দাঙ্গার রাজনীতি : রাজনৈতিক দাঙ্গা

১৫ ডিসেম্বর ২০১৯-এর শাহিনবাগ আন্দোলনের ধাঁচে উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের নীচে সিএএ বিরোধীদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০। রাস্তা অবরোধ করেছিলেন দলিত সংগঠন ভীমসেনার প্রায় হাজার দেড়েক প্রতিবাদী। চাঁদবাগ এলাকতেও শুরু হয়েছিল একই ধরণের একটি বিক্ষোভ। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেয় দিল্লি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের নেতৃত্বে পালটা সভা ও মিছিল করার চেষ্টা হলে সংঘর্ষে জড়ায় দু’পক্ষ। এক সময় জাফরাবাদ-মৌজপুরে সিএএ-বিরোধী ও সিএএ-পন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘিরে অশান্তির সূত্রপাত হয়। কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করলেও বিকেলের দিকে ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটা বিস্তীর্ণ অংশ। জাফরাবাদ, মৌজপুর, ভজনপুরা, খাজুরিখাস, গোকুলপুরী এলাকা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় পুলিশ। রবিবার বিকেলে কিছু জায়গায় আধা সেনাও মোতায়েন করা হয়েছিল। জাফরাবাগ চাঁদবাগের রাস্তা খালি করার জন্য তিনদিনের সময়সীমার হুমকি দিয়েছিলেন কপিল।

২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২০। সোমবার। ‘দুপুরে জাফরাবাদেই চারটে দোকান ও বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনটে গাড়িও জ্বালানো হয়েছে। গাড়ি সরিয়ে নিয়ে যেতে না যেতেই শুরু হয়েছে পাথরবৃষ্টি। ভীড়ের মধ্যে থেকে পাথর গিয়ে পড়েছে রাস্তার ধারের বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে। ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলে উল্লাসে ফেটে পড়েছে জনতা। পেট্রল-বোমা হাতে হাতে ঘুরেছে। ভীড়ের মধ্যে শুধু একটাই প্রশ্ন, মাচিস কাঁহা হ্যাঁয়?’(আ.বা.প.২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০)

গুজরাতের অনুসরণে বেছে বেছে হিন্দু বাড়িতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল গেরুয়া পতাকা যাতে আসন্ন হামলার হাত থেকে বেঁচে যায় হিন্দু পরিবারগুলো।

রাত সাড়ে ১১টা। উত্তর পূর্ব দিল্লির যমুনা বিহার এলাকা। শাহিদ সিদ্দিকির বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল উত্তেজিত জনতা। দোতলা বাড়ির একতলায় জামাকাপড়ের দোকান, প্রথমে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শাহিদের গ্যারাজে গাড়ি ও বাইকে আগুন লাগায় জনতা। স্লোগান ওঠে, ‘হিন্দুয়োঁ কা হিন্দুস্তান’, ‘জয় শ্রীরাম’। দোতলায় নিজের পরিবার, দু’মাসের সন্তানকে নিয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন শাহিদ। এই সময় ঘটনাস্থলে হাজির হন বিজেপির স্থানীয় পুরপিতা প্রোমোদ গুপ্ত। তিনিই রুখে দাঁড়ান, শাহিদের বাড়িতে আগুন লাগানো যাবে না, শাহিদরা প্রমোদের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাঁদের কোনো ক্ষতি হতে দেন নি প্রমোদ। 

সংবাদসংস্থা রয়টার্সের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল নির্মম এক দৃশ্য। সম্ভবত এক বিক্ষোভকারীকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারছে ‘দেশভক্ত’র দল। রক্তাক্ত দেহ নিয়ে হাঁটু মুড়ে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে মানুষটি। তাদের কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে উইকেট। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে রয়েছেন। সাংবাদিক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় মৌজপুর মেট্রো স্টেশনের কাছে দাঙ্গার খবর সংগ্রহ করতে গেলে হিন্দুসেনার একজন সদস্য এসে তাকে মাথায় তিলক লাগাতে বলে। তিলক কেন প্রশ্ন করায় উত্তর মেলে, ‘আপনিও তো ভাই হিন্দু। সমস্যা কোথায়? এতে ওখানে কাজ করতে সুবিধে হবে।’ অন্য একটি জায়গায় তাকে ছবি তুলতে বাধা দিয়ে বলা হয়, ‘ভাই আপ তো হিন্দু হো। কিঁউ যা রহে হো? আজ হিন্দু জাগ গয়া হ্যায়’। অনেক জায়গায় সাংবাদিকদের পোষাক খুলিয়ে ধর্ম যাচাইয়েরও অভিযোগ ওঠে উন্মত্ত জনতার বিরুদ্ধে।

