সিলিকোসিস : অসংগঠিত শ্রমিকের ‘সংগঠিত’ শোষণের কাহিনী

লিখেছেন সমুদ্র রায়।

সিলিকোসিস নামক মারণ পেশাগত রোগটি সম্পর্কে গত কিছু বছরে বেশ খানিকটা কৌতূহল ও রাজনৈতিক ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটা এখন অনেকেই জানেন যে সিলিকোসিস একটি রোগ, যে রোগ আসে ধূলোর (সিলিকা গুঁড়ো) মধ্যে বহু সময় থাকার ফলে এবং নিঃশ্বাসের সাথে সেই ধূলো শরীরের ভেতরে যাওয়ার ফলে। অর্থাৎ পেশার কারণে যে সমস্ত শ্রমিক এমন কোন শিল্পতে কাজ করেন যেখানে প্রচুর ধূলো ওড়ে (সবচেয়ে বেশী সম্ভাবনা পাথর খাদান ও পাথর ভাঙ্গার কারখানাগুলোতে), সেই সমস্ত শ্রমিকের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। এমনকি যে সমস্ত এলাকায় এই শিল্পকেন্দ্রগুলো চলে সেখানকার সাধারণ বাসিন্দাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থেকে যায়। এবং এটা জেনে রাখা ভাল যে সিলিকোসিস একটি মারণ রোগ, যার কোন চিকিৎসা নেই, কিছু বছরের মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। এবং এটাও নজরে আনা প্রয়োজন যে শুধু সিলিকোসিস নয়, এমন আরো অনেক পেশাগত মারণ রোগের কথা জানা যায় যা পাটশিল্প থেকে, অ্যাসবেস্টস শিল্প থেকে, তুলো, সেরামিক, বা কয়লানির্ভর শিল্প থেকেও হয়, এবং এই সমস্ত রোগের সম্মিলিত যে নামটি চিকিৎসাশাস্ত্রে চালু সেটা হল - pneumoconiosis।
 
ভারতবর্ষে বা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সিলিকোসিসের কাহিনীর একটা বিশেষত্ব হল যে বেশ কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা পাথরশিল্পের (মুলতঃ স্টোন চিপস উৎপাদক) বেশীরভাগটাই বেআইনিভাবে চলে (বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়), যেখানে সারা রাজ্য থেকেই কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রমিক কাজ করতে আসেন, কিন্তু যাদের শ্রমিক হিসেবে কোন পরিচিতি বা অধিকার থাকেনা, এবং তাদের সুরক্ষার জন্য এইসমস্ত বেআইনি ব্যবসার মালিকদের কোন দায় নেওয়ারও থাকে না। গত একশো বছর ধরে আধুনিক দুনিয়ায় এই নিয়ে বহু আলোচনা ও নানা সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের মত দেশে তার কোন ব্যবহার নেই, যেহেতু সরকারগুলোর কোন মাথাব্যাথা নেই এবং আমাদের মত দেশে সস্তা, বিপন্ন, অসংগঠিত, অনিশ্চিত (Precariat)  শ্রমিকেরও কোন অভাব নেই। বরং অভাব যেটার আছে সেটা হল এই সংগঠিত শোষণের বিরুদ্ধে অসংখ্য শ্রমিককে সংগঠিত করার মত শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকার – বা ছোট্ট কথায় ট্রেড ইউনিয়নের সক্রিয়তার। অথচ বাস্তব হল যে এই পেশাগত রোগ আর শিল্প এলাকার পরিবেশদূষণকে ঘিরে যত মানুষের জীবন আবর্তিত হয় তার চেয়ে বেশী বোধহয় আর কিছুতেই হয় না কারণ পাথরশিল্প ছাড়াও নির্মাণশিল্প, ইটভাঁটা, পরিবহণ শিল্প সবই এর আওতায় পড়ে। এটাও খেয়াল রাখার যে গত কয়েক বছরে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার পঞ্চাশের বেশী সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের মৃত্যু হওয়া কারণে এবং তাদের একটা লাগাতার আন্দোলন চালানোর কারণে সবার এদিকে নজর ঘুরলেও শ্রমিক শুধু এই এলাকা থেকেই যাননি বা যাচ্ছেন না, সারা রাজ্য থেকেই এমন অগুন্তি মানুষের এই সমস্ত কারখানাগুলোতে যাতায়াত ও আক্রান্ত হওয়া জারী থেকেছে। ফলে যেকোন সচেতন ও সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার কথা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে এমনটা হওয়ার বদলে সারা দেশ জুড়েই বিষয়টির প্রায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন নানা অসরকারি সংগঠন (NGO), যারা সমস্যার মূলে আঘাত করার বদলে আক্রান্ত মানুষের কিছুটা সুরাহার দিকেই নজর দিয়েছেন‌। ফলে মালিক বা সরকার অনেক সমস্যা এড়িয়ে যেতে পারছেন এবং সেই কারণেই তারা স্বাভাবিকভাবেই ট্রেড ইউনিয়নের বদলে NGO-দের পছন্দ করছেন।  
 
