রূপকথা ও পশুপাখি : প্রসঙ্গ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের

ছেলেবেলায় লোডশেডিং মানেই বই থেকে ছুটি। ছুটে চলে যেতাম ঘরের চৌকোনা বারান্দাটায়, শীতল পাটি বিছিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুনতাম রূপকথার গল্প। রাজপুত্র, কোটাল পুত্র, সুয়োরাণী- দুয়োরানী রূপকতী রাজকন্যায় ভরা সে দেশ।  বাংলার রূপকথা,  উপকথায় রূপকল্পের অভাব নেই। ভালো  মন্দের দ্বন্দ্ব ভুলে শেষ পর্যন্ত শুভর জয় হয় রূপকথার জগতে।   এই দেশ ঠাকুরমা, দিদিমার ভালোবাসা ও স্নেহ রসে সিক্ত শৈশবের বিস্ময়, বাল্যকালের কৌতুহল, কৈশোরের মুগ্ধতা,   যৌবনের আবেগ, ,  প্রাপ্ত বয়সের স্মৃতিচারণা । রূপকথার জগতের প্রতিটা সুতোয় লেগে আছে অফুরান ভালো লাগা, অপার বিস্ময়। কাহিনীর  বৈভব আমাদের দরিদ্র হতে দেয় না। রূপকথার গল্পে  মানুষ ছাড়াও আছে  রাক্ষস- খোক্কস, সোনার পাখি,  শুক- সারী, পক্ষীরাজ,  ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীরর কথা।   লোককথায়  রূপক হয়ে আসে  চরিত্ররা ।  তাদের আচার, আচরণ, কার্যকলাপে প্রকাশ পায়  সমগ্র জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস, সামাজিক জীবন । বঙ্গদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বিশ শতকের গোড়ার দিকে যুবক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয় পল্লী গ্রামে ঘুরে অগ্রজদের মুখ নিঃসৃত গল্প শুনে ফোনোগ্রাফের  মোম রেকর্ডে তাদের লিপিবদ্ধ করেন। গল্পগুলি ১৯০৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে কলকাতার কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে যোগাযোগ ঘটায় ওনারই  উদ্যোগে বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় “ ঠাকুরমার ঝুলি “।  সন্ধ্যেবেলা স্নেহময়ী ঠাকুরমা মুখ নিঃসৃত গল্প স্থান পেলো এই গ্রন্থে। অপরদিকে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত “ ঠাকুরদাদার ঝুলি” র ভূমিকায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার লেখেন, 

“ ঠাকুরমার ঝুলি’র সহিত সঙ্গতি রাখার নিমিত্ত এবং ‘গীতকথা'র সুর অনেকাংশেই পুরুষকন্ঠের বলিয়া,  কথাসাহিত্য বাঙ্গালার উপন্যাসের - ‘বঙ্গোপন্যাস- ঠাকুরদাদার ঝুলি ‘ নামকরণ। “ 

শ্রদ্ধেয় সংগ্রাহকের  কিছু  লেখা  “ স্বদেশের দিদিমা কোম্পানীর” র ঠাকুরমার ঝুলি এবং  বঙ্গোপন্যাস “ঠাকুরদাদার ঝুলি” ভরিয়ে রেখেছে  তাদের বৈচিত্র্যে। 

 

ছেলেবেলায় একটা গান প্রায়ই গাইতাম, 

“ ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী গল্প শোনায়

রাজার কুমার পক্ষীরাজ চরে যায়।” 

 

সংস্কৃত বিহঙ্গম বিহঙ্গমী থেকে ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী শব্দের উৎপত্তি।   গ্রন্থগুলির   সংগৃহীত কাহিনীগুলিতে স্বল্প পরিসরে এদের আর্বিভাব। রাজ্য  থেকে রাজপুত্র, কোটাল পুত্র কিংবা সওদাগরেরা  দূর দেশে  যাত্রাকালে গভীর অরণ্যে ভিতর  প্রবেশ করতেই   সাক্ষাৎ হয়  বিহঙ্গ দ্বয়ের সাথে। দক্ষিণা রঞ্জন মিত্র মজুমদারের অঙ্কিত  চিত্রানুযায়ী এদের  মুখাবয়ব মানুষের মতো, গাল ভর্তি দাড়ি অপরদিকে দৈহিক  গঠনে তারা ডানাযুক্ত সাধারণ পাখীর মতোই। এই বৈপরীত্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত তাদের আদলে। এমনকি শাবক ব্যঙ্গমার মুখাবয়ব পরিণত ব্যঙ্গমার মতোই।  এই চরিত্রগুলির মানসিক পরিণতি, অভিজ্ঞতা,  জ্ঞান বোঝাতেই হয়তো এমনভাবে তাদের প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রামীন জীবনে পরিবারের প্রধান, বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিভাবক স্হানীয় মানুষ যারা তাদের মূল্যবান উপদেশের মাধ্যমে কনিষ্ঠদের সঠিক পথ দেখায়, গল্পগুলিতে ব্যঙ্গমা বেঙ্গমী খানিকটা তেমনভাবেই এসেছে। 