২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০। জাতীয় পতাকা হাতে দেশভক্ত জনতার চিৎকার, দেশ কে গদ্দারোকো, গোলি মারো সালো কো। পরিস্থিতি সামলাতে পুরো উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে আগামী এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জাারী করা হয়, দিল্লিসংলগ্ন গাজিয়াবাদেও জারী হয় ১৪৪ ধারা। নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয় গাজিয়াবাদ-দিল্লির সীমানায় যাতায়াতের উপর। কিন্তু ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করেই সারা দিন চলে তান্ডব। মঙ্গলবার রাতে অশান্ত ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব দিল্লিতেও। জাফরাবাদ সহ মৌজপুর, চাঁদবাগ কারওয়াল নগরে কার্ফু জারি করে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয় দিল্লি পুলিশ।

দিল্লির কদমপুরীর বাসিন্দা মহম্মদ ফুরকান পেশায় হস্তশিল্প ব্যবসায়ী। রাতে সন্তানদের জন্য খাবার কিনতে বেরোতে হয়েছেল তাঁকে, তখনই সংঘর্সের মধ্যে পড়ে পায়ে গুলি লাগে তাঁর, গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।

৪২ বছর বয়সী রতনলাল দিল্লির গোকুলপুরী থানার হেড কনস্টেবল। আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী গোষ্ঠী সংঘর্ষ থামাতে পথে নেমে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান রতনলাল, এই সময় পত্রিকার রিপোর্ট বলে বিক্ষোভকারীদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে মৃত্যু হয় তার।

এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির পাশাপাশি চলছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর। সেই সময় সংবাদপত্রে প্রেসিডেন্টের নৈশভোজের ছবিসহ ফিরিস্তি ‘কমলালবুর রস, সোনার তবক দেওয়া ফরাসি টুকিটাকি, লেবু-ধনেপাতার হালকা সুপ, ডাল-রাইসিনা, আলু-টিক্কি, মশলাদার স্যামন, ভেড়ার মাংসের রান-আলিশান, দুষ্প্রাপ্য মোরেল মাশরুম দেওয়া দম মটর, দম-গোস্ত বিরিয়ানি, মালপোয়া সঙ্গে রাবড়ি, হেজলনাট অ্যাপলপাই ও ভ্যানিলা আইসক্রীম এবং আরও অনেক কিছু। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অসামান্য কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি খুবই শান্ত এবং ধার্মিক। দিল্লি ছাড়ার আগে সাংবাদিক বৈঠকে এমন কথাই বলে গেলেন আমেরিকার প্রেসেডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।’ (আ.বা.প. ২৬ ফেব, ২০২০)

ছাড় পান নি সাংবাদিকরাও। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা। হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, এটা ‘হিন্দুয়োঁ কি লড়াই’। অতএব ছবি- ভিডিও তোলা যাবে না।(আ.বা.প. ২৬ ফেব, ২০২০) অনেক এলাকায় মন্দির মসজিদ গুরুদ্বারা থেকে একসাথে শান্তির আহ্বান জাননো হয়েছিল, কিন্তু অশান্তি থামানো যায় নি। হামলার সময় পুলিশের দেখা পাওয়া যায় নি অনেক ক্ষেত্রেই।

