
বঙ্কিমী রূপকথা – ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, রাধারাণী
- 07 June, 2025
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা আর মৃণালিনী – বঙ্কিমের এই তিন আদি আখ্যান ছিল রোমান্স শ্রেণিভূক্ত। তারপর সমাজ সংসারের সমকালীন বাস্তবতায় এলেন বঙ্কিম, লিখলেন বিষবৃক্ষ (১৮৭৩)। উপন্যাসটি ব্যাপক আলোড়ন তুলল। কিন্তু তারপরেই আবার কিছুদিনের জন্য বঙ্কিম রোমান্সের জগতে ফিরলেন, লিখলেন রূপকথাধর্মী সহজ সরল প্রেম বিচ্ছেদের কাহিনী। বিষবৃক্ষের সমকালীন ইন্দিরা (১৮৭৩) যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪) আর রাধারাণী (পত্রিকায় প্রকাশ ১৮৭৫, পরে গ্রন্থাকারে) শুধু আকারেই ছোট নয়, শিল্পকীর্তির নিরিখেও বঙ্কিমের গৌণ কাজ বলেই বিবেচিত হতে পারে। এই পর্বটি যেন একটি বড় কাজের পর নতুন বড় কাজের দিকে যাবার মাঝে খানিক ধীরে চলা। গৌণ এই ত্রয়ী উপন্যাসের পরেই আমরা পাব বঙ্কিমের তিন অতি গুরুত্বপূর্ণ মহৎ শিল্পসৃষ্টি – চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭) ও কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮)।
ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, রাধারাণীর মিল শুধু আকারের ক্ষুদ্রতাতেই নয়, প্যাটার্নের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করতে পারি। এই তিনটি উপন্যাসেই নায়িকার জীবনে প্রথমে আসে ভাগ্যবিড়ম্বনা। কিন্তু সেই বিড়ম্বনা চরিত্রধর্মের তাড়না বা ভুল থেকে তৈরি হওয়া নয়, অনেকটাই নিয়তি নির্বন্ধ। ইন্দিরার জীবন অন্ধকার হয়ে গেল স্বামীগৃহে যাবার বেলায়, ডাকাতের হাতে পরে, যুগলাঙ্গুরীয় তে হিরণ্ময়ী ভালোবাসার মানুষকে বিবাহ করতে পারল না জ্যোতিষী কথিত অমঙ্গলবার্তার কারণে আর রাধারাণীর জীবনকে বিড়ম্বিত করল মামলায় হেরে নিঃস্ব হওয়া ও বালিকা বয়সে বাবা মায়ের অকাল মৃত্যুতে অনাথ হওয়ার করুণ ঘটনা। তবে শেষমেষ এই তিন আখ্যানেই এল মিলনাত্মক সমাপ্তি। ইন্দিরা ফিরে পেল স্বামী উপেন্দ্রকে, হিরণ্ময়ী আর রাধারাণী তাদের প্রেমিক পুরন্দর ও রুক্মিণীকুমারকে অনেক যন্ত্রণা ও বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে বিয়ে করতে সমর্থ হল। আমরা এই তিন আখ্যানের মধ্যেই রূপকথার গল্পের প্রচলিত ছক - বিড়ম্বনা ও ভাগ্য পুনরুদয়ের ইচ্ছাপূরণধর্মী পরিণতিকে দেখতে পাই। এগুলি তাই এক অর্থে আধুনিক রূপকথা, যদিও যুগলাঙ্গুরীয়তে রয়েছে ইতিহাসের পট আর বাকী দুটিতে সমকাল সংলগ্নতা।
ইন্দিরা
