পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্যচিত্র : কিছু খোঁজখবর

পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগে আজ থেকে উনপঞ্চাশ বছর আগে, 1972 সালে 5 জুন সুইডেনের স্টকহোমে ‘পরিবেশ বান্ধব’ নামে আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন শুরু হয় মহাসমারোহে, চলে 16ই জুন পর্যন্ত। সেই বছর 15ই ডিসেম্বর ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল এনভার্নমেন্ট প্রোগ্রাম’ নামে একটি সংস্থা গঠিত হলে পরের বছর থেকে 5ই জুনকে বিশ্বপরিবেশদিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সময় থেকেই ভারত সহ সারা বিশ্বে পরিবেশ দূষণ নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোরও হিড়িক পড়ে যায়। 1989 সাল থেকে পরিবেশ বিষয়ক তথ্যচিত্রে জাতীয় পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরিবেশকে রক্ষা করতে এবং পরিবেশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ‘জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ নিয়মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শন করলেও তা কতটা সফল হচ্ছে প্রশ্ন থেকেই যায়! মানব সভ্যতার চরম রসিকতা হল, একদিকে তথ্যচিত্র পুরস্কৃত হচ্ছে অন্যদিকে হাটে পশুপাখি বিক্রি হচ্ছে - রেস্তোঁরায় বা খাদ্যমেলায়  কচ্ছপ, হাঙ্গর, অক্টোপাসের মত নিষিদ্ধ প্রাণীর মাংসের মহোৎসব হচ্ছে।

পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পরিচালক মাইক পান্ডের ‘শোরস অফ সাইলেন্স’ নামের তথ্যচিত্রটির বেশ গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ছবিটি গ্রিন অস্কার পেয়েছিল গুজরাটের সমুদ্র-উপকূলে( সৌরাষ্ট্র কোস্ট ) হাঙ্গর শিকার ও বিরল প্রজাতিটির অবলুপ্তির কারণ সান্ধানের জন্য। মোট দশটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার রয়েছে এ ছবির ঝুড়িতে। অতিকায় জলজ প্রাণীটিকে বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে মুনাফার লোভে নৃ্সংশ ভাবে শিকার করার ছবি তুলেছিলেন পরিচালক। আহত অথচ জীবন্ত প্রাণিটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে টুকরো করার দৃশ্যগুলি শিহরিত হবার মত। মানুষের পাশবিক আচরনের সাক্ষী এই দৃশ্যগুলি মানব সভ্যতার উন্নতশিরকে অবদমিত করতে বাধ্য করে। ছবিটি যে কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য তা হল,  2000সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি  সামুদ্রিক প্রাণীর দুর্দশার চিত্র দেখিয়ে 1972 সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রশাসনকে দিয়ে তিমি হাঙ্গরমাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করাতে সক্ষম হয়।

 এ প্রসঙ্গে আর একটি ছবির নাম উল্লেখ করা যায় তা হল ‘ফিস ওয়ারস’(2019), পরিচালক অলি ওয়ার্ক। ভিয়েতনামে মেকং ডেল্টায় রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাছ পাঙ্গাসিয়াসএর ঝুড়ি। এই মাছ ডোরি বা ক্যাটফিস নামেও পরিচিত। অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে তাদের অস্তিত্বও সংকট জনক। বহু মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি শিল্পের শিকার এরা। অবৈধ  ভাবে টন টন মাছ কীভাবে প্যাকেট করে বাজারে যাচ্ছে, মুনাফার লোভে ছোট বড় সমস্ত মাছ জল থেকে তুলে আনা হচ্ছে তা দেখানো হয় ছবিটিতে।  আরও  একটি ছবিতে সলমন মাছের বিপন্নতার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে , নাম ‘দ্য আরটিফিসিয়াল’।