 

 এবার আসি পক্ষী ও মানব চরিত্রের মেলবন্ধন প্রসঙ্গে। মহাকাব্য থেকে পুরাণে বারংবার এসেছে  বিচিত্র পাখীর প্রসঙ্গ।  জটায়ু, গরুড়, পেঁচা, কাক, পায়রা, সারস  নিজ নিজ ভূমিকায় অবতীর্ণ।  এদের কারও গড়ন সম্পূর্ণ পাখীর মতো,  কেউ বা  মানুষ ও পাখীর মিলিত রূপ । যদি শারীরিক গঠনে পক্ষী এবং মানব এই দ্বৈত সত্তার  বিশ্লেষণে যাই, তবে বলা যেতে পারে এরা পাখী হলেও আচরণে উপকারী  মানুষের মতো । প্রতিকূলতায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বিপদমুক্ত করেছে  মানুষকে।  তবে আচরণগত দিক ছাড়াও রয়েছে অপর একটি ধারণা।  প্রাচীন সময়ে  অরণ্য জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ গাছপালা,  নদ- নদী, আকাশ, সমুদ্র,  পশু পাখিদের দেব দেবী জ্ঞানে পুজা করতো। টোটেম বিশ্বাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের কাছে জাগতিক শক্তি ছিলো পূজনীয়।  ভয় থেকে বিশ্বাস এবং বিবর্তনের পথ ধরে বনবাসী মানবজাতি অলৌকিক শক্তি, আত্মা, টোটেম বিশ্বাসী হয়ে পড়ে৷ এখান থেকে জীবকূলের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা তৈরি হয়, দৃঢ় হয় বন্ধন। সাঁওতাল গোষ্ঠীর পুরাণের সৃষ্টিতত্ত্বে “ মারাঙ্গবোংগা” কাকের কথা পাওয়া যায়, যিনি পৃথিবী সৃজনকালে  সকল জীব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন।  রূপকথা বা লোককথায় তাই মানব কুল এবং পক্ষীকূলের সহাবস্থান অস্বীকৃত নয়। 

 

প্রতীকী অর্থে পাখি মুক্তি, শান্তি, উন্নতি, আশা, আনন্দ,  সাহস, নব সূচনার প্রতীক। খোলা আকাশে উড়ন্ত  পাখি দেখলে মাটির মানুষও দুটো ডানার প্রত্যাশী হয়। বিহঙ্গ হয়ে মুক্তি চায়,  অজানা জগতে নিমেষে পৌঁছানোর জন্য পাখির জীবন কামনা করে।    

 

“ঠাকুরমার ঝুলি” গ্রন্থের ভূমিকায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার লিখছেন, 

“ স্বদেশের কোম্পানী একেবারে দেউলে। তাঁদের ঝুলি ঝাড়া দিলে কোন কোন স্থলে মার্টিনের এথিক্স এবং বার্কের ফরাসী বিপ্লবের নোটবই বাহির হইয়া পড়িতে পারে, কিন্তু কোথায় গেল- রাজপুত্র  পাত্তরের পুত্র, কোথায় বেঙ্গমা- বেঙ্গমী, কোথায় - সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের সাত রাজার ধন মাণিক।” 

মিত্র মজুমদার মহাশয় এই দুই পাখিকে স্বদেশের বলে আপন করে নেন।  বাংলা লোককথায় তারা মানুষের মর্যাদা পায়। কাহিনীগুলিতে তারা স্বামী( ব্যঙ্গমা)- স্ত্রী( ব্যঙ্গমী),  সন্তান সহ গাছে বসবাস করে। অরণ্য জীবনে বৃক্ষের ডালে, কোটরে কিংবা পাহাড়ের গুহায় মানুষ,  পাখি, পতঙ্গ সপরিবারে বসবাস করতো। একত্রে বসবাসের ধারণা  গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে । অরণ্য জীবন হোক কিংবা পরবর্তী সামাজিক জীবন মানুষ বাস করতো একান্নবর্তী পরিবারে ।   দলবদ্ধভাবে বসবাস করার প্রথা তখন থেকেই  বিদ্যমান ছিলো । একদিকে পরিবার প্রথা  অপরদিকে দাম্পত্যজীবন যাপনের প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে বেঙ্গমা বেঙ্গমীর মধ্য দিয়ে । 

 

আসি “ঠাকুরমার ঝুলি” র  ‘রূপ তরাসী’ অংশের “ নীল কমল আর লাল কমল “ গল্প প্রসঙ্গে। সংগ্রাহক মহাশয় লিখেছেন, 

 “ নূতন তরোয়াল ধার দিয়া,  দুই ভাই রাক্ষসের দেশের উদ্দেশে চলিলেন।”

 বনের ভিতর  পথ চলতে  ক্লান্ত  রাজপুত্রদ্বয় নীল কমল লাল কমল খুব বড়ো একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় বসলো। সেই গাছে বেঙ্গমা বেঙ্গমীর বাস। রাজকুমার যুগলের  কানে এলো দুই পাখীর কথোকপথন। রূপকথার জগত  বিস্ময়ে ভরিয়ে আমাদের  জানালো, পাখিরাও  কথা বলে।  বেঙ্গমা বেঙ্গমী  হয়ে উঠলো মানুষের মতো। মুছে গেলো দুটি ভিন্ন প্রাণী জগতের সূক্ষ্ম রেখা। অজিত কুসুমের কানে এলো বেঙ্গমীর কাতর আর্তনাদ, 

“ আহ্, এমন দয়াল কাঁরা, দুই ফোঁটা রক্ত দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়!” 

