বিজনেস সামিট ও পশ্চিমবঙ্গে আদানির পদধ্বনি

২০১৫ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বঙ্গ বিশ্ব বাণিজ্য শীর্ষ  সম্মেলন (বেঙ্গল গ্লোবাল বিজিনেস সামিট বা বিজিবিএস) শুরু করেছেন। ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত টানা ৫ টি বিজিবিএস-এর পরে মাঝে কোভিডের জন্য দু’বছর স্থগিত থাকার পরে গত এপ্রিলের ২০-২১ তারিখে ষষ্ঠটি অনুষ্ঠিত হল নিউ টাউনে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের কিছু আগে পঞ্চম বিজিবিএসে-এ মুখ্য আকর্ষণ ছিলেন মুকেশ আম্বানি, আর এবার ষষ্ঠটিতে শিরোমণি হিসেবে উপস্থিত হলেন গৌতম আদানি। ভারতে শাসক দল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরা সাধারণত বিজেপির দোসর হিসেবে আম্বানি-আদানির নাম একসাথেই উচ্চারণ করে থাকে। যদিও মমতা ব্যানার্জীর মুখে সাধারণত তাদের বিজেপির সঙ্গে একসাথে জড়িয়ে বিরোধিতা দেখা যায় না। তবুও পরপর দু-দুটি বিজিবিএস-কে ‘মহিমামণ্ডিত’ করলেন ভারতের দোসর পুঁজির দুই মালিক। ২০১৯-এর সম্মেলনে মুকেশ আম্বানি পশ্চিমবঙ্গে ১০,০০০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এবছরের সম্মেলনে গৌতম আদানি সম পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবেন বলে কথা দিয়েছেন। তবে কথাই তো আছে, ‘কেউ কথা রাখেনি’। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছেন যে ২০১৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সম্মেলনগুলিতে  প্রতিশ্রুত সাড়ে নয় লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রকল্পের ৫০%এর বেশি কার্যকরী হয়ে গেছে ও ২০১৯ সালের প্রতিশ্রুত ২৮৪ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কার্যকরী হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও শিল্প সহায়তাকারী দফতরের কাগজপত্র অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে  ৩৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে যার মধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকা কার্যকরী হয়েছে। গত দু বছরের অতিমারির মধ্যে তা বেড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ  প্রায় ৩৫ গুণ হওযার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ফলে ২০১৯ সালে আম্বানির দেওয়া কথার ১০ হাজার কোটির বিনিয়োগ কোথায় গেল জাতে ইচ্ছে করে।

যাক গিয়ে সেসব পুরোনো কথা (যদিও পুরানো সে দিনের কথা ভোলা কি আর যায়), এবারের বিজিবিএস-এর মুখ্য শিল্পপতি আদানির কথায় আসা যাক। উনি দুটি কথা বলেছেন। প্রথমে বিজিবিএস-এ বলেছেন, তাঁর কোম্পানিগুলি আগামী দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ও তাতে ২৫ হাজার মানুষের কাজ জুটবে। দ্বিতীয়টি তিনি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজিবিএস শেষ হওযার একদিন বাদে ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক কনক্লেভে। সেখানে বলেছেন ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে কোনো অভুক্ত থাকবে না ও দেশের জিডিপি ৩০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। ভারতের তথা এশিযার এক নম্বর সম্পদশালী ব্যক্তি যা বলেছেন তাকে অমান্য করে কার সাধ্যি। তেমনটা হলে চাই কি তিনি গুজরাটের আদালতে মানহানির মামলা করে দেবেন। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে ১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (ভারতীয় টাকায় ৯.৫ লক্ষ কোটি) মালিকের মান একটুও হানি হলে তার খেসারত তো কয়েক হাজার কোটি টাকা হবেই। অতিমারির সময়কালে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আদানির সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার (৩ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা)। ওই সময়কালে ভারতের জিডিপি একই স্তরে রয়ে গেছে। ভারতে দারিদ্রও বেড়েছে, ২০ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে কাকে বলে কারুর পৌষমাস কারুর সর্বনাশ। এও বোঝা যাচ্ছে আত্মনির্ভর ভারত তথা রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র বেসরকারিকরণের লাভের গুড় কারা খাচ্ছে, কারা দোসর মোদিজির।