শুধু মাছ নয়, সমস্ত জলজ প্রাণী আজ সংকটে। ক্ষতিকারক রাসায়নিক বর্জ্য, প্লাস্টিকের আবর্জনা ক্ষতি করে চলেছে তাদের, কচ্ছপ সহ বেশকিছু বিরল প্রাণী জেলিফিস ভেবে প্লাস্টিক খেয়ে মারাও যাচ্ছে। ক্রিস জর্ডনের ‘আলবাট্রস’ ছবিতে দেখান হয় প্রশান্ত মহাসাগরের মিডওয়ে দ্বীপে্র আলবাট্রস পাখিগুলি নিদারুন ভাবে প্লাস্টিক খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে। আলবাট্রসের হাজার হাজার বাচ্চার মর্মান্তিক মৃত্যু হচ্ছে ভুল করে এই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলার জন্য। পরিচালক ক্রিস জরডন বেশ কিছুদিন মিডওয়ে দ্বীপে থাকার ফলে কিছু মর্মান্তিক দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্লাস্টিক আমদের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হইয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিচালক ক্রেগ লিজন এর ‘এ প্লাস্টিক ওশন’ ছবি ও বি বি সি এর ‘ওয়ার্ল্ড ফুল অফ প্লাস্টিক’ ছবিতে দেখান হয় বিশেষ কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্য প্লাস্টিক ব্যবহার করা শুরু করলেও পরে এই প্লাস্টিক ভয়ানক সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে। প্লাস্টিক পচনশীল না হওয়ায় তাকে রিসাইকেলিং করা ছাড়া উপায় নেই। আবার প্লাস্টিকের জলের বোতলগুলি খুব বেশি পুনর্ব্যবহারযোগ্যও নয়। তাই ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই বর্জ্য প্লাস্টিক বেশিরভাগ গিয়ে পড়ে জলে।  সমুদ্রের জলে মাছধরার সময় জালে যে পরিমান প্লাস্টিক ওঠে তাতে অনুমান করা যায় আগামী 2025 সালের মধ্যে তিন টন মাছ উঠলে একটন প্লাস্টিক উঠবে। এমনই ভয়াবহ দূষণের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি আমরা।

 বরতমান পরিস্থিতি আরও সংকটজনক। কোভিড-19 সংক্রমণের কারণে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠায় তা আশ্চর্যজনক ভাবে বেড়ে গেছে।  ‘ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’র রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি মাসে 12900 কোটি মাস্ক ও 6500 কোটি গ্লাভস ব্যবহৃত হচ্ছে। মাস্ক গুলো বেশিরভাগই তৈ্রি হচ্ছে বিশেষ ধরণের পলিহাইড্রোকার্বন দিয়ে( পলপ্রপলিন,পলিইথিলিন,পলিএস্টার,পলিস্টাইরেন জাতীয় )। আর এই মাস্ক জলে বা মাটিতে বর্জ্য হিসেবে গেলে তা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামক আনুবিক্ষণিক বিষ ছড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে  এর সম্পুর্ণরূপে পচন হতে সময় লাগে প্রায় 450 বছর। সুতরাং এই বিষ জল ও মাটিতে উৎপন্ন খাদ্যদ্রব্যে  মিশে জীবজগতকে অসুস্থ করে তুলবে অচীরেই।

 জলজ প্রাণীর মত স্থলজ প্রাণীরাও একই ভাবে সংকটাপন্ন। ভালো নেই ওরাও।

গত শতাব্দীর সাতের দশকে বিজ্ঞানের হাত ধরে বন্যপ্রাণীরা জীবের সংকরায়্ণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এই গবেষণা শুরু হয়েছিল কলকাতায়। আলিপুর চিড়িয়াখানায় রূদ্রাণীর জন্ম হইয়েছিল ১৯৭২ সালে, তার বাবা  ছিল ভারতীয় বাঘ আর মা আফ্রিকান সিংহী। পরে 1985 সালে এই রূদ্রাণী ও একটি বাঘের (প্যান্থার টিইগ্রিস) সংকরায়ণ ঘটিয়ে জন্ম হয় কিউবানাকান এর। এরপরই বিশ্বজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। বিগক্যাট হিসাবে গিনেস বুকে নাম ওঠে কিউবানাকানের। আমেরিকা সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এই সংকরায়ণকে অনুসরণ করে । শুধুই বিজ্ঞানের গবেষণা ছিলনা এর কারণ, চিড়িয়াখানায় দর্শক টানার জন্য এই অনুচিত নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া চালান হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তবে সুদূর ভবিষ্যতে এই সংকরায়াণের ফলে নিদারুন কষ্টের মুখে পড়ে বিলুপ্ত হতে পারে বিশুদ্ধ প্রজাতি এই সংশয়ে বিশ্বের সমস্ত দেশেই কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়। সে যাত্রা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেলেও অবৈ্ধ শিকার আর নিরাপদ বাসস্থানের অভাবে অস্তিত্ব রক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে।