এই কাতরতা তো সন্তানের জন্য এক মমতাময়ী মায়ের হৃদয়ের আর্তি।  পাখিদের দৃষ্টি শক্তির জন্য মনুষ্য রক্তের উপর নির্ভর করতে হয়। নীল কমল লাল কমল জানায়, 

“ রক্ত আমরা দিতে পারি।”

দু ফোঁটা শোনিতের   বিনিময়ে দৃষ্টি পেয়ে উভয়ের মধ্যে গড়ে উঠলো রক্তের সম্পর্ক।   চিরঋণী বেঙ্গমা বাচ্চারা কৃতজ্ঞতা জানাতে গাছের উপর থেকে  রাজপুত্রদের কাছে উড়ে এসে উপকার করতে চাইলো।  এ যেন উপকারীর উপকার শোধ করার বাসনা। রূপকথার বেঙ্গমা বেঙ্গমীরা  উপকারী।   নীল কমল, লাল কমল বেঙ্গমা বাচ্চাদের পিঠে চড়ে 

“ ডাঙ্গা জঙ্গল, নদ নদী, পাহাড়পর্বত- মেঘ, আকাশ, চন্দ্র,  সূর্য সকল ছাড়াইয়া” হু হু করে শূন্যে উড়ে চললো। মনুষ্য জাতির ভার বহনে তারা যেন প্রস্তুত। সাত দিন সাত রাত পর এক পাহাড়ের উপর  নামিয়ে দিলো নীল কমল লাল কমলকে। গহীন  অরণ্য থেকে   ভিন্ন এক রাক্ষস জগতে পৌঁছাতে সাহায্য করলো বেঙ্গম বাচ্চারা। এই পাখিরা দুই জগতের সেতুবন্ধন করতে পারে।    মানুষ  নিজ ক্ষমতায় পৃথিবীর যে অগম পারে পৌঁছাতে সক্ষম নয়,  নীল আকাশ পথে বেঙ্গমরা সেখানে তাদের  পৌঁছে দেয় ।  আবার দেখা যায়,   “ অছিন অভিন্”  রাক্ষসপুরী ধ্বংসের পর মৃত রাক্ষসী আয়ী বুড়ির মাথা কাপড়ে জড়িয়ে বেঙ্গমের পিঠে চড়ে  দেশের মাটিতে পা রাখে রাজপুত্ররা ।  বেঙ্গমের উড়ান যেন  মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য নির্দিষ্ট । 

 

বঙ্গোপন্যাস “ ঠাকুরদাদার ঝুলি” গ্রন্থের  “ শঙ্খমালা” গল্পে পুনরায়  এলো ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর প্রসঙ্গ । সেখানে “ বেঙ্গমা বলে, “ বেঙ্গমী!এই যে শঙ্খসাধু বানিজ্যে যায়, আজ শঙ্খ সাধুর ঘরে নীলমাণিক রাজার জন্ম হইবে। “ 

 

এই পাখি ভবিষ্যৎ বক্তা,  ত্রিকালদর্শী।  আসন্ন কালের কথা সে সহজেই বলে দিতে পারে। সান্ধ্যকালীন কথোপকথনে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির কাছে মনের কথা বললেও বেঙ্গমী প্রথমে তা বিশ্বাস করেনি। এরপর বেঙ্গমা সমস্যার সমাধান বাতলে জানিয়েছে, 

“ ঐ নদীর ও- পারে মাণিক হংস বলিয়া ডাক দিলেই,  সেই পাখী আসিয়া সাধুকে পিঠে করিয়া ছয় মাসের পথ প্রহরে নিয়া যাইবে, প্রহরে ফিরাইয়া আনিবে। “ 

বেঙ্গমার দূরদর্শীতায় মানব সমাজ উপকৃত হয়, পথ খুঁজে পায় সমস্যার। রূপকথার পক্ষী যুগল আঁধার থেকে আলোর দিশারী। 

 