বঙ্কিমের বহু আলোচ্য উপন্যাসগুলির তালিকায় ‘ইন্দিরা’ পড়ে না। দুর্গেশনন্দিনীর মতো সূচনাগৌরব, কপালকুণ্ডলার মতো কাব্যিক সুষমা, বিষবৃক্ষ বা কৃষ্ণকান্তের উইলের মতো সমাজনীতির নিরীক্ষা, রাজসিংহের মতো ইতিহাস প্রেক্ষাপট বা আনন্দমঠের মতো বিতর্কের উপাদান তার মধ্যে নেই।
১৮৭৩ সালে একই বছরে প্রকাশিত হয় বঙ্কিমের দুটি উপন্যাস – ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘ইন্দিরা’। প্রথমটি নিয়ে সেকালে প্রবল আলোড়ন ওঠে, কারণ সেখানে দেখানো হল বিধবা নারীর পরপুরুষাসক্তি। যদিও ততদিনে বিধবা বিবাহ আইনসঙ্গতভাবে প্রচলিত হয়েছে, কিন্তু এই বিদ্যাসাগরীয় আন্দোলন নিয়ে বঙ্গসমাজের রক্ষণশীল অংশের আপত্তি প্রবল। একটি দুটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিয়ে আইনী ছাড়পত্র পেরিয়ে সমাজমনেও এই প্রথা তখনো খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয় নি। বঙ্কিম অবশ্য তাঁর উপন্যাসে বিধবা বিবাহের আয়জন করলেন, নায়িকাকে বাইরে থেকে নিয়ে এলেন পরিবারের অভ্যন্তরে। প্রথমা স্ত্রী সূর্যমুখীই স্বামী নগেন্দ্রর সঙ্গে বিধবা কুন্দনন্দিনীর বিবাহ দিলেন। নগেন্দ্র ও কুন্দনন্দিনীর বাসনাতপ্ত হৃদয় আঁচ করেই সূর্যমুখীর এই আয়োজন। কিন্তু তাতে তার মনের গভীরতম প্রদেশ সাড়া দিতে পারে নি। কিন্তু বিয়ের অব্যবহিত পরেই সূর্যমুখী ঘর ছাড়লেন। নগেন্দ্রও অনুতাপতদগ্ধ হৃদয়ে তার অন্বেষণে কাটিয়ে দিলেন অনেকগুলো দিন সপ্তাহ মাস। সূর্যমুখী যখন ফিরলেন তখনই আবার এলো বিপর্যয়। কুন্দনন্দিনী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন।
প্রকাশের পর থেকে আজ অবধি বিষবৃক্ষ উপন্যাস নিয়ে আলাপ আলোচনা বিতর্ক জারী আছে। বিধবা বিবাহ তথা নারীর জীবনতৃষ্ণাকে কীভাবে দেখলে শিল্পীর ন্যায়ধর্ম বজায় থাকত আর বঙ্কিম কেমনভাবে রক্ষণশীল অবস্থান থেকে সেই শৈল্পিক ন্যায়কে বর্জন করলেন, তাই নিয়ে অনেক পাঠকের আক্ষেপ প্রবল। পাশাপাশি এই উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণ, প্লট বিন্যাস, কাহিনীর নাটকীয় উত্থানপতন ও গতি যে উপন্যাসশিল্পের দিক থেকে একে অনন্য করে রেখেছে, তাও পাঠক সমালোচক মহল স্বীকার করে নিয়েছে। বিষবৃক্ষের এই শিল্পসাফল্যর পর বঙ্কিম লিখলেন ইন্দিরা। বিষবৃক্ষের সমকালীন এই লেখাটি তুলনায় কম বিতর্কিত, পাশাপাশি কম আলোচিত। এর কারণ যে সমাজপ্রশ্ন ও শৈল্পিক নৈপুণ্য বিষবৃক্ষকে অনন্য করেছে, ইন্দিরাতে বঙ্কিম সে পথে না হেঁটে একটি সহজ সরল ইচ্ছাপূরণধর্মী গল্প বলেছেন। গল্প বলার টেকনিকটিতে যতই মুন্সিয়ানা থাক, শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা এমন কোনও সমাজ দার্শনিক প্রশ্নের ওপর আধারিত নয়, যা একে ক্লাসিকের গোত্রে ঠেলে দিতে পারে।