পুঁজির মালিকদের এদেশে অতিধনী হওয়ার মধ্যে একটা প্যাটার্ন দেখা যায়। তাঁরা প্রথমে বিভিন্ন অনীতিনিষ্ঠ উপায়ে কিছুটা ধনবান হন, তার পরে সেই ধন ব্যবহার করে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা কোনো রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক নীতি, বাণিজ্য নীতি বিষয়ে আগাম জানতে পারেন, যাকে ব্যবসায়ীর ভাষায় বলে ‘ইনসাইডার স্টোরি’, এবং সেই অনুযায়ী ফাটকা লেনদেন করেন, বা অর্থ লগ্নি করেন। ধীরুভাই আম্বানির উত্থান নিয়ে ‘পলিয়েস্টার প্রিন্স’ বলে একটি পুস্তক ও আছে। একবার অতিধনীর কাতারে দাঁড়িয়ে পড়লে ওই পূর্বের দুর্নীতি কারচুপি করা শিল্পপতি দেশপ্রেমিক হয়ে পড়েন। দেশই প্রথম গোছের শ্লোগান জামার বুকে লাগিয়ে নেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তো একদম ঝকঝকে বিদ্বান, বুদ্ধিমান উদ্যোগী শিল্পপতি হয়ে ওঠেন, সরকারগুলিও তাঁদের কাছে নতজানু হয়ে পড়েন প্রকাশ্যে। রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পগুলিকে বেঁচে দেওয়া হয় জলের দরে। সাম্প্রতিক টাটার কাছে এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি, দুই দশক আগে অনিল আগরওয়ালের বেদান্তের কাছে ভারত এ্যালুমিনিয়াম, ইন্ডিয়া জিঙ্ক, বাইলাডিলা মাইনস বিক্রি এসবই সেই দোসর পুঁজির নিদর্শন।

গৌতম আদানির সঙ্গে সরকারগুলির খাতির ও বন্ধুত্ব কেমন সেটা একটু খুঁজে দেখা যেতে পারে। মানে কোন সুবাদের কলেজ ড্রপ আউট একজন ছোট ব্যবসায়ী দেশ জুড়ে, এমনকি দেশের বাইরেও কয়লা খনি কিনতে পারে ? দেশের বড় বড় বিমান বন্দর কব্জা করতে পারে ? ১০-১২ টা সমুদ্র বন্দরকে নিজের মালিকানায় আনতে পারে ? একদিকে কয়লা খনি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক হয়েও অপরদিকে পরিবেশ বান্ধব শক্তি ক্ষেত্রে বিপুল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ? সর্বোপরি দেশ ও জাতির অন্যতম নায়কের মতো দেশের দারিদ্র ও ক্ষুধা দূরীকরণের ভবিষ্যত এজেন্ডা মায় দেশকে ৩০ ট্রিলিয়ন জিডিপিতে পৌঁছানোর টার্গেট বছর নির্দিষ্ট করতে পারে ? কেবল কি গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন মোদীর হয়ে গুজরাটে শিল্প সম্মেলন সংগঠিত করা বা ২০১৪র নির্বাচনী প্রচারের নরেন্দ্র মোদীকে বিমানের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার মধ্য দিয়েই এই উত্থান না অন্য সরকারগুলির সঙ্গেও বোঝাপড়া রয়েছে, যেমন এরাজ্যে মমতা সরকারের সঙ্গে আপাতভাবে তা দেখা যাচ্ছে ? নাকি আদানির সঙ্গে সখ্যর মধ্য দিয়ে মমতা মোদির কাছে বার্তা পৌঁছতে চাইছেন ? - এসব জটিল ও গোপন কথা অবশ্যই ঝানু সাংবাদিকরা বিবেচনা করবেন। আমরা কেবল উত্থানের প্রক্রিয়াকে একটু খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করতে পারি।