রেভারেন্ড লাল বিহারী দে রচিত বাংলার উপকথার কাহিনী,   “রাজপুত্তুর সুপুরের কথায়”  বণিক কন্যা এক বিষধর  সাপের হাত থেকে বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর ছানাদের উদ্ধার করে। কৃতঞ্জ পাখী দম্পতি জানে,  সাহায্যকারী সন্ন্যাসী কোনো  পুরুষ নয় নারী , রাজপুত্র সুপুরের স্ত্রী। বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর   মল মহৌষধি। সাতবার সাত কলসী জল, সাতবার সাত কলসী দুধে রাজপুত্রকে স্নান করিয়ে পাখীদের  ত্যাগ করা শুকনো মল চূর্ণ করে কুমারের শরীরে লাগিয়ে দিলেই সে সুস্থ হবে। বিহঙ্গমার পিঠে চরে আসেন বণিক কন্যা। 

 

রূপকথার গল্পের আরেক পাখী শুক- সারী। দোহায় মিলে রাধা কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের বাকবিতন্ডা লেগেই আছে। এরা সম্ভবত টিয়াপাখি।  শুক নর,  সারী নারী। ঠাকুরমার ঝুলির “শীত বসন্ত” গল্পে এদের দেখা পাওয়া যায়।  বেঙ্গমা বেঙ্গমী র মতো তাদের ছানাপোনার উল্লেখ গল্পগুলিতে নেই।  এ পাখি যুগল প্রেমিক,   গলায় গলায়  ভাব ভালোবাসা তাদের। রাগ অনুরাগের  দ্বন্দ্ব নিয়েই এদের বাস।  মুনির পাতার কুটীরে বাস করে দুয়ে  মিলে। শুক সারীকে বলে, 

“ সারী, সারী বড় শীত! 

সারী উত্তর দেয়, 

“ গায়ের বসন টেনে দিস।”

আহা কি প্রেম!   বেঙ্গমা বেঙ্গমীকে গল্পে এসেছে অভিজ্ঞ রূপে,  শুক সারীর উপস্থিতি প্রেমরস সিক্ত নব দম্পতির মতো। হিন্দু পুরাণে  শুক কাম, প্রেমের দেবতা, সারী  মেয়ে পাখি রতির প্রতীক। স্বয়ং কামদেবতা এবং রতি দেবী টিয়া পাখির পিঠে বসে আসেন।  তার কাছে আছে  দুর্মূল্য গজমতির খোঁজ। মেয়েরা  রত্ন প্রিয়া, পুরুষরা এসব খোঁজ রাখে না।  এই পাখি সুখ সমৃদ্ধি বয়ে আনে। রাজকুমার বসন্ত তাদের সম্বোধন করে মেসো মাসী নামে। 

“সোনার কাটি রূপার কাটি”  গল্পের শুক পাখী  অবশ্য সারীর সাথে আসে না। বহু যত্নে খাঁচায় রাখা শুকের ভিতর আছে রাক্ষসী রানির প্রাণ৷  পাখির গলা ছিঁড়তেই রানী প্রাণে মারা যায়।  প্রকৃতি বুঝিয়ে দেয়, পাখী হত্যা করলে মানুষকেও তার শাস্তি পেতে হবে। পাখী পরিবেশের বন্ধু,  এর সংখ্যা কমতে থাকলে খাদ্যশৃঙ্গল ধ্বংস হবে। 

শুক সারী টিয়াপাখি,  তারা সংযোগ,  স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক, নকল করতে পটু৷ 

 

“মধুমালা” গল্পের রাজা মনের দুঃখে গিয়ে দাঁড়ালেন সোনার বৃক্ষতলে।  সন্ন্যাসী শুধোলেন,

“ হাত দুটি পাতহ রাজা, পাবে স্বর্ণপাখী।“ 

কিন্তু সে পাখির নখ, পাখা, চঞ্চু কেটে খেতে বললেন সাধু৷ ওমনি কোথা থেকে উড়ে এলো এক সোনার পাখি। উনুন জ্বালিয়ে বসে ছিলেন পাটরানী। পাখি মেরে রান্নার পর সাত ভাগে ভাগ করা হলো। 

“ ভোজন করহ সুখে বংশ – পাখীর মাঁস।

সদ্য সোনার কুমার,  তোমার, ভরবে রাজবাস।“ 

সন্ন্যাসীর কথায় সোনার পাখীর মাংস আহারে রাজার ঘরে পুত্র সন্তান জন্ম নিলো। আদর করে নাম রাখলেন মদনকুমার। অপুত্রক রাজার আঁটকুড়ে নাম গেলো ঘুচে।  সাতভাগে মাংস খাওয়ার বিষয়টা ভারি অদ্ভুত।  

 

রাজার ছেলে মদনকুমার মৃগয়া করতে গিয়ে আলাপ হলো চন্দ্রকলার সাথে। বিয়েতে যৌতুক পেলেন সোনার ময়ূর।