এতদসত্ত্বেও ইন্দিরা উপন্যাসটির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যাকে উপেক্ষা করা যায় না। বঙ্কিমের এই উপন্যাসেই সম্ভবত নারীর কামনা বাসনা সবচেয়ে স্পষ্ট, সবচেয়ে সরাসরি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছ। বঙ্কিমের অন্যান্য ক্ষুদ্রাকার আখ্যান – যুগলাঙ্গুরীয় বা রাধারাণীর চেয়ে এখানেই ইন্দিরা আলাদা।
উপন্যাসের নায়িকার নামেই উপন্যাসের নামকরণ, সেই ইন্দিরাকে ঘিরেই উপন্যাসের আখ্যান দানা বেঁধে উঠেছে। উনিশ বছর বয়সে ইন্দিরার বিয়ে হয়েছিল উপেন্দ্রর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পরেও দীর্ঘ আট বছর স্বামীসঙ্গ লাভের সৌভাগ্য ইন্দিরার হয় নি। সে ছিল বড়লোক বাবার মেয়ে। বাবা চেয়েছিলেন জামাই আগে ভালো উপার্জনের দিকে মন দিক, তারপর সুখে ঘর সংসার করুক। আঁতে ঘা নিয়েই উপেন্দ্র বেরিয়ে পড়ে ভালো কাজের সন্ধানে। আট বছর স্বামীসঙ্গ সুখ বঞ্চিতা ইন্দিরা যৌবনজ্বালায় অস্থির হয়ে স্বামীসঙ্গ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। একাকী শয্যা তার অসহনীয় বোধ হচ্ছিল। খানিক আড়াল আবডাল থাকলেও নারীর যৌন কামনার এমন খোলাখুলি প্রকাশ বঙ্কিম বা উনিশ শতকী বাংলা উপন্যাসে খুব সুলভ নয়।
“রাগে আমার শরীর গর গর করিত। কত টাকা চাই? পিতা—মাতার উপর বড় রাগ হইত-কেন পোড়া টাকা উপার্জনের কথা তাঁহারা তুলিয়াছিলেন? টাকা কি আমার সুখের চেয়ে বড়! আমার বাপের ঘরে অনেক টাকা—আমি টাকা লইয়া “ছিনিমিনি” খেলিতাম। মনে মনে করিতাম, একদিন টাকা পাতিয়া শুইয়া দেখিব—কি সুখ? একদিন মাকে বলিলাম, “মা, টাকা পাতিয়া শুইব|” মা বলিলেন, “পাগলী কোথাকার!”
তবে মা মেয়ের যন্ত্রণার আসল জায়গা বুঝলেন ও জামাইকে নিজের ঘরে ও মেয়েকে সেখানে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। আট বছর পর যখন উপেন্দ্র ঘরে ফিরল, তখন উঁচু পদে চাকরী আর অনেক টাকা পয়সা তার করায়ত্ত হয়েছে। উপেন্দ্রর বাবার চিঠি এল ইন্দিরার বাবার কাছে। ইন্দিরাকে এবার শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর আবেদনের আড়ালে নয়া গরিমার ঔদ্ধত্যের ছাপ সে চিঠিতে ছিল স্পষ্ট। ইন্দিরা পালকী চেপে লোকলস্কর সঙ্গে নিয়ে রওনা হল শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথমাঝে এল বিপর্যয়। ডাকাতে কালীদীঘীতে দলটি সত্যিই পড়ল ডাকাতের হাতে, ইন্দিরা লুন্ঠিতা হলেন। শেষমেষ ডাকাতদলের হাত থেকে পালিয়ে প্রথমে জনৈক কৃষ্ণদাসবাবুর বাড়িতে ও পরে তার বোন সুভাষিণীর বাড়িতে ইন্দিরার আশ্রয় মিলল। সুভাষিণীর সংসারে বাহ্যত পাচিকাবৃত্তিতে রত হলেও