বেদী ব্রদার্স ( অজয় ও বিজয় বেদী ) পরিচালিত ‘চেরাব অফ দ্য মিস্ট’ ছবিতে ভারতে রেডপান্ডার মত বিরল প্রজাতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন।  দেখা যায় ভারতে তাদের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে, তবে তা সংখ্যায় এক হাজারও নয়, তারা সংখ্যায় তুষার চিতা বা বড় বিড়ালের চেয়েও কম।

আর একটি ছবি, শেখর দত্তাত্রীর ‘দ্য ট্রুথ অফ ট্রাইগারস’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এই ছবিতে দেখান হয় বাঘের প্রাণহাণীর পিছনে প্রকৃত কারণ। এও দেখিয়েছেন বাঘ ভারতের জাতীয় প্রাণী হলেও  বাচ্চা বাঘের সংখ্যা আশ্চর্য জনক ভাবে কম রয়েছে। বাঘের সংখ্যা কমে যাবার কারণ  ছবিতে যেমন বঝিয়েছেন তেমনি বাঘের সংখ্যা বাড়াতে কিছু কর্তব্যের কথাও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তুলে ধরেছেন পরিচালক। পরিচালক মাইক পাণ্ডের ‘দ্য ভ্যানিশিং ভালচারস’ ছবিও শকুনের অস্তিত্ব সংকটের কথা শোনায়। এ ছবিতে বলা হচ্ছে 99% প্রজাতি মুছে ফেলা হয়েছে। ডাইক্লোফেনাক নামের একটি সাধারণ ভেটেরিনারি ড্রাগ এই প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। এই ছবিটি ভারতের ড্রাগ কন্ট্রলার জেনারেলকে এই ভেটেরিনারি ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করতে 2006 সালে নির্দেশ জারি করতে প্ররচিত করেন। ‘দ্য প্যাক-ওয়াইল্ড ডগ ডাইরিস’ ছবিতে পরিচালক কৃপাকর ও সেনানী মাত্র ৪৭ মিনিটে ভারতের বন্য কুকুরের জীবন যাপন, আবেগ ও হিংস্র শিকারের প্রবনতা দেখাতে সক্ষম হন। এই ছবির জন্য একাধিক পুরস্কার ও পায়। ভল্লুকনাচ দেখানো কালান্দার গোষ্ঠীর একটি পেশা। ভল্লুকরা এদের নির্যাতনের শিকার হয়। এই ভল্লুকদের পুনর্নির্বাসনের পথ খুঁজেছেন পরিচালক রিতা ব্যানার্জী তাঁর ছবি ‘এ ডান্স টু ফরগেট’ এ। কালান্দারদের একটি গোষ্ঠী জীবিকা নিরবাহের জন্য বন্য প্রাণীকে বেছে নিত। ভল্লুক নাচ দেখান যাদের পেশা ছিল তারা এই পেশা ছেড়ে দেওয়া্র ফলে একদিকে ভল্লুকগুলি অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে অন্যদিকে তারা বিকল্প পেশায় সন্তুষ্ট রয়েছে। মহিলা ক্যামেরাম্যান, মহিলা পরিচালক ও মহিলা সম্পাদক মিলে এ ছবিতে একটি সাফল্যের গল্প শোনায় আমাদের।

 