“ স্বর্ণমন্দিরের চূড়ায় যে ময়ূরটি আছে, কেবল তুমি সেইটি চাহিও।“ 

সোনার হরিণ পাওয়ার মতো সোনার ময়ূর পাওয়ার বাসনায় ছুটছে মানুষ। আনন্দ,  সৃষ্টি   

সোনার চূড়া ভেঙ্গে সোনার ময়ূর আনা হলো। নিষ্প্রাণ পাখীর দেহে প্রাণ এলো। খাওয়া শেষ হলে ময়ূরের পিঠে চড়ে মধুমালার দেশে পাড়ি জমালেন মদনকুমার। ময়ূর ক্ক- ক্ক মেঘঃ ডাকে পেখম মেললো আকাশে। বাস্তবে ময়ূর উড়তে অক্ষম তবে এই গল্পে সে উড়ে চলে রাজকুমার ভালোবাসার সন্ধানে। সাহায্য করে রাজকন্যাকে খোঁজার। 

 

 এই ময়ূর তাঁর অভীষ্ট মধুমালার খোঁজে উড়িয়ে নিয়ে চললো তার আলোর ডানা মেলে। ময়ূর আবেগ, ভালোবাসা,  সৌন্দর্য,  আভিজাত্য,  শ্রদ্ধার প্রতীক। তার ডানায় রামধনুর বাস। শ্রীকৃষ্ণের মাথায় শোভা পায় ময়ূরের পালক।  সে যখন মধুমালা আঁধার মোড়া দেশে পৌঁছায় মনে হয় আলো ঢালা পাখা যেন হাজারো মশাল। সোনার ময়ূর অন্ধকারে আশার আলো।  আকাশ বাতাস ঠেলে ময়ূর উড়ে চলে, নদ নদী পাহাড় পর্বত ছাড়াতে পারে ডানার আঁচড়ে বহুদূর চলতে পারে সে। অবশেষে মদনকুমার,  চার রানী, সোনার পালঙ্ক কাঁধে এনে ফিরলো নিজের ঘরে। 

 

ঠাকুরমার ঝুলির “ অরুন বরুন কিরণ মালা” র  সোনার পাখীও কথা কয়, প্রবীণের মতো বুদ্ধি দেয় রাজারকুমারদের রাজারকে নিমন্ত্রণের। রাজা এলে ভুল ভাঙিয়ে দেয় যুক্তি দিয়ে,  বাকযুদ্ধে এ পাখীকে কাবু করা কঠিন। গল্পে কেবল সোনার পাখীর কথাই আছে। সোনার পাখী জানে অরুণ বরুণ কিরণের মায়ের ঠিকানা৷ “ নদীর ও – পারে যে কুঁড়ে,  সেই কুঁড়েতে তোমাদের মা থাকেন।“ 

মিলন হলো সকলের,  গান ধরলো পাখী,

“ অরুন বরুন কিরণ, 

তিন ভুবনের ধন”, 

 

“মালঞ্চমালা” গল্পের নিঃসন্তান রাজা পুত্রকামনায় যজ্ঞ করার পর ঋষিদের কথা মতো তিনরাত গৃহবন্দী থেকে চারদিনের দিন ভোরে আর্শীবাদী সোনার আম নিয়ে রানীর কাছে যাবেন। “ “রাজপুরীর পক্ষীরাজ ঘোড়া রাজদুয়ারে।“ 

সেই ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা দিলেন। পক্ষিরাজ ঘোড়ার অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। কাল্পনিক চরিত্র পক্ষিরাজ সাদা ধবধবে, নরম তুলোর মতো বিরাট দুটো ডানা উড়িয়ে সে ভেসে বেড়ায় আকাশে। কল্পনার জগতে পাড়ি দেন রাজা, রাজপুত্রের দল। সে দেশ রূপকথার দেশ, ফাগুন যেখানে বিচরণ করে বারোমাস। রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়ার অভাব নেই তবু তিনি সন্তান পাওয়ার আনন্দে ভাসছেন, তাই পক্ষিরাজ আজ তার বাহক। রানীর কোল আলো করে জন্ম হলো রাজকুমারের। কিন্তু বিধি বাম,  তার আয়ু মাত্র বারোদিন। দুঃখে রাজা রানীর মরমর দশা আর “পক্ষিরাজ আহার ছাড়িল”। রাজপুত্রের মৃত্যু চিন্তায় মানুষের মতো পক্ষিরাজ ব্যথায় জর্জরিত। পরিবারের একজন সদস্যের মতো সে বাস করে সকলের সাথে। 

কোটাল কন্যা মালঞ্চের সাথে বিয়ের বাসর রাতেই রাজপুত্রের মৃত্যু হলো। ডাইনি সন্দেহে কুমারের চিতার সাথে নাক কান কেটে জীবন্ত পুড়িয়ে দিতেই জ্বলন্ত চিতার আগুনে নেমে এলো বৃষ্টি।  “ পক্ষিরাজ পাগল হইয়া চারিদিকে ছুটে।“ 