ইন্দিরার বড় ঘরের প্রেক্ষাপট ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকল, সুভাষিণী ইন্দিরাও পরস্পরের ঘনিষ্ট সখীতে রূপান্তরিত হলেন। সুভাষিণী কীভাবে ইন্দিরার ভাগ্যবিড়ম্বনার সমুদয় আখ্যান জানলেন ও উকিল স্বামী রমণবাবুর সহায়তায় ইন্দিরার স্বামী উপেন্দ্রকে তাঁদের ঘরে এনে ইন্দিরার সামনে দাঁড় করাতে পারলেন, তার কলাকৌশল রম্য আখ্যানে বঙ্কিম উপস্থিত করেছেন। উপেন্দ্র স্বাভাবিকভাবেই হারানো স্ত্রী ইন্দিরাকে চিনতে পারলেন না। ইন্দিরার অবশ্য দয়িতকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না। এবার শুরু হল এক নতুন পরীক্ষার পালা। ডাকাতের হাতে পড়া বউকে উপেন্দ্র ঘরে ফেরাতে রাজী কীনা তা কৌশলে বুঝে নিতে চাইলো ইন্দিরা। স্বামীর এই বিষয়ে দ্বিধা দেখে প্রয়োগ করল ভিন্ন অস্ত্র। সে তখন স্বামীসঙ্গসুখ লাভের জন্য মরীয়া। মদনবাণে পরিচয়ের আড়ালে থাকা স্বামীকে বিদ্ধ করে তার ঘরে পর্যন্ত উঠে এল সে। এখানে আখ্যানমধ্যে এক অদ্ভুত টেনশন পয়েন্ট তৈরি করেছেন বঙ্কিম। পাঠক ও ইন্দিরা জানে যে উপেন্দ্রই তার স্বামী। ফলে তাদের কামনাতুর আবেগভরা দৃশ্যাবলী পাঠকমনে সমাজনিষিদ্ধ সম্পর্কের দ্যোতনা আনে না। কিন্তু উপেন্দ্র জানেন না ইন্দিরাই তার হারানো স্বী। তাই তার ইন্দিরা আসক্তি সেই পর্বে খানিকটা পরনারী সংসর্গের ব্যাপারই বটে। স্বামীর চিত্তবৃত্তির এই দিকটি ইন্দিরাকে অবশ্য আকুল করে নি, সে বিপর্যয়পর্ব পেরিয়ে স্বামী শ্বশুরের ঘরে ফিরে নিজের যৌবনজ্বালা মেটাতে ও তার যাবতীয় বাধা নিষ্কন্টক করতেই ব্যাগ্র ছিল। এজন্য প্রচলিত কিছু গণ্ডী পেরোতে তার আপত্তি ছিল না। এটাই ইন্দিরা চরিত্রকে অনেকটা ব্যতিক্রমী করেছে। উপন্যাসটির আখ্যানভাগটি খুব বেশি বিশেষত্ব দাবী করতে না পারলেও ইন্দিরা চরিত্রটি কিন্তু এসব কারণে বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ।
ইন্দিরা চরিত্রের মাধ্যমে আর একটি দিক ফুটে ওঠে যা সেকালের বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যেই ছিল অতিবিরল। উপন্যাসের এই অংশটির ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক।
“সু। আচ্ছা, আগে তোর ঘর হোক, তারপর ঘরে আগুন দিস। ও সব কথা রাখ।কেমন করে স্বামীর মন ভুলাবি, তার একজামিন দে দেখি? তা নইলে ত তোর গতি নেই।
আমি একটু ভাবিত হইয়া বলিলাম, “সে বিদ্যা ত কখনও শিখি নাই।”
সু। তবে আমার কাছে শেখ। আমি এ শাস্ত্রে পণ্ডিত, তা জানিস?
সু। তবে শেখ। তুই যেন পুরুষ মানুষ। আমি কেমন করিয়া তোর মন ভুলাই দেখ।
... বলিলাম, “যা শিখাইলে, তা স্ত্রীলোকের অস্ত্র বটে, কিন্তু এখন উ-বাবুর উপর খাটিবে কি?”
