সাম্প্রতিক চিন ও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির গতিপ্রকৃতি প্রসঙ্গে

‘কাজের রিপোর্ট’এর অর্থই হ’ল কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে গৃহীত কৌতূহল জাগানো প্রতিবেদন। রিপোর্টে সাম্রাজ্যবাদ বা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি।এমনকি ইউক্রেনের ওপর চলমান রুশ আক্রমণেরও কোন উল্লেখ নেই, এই আক্রমণের নিন্দা জানানো তো দূরস্থান। পার্টি কর্তৃক জাতীয় পরিস্থিতির মূল্যায়ন, কাজের পর্যালোচনা ও আগামী কর্তব্য সম্পর্কে অতি দীর্ঘ বিবরণ সম্বলিত এই রিপোর্ট। যদিও জাতীয় জীবনের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ যে কোভিড১৯ অতিমারি সে সম্পর্কে রিপোর্টে খুবই সংক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে মাত্র। আর (সংক্ষিপ্ত) সেই বর্ণনাও করা হয়েছে গর্বোদ্ধত স্বরে “ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে রুখে দেওয়ার এক সর্বাত্মক জনযুদ্ধের” সফলতা হিসেবে চিহ্নিত করে, অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে চীনের নাগরিকেরা ইতিমধ্যেই দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন এবং‘কোভিড শূন্য নীতি’কে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চলেছেন। বিশেষ বিরক্তিকর দিকটি হ’ল, সাধারণ সম্পাদক তথা রাষ্ট্রপতি তথা কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যানের নজির বিহীন মহিমা কীর্তন। এটি যৌথ নেতৃত্বের ঊর্ধ্বে আর এক অত্যুচ্চ নেতার (সুপার লিডার) উত্থান এবং তাঁর হাতে সমস্ত ক্ষমতার একচেটিয়াকরণের অশুভ লক্ষণকে সূচিত করে, নিশ্চিতরূপে যার পরিণাম অবশেষে বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়।

এবার কংগ্রেসের মুখ্য রাজনৈতিক প্রতিপাদ্যগুলির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক। মজবুত তথ্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করার তাগিদে আমরা কাজের রিপোর্টে বর্ণিত বক্তব্যকেই ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করেছি যার পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও সংক্ষিপ্ত মন্তব্য অথবা ব্যাখ্যাকে আমরা বন্ধনির মধ্যে রেখেছি।

বিংশ কংগ্রেসের পশ্চাৎপট

“এক দশক আগে (যখন শি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন) আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হইঃ

পার্টির অভ্যন্তরে পার্টি নেতৃত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রশ্নে, স্পষ্ট উপলব্ধি ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবের পাশাপাশি দুর্বল, ফাঁপা ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পার্টি নেতৃত্বকে শিথিল করে দেওয়ার মত বিষয়গুলি বিরাজ করছিল এবং গভীর উদ্বেগজনক কিছু দুর্নীতির ঘটনা উদঘাটিত হয়েছিল।......

তীব্র কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাসমূহ চীনের অর্থনীতিকে ঘিরে ধরেছিল।... ...

ধনোপাসনা, ভোগবাদ, আত্মকেন্দ্রিকতা ও সবকিছু নাকচ করার (নেতিবাচকতা/সন্দেহবাদ) মত বিপথগামী চিন্তার ধরন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় এবং অনলাইন আলাপ আলোচনায় ব্যাপক বিশৃংখলা চোখে পড়ে। জনগণের মনোজগতে এবং সাধারণ মানুষের মতামতের ক্ষেত্রে এর গভীর প্রভাব দেখা দেয়।”

রিপোর্টে বলা হয়েছে, শি’র নেতৃত্বে এইসব গুরুতর সমস্যার বহুলাংশে সমাধান হয়েছে।

“চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিকে নিবিড়ভাবে অনুসরণের মধ্য দিয়ে সমস্ত পার্টি সদস্য আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছেন।...... আত্মনির্ভরতা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আমাদের উদ্যোগের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশে আরএন্ডডি (গবেষণা ও বিকাশ - অনুবাদক) খাতে ব্যয়কে ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান থেকে বাড়িয়ে ২.৮ ট্রিলিয়ন করা হয়েছে — যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সারা বিশ্বের মধ্যে আমাদের দেশই হ’ল আরএন্ডডি ক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মী সংখ্যার নিরিখে সবার উপরে।... ...”