এই পক্ষিরাজ এখন কথা না বললেও সে শোকে ক্রোধে চঞ্চল হয়, মানুষের মতোই উন্মাদ হয় মানসিক আঘাতে। স্বামীকে রাজ্য ছাড়লেন মালঞ্চ,  এক রাজার রাজ্যের পক্ষিরাজ পাগল, রাজ্যময় ছুটে বেড়ায় আর “ মানুষ পাইলেই ধরিয়া খায়”. এখানে রূপকথার ঘোড়া হয়ে উঠলো মানুষ খেকো। মালঞ্চ কাছে এসে রাজপুত্র চন্দ্রমাণিকের নাম বলতেই পক্ষিরাজ চিনতে পারলো। ছুটলো কোটাল কন্যার সাথে দুধবর্ণ রাজার দেশে৷  কিন্তু কোথায় পক্ষিরাজের শান্ত সুন্দর রূপ, সে যে “ আগুণ – চোক কান খাড়া, খুড়ের ঘায়ে মাটি থরে থরে কাঁপে। মালঞ্চ হরিকালীর পিঠে বালক স্বামীকে তুলে রাজপুত্র চন্দ্রকেতু ফিরে পাবার আশায় বুক বাঁধলেন। পক্ষিরাজ  আশার প্রতীক, সেই পারে অসম্ভব কে সম্ভব করতে,।  মালঞ্চ শাড়ির সুতো ছিড়ে পক্ষিরাজের গলার মালায় গেঁথে দিলে। “ ঘোড়া উড়ে চলিল” এই উড়ান স্বপ্নের দেশের উড়ান, কল্পনার পাখার ভর করে সুন্দরকে কাছে পাবার উড়ান। পক্ষিরাজের দুটো ডানায় মেখে থাকে অলীক জগতের রামধনু,  ধুলো মাটির থেকে মেঘের পথে পাড়ি দিতেই ভালোবাসে। রাজপুত্ররাও পক্ষিরাজ দেখে চমকিত, 

“ এ তো ঘোড়া ঘোড়া নয়,  ঘোড়া পক্ষিরাজ।  চন্দ্রকেতু রশিতে টান দিলে ঘোড়ার গায়ের ভঙ্গী ঢেউ খেলে, চার পায়ে টগবগ ওঠে। ফিরে এলো একা পক্ষিরাজ।  সব আশা শেষ মালঞ্চের। এই প্রথম কথা ফুটলো ঘোড়ার মুখে। “ রাজার পুরী সোনার চূড়া, সেথায় ছিলো মালা, 

সে মালা টানিয়া নিল তোমার চিকণকালা” 

পক্ষিরাজ সংবাদ বাহক, মালঞ্চের চিঠি নিয়ে সে রাজার ঘরে যায়। অতিথি আপ্যায়নের মতো জল, ঘাস খেয়ে বিদায় নিলো। কাহিনীতে কখনও সে যোগাযোগের মাধ্যম,  কখনও বার্তাবাহক। মানুষের মতোই ঘোড়া কর্তব্য পরায়ণ। ঠাকুরমার ঝুলির ডালিমকুমার গল্পে,  রাক্ষসী রানী মন্ত্র বলে যাদু করে পক্ষিরাজ ঘোড়াকে পাঠায় পাশাবতীর রাজ্যে৷ সকল রাজপুত্র ছুটেছে পক্ষিরাজে ভর করে। অন্ধ রাজকুমারকে পিঠে চাপিয়ে পক্ষিরাজ ঝর- জলের অন্ধকারে আকাশ পথে ছুটতে ছুটতে পথ হারিয়ে মাটিতে পরতেই হয়ে গেলো পাথর। ডালিম কুমারের ছোঁয়ার প্রাণ পায় পক্ষিরাজ,  ছুটে চলে তীর- বজ্রের বেগে। কড়ি, হাড়ের পাহাড় পেরিয়ে ছুটে ঘোড়া। পৌঁছালো পাশাবতীর দেশে। পাশা খেলায় পণ হারলো পক্ষিরাজকে। পক্ষিরাজকে গরাসে গিলে ফেলে পাশাবতীরা। 


 

শঙ্খমালা” গল্পে এসেছে মানিক হংসের কথা। শঙ্খমণি  হাঁক দিতেই সামনে এলো “ ধবল পর্ব্বত দুই পাখ” ছড়িয়ে পাখি। তার জন্ম কাহিনি বড়ই বিচিত্র। মোহনলালের তীরের ফলায় ডিম ফুটে। সেজন্য সে বড়ই কৃতঞ্জ মানুষ জাতির প্রতি । সাধু সওয়ার হলেন হাঁসের পিঠে। 

“ প্যাঁক প্যাঁক শব্দে হংস পলকে ছাড়ায় পথ।

দন্ডেকে ছমাসের পথ গেল, যেন পুষ্পকরথ।!