 

আদানি গোষ্ঠির মোট কেনাবেচার পরিমাণ প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা, বাজারী মূলধন সাড়ে ষোলো লক্ষ কোটি টাকা, সামগ্রিক মুনাফার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে। মোট ঋণের পরিমাণ দেড় লক্ষ কোটি টাকার মত। এই ঋণের অনেকটা বিদেশ থেকে নেওয়া অনেকটা দেশের মধ্যেও, শেয়ার ও সমপত্তি বন্ধক দিয়ে ব্যাঙ্ক ঋণ। এগুলির অনেকটাই বৃত্তাকার ধরণে ঘুরছে, সম্পর্কিত কোম্পানিদের লেনদেনের মধ্য দিয়ে। বিষয়টি জটিল। একটু সহজ ভাবে বললে এমনটি। কোম্পানি ক কোম্পানি খ এর কিছু শেয়ারের মালিক তারা সেই শেয়ার বন্ধক দিয়ে ঋণ নিল। তারা আবর সেই টাকা দিয়ে কোম্পানি গ কে ঋণ দিল বা গএর শেয়ারে বিনিয়োগ করল।  যদিও কোম্পানি গ ও কোম্পানি ক একই ধরণের ব্যবসায়ে নেই। এবং কোম্পানি ক, খ ও গ সবকটিই একই গোষ্ঠি, এক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত। ‘দ্য স্ক্রোল’ এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছিল। ফলে বাজার থেকে অর্থ ও ঋণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠির স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিবিআই আদানি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজেশ আদানিকে ৮০ লক্স টাকার কর ফাঁকির জন্য গ্রেফতার করেছিল। ২০১৭ সালে ভারতীয় কাস্টমস অভিযোগ করে যে আদানি গোষ্ঠি কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য কর মুক্ত স্থানের আদানি পরিবারের দুবাইএর খোলস (শেল) কোম্পানিকে ব্যবহার করছে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ওইরূপ ২৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ১৮০০ কোটি টাকা সরানোর একটি খবর প্রস্তুত করে। ২০১৪ সালে ভারত সরকারের রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দুবাই হয়ে মরিসাসের একটি সংস্থায় অর্থ পাঠানোর একটি জটিল বন্দোবস্তকে খুঁজে বের করে।  ওই সংস্থাটির মালিক গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ শান্তিলাল আদানি।

কয়লা খনি ও বিদ্যুতে আদানি

ঝাড়খন্ডের রাঁচির থেকে ৩৮০ কিমি দূরত্বে মালি সমেত ১০টি গ্রামের ৫১৯ একর জমি আদানি পাওযারের হাতে তুলে দেয় ওখানকার তৎকালীন বিজেপি সরকার। গোড্ডায় ১৬০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ যাবে বাংলাদেশে। মোদিজি আদানির ব্যক্তিগত বিমানে চড়েই বাংলাদেশ যান, সঙ্গে নিয়ে যান শিল্পপতিদের প্রতিনিধি হিসেবে গৌতম আদানিকে। ওই সময়েই বাংলাদেশে বিদ্যুত সরবরাহের চুক্তি হয়। তার আগে আগস্ট মাসেই ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রীয় অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়। এরপরে ২০১৬ সালে জমি চায় আদানি, ২০০০ একর। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ঝাড়খন্ডের সরকার আদানির জন্য ৫১৯ একর আদিবাসীদের এবং তপশিলি সম্প্রদায়ের জমি অধিগ্রহন করে আদানিকে হস্তান্তর করে।

