অরবিন্দ আদিগার 'হোয়াইট টাইগার' ও ভারতের সমাজ রাজনীতি

অরবিন্দ আদিগার 'দ্য হোয়াইট টাইগার' ২০০৮ সালে যখন ম্যান বুকার পুরস্কার পেলো, পাঠক-সমালোচকরা বিভক্ত হলেন দুটি দলে। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ, বিশেষত উত্তর ভারতের অন্ধকারাছন্ন দিকগুলো যেভাবে নির্ভীক সাহসিকতায় তুলে ধরা হয়েছে প্রোটাগোনিস্ট বলরামের জবানিতে, সমালোচকদের একদল সেই সাহসী প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানালেন। আরেকদল পেলেন ষড়যন্ত্রের ঘ্রাণ, তাঁরা মনে করলেন আন্তর্জাতিক পাঠকদের সামনে উত্তরভারত সম্পর্কে এহেন উলঙ্গ সত্যবর্ণন আদতে একপেশে এবং এই একপাক্ষিক উপস্থাপনই নাকি বইটির পুরস্কারের মঞ্চে এগিয়ে থাকার কারণ। সত্যাসত্য পেরিয়ে এই দুই মতামতের মধ্যেও এই কথা অবশ্য স্বীকার্য যে লক্ষণগড় থেকে ধানবাদ হয়ে রাজধানী দিল্লি ও তারপর শিল্পনগরী ব্যাঙ্গালোরের বুকে বলরামের ভাগ্যসন্ধানের আখ্যান পাঠককে কতগুলো অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করায়।

          বলরাম হালওয়াইয়ের জীবন দর্শন এক আপাদমস্তক পলিটিক্যাল ইনকারেক্টনেসের কচকচি। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করতে না পারা বলরাম স্বভাবতই নিজের অধিকার সম্পর্কে অবগত নয়, তদুপরি গড়পড়তা ভারতীয় হিন্দু পুরুষের মতোই সেও নারীবিদ্বেষী, মুসলিমবিরোধী। আদিগা বলরামের চরিত্রায়নে কোন রাজনৈতিক পরিচ্ছন্নতার ধার ধারেননি বলেই বোধ হয় ভারতবর্ষের গ্রামীণ অঞ্চলের প্রান্তিক অর্ধশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষের খণ্ড চিত্র হিসেবে চরিত্রটি আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। সে জানে দুঃস্থের জীর্ণ লিকলিকে বাহু শোষকের বেশি বলের বিরুদ্ধে পাঞ্জা লড়ার উপযুক্ত নয়। তাই কোন আপোস-আলোচনা নয়, শত শত গরীবের বুকে পা দিয়ে ক্ষমতাকে মুষ্টিবদ্ধ করেছে যারা, তাদের আঁচড়ে কামড়ে তাদেরই মুঠো থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারলে তবেই মোক্ষ, আর সেই মোক্ষলাভের পথে অহিংসার স্থান নেই।

অনটনের সংসারে অনাদরে বেড়ে ওঠা মুন্না যখন বড় শহরে বড়লোকের ড্রাইভার বলরাম, তখন থেকেই তার চোখে ছুলোভাবে ধরা দিতে থাকে তার নিজের শ্রেণীর সাথে তার মালিকের শ্রেণীর যাপনগত পার্থক্যগুলো। এরপর একান্ত অনুগত ড্রাইভার থেকে মালিকের নাম নিয়ে এন্ট্রেপ্রেনিওর অশোক শর্মা, 'দ্য হোয়াইট টাইগার' হয়ে ওঠার এই মেটাফোরিক্যাল উত্থান কিন্তু তাই বলে সমগ্র শ্রমজীবী মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ মুক্তির লড়াই নয়, বন্ধন মুক্তির এই সুচারু পরিকল্পনা বরং অনেক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বলরামকে দেখে তাই কখনো কখনো ভয় হয়, মুরগির খোঁচড় থেকে পালিয়ে সে নিজেই কোনো একদিন এক নতুন শোষণ যন্ত্রের মালিক হয়ে বসবে না তো?