সত্যিই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিগন্তে অগ্রগতির ক্ষেত্রে চীনের অপ্রত্যাশিত গতি এবং সেমি কন্ডাক্টর, স্টেট অফ দি আর্ট ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের মত সমসাময়িক সূর্যোদয় শিল্পের রূপায়ন পশ্চিমী দুনিয়াকেও তাক লাগিয়ে দেয়, কারণ প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সাথে সাথে এটি তাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের সামনেও গুরুতর চ্যালেঞ্জ হাজির করে।

সাফল্যগুলি তুলে ধরার পাশাপাশি রিপোর্টে সমাধান হয়নি এমন বহু সমস্যা ও অসমাপ্ত কাজ সম্পর্কেও বলা হয়েছে।

“মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। শহর এবং গ্রাম এলাকার মধ্যে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়ন ও আয় বণ্টনের ক্ষত্রে এখনও বড়সর ব্যবধান রয়েছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা পরিষেবা, শিশু ও বৃদ্ধদের পরিচর্যা এবং আবাসনের মত বিষয়গুলিতে আমাদের জনগণ নানা অসুবিধার মুখে পড়েন। রয়েছে বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ ও পরিবেশ সুরক্ষার মত সুবিশাল কর্তব্যকর্ম।… ...দুর্নীতির সূতিকাগারগুলিকে নির্মূল করা এখনও দুরূহ কাজ।... ... দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে......পদস্থ আধিকারিকরা যাতে স্পর্ধা ও সুযোগ না পায় অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার বাসনা না জাগে সেজন্য পদক্ষেপ (গ্রহণকে সুনিশ্চিত) করতে হবে।”

রিপোর্ট ‘সূতিকাগারগুলিকে’ সুনির্দিষ্টকরণে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু আগের তুলনায় দুর্নীতি মোকাবিলায় বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশী বাস্তবসম্মত, মার্জিত ও সর্বতোমুখী। অতীতে শত শত দুর্নীতিবাজ আমলাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর যে পন্থা নেওয়া হয়েছিল তা অসফল বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। এখন রোগ নিরোধের ওপরই বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে — “পদাধিকারীরা যাতে স্পর্ধা ও সুযোগ না পায় অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার বাসনা না জাগে” — উল্লেখের সঙ্গে শাস্তির প্রসঙ্গকেও খারিজ করা হয়নি।

রিপোর্টে একটি প্রশ্নে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, শি’র নেতৃত্বে পার্টি “তত্ত্বগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে — যা এক নতুন যুগের জন্য চীনা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারার উপর আধারিত।” এটাও স্পষ্ট করা হয়েছে যে এই ‘চিন্তাধারা’ সমগ্র একুশ শতক ধরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির(এবং নিশ্চিতভাবে সরকারেরও) সমস্ত কর্মকাণ্ডের বুনিয়াদী পথ প্রদর্শক হিসেবে থাকবে বলেই আশা করা যায়। সুতরাং সমকালীন চীনকে বোঝার মূল চাবিকাঠি এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সূত্রায়নের প্রকৃত মর্মোদ্ধারের জন্য, আসুন, আমরা চেষ্টা করি।

‘এক নতুন যুগের জন্য চীনা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সমাজতন্ত্র’

গোটা বিষয়টিকে এক সঠিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার জন্য, আমাদের গোড়া থেকে শুরু করা প্রয়োজন এবং তারপর বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছানো উচিত।

রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ

এঙ্গেলসের সূত্র ধরে লেনিন ও মাও তাঁদের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত থেকে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথে এক প্রয়োজনীয় সেতু হিসেবে বর্ণনা করেছেন — যেখানে জমি, কারখানা ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ সমূহ আর ব্যক্তি মালিকের থাকে না, বরং হয়ে ওঠে সমগ্র জনগণের সম্পত্তি।

‘ট্যাক্স ইন কাইন্ড’, ১৯২১ এ লেনিন লিখেছেন : “নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রধান দিকগুলির অন্যতম হ’ল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, যা, সোভিয়েত ক্ষমতার আওতায় শ্রমিকশ্রেণী দ্বারা সচেতনভাবে অনুমোদিত ও নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের একটি রূপ। আমাদের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া সরকার রয়েছে এমন সবদেশের পুঁজিবাদের থেকে মূলগতভাবে পৃথক। বুর্জোয়াদের দ্বারা নয়, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সর্বহারাদের দ্বারা — যারা কৃষকদের সম্পূর্ণ আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।”

চীনে পুঁজিবাদের বিকাশ ছিল গোড়ার দিকের সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় (এমন কি সমসাময়িক ভারতের তুলনায়) অনেকটাই প্রাথমিক স্তরে। এখানে মাও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ‘একমাত্র’ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানোর জন্যদেশীয় পুঁজিপতিদের সাথে যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