 পরিবেশ নিয়ে তথ্যচিত্র তৈ্রি প্রসঙ্গে একটু পিছন ফিরে তাকান যাক।  মনুষ্যেতর প্রাণীকে নিয়ে প্রথম এই ধরণের ছবি তৈ্রি করেন ওয়াল্ট ডিজনি। পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো বা পরিবেশ দূষণ তুলে ধরা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষ ভাবে অর্থনৈতিক চাপে পড়ে এই অ্যানিমেশন চিত্রপরিচালক তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন যা নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বেশ কিছু টাকা ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে আটকে থাকায় তিনি আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছিলেন।  ‘ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জেই খরচ করতে হবে’ এই শর্তে টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি পেলে বাধ্য হয়ে 1950 সাল থেকে 1954 সালের মধ্যে ডিজনি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে মোট চারটি ছবি করেন। এই ‘লাইভ একশন’ ছবিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছবি ট্রেজার আইল্যান্ড (‘Treasure Island’)। এই সময় ছবিগুলি ডিজনিকে আর্থিক সহযোগিতা করলেও তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে ‘লাইভ একশন’ ছবি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। তাই তাঁর স্টুডিওর পরিকাঠামো ও অন্যান্য ব্যবস্থার এমন ভাবে পরিবর্তন করেন যাতে অ্যানিমেশন ছবি ছাড়াও অন্য ধরনের ছবি নির্মাণ করা যায়। ডিজনি স্টুডিওর একটা বড় সুবিধা ছিল, তাঁদের অ্যানিমেশন ছবির কাজের অভিজ্ঞতা। নতুন ধরনের কাজের আগ্রহ ও দক্ষতা থাকায় ডিজনি এমন ধরনের ছবি করার কথা ভাবলেন যেটি হবে সত্যিই নতুন বিষয় ও নতুন মেজাজের ছবি,  যে ছবি নতুন ধারার প্রবর্তন করবে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সীমানা আলাস্কার প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষ ও জীবজন্তুর জীবনযাপনের চিত্তাকর্ষক ছবি তুলতে চেয়েছিলেন।  কম খরচে ছবি তৈরির জন্য যোগাযোগ করেছিলেন আলাস্কার এক ক্যামেরা বিক্রেতার সঙ্গে, নাম  Al Milotte। Al Milotte এবং তাঁর স্ত্রী Elma দুজনেরই 16m.m ক্যামেরা দিয়ে আলাস্কা ঘুরে বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক ছবি তোলেন - সলমন মাছ ধরার ছবি, সোনার সন্ধানে প্রসপেক্টিং, তামার খনির কর্ম পদ্ধতির ছবি তোলেন। এই সঙ্গে সীলের এক প্রজাতি, লোম ওয়ালা সীলেদের প্রজনন ও শাবকদের বড় করে তোলার ছবি তোলেন।  সেই ছবি ডিজনির স্টুডিওতে এসে পৌঁছালে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করে ‘Seal Island' নামে সাতাশ মিনিটের একটি ছবি নির্মাণ করা হয়, ছবিটি মুক্তি পায়  1949 সালে। সেই বছরেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিটি অস্কার পুরস্কার পায়। এই ভাবে শুরু হয় ডিজনির ‘True life Adventure series’। 1950 থেকে 1960এর মধ্যে ডিজনি স্টুডিও থেকে এক ডজনেরও বেশি  True life adventure series এর ছবি  তৈ্রি হয়। সীমান্তের ছবি তুলতে গিয়ে ডিজনি আবিষ্কার করেন চলচ্চিত্রের নতুনদিগন্ত। সেই সময় ডিজনির ‘ The True life adventure’ কে অনুসরণ করে বহুপরিচালক তথ্যচিত্র তৈরি করলেও ডিজনি স্টুডিওর ছবিগুলি স্বতন্ত্রতার দাবি রাখে। সেইসঙ্গে মানুষকে পরিবেশপ্রেমী করে তুলতে ছবিগুলির অবদান অনস্বীকার্য।

