইতালিতে যেরকম রাজকীয় সংবর্ধনা পেয়েছেন, এটি তাঁকে যতটা পুলকিত করেছিল এবং মুসোলিনি তাঁর মনে যে পরিমান কৌতূহল সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে ইতালিতে বসে মুসোলিনির গুণগান গেয়ে তিনি যে ভুল করেছেন, এটি তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের ক্রমাগতই মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন কিছু ভুল হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ যেন রবীন্দ্রনাথের গলায় কাঁটার মতো বিঁধছিল। তাই বোধহয় হঠাৎই রলাঁর সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ইতালি সফর এবং ফ্যাসিজমের কথা তুলে ফেললেন। তিনি বলে চললেন, ফ্যাসিজম নিয়ে সর্বপ্রথম ইউরোপগামী জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয় - পরে ইতালিতে দেখেছেন সকলকেই ফ্যাসিজমের প্রশংসা করতে - তাঁরা বলেছেন ইতালির জনসাধারণের যোগ্যতা নেই রাষ্ট্রশাসন করবার - তাই মুসোলিনিই ইতালির পরিত্রাতা। রম্যাঁ রলাঁ মন্তব্য করেছেন, "তখন রবীন্দ্রনাথ (তাঁর মধ্যে যা দেখে অবাক হয়ে গেলাম) লেগে গেলেন ফ্যাসিবাদের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে : যদি কোনো জাতি প্রকৃতই নিজেকে চালাতে অক্ষম হয়, অরাজকতায় ও নিস্ফল হিংসায় যদি সেই জাতির তলিয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য সাময়িকভাবে বিশেষ বিশেষ স্বাধীনতাকে দমনকারী এক অনমনীয় কতৃত্বের প্রয়োজন তাকে মানতেই হয়।" [৬৩] শুনতে শুনতে অধীর হয়ে উঠলেন রম্যাঁ রলাঁ কারণ আশ্চর্যজনকভাবে, পৃথিবীতে সর্বকালে সর্বদেশে একনায়করা এই যুক্তিই ব্যবহার করে এসেছেন, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে দিতে। রলাঁর ধৈর্যচ্যূতি ঘটছে, উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন। অবশেষে থামলেন রবীন্দ্রনাথ। রলাঁ বললেন, এবার ইতালির শহিদদের কথা আমি বলবো, আপনাকে শুনতে হবে তা।
 
 
(নয়)

পরবর্তীকালে নিজের পত্রপ্রবন্ধ 'I will not rest'-এ রম্যাঁ রলাঁ লিখেছিলেন, "আমি রবীন্দ্রনাথের চোখ খুলিবার চেষ্টা করিলাম। এ চেষ্টা আমার পক্ষে খুব সহজ হয় নাই। ফ্যাসিজমের আসল রূপ আমি তাঁহার নিকট খুলিয়া ধরিলাম।" [৬৪] রম্যাঁ রলাঁ বাস্তবিক অর্থেই বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের চোখ খোলার কাজটা আদৌ সহজ হয় নি। কেন হয় নি, সেটাই আমরা এবার দেখবো। কয়েকদিন পরে নিজের বাড়িতে সকলকে ডাকলেন রলাঁ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে সংঘটিত নৃশংসতা, সহিংসতা এবং ক্রমবর্ধমান উৎপীড়নের একটি চিত্র তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। এবার তাঁকেই উদ্ধৃত করি। "আমি তাঁর মুখোমুখি খোলা আলোয় - বসতে না বসতেই, যা বলে রেখেছিলাম, তাই বললাম। ইতালির যুবশক্তির যে প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের কথা বললাম - বললাম মিলানের তরুণ ছাত্রদের কথা, যাদের শিক্ষকেরা ত্যাগ করেছে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে - লিবারাল উমবের্তে জানোত্তি-বিঅাংকোর কথা, অসম্মানিত বিবেক, লজ্জায় ও নৈতিক বেদনায় পীড়িত আদর্শবাদী মাজিনিপন্থীদের কথা - নিহত জ্ঞানী আমেনদোলার কথা - নির্বাসিত এবং ঘাতকের ভয়ে সর্বদা ভীত সৎসালভেমিনির কথা, ইত্যাদি। এবং দেখলাম রবীন্দ্রনাথের মুখটা কুঁকড়ে গেল।" [৬৫] ফ্যাসিবাদের উগ্র সাম্রাজ্যবাদী রূপ, তার জাতিবিদ্বেষ এবং যুদ্ধবাজ চরিত্র সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। ইতালিতে মুসোলিনি কিভাবে গণতন্ত্র পদদলিত করেছেন এবং একনায়কতন্ত্র স্থাপন করে হাজার হাজার প্রতিবাদী ছাত্র, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে, কারাগারে নিক্ষেপ করে অথবা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছেন, তাও তুলে ধরলেন। ইতালি সফর নিয়ে কয়েকটি ইউরোপীয় সংবাদপত্রের তীর্যক মন্তব্য সম্পর্কে রলাঁ রবীন্দ্রনাথকে অবহিত করালেন। রলাঁর এই আবেগপূর্ণ ভাষণের পরেও রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের প্রতি প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হলেন না তবে, ফাসিস্ট প্রেস তাঁর সম্বন্ধে যে মিথ্যা প্রচার করছে তার প্রতিবাদ করতে রাজি হলেন তিনি। রলাঁ কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি চান, ফ্যাসিবাদের দ্বারা অগণিত উৎপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠে কবি প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদকে ধিক্কার দিন। রলাঁ রবীন্দ্রনাথকে মনে করিয়ে দিলেন, আজ ইতালির জনগনের উপর এই নির্যাতনের প্রতিবাদ যদি কবি যথাসময়ে না করেন তাহলে আগামীকাল ভারতবাসীর উপর ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদের কোনও গুরুত্ব থাকবে না। দ্বিধাবিভক্ত রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত রলাঁর কথা মেনে নিলেন এবং সিদ্ধান্ত হল যে, সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে একটি লেখা ফরাসি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হবে, যাতে তিনি তার সফরের অপছন্দের দিকগুলোর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করবেন।

রলাঁ পরম উৎসাহে প্যারিস থেকে তার লেখক ও সম্পাদক বন্ধু জর্জ দ্যুয়ামেল এবং প্রকাশক এমিল রোনিজেকে কে ডাকালেন, উদ্দেশ্য ফরাসি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারটি প্রচারের ব্যবস্থা করা। দ্যুয়ামেল কিছু প্রশ্ন লিখে দিলেন, স্থির হল ওই প্রশ্নগুলির উপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ একটি বিবৃতিমুলক প্রবন্ধ তৈরি করবেন। কিন্তু সে ব্যবস্থাটিও কাজে লাগল না। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথ যে বিবৃতিটি তৈরি করলেন তাতে পড়ে হতাশ হলেন সকলেই। কবি প্রশ্নগুলির ধার দিয়েও গেলেন না বরং যে প্রবন্ধটি রচনা করলেন তা হল অতি অস্পষ্ট উক্তিতে পরিপূর্ণ। সুস্নাত দাশের ভাষায়, "রোলাঁর চাপে প্রায় বাধ্য হয়েই ৩০শে জুন ভিলেন্যুভ-এ কবি যে প্রবন্ধটি রচনা করলেন তাতে তিনি আবেগহীন তত্ত্বালোচনার ভাষাতেই শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে জানালেন যে, এই ফ্যাসিবাদকে তিনি সমর্থন করেন না। মুসোলিনি সম্বন্ধে যা লিখেছেন তার মধ্যে কিছু প্রশংসার ভাবও আছে এবং আলোচনা-প্রসঙ্গে তিনি নেপোলিয়ন এবং আলেকজান্ডারেরও উল্লেখ করলেন, যদিও প্রবন্ধের শেষ কয়েক লাইনে কর্মবীরদের চেয়ে চিন্তানায়কদেরই যে তিনি বেশি মুল্য দেন সেকথারও উল্লেখ করলেন প্লেটোর মতো দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে।" [৬৬] স্পষ্টতই, কোনোক্রমেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর মন থেকে ইতালির সেই জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনার কথা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না। প্রবন্ধটিতে সামগ্রিকভাবে মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোনও আক্রমণাত্মক বক্তব্য নেই বরং নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডারের সঙ্গে মুসোলিনির তুলনা ফ্যাসিস্টদের সাহায্যই করবে বুঝতে পেরে রলাঁরা নৈরাশ্যে ভেঙে পড়লেন। রলাঁর ভাষায়, "হতবুদ্ধি হয়ে আমরা শুনছিলাম ; এবং কেউ কারুর দিকে তাকাতে সাহস করছিলাম না। যখন তিনি শেষ করলেন, শীতল কঠিন স্তব্ধতা নেমে এল।" [৬৭] বিবৃতিটি শুনে সম্পাদক দ্যুয়ামেল কবির উপর ক্রোধে প্রায় ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে যান ! তিনি বলেন, মৌলিক বিষয়গুলিতে রবীন্দ্রনাথের এইরূপ দোমনা ভাব তিনি মোটেই পছন্দ করছেন না। রলাঁ রবীন্দ্রনাথকে এই প্রবন্ধ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানালে, তিনি রাজি হলেন। ক্ষুব্ধ রলাঁ মহলানবিশকে বললেন, "ইউরোপে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর কাব্য ততটা নয় - লোকে তাঁর কবিতা খুব কমই জানে বা কিছুই জানে না - যতটা যুদ্ধের সময় তাঁর মহান ও উদার বাণী, সাম্রাজ্যবাদ, যান্ত্রিক সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের অন্ধ শক্তিগুলির ভবিষ্যৎদৃষ্টাসুলভ নিন্দা এবং তাঁর পবিত্র ভুমিকা যা জনসাধারণ মেনে নিয়েছে। অতি নিকৃষ্টতর পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ ও একটা পাশবিক ডিকটেটরশিপের সঙ্গে আপস করার মতো অবস্থায় আসার ফলে এক নিমেষে তিনি সমস্ত কিছু হারাতে বসেছেন। যে দ্যুয়ামেল আমার চাইতেও নরমপন্থী, তাঁর মতো একজন লেখকের বিদ্রোহ হচ্ছে বিপদের সংকেত।" [৬৮] পরবর্তীকালে রলাঁ তাঁর দিনপঞ্জীতে লিখেছেন, প্রবন্ধটিতে "তড়িঘড়ি তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যোগ করেছেন যে, ফ্যাসিবাদের কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি বিচার করতে পারেন না, তিনি কিছুই দেখেন নি, কিছুই শোনেন নি, কিছুই বোঝেন নি, কিছুই জানেন নি, তিনি হাত ধুয়ে ফেলেছেন।" [৬৯]

এইখানে বোধহয় হতাশ রম্যাঁ রলাঁ একটু অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ফেলেছেন। বিষয়টা একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে। প্রথমত, দেশে থাকতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন, ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী সংবাদপত্রগুলি তখন রীতিমত মুসোলিনির প্রশংসা করত। পক্ষান্তরে, ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলি তো বটেই এমনকি ভারতের ব্রিটিশ পদলেহি কাগজগুলিও মুসোলিনির বাপান্ত না করে জল খেত না। উভয়ক্ষেত্রেই কারণটা একই - মুসোলিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ক্রমাগত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গরম গরম বক্তৃতার দ্বারা বিষোদ্গার করে চলেছিলেন। তাই এখানে 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' - এই তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবেই কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, সত্যি কথা বলতে কি, রবীন্দ্রনাথের ইতালি ভ্রমণ ছিল কোনও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে নয়, ছিল নিতান্তই সরকারি টুরিস্ট হিসেবে ভ্রমণ। তাঁকে যেটুকু দেখানো হয়েছিল এবং যেটুকু শোনানো হয়েছিল কবি সেইটুকুই দেখেছিলেন, সেইটুকুই শুনেছিলেন। সেই দেখা ও শোনার মধ্যে মুসোলিনি এবং ফ্যাসিবাদের কোনও বিরুদ্ধতা থাকবার প্রশ্নই ছিল না। তৃতীয়ত, কবির সঙ্গে দেখা করতে আসা ক্রোচে রাজনৈতিক বিষয়ে চুপ ছিলেন, স্কোত্তি খোলাখুলিভাবে কিছুই বলেন নি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এমন কিছুই ছিল না, যা দিয়ে তিনি একটি দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করতে পারেন। পরের মুখে ঝাল খেয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করবেন, এমন দুরাশা করা রলাঁরও উচিত হয় নি। দিনকয়েক পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রলাঁ। কবির বলা 'I cannot say any more than this because I have not seen anything more.' এই বাক্যটির পিছনে কি অসহায়তা লুকিয়ে ছিল তা বুঝতে পেরেছিলেন রলাঁ, ৭ই জুলাই কালিদাস নাগকে লেখা চিঠিতেই তার প্রমাণ - "Truly, he was not allowed to see anything but fascist histrionics. We felt sad for this is exactly what the fascist dissemblers had wanted." [৭০] এরপর রলাঁ যেটা করলেন তা সিম্পলি স্পোর্টসের পরিভাষায় বলে চেঞ্জ অফ ট্যাকটিক্স। রলাঁ ও দ্যুয়ামেল রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করলেন ইতালি থেকে নির্বাসিত কিছু মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা না বলে কিছু লেখা বা বলবার দরকার নেই। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, একবার যদি ওই নির্যাতিতদের নিগ্রহের কাহিনী তাঁদের নিজেদের মুখে শুনতে পান সংবেদনশীল কবি, তাহলে অবশ্যই তিনি ফেটে পড়বেন ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে।