পুঁজিবাদী শিল্প ও বাণিজ্যের রূপান্তর সাধনের একমাত্র পথ

(৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩, গণতান্ত্রিক দলসমূহ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মহলের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের সাথে কথোপকথনের রূপরেখা)

“... ... রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ হ’ল পুঁজিবাদী শিল্প ও বাণিজ্যের রূপান্তর সাধন ও ক্রম পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে সম্পূর্ণ উত্তরণ ঘটানোর একমাত্র পথ।

কিছু কিছু পুঁজিপতি রাষ্ট্র থেকে তাদের প্রভূত দূরত্ব বজায় রাখে এবং সবকিছুর আগে মুনাফা — তাদের এই মানসিকতার বদল ঘটেনি। কিছু কিছু শ্রমিক এগিয়ে চলেছেন অতিরিক্ত দ্রুততার সাথে এবং তাঁরা পুঁজিপতিদের কোন রকম মুনাফা করতে দিতে নারাজ। আমাদের এই সমস্ত শ্রমিক ও পুঁজিপতিদের শিক্ষিত করার জন্য চেষ্টা চালানো প্রয়োজন এবং তাদের সাহায্য করা উচিত যাতে তারা ক্রমে ক্রমে (যত দ্রুত হয় তত ভালো) আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন — যে নীতি হ’ল চীনের ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প ও বাণিজ্য প্রধানত জাতীয় অর্থনীতির ও জনগণের জীবনযাত্রার সেবা করা এবং পুঁজিপতিদের জন্য আংশিক মুনাফা অর্জন করা এবং এইভাবে রাষ্ট্রীয় পথে এগিয়ে চলা।......

“পুঁজিপতিদের দেশপ্রেমের শিক্ষা প্রদান জারি রাখা প্রয়োজন এবং এই লক্ষ্যে, তাঁদের এক ভালো সংখ্যক অংশকে —যাদের প্রসারিত দিশা আছে এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও জনগণের সরকার সম্পর্কে জানার ইচ্ছা আছে — আমাদের প্রণালীবদ্ধভাবে লালন করতে হবে যাতে করে তাঁদের মাধ্যমে অন্যান্য পুঁজিপতিদের অধিকাংশের মধ্যেই আস্থা জাগানো যায়।......

“শুধুমাত্র যা প্রয়োজন ও সম্ভব, তার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকে যে অবশ্যই প্রয়োগে নিয়ে যেতে হবে তাই নয়...… পুঁজিপতিদের তরফ থেকেও এটিকে হতে হবে স্বেচ্ছামূলক, কারণ এটি হল এক সমবায় প্রতিষ্ঠান আর সমবায় কোন বল প্রয়োগকে অনুমোদন করেনা। জমিদারদের আমরা যেভাবে মোকাবিলা করেছি তার তুলনায় এটা ভিন্ন প্রকারের।

লেনিনের নেপের তুলনায় এটি ছিল খানিকটা ভিন্ন চরিত্রের, যা চীন বিপ্লবের গতিপথ ও পৃথক শ্রেণী বিন্যাস দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। ১৯৪৯’র আগে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শক্তিসমূহের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ চীনের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের বিপরীতে সেদেশের জাতীয় বুর্জোয়ারা ছিল সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে, দোদুল্যমান হলেও, কমিউনিস্ট পার্টির এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রশক্তি। মুক্তির পরে সিপিসি সতর্কতার সঙ্গে এই সম্পর্ককে লালন করেছে। দলিলে বিষয়টি নিম্নলিখিত ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

১৯৬০’র দশকের মধ্যপর্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শৈশবকালে সামনের দিকে বিরাট উল্লম্ফন ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে সে বামপন্থী কমিউনিজমের শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলার শিকার হয়। প্রথমটির ব্যর্থতা ও দ্বিতীয়টি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর, বিশেষতঃ ১৯৭০’র দশকের শেষার্ধে দেং শিয়াও পিং দায়িত্ব গ্রহণের পর, পার্টি আবার রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের কাঠামোর দিকে মুখ ফেরায় অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদিকা শক্তির উন্মোচন ঘটায়। রাষ্ট্রের কঠোর তদারকিতে এবং সমাজতন্ত্রের বস্তুগত বুনিয়াদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে ‘এলপিজি’ (উদারীকরণ-বেসরকারীকরণ-বিশ্বায়ন) মডেলেরই এক সংশোধিত সংস্করণকে গ্রহণ করা হয়।