মজার ব্যাপার হল যে শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষই নয়, এই ঘটনা এক আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিহাস বলে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যে উত্তুঙ্গ জায়গায় পৌঁছনোর সম্ভাবনা দেখাচ্ছিল সত্তরের দশক থেকেই তার এক অবনমন শুরু হয়। বিশ্বায়িত পুঁজির পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রমিক ও শোষণের এক বিকেন্দ্রিকরণ শুরু হয়, সংগঠিত ফ্যাক্টরি উৎপাদনের বাইরে সে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, বিপুল উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে সে পরিকল্পিতভাবেই নানা শর্তে কাজে লাগাতে শুরু করে সমস্ত রকম শ্রম আইনের আওতার বাইরে গিয়ে। যার ফলে বিপুল অসংগঠিত শ্রমশক্তির বিস্তার ঘটে। ILO-র রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা ২০০ কোটি যেটা মোট শ্রমশক্তির ৬১%, আর ভারতের মত দেশে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯২%। ফলে সংগঠিত ক্ষেত্রের প্রথাগত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ক্রমশই ছন্নছাড়া হয়ে উঠতে থেকেছে এবং ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়েছে। এবং ড্যান গ্যালিনের কথা অনুযায়ী এই ‘ধুঁকতে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের অবৈধ সন্তান হিসেবেই জন্ম নিয়েছে ‘NGO movement’। মার্ক্স এককালে আক্ষেপ করেছিলেন যে শ্রমিক শ্রেণী “are fighting with effects, but not with the causes of those effects…they are applying palliatives, not curing the malady”, কিন্তু উপরোক্ত বদলের ফলে এমনকি সেইটুকুও শ্রমিক শ্রেণীর হাতছাড়া হতে বসেছে আর পৃথিবীজোড়া বিস্তার হয়েছে NGOization-এর। Down to Earth পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১৫ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে CBI-এর হিসেব অনুযায়ী ভারতবর্ষে ৩১ লক্ষ NGO কাজ করে, যা এদেশের যত বিদ্যালয় আছে তার দ্বিগুণ, যত হাসপাতাল আছে তার ২৫০ গুণ। এও দেখানো হয় যে যখন দেশের প্রতি ৪০০ মানুষ পিছু একটি করে NGO আছে, সেখানে পুলিশকর্মী আছেন প্রতি ৭০৯ জন পিছু ১ জন। ২০০৬ সালে পিটার হল-জোন্স বলছেন যে NGO economy হয়ে উঠেছে দুনিয়ার অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়োগ করে। ২০০৩ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্টে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে NGO-রা ক্রমশই বিরোধীতার বদলে চালু বন্দোবস্তের সহযোগী হয়ে উঠছে। অর্থাৎ অসংগঠিত শ্রমশক্তির বিকাশের সাথে সাথেই ‘NGO movement’-এর উত্থান হয়েছে এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী।  
 