(দশ)

ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভিলন্যুভ থেকে জুরিখে যাওয়ার সময় এসে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ভিলন্যুভ ত্যাগ করবার পরের দিনই অর্থাৎ ৫ই জুলাই, রলাঁ ফ্যাসিস্ট সরকারের উৎপীড়নে দেশত্যাগী অধ্যাপক জিইসেপে সালভেমিনিকে (Giusepoe Selvemini) লিখলেন, "আপনার সঙ্গে আলাপ না করে এবং আপনার মুখে পদানত ইতালির এবং তার শহিদদের কথা না শুনে যাতে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ত্যাগ না করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কেননা, অপপ্রচারের দ্বারা ফ্যাদিস্ট প্রেস রবীন্দ্রনাথকে স্বদলভুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। ... আমার প্রবল আকাঙ্খা যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে আপনাদের সমর্থন ঘোষণা করেন।" [৭১] পূর্বোল্লিখিত পত্রে কালিদাস নাগকে রলাঁ লিখলেন, "The wrong has been done by those who exploited him during the trip to Italy, by giving it a twist. And I am confident that, despite their conspiracy, the Poet will thwart it, and in due course, rise up to speak the noble and the invincible truth." [৭২]

জুরিখে প্রফেসর সালভাদোরির সঙ্গে এবং ভিয়েনায় মদিগ্লিয়ানির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার নির্ধারিত হলো। প্রফেসর সালভাদোরি ইতালিতে অকথ্য লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করবার পর কোনোরকমে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসে সস্ত্রীক জুরিখে বসবাস করছিলেন। বৈঠকের নির্ধারিত দিনে প্রফেসর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় কবির সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেননি, কিন্তু তাঁর জীবনসঙ্গিনী শ্রীমতী সালভাদোরি (Signora Salvadori) সে শূন্যতা পুষিয়ে দিলেন। আলোচনার শুরুতেই অধ্যাপক পত্নী করলেন সেই বিখ্যাত প্রশ্নটি -, "You, who are so good, why did you come to Italy, now the land of violence and persecution?" [৭৩] প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইতালি সফরের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত কিংবা ফ্যাসিস্টদের কার্যক্রম সম্পর্কে পড়াশোনা করবার কোনও সুযোগই আমার হয়নি এবং এ ব্যাপারে আমি কোনও মতামতও ব্যক্ত করিনি। বরং আমার অধিকাংশ সাক্ষাৎকারে সতর্কতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছি যে ফ্যাসিজমের পক্ষে অথবা বিপক্ষে বলবার মতো যোগ্যতা আদৌ আমার নেই। "I had no opportunities to study the genesis or the activities of the Fascist movement and I did not express any opinion about it. In fact, in most of my interviews I was careful to explain that I was not competent to say anything either for or against Fascism, not having studied it." [৭৪] মুসোলিনি সম্পর্কেও তাঁর অভিমত জানালেন কবি - "আর মুসোলিনি সম্পর্কে বলতে গেলে অবশ্যই আমাকে বলতে হবে শিল্পী হিসেবে তিনি আমাকে আকৃষ্ট করেছেন, তার কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিত্ব আমাকে নাড়া দেয়। ইতালিতে যার সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে, প্রায় সবাই একবাক্যে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, নৈরাজ্য এবং সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়া থেকে মুসোলিনি ইতালিকে রক্ষা করেছেন।" [৭৫]

অধ্যাপক পত্নী জোর দিয়ে বললেন, এটা সত্য নয়। যারা ফ্যাসিস্টদের পক্ষে, এটা তাদের বক্তব্য। যারা ফ্যাসিবাদ-বিরোধী তাঁদের সঙ্গে আপনাকে সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। আর্থিকভাবে ধ্বংস হওয়া থেকে মুসোলিনি ইতালিকে রক্ষা করেছেন, এটাও সত্যি নয়। "The financial position of Italy was better before Mussolini came into power. Look at the Lira, it was 70 to the pound, and it is now 130 …" [৭৬] এই অবধি পড়ে পাঠকপাঠিকাগণ আশাকরি স্পষ্টই বুঝতে পারছেন যে, আইটি সেল আর হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি সেকালেও ছিল, অন্যরূপে যারা ক্রমাগত বিকাশ ও উন্নয়নের ঢাক বাজিয়ে তিল-কে তাল-রূপে প্রোজেক্ট করত !

শ্রীমতী সালভাদোরি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে বললেন, "But what makes us unhappy is that you have unintentionally helped to support Fascism. We know it is unintentional, for you are too good to do so." [৭৭] এরপর তিনি একে একে ফ্যাসিস্টদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের কাহিনী পরতে পরতে খুলে ধরলেন রবীন্দ্রনাথের সামনে। কিভাবে একরাত্রে আঠারো জন ফ্যাসিবিরোধী ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা হয়, কিভাবে সন্তানের সম্মুখে পিতাকে, মায়ের সম্মুখে সন্তানকে খুন করা হয় - এসবের লোমহর্ষক বিবরণ দিলেন তিনি। মনস্তাপে দগ্ধ রবীন্দ্রনাথ সরাসরি জানালেন, "I wish I had known for certain the dark deeds that were been done in Italy, then I would not have come to that country - I certainly would not. I had not met any of the people who suffered. But now that I have seen you, I realise my own responsibility." [৭৮] এই বৈঠকটির কথোপকথনের নোট নিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং তিনি রলাঁকে চিঠি লিখে জানালেন, কবি তীব্র মানসিক যাতনা ভোগ করছেন। পুরো আলোচনাটি প্রায় ঘন্টাখানেক স্থায়ী হয় এবং পরবর্তীকালে 'ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান'-এ অক্টোবর ১৯২৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

কিন্তু ফ্যাসিবাদের ফাঁদ থেকে কবির মোহমুক্তি ঘটলেও দেখা যাচ্ছে, মুসোলিনি সম্পর্কে তা হল না। ৭ই জুলাই কার্লো ফর্মিকিকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, তিনি মুসোলিনির প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ কিন্তু তাই বলে ফ্যাসিজমকে সমর্থন করতে পারবেন না - "ইতালি ছেড়ে আসার পর ফ্যাসিবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে অসংখ্য তথ্য আমার গোচরে এসেছে, সেগুলো আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। আমার পক্ষে পরিস্থিতি বিশেষ করে হতবুদ্ধিকর হয়ে উঠেছে, কারণ আপনাদের সংবাদপত্রগুলো থেকে ইউরোপে এবং ভারতবর্ষে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ফ্যাসিবাদকে আমি নৈতিক সমর্থন দিয়েছি - যদিও (আপনার জানা আছে) সবসময় এবং একভাবে আমি ইতালির প্রশ্নে আমার চরম অযোগ্যতার কথা সাংবাদিকদের জানিয়ে এসেছি। ... জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমার বক্তৃতায় ও আমার লেখায় আমি অত্যন্ত জোরালোভাবে আমার বক্তব্য প্রকাশ করেছি, ... নিন্দা করেছি সেই নরবলিকে যা সংঘটিত হচ্ছে জঘন্য জাতি-উপাসনার ক্ষেত্রে। একটি জাতির শক্তিবৃদ্ধির জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বিধাশুন্য অপরাধের কর্মসূচি অনুমোদন করছি দেখানোটা আমার কাছে চরম বিরক্তিকর। ... ব্যক্তিগতভাবে মুসোলিনির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার যে বাধকতা আছে, তা আমাকে, তিনি যে আন্দোলনের নেতা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণে সন্দেহ করতে বা তাদের গুরুত্ব ছোট করে দেখতে তাগিদ দেয়। কিন্তু দিনের পর দিন সে-সব না জেনে চলাটা আমার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। ... এ সবকিছুর জন্য আমি অত্যন্ত অসুখী বোধ করছি ...।" [৭৯]

১০ই জুলাই রবীন্দ্রনাথ গেলেন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে। ওখানে দেখা হল আইনজীবী মদিগ্লিয়ানির (Modigliani) সঙ্গে, যিনি মাত্তিয়োত্তি হত্যা মামলা পরিচালনা করবার জন্য ফ্যাসিস্টদের হাতে নির্যাতিত হয়ে দেশছাড়া। দেখা হল প্রফেসর সালভেমিনির সঙ্গে, দেখা হল বিখ্যাত সোস্যালিষ্ট নেত্রী বালবানোফের (Angelia Balabanoff) সঙ্গে, এবং আরও কয়েকজন নিভৃতে কবির সঙ্গে আলাপ করে ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের মর্মন্তুদ কাহিনী শোনালেন। সব শুনে কবির মানসিক যন্ত্রনা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠলো। বছর সাতেক আগে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের সময় যে মানসিক উত্তেজনা ও পীড়ন তিনি অনুভব করেছিলেন, ইতালির কাহিনী শুনে রবীন্দ্রনাথ যেন সেই মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করলেন।

স্পষ্টতই বিচলিত কবি রলাঁকে লিখলেন, "ইতালি সফরের পরে আমার মনে যে মলিনতার স্পর্শ লেগেছিল সম্প্রতি এক মুক্তি-স্নানে তা দূর হয়েছে। ফলাফল পরে জানতে পারবেন।" [৮০]

বাস্তবিকই, রলাঁ কান পেতে ছিলেন, এই ইঙ্গিতটি শোনবার জন্যই।


(এগারো)

অবশেষে ভিয়েনা থেকে রবীন্দ্রনাথ চার্লস অ্যানড্রুজকে সেই বিখ্যাত এবং সুদীর্ঘ চিঠিখানি লিখলেন ২০শে জুলাই, তাঁর ইতালি সফরের বিড়ম্বনার কথা বর্ণনা করে। পত্রটিতে কেমন করে তিনি বারবার সাক্ষাৎকারপ্রার্থী সাংবাদিকদের ফাঁদে পড়েছেন, তা জানালেন - "My interviews, as published in Italy, were the products of three personalities - that of the reporter, the interpretor and mine. ... Being ignorent of Italian I had no means of checking the result of this concoction. The only precaution which I could take was to repeat emphatically to all my listeners that I had no opportunity to study the history and character of Fascism." [৮১] আরও বললেন, তার সফরের কোনো পর্যায়েই ফ্যাসিবাদের কোনো প্রশংসা করেননি, তবে শিল্পী হিসেবে মুসোলিনির প্রশংসা করেছেন। স্পষ্টাক্ষরে কবি লিখলেন, "ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতির সঙ্গে সমগ্র মানবতাই সংশ্লিষ্ট। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেক বিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে - সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বরাবরই বলে এসেছি যে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলি সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবকে লালন-পালন করে সারা পৃথিবীর সামনেই এক ভয়াবহ বিপদ সৃষ্টি করছে।" [৮২] ৫ই আগস্ট ১৯২৬, কবির এই ঐতিহাসিক প্রতিবাদপত্র 'ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান' পত্রিকায় প্রকাশিত হল। এরপরেও রবীন্দ্রনাথের চিঠির নমনীয় স্বর রম্যাঁ রলাঁ পছন্দ করেননি। তিনি চিঠির নির্বাচিত অংশ শনাক্ত করে মূল বিষয়গুলো পুনরায় সম্পাদনা করে অন্যান্য ইউরোপীয় সংবাদপত্রে প্রচারের জন্য বিতরণ করলেন। রলাঁর ভাষায়, "মোটামুটি নীতিগতভাবে ফ্যাসিবাদকে নিন্দা করতে রবীন্দ্রনাথ কিছু জোরালো বাক্য খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু ইতালির অপরাধগুলোর যথাযথ প্রাসঙ্গিকতা সমস্তই এড়িয়ে গেছেন। ... চিঠিটা কাউকে খুশি করবে না এবং রবীন্দ্রনাথের সমুচ্চ নৈতিক চরিত্র ইউরোপের কাছে যে প্রত্যাশা জাগায়, তা মোটেই পূরণ হবে না। ... আমি সবচেয়ে স্পষ্ট, সবচেয়ে খোলাখুলি-বলা লাইনগুলি এক জায়গায় করলাম এবং এই অংশগুলো 'য়ুরোপ' পত্রিকায় সঙ্গে সঙ্গে ১৫ই আগস্টের সংখ্যায় পাঠিয়ে দিলাম।" [৮৩]