যাই হোক না কেন, দেং মাও থেকে অনেক দূরে এগিয়ে যান এবং তাঁর অনুগামীরা হয়ত বা এগিয়ে চলেন আরো বহু দূর। উন্মুক্ত করে দেওয়ার অংশ হিসেবে বিদেশী পুঁজিকে সস্তা শ্রম, কাঁচামাল ও পরিকাঠামো দেখিয়ে প্রলুব্ধ করা হয় — যাতে তারা চীনে বিশাল আকারে বিনিয়োগ করতে পারে। শ্রমিকদের নির্মম শোষণ, সম্পদ ও আয়ের বৈষম্যের দ্রুত বৃদ্ধি, লাগামছাড়া দুর্নীতি ইত্যাদির বিনিময়ে এক ‘যাদুকরী’ বিকাশ সংঘটিত হয়।

ইতিমধ্যে, সিপিসি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের অকপট অভিধার পরিবর্তে প্রথমে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ বলা শুরু করে এবং কিছুদিন পর তারা আরও ঘোলাটে শব্দবন্ধ ‘চীনা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সমাজতন্ত্র’ ব্যবহার করতে থাকে। বাস্তবে, দুই নীতিগত সূত্রায়নেরই অর্থ দাঁড়িয়েছে বেশী বেশী করে বাজারের শক্তিসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান এবং দেশী ও বিদেশী বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে সহযোগিতাকে গভীরতর করে তোলা। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, পার্টিও সর্বহারার একনায়কত্ব বা জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্বের মত শব্দ ব্যবহার করা বন্ধ করে দেয় — সম্ভবত এর কারণ হ’ল, এই শব্দগুলি উচ্চারিত হলে বেসরকারী বিনিয়োগকারী ও পশ্চিমী সরকারগুলি আতঙ্কে দূরে সরে যেতে পারে অথচ নয়া বিশ্বায়নপন্থী নীতির সাফল্যের জন্য এদের সমর্থনই বেশী প্রয়োজন। পরিবর্তে, পার্টি নিঃশব্দে নিয়ে আসে এক ব্যাপক, উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ও ভয়ানকভাবে দক্ষ শাসন প্রণালী যা সমগ্র জনসংখ্যার ওপর পার্টি-রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। 

এটাই হল বিবর্তন প্রক্রিয়ার নগ্ন স্বরূপ — আর বর্তমানে যার সারবস্তু হল এক সর্বশক্তিমান শাসক দল ও এক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের পুরোপুরি ও দৃশ্যত স্থায়ী একীভবন — যাকে পার্টি-রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ বলে অভিহিত করা যায়।

এই সাধারণ নীতিগত কাঠামোই, মাঝে মধ্যে কিছু আংশিক পরিবর্তন সহ, আজ পর্যন্ত বহাল রয়েছে। ২০২০’র অক্টোবরে, সিপিসি পলিটব্যুরোর ভাষায়, “পুঁজির বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে পড়াকে প্রতিহত করার” এক সঙ্ঘবদ্ধ অভিযান চালানো হয়। জ্যাক মা’র মত অতি পরিচিত কয়েকজন অর্বুদপতি ও প্রথম সারির কর্পোরেটের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন মাত্রায় আর্থিক শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিতে পার্টি ইউনিট গড়ে তোলা সমেত অর্থনৈতিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ রাখার উদ্দেশ্যে ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সরকার ও বাণিজ্য জগৎ — উভয় তরফ থেকেই বলা হয়, একচেটিয়া বিরোধী এই অভিযান পার্টি-রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সাধারণ কাঠামোর আওতায় এক বিলম্বিত শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ামাত্র, প্রকৃত কোন দমনাভিযান নয়। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক কিছু না থাকলেও, এটি কোনও কোনও বিশেষ ব্যাপারের ইঙ্গিতবাহী। সিপিসি খুবই সতর্ক এবং রাশিয়ায় যেমনটি ঘটেছিল তেমন কোন আধিপত্যকারী রাজনৈতিক মোড়লতন্ত্রের উত্থান যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ।

ভারত এবং অন্যান্য আরও অনেক দেশের বিপরীতে চীনে পারস্পরিক ঘনসম্বদ্ধ অতিধনী কর্পোরেটদের নিছক অঙ্গুলি হেলনে রাষ্ট্র চালিত হয়না। কখন ও কীভাবে, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে এবং কতটা পরিমাণে পুঁজিকে উৎসাহিত করা হবে — তা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার রাশ পার্টি-রাষ্ট্র বজায় রেখে চলেছে। পূর্ণ শক্তিতে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক দড়ির টান দেওয়াকে নিশ্চিত রেখে, পরিস্থিতি ও অগ্রাধিকার সাপেক্ষে পুঁজিকে কিছু কিছু বিধিনিষেধকে ফাঁকি দেওয়ার অনুমতি অবধি (এই ব্যবস্থায়) দেওয়া হয়ে থাকে।