‘সকাল ৯টা। ভজনপুরা। দোকানপাট সব বন্ধ, যানবাহনও বেশ কম। যেন অঘোষিত বন্ধ। থমথমে। হঠাৎই খবর এল, পাশের মহল্লা গোকুলপুরীতে আগুন লাগানো হচ্ছে। কয়েকটি গাড়িতে আর দোকানে। সঙ্গে পাথরবৃষ্টি। সিএএ বিরোধী এবং সিএএ সমর্থকদের মধ্যে। এ কি দেশের রাজধানী? ধীর গাড়ির টায়ার, থেকে ভেসে আসছে চিৎকার, হইহল্লা। চোখের সামনে জ্বলছে একটা গোটা মার্কেট। কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে ঘন কালো ধোঁয়া। সস্তায় টায়ার বিক্রি হয় এই গোকুলপুরী মার্কেটে। ....সেখানে কে বা কারা সাতসকালেই আগুন দিল। কোন জ্বালা রহা হ্যায় দিল্লি কো? .....না আছে পুলিশ, না দমকল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবি তোলার আগেই পাশে পড়ল আধলা ইট। ‘দাদা চলিয়ে, বাইক পে আইয়ে, জলদি, পাথ্থরবাজি চালু হো গ্যায়া’ সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘদিনের বন্ধুর ডাক শুনে তড়িঘড়ি তাঁর বাইকে উঠে পড়া গেল। পিছনে ছুটে আসছে উন্মত্ত জনতা। সঙ্গে চিৎকার, জয় শ্রী রাম।’ (এই সময়, ২৬ ফেব, ২০২০)

বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, বিজেপি বিধায়ক অভয় বর্মা, বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মার নাম বারবার উঠে আসছিল এই সময় উস্কানিমূলক মন্তব্য করে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার। আবার আম আদমি পার্টির কাউন্সিলর তাহির হুসেনের বাড়ির ছাদ থেকে হিন্দুদের লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা, অ্যাসিড, গুলতি দিয়ে ইট-পেরেক ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি ক রেড্ডি দাবি করেন যে রীতিমতো পরিকল্পনা করে সারা বিশ্বের সামনে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে।

নয়াদিল্লি, ২৮ ফেব্রুয়ারী: ‘তোদের নাগরিকত্ব চাই? দিচ্ছি, দাঁড়া!’ মৌজপুরে মহম্মদ ইব্রাহিমের বাড়ির গেট ভেঙে ঢুকে এক দল লোক যখন পেট্রোল ছড়াচ্ছে, তাদের মুখে একটাই শাসানি। আবার খাজুরি খাসে বিএসএফ জওয়ান মহম্মদ আনিসের বাড়িতে তান্ডব শুরুর সময় একই সুরে গালিগালাজ, ‘ইধার আ পাকিস্তানি, তুঝে নাগরিকতা দেতে হ্যায়।’ প্রথমে বাড়ির বাইরে গাড়িতে আগুন লাগানো হয়, তার পরে আনিসের বাড়িতে ঢুকে গ্যাস সিলিন্ডার খুলে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা, ২০০২ সালে গুজরাতের মতোই। বাবা, কাকা, খুড়তুতো বোনকে নিয়ে কোনও ক্রমে পালান আনিস। তাঁর আর বোনের বিয়ের জন্য টাকা, গয়না রাখা ছিল বাড়িতেই। সব পুড়ে ছাই। (আ.বা.প.২৯ ফেব্রুয়ারী) তিন বছর জম্মু-কাশ্মীরে থেকে সীমান্ত পাহারা দিয়েছেন আনিস। তার বাড়ির বাইরের ফলকে তার নামের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ফলকও খোদাই করা ছিল। তবু রেহাই পান নি আনিসের পরিবার। তবে আনিসের বাবা জানিয়েছিলেন, ‘যারা হামলা চালিয়েছে তারা বাইরে থেকে এসেছিল। আমাদের পাড়ার কোনও লোক এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না। হিন্দু প্রতিবেশীরা বারবার ওই ভীড়কে অনুরোধ করছিল আমাদের বাড়িতে হামলা না করতে। কিন্তু কেউ শোনে নি। বাড়ির সামনে রাখা গাড়িতে আগুন প্রতিবেশীরাই নিভিয়েছেন।’(এই সময়, ২৯ ফেব)

করওয়াল নগরের মোড়েই বড় রাস্তার ওপর চাঁদ বাবার মাজার। হিন্দু মুসলমান সকলেই এসে মাথা ঠেকিয়ে যেতেন এই পিরের মাজারে। এর দেখভাল করা মিনাজউদ্দিনের ভাষায়, ‘এক দল লোক রে রে করে দৌড়ে এল। অচেনা মুখ। পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল মাজারের বাইরে। ভিতরে ফেলে দেওয়া হল জ্বলন্ত টায়ার।’ মাজার পুড়ে ঝামা হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে নি তারপর।

