ভয় আর ভূতের ভাষ্য

১.

এই লেখা লিখছি যখন, তখন শিয়রে উপস্থিত সিনেম্যাটোগ্রাফ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২১, যা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছে কিছু 'পুনরীক্ষণ (revisionary) ক্ষমতা'। এই বিল পাশ হলে, সেন্সর বোর্ড যে ছবিকে ছাড়পত্র দিয়েছে, তাকেও দর্শকের মতামতের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ করে দিতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। তা নিয়ে নন্দিতা দাস, অনুরাগ কশ্যপ, শাবানা আজমি প্রমুখ পরিচালক ও অভিনেতারা কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠি বলছে, এমন নিয়ম চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের রাষ্ট্রের হুমকি ও ভীতিপ্রদর্শনের সামনে শক্তিহীন করে দেবে। 'ভীতিপ্রদর্শন' কথাটির সমার্থক ইংরেজি শব্দ হিসেবে চিঠিতে পাচ্ছি 'intimidation' আর 'threat' কথাদুটি। ঘটনাচক্রে, বর্তমান নিবন্ধের বিষয়ও ভীতি। এবং সিনেমাও।

ভয়, যাকে জোর করে অস্বীকার করাতেই পুরুষকার, তা কি আমাদের ঘটমানতার অঙ্গ নয়? বলা বাহুল্য, জনমানসে ভয় চারিয়ে দেওয়া রাজনীতির অঙ্গ আজ। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রথমে 'অপর'-এর ধারণা তৈরি করে। এডওয়ার্ড সাইদ বলেছিলেন 'ফিয়ার অফ দ্য আদার'-এর কথা। সেই অচেনা, অজানা অপরের প্রতি ভয় ক্রমশ পরিণত হয় ঘৃণায়- যে ঘৃণাকে জিইয়ে রাখা দরকার রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রয়োজনে। সেই সঙ্গে জুড়ে যায় আপন অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ভয়। কখনও বেনাগরিক হওয়ার ভয়, কখনও রাষ্ট্রদ্রোহী চিহ্নিত হওয়ার ভয়। নবারুণের 'আমার কোনো ভয় নেই তো?' গল্পে ভীতু, নির্বিবাদী বীরেন হাজার বার হাজার জনকে জিজ্ঞাসা করত, 'আমার কোনো ভয় নেই তো?' রাষ্ট্র-নির্ধারিত ভয়ের আবহেই জনমানুষের ঘোরা-ফেরা। অথচ ভয়ের উৎস হিসেবে সে প্রায়শ চিহ্নিত করে রাষ্ট্রনির্ধারিত 'অপর'-কে, স্বয়ং রাষ্ট্রকে নয়।

প্রাথমিক ভাবে ভয় এক শক্তিশালী, আদিম অনুভূতি। তা জরুরিও। তা শারীরিক-মানসিক বা অন্য যে কোনো রকম বিপদের উপস্থিতি বা ক্ষতির সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করে। অবশ্য ভয় ততক্ষণ পর্যন্ত অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক, যতক্ষণ না তা আতঙ্কজনিত ব্যাধিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। মনোবিদরা বলেন, ভয় 'ফাইট অর ফ্লাইট অর ফ্রিজ' প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ভয়ে ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা হতে পারে (ফ্রিজ)। তা না হলে মানুষ পালাতে পারে (ফ্লাইট)। তৃতীয় এক উপায় আছে, তা হল প্রতিরোধ (ফাইট)৷

এখন, যদি 'ভয়' নামক রাষ্ট্রের এই হাতিয়ারকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা যায়? ভয়ের এক ভিন্ন, কাউন্টার- ন্যারেটিভ যদি তৈরি করা যায়? যদি এমন আখ্যান গাঁথা যায়, যেখানে রাষ্ট্রের কল্যাণকর মুখোশ ছিঁড়ে তারই ভয়ংকর মুখটি উন্মোচিত হয়ে পড়ে?