এরপর আদানি সংস্থা তাদের অবস্থান  বারে বারে পাল্টাতে থাকে। যেমন, কোম্পানি যখন পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিল, তখন তারা বলেছিল যে তারা এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহ করবে গোড্ডা-র সন্নিকটের চির নদী থেকে। পরে বলে যে তাদের অতিরিক্ত জল লাগবে,  সেই জল তারা নেবে সংলগ্ন জেলা সাহেবগঞ্জের গঙ্গা থেকে; তার জন্য অতিরিক্ত ৪৬০ একর জমি লাগবে। কয়লা আনার জন্য তাদের রেল লাইন পাততে ৭৫ একর জমি লাগবে, এবং এই কাজটি আদানির হয়ে ভারতীয় রেলকেই করে দিতে হবে।

২০১৭-এর মার্চ-এ ঝাড়খন্ড সরকার নোটিশ দিয়ে বলে যে আদানি-র এই প্রকল্প “জনস্বার্থ”-এ হচ্ছে, অতএব জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া পুনরায় চালু হবে। দেশের আইন অনুসারে রপ্তানির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে, যে রাজ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, সেই রাজ্যকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। ঝাড়খন্ড সরকার ও আদানি-র কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যেখানে ঝাড়খন্ড সরকার মেনে নেয় যে আদানি-র কোম্পানি “অন্য সূত্র” থেকে ঝাড়খড রাজ্যকে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ দেওয়ার চেষ্টা করবে। আদানি-র কাছ থেকে এই বিদ্যুৎ ঝাড়খন্ড সরকারকে বাজারের দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হবে; এই মর্মে রাজ্য সরকার তার আইন পরিবর্তিত করে নিয়েছে। এর ফলে আদানি-র কোম্পানির বছরে অতিরিক্ত ৭৪১০ কোটি টাকার বাড়তি মুনাফা হবে।

এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে “জনশুনানী”-র সময়ে পুলিশ আচমকা কাঁদুনে গ্যাস ফাটিয়ে সবাইকে হটিয়ে দেয় এবং ঘোষণা করে যে গণশুনানি শেষ, গ্রামবাসীরা “স্বেচ্ছা”-য় এই প্রকল্পে সায় দিয়েছে। এই মিটিং-এর  নোটিশে বলা হয়েছিল যে গ্রামবাসীরা যেন এই মিটিং-এ উপস্থিত থেকে এই প্রকল্পে সায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও স্থানীয় গ্রামসভা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এই প্রকল্পের বিরোধী, কেননা এখানে আদিবাসীরা তাদের বাসস্থান ও জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে।এই “গণশুনানী”-র পর গোড্ডা জেলার কালেক্টার ঘোষণা করেন যে এই প্রকল্পে একজনও উচ্ছেদ হচ্ছেন না। ২০২০-র কোভিডকালে এসে দেখা যায় যে আদানি গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, তারা ঐ জমি এবং জলের অধিকার অন্যভাবে ব্যবহার করতে চায়, যাকে এমনকি ঝাড়খন্ড সরকারের পক্ষেও “জনস্বার্থ” বলে ঘোষণা করা মুশকিল।

অস্ট্রেলিয়ার কয়লার সমস্যার কথা বলে আদানি গোষ্ঠী মোদী সরকারের কাছ থেকে অন্যায্য উপায়ে নতুন “কোল ব্লক” গুলির বেশ কয়েকটা এখনই হাতিয়ে নিয়েছে। মোদি সরকার কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিকে চাপ দিয়ে আদানি গোষ্ঠীকে বিপুল পরিমাণ ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেই ঋণ এখন ক্রমাগত খেলাপি হয়ে চলেছে, অচিরেই হয়তো সেই ঋণ মুকুব করা হবে। যে চৈনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে আদানি গোষ্ঠী এই কেন্দ্রের পরিকল্পনা করেছিল, সেই প্রযুক্তি দূষণের দায়ে এখন সারা পৃথিবীতে প্রত্যাখ্যাত।