সুভাষিণী তখন হাসিয়া বলিল, “তবে আমার ব্রহ্মাস্ত্র শিখে নে।”
এই বলিয়া, মাগী আমার গলা বেড়িয়া হাত দিয়া আমার মুখখানা তুলিয়া ধরিয়া, আমার মুখচুম্বন করিল।
… সুভাষিণী বলিল, “তোর তবে বিদ্যা হবে না। তুই কি জানিস, একজামিন দে দেখি। এই আমি যেন উ-বাবু এই বলিয়া সে সোফার উপর জমকাইয়া বসিয়া,--হাসি রাখিতে না পারিয়া, মুখ কাপড় গুঁজিতে লাগিল। সে হাসি থামিলে বলিল, “একজামিন দে”। তখন যে বিদ্যার পরিচয় পাঠক পশ্চাৎ পাইবেন, সুভাষিনীকেও তাহার কিছু পরিচয় দিলাম।সুভাষিনী আমাকে সোফা হইতে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল—বলিল “দূর হ পাপিষ্ঠা! তুই আস্ত কেউটে!”
… আমি। আচ্ছা। এখন সাড়া শব্দে বুঝিতে পারিতেছি, বাবুদের খাওয়া হইয়া গেল। রমণ বাবুর ঘরে আসিবার সময় হইল, আমি এখন বিদায় হই। যা শিখিয়াছিলে, তার মধ্যে একটা বড় মিষ্ট লাগিয়াছিল—সেই মুখচুম্বনটি। এসো আর একবার শিখি।
তখন সুভাষিণী আমার গলা ধরিল, আমি তার গলা ধরিলাম। গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক পরস্পরে মুখচুম্বন করিয়া, গলা ধরাধরি করিয়া, দুই জনে অনেক্ষণ কাঁদিলাম। এমন ভালবাসা কি আর হয়? সুভাষিণীর মত আর কি কেহ ভালবাসিতে জানে? সুভাষিণীর মত আর কি কেহ ভালবাসিতে জানে? মরিব, কিন্তু সুভাষিণীকে ভুলিব না।”
আমাদের আগ্রহ হয় বঙ্কিমের সমকালীন পাঠকপাঠিকাদের কেউ কি সমকামী সম্পর্কের দৃষ্টিকোণে উপন্যাসের এই অংশটি পাঠ করেছিলেন? এই নিয়ে কোনও আলাপ আলোচনা হয়েছিল, এমন কোনও সংবাদ আমরা জানি না। তবে আজকের কোনও কোনও পাঠকের চোখে এই অংশটির পাঠ উপন্যাসের দুই সখী – ইন্দিরা ও সুভাষিণীর সমকাম সম্পর্কের ইঙ্গিৎ নিয়েই ধরা দিতে পারে।
বঙ্কিমের এই উপন্যাসে নারীর সমকামী সম্পর্কের ইঙ্গিৎ থাকলেও তা অবশ্য বিষমকামের চিরাচরিত দিকটিকে অতিক্রম করে যায় নি। সুভাষিণী ও তার স্বামী রমণবাবুর মিষ্টি মধুর দাম্পত্যের ছবি এই উপন্যাসে ধরা আছে। ইন্দিরার স্বামীসঙ্গ লাভের আতপ্ত ইচ্ছাটিও আদ্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাসের আখ্যানভাগ জুড়ে। বস্তুতপক্ষে নারীর পুরুষসঙ্গ ও শরীরী কামনার ইঙ্গিৎময় এবং সুস্পষ্ট উচ্চারণের নিরিখে ইন্দিরাকে কালাতিক্রমী নভেল হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
যুগলাঙ্গুরীয়