লক্ষনীয়, চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজ জগতে ইদানিং দেখা যাচ্ছে ভয়ের ছবিদের আনাগোনা। তাদের মধ্যে এমন ভাবে বোনা আছে সামাজিক ভাষ্য যে, তাদের কেবল ফ্যান্টাসি হিসেবে বরখাস্ত করা যাচ্ছে না। কারণ  বিভীষিকাগুলি বড় চেনা ঠেকছে। আমেরিকায় ট্রাম্পের শাসনকালে যখন অরাজনৈতিক নাগরিকও বুঝতে পারছিল যে তার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তখন জর্ডন পিল নিয়ে এসেছিলেন 'গেট আউট' (২০১৭)-এর মতো ছবি, যা আদতে একটি থ্রিলার বা হরর ফিল্ম, অথচ আমেরিকান প্রগতিশীল লিবারালদের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে যে বর্ণবিদ্বেষ, তাকে নগ্ন করছে ছবিটি। ২০১৯ সালে ম্যাত বেত্তিনেলি-ওলপিল আর টাইলার গিলেট আরেক ব্ল্যাক কমেডি সৃষ্টি করছেন, 'রেডি অর নট'।  সেখানে এক পরাবাস্তব দুনিয়ায় এক অভিজাত বংশের বধূ হওয়ার জন্য একটি মেয়েকে নানা ভয়ংকর প্রাণঘাতী 'খেলা'-য় অংশ নিতে হয়। এখানেও 'আমরা' বনাম 'ওরা'-র দ্বৈরথ। প্রিভিলেজডদের শ্রেণিতে স্থান পাওয়ার জন্য সাধারণের যে আকুলি-বিকুলি, এবং তার উৎসে রয়েছে যে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ভয় ও উদ্বেগ, তার প্রতি পরিচালকদ্বয় অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। এই ২০১৯ সালেই জর্ডন পিল আবারও নিয়ে এসেছিলেন 'আস', যেখানে 'আমরা' আর 'ওরা'-র বিভাজন আরও স্পষ্ট, এমনকি চলচ্চিত্রের নামেও যার ছায়া। ভয়ের সেই আখ্যানে 'ওরা' মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে থাকে, 'ওরা' বুভুক্ষু,'ওদের' স্বর নেই। কিন্তু 'ওরা' আসলে 'আমাদের'-ই মতো দেখতে, 'আমাদের'-ই অল্টার ইগো। 'ওদের' বঞ্চনাই 'আমাদের' সমৃদ্ধির উৎস।

 

২.

এই প্রেক্ষিতেই দিবাকর ব্যানার্জির মনস্টার ছবিটি পাঠ করা আবশ্যক। নেটফ্লিক্সে ২০২০ সালে 'ঘোস্ট স্টোরিজ' এসেছিল, যেখানে 'বম্বে টকিজ' আর 'লাস্ট স্টোরিজ'-এর রীতি মেনে আবার চারজন নির্দিষ্ট পরিচালক চারটি ছোট ছবি বানিয়েছিলেন। এবারে সাধারণ বিষয়টি হল ভূত, বা ভয়। অবাক হলাম, এমন অমিত সম্ভাবনাময় জঁর স্রেফ আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে হেলায় হারালেন অন্য পরিচালকরা; অথচ সব প্রত্যাশা ছাপিয়ে গেল 'ঘোস্ট স্টোরিজ'-এর তৃতীয় ছবিটি, দিবাকর ব্যানার্জির 'মনস্টার'। পরাবাস্তবতার হাত ধরে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ঢুকে পড়ল অ-ভৌতিক বাস্তবতা। দিবাকর এই জঁর নিয়ে এই সময় ও পরিসরে যা যা করা যায়, তা সবটা করে দেখালেন।

এ হল আশ্চর্য এক নরখাদক পরাবাস্তবতার গল্প, যা এক ডিস্টোপিয়ায় নিয়ে যায়, ছবিতে যার নাম 'বিসঘরা'। সেখানে সার্ভে করতে এক বহিরাগত মানুষ (সুকান্ত গোয়েল) এসে পড়ে, যার নাম নেই কারণ নাম থাকা জরুরি নয়। সেই শহরে দুটি বাচ্চা শুধু বেঁচে। বিসঘরা-র লোকেদের খেয়ে গেছে 'সওঘরা' নামে বড় শহরের লোকেরা। হ্যাঁ, বড়শহর আর ছোটশহর, এভাবেই এখানে হায়ারার্কি সূচিত হয়েছে। এবার দর্শক সেই হায়ারার্কিকে জাতপাত-ভাষা-বর্ণ-শ্রেণী যা খুশি মাত্রায় ভাবতে পারেন। বস্তুত ছবিটি অনেক কিছুকেই দর্শকের কল্পনার উপর ছেড়ে দেয়, চামচে গেলানোর বদলে।