দেউচা-পাচামিতে খোলা মুখ কয়লা খনির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠেপড়ে লেগেছেন। মনে হয়, আদানিও সেটিকে পাখির চোখ করেছেন। তবে ছত্তিশগড়ে অনুরূপ কয়লাখনি যা বিগত বিজেপি সরকার ২০১১ সালে  আদানিদের দিয়েছিল তার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। অরণ্যের একেবারে ধার ঘেঁষে বেসরকারি দুটি খোলামুখ খনির কাজ শুরু হয়। এর ফলে প্রতিবেশের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ অরণ্য একেবারে ধংস হয়ে যায়, জলের উৎসের বারোটা বাজে, ধোঁয়া, ধুলো তাপ এবং শব্দ দূষণে পুরো অঞ্চলটির অপূরণীয় ও অপ্রত্যাহারযোগ্য ক্ষতি হয়। হাতিদের বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা অনেক আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং মানুষের সঙ্গে তাদের অনভিপ্রেত সংঘাত বাধে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে হাজার হাজার বৃক্ষ-নিধন, যারা অনেকেই প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন।

 

নবীকরণযোগ্য শক্তিতে আদানি

 

সারা বিশ্বের মানুষের কাছ থেকে ধিক্কার শুনে এবং দোসর-পুঁজিকে নতুন ক্ষেত্রে স্থান করে দেওয়ার জন্য মোদি সরকার ঘোষণা করে যে ভারতের শক্তি উৎপাদনে এখন থেকে নবীকরণযোগ্য শক্তির ভাগ বাড়াবে। ২০২০-র অগস্ট মাসে মধ্য প্রদেশের রেওয়া-তে মোদি সরকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ সৌরশক্তি উত্পাদন কেন্দ্রের উদ্বোধন করে। এই কেন্দ্রের একটি বড়ো শেয়ার মধ্য প্রদেশের সরকারি শক্তি বণ্টন কর্পোরেশনের মাধ্যমে আদানির সংস্থা কব্জা করেছে। এই প্রকল্প রূপায়নের যাবতীয় ঝক্কি পোহাবে মধ্যপ্রদেশ সরকার, আর লাভে ভাগ বসাবে আদানি।

বিমানবন্দরে আদানি

ভারতে বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ ঘটেছে একটিমাত্র সংস্থার হাত ধরে, তথাকথিত “প্রতিযোগিতা”-র তত্ত্বকে চুলোর দোরে পাঠিয়ে। এযাবৎ বেসরকারিকৃত সব কটি বিমানবন্দর পরিচালনা বা দীর্ঘকালীন লীজ পেয়ে বসে আছেন শ্রী গৌতম আদানি মহাশয়, মোদি সরকারের পরম দাক্ষিণ্যে। এই সব আধুনিক পরিষেবা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালাতে হলে যে অভিজ্ঞতা এবং সেই বিশেষ ক্ষেত্রে যে দক্ষতা প্রয়োজন আদানি সংস্থার তা নেই এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি সংস্থার তা রয়েছে। আদানিকে এই অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার জন্য দেশের মধ্যে একচেটিয়া বাণিজ্যে লাগাম পরানোর লক্ষ্যে যে কটি আইনের অস্তিত্ব রয়েছে, সেগুলিকে পদদলিত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের এয়ারপোর্ট অথরিটি জানায় বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের জন্য যে নিলাম হয়েছিল, সেই নিলামে গৌতম আদানি পরিচালিত শিল্প গোষ্ঠী আমেদাবাদ, জয়পুর, থিরুভানন্তপুরম, লক্ষ্ণৌ এবং ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরগুলির “উন্নতি এবং পরিচালনা করার” অধিকার পেয়েছে। ঘোষণার পরের দিন, গুয়াহাটি বিমানবন্দরের জন্য সেই একই কাজ করার অধিকার দেওয়া হয় আদানি গোষ্ঠীকে। ওই বদান্যতার সময়ে সব রীতি নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে, ভারত সরকারের ডিপার্টমেনট অফ ইকোনোমিক এ্যাফেয়ার্স ও নিতি আয়োগের পরামর্শ ও বিরূপ সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এর পরেও ব্যাঙ্গালোর বিমান বন্দরের সরকারি শেয়ার আদানির হাতে যেতে চলেছে। অবশ্য কেরালা সরকার তিরুবন্তপুরম বিমান বন্দরের ক্ষেত্রে আপত্তি তুলে আদালতে গিয়েছে।