ভিয়েনা থেকে প্যারিস হয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে লন্ডন পৌঁছালেন রবীন্দ্রনাথ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কবি জানালেন, "Freedom of expression is repressed in Italy, I have never met a single individual in Italy who dared to speak a word against Fascism. ... You can make a country prosperous, but if your methods are wrong that is the concern of humanity, and they must be judged according to the ethical standard. ... I wish that I could have remained neutral with regard to Italian politics, and if I had not been misinterpreted in the papers I would have been able to do so." [৮৪] 'ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান' পত্রিকায় প্রকাশিত হল কবির এই ইন্টারভিউ ৬ই আগস্ট। ব্রিটেনেরই 'দ্য স্টার' পত্রিকায় 'ফর ন্যাশনালিইজম : ট্যাগোর অ্যান্ড ব্লাইন্ড প্যাশন ফর ফ্যাসিজম' শিরোনামে ছাপা হল রবীন্দ্রনাথ বলছেন, "জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ফ্যাসিবাদের অন্ধ আবেগ দেখার পর এর প্রতি আমার কোনো সমবেদনা থাকতে পারে না। যদিও মানুষগুলোর জন্য আমার গভীর ভালোবাসা আছে। ... ইতালীয় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা আমার ভাবনা বিকৃত করেছে। এবং আমি জানতে পেরেছি যে, ফ্যাসিবাদের প্রতি আমার নিঃশর্ত সমর্থন আছে বলে প্রচারিত হয়েছে।" [৮৫]

একটা কথা বলা হয় নি। অ্যানড্রুজকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির একটি কপি তিনি কার্লো ফর্মিকিকেও পাঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে ওই একই দিন অর্থাৎ ২১শে জুলাই রবীন্দ্রনাথ ফর্মিকিকে আরেকটি চিঠি লেখেন, যাতে তিনি স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন, "যে চিঠি আমি এনড্রুজকে লিখেছি তার কপি আপনাকে পাঠাচ্ছি। তা থেকে আপনি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আমার মনোভাবের একটা ধারণা পাবেন। আমি আবার কৈফিয়ত দিতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ শুধু ইউরোপেই নয়, ভারতবর্ষেও জনরব উঠেছে যে আমি ফ্যাসিবাদী মত সমর্থন করছি এবং ভারতবর্ষে ফিরে গিয়ে তার পক্ষ সমর্থনের ব্রত নিয়েছি। ইতিমধ্যে অন্যদিকের সাক্ষ্যপ্রমাণ ভিড় করে আসছে ; এবং এইসব তথ্যের কোনো-কোনোটির চেহারা অস্বস্তিকর। আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না, তারা আমাকে কি ভীষণ পীড়িত করছে। ... এতে ইতালিতে আমার বিশ্বভারতীর স্বার্থের হানি হবে, ... কিন্তু তবু আমি যা করছি, তা করা থেকে নিবৃত্ত হতে পারি না, ... আমি কিছু আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করি, ... আমি নিশ্চিন্ত যে ফ্যাসিবাদের পক্ষ সমর্থন করা আমার পক্ষে এক ধরণের নৈতিক আত্মহত্যা। ... প্রতিবাদ না করে জনরব চলতে দেওয়াটা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।" [৮৬]

৫ই আগস্ট অ্যানড্রুজকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি ব্রিটেনের 'ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান' পত্রিকায় প্রকাশিত হলে কার্লো ফর্মিকি ওই পত্রিকাতেই তার উত্তর দেন। তিনি বলেন, তিনি কবির সঙ্গে ইতালিতে বরাবরই ছিলেন এবং তাঁর দোভাষীর কাজ করেছিলেন। ফর্মিকি জানালেন, ইতালীয় সংবাদপত্রে যা প্রকাশিত হত, তা তিনি অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথকে শোনাতেন। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, ইতালিতে থাকাকালীন অবস্থাতেই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সন্দেহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যা বলছেন আর সংবাদপত্রে যা প্রকাশিত হচ্ছে তা অনেকক্ষেত্রেই আকাশপাতাল পার্থক্য।

আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অ্যানড্রুজকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অনুবাদ এবং ব্রিটেনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারগুলি আদৌ ইতালির কোনও পত্রিকায় ছাপা হল না। ইতালিবাসী জানতেও পারলো না, রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন ; কেবলমাত্র ইতালীয় কাগজগুলি কবি সম্বন্ধে গালিগালাজ শুরু করলো, যেহেতু তিনি ফ্যাসিজম সমর্থন করেন নি।


(বারো)

ইউরোপের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সাক্ষাৎকারগুলি প্রকাশের পর ১২ই সেপ্টেম্বর কালিদাস নাগকে লিখিত চিঠিতে রলাঁ গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে লিখলেন, ইউরোপে রবীন্দ্রনাথের যে সব ভক্ত আছেন তাঁরা অবশেষে সব বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হলেন। "His deniel of the lies published in the Italian press has come out in English, French, German newspapers and has blissfully restored public opinion. ... And it was just about time. I cannot tell you kow upset everyone was in France to hear that Tagore had rallied behind the Machiavellian politics of Mussolini. There was extreme indignation : and till the publication of the Poet"s denial, I had to write numerous letters to counter the canards of the European fascist press." [৮৭] কিন্তু ইতালি তথা মুসোলিনির এই 'ম্যাকিয়াভেলিয়ান রাজনীতি'র ব্যর্থতার পর তুমুল চটে গেল ইতালির গণমাধ্যমগুলি। একাধিক ফ্যাসিস্ট মুখপত্র পত্রিকাগুলি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনায় ফেটে পড়ল। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বাসঘাতক, ইতালির নিন্দাবাদি ইত্যাদি বলে গালাগালির ঝড় শুরু করল তারা। ইতালির বোলোনিয়ার 'অ্যাসলটো' পত্রিকা ২৮শে আগস্ট তীব্র ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করে লিখলো, "That Tagore, who came to Italy twice and inflicted us on his very heavy poetic lucubration, is an old actor who is worthy of our highest contempt … He is paid so much at each lecture … this viscid, insinuating individual, who is as honeyed as his words and poems, came to Italy as he was invited, paid and helped by the government. He exalted Italy, glorified fascism, and sang the praises of Mussolini … As soon as he crossed the border, this old man with an unsound soul, who impressed the public with his long black tunic and his white beard, talked behind the back of Italy, Fascism and its great leader, who is endlessly greater than him … He approximately behaved like prostitutes who always swear they are in love with their latest customer. Today we claim we do not like Tagore as a poet anymore because he is emasculated and without backbone. He disgusts us as a man because he is false, dishonest and shameless." [৮৮] মুসোলিনির মুখপত্র 'পোপোলো দ্য ইটালিয়া' (Popolo d' Italia) রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে লিখলো, "এই অসৎ 'তারতুফ'টি যাকে দুনিয়ার গর্দভগুলি মহত্ত্বের আসনে বসিয়েছে ..." [৮৯] প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, Tartuffe একটি বিখ্যাত ফরাসি নাটকের একটি ভণ্ড চরিত্র।

পাঠকপাঠিকাগণ জানতে পারলে অবাক হয়ে যাবেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান নেওয়ার পর কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদের জন্মভূমি ইতালিতেই নয়, রবীন্দ্রনাথ সমালোচিত হলেন স্বদেশেও। 'প্রবাসী' পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় (তখন পত্রিকা সম্পাদক রামানন্দ-পুত্র অশোক চট্টোপাধ্যায়) 'রবীন্দ্রনাথের মত পরিবর্তন' শীর্ষক প্রবন্ধে লেখা হল, "সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের একটি পত্র সংবাদপত্রাদিতে প্রকাশিত হইয়াছে। চিঠিটি মিঃ সি. এফ. এন্ড্রুজকে লিখিত। ইহাতে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিস্ট দল ও তাহাদের রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন। ... কবি যেভাবেই ইতালি সম্বন্ধে সত্য খবর জানিতে পারিয়া থাকুন না কেন, তাঁহার পক্ষে এই সকল সত্য পূর্ব হইতেই অনুসন্ধান করিয়া ইতালি ভ্রমণকালে তদ্দেশীয় গভর্নমেন্টের আতিথ্য গ্রহণ না করিলেই ভাল হইত। ... কবি পূর্বে ইতালীয় গভর্নমেন্টের আতিথ্য গ্রহণ করিয়া ও পরে তাহাদিগের সমালোচনা করিয়া ইতালীয়দের মনে যে অসন্তোষের ভাব জাগ্রত করিয়াছেন তাহা ভারতের পক্ষে কোন প্রকারেই লাভজনক হইতে পারে না।" [৯০] মর্ডান রিভিউ-তেও অশোক চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ প্রবল সমালোচনা করলেন। রম্যাঁ রলাঁ তাঁর দিনপঞ্জীতে লিখেছেন, "ভারতীয়দের মধ্যেও ফ্যাসিবাদের প্রতি যে প্রবণতা আছে তার বিরুদ্ধেও লড়াইয়ের প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের যে সব সহচর আছেন, তাঁদের মধ্যে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের এক পুত্র Modern Review পত্রিকায় এই ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করেছেন যে রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদ বিরোধী উক্তিগুলি সন্দেহজনক। তার জন্য রবীন্দ্রনাথ খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। [৯১] বাস্তবিকই, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ক্ষোভের কথা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন। ২৫শে অক্টোবর ভিয়েনা থাকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে কবি লিখলেন, "আমার সম্বন্ধে এরকম তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও অবজ্ঞাসূচক উক্তি দেশী বিদেশী শত্রুমিত্র কারো কাছ থেকে অনেক দিন পাইনি। যাদের সঙ্গে সমাজ বা রাষ্ট্র সম্বন্ধে আমার মতান্তর আছে, আমার মত ও আচরণকে আক্রমণ করবার তাদের ন্যায্য অধিকার আছে। কিন্তু আপনার কাগজে এটা মতঘটিত প্রতিবাদ নয়, ব্যক্তিগত অবমাননা। ... মর্ডান রিভিউ, প্রবাসীতে যে-প্রসঙ্গে সমালোচনা বেরিয়েছে সে হচ্ছে ফ্যাসিস্ট দলের প্রতি আমার আতিথ্য-বিরুদ্ধ ব্যবহার। ... লেখাটাকে 'ভুল' বলছেন। কিসের ভুল? ঘটনার ভুল? এ সম্বন্ধে যেটুকু ঘটনা প্রাসঙ্গিক সে আমার চিঠিতেই আছে। কিন্তু লেখক ব্যঙ্গ করে বলেছেন, চিঠিটা আমার কিনা, তাঁর সন্দেহ রয়ে গেছে। অর্থাৎ তাঁর মতে চিঠি আমার এতই অযোগ্য যে ওটাকে জাল বলে মনে করলেই আমার লজ্জা রক্ষা হয়। বোধহয় ইতালির কোনো ফ্যাসিস্ট কাগজেও এমন ছদ্ম সন্দেহের কুটিল অলঙ্কার প্রয়োগ করা হয় নি।" [৯২]

ইংল্যান্ড থেকে নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক হয়ে রবীন্দ্রনাথ এলেন জার্মানিতে। আমরা আগে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক প্রতিবাদপত্রের বিরোধিতা করে কার্লো ফর্মিকি ম্যাঞ্চেস্টর গার্ডিয়ানে চিঠি লিখেছিলেন। বার্লিন থেকে রবীন্দ্রনাথ পুনরায় সেই চিঠির প্রত্যুত্তরে ওই পত্রিকাতেই লিখলেন, "Prof Formichi is one of my best friend in Europe, and I do not wish to enter into a controversy with him about a subject that has been a misunderstanding for which I myself must acknowledge my own share of the blame. ... But this does not at all means that I had any sympathy for the methods of Fascism, the nature of which I gradually came to learn at a later date." [৯৩] পত্রটি ২০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হল।


(তেরো)