লোকটি অন্ধকার সেই গাঁয়ে প্রবেশ করে যখন, তখন জীর্ণ কাকতাড়ুয়া ছাড়া চরাচরে আর কাউকে দেখা যায় না। মোবাইলে বড় শহরের নেটওয়ার্ক আর আসে না, যা হয়ত বোঝায় যে বিসঘরা আর সওঘরার মধ্যে আত্মিক আদানপ্রদান নেই, আছে শুধু 'আমরা-ওরা' সমীকরণ। কাশ্মীরের ইন্টারনেট ব্লকেড বা অন্য অনেক কিছুই মনে পড়তে পারে এই সূত্রে।

বাচ্চাদুটি যে সব আপাত-অসম্ভব নরখাদকদের কথা বলে, তারও উপরে মূর্ত হয়ে ওঠে তাদের বাসি রুটি, পচা দুধ আর পেঁয়াজের নৈশাহার, যা হয়ত ততটা অচেনা নয়। বাইরে শোনা যায় নরখাদকের হুঙ্কার। ছেলেটি (আদিত্য শেট্টি) জানায়, মেয়েটির বাবা খেয়ে ফেলেছে ছেলেটির বাবাকে। শুধু ছেলেটির বাবাকে কেন, বিসঘরার সবাইকেই নরখাদক খেয়ে ফেলেছে একে একে। মেয়েটি (ইভা অমিত পরদেশী) এ নৃশংসতা সইতে পারেনি। নরখাদক হতে তার বেধেছে। তাই সেও আজ শিকার্য বস্তু ছাড়া কিছু নয় নিজের বাবার চোখে৷ সওঘরার নেতা চায় সম্পূর্ণ বশ্যতা। নিজের সন্তানের অবাধ্যতাও ক্ষমার্হ নয়।

জানা যায়, স্কুলের ভূগোল ক্লাসে (ভূগোল, মানচিত্র, দেশ এখানে গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ হয়ে যায়) হানা দিয়েই প্রথম নরভোজ শুরু করেছিল নরখাদকরা। স্কুলের বোর্ডে ভারতের ম্যাপটি আধা-আঁকা, আধা-মোছা অবস্থায় আছে তখনও, যখন দুটি জীবন্ত বাচ্চা আর বহিরাগত লোকটি নরখাদকদের ভয়ে ক্লাসরুমে আশ্রয় নিয়েছে। তারা দেখে, অন্ধ প্রিন্সিপাল (এবলিস্ট হলেও অন্ধত্বের রূপক খুব বাঙ্ময়) সওঘরার বশ্যতা স্বীকার করে জম্বি হয়ে গেছে। সেই অন্ধ জম্বি শিক্ষক পরিত্যক্ত মঞ্চে জাতীয় পতাকার সামনে বিবেক দংশনে চিৎকার করে, আর্তনাদ করে, বমি করে। আবার অন্ধত্বের রূপক ফিরে আসে, যখন দেখা যায় নরখাদকদেরও দৃষ্টিশক্তি অতি ক্ষীণ। তারা তখনই কাউকে দেখতে পায়, যখন সে নড়ে-চড়ে, কথা বলে। 'যো হিলতা হ্যায়, উও দিখতা হ্যায়।' চলন-গমন বা কথা বলা, প্রাণের স্বাভাবিক এই প্রকাশগুলিকে চেপে রাখতে পারলে নরখাদকের চোখে পড়ার ভয় নেই৷

বস্তুত বিসঘরার মানুষেরা হয় সওঘরার নরখাদকদের পেটে গেছে, নয় তারাও স্বজাতিকে খেয়ে বশ্যতা স্বীকার করেছে ও জম্বিতে পরিণত হয়েছে। খাদ্য-খাদক বিভাজন, যা রাজনৈতিক-সামাজিক হায়ারার্কির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, তা হিন্দুরাষ্ট্র-কৃত অপরায়নের দ্যোতক নয় কি? বিসঘরা ( বিশ ঘর যেখানে) যে আসলে মাইনরিটি (ধর্মীয়/ ভাষিক/বর্ণগত) আর সওঘরা (একশ ঘর যেখানে) যে মেজরিটি তা বুঝতে সম্ভবত বাকি থাকে না।