আমরা এই মনুষ্য জাতিটা অন্যান্য প্রাণীদের কথা তো নয়ই, নিজেদের ভবিষ্যতের কথাও ভাবিনা, তার চাক্ষুষ প্রমাণ ম্যনগ্রোভ ও সেক্রেডগ্রোভ সহ অন্যান্য বনাঞ্চলের আয়তন ও সংখ্যার ক্রমহ্রাসমানতা, প্লাস্টিকের কারখানা রমরমিয়ে চলা, জলে নির্দ্বিধায় বর্জ্য ফেলা, কৃ্ষিক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ করা। বর্তমানে করোনায় মৃত বিষাক্ত লাশও নির্মম ভাবে নদির জলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণ পর হাত ঘুরিয়ে আবার সেই জলই আমরা জল পান করছি।

 অরণ্য সংকচনের ফলে বন্যপ্রাণীর বাসস্থানের নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে অক্সিজেন যেমন কমছে, তেমন কমছে আমাদের সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। আজ সুন্দারবনে সুন্দরীগাছ খুঁজে খুঁজে দেখতে হয়, এখানকার গরান, হিজল, গেওয়া গাছও হারিয়ে যেতে বসেছে।  এ প্রসঙ্গেও আর একটি তথ্যচিত্রের কথা বলা যায়- একটি নির্জন বনে কাঠমাফিয়াদের বিরুদ্ধে এক বনদপ্তরের অফিসারের লড়াইকে তুলে ধরেছে একটি বিখ্যাত ছবি ‘বনানী(১৯৮৯)’। ছবিটি ১৯৮৯ সালে জাতীয় পুরস্কার পেলেও এর ত্রিশ বছর পর হাহাকার শুনি ‘আরোগ্যের জন্য ঐ সবুজের ভীষণ দরকার’/ ‘চোখ শুধু সবুজ চায়, দেহ চায় সবুজ বাগান’।

প্রাচীন কালে ভারতের মত বিশ্বের সব দেশেই পবিত্র অরণ্য ছিল। তখন দেবদেবীর পুজোর জন্য একটি করে বড় অরণ্য বা জঙ্গল রাখা হত। এই জঙ্গলেরই বড় গাছকে দেবতা রূপে পুজো করা হত। কোনও কো্নও জঙ্গলে মন্দিরও থাকত, ধর্মের অজুহাতে সেখানে গাছকাটা নিষিদ্ধ ছিল, পশুপাখি নিরাপদে সেখানে থাকতে পারত। যে কোনো ধর্মের মানুষের যাবার অধিকার ছিল সে সব জঙ্গলে। কোনও কোনও জঙ্গলে বিশেষ দিনে মেলাও বসত। এই পবিত্র অরণ্যগুলি সুরক্ষিত আশ্রয় ছিল পশু পাখিদের জন্য। ব্র্যান্ডিস  রচিত ‘ইন্ডিয়ান ট্রিস’ (1906) বই এ ভারতের বেশ কয়েকটি সেক্রেড গ্রোভকে চিহ্নিত করেন। ভারতের হিন্দু গ্রোভ, মাওফ্লাং গ্রোভ, গ্রিসের ওক গাছের বিখ্যাত দোদোনা গ্রোভএর মত অসংখ্য গ্রোভ আজ ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশকে দূষনের হাত থেকে বাঁচাতে, পশুপাখিকে আশ্রয় দিতে এদের অবদান অনস্বীকার্য। স্যাক্রেড গ্রোভ, ম্যানগ্রোভ, পৃথিবীর ফুসফুসে অক্সিজেন যোগায়। বর্তমানে সেগুলোও সংখ্যায় কমছে আশ্চর্য জনকভাবে।  

এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আলোচ্য বর্তমান করোনাকালীন পরস্থিতি। বিশেষ করে ভারতে, মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় শবদাহ করার জন্য হঠাৎ করেই অতিরিক্ত পরিমানে কাঠের প্রয়োজন হয়ে পরেছে। শুধুমাত্র দিল্লিতে গত একমাসে কাঠের প্রয়োজন হয়েছে 10000 কুইন্টাল। এমনিতেই প্রতিটি চিতায় প্রায় তিন থেকে চার কুইন্টাল কাঠ লাগে, তাই দিল্লিতে সরকারিভাবে 200টি বড়গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রজেক্টে আরও 60 টি গাছ কাটা হয়েছে। এ ছবি শুধু দিল্লিতে নয় সারা দেশ জুড়ে। এই সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখাও এখন দঃসাহসের সামিল।