পার্টি-রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজ

নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র

সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মত আভিধানিক শব্দে অভিহিত হোক বা তার যাই নাম দেওয়া হোক, নিজেকে সমাজতান্ত্রিক (যে কোন স্তরেরই হোক) বলে দাবি করে এমন যে কোন দেশের সমাজতন্ত্রের যথার্থতাকে যাচাই করার গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হল সত্যিকারের গণতন্ত্রকে অনুশীলন করা। চীন কি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ? চীনের দিকে দৃষ্টি রাখেন এমন যে কোন ব্যক্তি, অন্ধ না হলে, জানেন যে উত্তরটি ‘না’ বাচক। কিন্তু সিপিসি দাবি করে তাদের ‘সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার জনগণতন্ত্র’ (রিপোর্টে এই জবরজং শব্দবন্ধই ব্যবহার করা হয়েছে) পশ্চিমী ব্যবস্থার থেকে অনেক ভালো। তাঁদের মতে পশ্চিমের দেশগুলিতে ভালভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার থেকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও জাতিগুলির মন জেতার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে চীনা ব্যবস্থায় ভালো প্রশাসন, সুবিধাগুলি পৌঁছে দেওয়ার দক্ষ ব্যবস্থা এবং “রাষ্ট্রের ইচ্ছার সঙ্গে জনগণতন্ত্রের একাত্মকরণের” ওপর জোর দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেনা, তার নিজস্ব একটা পৃথক ‘ইচ্ছা’ (যেটা আরও মহত্তর বলেই ধরে নেওয়া হয়) আছে এবং দরকার দু’টির মধ্যে সমন্বয় সাধন। ‘জনগণের থেকে, জনগণের প্রতি’ মাও’এর সূত্রবদ্ধ পরম্পরা থেকে এটি নিশ্চিতভাবেই বহু দূরে সরে যাওয়া। যে পরম্পরা ছিল গৌরবের দিনগুলিতে পার্টির শক্তির মূল উৎস — যেখানে জনগণের ইচ্ছা বা মতামতকেই পার্টির নীতি নির্ধারণের সূচনা বিন্দু বা প্রাথমিক উপাদান বলে মনে করা হত। বিপরীতে, আজ যা অনুসরণ করা হচ্ছে তা হ’ল এক দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক — যা দাঁড়িয়ে আছে এক অনুমিত সামাজিক চুক্তির উপর — গ্রহীতাদের (নাগরিক সমাজ) চরম আনুগত্যের প্রতিদান হিসাবে দাতা (রাষ্ট্র) তাদের বস্তুগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্নবান হয়।

শব্দার্থের তারতম্যকে বাদ দিলে, সরল সত্যটা হ’ল পার্টি-রাষ্ট্রের নজরদারি জনগণের খোলামেলা মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারকেই অস্বীকার করে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকারকে অস্বীকার করে; শ্রমজীবী জনগণকে তাদের নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্তা হিসেবে দেখে না। পার্টি কর্তৃক জনগণের প্রতি প্রভু/অভিভাবকসুলভ (কখনো কল্যাণকামী কখনো বা নিপীড়নকারী) আচরণ করা হয়। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় “সমাজের মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়ে সমাজের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করার এক শক্তি — যা ক্রমেই তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে; পার্টি হয়ে ওঠে চীনের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের এক মধ্যস্থতাকারী। সমাজতন্ত্রে জনগণনিজেদের ভাগ্যকে নিজেদের হাতে তুলে নেয় — এই যে বুনিয়াদী মার্কসবাদী ধারনা, ‘সমগ্র প্রক্রিয়ার জনগণতন্ত্র’ তাকে লঘু করে দেয়, এমন কি তাকে নাকচ করে দেয়।”

স্বাধীনতা বিহীন সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা

রিপোর্টে ‘সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার’ প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতা ও লিঙ্গ নিরপেক্ষতা দাবি করছেন যে মহিলারা তাঁদের, ধর্মীয়/জাতিগত সংখ্যালঘুদের এবং কুইয়ার (queer) সম্প্রদায়ের প্রতি এই অঙ্গীকার সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সব ধরনের প্রতিবাদীদের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। সম্প্রতি সিপিসি’র এক সদস্য জাক ইয়াও’এর ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা আজকের প্রবণতাকে প্রকট করে তুলেছে।