ছবিতে ভীষণ অস্বস্তিকর এক নরভোজন দৃশ্য আছে। হ্যাঁ, সত্যিই সওঘরার নেতা খেয়ে ফেলে নিজের মেয়েকে, কারণ সে বিসঘরার ছেলেটির সঙ্গে বাস করছিল, সওঘরার আধিপত্য মানছিল না। অনার কিলিং-এর ঘটনাগুলি ভিড় করে আসে স্মৃতিতে। রাক্ষসটি যখন ভোজন করে ক্লাসরুমে, তখন আশ্চর্য ভাবে তার পিছনে জেগে থাকে ভারতের ম্যাপের কাশ্মীর ও উত্তরপূর্বাঞ্চল। বাকি অংশ দানবের শরীরে ঢাকা পড়ে যায়। এর পরেও কি বলে দিতে বাকি থাকে যে, এ এক টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রের দুঃস্বপ্ন? যে রাষ্ট্র বৈচিত্র‍্য সহ্য করে না, একীভবন চায় ধর্মে, দর্শনে, বাচনে, সংস্কৃতিতে, তা ক্রমশ নরখাদক রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। তা বিদ্রোহ আর বিদ্রোহীকে গ্রাস করে, চিবিয়ে খায়৷ এদিকে, নিস্তব্ধতার মধ্যে হাড় চেবানোর কচমচ শব্দ শোনে আর ভোজনপর্ব দেখে অন্য বাচ্চাটি ও লোকটি। সেই যে নরখাদকদের দেশে অস্তিত্বের মূল সূত্রটি- 'যো হিলতা হ্যায় উও দিখতা হ্যায়'- তার পালন করে ছেলেটি ও লোকটি অক্ষরে অক্ষরে, যা অপরের উপর ঘটা অত্যাচারকে মেনে নেওয়ার নিঃশব্দ নাগরিক স্বার্থপরতাকে মনে করিয়ে দেয়।

শেষ রক্ষা অবশ্য হয় না। লোকটি ও ছেলেটি তাদেরই সঙ্গী মেয়েটির রক্ত মেখে নেয়, যাতে তাদেরও নরখাদক জম্বি মনে হয়। স্বজাতির রক্তে স্নাত হয়ে তারাও 'আমরা'-র দলে ঢুকে পড়তে চায়, কারণ 'ওরা' হয়ে থাকার একমাত্র পরিণতি মৃত্যু। চূড়ান্ত পরীক্ষায় ছেলেটি বন্ধুর মাংস চিবায়, কিন্তু লোকটি পারে না৷ সে ধরা পড়ে যায়, তাড়া খেয়ে সে এক গর্তে পড়ে। কতশত গণপ্রহারের চেনা দৃশ্য মনে পড়ে যায়।

এক রঙ-বেরঙের  রাঙতার মালা ছুঁড়ে দেয় গর্তস্থিত লোকটির দিকে নরখাদকদের সর্দার, যেন হিন্দুরাষ্ট্রের উপবীত। হয় তা ধারণ করতে হবে, নয় মরতে হবে। এসব সত্যি, নাকি দুঃস্বপ্ন, এই দোলাচলে ছবিটি শেষ হয়। লোকটির ঘুম ভেঙে যায়। সে নিজেকে এক দগ্ধ পরিত্যক্ত গাঁয়ে আবিষ্কার করে। গাড়ি করে কয়েকজন উদ্ধারকারী আসে, তাকে বোঝায় যে সে স্বপ্ন দেখছিল, গাঁ-টি আগেই পুড়ে গেছে / পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