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে হাঙ্গেরী এসে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসকরা পূর্ণ বিশ্রামের নির্দেশ দিলে বালাটন হ্রদের ধারে কবি কয়েকদিন বাস করেন। এই সময়ে তাঁর অসুস্থতার সংবাদে উদ্বেগপ্রকাশ করে এবং আরোগ্যকামনা করে রম্যাঁ রলাঁর একটি চিঠি এসেছিল। এই পত্রে তিনি কেন কবিকে ইতালিতে মুসোলিনির স্বৈরাচার সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন তার একরকম কৈফিয়ত দেন, বলা যায়। ১১ই নভেম্বর, ১৯২৬এর এই চিঠিতে রম্যাঁ রলাঁ লিখেছিলেন, "Often I have accused myself for having disturbed your rest when I took away from you the confidence you had in your Italian hosts. However, I had no other interest in my mind but your glory, which I value more than your rest. I did not want devils misusing your sacred name in the annals of history. Forgive me if my intervention has caused you some restless hours. The future (the present already) will show you that I have acted as your faithful and vigilant guide." [৯৪] আমরা দেখেছি রম্যাঁ রলাঁ একশো শতাংশ সঠিক কথাই বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা এবং বিপদ সম্বন্ধে অবহিত করে, তাঁকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্রে রম্যাঁ রলাঁর ভুমিকা প্রশ্নাতীত। সরোজ দত্ত যথার্থই লিখেছেন, "১৯২৬ সালে যখন অতর্কিতে, অসতর্ক মুহুর্তে সরল মনে রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির ফাঁদে পা দিতে গিয়াছিলেন, তখন রলাঁই সর্বনাশের সীমান্ত হইতে তাঁহার বর্তমান ও ভবিষ্যতের সুনামকে রক্ষা করেন।" [৯৫] এমনকি, ৩০শে সেপ্টেম্বর, অ্যানড্রুজের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লেখবার আগে পর্যন্ত সমস্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, যাঁরা ফ্যাসিস্ট প্রেসের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে সাময়িকভাবে ভুল বুঝেছিলেন, রলাঁ ক্রমান্বয়ে তাঁদের আশ্বাস দিয়ে গেছেন, ওই মিথ্যা প্রচারে কান না দিতে। তিনি বার বার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ফ্যাসিজমকে সমর্থন করা অসম্ভব। নিঃসন্দেহে রলাঁর মতো এত বড়ো সুহৃদ ইউরোপের মাটিতে রবীন্দ্রনাথের আর কেউ ছিল না।

রবীন্দ্রনাথের এই ইউরোপ সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা তথা শিক্ষা ছিল ফ্যাসিজম ও যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা। এই ঘটনার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ দুনিয়াব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসী লেখক, চিন্তাবিদ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কম্যুনিস্ট বুদ্ধিজীবী অঁরি বারব্যুস (Henry Barbusse) ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট হচ্ছিলেন। বারব্যুসের ভাষায় - "A protest of enlightened and respected persons is the only thing likely, if it is organised and continuous, to put a stop to an abomibable state of things." [৯৬] এই প্রসঙ্গে রলাঁ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, "... ১৯২৬ সালের নভেম্বরে বারব্যুস ও আমি ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক সমিতি গঠনের পরিকল্পনা করলাম। আমাদের দুইজনের নামে একটি আবেদন আমরা বাহির করিলাম : 'ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে স্বাধীন মানুষের আবেদন' (Committee for the defence of the victims of Fascism and the White Terror)। এই ইস্তেহারের ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যা 'শহীদ জাতিগুলির সাহায্যার্থে' উৎসর্গীকৃত। ১৯২৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্যারির সাল-ব্যুলিয়েতে প্রথম বৃহৎ ফ্যাসিজম-বিরোধী সভার অধিবেশন হয়।" [৯৭] ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ রবীন্দ্রনাথ বারব্যুসের কাছ থেকে একটি পত্র পান। ওই পত্রের মাধ্যমে বারব্যুস রবীন্দ্রনাথের কাছেও আবেদন করেছিলেন। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে ' প্রিয় বিশিষ্ট সহকর্মী' বলে সম্বোধন করে বারব্যুস লিখেছিলেন, "Allow me to join a personal appeal to the one included herewith and to which I am requesting you to adhere. Your name is one of those which impose themselves in a league of great honest people who would stand up to oppose and fight the invading barbarity of Fascism. I have worded this appeal spontaneously, without listening to any suggestion of a political order, or anything like it ; I have only followed the feeling the soliderity and the voice of common sense. ... I must add that concerning the tenor of this appeal, I have exchanged views with Romain Rolland who is heartily with me, and who also thinks that a levy of free spirits, a protest of enlightened and respected persons is the only thing likely, if it is organised and contineuous, to put a stop to an abominable state of things." [৯৮] বারব্যুস এই চিঠির সঙ্গে সংগঠনের আবেদনপত্রটিও রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন।

কবি ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদীদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে লিখলেন, "It is needless to say that you appeal has my sympathy, and I feel certain that it represents the voice of numerous others who are dismayed at the sudden outbursts of violence from the depth of civilization ... I rejoice at the fact that there are individuals who still believe in a higher destiny of man, proving in their suffering the deeathless life of the human soul ever ready to fight its own aberrations." [৯৯]

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসোলিনির এই মতান্তরের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হল বিশ্বভারতী। অধ্যাপক তুচ্চিকে তৎক্ষণাৎ বিশ্বভারতী ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, মুসোলিনি যে উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তা বিলকুল মাটি হয়ে গেল। আবার একইভাবে ফ্যাসিবাদের সপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করবার যে প্ল্যান করেছিলেন মুসোলিনি-ফর্মিকি, তার উপরেও জল ঢেলে দিল রবীন্দ্রনাথের অস্বীকৃতি এবং ইউরোপীয় পত্রপত্রিকায় তার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। কল্যাণ কুণ্ডুর ভাষায়, "And with this, Mussolini’s plan to involve Tagore in his political propaganda came to a crashing end." [১০০]

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-মুসোলিনির এ কাহিনী "শেষ হইয়াও হইল না শেষ"। এ প্রসঙ্গে আমরা আবার ফিরে আসবো।


(চোদ্দো)

১৯২৬ সালের পর থেকেই ক্রমান্বয়ে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে উদাত্ত কণ্ঠস্বর শোনা যেতে থাকলো রবীন্দ্রনাথের। ১৯২৭ সালের গোড়ায় চীনের ব্রিটিশ অধিকৃত রাজ্যগুলি রক্ষার অজুহাতে ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল। ৩০শে জানুয়ারি 'Forward' পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি চপলাকান্ত ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অভিমত জানতে চাইলে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধির তীব্র নিন্দা করে একটি বিবৃতি দেন যা ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "The present expedition of the English against China is a crime against humanity, and to our utter shame India is being used as pawn in the game. ... In a crusade against justice, freedom and morality where the English are the aggressors, India is being dragged into the field against her own will." [১০১] ১৯২৮ সালের মার্চ-এপ্রিলে রলাঁ ও বারব্যুসের উদ্যোগে 'ওয়ার্ল্ড লীগ অফ পিস' নামের একটি শান্তি-সংগঠন তৈরি হয় এবং এর পক্ষ থেকে 'গোল্ডেন বুক অফ পিস' নামে একটি সংকলন পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে বাণী প্রেরণের অনুরোধ এলে, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "In our political ritualism, we still worship the tribal god of our own make (রবীন্দ্রনাথ কি কালীপূজার কথা বলতে চেয়েছিলেন?) and try to appease it with human blood. This fetishism is blindly primitive and angers truth that leads to death-dealing conflicts. To many of us it seems that this blood-strained idolatory is a permanent part of human nature. ... Let us, today, by the strength of our faith prove that the homicidal orgies of a cannibalistic politics are doomed, in spite of contradictions that seen overwhelming formidable." [১০২] 
 
সম্পূর্ণ বিবৃতিটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধসৃষ্টির বিপক্ষে সুতীব্র ধিক্কার। ওই বছরই জুলাই মাসে ব্রিটিশ সাংবাদিক মিনিঙ্গার্ডোর (F L Minningerode) সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ আবার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন - "The methods and basic principles of Fascism concern all humanity, and it is absurd to imagine that I could ever support a movement that ruthlessly suppresses free speech, that compels obedience to its commands that are against the convictions of individuals, and that follows the bloodbespattered path of violence and of secret crime. ... So even if it were not almost criminal, it would at least be very foolish for me to admire a political ideal that comes out openly for brutal violence as the moving force of civilisation." [১০৩]

১৯২৯-৩০ সালে ইউরোপ সহ পৃথিবীব্যাপী এক ভয়ঙ্কর আর্থিক মন্দা শুরু হল। জার্মানিতে নাৎসিবাদ আত্মপ্রকাশ করলো, যা ইতালির ফ্যাসিবাদের চেয়েও ভয়াবহ বলে পরবর্তীকালে পরিগণিত হয়েছিল। এইসময় দেখা যায় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবীমহলের একটা বড় অংশ ইতালির ফ্যাসিবাদ ও জার্মানির নাৎসিবাদের উপর সহানুভূতিশীল। ভারতের জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলিতেও ফ্যাসিজমের প্রচারকার্য চলছিল। "এমন কি গান্ধীজি, পণ্ডিত মালব্য, সুভাষচন্দ্র প্রভৃতি কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারাও অনেকে ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের আগে পর্যন্ত মুসোলিনি ও ফ্যাসিজমের প্রকৃত চরিত্ররূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন নি।" [১০৪] কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতালীয় ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক প্রমথনাথ রায়, অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরা সেই সময় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকাঠামোর প্রশংসা করে পাতার পর পাতা লিখে চলেছেন। ঠিক এই পরিস্থিতিতে ১৯৩০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছালেন জার্মানিতে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে সেই মুহুর্তে জার্মানির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণের টাকা তখনও তাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে জার্মানির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট প্রবল ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নেপাল মজুমদার জানিয়েছেন, ১৯৩০ সালের শুরুতেই জার্মানিতে তেইশ লক্ষ লোক বেকার কয়ে পড়ে। শ্রমিক কৃষকের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানির মধ্যবিত্ত শ্রেণীও প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। "জার্মানির এই অর্থনৈতিক সংকট তার রাজনৈতিক সংকটকেও ঘনীভূত করিয়া তুলিতে থাকে। জার্মানির সোস্যাল ডেমোক্রাট ও কম্যুনিস্টরা তাহাদের দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব-কলহ ভুলিয়া কোন সম্মিলিত কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারে নাই। ফলে জনসাধারণ আরও বিভ্রান্ত হয়। আর এই প্রতিক্রিয়ার উর্বর ক্ষেত্রেই হিটলারের 'Mein Kemph'এর জীবনদর্শন জার্মানির মধ্যবিত্ত যুবক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে আস্তে আস্তে প্রভাবিত করতে থাকে। ... সুতরাং সহজেই একশ্রেনীর মধ্যে হিটলারের প্রতি অনুরাগ বাড়িতে থাকে।" [১০৫] অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যে সময় জার্মানি ভ্রমণ করেন তখনও হিটলার-অনুরাগী নাৎসিরা খুব সংখ্যালঘিষ্ঠ ছিল তাই জার্মানির এই নয়া ফ্যাসিবাদের কথা বহুর্বিশ্বে তেমনিভাবে প্রচারিত হয় নি। সম্ভবত এইসব কারণেই জার্মানির তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে পুরোপুরিভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় নি। তবে এইটুকু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, অর্থনৈতিক সংকটের চাপে জার্মানিতেও এক ধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদী চরিত্র ক্রমপ্রকাশিত হতে চলেছে। ১৮ই আগস্ট ১৯৩০ জার্মানি থেকে নির্মলাকুমারী মহলানবিশকে লেখা পত্রে (পথ ও পথের প্রান্তে পত্রগুচ্ছ) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "এই যাত্রায় আগের বারের চেয়ে জার্মনির অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে আমার প্রবেশাধিকার ঘটেছে। ওদের কাছাকাছি এসেছি। এদের মধ্যে যে যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্বজাতিয়তা আছে তা নয়, য়ুরোপের অন্য সকল জাতের হাতের ঠেলা খেয়ে এরা ভিতরে ভিতরে খুব কঠোরভাবেই ন্যাশনালিষ্ট হয়ে উঠেছে।" [১০৬] মনে রাখতে হবে, জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতাদখল করতে তখনও তিন বছর বাকি।

তবে ঘনিষ্ঠবৃত্তে লিখিত পত্রে এমনটি লিখলেও, জার্মানিতে অনুষ্ঠিত কোনও সভা, সাক্ষাৎকার অথবা বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ তাদের নবনির্মিত এই উগ্র জাতিয়তাবাদের সমালোচনা করেন নি। এর একটা কারণ বোধহয় পরাজিত অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত জার্মানির, যাকে চিরকালের মতো পঙ্গু করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল মিত্রশক্তি - এই পুরো পরিস্থিতিটাই রবীন্দ্রনাথের কাছে সম্ভবত অন্যায় বলে মনে হয়েছিল। রম্যাঁ রলাঁকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "suffering often brings out the worse thing in a nation ..." [১০৭] জার্মানবাসীর এই দুর্দশা ও নির্যাতন ভোগ যে তাদের মন্দদিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, এ আশঙ্কা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন।

কয়েকবছরের মধ্যেই জার্মানিতে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বইপত্র !