উল্টো চিত্র চমন পার্কে। মুস্তাফাবাদে হিন্দুদের স্কুল জ্বলছে, পাশেই অক্ষত মুসলিমদের স্কুল। জাফরাবাদের কাছে আবর্জনা ভর্তি নালা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মী অঙ্কিত শর্মার ক্ষতবিক্ষত দেহ।  সারা শরীরে পাওয়া গিয়েছিল চারশোর কাছাকাছি ক্ষত, কোপানোর ফলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার অন্ত্র। হত্যার অভিযোগ তাহির হুসেনের বিরুদ্ধে। ভজনপুরায় বাড়ির সামনেই গুলিবিদ্ধ হন ২৩ বছরের রাহুল ঠাকুর। পরিবারের সামনেই শেষ হয়ে যায় তার প্রাণ। কিছু দিন পরেই সিভিল সার্ভিসে বসার কথা ছিল তার।

তবে যে ভিডিও দেখে শিউরে উঠতে হয়েছিল তা হল রাস্তায় পড়ে আছে জখম, রক্তাক্ত পাঁচ তরুণ। তাদের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীরকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করছে দিল্লি পুলিশ! পরে তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। মৃত মহম্মদ ফয়জান কদমপুরীর বাসিন্দা, ভজনপুরা থানা থেকে যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার নির্যাতিত শরীর প্রায় অসাড়।

শিববিহার এলাকার তিনটি স্কুলবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পুলিশের কোনো সাড়া মেলে নি স্কুল-কর্তৃপক্ষের আহ্বানেও। জিটিবি হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পড়ে থাকা বহু মৃতদেহ বিকৃত হতে শুরু করেছিল, কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত, কেউ বা গুলিবিদ্ধ, কাউকে কোপানো হয়েছে ধারালো অস্ত্রে। পুলিশি নিষ্কৃয়তার কারণে ময়না তদন্ত ও অন্যান্য কাজ চলছিল ঢিমেতালে।  

উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে যখন তীব্র হয়েছে গোষ্ঠী সংঘর্ষ, সেই ২৪, ২৫, ২৬ ফেব্রুয়ারী পুলিশের থেকে জরুরী সহায়তা চেয়ে বিপদগ্রস্তরা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেছেন মোট ১৩,২০০ বার। বাসিন্দাদের অভিযোগ, তৎক্ষণাৎ সাহায্য পাঠানো দূরে থাক, অধিকাংশ কলের উত্তরই দেয় নি কন্ট্রোল রুম।(এই সময়, ২৯ ফেব)

একদিকে শিবপুরী। অন্যদিকে মুস্তাফাবাদ। মাঝখানের রাস্তাটা স্থানীয়দের কাছে ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বর্ডার’। রাস্তা বরাবর বিরাট নালা। পারাপারের সেতুগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কোথাও চেয়ার-টেবিল, কোথাও বাঁশ-তারের ব্যারিকেড দিয়ে। নালার একটি বিশেষ অংশ পুলিশ ঘিরে রেখেছিল। বহু মানুষকে হত্যা করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই নালায়। আশেপাশের পুড়ে যাওয়া বাড়ি, দোকানের ভিতর থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। সারি সারি গাড়ির পোড়া কঙ্কাল। বাড়ির গায়ে, পুড়ে যাওয়া কাঠের দরজায় গুলির দগদগে ক্ষত। ‘ওই যে রাজধানী পাবলিক স্কুলটা দেখছেন, তার ছাদে ইর-পাথর-অ্যাসিড-পেট্রল বোমা জমা করেছিল ওরা। ছাদে লোহার রড গেঁথে বিরাট গুলতি বানিয়েছিল। আমরা নীচ থেকে ইট-পাথর ছুড়ছিলাম। ওরা তিন-চারজন মিলে গুলতিতে টান দিয়ে বড় বড় পাথর গোলার মতো ছুঁড়ছিল। (আবাপ, ২৮ ফেব) মুস্তাফাবাদের পাশাপাশি দুটি স্কুলে ভাঙচুর চালিয়ে প্রায় ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছিল, হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল নিমেষে।