চামচে করে গেলানোর পরিচালকীয় দায় এখানে যে নেই, বরং সব কিছুই দর্শকের কল্পনা ও বোধের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে- তা আগেই বলেছি। মজার কথা হল, চামচে গেলানোর রূপকটিও খোদ ছবিতেই আছে শেষ দৃশ্যে। যখন উদ্ধারকারীদের গাড়ি বড় শহরে ফিরে যাচ্ছে, তখন এক মহিলা 'উদ্ধার পাওয়া' লোকটিকে চামচে খাবার খাওয়াচ্ছে, আর বড় শহরের বড় নেতার সাগরেদ লোকটিকে বোঝাচ্ছে, বিসঘরার শিশুরা কেন পরীক্ষায় ফেল করছে, তা নিয়ে লোকটির সার্ভে করতে যাওয়ার কোনো অর্থই নেই। সে শিশুরা জন্মেছেই ব্যর্থ হওয়ার জন্য৷ তাদের মাস্টারমশাইও ট্রান্সফার নিয়ে সওঘরার স্কুলে চলে গেছেন। এই বলে পিছনের সিটে বসা মাস্টারমশাইকে দেখায়, যাকে অবিকল সেই অন্ধ প্রিন্সিপালের মতো দেখতে। বড় শহরের বড় নেতার অবাধ্য মেয়েরও আভাস থাকে তার কথায়, যে বিসঘরায় থাকতে গিয়েছিল। এই সময় সামনের সিটে আসীন বড় শহরের বড় নেতা (গুনশন দেভিয়া) মুখ ফেরায়। নেতার কানেও তেমন একটি দুল, যেমনটা ছিল সওঘরার নরখাদকের কানে। চামচে করে মহিলা খাওয়াচ্ছে লোকটিকে, আর নেতা বড় শহরের মহত্বের 'ইতিহাস' বোঝাচ্ছে তাকে- এমতাবস্থায় ছবি শেষ হয়।  ভূগোলের মতো ইতিহাসও শাসকের নীতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় না কি? ছবিটি ততটাই ভয়ংকর ও অস্বস্তিকর, যতটা ভয়ংকর ও অস্বস্তিকর মৃত ও ব্যর্থ গণতন্ত্রে বাস করা। ছবিটি আজীবন মনে রয়ে যাওয়ার মতো এক দুঃস্বপ্ন।

 

৩.

 

দিবাকর ব্যানার্জি একমাত্র পরিচালক নন, যিনি বর্তমান প্রেক্ষিতে একটি ডিস্টোপিয়ার গল্প বলেছেন৷ নেটফ্লিক্সে ২০১৮ সালে এসেছিল প্যাট্রিক গ্রাহামের ওয়েবসিরিজ 'ঘুল'। ছবিটির নির্মাণ শৈলী বিশেষ পছন্দের না হলেও, মেজরিটেরিয়ান স্টেটের দেখা সেখানেও পাওয়া যায়। এক চিরবর্ষণমুখর প্রায়ান্ধকার প্রদেশের এক সৈন্যঘাঁটিতে আটকে রাখা হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু বিদ্রোহীকে, আর সেখানেই হানা দেয় ঘুল নামক অপদেবতা, যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের তাদের নিজস্ব পাপের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আবার ২০১৯ সালে এসেছিল প্র‍য়াগ ঠাকুরের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে দীপা মেহতার ওয়েবসিরিজ  'লেয়লা', যেখানে ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে এক মা হন্যে হয়ে তার সন্তানকে খুঁজে বেড়ায়, যে সন্তান মিশ্ররক্তের, হিন্দু নারীর সঙ্গে মুসলমান পুরুষের বিবাহজাত। সে দেশে দরিদ্র সংখ্যালঘুকে উৎখাত করার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, ধনী সংখ্যালঘু দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে কোনোমতে টিকে আছে। সেখানে অন্য ধর্মে বিয়ে করা মেয়েদের প্রথমে পাঠানো হয় রিহ্যাবে, যেখানে তাদের মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিকতার মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়। কিন্তু শুদ্ধিকরণ সম্ভব না হলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শ্রমকেন্দ্র বা লেবার ক্যাম্পে। মিশ্ররক্তের শিশুদের রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করে, বেচে দেয়, শ্রমিকে পরিণত করে বা স্রেফ মেরে ফেলে। সংখ্যালঘু 'দুশ'-দের সেখানে হাইওয়েতে ওঠার অধিকার নেই। এমনকি জল পান করার অধিকারও সংখ্যাগুরুর একচেটিয়া।