প্রভুভক্ত পাখি শঙ্খমণিকে নামিয়ে বললো,

“ আবার যখন ফিরবে, মাণিক বলিয়া ডাক দিও। মিলন হলো শঙ্খমনি আর শক্তির।  মিলনের মাধ্যম মানিক হংস। হংস প্রতীক, 

এই হংস কথা বলিয়ে পাখি। ভবিষ্যৎ বক্তা, আগেি জানে “মালা রাখিতে পারিবে না, সমুদ্রে হারাইবে।“ 

বনের পাখিরা মানুষের দুঃখে কাঁদে, “ সওদাগর বৌ! উঠিয়া খাওদাও।“ 

সাগর জলের অতলে মানিক হংসের হংসিনী বাস করে, ডিমে তা দেয়। মালা খানা দেখে গুছিয়ে রাখলো। এখানে এসেছে হংস পরিবারের কথা। বারো বছর ডিমে তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে চারটি ছানা হয়। হংস আসে ঘরে, চোখে পরে মালাখানা। হায় হায় করে কেঁদে ওঠে।  হংসিনীর কথায় সপরিবারে নীলমাণিকের রাজপুরীর বটবৃক্ষে বাসা বাঁধে। হংস দূর সমুদ্রে গেছে, হংসিনী গেলো খাবার জোগাড়ে, এই ফাঁকে বাচ্চাদের ঝগড়া শুরু।  গাছের কোটর থেকে মালা খানা মাটিতে পড়লো, কুড়িয়ে নিলো রাজপুত্র নীলমাণিক। দৈববাণী শুনিয়ে মানিক হংস সব সত্য উদঘাটন করলো। 


 

রেভারেন্ড লাল বিহারী দে মহাশয়ের বাংলার উপকথার হীরামণের কথা গল্পে  ও পক্ষিরাজের কথা আছে। সে রাজাকে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে সুন্দরী রাজকন্যার দেশে রাজাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু একবারের বেশী চাবুক মারলে সে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, শক্তি হারিয়ে যায়। 

 

হীরামণ কথা বলা পাখি, রাজার কাছে বিক্রির সময় নিজের নিজের দাম বাতলে দেয়। প্রতিশ্রতি দিয়ে রাজাকে জানায়, 

“আমি আপনার অনেক উপকারে লাগবো।“ 

হীরামণ বুদ্ধিমান, ধার্মীক, তিনশো তেতত্রিশ কোটি দেবতার নাম শোনায় রাজাকে। সারাদিন রাজা হীরামণের সাথে মেতে থাকলে ঈর্ষা হয় রানিদের।। বুদ্ধিমান পাখি দেবতার নামগান শুনিয়ে মন জয় করে নিলো। সে পন্ডিত,  গণনা এবং বিচারে পটু। উপস্থিত বুদ্ধি থাকায় রানীদের ছলনা থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে রেখেছিলো আগেই।  হীরামণ তোতা পাখি। এ প্রসঙ্গে মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনী গল্পের কথা। 

 

“শ্বেত বসন্তের কথা”  গল্পে আছে দুই বাছুরের কথোপকথন।  তারা মানুষের বিবেকহীনতা,  দুর্নীতি, পাপের  কথা আলোচনা করে। মানুষের লুকোনো রহস্য সব তাদের নখদর্পনে।  কোটালপুত্র তার নিজের মাকে নিজের অজান্তেই বিয়ে করতে চায়। গোয়াল ঘরের চালের উপর দাঁড়িয়ে সব কথা শুনে রাজার কাছে জানায় সে। সব শুনে রাজা স্ত্রীকে ঘরে ফিরিয়ে আনে।। দুই বাছুরের কারণে মিলন হয় রাজা রানীর। 


 

মহাভারতে “অশ্বত্থামা” হাতির মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিলো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এমনকি এই অর্ধ সত্যের জন্য যুধিষ্ঠিরের বিবেক দংশনের শেষ ছিলো না। দক্ষিণা রঞ্জন মহাশয়ের 

ঠাকুরমার ঝুলির “শীত বসন্ত” গল্পে  এসেছে এক রাজ হাতির কথা, শ্বেত রাজ হাতি।  বিরাট সেই হাতি, দুধ সাদা গায়ের রঙ, রাজকীয় তার চলন। বনের দীর্ঘ পথ হেঁটে ক্লান্ত দুই ভাত শীত বসন্ত গাছের ছায়ায় বসে। বসন্তকে বসিয়ে ভাই শীত সরোবরে যায় খাওয়ার  জল আনতে।   দেশের রাজা নির্বাচনের জন্য সে দেশের  রাজ হাতি পিঠে পাট সিংহাসন নিয়ে বেরিয়েছিলো। শর্ত, “ হাতী যাহার কপালে রাজটিকা দেখিবে,  তাহাকেই রাজসিংহাসনে উঠাইয়া দিয়া আসিবে, সে-ই রাজ্যের রাজা হইবে।“ 

 হাতিরা  অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী৷   শীতের কপালে রাজটীকা দেখে হাতি শুঁড়ে জড়িয়ে তুলে নিলো আসনে। রাজ্যের রাজা নির্বাচনের গুরুদায়িত্ব ছিলো হাতির উপর। বিচক্ষণ হাতি সে কাজ পালন করেছে। জহুরি যেমন রত্নের মূল্য বোঝে, শ্বেত হাতিও রাজ লক্ষ্মণ চিনতে পারলো নিমেষে।  