(পনেরো)

১৯৩০ সালের নভেম্বর মাস। সদ্য সোভিয়েট রাশিয়া ভ্রমণ করে বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

আগেই বলেছিলাম না যে, মুসোলিনি পর্ব এখনও শেষ হয়নি রবীন্দ্রনাথের। আমেরিকায় আসবার পর দেখা গেল, কার্লো ফর্মিকির সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার পালাও কিন্তু তখনও ফুরায়নি কবির। নিউ ইয়র্কে পুনরায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হল ফার্মিকির যাঁকে কবি ছাড়া তাঁর সমস্ত সহযোগীই ফ্যাসিস্ট চর ব্যতীত অন্য কিছু মনে করতেন না। ফর্মিকি তখন বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতালীয় সংক্রান্ত বিষয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বরাবরই এই অধ্যাপকটি সম্বন্ধে অন্তরে কিছুটা দুর্বলতা পোষণ করতেন। তা যাইহোক, রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় এসেছেন খবর পেয়ে, ফর্মিকি সুযোগ করে দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ওই দেখার ফল হল একটি চিঠি। মুসোলিনিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি। কিভাবে ঘটল এ ঘটনা? কল্যাণ কুণ্ডু জানিয়েছেন, "During the course of the conversation, Tagore expressed his intention to resolve any misunderstandings he had with Mussolini. Formichi suggested the Poet write a letter to Mussolini directly explaining his account." [১০৮] বাস্তবিক অর্থেই কান্নায় ভেঙে পড়া ফর্মিকির প্ররোচনায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ত সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে দিয়ে মুসোলিনিকে পাঠানোর জন্য চিঠির একটি খসড়া তৈরি করলেন। কিন্তু সরাসরি পোষ্ট করলেন না। বরং, ২১ নভেম্বর ১৯৩০, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে পাঠালেন লিখে পাঠালেন, "Prof. Formichi এসেছিলেন। এখনো আমাদের উপরে তাঁর আন্তরিক টান আছে। আমার সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলুম ইটালি দিয়ে আমার যাওয়া চলবে কিনা। তিনি বললেন মুসোলিনিকে একখানা চিঠি লিখ্লেই সমস্ত জঞ্জাল সাফ হয়ে যায়। আমি তাঁকে বলেচি, চিঠি লিখব। চিঠিটা এইসঙ্গে পাঠাই। যদি দ্বিধার কারণ না থাকে পাঠিয়ে দিস। চিরকাল ইটালির সঙ্গে ঝগড়া জাগিয়ে রাখা ঠিক নয়।" [১০৯] বলা বাহুল্য, রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিটির সঙ্গে ওই উপরোল্লিখিত খসড়াটিও সংযোজন করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।

মজার কথা হল, রথীন্দ্রনাথকে লেখা পত্রটি চিঠিপত্রের দ্বিতীয় খণ্ডে স্থান পেলেও, মুসোলিনিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই বিশেষ চিঠিটি বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের কোনও খণ্ডেই প্রকাশিত হয় নি। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে খসড়াটি সযত্নে রক্ষিত আছে।

কি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনিকে লেখা সেই বিশেষ চিঠিটিতে? দেখা যাক,

"Il Duce
Signor Mussolini
1172 Park Avenue
New York
Nov. 21, 1930
Your Excellency
It often comes to my memory how we were startled by the magnanimous token of your sympathy reaching us through my very dear friend Prof Formichi. The precious gift, the library of Italian literature, is a treasure to us highly prized by our institution and for which we are deeply grateful to Your Excellency.
I am also personally indebted to you for the lavish generosity you showed to me in your hospitality when I was your guest in Italy and I earnestly hope that the misunderstanding which has unfortunately caused a barrier between me and the great people you represent, the people for whom I have genuine love, will not remain permanent, and that this expression of my gratitude to you and your nation will be accepted. The politics of a country is its own ; its culture belongs to all humanity. My mission is to acknowledge all that has eternal value in the self-expression of any country. Your Excellency has nobly offered to our institution in behalf of Italy the opportunity of a festival of spirit which will remain inexhaustible and ever claim our homage of a cordial admiration.
I am, Your Excellency,
Gratefully Yours
Rabindranath Tagore." [১১০]

গবেষক কল্যাণ কুণ্ডু নিশ্চিত নন, চিঠিটি আদৌ মুসোলিনিকে রবীন্দ্রনাথ পঠিয়েছিলেন কি না। তবে ইতালীয় এক লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন যে চিঠিটি ইতালি পৌঁছেছিল, কিন্তু মুসোলিনির হাতে গিয়েছিল কি না, তা জানা নেই - "Whether that letter was ever sent to Mussolini is still unknown. However, according to Mario Prayer, the letter was sent but it was not clear if it ever reached the hand of the Duce." [১১১] কিন্তু কল্যাণ বাবুর দেওয়া তথ্যসূত্রে আমরা দেখছি, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নাল 'ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ'এর জুলাই ১৯৯১ সংখ্যায় 'Italian Fascist Regime and Nationalist India : 1921-45', শীর্ষক প্রবন্ধে মারিও প্রায়র স্রেফ এইটুকুই লিখেছিলেন - "In 1930, in fact, Tagore wrote a letter to the Duce, expressing his hope that the friendship between the Italian and Indian people would not be hindered in the least by the 'misunderstanding' between them of four years earlier." [১১২] পলাশ দত্ত জানিয়েছেন, "ইংরেজি ভাষায় রবিজীবনীর লেখক কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যান্ড্রু রবিন্সনও এই চিঠির কথা বলতে ভোলেন না অবশ্য। তবে তাঁদেরও ধারণা ছিল চিঠিটি পাঠানো হয়নি : '১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্কে রবীন্দ্রনাথের আবার দেখা হলো ফর্মিচির সঙ্গে। বাধা ভাঙতে তিনি মুসেলিনিকে চিঠি লেখানোর জন্য রবীন্দ্রনাথকে রাজি করাতেও সমর্থ হন বলেই দেখা যায়। রথীন্দ্রনাথের পরামর্শে চিঠিটি পাঠানো হয়নি, তবে এর খসড়া রবীন্দ্রভবনে অক্ষত আছে।' ওই চিঠির ভাগ্যে আসলে কী হয়েছিল, তা ২০১০ সালে আমাদের নিশ্চিত করেন গিউসেপ্পে তুচ্চির মেয়ে গিউসেপ্পে ফ্লোরা। ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঐতিহাসিক আর্কাইভের বরাত দিয়েই এই নিশ্চয়তা দেন তিনি। ফ্লোরা জানান, রবীন্দ্রনাথের পাঠানো সেই চিঠিটি ওই আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সম্পর্কের বরফ কি গলেছিল? ফ্লোরা জানাচ্ছেন, তাঁর জানা মতে রবীন্দ্রনাথের ওই চিঠির জবাব দেননি মুসোলিনি।" [১১৩] আর এক গবেষক সুস্নাত দাশ আবার এই বিষয়টি অন্য আঙ্গিক থেকে দেখেছেন, তাঁর মতে, ওই চিঠিটা মুসোলিনিকে আদৌ পাঠানো হয় নি। "সম্ভবত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ইতালি নিয়ে নুতন আর একটি উৎপাত সৃষ্টির ঝুঁকি নিতে চান নি। এ চিঠি পাঠানো হলে মুসোলিনি ও ফর্মিকি এর পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে এই খবর 'রয়টার'কে দিয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গে পুনরায় একটি জমকালো সম্পর্কস্থাপনে নিশ্চয়ই তৎপর হয়ে উঠতেন ; কিন্তু তা ঘটে নি।" [১১৪] সুস্নাতবাবুর ধারণাটি কিন্তু আদৌ ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

এখন কথা হল, চিঠিটা পাঠানো হোক বা না হোক, মুসোলিনি পড়ুন বা না পড়ুন ; ওই চিঠির সাক্ষ্যেই কি আদৌ প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির'এর কবি ফাসিস্ট-বান্ধব? না, এমন কথা যিনি বলেন তিনি আহাম্মক ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুত, চিঠিটির মধ্যে এমন কোনও মন্তব্য ছিল না যা ফ্যাসিবাদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন অথবা সহানুভূতিকে ইঙ্গিত করে। বরং "The politics of a country is its own ..." বাক্যটির মাধ্যমে তিনি ইতালির রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর মানসিক দূরত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।


(ষোলো)

আমরা ইউরোপ তথা পৃথিবীব্যাপী সেই ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দার কথা আলোচনা করেছিলাম। একই সাথে ক্রমশই ঘোরালো হয়ে উঠছিল বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ১৯৩১ সালে জাপান লীগ অফ নেশনস ত্যাগ করে মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩২ সালের ২৭-২৮শে আগস্ট আর্মস্টার্ডামে বিশ্বশান্তি সম্মেলন আয়োজিত হল। যুদ্ধবিরোধী সমস্ত দেশের প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সংবাদপত্রের খবরে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ এই সম্মেলনে একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন এবং সাংগঠনিক কমিটিতেও তাঁর নাম ছিল। দিকে দিকে অসংখ্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন গজিয়ে উঠছিল। ঠিক তার পাশাপাশি ১৯৩২ সালে জার্মানির নির্বাচনে একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয় হিটলারের নাৎসি পার্টি এবং ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি (তারিখটা লক্ষ্য করবেন) জার্মানির প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ অ্যাডলফ হিটলারকে চ্যান্সেলর পদে অভিষিক্ত করলেন। এর আগেই বড় বড় শিল্পপতিগণ হিটলারের সমর্থক হয়ে উঠেছেন কম্যুনিস্ট আধিপত্যের ভয়ে। এই সময়ের অবস্থা বিশ্লেষণ করে রজনীপাম দত্ত লিখেছিলেন, "The class conscious workers who became disillusioned with Social Democracy passed to Communism. The polically backward elements passed to Fascism." [১১৫] হিটলারের নির্দেশে ৩০শে মে, বার্লিনের রাজপথে বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের পুস্তকাবলীর বহ্ন্যুৎসব করা হল। রেহাই পায় নি রবীন্দ্রনাথের বইও। রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগিয়ে তার দোষ চাপানো হল কম্যুনিস্টদের উপর। আরম্ভ হল কম্যুনিস্ট এবং সোস্যালিষ্টদের ধরপাকড়, মিথ্যা মামলা ও নির্বিচারে নিধন। ইহুদিদের উপর পৈশাচিক অত্যাচার যা হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত হয়ে আছে, তার কথা তো বলাই বাহুল্য। ১৯৩৪ সালের ২রা আগস্ট প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের মৃত্যুর পর হিটলার নিজেই প্রসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর উভয় পদই দখল করে নিলেন এবং নিজেকে ফ্যুয়েরার হিসেবে ঘোষণা করলেন।

এইবার ইতালির ফ্যাসিবাদী হুঙ্কারের সরাসরি বিরোধিতা করলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৭ মার্চ ১৯৩৫, রবীন্দ্রনাথের কালি ও কলমে ছবি হয়ে উঠে এলেন মুসোলিনি। 'রবীন্দ্রনাথের মুসোলিনি' প্রবন্ধে দেবদত্ত গুপ্ত লিখেছেন, "অস্থির রেখার দ্রুত গতির চলনে যেন এক পাগলের তাণ্ডবের ছবি এটি। এর আগে রবীন্দ্রনাথ এমন কোনও সমর নায়কের ছবি বা কোনও নামজাদা মানুষেরও অবয়ব এঁকেছেন কিনা সন্দেহ। মুসোলিনিকেও যে চেনা যাচ্ছে এমনটা নয়। কিন্তু তিনি সরাসরি ছবির তলায় চরিত্রের নাম মুসোলিনি লিখেই দিলেন। কবি অঙ্কিত মুসোলিনির এই ছবির মধ্যে ধরা পড়েছে তাঁর উন্মাদের মতো রণ হুঙ্কারের চিত্র। ক্ষিপ্র রেখায় ও ভঙ্গিতে কবি মুসোলিনির চরিত্রের সেই বেতালা আর বদ মেজাজি রূপটিকে পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।" [১১৬] নিজের কথায় ও লেখায় যে ভাবে একসময়ে এই হীন চরিত্রের রাষ্ট্রনায়কের প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারই যেন প্রায়শ্চিত্ত করলেন তিনি।

সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য পূরণে মুসোলিনির প্রথম প্রয়াস হল আবিসিনিয়া দখল করা। ইতালিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্থান অনুসন্ধান, খাদ্য সংস্থান, শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ, ও উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রী বিপণনের উপযুক্ত বাজার ইত্যাদির জন্য ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা বা আবিসিনিয়া দখল করার জন্য ইতালি সচেষ্ট ছিল। এই অভিপ্রায়ে ৩রা অক্টোবর ১৯৩৫ ইতালীয় আবিসিনিয়া আক্রমণ করে । ইতালীয় আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ আবিসিনীয় সম্রাট হেইলে সেলাসি দেশ ত্যাগ করেন। লীগ অফ নেশনস স্রেফ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা - পত্রপুট কাব্য সংকলনের অন্তর্গত 'আফ্রিকা'। এই কবিতাটিতে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির উপনিবেশ দখলের প্রক্রিয়াকে রবীন্দ্রনাথ যেন দেখলেন এক পরাধীন নিপীড়িত জাতির প্রতিনিধি হিসেবে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি আপন সমৃদ্ধশালী সমাজ তৈরির জন্য কিভাবে উপনিবেশগুলি শোষণ করে চলেছে, তার স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে কবিতাটিতে। একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন নিজের দেশে তাদের উদারনৈতিকতার ভণ্ডামীকেও।

          "এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
               নখ যাদের তীক্ষ্ম তোমার নেকড়ের চেয়ে,
                   এল মানুষ-ধরার দল
      গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
                   সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
   তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
          পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে ;
    দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
                   বীভৎস কাদার পিণ্ড
    চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।
সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
      মন্দিরে বাজছিল পূজোর ঘণ্টা
      সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে ;
                শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে ;
                কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
                             সুন্দরের আরাধনা।" [১১৭]

শোনা যায়, ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধে রচিত হয়েছিল ২৮ মাঘ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে।কবিতাটির প্রায় প্রতিটি স্তবক ফ্যাসিবাদের হাতে নিপীড়িত মানবসভ্যতার হাহাকারে সমৃদ্ধ। পাঁচ লক্ষ ফ্যাসিস্ট সৈন্য এই অভিযানে যোগ দিয়েছিল এবং সবচেয়ে বড় আয়রনি হল আধুনিক বিজ্ঞানে অনগ্রসর হাবসিদের উপর ইতালি বোমাবর্ষণ তো বটেই এমনকি বিষাক্ত গ্যাসও ব্যবহার করলো। লীগ অফ নেশনসের সভায় ইতালিকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করা হল এবং ইতালির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করা হল।

আবিসিনিয়াতে যুদ্ধ চলাকালীনই জেনারেল ফ্ল্যাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে নেমে আসে ফ্যাসিস্ট অত্যাচার (‌জুলাই, ১৯৩৬)‌। স্পেনের নুতন রিপাবলিকান গভর্নমেন্ট ভূমি সংস্কার প্রবর্তন করতেই রক্ষণশীল কয়েকটি রাজনৈতিক দল আর ভূস্বামীদের সহায়তায় জেনারেল ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, ১৮ই জুলাই। ইতালি ও জার্মানি স্পেনে ফ্যাসিস্ট রাজত্ব প্রতিষ্ঠার আশায় খোলাখুলিভাবে মদত দিতে লাগলো জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে। ইতালি লক্ষাধিক সৈন্য পাঠালো, জার্মানি দিল ট্যাঙ্ক, কামান এবং বিমানবহরের সাহায্য। জার্মান ও ইতালীয় বোমারু বিমানগুলি রাতের অন্ধকারে মাদ্রিদ, বার্সিলোনা প্রভৃতি শহরগুলির উপর বোমাবর্ষণ করতে লাহলো। এমনকি, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, রেডক্রশ বা শিশু-আবাসগুলিও রেহাই পেল না। প্রায় তিন বছর তীব্র লড়াইয়ের পর পাঁচ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ১৯৩৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল জেনারেল ফ্রাঙ্কো জয়লাভ করলেন। ফ্যাসিজমের নিকট গণতান্ত্রিক শক্তি পরাজিত হলেও স্পেনের গৃহযুদ্ধ সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। স্পেনের রিপাবলিকান সরকারকে সাহায্য করবার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষেরা একজোট হয়ে যে বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড তৈরি করেছিলেন তাতে দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক যোগ দিয়েছিলেন। "পৃথিবীর উজ্জ্বলতম প্রতিভার অধিকারী শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কলম, তুলি, ভায়োলিন, গীটার ফেলে স্পেনের রণাঙ্গনে ছুটে আসেন রাইফেল হাতে ফ্যাসিস্ট বর্বরতাকে প্রতিরোধ করবার জন্য।" [১১৮] স্পেনের বিখ্যাত কবি ফ্রেডরিকো গার্সিয়া, সঙ্গীতজ্ঞ পাবলো ক্যাসালস, ইংল্যান্ডের ভাস্কর ফেলিসিয়া ব্রাউন, সাহিত্য সমালোচক র‍্যালফ ফক্স ও ক্রিস্টোফার কডওয়েল স্পেনের রণাঙ্গনে প্রাণ দেন। এছাড়াও প্রখ্যাত লেখক-শিল্পী এইচ. জি. ওয়েলশ, ই. এম. ফস্টার, ভার্জিনিয়া উলফ, জন স্ট্রাচি প্রভৃতিরা স্পেনে ফ্যাসিস্ট বর্বরতার তীব্র নিন্দা করে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে লেখনী ধারণ করলেন।

পঁচাত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথও স্পেনের ঘটনায় নীরব থাকতে পারলেন না। স্পেন উঠে এল তাঁর কলমে, সেঁজুতি কাব্য সংকলনের 'চলতি ছবি' কবিতায়, আষাঢ় ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে -
  
"যুদ্ধ লাগল স্পেনে ;
চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতঘ্নীবাণ হেনে।
           সংবাদ তার মুখর হল দেশ-মহাদেশ জুড়ে
                   সংবাদ তার বেড়ায় উড়ে উড়ে
                             দিকে দিকে যন্ত্রগরুড়রথে
 উদয়রবির পথ পেরিয়ে অস্তরবির পথে।" [১১৯]

ভারতে 'লীগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম এ্যান্ড ওয়ার'এর শাখা গঠিত হল, রবীন্দ্রনাথ সোৎসাহে রাজি হলেন তার সভাপতি হতে। স্পেনের ফ্যাসিবাদী বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত বিবৃতি "স্পেনে আজ বিশ্বসভ্যতা পদদলিত। স্পেনের জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছে। অর্থ ও জনবল দিয়ে বিদ্রোহের সাহায্য করছে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ। ... আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের এই প্রলয়ঙ্কর বন্যাকে রোধ করতেই হবে। ... বর্বরতার প্লাবনে নিমজ্জিত হওয়ার আগেই সভ্যতাকে রক্ষা করতেই হবে। ... স্পেনের জনগণের চুড়ান্ত পরীক্ষা ও দুঃখভোগের মুহুর্তে মানবতার বিবেকের কাছে আমি আবেদন করছি : স্পেনের গণফ্রন্টের পাশে দাঁড়ান ; জনগণের সরকারকে সাহায্য করুন, লক্ষ-কণ্ঠে ধ্বনি তুলুন - 'প্রতিক্রিয়া দূর হও'। লাখে লাখে এগিয়ে আসুন গণতন্ত্রের সাহায্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষায়। (ইংরাজী থেকে অনুদিত)" [১২০]


(সতেরো)

স্পেনের গৃহযুদ্ধ তখনও শেষ হয় নি। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে চীন আক্রমণ করে বসলো জাপান। চীনে জাপ-আক্রমণের সূচনাকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ জাপানকে তীব্রভাবে নিন্দা ও ভর্ৎসনা করে আসছিলেন। ২১সে সেপ্টেম্বর মধ্যরাত্রী থেকে জাপানী বোমারু  বিমানগুলি নানকিং ও ক্যান্টনের উপর অবিরত বোমাবর্ষণ করতে থাকে। শান্তির প্রতীক গৌতম বুদ্ধের ভক্ত জাপানীদের এই বর্বরতা যেন সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। যুদ্ধবিরোধী রবীন্দ্রনাথ পত্রপুট’ কাব্য সংকলনে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে লিখলেন -

   "যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে।
ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা,
          কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।
মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভর্তি করতে
                     বেরোল দলে দলে।
সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
                      তাঁর পবিত্র আর্শীবাদের আশায়।
            বেজে উঠল তূরী ভেরি গরগর শব্দে,
                     কেঁপে উঠল পৃথিবী।
ধূপ জ্বলল, ঘণ্টা বাজল, প্রার্থনার রব উঠল আকাশে
                   ‘করুণাময়, সফল হয় যেন কামনা' —
কেননা, ওরা যে জাগাবে মর্মভেদী আর্তনাদ
                             অভ্রভেদ করে,
          ছিঁড়ে ফেলবে ঘরে ঘরে ভালোবাসার বাঁধনসূত্র,
                   ধ্বজা তুলবে লুপ্ত পল্লীর ভস্মস্তূপে,
          দেবে ধুলোয় লুটিয়ে বিদ্যানিকেতন,
                   দেবে চুরমার করে সুন্দরের আসনপীঠ।
তাই তো চলেছে ওরা দয়াময় বুদ্ধের নিতে আশীর্বাদ।
          বেজে উঠলো তূরী ভেরি গরগর শব্দে,
                             কেঁপে উঠলো পৃথিবী।
ওরা হিসাব রাখবে মরে পড়ল কত মানুষ,
                             পঙ্গু হয়ে গেল কয়জনা।
তারি হাজার সংখ্যার তালে তালে
                                 ঘা মারবে জয়ডঙ্কায়।
পিশাচের অট্টহাসি জাগিয়ে তুলবে
       শিশু আর নারীদেহের ছেঁড়া টুকরোর ছড়াছড়িতে।
ওদের এই মাত্র নিবেদন, যেন বিশ্বজনের কানে পারে
                                          মিথ্যামন্ত্র দিতে,
 যেন বিষ পারে মিশিয়ে দিতে নিশ্বাসে।" [১২১]

জাপানের হাতে ১৫ ডিসেম্বর নানকিং শহরের পতন হল। প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে জাপানী সৈন্যেরা। বৃহৎ শক্তিবর্গের নীরবতায় দৃশ্যত বিক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ ৭ই পৌষ শান্তিনিকেতনের এক প্রভাতী সভায় তীব্র ধিক্কার দিলেন - "আজ চীনে কত শিশু নারী, কত নিরপরাধ গ্রামের লোক দুর্গতিগ্রস্ত - যখন তার বর্ণনা পড়ি হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। আজ এই সঙ্গীতমুখর শান্ত প্রভাতে আমরা যখন উৎসবে যোগ দিয়েছি, এই মুহুর্তেই চীনে কত লোকের দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছে - পিতার কাছ থেকে পুত্রকে, মাতার কাছ থেকে সন্তানকে, ভাইয়ের কাছ থেকে ভাইকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যাচ্ছে, যেন মানুষের কোনো মুল্য নাই - সে কথা চিন্তা করলেও ভয় হয়। অপরদিকে আছে আপন সাম্রাজ্যলোভী ভীরুর দল, তারা এই দানবের কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। ... চীনকে যখন জাপান অপমান করেছে সিনেমার ভিতর দিয়ে, সাহিত্যের ভিতর দিয়ে - যেমন অপমান আমাদের দেশেও হয়ে থাকে - তখন এই প্রতাপশালীর দল কোনো বাধা দেয় নি বরং চীনকে দাবিয়ে দিয়েছে, বলেছে চীনের চঞ্চল হবার কোনো অধিকার নেই।" [১২২] কয়েকদিন পরেই ‘নবজাতক’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতাটি রচিত হল ১৯৩৮ সালের ৭ই জানুয়ারি। বিষয়বস্তু ওই একই - যুদ্ধ।

"হুংকৃত যুদ্ধের বাদ্য
সংগ্রহ করিবারে শমনের খাদ্য।
সাজিয়াছে ওরা সবে উৎকটদর্শন,
দন্তে দন্তে ওরা করিতেছে ঘর্ষণ,
হিংসার উষ্মায় দারুণ অধীর
সিদ্ধির বর চায় করুণানিধির—
    ওরা তাই স্পর্ধায় চলে
     বুদ্ধের মন্দিরতলে।
তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো। ...
হত-আহতের গনি সংখ্যা
তালে তালে মন্দ্রিত হবে জয়ডঙ্কা।
নারীর শিশুর যত কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ
জাগাবে অট্টহাসে পৈশাচী রঙ্গ,
মিথ্যায় কলুষিবে জনতার বিশ্বাস,
বিষবাষ্পের বাণে রোধি দিবে নিশ্বাস
মুষ্টি উঁচায়ে তাই চলে
     বুদ্ধেরে নিতে নিজ দলে।" [১২৩]

দুটি কবিতাতেই দেখা যায়, নাম না করে রবীন্দ্রনাথ জাপানের চীন আক্রমণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তবে দ্বিতীয় কবিতাটির শিরোনামের নিচে প্রদত্ত আছে একটি জ্ঞাপিকা। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি জাপানি সৈনিক যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধ-মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে ; ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।" [১২৪]