রেলওয়েতে আদানি

রাজ্যসভার এক প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে যে প্রথম ১২ জোড়া বেসরকারি ট্রেন নিয়মিত ভাবে চলা শুরু হবে এপ্রিল ২০২৩ থেকে। এরপর প্রতি অর্থবর্ষে কিছু কিছু করে নতুন বেসরকারি ট্রেন নিয়মিতভাবে চলতে শুরু করবে। ২০২৭ সালের মধ্যে ১৫১ জোড়া বেসরকারি ট্রেন চলবে। রাজ্যসভায় সরকার জানিয়েছে যে টেন্ডারের ভিত্তিতে যে যে বেসরকারি সংস্থা বরাত পেতে চলেছে তাদের তালিকা এই রকমঃ আদানি পোর্টস, এসেল গ্রুপস, টাটা রিয়েল্টি অ্যান্ড ইনফ্রাস্টাকচার, বম্বাডিয়ের এবং অ্যালস্টম।

গুজরাটে মোদি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর বদান্যতায় আদানি গোষ্ঠী ভারতীয় রেলের সহায়তায় ৩০০ কিমি ব্যাপী এক বেসরকারি রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা তার সমুদ্র বন্দর থেকে বিভিন্ন স্থানে মাল পাঠানর কাজে লাগে। রেল চালানো ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আদানির অভিজ্ঞতার পুঁজি কেবল এইটুকুই!

রাস্তায় আদানি

মোদি সরকারের একটি “প্রিয় প্রকল্প”-এর নাম “ভারতমাতা প্রকল্প”। এই প্রকল্পে জাতীয় সড়ক সংস্থাকে দু বছরের মধ্যে ৩৪,৮০০ কিমি জাতীয় সড়ক নির্মাণ করতে হবে। এই নির্মাণ কার্য চলবে “প্রাইভেট-পাবলিক-পার্টনারশিপ বা পিপিপি” মারফৎ। এই প্রকল্পের জন্য নিলামে অন্যতম দাবিদার আদানি গোষ্ঠী। এই প্রকল্পে ৬ লেন-এর রাস্তা বানানো হবে, যার দুটি অংশ পড়েছে আমাদের রাজ্যে। একটি অংশ পানাগড় থেকে পালশিট (৬৭.৭৫ কিমি দৈর্ঘের) এবং অন্যটি পালসিট থেকে ডানকুনি ( ৬৩.৮৩ কিমি দৈর্ঘের)। দুটি অংশই পড়েছে জাতীয় সড়ক ১৯-এ। যদিও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ তাদের পিপিপির অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে ভারত সরকারকে জানিয়েছে যে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের নিজেদের বানানো এবং নিজেদের চালানো টোল-এ লাভ অনেক বেশি, কিন্তু সরকার তাদের নির্দেশ দিয়েছে যে ভারতমাতা প্রকল্পটি কেবলমাত্র পিপিপি মডেল-এই চালাতে হবে! অতএব, যা ভাবছেন ঠিক তাই ঘটলো। এই দুটি প্রকল্প আদানি গোষ্ঠী ২ এপ্রিল, ২০২১, ঘোর অতিমারি কালে কব্জা করলো, যদিও জাতীয় সড়ক প্রকল্পের আধিকারিকরা হিসেব কষে ভারত সরকারকে জানিয়েছিলেন যে এই দুই রাস্তা তাঁরা বানিয়ে নিজেরাই রক্ষণাবেক্ষণ ও টোলের ব্যবস্থা করলে তা পিপিপি-র চেয়ে ঢের লাভজনক হবে। আদানি গোষ্ঠী যথারীতি এটি “বিন্ড-অপারেট-ট্রান্সফার”, এই ভাবে চালাবে আগামী কুড়ি বছর। এই প্রকল্পের খরচ ২০২০.৯৩ কোটি টাকা। টোলের মূল্য আদানি সংস্থা একতরফা ভাবে ঠিক করবে।