যুগলাঙ্গুরীয় উপন্যাস নয়, বিশুদ্ধ রোম্যান্স। এমনকী একে একালের রূপকথা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কাহিনী অংশটি রূপকথার ঢঙেই সাজিয়েছেন বঙ্কিম। নায়িকা হিরন্ময়ী ও নায়ক পুরন্দরের বাল্য প্রেম বিবাহে পরিণতি পেল না। পুরন্দরের পিতা কেন যে বিবাহে অসম্মতি জানালেন তাও জানা গেল না। অভিভাবকের বারণে বিবাহ রদ হলেও ভালোবাসার মানুষরা পরস্পরকে ভুলতে পারল না। ভোলার চেষ্টায় নায়ক দূর সিংহলে বাণিজ্যে গেল। বহু বছর আর ফিরল না। হিরন্ময়ীও রইলো অবিবাহিত। তারপর একদিন পারিবারিক গুরুদেব পরিবারকে ডেকে পাঠালেন কাশীতে। সেখানে গুরুদেবের আয়োজনে হিরন্ময়ী পাত্রস্থ হল, তবে বিবাহ কাজ হল বর বউ এর চোখ বাঁধা অবস্থায়। কেউ কাউকে চিনল না, জানল না। পরবর্তীকালে চেনার চিহ্ন হিসেবে দুজনকে দেওয়া হল একই রকমের আংটি, যে অভিজ্ঞান বিখ্যাত অভিজ্ঞান শকুন্তলম থেকেই স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ভারতীয় সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বিবাহের পর হিরন্ময়ী সপরিবার তাদের তাম্রলিপ্ত নগরে ফিরল। বঙ্কিম জানিয়েছেন এ কাহিনী যে ঐতিহাসিক সময়ের সেই সময়ে তাম্রলিপ্তের পাশেই ছিল সমুদ্র আর এটি ছিল নদী বন্দর। এই তথ্য ও ভাষাভঙ্গীমায় অতীত কালের ব্যঞ্জনা ছাড়া ইতিহাস প্রসঙ্গ অবশ্য এই আখ্যানে আর সেভাবে আসে নি। তাম্রলিপ্তে ফেরৎ আসার পর রূপকথার ছক অনুসারেই নায়িকার ভাগ্যবিড়াম্বনা ঘটল। বাবা মারা গেলেন, মাও সহমৃতা হলেন। বাবা প্রচুর ঋণ রেখে যাওয়ায় সমুদয় সম্পত্তি মায় বসতবাড়িটি পর্যন্ত দেনা শোধ করতে ব্যয়িত হল। একটি জীর্ণ কুটীরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল আশৈশব স্বচ্ছলতা ও বৈভবে কাটানো নায়িকা হিরন্ময়ী।
এই সময়েই পুরন্দর আবার ফিরলেন তাম্রলিপ্তে। সঙ্গে আনলেন প্রচুর ধনসম্পত্তি। ইতোমধ্যে পাঁচ বছর কেটেছে, অতিক্রান্ত হয়েছে জীবনফাঁড়া কাটাতে পাঁচ বছরের জন্য স্বামী স্ত্রীর দেখা সাক্ষাৎ না করার নির্দেশকাল। রাজা মদনদেব ইতোমধ্যে গুরুদেব মদনস্বামীর কাছ থেকে হিরন্ময়ী পুরন্দর বৃত্তান্ত জেনেছেন। ক্রমশ পাঠকও জানতে পারে যে হিরন্ময়ীর কুষ্টিতে নাকী লেখা ছিল বিবাহের পাঁচ বছরের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাকে বৈধব্যের মুখোমুখি হতে হবে। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হবার পরেই রাজা মদনদেব রাজসভায় ডেকে নিলেন হিরন্ময়ী পুরন্দরকে। গুরুদেবের কাছ থেকে যা জেনেছিলেন সব প্রকাশ করে দিলেন। মিলিয়ে দিলেন হিরন্ময়ী পুরন্দরকে।