আমরা দেখেছি, সাম্রাজ্যবাদীদের পররাজ্যের প্রতি লোলুপতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনই প্রতিবাদ করে এসেছেন। কিন্তু লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক কর্মীদের এই প্রতিবাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে তাঁর মধ্যেও মাঝেমধ্যে সন্দেহ জেগেছে - ভেবেছেন এ হল অক্ষম ও দুর্বলের প্রতিকারবিহীন নিষ্ফল কান্না ! বোধহয় এইজন্যই অ্যানড্রুজকে তিনি লিখেছিলেন, "I keenly feel the absurdity of raising my voice against an act of unscrupulous and virulent imperialism of this kind when it is pitiably feeble against all cases that vitally concern ourselves." [১২৫] হতাশ রবীন্দ্রনাথও একসময় এও ভেবেছিলেন শক্তির উন্মত্ততাকে শক্তি দিয়েই আটকাতে হবে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় 'কালান্তর' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য - "পোলিটিকাল মতভেদের জন্যে ইটালি যে দ্বীপান্তরবাসের বিধান করেছে, সে কীরকম দুঃসহ নরকবাস, সে-কথা সকলেরই জানা আছে। য়ুরোপীয় সভ্যতার আলোক যে-সব দেশ উজ্জ্বলতম করে জ্বালিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রধান স্থান নিতে পারে জর্মনি। কিন্তু আজ সেখানে সভ্যতার সকল আদর্শ টুকরো টুকরো করে দিয়ে এমন অকস্মাৎ, এত সহজে উন্মত্ত দানবিকতা সমস্ত দেশকে অধিকার করে নিলে, এও তো অসম্ভব হল না। যুদ্ধপরবর্তীকালীন য়ুরোপের বর্বর নির্দয়তা যখন আজ এমন নির্লজ্জভাবে চারিদিকে উদঘাটিত হতে থাকল তখন এই কথাই বার বার মনে আসে, কোথায় রইল মানুষের সেই দরবার যেখানে মানুষের শেষ আপিল পৌঁছবে আজ। মনুষ্যত্বের ‘পরে বিশ্বাস কি ভাঙতে হবে - বর্বরতা দিয়েই কি চিরকাল ঠেকাতে হবে বর্বরতা।" [১২৬] ফ্যাসিস্টদের বর্বরোচিত আচরণের উপযুক্ত জবাব যে পাল্টা আক্রমণ তা রবীন্দ্রনাথের মানসে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাই 'প্রান্তিক' কাব্য সংকলনে কবি লিখলেন,

"নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস —
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।" [১২৭]


(আঠারো)

ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হয়ে উঠল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষণ। একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ আরও আগ্রাসী রূপ নিল। ১৯৩৮ সালের ১২ই মার্চ হিটলার আচমকা অস্ট্রিয়া দখলের করে নিলেন। এরপর হিটলারের চোখ পড়ল চেকোম্লোভাকিয়ার ওপর। হিটলার মুসোলিনীর আঁতাতের সংবাদে তখন শুভশক্তি বিপর্যস্ত। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হিটলার-তোষণনীতি নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন চেক অঞ্চলের উপর হিটলারের দাবী নির্লজ্জভাবে মেনে নিলেন। উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত রবীন্দ্রনাথ ২৪শে সেপ্টেম্বর চেক প্রেসিডেন্ট বেনেসের কাছে তাঁর অন্তরের ক্ষোভ ও মর্মবেদনা জানিয়ে তারবার্তা পাঠালেন - "বিশ্বাসঘাতকতার চক্রান্তে আপনার দেশ আজ নিঃসঙ্গ ও একক হইয়া পড়িয়াছে। এই শোচনীয় ঘটনায় ভারতবর্ষের পক্ষ হইতে এবং নিজের পক্ষ হইতে গভীর দুঃখ ও বিক্ষোভ জানাইতেছি।" [১২৮] ২৯শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাত্রে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স এবং ইতালি-জার্মানির মধ্যে কুখ্যাত মিউনিখ চুক্তি সাক্ষরিত হল, যার দ্বারা চেকোস্লোভাকিয়ার উপর জার্মানির সমস্ত দাবী মেনে নেওয়া হল। উল্লেখযোগ্য এই যে, সোভিয়েট ইউনিয়ানকে এই কূটনৈতিক আলোচনা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ রাখা হয়েছিল কারণ তারা ছিল চেকের স্বতন্ত্রতার পক্ষে।

বিপন্ন চেকদের এই নিদারুণ অপমান ও লাঞ্ছনার কথা চিন্তা করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, 'প্রায়শ্চিত্ত' কবিতাখানি, ১৭ই আশ্বিন ১৩৪৫।

"প্রতাপের ভোজে আপনারে যারা বলি করেছিল দান
          সে-দুর্বলের দলিত পিষ্ট প্রাণ
                নরমাংসাশী করিতেছে কাড়াকাড়ি,
                   ছিন্ন করিছে নাড়ী।
তীক্ষ্ম দশনে টানাছেঁড়া তারি দিকে দিকে যায় ব্যেপে
                        রক্তপঙ্কে ধরার অঙ্ক লেপে।
               সেই বিনাশের প্রচণ্ড মহাবেগে
     একদিন শেষে বিপুলবীর্য শান্তি উঠিবে জেগে।
                 মিছে করিব না ভয়,
           ক্ষোভ জেগেছিল তাহারে করিব জয়।
              জমা হয়েছিল আরামের লোভে
                             দুর্বলতার রাশি,
              লাগুক তাহাতে লাগুক আগুন —
ভস্মে ফেলুক গ্রাসি।
          ঐ দলে দলে ধার্মিক ভীরু
                        কারা চলে গির্জায়
                   চাটুবাণী দিয়ে ভুলাইতে দেবতায়।
          দীনাত্মাদের বিশ্বাস, ওরা
                     ভীত প্রার্থনারবে
                      শান্তি আনিবে ভবে।
          কৃপণ পূজায় দিবে নাকো কড়িকড়া।
                   থলিতে ঝুলিতে কষিয়া আঁটিবে
                               শত শত দড়িদড়া।
                   শুধু বাণীকৌশলে
                              জিনিবে ধরণীতলে।
                   স্তূপাকার লোভ
                             বক্ষে রাখিয়া জমা
                   কেবল শাস্ত্রমন্ত্র পড়িয়া
                             লবে বিধাতার ক্ষমা।
 সবে না দেবতা হেন অপমান
                    এই ফাঁকি ভক্তির।
          যদি এ ভুবনে থাকে আজো তেজ
                           কল্যাণশক্তির
          ভীষণ যজ্ঞে প্রায়শ্চিত্ত
                    পূর্ণ করিয়া শেষে
          নূতন জীবন নূতন আলোকে
                    জাগিবে নূতন দেশে।" [১২৯]

১৫ই অক্টোবর ১৯৩৮, রবীন্দ্রনাথ চেক জনগণের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি জানিয়ে চেক কবি ভি লেসনিকে চিঠি লিখলেন এবং তার সঙ্গে 'প্রায়শ্চিত্ত’ কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদটি পাঠিয়ে দিলেন। কবি লিখলেন, "আপনার দেশের জনগণ যে দুঃখভোগ করছে সে-সম্পর্কে আমার অনুভব এত তীব্র যে মনে হচ্ছে আমি তাদেরই একজন ছিলাম। আপনাদের দেশে আজ যা ঘটছে তা তো শুধুমাত্র স্থানীয় কোনো দুর্ভাগ্য নয় ... এই ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রকাশ পেল তিন শতাব্দীকাল ধরে পাশ্চাত্যের জনগণ মানবতার যে-সব নীতির জন্য চর্চা শহীদ হয়েছেন, সেগুলো রক্ষার ভার এসে পড়েছে কতিপয় কাপুরুষ রক্ষকের হাতে, যারা নিজেদের চামড়া বাঁচাতে গিয়ে সেগুলো বিকিয়ে দিচ্ছে। যখন এমনকি উৎপীড়করাও একে অপরকে মদৎ দিচ্ছে তখন যদি দেখা যায় যে গণতান্ত্রিক জাতিগুলি একে অপরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তখন আশাভরসা করার কিছু থাকে না।" [১৩০]

এরই মাঝে অতিবাহিত হয় কবির জন্মদিন। এই ক্ষণে ফ্যাসিবাদের চরম পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা জানিয়ে 'জন্মদিন' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন -

"ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা,
মাংসগন্ধ মুগ্ধ যাঁরা, একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা
শ্মশানের প্রান্তচর, আবর্জনাকুণ্ড তব ঘেরি
বীভৎস চিৎকারে তাঁরা রাত্রিদিন করে ফেরাফিরি,
নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।
শুনি তাই আজি
মানুষ-জন্তুর হুংকার দিকে দিকে উঠে বাজি।" [১৩১]
 
১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সরকারিভাবে আরম্ভ হল। পার্ষদ অমিয় চক্রবর্তীকে ‌২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ এ লেখা এক চিঠিতে‌ রবীন্দ্রনাথ সরাসরি ফ্যাসিজমের পরাজয় কামনা করলেন। লিখলেন, "এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব-ইতিহাসে ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না।" [১৩২] গতবছর দেশব্রতীতে লেখা একটি প্রবন্ধে, এই চিঠির সূত্র ধরে সৌভিক ঘোষাল লিখেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথ যে কোনও পরাশক্তির আগ্রাসন, দমন, শাসন, শোষণের উল্টোদিকে বরাবর দাঁড়িয়েছেন। তবু ফ্যাসিজম এমন একটা শক্তি যার তুলনায় ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের মত ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয়কেও তিনি শ্রেয় মনে করেছেন। ইংরেজের হাতে ভারতবর্ষের পরাধীনতা সত্ত্বেও এই অবস্থান এক ধরনের লেসার ইভিলকে বেছে নেওয়ার চেষ্টা।" [১৩৩] এই "লেসার ইভল" তত্ত্বের দ্বারা যে ফ্যাসিবাদ আটকানো যায় না, তা অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন খুব তাড়াতাড়িই। কারণ তিনি দিনের পর দিন দেখেছিলেন চীন, স্পেন, আবিসিনিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়া যখন ফ্যাসিস্ট শক্তিবর্গের দ্বারা আক্রান্ত, তখন প্রবল পরাক্রান্ত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকা এই পৈশাচিক আক্রমণের নীরব দর্শকমাত্র। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "দেখলুম দূরে বসে ব্যথিত চিত্তে, মহাসাম্রাজ্যশক্তির রাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে দেখতে লাগল জাপানের করাল দংষ্ট্রাপংক্তির দ্বারা চীনকে খাবলে খাবলে খাওয়া, অবশেষে সেই জাপানের হাতে এমন কুশ্রী অপমান বারবার স্বীকার করল যা তার প্রাচ্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনচ্ছায়ায় কখনও ঘটেনি। দেখলুম ঐ স্পর্ধিত সাম্রাজ্যশক্তি নির্বিকারচিত্তে এবিসীনিয়াকে ইটালির হাঁ করা মুখের গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেখল, মৈত্রীর নামে সাহায্য করল জর্মনীর বুটের তলায় গুঁড়িয়ে ফেলতে চেকোস্লোভাকিয়াকে ; দেখলুম নন-ইন্টারভেনশনের কূটিল প্রণালিতে স্পেনের রিপাবলিককে দেউলে করে দিতে - দেখলুম ম্যুনিক প্যাক্টে নতশিরে হিটলারের কাছে একটা অর্থহীন সই সংগ্রহ করে অপরিমিত আনন্দ প্রকাশ করতে।" [১৩৪] 'গ্রেটার ইভল' এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই 'লেসার ইভল'ই কে ভরসা করে আমরা যুগে যুগে কি প্রবঞ্চিত হচ্ছি না?