প্রেসিডেন্ট জিয়াবাও আর তাঁর দেশকে সে শ্রদ্ধা করে কারণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মতন তাঁর দেশ ইউরোপীয় 'সভ্য' দেশের দাসত্ব স্বীকার করেনি কোনোদিন। বলরাম মনে করে ভারতের মতন দেশে ৭০% খেটে খাওয়া মানুষের এই দাস হয়ে থেকে যাওয়ার অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তিই তাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের মূল কারণ। গোটা দেশ তার কাছে দুই ভাগে বিভক্ত- একদিকে উদ্বৃত্ত ভোগকারী পেটমোটা মানুষের ভারত, আর অন্যদিকে অভুক্ত আধপেটা মানুষের ভারত। শোষণের উৎস এবং কার্যকারণ বিষয়ে বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ আর শ্রেণী বারংবার ফিরে ফিরে এসেছে তার জীবন দর্শনে। মালিককে খুন করে তার ঘুষের ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করার পর বলরাম ওরফে অশোক শর্মা তখন পুঁজিবাদী কূটনীতি আর ব্যক্তি স্বাধীনতার এক আশ্চর্য মিশেল। নিজের কৃতকর্মের জন্য সে কি অনুতপ্ত, নাকি গর্বিত? সেটা স্পষ্ট করে বোঝা না গেলেও শুধু এটুকু বোঝা যায় যে, স্বাধীনতা অর্জন তার কাছে কোন আদর্শগত মতবাদের উপপণ্য নয়, স্বাতন্ত্র্য অর্জনের পথ তার কাছে সমস্ত ভালো খারাপের ঊর্ধ্বে। 'মুরগির খুপড়ি' ভেঙে পালাতে চাওয়া বলরাম কি তবে ওয়ার্কিং ক্লাসের জেসাস ক্রাইস্ট, মহানির্বাণলব্ধ সিদ্ধার্থ, নাকি স্রেফ অর্থলোভী বিশ্বাসঘাতক? ছোটবেলা থেকে ক্ষমতাশালীদের লাথি খেতে খেতে যে ছেলে বড় হয়, সে কি তার সহজাত প্রবৃত্তিতেই চিনে ফেলতে পারে তার শ্রেণীশত্রুকে? নাকি ওই অপমানই তাকে তার চিহ্নিত শত্রুর প্রতি আমৃত্যু অনুগত থাকার শিক্ষা দেয়?

উত্তরপ্রদেশের বহুজন সম্প্রদায়ভুক্ত বলরাম বোনের বিয়ের ঋণ মেটাতে অপারগ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে স্কুলের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চলে আসে গ্রামের চায়ের দোকানে, সেখানে কয়লা ভাঙতে ভাঙতে সে বুকের ভেতর একসাথে লালন করে ক্ষোভ আর স্বপ্ন। দিল্লি শহরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হোন্ডা সিটির ভেতর বসে সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়, জড়োসড় হয়ে ফুটপাতে ঘুমোনো মানুষগুলো তখন তার বাস্তব জীবনের চেয়ে অনেক দূরে। প্রভুর প্রতি অলঙ্ঘনীয় আনুগত্যই যার জীবনধারণের সমীকরণ, সেই সাধাসিধে ছেলেটির এমন চতুর, ক্রুর, খুনে প্রবৃত্তির পুঁজিপতি হয়ে ওঠা কি নিজের শ্রেণীর কাছে ফিরতে চাওয়া, তাদের বিচার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা? ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলরাম হয়তো তার শ্রেণীর পক্ষে সংগ্রামের ইতিহাস জানে না, সে রাজনৈতিক চেতনা তার মধ্যে নেই, শোষকের বিরুদ্ধে একত্রিত আন্দোলনের কথা সে কোনদিন ভাবেও নি, তবু তার সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তিমূলক আখ্যান যেন 'সর্বহারার শৃঙ্খলমোচনের' এক বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা।