এই প্রসঙ্গে যে কথাটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল যে বাংলার সিলিকোসিস আন্দোলনে প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটে অনেকগুলি ট্রেড ইউনিয়ন একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই চালিয়েছে সিলিকোসিস আক্রান্তদের অধিকারের সপক্ষে যা বাংলায় এই আন্দোলনকে একটি আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রায় ৯-১০টি শ্রমিক সংগঠন মিলে ও আরো বেশ কিছু গণসংগঠন মিলে গঠিত হয়েছে পেশাগত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি কোঅর্ডিনেশন কমিটি যারা গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছেন। এবং এর ফলেই এরাজ্যে সিলিকোসিস বা পেশাগত রোগ একটি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে পরিগণিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংগঠন ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’ ও সমগ্র কোঅর্ডিনেশন কমিটির ধারাবাহিক চেষ্টার ফলে ভারতবর্ষের মাত্র তৃতীয় রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ঘোষণা করেছে ‘সিলিকোসিস ত্রাণ, চিকিৎসা, ও পুনর্বাসন প্রকল্প’, যাকে এই লড়াইয়ের একটি প্রাথমিক বিজয় হিসেবে দেখা যেতে পারে।
 
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই লড়াই এখানে শেষ নয়, বরং বর্তমান ফল থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্রয়োজন পরবর্তী ধাপের দিকে এগোনোর। যেমন ঘোষিত প্রকল্পটি খতিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে যে সিলিকোসিস প্রতিরোধের প্রসঙ্গে ঘোষিত প্রকল্পটি একেবারেই দুর্বল এবং মালিকপক্ষের প্রতি নরম, বিশেষ করে রাজস্থানের ঘোষিত প্রকল্পের তুলনায় । প্রকল্পের কোথাও মালিকপক্ষকে দায়িত্ব নেওয়ার কথা (Silicosis is a notified disease under the Mines Act (1952) and the Factories Act (1948)) বলা নেই, ক্ষতিকারক ইন্ড্রাস্টিগুলোকে আইনের আওতায় আনা, তাদের শ্রমিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে বাধ্য করার কথা, District Mineral Fund-এ এলাকার স্বার্থে আইনানুগভাবে শিল্প মালিকদের থেকে মুনাফার অংশ সংগ্রহ করার কথাও বলা নেই যদিও মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট স্পষ্টতঃই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন গত মার্চ, ২০২১ সালে। এবং আইনকে কোন মালিক অস্বীকার করলে তার ক্ষেত্রে কোনরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়নি। বরং অর্থহীনভাবে আক্রান্ত শ্রমিকদের সরাসরি মালিকদের থেকে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে যার অর্থ সরকার নিজেকে মালিককে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। আবার অন্যদিকে ট্রেড ইউনিয়ন বা আক্রান্ত শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের বদলে নজরদারি কমিটিতে NGO সদস্যদের রাখার কথা বলা হয়েছে। ফলতঃ এটা বোঝা কঠিন হয় না যে সরকার সিলিকোসিসের উৎসটিকে রোখার রাস্তায় যেতেই চায় না, যা প্রকল্পটির আসল উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ করে দেয়। এর ওপরে যখন দেখা যায় যে পাথরশিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা বীরভুমের সাম্প্রতিক রিপোর্টে সরকার জানাচ্ছে যে এই জেলার সবক’টি (১৮২টি) খাদানই নাকি বন্ধ অথচ অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক জেলা থেকে পাথর বার করে নিয়ে যাচ্ছে, আবার মাত্র ছয় মাস আগে প্রকাশিত জেলার পরিবেশ রিপোর্টে জানানো হচ্ছে যে পাথরশিল্পের দূষণ নিয়ে সবে নাকি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হবে, এবং ২০২০ সালের ৪ মার্চ লোকসভার একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০১৬ থেকে শুরু করে ২০১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত বীরভূম জেলা থেকে মাত্র ২.৫৭ কোটি টাকা District Mineral Fund-এ সংগৃহীত হয়েছে ও তার মধ্যে মাত্র ২১ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, তখন সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় নিশ্চয়। কাজেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষতঃ সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের সামনে এই বিষয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার লম্বা রাস্তা পড়ে রয়েছে এবং ঘোষিত প্রকল্পটি হাতে নিয়ে সবাইকে এই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

(আজকের দেশব্রতী পত্রিকার সৌজন্যে প্রকাশিত।)