রূপকথার ছকেই মধুর মিলনে সমাপ্ত হল আখ্যান। জীবনে এল ধনসম্পদ, প্রেম আর পরিবার। সামাজিক কোনও সমস্যার দিকে বঙ্কিম তাঁর এই আখ্যানকে সামান্যতম হেলাতে চান নি। আগাগোড়া একে রূপকথা রোমান্সের আবহে রাখতে চেয়েছেন। মাতাতে চেয়েছেন গল্পবুভুক্ষু পাঠককে। বিষবৃক্ষে উপন্যাস সিদ্ধি অর্জন করেও মাঝের বেশ কয়েকটা বছর ছোট আখ্যান, হালকা রোমান্সের জগতে ঘোরাফেরা করেছেন বঙ্কিম। ইন্দিরাতে এর সূচনা। তারপর যুগলাঙ্গুরীয়। এর পর আবার নিরীক্ষার জটিলতর জগতে ফিরবেন বঙ্কিম। লিখবেন চন্দ্রশেখর, যা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নভেলিস্ট হিসেবে তাঁকে খ্যাতিমান করতে একটি মাইল ফলক।
রাধারাণী
যুগলাঙ্গুরীয় উপন্যাসে বঙ্কিম ইতিহাসের পটে যে রূপকথাধর্মী রোমান্স জাতীয় আখ্যান লিখেছিলেন, তারই যেন এক আধুনিক সংস্করণ রচনা করলেন রাধারাণী উপন্যাসে। যুগলাঙ্গুরীয়র মতো রাধারাণীতেও প্রথম জীবনে নায়িকার অশেষ কষ্ট আর পরিশেষে নায়কের সঙ্গে মধুর মিলন। যুগলাঙ্গুরীয় সেকালের কাহিনী বলে সেখানে নিয়তি, ভাগ্যগণনা ইত্যাদি পথে নায়িকার দূর্বিপাক সৃষ্টি করেছিলেন বঙ্কিম। রাধারাণী ইংরেজ আমলে রচনা। তাই নায়িকার দূর্বিপাকের জন্য নিয়তির বদলে আদালত ও মামলা মোকাদ্দমাকে হাজির করেছেন বঙ্কিম ও আধুনিক পাঠকের বিশ্বাস উৎপাদনে সফল হয়েছেন।
উপন্যাসের একেবারে শুরুতেই রাধারাণীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ছবিটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন বঙ্কিম। - “রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখিতে গিয়াছিল। বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ণ হয় নাই। তাহাদিগের অবস্থা পূর্বে ভাল ছিল–বড়মানুষের মেয়ে। কিন্তু তাহার পিতা নাই; তাহার মাতার সঙ্গে একজন জ্ঞাতির একটি মোকদ্দমা হয়; সর্বস্ব লইয়া মোকদ্দমা; মোকদ্দমাটি বিধবা হাইকোর্টে হারিল। সে হারিবামাত্র, ডিক্রীদের জ্ঞাতি ডিক্রী জারি করিয়া ভদ্রাসন হইতে উহাদিগকে বাহির করিয়া দিল। প্রায় দশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি; ডিক্রীদার সকলই লইল। খরচা ও ওয়াশিলাত দিতে নগদ যাহা ছিল, তাহাও গেল; রাধারাণীর মাতা, অলঙ্কারাদি বিক্রয় করিয়া, প্রিবি কৌন্সিলে একটি আপীল করিল। কিন্তু আর আহারের সংস্থান রহিল না। বিধবা একটি কুটীরে আশ্রয় লইয়া কোন প্রকারে শারীরিক পরিশ্রম করিয়া দিনপাত করিতে লাগিল। রাধারাণীর বিবাহ দিতে পারিল না।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রথের পূর্বে রাধারাণীর মা ঘোরতর পীড়িতা হইল–যে কায়িক পরিশ্রমে দিনপাত হইত, তাহা বন্ধ হইল। সুতরাং আর আহার চলে না। মাতা রুগ্না, এ জন্য কাজে কাজেই তাহার উপবাস; রাধারাণীর জুটিল না বলিয়া উপবাস। রথের দিন তাহার মা একটু বিশেষ হইল, পথ্যের প্রয়োজন হইল, কিন্তু পথ্য কোথা? কি দিবে?
রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে কতকগুলি বনফুল তুলিয়া তাহার মালা গাঁথিল। মনে করিল যে, এই মালা রথের হাটে বিক্রয় করিয়া দুই একটি পয়সা পাইব, তাহাতেই মার পথ্য হইবে।”
মেলায় ফুল বেচতে এসে রাধারাণীর সঙ্গে জনৈক ধনী ব্যক্তি রুক্মিণীকুমার রায়ের পরিচয়। খানিক আড়াল থেকে নানারকম সাহায্য করে রুক্মিণীবাবু চলে যান কিন্তু পরস্পরের প্রতি পরস্পরের এক নিবিড় টান তৈরি হয়ে যায়।
রাধারাণীর বিধবা মা মৃত্যুর সময় বালিকা রাধারাণীকে পারিবারিক শুভানুধ্যায়ী কামাখ্যাবাবুর হাতে তুলে দেন লালল পালনের জন্য। সে কাজ কামাখ্যাবাবু অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে করেন। রাধারাণীকে তিনি শুধু স্নেহচ্ছায়াই দিলেন না, আধুনিক যুগের উপযোগী করেও গড়ে তুললেন।
“কামাখ্যা বাবু নব্যতন্ত্রের লোক–বাল্যবিবাহে তাঁহার দ্বেষ ছিল। তিনি বিবেচনা করিলেন যে, রাধারাণীর বিবাহ তাড়াতাড়ি না দিলে, জাতি গেল মনে করে, এমত কেহ তাহার নাই। অতএব যবে রাধারাণী, স্বয়ং বিবেচনা করিয়া বিবাহে ইচ্ছুক হইবে, তবে তাহার বিবাহ দিব। এখন সে লেখাপড়া শিখুক।”
রাধারাণী যে পরিচয়ের পর থেকেই রুক্মিণীকুমার রায়কে মন দিয়ে ফেলেছিল তা জানা গেল পাঁচ বছর পর যখন রাধারানীর বিবাহ আয়োজন শুরু হল। “পাঁচ বৎসর গেল–রাধারাণী পরম সুন্দরী ষোড়শবর্ষীয়া কুমারী। কিন্তু সে অন্ত:পুরমধ্যে বাস করে, তাহার সে রূপরাশি কেহ দেখিতে পায় না। এক্ষণে রাধারাণীর সম্বন্ধ করিবার সময় উপস্থিত হইল। কামাখ্যা বাবুর ইচ্ছা, রাধারাণীর মনের কথা বুঝিয়া তাহার সম্বন্ধ করেন। তত্ত্ব জানিবার জন্য আপনার কন্যা বসন্তকুমারীকে ডাকিলেন।
বসন্তের সঙ্গে রাধারাণীর সখিত্ব। উভয়ে সমবয়স্কা। এবং উভয়ে অত্যন্ত প্রণয়। কামাখ্যা বাবু বসন্তকে আপনার মনোগত কথা বুঝাইয়া বলিলেন।
বসন্ত সলজ্জভাবে, অথচ অল্প হাসিতে হাসিতে পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “রুক্মিণীকুমার রায় কেহ আছে?”
কামাখ্যা বাবু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “না। তা ত জানি না। কেন?”
বসন্ত বলিল, “রাধারাণী রুক্মিণীকুমার ভিন্ন আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না |”
কা। সে কি? রাধারাণীর সঙ্গে অন্য ব্যক্তির পরিচয় কি প্রকারে হইল?
বসন্ত অবনতমুখে অল্প হাসিল। সে রথের রাত্রির বিবরণ সবিস্তারে রাধারাণীর কাছে শুনিয়াছিল, পিতার সাক্ষাতে সকল বিবৃত করিল।”
এরপরের কাহিনী সরল ও রূপকথাধর্মী রোমান্সের মতো মিলনান্তক। যথাকালে রুক্মিণীকুমার সংবাদপত্রে দেওয়া তাঁর অন্বেষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপণটি নিয়ে হাজির হলেন রাধারাণী সকাশে। কথায় কথায় জানা গেল রাধারাণী যেমন রথের দিনের সাক্ষাতে রুক্মিণীকুমারকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন, রুক্মিনীকুমারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। সমস্ত আড়াল সরে রাধারাণী রুক্মিণীকুমারের বিবাহ এরপর ছিল সময়ের অপেক্ষা।
সরল, সমাজ সংসার ন্যায় নীতির গূঢ় প্রশ্ন নিয়ে অনেক ক্লাসিক উপন্যাসের জন্মদাতা বঙ্কিম যে শত বন্ধন জাল জটিলতা রহিত পাঠকের মনমাতানো হালকা গল্পরস জমাতে কতটা পারদর্শী ছিলেন, রাধারাণী তার উদাহরণ।