          বলরামের এই পাশা উল্টে দেওয়ার চেষ্টাকে নিঃসন্দেহে বিচ্ছিন্নই বলা চলে, কারণ তার জীবন দর্শনে উঠে এসেছে ভারতীয় দলীয় রাজনীতির প্রতি এক তীব্র ঘৃণা। গান্ধীর অহিংসার আদর্শকে সে ভারতবর্ষের আরো পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখে। আবার অপরদিকে তার গ্রামে বেড়ে চলা মাওবাদী কার্যকলাপ তাকে বিব্রত করে। তার রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সোশ্যালিস্ট পার্টি কিভাবে গ্রামের জমিদারদের সাথে হাত মিলিয়ে ভোটের আগের দিন রাতে সমঝোতা করে নিচ্ছে সবকিছু, সেই গল্প সে জিয়াবাওকে জানায়, তার কলম থেকে ঝরে পড়ে শ্লেষ, ব্যাঙ্গ, ক্ষোভ, হতাশা। নিজের গল্প বলতে বলতে সে তখন তার দেশের গণতন্ত্র নামক এক বিরাট রঙ্গমঞ্চের নাট্যকার। ভারতের অন্ধকারতম প্রান্তগুলিতে যেখানে মানুষের কাজের মজুরি নেই, দুবেলা পেটে ভাত নেই, শিক্ষা নেই, পানীয় জল নেই, হাসপাতাল নেই, ভোট ব্যবস্থার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি বেছে নির্বাচন করা সেখানে সোনার পাথরবাটির মতন অলীক। গনের তন্ত্রের নামে যেখানে ভোটের দিন ছাপ্পা ভোট, বুথরিগিং, টাকা ও পেশিবলের ক্ষমতা জাহির করা হয় বছরের পর বছর ধরে, দেশের নেতারা তাকেই গোটা বিশ্বের সামনে বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে প্রচার করে, লিফলেটের দুই পাতার ভেতর লিখে ফেলে গাদা গাদা না পূরণ হওয়া প্রতিশ্রুতি। লক্ষণগড় থেকে দিল্লি আসা বলরামের পরিবর্তিত, বিস্মিত দর্শন যেন স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের প্রতিটি যুবক যুবতীর মস্তিষ্কের ব্যবচ্ছেদ। ঠিক যেমন করে প্রতিদিন আধপেটা খেয়ে তারা ভেবে পায় না কিভাবে আমেরিকার অনুসরণ করে রাজধানী শহরের আকাশ থেকে মাটির তলা পর্যন্ত ফুঁড়ে দানবাকৃতী নগরায়ন চলে, যে দেশের সংবিধানে সাম্যবাদ গুরুত্ব পেয়েছে সেখানে কিভাবে রঙচঙে, আলোর রোশনাই পূর্ণ শপিংমলে ঢুকতে গেলে তাদের পোশাক দেখে যাচাই করা হয়, কিভাবে নেশার ঘোরে বড়লোকের চাকার তলায় চলে যায় ফুটপাতের বাচ্চা মেয়ে, কিভাবে এক দাস তার নিজের আনুগত্যের শেষ বিন্দু অব্দি নিংড়ে নিলেও তার মালিকের করা দোষের জন্য কৌশলে বলি চরানো হয় তাকেই। সংবিধানে বর্ণিত সাম্যবাদ, মৌলিক অধিকার, বা নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার মতন শব্দবন্ধগুলি 'বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র' নামক প্রহসনের সংলাপে লুকিয়ে থেকে যায়। ভোটের রাজনীতি, ঘুষের রাজনীতি, সুবিধাবাদের রাজনীতিতে সেই জন্যেই বোধহয় বলরামের মতন খেটে খাওয়া মানুষদের কোন কৌতুহল নেই। রাজনৈতিক নেতারা যারা নিজেদেরকে জনগনের ত্রাতা হিসেবে প্রচার করেন, তারা বলরামের মত মানুষদের কাছে মুরগির খোচড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কসাইয়ের মতন। ওই খোচড় থেকে বলরাম পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে কারণ সে তার ভাগ্য ওই কসাইদের হাতে তুলে দেয়নি, কোন স্বঘোষী তো নেতা ছাড়াই শ্রমজীবী মানুষ শোষিত হতে হতে একদিন যে হাতে অস্ত্র তুলে নেবেই, বলরাম যেন নিজের জীবনের গল্প দিয়ে সে কথাই প্রমাণ করেছে। খাঁচার সিধ কেটে সিস্টেমের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তবুও সে একবারও নিজের শ্রেণীর অন্যান্য মানুষের হাত ধরে পালানোর কথা ভাবেনি, আর এইখানেই যেন তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক ও উদ্দেশ্য আরো বেশি করে ধোঁয়াশা হয়ে আসে। তার জীবন যেন ক্রুর পুঁজিবাদ আর ব্যক্তিগত অগ্রগতির এক মূর্তিমান যুদ্ধক্ষেত্র। ফুটপাতের বাচ্চার হাত থেকে হণ্ডা সিটির জানলা গলে বলরামের হাতে আসা বুদ্ধমূর্তি যেন তার নির্বাণের চাবিকাঠি, তবুও কি একবারও 'ত্রাতা'র ভূমিকা পালন করার কথা ভেবেছে সে? বরং দাসত্বের শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের সাথে ক্রমাগত লড়াই করতে হয়েছে তাকে। যে জন্মগত পরিচয় তাকে শিখিয়েছে আনুগত্যপূর্ণ জীবনই তার অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়, সেই পরিচয়কে সে ঘৃণা করে। যারা সেই শ্রেণী পরিচয়ে এখনও প্রশ্নহীন বিশ্বাস রাখে, তাদেরকে হাত ধরে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলরাম ভাবেনি। রাতের একা ঘরে মালিকের অনিষ্ট চিন্তা করার পরেও সে যখন তারই খোঁজে তার অ্যাপার্টমেন্টের ছুটে ছুটে যায়, মদ্যপ মালিকের দিকে বাড়িয়ে দেয় ভরসার কাঁধ, বলরাম তখন আয়নার সামনে নিজের আত্মসম্মানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। নিজের রক্তে, নিজের শ্রেণী ও বর্ণগত চরিত্রে এমন অপরিসীম আনুগত্য তাকে অবাক করে দেয়। সে বুঝতে পারে যে শ্রেণী শোষিত হওয়াকে সেবা করার আসনে বসিয়েছে, মূল্যবোধের মিথ্যে শ্লাঘায় প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করেছে, শত্রুর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিহিংসা লালন পালন করা ছাড়া সেই শ্রেণীর মুক্তি নেই।

'বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস' – মাও সে তুংয়ের এই অমোঘ বাণী সম্পর্কে কি বলরাম অবগত ছিল? জানা নেই। তবে সে জানে হিংস্র রক্তক্ষয়ী প্রতিশোধ ব্যতীত আর যেকোনো পন্থাই সমঝোতার সামিল। না হয় থাকলোই তার মোটা দাগের বৈষয়িক লক্ষ্য, তবু যেন বলরাম হালওয়াইয়ের মতন ফিকশনের চরিত্রদের মধ্যে সর্বহারার একনায়কের আভাস পাওয়া যায়। নৈতিক-অনৈতিকের সূক্ষ্ম চালে ভেস্তে দিয়ে যারা যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষকের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে, বস্তাপচা মূল্যবোধ তাকে লক্ষ্যে স্থির থাকতে না দিলে সে সে নিজেকে বোঝায় যে ওই লাল সুটকেসে থাকা ঘুষের টাকা আদতে তারই মতন খেটে খাওয়া মানুষের ঘাম ও রক্তের দামের কাছে অনেক সস্তা, ভয় আর সাহস একসাথে বুকে নিয়ে মালিকের গলায় এমন করে ছুরি চালায় যেন ওই গলার নলিটাই তার এতদিনের দাসত্বের শেকল - একবার ওই শেকল ছিঁড়ে ফেলতে পারলেই মোক্ষলাভ!

            বলরামের মেটাফোরিক উত্থান তাই এমন অন্ধকার দিনে আশা জোগায়। শিকার হয়ে থেকে যাওয়ার বদলে চোখের পলকে বেমালুম খেলা ঘুরিয়ে শোষক-শোষিতের সমস্ত বাইনারী খোলনলচে দেওয়ার সাবলীল ক্ষমতা দিয়েছেন লেখক এর হাতে - ঠিক যতটা সাবলীল দক্ষতায় আর ক্লাইম্যাকটিকাল অনুক্রমে তিনি পাঠকদের সাথে বইটির ভূমিকায় পরিচয় করিয়েছেন তার প্রোটাগোনিস্টের - "Servant… Philosopher… Entrepreneur… Murderer!"