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে সাদা হাতির কদর আছে। তবে কথায় আছে “ মরা হাতি লাখ টাকা” তাহলে জীবিত অবস্থায় তাকে পুষলে বহুল অর্থ জোগাড় করতে হয়। তাছাড়া শ্বেতকায় হাতি পালন করতে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। আগেকার দিনে রাজা, জমিদার কিংবা অভিজাত পরিবারে হাতি পোষার চল ছিলো। আরাম প্রিয় সাদা হাতি পরিশ্রমী নয়, তাই যুদ্ধের সময় এদের ব্যবহার করতো না রাজারা। তবে দৈহিক শক্তিতে হিংস্র জন্তুকে শুঁড়ের আঘাতে মেরে ফেলতে পারে অনায়াসেই। হিন্দু পুরাণে পাই, অষ্ট দিকগজ আট দিক রক্ষা করে। এরা হলো,  ঐরাবত, পুণ্ডরীক,  বামন, কুমুদ, অঞ্জন, পুষ্পদন্ত, সার্বভৌম, সুপ্রতীক।এছাড়াও  পৃথিবীর চারদিক ধারণ করে আছে চার হাতি- বিরূপাক্ষ,  মহাপদ্মাসন, সৌমাসন, ভদ্র। সুরক্ষা,  আভিজাত্য,  কর্তব্য, বুদ্ধিমত্তায় গজরাজ তুলনাহীন।  রূপকথায় হাতির মাথায় শোভে ‘গজমতি’।  “ শীত বসন্ত “ গল্পে অমূল্য গজমতির সন্ধানে লোকজন ছুটছে বেড়ায় বিনিময়ে মিলবে রাজকন্যার মন । বসন্ত যায় গজমতি আনতে। সেখানে বিরাট এক ক্ষীর সাগরের কূলে “দুধবরণ হাতি দুধের জল ছিটিয়ে খেলা করিতেছে”।  এই অংশটা পড়ে মনে পড়লো সমুদ্র মন্থনের কথা।  দেবতা অসুরের দ্বন্দ্বে উঠে ঐরাবত, জ্যোৎস্নার মতো সাদা সে হাতি অধিকার করেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র।  ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের  সে হাতীর মাথায় গজমতি। বসন্ত ঝাঁপিয়ে  পড়লে কথা বলে ওঠে  হাতি, জানতে চায় বসন্তের  নাম ধাম, দেশ। বিজ্ঞ  রাজ হস্তীর উপস্থিত বুদ্ধির অভাব নেই।  হিন্দু পুরাণে হাতির সাথে জড়িয়ে আছে গণেশের কথা।  তবে এমনিতে ধীর স্থির স্বভাবের। 

আধুনিক সমাজে “White Elephant “ শব্দটা রূপক রূপে প্রচলিত। বৃহদাকার নির্মাণ, উন্নত,  ব্যয় বহুল প্রযুক্তি  অথচ লোকসান গুনতে হয়, এমন ক্ষেত্রে শব্দটার ব্যবহার হয়। 


 

সুতা শঙ্খ সাপ, ডালিমকুমার গল্পে, রাক্ষসী রানীর বড়ো পেয়ারের,  প্রভুভক্তি অসীম। কৌটোর মধ্যে চুপ করে শুয়ে থাকে, রানীর ডাকে বের হয়ে আসে, 

“ সূতাশঙ্খ, সূতাশঙ্খ শাঁখের আওয়াজ!

কুমারের আয়ু কিসে বল দেখি আজ?”

সরু, মিহি, চুলের মতো সাপ দেখতে সূতার মতো সরু তবে তার হাঁকডাক শঙ্খের মতো রানীকে খবর দেয় সে, 

“ ডালিম কুমারের আয়ু ডালিমের বীজে।“ 

সব শুনে রাক্ষসী রানী সূতাশঙ্খ তাকে পাঠালো পাশাবতীর ঘরে। বাতাসে ভর দিয়ে গাছের উপর দিয়ে সে এগিয়ে চলে৷ সাপ  অলস, সূতাশঙ্খও ব্যতিক্রম নয়৷ রানীর ধারণাকে ফাঁকি দিয়ে সে তখন পথের ক্লান্তি কাটাতে মাঝপথে গাছের ফলের ভিতর ঢুকে  ঘুম দিলো। রাজকন্যা সে ফল খেলে লিখন, সাপ সব গেলো কন্যার পেটে। সে সাপ অজগরের বেশে অন্ধ রাজকুমারকে গিলতে আসে। বত্রিশ ফণা ছড়িয়ে বিষদাঁতে আগুন ছুটিয়ে লকলক করে জিভ। দৃষ্টি ফিরতেই  রাজপুত্রের তরোয়ালের আঘাতে অজগর সাত খন্ড হয়। 


 

তথ্য সূত্র - 

১) ঠাকুরমার ঝুলি - দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার 

২) ঠাকুরদাদার ঝুলি - দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

৩)  লোক সংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ - পল্লব সেনগুপ্ত 

৪) রূপকথার প্রসঙ্গ- বরুণ কুমার চক্রবর্তী