অন্য অনেকের মতো, ইয়াও’ও এক ব্যাঙ্ক জালিয়াতির কারণে তার জমানো টাকা লেনদেন করতে পারছিলেন না। তিনি অনলাইনে ও পথে নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেন। দ্রুত তাঁর ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করা হয়। ক্ষোভ বিক্ষোভের যে ন্যায্য কারণ ছিল সেকথা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে এবং এটাও মেনে নেয় যে প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তাঁরা কখনও আন্দোলনকে মান্যতা দেননি যদিও দীর্ঘ প্রতিবাদের পর সমস্যার প্রতিকারের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশের কাছ থেকে মাঝে মধ্যেই তাঁকে হুমকি দিয়ে যে ফোন করা হত তার উল্লেখ করে ইয়াও বলছেন, বার্তা সুস্পষ্ট, “ঝামেলা পাকিওনা... ... আপনি যখন আপনার অধিকার রক্ষার চেষ্টা করছেন, কর্তৃপক্ষ তখন সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য তৎপর।”

সাধারণ এক পার্টি সদস্যের এই সরল বিবৃতি বৃহত্তর ছবিটার একটা ঝলক মাত্র। প্রতিবাদ জানানোর অধিকার, এমনকি শান্তিপূর্ণ জমায়েত করার অধিকারকেও অস্বীকার এবং সব ধরনের বিক্ষোভ দমন করে শুধুমাত্র সামাজিক ‘স্থিতাবস্থার’ ওপর গুরুত্ব আরোপ কর্তৃত্ববাদী পার্টি-রাষ্ট্রের বদ্ধমূল মানসিক বিকৃতিকেই দেখিয়ে দেয়, যা মুক্ত জনগণ ও গণরোষকে ভয় পায়। ক্ষমতাসীনদের কাছে, সামাজিক স্থায়ীত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা হ’ল সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয়, “সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের ভিত্তি” হিসেবে যা হল তাদের প্রথম কথা। নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর কিয়াংঝাও (quuangguo) বা শক্তিশালী রাষ্ট্রের আক্রমণকে সে কারণে দেশের নবউদ্যম ও সমৃদ্ধির জন্য যথার্থ বলে যুক্তি খাড়া করা হয়।

আন্তজার্তিক আঙিনায় জাতীয়তাবাদ

যেহেতু কোন দেশের বিদেশ নীতি মূলত তার আভ্যন্তরীণ নীতিরই সম্প্রসারিত রূপ সুতরাং এই রকম নবউদ্দীপিত জাতি আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নিতে পারে — সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। এই সহস্র লক্ষ কোটি টাকার প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর নেই। আজকের দিনে জাতীয়তাবাদ বলতে চীনে যা বোঝায়, মুক্তি পরবর্তী সময়ের প্রথম তিন দশকে দেশপ্রেম অর্থে যা বোঝাত — জনগণই সর্বপ্রথম — তা থেকে আলাদা, আর বিপ্লবী সর্বহারা আন্তজার্তিকতাবাদ থেকে সে সরে গেছে বহু দূরে। বৃহৎ রুশ জাতিদম্ভের মত এটিও আসলে হান জাতীয়তাবাদ — যা রাজকীয় অতীতের জন্য গর্ব বোধ করে।

আমরা এটাও জানি যে সে দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির মূল চালক হল বৃহৎ পুঁজি — যার জিনগত উপাদানেই সম্প্রসারণবাদ জেঁকে বসে আছে আর (সেইসঙ্গে রয়েছে) চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপরের সারির এক প্রভাবশালী অংশ, যারা কী বিশ্ব অর্থনীতি, কী বৃহৎ শক্তির রাজনীতি — উভয় ক্ষেত্রেই জাতিকে এক জাঁদরেল ভূমিকায় দেখতে চায়। অতীত ও বর্তমানের এই আবেগ সাম্প্রতিক কালের ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে আরও মজবুত হয়েছে। (এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে) ভৌগলিক পরিধিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার উদগ্র বাসনা, আমেরিকা ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্রশক্তিগুলি দ্বারা তাকে ঘিরে ফেলার আক্রমণাত্মক পরিকল্পনার ফলে, পূর্ণতা পাওয়া কঠিন। পাশাপাশি তার পক্ষে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এমনকি সামরিক বিষয়েও রক্ষণ ও আক্রমণের সীমারেখা পার হওয়াও দুষ্কর। মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার এই দাবিদার তার বুনিয়াদী প্রতিশ্রুতি— “আমরা কখনোই বৃহৎ শক্তিসুলভ আধিপত্য চাইনা” — প্রথম যা মাও এবং দেং সূত্রবদ্ধ করেন এবং বিশেষ করে বিগত চার বছরে শি দু’বার যা পুনরোচ্চারণ করেছেন — রক্ষায় সফল হয় কিনা সে দিকেই আগামী দিনগুলিতে তার শত্রু-মিত্র সকলেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকবে।