এই গভীর অন্ধকারেও আলোর দিশা পাওয়া যায় যখন জেনেছিলাম বিজেপির হিন্দু কাউনসিলর আশ্রয় দিয়েছেন মুসলিম পরিবারকে, দলিতরা রাত জেগে মুসলিমদের ঘর পাহারা দিয়েছেন, শিখরা আটটি গুরুদ্বারের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন আর্তদের জন্য, দাঙ্গাসন্ত্রস্ত এলাকায় হিন্দু-মুসলমান একসাথে সম্প্রীতি-মিছিল করেছেন। হিংসাদীর্ণ উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটি গুদামে দিনচারেক লুকিয়ে থাকার পর মুর্শিদাবাদের এগারো জন শ্রমিককে উদ্ধার করে বাংলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন লোকসভার কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ফেসবুকে তাদের দুরবস্থার কথা জানিয়ে পোস্ট করেছিলেন এক শ্রমিক, তা দেখে এক তরুণ যোগাযোগ করেছিলেন অধীর চৌধুরীর সাথে।

উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য চার বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশকে বুধবার ২৪ ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এস মুরলীধর। সেদিন রাতেই তাঁকে পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির নির্দেশ জারি হয়। গুজরাতের মতোই দিল্লি পুলিশের তিনদিন ধরে নিষ্ক্রিয়তা কদর্য মুসলিম বিদ্বেষেরই উত্তরাধিকার বহন করছিল তা বলাই বাহুল্য। রাজধানীর নাগরিকরা আহত, নিহত, অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন পুলিশের চোখের সামনে, সাহায্য চেয়েও পান নি, এমনকি হাসপাতালে অ্যামবুলেন্স ঢুকতেও বাধা দেওয়া হয়েছে, পুলিশ ঘটনার মধ্যে উপস্থিত থেকেও দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার না করে নির্দেশের অপেক্ষায় থেকেছে যা ‘সরকারি রাজনীতি’ ছাড়া আর কিছুই নয় যার পিছনে কাজ করেছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ধর্মান্ধতা।

কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের পরিস্থিতি জটিল হয়েছে সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শাসক দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছে নানাভাবে, এমনকি খাদ্যাভ্যাসের ওপরও নেমে এসেছে নিষেধাজ্ঞা। মহম্মদ আকলাখ নামক এক ব্যাক্তিকে ঘরে গোমাংস রাখার অপরাধে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গোটা উত্তর ভারত জুড়ে গোরক্ষকদের অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ, এ সময় মিডিয়ার বহুল প্রচলিত শব্দ ‘মব লিঞ্চিং’। ইদের বাজার করে ফেরা মুসলিম কিশোরকে ছুরিকাঘাতের পর ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ট্রেন থেকে, যুবককে ল্যাম্পপোস্টে পিছমোড়া করে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে গোরু চুরির অভিযোগে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পোষাক দেখে চিহ্নিত করে ফেলেছেন অপরাধীকে! প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত, স্বাধীন চিন্তাশীল কোনো মানুষ গরিষ্ঠ জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী সত্যভাষণের সাহস ও স্পর্ধা দেখালেই তাঁকে হেনস্থা হতে হচ্ছে নানাভাবে। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বরের কন্ঠ অবশ্য তাতে রুদ্ধ হওয়ার নয়। আবার বহু ক্ষেত্রে প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীরাই একসময় ক্ষমতার নরম আয়েসি গদির এক কোণে জায়গা পাওয়া কীটে পরিণত হয়েছেন, যেমন চেক নাট্যকার ভাস্লাব হাভেল বা এই বঙ্গের মেফিস্টো ‘অরণ্যদেব’ বসু – এদের চিহ্নিত করাটা আবশ্যক। এই বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে যে ‘সম্মতি’র প্রচেষ্টা রাষ্ট্রযন্ত্র করে থাকে, সে সম্পর্কে সচেতন না হলে সাধারণ মানুষের সামূহিক জীবন যে ক্রমশ বিপন্ন হবে তা বলাই বাহুল্য।