১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলেন। কবি তখন গভীর রোগশয্যায়। তাঁকে অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। অসুস্থতা ও শারীরিক বেদনার মধ্যেও কবি যুদ্ধ পরিস্থিতির খবরাখবর রাখছেন। ৩০শে জুলাই অস্ত্রোপচারের দিনের সকালে সস্ত্রীক প্রশান্তকুমার মহালনবীশ গিয়েছেন তাঁকে দেখতে। মহালনবীশ লিখেছেন, "যে দিন অপারেশন করা হয় সেদিন সকাল বেলা অপারেশনের আধঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা : ‘রাশিয়ার খবর বলো।’ বললুম, একটু ভালো মনে হচ্ছে, হয়তো একটু ঠেকিয়েছে।’ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, হবে না? ওদেরই তো হবে। পারবে, ওরাই পারবে।' তাঁর সঙ্গে আমার এই শেষ কথা। আমি ধন্য সেদিন তাঁর মুখের জ্যোতিতে আমি দেখেছি বিশ্বমানবের বন্দনা।" [১৩৫] রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বুঝেছিলেন। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। ফ্যাসিবাদের জয় ঠেকাতে ওরাই পেরেছিল। ওরাই পারে। "পারবে, ওরাই পারবে।"


তথ্যসূত্র :

১) পৃষ্ঠা ৬০, ন্যাশানালিজম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ম্যাকমিলান এ্যাণ্ড কোম্পানী লিমিটেড, ১৯১৮
২) পৃষ্ঠা ২০, রম্যাঁ রলাঁ ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৩) পৃষ্ঠা ১৭১, রবীন্দ্র রচনাবলী অষ্টম খণ্ড, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৪২
৪) এই জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীকে জেলে পাঠাত, গৌতম চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে অাগস্ট ২০১৬
৫) পৃষ্ঠা ১৮১, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
৬) রবীন্দ্রনাথ আপনি ইতালি কেন এলেন, পলাশ দত্ত, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই আগস্ট ২০১৩
৭) প্রাগুক্ত
৮) পৃষ্ঠা ১৮১, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
৯) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮১
১০) পৃষ্ঠা ২০৯, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
১১) ইতালিতে ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনির উত্থান, এস ইউ ডট এ আর ডট এন্টারটেইনমেন্ট, ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২০
১২) যার মাথা থেকে এলো ফ্যাসিবাদ, রাফিয়া মাহমুদ প্রাত, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৯শে নভেম্বর ২০২০
১৩) পৃষ্ঠা ৪-৫, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১৪) পৃষ্ঠা ১৭, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস প্রথম খণ্ড, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৫৫
১৫) পৃষ্ঠা ১৪২, রাজনীতি বিপ্লব কূটনীতি, কাশীকান্ত মৈত্র, রবীন্দ্র লাইব্রেরী, ১৯৬৩
১৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৬
১৭) পৃষ্ঠা ১, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১৮) পৃষ্ঠা ১৬৪, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৫২
১৯) রবীন্দ্রনাথ আপনি ইতালি কেন এলেন, পলাশ দত্ত, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই আগস্ট ২০১৩
২০) পৃষ্ঠা ১৮২, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
২১) পৃষ্ঠা ১৮৩, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
২২) পৃষ্ঠা ৫০৮, প্রবাসী ১৩৩২ পঞ্চবিংশ ভাগ প্রথম খণ্ড, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রবাসী কার্যালয়, ১৯২৫
২৩) পৃষ্ঠা ১৮৩, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
২৪) ফ্যাসিবাদ ও রবীন্দ্রনাথ, দেবযানী রক্ষিত, প্রবাহ প্রথম খণ্ড সংখ্যা ১, আগস্ট ২০১৬
২৫) পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৫৩
২৬) পৃষ্ঠা ১৮৩, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
২৭) পৃষ্ঠা ২১১, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
২৮) পৃষ্ঠা ১৮৮, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
২৯) পৃষ্ঠা ২৫২, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৩০) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৩১) পৃষ্ঠা ২২৭, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
৩২) পৃষ্ঠা ১৩, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
৩৩) পৃষ্ঠা ২২৭, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
৩৪) পৃষ্ঠা ২৫৭-২৫৮, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
৩৫) পৃষ্ঠা ২৭০, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৩৬) পৃষ্ঠা ১৬৩, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৫২
৩৭) পৃষ্ঠা ২৯২, রবিজীবনী নবম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৯
৩৮) পৃষ্ঠা ২৭০, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৩৯) পৃষ্ঠা ২৪৭, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
৪০) পৃষ্ঠা ৫১০, খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে, সৌরীন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৬৪
৪১) পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৫২
৪২) পৃষ্ঠা ১২৫, সাময়িকপত্রে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ : প্রবাসী, সোমেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৯৭৬
৪৩) পৃষ্ঠা ২০৪, পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা, ১৯৬১
৪৪) পৃষ্ঠা ১৫১, আত্মবিরোধী রবীন্দ্রনাথ, সুব্রত রায়চৌধুরী সম্পাদিত, তথ্যসূত্র পত্রিকা, ২০১৮
৪৫) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৪৬) পৃষ্ঠা ৮৫৪, প্রবাসী ২৬শ ভাগ প্রথম খণ্ড ১৩৩৩, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রবাসী প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯২৬
৪৭) পৃষ্ঠা ২৪৯, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
৪৮) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৪৯) পৃষ্ঠা ২৫১, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
৫০) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৫১) পৃষ্ঠা ২০৫, পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা, ১৯৬১
৫২) পৃষ্ঠা ৫১০-৫১১, খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে, সৌরীন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৬৪
৫৩) পৃষ্ঠা ২০৯, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬১
৫৪) রবীন্দ্রনাথের ছবি তুলেছিলেন মুসোলিনি, দিলীপ মজুমদার, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই ডিসেম্বর ২০১৯
৫৫) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৫৬) পৃষ্ঠা ২০৪, পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা, ১৯৬১
৫৭) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৫৮) পৃষ্ঠা ১৬৮, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৫২
৫৯) পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৪, রম্যাঁ রলাঁ কালিদাস নাগ করেসপনডেনস : দ্য টাওয়ার এ্যাণ্ড দ্য সি, কালিদাস নাগ সম্পাদিত, প্যাপিরাস, ১৯৫৬
৬০) পৃষ্ঠা ৩, শিল্পীর নবজন্ম, সরোজ কুমার দত্ত অনুদিত, অগ্রনী বুক ক্লাব, ১৯৪৬
৬১) পৃষ্ঠা ১০১, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৬২) পৃষ্ঠা ২০৭, পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা, ১৯৬১
৬৩) পৃষ্ঠা ১০১, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৬৪) পৃষ্ঠা ৭১, শিল্পীর নবজন্ম, সরোজ কুমার দত্ত অনুদিত, অগ্রনী বুক ক্লাব, ১৯৪৬
৬৫) পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৬৬) পৃষ্ঠা ১৭-১৮, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
৬৭) পৃষ্ঠা ১২৯, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৬৮) পৃষ্ঠা ৯১, কালান্তরের পথিক রম্যাঁ রলাঁ - প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৬৯) পৃষ্ঠা ১২৯, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৭০) পৃষ্ঠা ১৮৫, রম্যাঁ রলাঁ কালিদাস নাগ করেসপনডেনস : দ্য টাওয়ার এ্যাণ্ড দ্য সি, কালিদাস নাগ সম্পাদিত, প্যাপিরাস, ১৯৫৬
৭১) পৃষ্ঠা ৫২০, খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে, সৌরীন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৬৪
৭২) পৃষ্ঠা ১৮৬, রম্যাঁ রলাঁ কালিদাস নাগ করেসপনডেনস : দ্য টাওয়ার এ্যাণ্ড দ্য সি, কালিদাস নাগ সম্পাদিত, প্যাপিরাস, ১৯৫৬
৭৩) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৭৪) পৃষ্ঠা ২৬৬, আত্মবিরোধী রবীন্দ্রনাথ, সুব্রত রায়চৌধুরী সম্পাদিত, তথ্যসূত্র পত্রিকা, ২০১৩
৭৫) মুসোলিনির ফ্যাসিজমের ফাঁদে রবীন্দ্রনাথ, এম এ মোমেন, বণিক বার্তা, ২৭শে নভেম্বর ২০২০
৭৬) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৭৭) পৃষ্ঠা ২৭৭, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৭৮) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৭
৭৯) পৃষ্ঠা ১৪৭, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৮০) পৃষ্ঠা ৫২১, খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে, সৌরীন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৬৪
৮১) পৃষ্ঠা ২৭৮, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৮২) পৃষ্ঠা ১৯, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
৮৩) পৃষ্ঠা ১৫১, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৮৪) পৃষ্ঠা ২৮০-২৮১, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৮৫) রবীন্দ্রনাথ আপনি ইতালি কেন এলেন, পলাশ দত্ত, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই আগস্ট ২০১৩
৮৬) পৃষ্ঠা ১৪৮, রম্যাঁ রলাঁ : ভারতবর্ষ দিনপঞ্জী, অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৮৭) পৃষ্ঠা ১৯২, রম্যাঁ রলাঁ কালিদাস নাগ করেসপনডেনস : দ্য টাওয়ার এ্যাণ্ড দ্য সি, কালিদাস নাগ সম্পাদিত, প্যাপিরাস, ১৯৫৬
৮৮) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
৮৯) পৃষ্ঠা ৯১, কালান্তরের পথিক রম্যাঁ রলাঁ - প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৯০) পৃষ্ঠা ১৩১, সাময়িকপত্রে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ : প্রবাসী, সোমেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৯৭৬
৯১) পৃষ্ঠা ৯৪, কালান্তরের পথিক রম্যাঁ রলাঁ - প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত, র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, ১৯৬০
৯২) পৃষ্ঠা ৪২৮, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৯৩) পৃষ্ঠা ২৮২-২৮৩, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৯৪) পৃষ্ঠা ৩৪৬, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক চতুর্থ খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬৪
৯৫) পৃষ্ঠা ৪, শিল্পীর নবজন্ম, সরোজ কুমার দত্ত অনুদিত, অগ্রনী বুক ক্লাব, ১৯৪৬
৯৬) পৃষ্ঠা ৩৪৭, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক চতুর্থ খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬৪
৯৭) পৃষ্ঠা ৭২, শিল্পীর নবজন্ম, সরোজ কুমার দত্ত অনুদিত, অগ্রনী বুক ক্লাব, ১৯৪৬
৯৮) পৃষ্ঠা ২৯৩, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
৯৯) পৃষ্ঠা ৩৪৭, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক চতুর্থ খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৬৪
১০০) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
১০১) পৃষ্ঠা ২৯৫, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, দেজ পাবলিশিং, ১৯৬৩
১০২) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪৪
১০৩) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৬৬-৪৬৭
১০৪) পৃষ্ঠা ২২, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১০৫) পৃষ্ঠা ৫৬, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ তৃতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, পুস্তক বিপণি, ১৯৯৭
১০৬) পৃষ্ঠা ১২৬, পত্রধারা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৩৮
১০৭) পৃষ্ঠা ৫৭, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ তৃতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, পুস্তক বিপণি, ১৯৯৭
১০৮) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
১০৯) বেনিতো মুসোলিনির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশিস পাঠক, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ই অগস্ট ২০১২
১১০) পৃষ্ঠা ২৮০, আত্মবিরোধী রবীন্দ্রনাথ, সুব্রত রায়চৌধুরী সম্পাদিত, তথ্যসূত্র পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩
১১১) মুসোলিনি এ্যান্ড টেগোর, কল্যাণ কুণ্ডু, পরবাস ডট কম, ৭ই মে ২০০৯
১১২) পৃষ্ঠা ২৫৩, ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ভলিউম ২৮ তৃতীয় সংখ্যা, সাগে পাবলিকেশনস, ১৯৯১
১১৩) রবীন্দ্রনাথ আপনি ইতালি কেন এলেন, পলাশ দত্ত, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই আগস্ট ২০১৩
১১৪) পৃষ্ঠা ২১, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১১৫) পৃষ্ঠা ২৪, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস প্রথম খণ্ড, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৫৫
১১৬) রবীন্দ্রনাথের মুসোলিনি, দেবদত্ত গুপ্ত, বঙ্গদর্শন ডট কম, ২৪শে মার্চ ২০১৭
১১৭) পৃষ্ঠা ৪৯-৫০, রবীন্দ্র রচনাবলী বিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৬৭
১১৮) পৃষ্ঠা ২৭, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১১৯) পৃষ্ঠা ৪৮, রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাবিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৭১
১২০) পৃষ্ঠা ২৮, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১২১) পৃষ্ঠা ৫১, রবীন্দ্র রচনাবলী বিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৬৭
১২২) পৃষ্ঠা ২৯, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১২৩) পৃষ্ঠা ১১-১২, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৫৮
১২৪) পৃষ্ঠা ১১, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৫৮
১২৫) পৃষ্ঠা ৪৫২, ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ তৃতীয় খণ্ড, নেপাল মজুমদার, পুস্তক বিপণি, ১৯৯৭
১২৬) পৃষ্ঠা ২৫২, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৫৮
১২৭) পৃষ্ঠা ১৯, রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাবিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৭১
১২৮) পৃষ্ঠা ৩২, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১২৯) পৃষ্ঠা ১০-১১, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৫৮
১৩০) পৃষ্ঠা ৩৩, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১
১৩১) পৃষ্ঠা ২৮, রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বাবিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, ১৯৭১
১৩২) পৃষ্ঠা ৩০৫, চিঠিপত্র একাদশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৭৪
১৩৩) সভ্যতার সংকটের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ, সৌভিক ঘোষাল, দেশব্রতী, ৭ই মে ২০২০
১৩৪) পৃষ্ঠা ৩০৪-৩০৫, চিঠিপত্র একাদশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৭৪
১৩৫) পৃষ্ঠা ৩৯, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিভক্ত বাংলা, সুস্নাত দাশ, প্রাইমা পাবলিকেশনস, ১৯৬১