সামনের পথ

রিপোর্টে ঘোষণা করা হয়েছে, “এক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন এখনও সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে এবং সে ব্যাপক ও গভীর সামাজিক রূপান্তরণের মধ্যদিয়ে চলেছে।” সুতরাং পার্টির সামনে কী কর্মসূচি রয়েছে?

“আমাদের আভ্যন্তরীণ চাহিদাকে বাড়িয়ে তোলার রণনীতিকে জোগানমুখী কাঠামোগত সংস্কারকে গভীরতর করে তোলার উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করাকে সুনিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে উচ্চস্তরে আবদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘরোয়া অর্থনীতিকে আরও গতিশীল ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে হবে।......দেখতে হবে বাজার যেন সম্পদ বণ্টনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে এবং সরকার যেন তার ভূমিকা ভালো ভাবে পালন করে।

আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির (SEO) সংস্কারকে গভীরে নিয়ে যাব; রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের মানচিত্রকে উন্নত করা ও তার কাঠামোকে সুসম্বদ্ধ করার প্রয়াসে গতিবৃদ্ধি করব; নজর রাখব যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজি ও সংস্থাগুলি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আরও উন্নত ও আরও বড় হয়; রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির মূল প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে তুলব।” (নীতিগত এই দিশা প্রশংসনীয় — এর বেশ কিছু দিক ভারতও আহরণ ও প্রয়োগ করতে পারে, যদিও এটা নিশ্চিত, কোম্পানিরাজ তা কখনোই করবেনা) ।

একই সঙ্গে “বেসরকারী সংস্থাগুলিকে আমরা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেব, তাদের সম্পত্তির অধিকারকে রক্ষা করব এবং আইনানুসারে উদ্যোগপতিদের অধিকার ও স্বার্থকে রক্ষা করব এবং বেসরকারী ক্ষেত্রের বিকাশকে সুগম করে তুলব।... ... আর্থিক স্থিতিশীলতাকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থাপনাকে আমরা মজবুত করব, আইন অনুসারে সমস্ত ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণের (regulation) আওতায় রাখব এবং ব্যবস্থাপনাগত কোন ঝুঁকি যাতে মাথা না তোলে — তা নিশ্চিত করব...... (এবং) প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের অংশকে বৃদ্ধি করব।”

“আর্থিক বিকাশের অনুরণের জন্য আমরা একচেটিয়াগোষ্ঠিগুলির বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেব, সত্যিকার অর্থনীতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার কাজটি অবশ্যই চালিয়ে যাব। চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের শক্তিবৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের গুণমান, অ্যারোস্পেশ, পরিবহন, সাইবার স্পেশ ও ডিজিটাল বিকাশের দিকে দ্রুত গতি সঞ্চার করব... ...ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের উচ্চ লক্ষ্য, আরও স্মার্ট ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন উপযোগী করে তুলব... ...”

এখানে দক্ষতার সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতির পরিকল্পিত বদল ও পুনর্বিন্যাস বিশেষ লক্ষণীয়। দেং’য়ের “প্রথমে কিছু লোককে ধনী হতে দেওয়া যাক” (যাতে করে বর্ধিত উৎপাদন ও ভোগের মাধ্যমে আর্থিক বিকাশ ঘটে) থেকে একচেটিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা — অতীতে হয়ত বিকাশের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করেছে। এখন এগুলি ছোট ছোট অথবা স্টার্টআপ সংস্থাগুলির বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে; ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে পরিমাণের থেকে গুণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো, সমস্ত উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া — এগুলি কিছু ভালো উদাহরণ।

রিপোর্টে আরও বলছে, “আমরা কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নকে প্রথমে রাখার নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাব, শহর এবং গ্রাম এলাকার একসাথে উন্নয়ন ঘটানো এবং উভয়ের মধ্যে উৎপাদনের উপকরণগুলির (factors) প্রবাহকে মসৃণ রাখার কাজকে অব্যাহত রাখব।......এই উদ্যোগগুলির মাধ্যমে, চীনে খাদ্য সরবরাহ যাতে দৃঢ়ভাবে তার নিজের হাতে থাকেতা সুনিশ্চিত করব।”

(বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় বহুজাতিক কর্পোরেশনের বেশী বেশী নিয়ন্ত্রণের [বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, কৃষিজমি, এমনকি কোথাও কোথাও খোদ কৃষক অবধি] প্রেক্ষিতে এটি সমস্ত ছোট ও উন্নয়নশীল দেশেরই সত্যিকারের উদ্বেগের বিষয়।)

এইসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণঘোষণা হল, “জনসাধারণের সমৃদ্ধি অর্জনই হ’ল সমাজতন্ত্রের নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য”। বিগত কয়েক বছর ধরে পার্টি এবং সরকার এই বিষয়ে সোচ্চারে বলে চলেছে এবং সীমিত সাফল্যও অর্জন করেছে। ২০১২ থেকে ২০২০’র মধ্যে চীনের গিনি কোএফিসিয়েন্ট ৪৭.৪ থেকে সামান্য হ্রাস পেয়ে ৪৬.৮এ এসে দাঁড়িয়েছে (আমেরিকার ক্ষেত্রে এই সূচক ছিল ২০২০তে সামান্য বেশী অর্থাৎ ৪৯)।

যাই হোক, এইসব নীতিগত সিদ্ধান্তকে নিছক বুলি কপচানো মনে হয়না, আন্তরিক প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে। কিন্তু মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে চিত্রটা খুবই ভিন্ন ধরনের।

রিপোর্টে “মানবাধিকারের বিকাশের এক চীনা পথের” ওকালতি করা হয়েছে। সোজা কথায় ধরলে এর অর্থ হ’ল, অধিকারগুলি মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য নয়, সেগুলিকে অনুমোদন দেওয়া হয় একমাত্র কর্তৃপক্ষের দ্বারা স্থিরীকৃত সীমানার মধ্যেই। আর কোন কোন বর্গের ক্ষেত্রে, যেমন উইঘুর মুসলিমদের বেলায় এসবের (অধিকারের) ছিটেফোঁটাও নেই। পার্টি জাতিসত্ত্বার সমস্যাকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক চীনা দৃষ্টিভঙ্গি (অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতীয়তাবাদী) গ্রহণের সুপারিশ করেছে — যা “চীনের ধর্মসমূহকে অবশ্যই চৈনিক দিশাসম্পন্ন হতে হবে” — এই নীতির উপর আধারিত।

চীনেও তাহলে পিতৃভূমি-পুণ্যভূমির কলতান! বস্তুত, অ-চৈনিক নাম (যেমন মহম্মদ), পরিধেয় (যেমন ফেজ টুপি) এবং চেহারা বা বহিরঙ্গে কিছু ভিন্নতা (যেমন বিশেষ ধরনের দাড়ি রাখা) ইত্যাদি মোটেই সহ্য করা হয় না। জাতীয়তাবাদের নামে জোর করে সংখ্যাগুরু আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার এই কসরতের সঙ্গে ভারতে আমরা ভালোই পরিচিত। পার্টি-রাষ্ট্রধর্মসমূহকে সক্রিয় পথপ্রদর্শন করার দায়ভার অবধি গ্রহণ করে ফেলেছে। স্পষ্টতই এটা (‘পথপ্রদর্শন’) হলো ‘অ-চীনা’ ব্যক্তিগত বিশ্বাস/ধর্মাচারণের ওপর নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের এক নরম পোশাকিভাষ্য মাত্র — যা ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখার (রিপোর্ট যাকে পশ্চিমা ধারণা বলে খারিজ করেছে) অর্থাৎ প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার এবং বিশ্বাসের প্রশ্নে ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দের প্রতি সম্মান জানানোর একেবারে বিরোধী।

সুতরাং আমাদের নিবন্ধের শুরুতেই দেওয়া প্রতিশ্রুতি — “চীনা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সমাজতন্ত্র” — এই বিবিধার্থক ও অদ্ভুত চীনা শব্দবন্ধের মর্মোদ্ধারকীভাবে করা যায় ? সমগ্র পর্যবেক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে; এটি আসলে চীনা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পুঁজিবাদ — যা জাতীয়তাবাদের ভারি বোঝায় ঠাসা এবং যার সঙ্গে রয়েছে সমাজতন্ত্রের ঈষৎ লালিমা।

[কৃতজ্ঞতা - দেশব্রতী পত্রিকা]