আজ কান পাতলে শোনা যায় নীরব আর্তনাদ-

  “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।

লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,

হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সরবগ্রাসী,

দাও সে তপোবন পুন্য ছায়ারাশি,

গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,

সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,”-

আমাজনএর রেইন ফরেস্ট নিয়ে তৈরি হওয়া আর একটি ছবি ‘গারজেন্স অফ দি আমাজন’(2020), পরিচালক ব্রায়ান এপস্টাইন। আমাজনের বনাঞ্চল আয়োতনে বাড়লেও রাষ্ট্রের উন্নয়নের কারণে তা ধ্বংসের মুখে চলে যাচ্ছে। বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণ যাদের দায়িত্ব তারাই সঙ্কুচিত করে চলেছে একটু একটু করে। সেই সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে।

ভারতের জুলজিক্যাল সারভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর সম্প্রতি জলের ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এখনই সতরক না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ জল সংকটে পড়তে হবে আমাদের।

এ প্রসঙ্গে আদিনাথ কোঠারের ‘পানি’ ছবিটির কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে একটি শুষ্ক গ্রামে পাণীয় জলের অভাব করুন পরিস্থিতি তৈ্রি হয়। জলের অভাব ঠেকাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মানুষ। ‘স্টোরি অফ ওয়াটার’ এ আয়ারলান্ড এ কী ভাবে দুর্গম অঞ্লের প্রাকৃ্তিক উৎস থেকে পাণীয় জলের পরিশুদ্ধ করে আনা কতটা খরচ ও কষ্টসাধ্য তা দেখানো হয়। অথচ সাধারন মানুষ অবলীলায় পাণীয় জল দিয়ে গাড়ি ধুয়ে, অপ্রয়োজনে টয়লেটে ব্যবহার করে বা গৃহস্থ কাজে নির্বিকারে অপচয় করছে যা অদূর ভবিষ্যতে পাণীয় জলের অভাব বয়ে আনবে। আর একটি ছবি ভারতের পাঞ্জাবের জলাভাবের কথা শোনায়, পাঞ্জাবের এই অঞ্চলটি শুষ্ক হয়ে  যাওয়ায় সেখানকার মানুষকে জল কিনে খেতে হচ্ছে। প্রায় মরুভূমিতে পরিনত অঞ্চলটিতে প্রশাসন থেকে প্রতিদিন মাথাপিছু আট লিটার করে জল দিয়ে যায়, বাকি জল কিনতে হয়।  এই অঞ্লের মানুষ জলসংকটের কারণে অত্মহত্যা করে যা প্রশাসন স্বীকার না করলেও সত্যি বলে প্রমাণ করেন পরিচালক। ছবির নাম ‘H2woe:India’s water crisis-Warning to the World’।  প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত একটি ছবির কথা উল্লেখ করা যায়। দক্ষ পরিচালক মাইক পান্ডের ‘শরেস অফ সাইলান্স’ ছবিতে মাত্র দুটি দৃশ্যের মাধ্যমে দেখিয়েছেন গুজরাটের গ্রামের পাণীয় জলের অভাব। একটি নলকূপ আর অসংখ্য কলসএর দৃশ্য বুঝিয়ে দেয় জলের হাহাকার।