ওয়েবসিরিজ অনেক এপিসোড, সিজন ইত্যাদি জুড়ে বিস্তৃত হতে পারে। কিন্তু দিবাকর পেয়েছিলেন একঘণ্টার কিছু কম সময়, একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের চার ভাগের একটি ভাগ মাত্র। তাই তাঁকে হতে হয়েছে আরও সূক্ষ্ম, আরও সিম্বল-নির্ভর, মিনিমালিস্ট। কয়েকটি মোক্ষম আঁচড়ে তিনি এক বিভৎস মুখাবয়ব আঁকলেন, যে মুখ রাষ্ট্রের। এই সংক্ষেপায়ন দুর্বলতার বদলে শক্তি হয়ে উঠল তাঁর শৈল্পিক মুন্সিয়ানায়। চিৎকৃত ভয়াবহতার বদলে তিনি জোর দিলেন ভয়ের পরিবেশের প্রতিটি খুঁটিনাটি উপাদানে, তাদের বহুস্তরী রূপকে পরিণত করলেন। নরখাদকের ভয় বা খাদ্য হয়ে যাওয়ার ভয় আর অস্তিত্বরক্ষার লড়াই - এ তো একেবারে আদিমতম ভয় ও সংগ্রাম! অথচ সে আবরণের আড়ালে দিবাকর সোচ্চারে বলেন একবিংশ শতকেরই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের কথা। অথচ এ ছবি সহজেই এড়াতে পারে সেন্সর বোর্ডের কাঁচি বা নতুন  সিনেমাটোগ্রাফ বিলের শাসন, কারণ 'ঘুল' বা 'লেয়লা'-র চেয়ে অনেক বেশি পরোক্ষ এখানে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বিরোধিতা। রাষ্ট্র যত কঠোর হয়, শিল্প ততই নতুন ফিকির বের করে নেয় প্রতিবাদের। ভূতের গল্প, ভয়ের গল্প তেমনই এক ফিকির। হয়ত ছোট ছবির বাণিজ্যিক দায় থাকে কম, তাই দিবাকর ব্যানার্জির শৈল্পিক পরীক্ষণ সম্ভব হয়েছে।

 

৪.

শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস বলে, ইউটোপিয়ার কল্পনার চেয়েও মানুষের মনে বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম কাল্পনিক ডিস্টোপিয়া। আজও ইউএসএ বা পোল্যান্ডে নারীবিদ্বেষী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা পরিধান করেন মার্গারেট অ্যাটউড রচিত 'দ্য হ্যান্ডমেইডস টেইল'-এর (১৯৮৫)  হ্যান্ডমেইডদের মতো পোষাক। কেন? কারণ তারা হ্যান্ডমেইডদের পরিণতি মনে করিয়ে ভয় দেখাতে চায় জনমানবীকে। ডিস্টোপিয়া অবচেতনের ভয়কে চোখের সামনে মূর্ত করে, আর ভয়ের প্রভাব সুখানুভূতির চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। ডিস্টোপিয়া তাই ভবিষ্যতের অনিষ্ট এসে পড়ার আগে সে সম্পর্কে শিল্পীর সাবধানবাণী। যে বর্তমান ভয়াবহতায় আমরা গা সইয়ে নিয়েছি, সেই ভয়াবহতার চূড়ান্ত আগামী রূপটি আমাদের সামনে হঠাৎ নগ্ন করে ডিস্টোপিয়া, আমাদের সুযোগ দেয় তাকে প্রতিহত করার।

অন্যদিকে মনোবিদরা বলেন, প্রবল ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে আসে। কিন্তু পরিমিত ভয়ে মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চায়। আর পালানোর পথ নেই, এই বোধ থেকে আসে প্রতিরোধ। মনোচিকিৎসায় 'ফোবিয়া' কাটানোর অন্যতম উপায় হল 'ফ্লাডিং', যেখানে সুরক্ষিত, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ সময়ের জন্য তার ফোবিয়ার উৎসটির মুখোমুখি হন প্র‍তি সেশনে। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি সুরক্ষিত আছেন, তখন ধীরে ধীরে ভয় কাটে। উপরন্তু ভবিষ্যতে সত্যি সেই ফোবিয়ার উৎসের সঙ্গে মোলাকাত হলে যাতে তিনি প্রতিরোধ করতে পারেন, ব্যক্তি সেই শক্তি অর্জন করলেও করতে পারেন এই পন্থায়।

হয়ত এসব কারণেই সরাসরি প্রতিরোধের ভাষ্য না হাজির করেও ভয়ের ছবি আজকের পপুলার কালচারে এক মান্য জায়গা করে নিচ্ছে, যে জায়গাকে কিছুতেই অরাজনৈতিক বলা যায় না। দিবাকর ব্যানার্জি বা জর্ডন পিল-রা ভূত নাচাচ্ছেন দক্ষ হাতে।