বন্দরে আদানি

২০০৯ সালে  ইউপিএ-২ সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে গুজরাটের আদানি গোষ্ঠী গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলে, আরব সাগরের গায়ে মুন্দ্রা বন্দর ও বিশেষ আর্থিক অঞ্চল গড়ার বরাত পায়। এই বেসরকারি বন্দর গড়ার জন্য মোদি নেতৃত্বাধীন গুজরাট সরকার আদানি গোষ্ঠীকে “রাইট-টু-ইউজ” ভিত্তিতে “সেজ” ও বন্দরের জন্য ১০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল ( প্রায় ২০০৮ হেক্টর) বরাদ্দ করে। এই পুরো জমিটি আসে সংরক্ষিত অরণ্য ধ্বংস করে। সরকারি বদান্যতায় আদানি গোষ্ঠী জলের দরে বিশাল পরিমাণ জমি পেয়ে যায়, আদানির জন্য দাম পড়ে প্রতি বর্গ মিটারে ১০ টাকার মতো। ওদিকে মুন্দ্রা অঞ্চলে, আশপাশের জমি সরকার বেচেছে বর্গ মিটার পিছু ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এই প্রকল্পে চাষীদের মালিকানায় থাকা যেসব জমি এই “সেজ”-এর অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, গুজরাট সরকার ব্রিটিশ আমলের ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন মোতাবেক অধিগ্রহণ করে আদানি গোষ্ঠীকে দিয়ে দেয়। এই আইনে চাষীদের জমির ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যৎসামান্য।

মুন্দ্রা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে গুজরাট সরাকারের বদান্যতায় আদানির প্রবেশ ঘটে হাজিরা বন্দরে। সরকারের আওতায় থাকা বন্দরগুলি যখন সমস্ত নিয়মকানুন মানতে বাধ্য থাকে তখনই সেই সব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আদানির বন্দরগুলি অনেক লাভজনক হয়ে ওঠে। যেমন মুন্দ্রা ব্দরের কাছেই কান্দলা বন্দর ক্রমাগত রুগ্ন হচ্ছে। ওদিকে আদানি পোর্টস ও সেজ লিমিটেড তাদের থাবা বাড়িয়েই চলেছে দেশের ৫ টি রাজ্যে ৭ টি বন্দর তারা দখলে নিয়েছে, সাথে আছে ৪টি টার্মিনাল। এরাজ্যেও তাজপুরে যে বন্দরের কতা চলছে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের জন্য আদানির বিজিবিএস-এ আগমন ও ‘বদান্যতা’।দোসর-পুঁজিপতি আদানি আর ফ্যাসিস্ট মোদি রাজনীতির যুগলবন্দী জমে এ দেশে যে বেশ জমে উঠেছে, উপরের ঘটনাসমূ্হ তা প্রকট করেছে। এতদিন মোদির সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা বিনিময়ের পরে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে হাত মেলানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন মহান শিল্পপতি গৌতম আদানি। মুখ্যমন্ত্রীও আনন্দে উদ্বেল।

ঋণ স্বীকার: শুভাশীষ মুখার্জি; পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস ও দোসর-পুঁজি; www.sahomon.com ( আদানির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি বদান্যতার সমস্তটাই এই সূত্রে প্রাপ্ত)