একদিকে সীমাহীন দূষণ আর অন্যদিকে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে শূন্যে দড়ির উপর হাঁটছি আমরা। ভুলে যায় পরিবেশ বন্ধুদের এত সচেতনতা বাড়ান সত্বেও পরিবেশ বন্ধুরা হারিয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত। পরিবেশ নিয়ে ‘World Wild life Fund for Nature’ প্রতি দু বছর অন্তর লিভিং প্ল্যানেট রিপর্ট দেয়। 2020 সালের রিপোর্ট অনুযায়ী 1970 সাল থেকে 2016 সাল পর্যন্ত  নদী  বা জলাভূমিতে বসবাসকারী প্রাণীর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমেছে। এদের হারিয়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান গিয়ে দাঁড়ায় 84 শতাংশ। এ ছাড়া পাখি, মাছ, উভচর প্রাণি, সরিসৃ্প প্রভৃতির সংখ্যা কমেছে 68 শতাংশ। আঞ্চল বিশেষে  এর চিত্রটা দাঁড়ায়, আমাজন জঙ্গল সহ দক্ষিণ আমেরিকায় প্রাণীর অবলুপ্তি 94 শতাংশ, আফ্রিকা মহাদেশে 65 শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় 45 শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় 33 শতাংশ এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় 24 শাতাংশ। এই পরিসংখ্যান পরিবেশবিদদের তো বটেই পরিবেশ সচেতন মানুষের কপালেও ভাঁজ ফেলেছে।

  “Learn to know, Learn to do, Learn to be and Learn to live together.” যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য হয় তবে এই live together কথাটির অর্থ কি পাড়া বা গ্রাম বা দেশের সব মানুষকে নিয়ে সকলকে নিয়ে মিলে মিশে থাকা? বৃহত্তর অর্থে এই বিশ্বের সমস্ত প্রাণীকূলের সঙ্গে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়াতেই মূল উদ্দেশ্য লুকিয়ে নয়কি?। বাইবেল, কোরান, গীতা, ত্রিপিটক সবেতেই একই কথা রয়েছে ‘অহিংসা’। পুরানের সব দেবতার সঙ্গে একটি করে মনুষ্যেতর প্রাণী রাখার প্রচলন আছে, বাহনের অজুহাতে অন্যপ্রাণীকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে। সেখানে তাদের সংরক্ষণ ও যত্নের ঈঙ্গিত রয়েছে।

  বর্তমানে আকণ্ঠ দুষণ আর অতিমারীর ছোবলে অস্তিত্ব সংকট আমাদের এতটাই শ্বাসরূদ্ধ যে  ‘ডানদিকে গিরিখাত আর বাঁদিকে ধস’ দেখে বাঁচার জন্য ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’র সময়ও অতিক্রান্ত। এতদিন বিপন্ন প্রাণীদের আর্তনাদ আমাদের কানেই পৌঁছাইনি, আজ আমাদের আর্তনাদও তার সঙ্গে মিশে গেছে।। আমরা যদি  নতুন করে জেগে উঠে ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ কথাটি শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দি্ই বৃহৎ প্রাণীকূলের উদ্দেশ্যে তবে এ বিশ্ব সকল জীবের বাসযোগ্য হইয়ে উঠবে। আর তখনি পুরস্কৃত করা হবে পরিবেশকে।

 

 

 *************************************

তথ্যসূত্র-

1) তথ্যচিত্রের কথকতা- ঋত্বিক সিনে সোসাইটি।

2) ‘শহরের স্বার্থেই জলাভূমি  বাঁচানোর আবেদন’ – আনন্দ বাজার পত্রিকা, 20শে মার্চ, 2019।

3) ‘ক্ষত নিয়েও নগরের বিষ টেনে নিচ্ছে নীল কন্ঠ’-এই সময়, 28শে জুন, 2018

4) মেহেবুব কাদের চৌধুরী- আনন্দ বাজার পত্রিকা.-24 শে মে, 2021

5) ‘এন্সেফ্যালাইটিস রোধে হু এর বাজি পাতিহাঁস’ (রাহুল রয়)-আনন্দ বাজার পত্রিকা, 25 শে জুলাই, 2014

6)’ প্রতিদিন নতুন বিপদ বাড়ছে’ (আদিত্য ঘোষ)-আনন্দ বাজার পত্রিকা -3ই জুন 2021

7)  ‘ঘরে ডেকে আনা মৃত্যু’- (কল্যান রুদ্র)- আনন্দ বাজার পত্রিকা। 5ই জুন, 2021